বাউল সম্রাট
মহাত্মা ফকির লালন সাঁই এর জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তার সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসুত্র তার নিজের রচিত অসংখ্য গান। কিন্তু মহাত্মা ফকির লালনের কোন গানে তার জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য তিনি রেখে যাননি, তবে কয়েকটি গানে তিনি নিজেকে “লালন ফকির” হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকারী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত: কিছুই বলিতে পারে না।” তথাপি কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতিরেকেই একটি সূত্রে তাকে হিন্দু কায়স্থ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও মহাত্মা ফকির লালন হিন্দু না মুসলমান এই কৌতূহল ও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে জীবদ্দশায়।কিছু সুত্রে জানা যায় লালনের প্রিয়জনেরা তাকে ডাকত নালন নামে। নাল অর্থ উর্বর কৃষিজমি। লালনের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়।মহাত্মা ফকির লালনন মানবতাবাদ বিশ্বাসী ছিলেন।কিন্তু সকল ধর্মের লোকের সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিল।মুসলমানদের সাথে তার সুসম্পর্কের কারনে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করত।আবার বৈষ্ণবধর্মের মত পোষণ করতে দেখে হিন্দুরা তাকে বৈষ্ণব মনে করতো। প্রকৃতপক্ষে মহাত্মা ফকির লালন কোন জাতিভেদ মানতেন না। তবে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতার বিশ্বাস করতেন বলে কারও কারও কাছে জানা যায়। অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, তিনি একজন বাঙ্গালী যার জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর গ্রামে।তার জন্ম তারিখ অজানা।হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ নিবন্ধে কথিত আছে, মহাত্মা ফকির লালন যৌবনকালে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন সাথীরা তাকে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু মহাত্মা ফকির লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তদীয় স্ত্রী মতিজান তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর মহাত্মা ফকির লালন তার কাছে দীক্ষিত হন এবং ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস শুরু করেন।
এছাড়া কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেকের সঙ্গে মহাত্মা ফকির লালনের পরিচয় ছিল বলেও বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া যায়। ঠাকুরদের জমিদারিতেই ছিল তাঁর বসবাস এবং ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা ছিলেন তিনি। কিন্তু এই ঠাকুরদের সঙ্গে মহাত্মা ফকির লালনের একবার সংঘর্ষ ঘটে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এরই একটি সংখ্যায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্তে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে আসেন। এতে করে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঠাকুর-জমিদারেরা। তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে শিষ্যদের নিয়ে মহাত্মা ফকির লালন সশস্ত্রভাবে জমিদারের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করেন এবং লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যায়। এর পর থেকে কাঙাল হরিনাথকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করেছেন লালন। অর্থাৎ মহাত্মা ফকির লালন এবং তাঁর অনুসারীদের সেদিনের শ্রেণীবিভক্ত সমাজেও অবস্থান ছিল শোষণের বিরুদ্ধে আর নিপীড়িতের পক্ষে।
মহাত্মা ফকির লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। তার শিষ্যরা তাকে “সাঞ’’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি প্রতি শীতকালে একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) আয়োজন করতেন। যেখানে সহস্রাধিক শিষ্য ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হতেন এবং সেখানে সংগীত ও আলোচনা হত।চট্টগ্রাম, রঙপুর, যশোর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্য্যন্ত বাংলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক মহাত্মা ফকির লালনের শিষ্য ছিলেন; শোনা যায় তার শিষ্যের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের বেশি ছিল।এছাড়া মহাত্মা ফকির লালন সংসারী ছিলেন বলে জানা যায়। তার সামান্য কিছু জমি ও ঘরবাড়ি ছিল।
মহাত্মা ফকির লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরী করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ।মহাত্মা ফকির লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তাঁর বোটে বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন- যা ভারতীয় জাদুঘরের সংরক্ষিত আছে। যদিও অনেকের দাবী এই স্কেচটিতে মহাত্মা ফকির লালনের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি।
মৃত্যুঃ
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর মহাত্মা ফকির লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন।মৃত্যুরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের কে বলেনঃ “আমি চলিলাম’’ এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়।তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোন ধরনের ধর্মীয় রীতিই নীতিই পালন করা হয় নি।তারই উপদেশ অনুসারে তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তার সমাধি করা হয়। আজও সারা দেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মোশারফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাহার নামের আগে “মহাত্মা” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। উল্লেখ্য যে, গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তাকে ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যায়িত করা হয়।