Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হিতের সহিত || Suchandra Basu

হিতের সহিত || Suchandra Basu

হিতের সহিত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের সরল সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাহিত্য’ মানে ‘হিতের সহিত’। তার কথা বিবেচনায় আনলে দুটো দিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত ‘হিত’ আর দ্বিতীয়ত ‘সহিত’। ভাষাশাস্ত্র মানলে ‘হিত’ শব্দের অর্থ ‘ভাল’, ‘মঙ্গল’, ‘বেহতর’ নানাধারার উপাদান এতে প্রোথিত আছে। আর ‘সহিত’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘সাথে’ বা ‘সঙ্গে’। মানে হিতের সঙ্গে থাকা। মানে ব্যক্তির নৈর্ব্যক্তিক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ মূলত সাহিত্য বিচার করেছেন, ব্যক্তির সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার বোধ থেকে।কিন্তু ‘সাহিত্য’ শুধু ‘শুভ’র হবে এমন না, ‘অশুভ’ পাঠাতনে সাহিত্য হতে পারে! মাইকেল মধুসদন দত্ত ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’ রাবণ চরিত্রে ‘কুৎসিত সৌন্দর্যে’র রূপক দেখিয়েছেন। ‘হিত’ সাহিত্যের বেলায়ও তাই। শিল্পের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক শুধু হিতে নয়, বিপরীতেও সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় বটে। যেইভাবে দেখা বা লেখা হোক না কেন, সাহিত্য কিন্তু ‘উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ’ নয়। উদ্দেশ্য সামাজিক হলে সাহিত্য নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে। সাহিত্য বাস্তব-অবাস্তব দশার সাথে কল্পনার প্রকাশ ঘটায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শব্দ-নৈঃশব্দ, সংবেদনশীলতা, আকার-অনুভূতি, ভেদ-বিভেদ, নানামাত্রায় প্রকাশ ঘটতে পারে। ব্যক্তির মনোজগত সাহিত্যের নিয়ন্তা নয়। জগতের অপরাপর ভাববস্তু লেখকের চিন্তার মনোজগতকে প্রভাবিত করে। একটা জিনিস পরিষ্কার, লেখক একাই লেখেন কিন্তু ভাবজগত আর বস্তুগত প্রকৃতিতে ‘ব্যক্তি’ একা নন। ফলে ব্যক্তির মনোজগতের সৌন্দর্যবোধ একার নয়, সমষ্টির ভাবধারা হতে সৃষ্ট। আধুনিক দর্শনশাস্ত্র যাকে বলে ‘সামাজিক চেতনা’।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর শিল্প-সাহিত্য দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একমাথায় ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ বা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’। আর অন্যমাথায় ‘আর্ট ফর লাইফ সেক’ বা ‘মানুষের জন্য শিল্প’।
দুইধারাই মানুষের জন্য সৃষ্ট।
মানব চিন্তার কাঠামোগত পরিবর্তন, সংস্কৃতির ভাঙন, শ্রেণি বিরোধ, নিষ্পেষিতের অধিকার আর মানুষের গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে সাহিত্য জগতে লড়াই দীর্ঘতর।
‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব মূলত আঙ্গিকবাদী সাহিত্যের নব-প্রয়াস। অনেকে এটাকে ‘মানব বিবর্জিত তত্ত্ব’ বলেছেন।
তত্ত্বটি বেশ সুন্দর। তত্ত্বের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অতুলনীয়।
‘সৌন্দর্যবোধ’ রচনায় তিনি বলেছেন, ‘সৌন্দর্য নাকি প্রয়োজনের বাড়া’। সমাজ কাঠামোর দিকে তাকালে বস্তুগতভাবে ‘প্রয়োজন’ জিনিসটা আপেক্ষিক। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামোর দিক থেকে ‘প্রয়োজন’ জিনিসটা ‘মৌলিক অধিকারের’ পর্যায়। জগত-সংসারে রাষ্ট্র এত সরল নয়। ক্ষমতা কাঠামোয় তাতে নানা ভেদাভেদ জারি আছে। ভাবা যায়, যার প্রয়োজনটুকুই অধিকারে নাই, তার কাছে ‘প্রয়োজনের আধিকার’ অর্জন করাই তো সৌন্দর্য।
বস্তুত ব্যক্তির প্রয়োজনই যেখানে স্বপ্নলোকের অধিকারে, সেখানে ‘বাড়া’ বা ‘বাড়তি’ সৌন্দর্য ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন, সৌন্দর্য জিনিসটা ‘উপরি পাওনা’। পদটিতে বাংলা অর্থশাস্ত্রে দুটো ভাব লুকিয়ে আছে। কারণ ‘পরি’তে উপসর্গ যোগ করলে ‘উপরি’ হয়। অনেকটা ভেতর নয়, বাহির দেখার মত। রবীন্দ্রনাথের ‘উপরি পাওনা’ কথাটা ‘উপরি-কাঠামো’র মত শোনায়। তবে ‘পাওনা’ আর ‘কাঠামো’ জিনিসটা এক নয়। সৌন্দর্যকে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রয়োজনের বাড়া’ অর্থে ‘উপরি পাওনা’ বলেছেন। দুটো ভাবনা একই বাক্যের সারাৎসার।
যতই তর্ক-তত্ত্ব বিনিময়-বিতর্ক হোক না কেন, শিল্প-সাহিত্য তো মানুষের জন্য। মানুষকেই কেন্দ্র করে প্রাণ-প্রকৃতি, বস্তু-অবস্তু, আকার-নিরাকার, ভাব-অভাব, কল্পনা-শূন্যতা, আনন্দ-বেদনা সাহিত্য-শিল্পের ভেতর আর বাইরের কাঠামোয় থাকে। ফলে নানামুখি শিল্প-সাহিত্যের খণ্ড খণ্ড চিন্তা-চেতনা রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ভাষা সৃষ্টি করে। ভাষা যেমন ব্যক্তি মানুষকে চিন্তার মুক্তি দেয়, ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বোধের উন্মেষ ঘটিয়ে শিল্প-সাহিত্য মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে সাম্যের দিকে নিয়ে যায়।
আধুনিক পুঁজিবাদী যুগ অবক্ষয় আর বিচ্ছিন্নতার যুগ। মার্কস বলেছেন, ‘মানব সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস।’ শিল্পী-সাহিত্যিকদের বেলায় বলা যায়, ‘ব্যক্তি মানুষের মুক্তি হচ্ছে মানুষ হয়ে ওঠার লড়াই।’ দর্শন বলছে, ‘ব্যক্তি’ হচ্ছে মানুষের একক আর ‘মানুষ’ বহুবাচক ধারণা। মানুষ হচ্ছে মানবিক আর সামাজিক চিন্তার ধারক-বাহক। ফলে ব্যক্তির একক লড়াইটা সেখানে। আর মানুষের লড়াই হচ্ছে সমাজ-রাষ্ট্রে ‘সামাজিক মালিকানা’ প্রতিষ্ঠা করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress