Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কোরিয়ান কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা || Sankar Brahma

কোরিয়ান কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা || Sankar Brahma

কোরিয়ান কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

কোরিয়াকে ‘সন্ন্যাসীর দেশ’ বলা হয়ে থাকলেও, বর্তমানে কোরিয়ো কবিদের ভাষায় তাকে ‘কবিতার দেশ’ বলা হয়ে থাকে।
প্রথমদিকে ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে কোরিয়ো কবিদের বিকাশ ঘটলেও, প্রথম বা দ্বিতীয় এবং একাদশ চান্দ্রমাসে লন্ঠন ও ফসল কাটার উৎসবকে কেন্দ্র করে বিস্তার লাভ করেছে। কোরিয়ান ভাষার প্রাচীনতম কাব্যগ্রন্থটি কিউন ইয়ো (균여, 均 如) রচিত “দশটি ব্রত সমান্তভরের গান”, এটি কবির মৃত্যুর এক শতাব্দী পরেও ১০৭৫ অবধি ছিল। কোরিয়ার প্রিয় কাব্য রীতি সিজো প্রায়শই একাদশ শতাব্দীর সিওনবি বিদ্বানদের কাছে পাওয়া যায়, তবে এর শিকড়গুলিও পূর্বের রূপগুলির মতোই রয়েছে। সিজো ঘরানার আদি রূপে বেঁচে থাকা কবিতাটি চতুর্থ শতাব্দীর।
হায়াঙ্গা কবিতা বলতে বোঝায় বহিরাগত কোরিয়ান কবিতা যা হানজা ব্যবহার করে কোরিয়ান শব্দগুলি প্রতিলিপি করে (ইডু পদ্ধতির অনুরূপ, প্রতিলিপির হায়ঙ্গা স্টাইলকে বলা হয় (hyangch’al) এবং ইউনিফাইড সিলার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। এটি কবিতার প্রথম স্বতন্ত্র কোরিয়ান রূপগুলির মধ্যে একটি। গোরিও পিরিয়ডের সামগুক ইউসার ১৪ টি কবিতা রয়েছে যা আজ অবধি সংরক্ষণ করা হয়েছে।

হাইয়াঙ্গা বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক বিধি দ্বারা চিহ্নিত। কবিতাগুলি চার, আট বা দশ লাইনের সমন্বয়ে থাকতে পারে। দশ-লাইনের কবিতাগুলি সর্বাধিক বিকাশযুক্ত, যথাক্রমে চার, চার এবং দুটি লাইন সহ তিনটি বিভাগে কাঠামোযুক্ত। দশ লাইনের অনেকগুলি কবিতা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা রচিত হয়েছিল। শিলার পরিধি হাওয়ারং ‘এর বিকাশ ও সমৃদ্ধির’ ক্ষেত্রে এর ভূমিকা হায়াঙ্গা জেনার অনেক পণ্ডিতের আগ্রহের বিষয়।
গোরিও পিরিয়ড হানজার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। হাইয়াঙ্গা মূলত কোরিয়ান সাহিত্যের একটি রূপ এবং “গোরিও গান” হিসাবে অদৃশ্য হয়ে গেল (গোরিও গায়ো) আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ গোরিয়েও গানগুলি মৌখিকভাবে গাওয়া হয়েছিল এবং অনেকগুলি জোসিয়ন আমলে বেঁচে ছিল, যখন তাদের কয়েকটি হ্যাঙ্গুল ব্যবহার করে লেখা হয়েছিল। গোরিও গানের কাব্যিক রূপটি পরিচিত হিসাবে রয়েছে।

কোরিয়ো যুগের (৯১৮ – ১৩৯২ খ্রীষ্টাব্দ) এমন প্রায় ষাটটি কবিতা পাওয়া গেছে। কিছুটা দীর্ঘ বলে, এইসব কবিতাকে ‘ছাংগা’ বলা হতো। এইসব কবিতার রচয়িতারা সকলেই সাধারণ লোক, এমন কি কেউ কেউ জনপদ বঁধু ( কিসেয়াং)। কবিতাগুলির কাব্যিক উৎকর্ষ যথেষ্ট এবং প্রেমের উৎকৃষ্ট প্রকাশ।
সুতীব্র আবেগের বাধাহীন প্রকাশ সেইসব কবিতাগুলোয় সমুজ্জল অথচ তা কিন্তু অশালীন নয়।
গাসা শ্লোকের একটি রূপ, যদিও এর সামগ্রীতে নৈতিক উপদেশের মতো পৃথক অনুভূতির প্রকাশের চেয়ে আরও বেশি কিছু অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। গাসা শ্লোকের একটি সহজ রূপ, যার প্রতিটি তিন বা চারটি সিলেবলের দ্বিগুণ হয়। কেউ কেউ গাসাকে প্রবন্ধের রূপ বলে মনে করেন। গাসার সাধারণ থিমগুলি ছিল প্রকৃতি, ভদ্রলোকদের গুণাবলী বা পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে প্রেম। ফর্মটি প্রথম গোরিও আমলে আবির্ভূত হয়েছিল এবং জোসেওন রাজবংশের সময়ে এটি জনপ্রিয় ছিল।
এগুলি সাধারণত গাওয়া হত এবং ইয়াংবান মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর কবি জিয়ং চোলকে রূপটি নিখুঁত রূপকার বলে গণ্য করা হয়, যার মধ্যে সমান্তরাল রেখার সমন্বয়ে প্রতিটি বিভক্ত হয়ে যায়।

সিজো একটি (traditional) ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান ভাষাগত কাব্যিক রূপ যা উত্থাপিত হয়েছিল (Koryǒ) কোরিও সময়কাল, সময়কালে পুষ্পিত (Chosǒn) কোসন রাজবংশ, এবং এখনও লেখা হয়। সাধারণ থিমগুলি অন্তর্ভুক্ত করে তবে নিম্নলিখিতগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় , প্রকৃতি , অতীতের নস্টালজিয়া , প্রেমের আগ্রহ , (historical) ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি , নৈতিক নির্দেশন। বেশিরভাগই লিখেছেন তখনকার শিক্ষিত জনগণ এবং শিক্ষিতরা উপভোগ করেছেন (ইয়াংবান ক্লাস) তবে এর ব্যতিক্রমও ছিল। কিসেনগস নিম্নতম শ্রেণীর ছিল, তবুও তারা তৈরি করতে পারে এবং আবৃত্তি করতে পারে সিজো।

সিজো। ছোট তিন লাইনের কবিতা। জাপানে যেমন হাইকু, কোরিয়াতে তেমনি শিজো। সংক্ষিপ্ত, শাণিত। সহজ, কিন্তু ভারী সুন্দর।

অনেকে বলেন, কবিতার ফর্ম হিসেবে সিজো নাকি হাইকুর চেয়েও প্রাচীন। হাইকুর মত সিজোরও আছে কিছু বজ্র-আঁটুনি নিয়মকানুন। একেকটা লাইনে থাকবে মাত্র চোদ্দ থেকে ষোলটা সিলেবল, বাংলায় যাকে বলে ‘দল’। তাই শিজোয় শব্দব্যবহার হতে হয় খুব সংযত, পরিমিত।

হাইকুর সঙ্গে তুলনা করলে অবশ্য বোঝা যায়, সিজোর এই লাইনের দৈর্ঘ্যও নেহাৎ কম নয় , কারণ হাইকুতে সাধারণতঃ প্রথম লাইনে পাঁচ, দ্বিতীয় লাইনে সাত আর শেষ লাইনে পাঁচ, এইভাবে সিলেবল-এর বিন্যাস হয়। মোট সতেরো। হাইকু তাই আরও ছোট্ট। এখানে একফাঁকে মনে করে নেওয়া যেতে পারে মাৎসুয়ো বাশোর সেই বিখ্যাত হাইকুটিকে, ইংরেজি অনুবাদে যাকে লেখা হয় : “An ancient pond/ a frog jumps in/ the splash of water”,
রবীন্দ্রনাথ যার বাংলা অনুবাদ করেছিলেন
‘পুরোনো পুকুর/
ব্যাঙের লাফ/
জলের শব্দ’।
ভাষান্তরের সময়ে ওই মাত্রা-সিলেবল এর চুলচেরা হিসেব মানেননি তিনি। সেটা সম্ভবও নয় কারণ দুটো ভাষার গঠনরীতি পুরো আলাদা।

কোরিয়ান সিজো অমন সাতে-পাঁচের নিয়মে থাকে না, তার দৈর্ঘ্য আরেকটু লম্বা– তিন লাইন মিলিয়ে চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশ সিলেবল। সেই জন্য হাইকুতে যেমন একটা লাইন শুধু একটাই দৃশ্য দেখায়, শিজোর একেকটা লাইনে ধরে যায় দুটো টুকরো ছবি। লাইনের মাঝখানে ছোট্ট একটা বিরতি পড়ে, যার দুপাশে থাকে সে দুটো বাক্যাংশ।

গোলমেলে ঠেকছে কী?
একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপার টা বোঝানো সহজ হয়ে উঠবে। শুরু করা যাক তবে।

” দশটা বছর ব্যয় করে এই পর্ণকুটির তৈরি করা
আধখানা তার বাতাস থাকে, আধখানা তার চাঁদের বাড়ি
কোথায় তোমায় বসতে দেব? বরং তুমি বাইরে এসো।”

সং সুন নামে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের এক কোরিয়ান কবির লেখা । রাজদরবারে কাজ করতেন আগে, পরে সব ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যান, লেখালিখি নিয়েই জীবন কাটান। এই কবিতাটার পিটার লি-কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুুবাদ করা। এখানে যদি এক একটা লাইনকে দেখা যায় আলাদা করে, বোঝা যাবে প্রত্যেকটায় আসলে দুটো বাক্যাংশ আছে, দুটো ছবি।
প্রথম লাইনেই যেমন দুটো স্টেটমেন্ট, একটা বলছে দশ বছর পরিশ্রমের কথা, অন্যটা বলছে বাড়ির কথা। দ্বিতীয় লাইনে তো আধাআধি ভাগ হয়ে গেছে লাইনটাও, বাড়িটারই মত… যার অর্ধেকটায় থাকে বাতাস, আর বাকি অর্ধেকটায় চাঁদ। শেষ লাইনেও অমন দু ভাগ, প্রথম অংশটা বলছে,
বাড়িতে ঢুকতে / বসতে দেবার জায়গা নেই (যেহেতু বাতাস ও চাঁদ আগেই সবটা দখল করে রেখেছে), আর শেষ টুকরোটা জানাচ্ছে, বাড়ির বাইরেই বরং অতিথিকে গ্রহণ করা হবে।

ছোট্ট একটা ছিমছাম কবিতা। তিন লাইনের জাফরির ফাঁক দিয়ে আসা একটুকরো গল্পের আভাস। সিজো আসলে এরকমই।
সিজো-তে তিন লাইন মিলিয়ে মোট চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশটা সিলেবল থাকে। লাইন পিছু চোদ্দ থেকে ষোলটা।

ইংরেজি অনুবাদের সময়ে সচরাচর সিলেবল-এর হিসেব একদমই মানা হয় না, এমনকি লাইনের হিসেবও নয়। বাংলায় সেটা করা বরং তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ। অনুবাদ করার সময়ে ষোল মাত্রার স্বরবৃত্তের ছাঁচ রাখার চেষ্টা করা ভাল , যাতে সিলেবল – এর হিসেবটা বজায় থাকে মোটামুটি (মানে ছেচল্লিশ সিলেবলের উর্ধ্বসীমাটা আরেকটু বাড়িয়ে আটচল্লিশ বানানো যায় আর কি!) আর ছন্দটাও খানিক ফিরিয়ে আনা যায়। যদিও কোরিয়ান শিজোতে সিলেবল বিন্যাসের হিসেবটা আরও জটিল, সেগুলো কয়েকটা শব্দবন্ধে ভাগ হয়ে এরকম দেখায়

১ম লাইন – ৩ -৪ -৪ – ৪ (বা ৩)
২য় লাইন – ৩ -৪ -৪ – ৪ (বা ৩)
৩য় লাইন -৩-৫-৪-৩

এ তো গেল শিজোর শুষ্ক গঠনগত দিকটা – খাঁচার গড়ন, যন্ত্রপাতি আর কলকব্জা। তার ভেতরের কবিতাটা কেমন হবে? নিয়ম আছে তারও। প্রথম লাইনে বিষয়টার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে, দ্বিতীয় লাইনে সেটাকেই দেখানো হবে সবিস্তারে। তৃতীয় লাইনে এসে কিন্তু একটু পালটে যাবে বিষয়মুখ, আসবে একটা ছোট্ট টুইস্ট (কিম্বা, ক্ষেত্রবিশেষে একখানা বড় ক্লাইম্যাক্স) মোটমাট প্রথম দু লাইনের থেকে একটু বদলে যাবে স্বর।

যেমন আগে দেওয়া কবিতাটায় প্রথম লাইনে এসেছে বাড়িটার উল্লেখ। দ্বিতীয় লাইনে তারই বিস্তারিত বর্ণনা। শেষ লাইনে কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত নতুন সুর এসে গেছে, একজন অতিথির কথা, একজন ‘তুমি’, যাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া যাচ্ছে না। এটাই সিজোর বৈশিষ্ট্য। একটা ছোট্ট মোচড় শেষে, একটা আলতো বিষয়ান্তর।
ব্যস, সিজো মানে এই-ই।
শেষ লাইনে টুইস্টের কথা বললাম ঠিকই,
কিন্তু সিজো সেই অর্থে ওপরচালাক কবিতা নয় মোটেই। পাঠককে চমকে দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। সিজো আসলে খুব সরল, এবং গভীর। প্রাচ্যের দেশগুলোতে,
তা চিন হোক জাপান হোক আর কোরিয়াই হোক, কবিতার মূলসুরটা তো খুব সহজ তারে বাঁধা থাকে। হয়তো প্রকৃতির বর্ণনা, হয়তো কবির সুখ বা দুঃখের একটুকরো ছবি, এইটুকুই। শেষ লাইনে যেটা আসে সেটা ওই একই ছবিকেই হয়তো একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে নেওয়া হয়।

আর হ্যাঁ, সিজো কিন্তু গান হিসেবেও গাওয়া হত। সুর-টুর দিয়ে, বাঁশির সঙ্গে। অনেক সময়েই সেগুলো হত তাৎক্ষণিক, কোনও জলসায় বসে তখনই কথা বসিয়ে সুর দিয়ে গেয়ে ফেলা। সেকালে আমাদের দেশেও কবিয়ালরা যেমন করতেন। কাজেই কবিদের সিজো-নির্মাণের নিয়মকানুন, অক্ষর আর সিলেবল-এর বিন্যাস একদম ভালোভাবে রপ্ত থাকতে হত, যাতে যে চট করে কথা বসিয়ে ওই ফর্ম্যাটে যে কোনও বিষয়ের ওপর কবিতা কিম্বা গান বেঁধে ফেলা যায়।
প্রথম সিজোর জনকের মর্যাদা দেওয়া হয় ‘উ তাক’ নামের এক কবিকে। মোটামুটি তেরোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি, এই তাঁর জীবনকাল।

রুচিশীলতা, সরলতা, ঐতিহ্যপরায়ণতা, বাস্তব বোধ, প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির বিমূর্ত চিন্তাধারা
শুধু নয়, কবিদের তীব্র অনুভূতি প্রবণতা ও আন্তর অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ, এইসব কবিতাগুলিকে সমুজ্জল করে তুলেছে পাঠকের কাছে।
কবিদের জীবন-মুখিতা, জীবন পিপাসা, স্বতোৎসারিত সারল্য , অভিজ্ঞতার গুণগত উৎকর্ষতা , প্রকাশের সৎ সাহস শুধু কোরিয়ো কবিদের বৈশিষ্ট্য নয় , বরং সমগ্র কোরিয়ো জাতীর মানসিকতার দ্যোতক।
কোরিয়ো কবিরা স্বদেশের সংস্কৃতির ধারক বাহক হলেও, চীনের কবিতার বিপুল ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সেটাকে যথাযথ রূপে আত্বস্থ করে গ্রহণ করেছিলেন।
কোরয়ো যুগের উচ্চমানের কাব্যিক ঐতিহ্যধারা পরবর্তী ‘য়ি-যুগ’-এ আরও প্রবাহমান হয়ে ওঠে , বিশেষতঃ ‘হ্বোয়াং-চিন-ই’ – এর কবিতায়। সংদো-র এই বিখ্যাত কিসায়েং (জাপানী ভাষায় গেইসা) কোরিয়ার সর্বকালের
শ্রেষ্ট কবি।
হ্বোয়াং-চিন-ই-র কবিতায় নাটকীয়তা , প্রকৃতি-মুখিতা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা , সারল্য , বিশেষতঃ দ্ব্যর্থবোধকতা , এবং সেই সঙ্গে অনুভূতির তীব্রতা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার কবিতার সংকেত-ধর্মিতা , যথার্থ শব্দ প্রয়োগের পটুত্ব , বিষয় বস্তুর সাবলীল ক্রমবিকাশ কোরিয়ো সাহিত্যে তাঁকে প্রথম সারীর কবি হিসাবে গণ্য করেছে।


হ্বোয়াং-চিন-ই(১৫০৬-১৫৪৪).
—————————————–
স্রোতস্বিনী
—————-
পাহাড়ের কোল ঘেষে ছোটা
সবুজ নীলাভ নদী তুমি
কোরো না গর্ব স্রোতের বেগের,
একবার সমুদ্রে পৌঁছালে
ফিরে কি আর আসবে তুমি?
তার চেয়ে বরং এখন যখন
জ্যোৎস্নার প্লাবন ভরে তোলে পাহাড়গুলিকে,
এখানে একটু থেমে বিশ্রাম নিলে ক্ষতি কি বলো?


‘য়ি-যুগ’-এর আর একজন বিখ্যাত কবি চোং-চোল। তার কবিতায় অতীত জীবনের ব্যর্থতা,অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিতৃষ্ণা,সৌন্দর্য পিপাসা,প্রেম ও বিরহ বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে।


চোং-চোল(১৫৩৭-১৫৯৪).
————————————
একাকী
———–
ফুলেরগুচ্ছ কী অপূর্ব মনোরম
প্রজাপতিগুলি মিথুনাবদ্ধ ওড়ে,
প্রাণ প্রাচুর্যে সজীব গাছেরা দূরে
ডাকছে কোকিল কোকিলাকে করুণ সুরে।
পাখি ও পশুরা কত আনন্দে ভালবেসে
একত্রে থেকে এখানে সেখানে ঘোরে,
তবে আমি কেন বন্দীর মতো
একা পড়ে থাকি নিজ ঘরে?


তবে এ যুগের সর্বশ্রেষ্ট কবি হিসাবে যার নাম সবার মুখে মুখে, তিনি হলেন ‘য়ুন-সোন-দো’।ছোট বড় নানান কবিতার মধ্যে তার মূল সুর- পল্রী প্রীতি,প্রকৃতি প্রেম, সঙ্গীত পিপাসা, সদা সতর্কতা অথচ বিশ্রাম প্রিয়তা তার কবিতায় বারবার ধ্বনিত হয়েছে।


য়ুন-সোন-দো(১৫৮৭-১৬৭১).
—————————————–
নরম কাঠের জানলা দরজা বন্ধ রাখি
হিমেল বাতাস আসে ছুটে,
বাতিটা নেভাও রাত্রিও গভীর হলো বটে
এসো নীরবে বালিশে মাথা রাখি,
ঘুমিয়ে কাটাই নিশি রাতি।
সূর্য এসে আলোয় আকাশ না ভরে দিলে
তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না প্রিয় সাথী।


তাছাড়া এ যুগের অন্যান্য কবিদের মধ্যে রয়েছেন, সোঙ- সুন, কোন-হো-মুম, ইম-চে, কিম-হ্বোয়াং-উক, য়ি-ম্যোঙ-হান প্রমুখও।
এছাড়া অজ্ঞতনামা কবিদের কিছু লেখাও পাওয়া গেছে,যাদের লেখার ভাবঘনত্ব এবং বিষয়-বৈচিত্র মুগ্ধ করে। ‘য়ি-যুগ’-এর সমাপ্তি কাল ১৯১০ সালে।
এর পর থেকেই কোরিয়ো কবিতায় আধুনিক যুগের শুরু হয়। এ যুগের কবিরা জাতীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার না করে, পাশ্চাত্য ভাবধারাকে গ্রহণ করে নতুন সৃষ্টির প্রায়াসী হয়েছেন।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রাথমিকভাবে আমেরিকার আধুনিক কবিরা, যেমন এজরা পাউন্ড এবং টি এস এলিয়টের অনুবাদগুলিতে ইমেজিস্ট এবং আধুনিক কাব্য পদ্ধতি প্রবর্তনের চেষ্টা ছিল। প্রজাতন্ত্রের প্রথমদিকে (কোরিয়ান যুদ্ধের পরে ১৯৫৩ সালে শুরু হয়েছিল), দেশপ্রেমমূলক কাজগুলি খুব সফল হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশক থেকে লিরিক্যাল কবিতা প্রাধান্য পেয়েছিল। কবিতা একবিংশ শতাব্দীর কোরিয়ায় প্রকাশিত ও লেখনী রচনার সংখ্যা উভয় ক্ষেত্রেই বেশ জনপ্রিয়।
আধুনিক কোরিয়ার একটি কবিতা সংকলিত হচ্ছে।
১০,৩০০ আসল কোরিয়ান কবিতার সংগ্রহ থাকছে তাতে।

তারা পুরণো ‘কাসা’ ( আলোচনামূলক কাব্য), বা ‘সিজো’ (তিন পংক্তির অনধিক পঁয়তাল্লিশ অক্ষরের কবিতা) এই দুই কাব্যধারা পরিহার করে তাঁরা কবিতার ছন্দ ও দৈর্ঘমাত্রা নির্ধারণ করেছেন, এমন কি ছন্দ বর্জিত গদ্য কবিতাও লেখেছেন অনায়াসে।
তাদের কবিতায় – প্রেম , বিরহ , বাৎসল্য , সৌন্দর্য , প্রীতি , ধর্মবোধর, প্রকৃতি প্রেম, দারিদ্র , হতাশা , সেই সঙ্গে জীবনের প্রতি গভীর মূ
ল্যবোধ প্রভৃতি তাঁদের কবিতায় ছায়া ফেলেছে।
এই মুহূর্তে যারা লিখছেন, তাদের মধ্যে –
হান-য়োঙ-য়ুন , য়ু-চি-হ্বোয়ান , কিম-দোং-ম্যোঙ ,
য়াং-ম্যোঙ-মুন , কিম-চুন-সু , চো-চি-হুন ,
কিম-নাম-জো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য, যাদের লেখা মনে রেখাপাত করে।


হান-য়োঙ-য়ুন (১৮৬১-১৯৪৪).
—————————————
উইলো চারা
—————–
রুয়েছি উইলো চারা একদা উঠোনে
ঘোড়াটাকে তার ডালে বাঁধব বলে,
বানালাম চাবুক উইলোর সরু ডালে
পলকে ঘোড়াটা দূরে ছুটবে বলে।
রুয়েছি উঠোনে একদা উইলো চারা
অশ্ব ছোটানো চাবুক বানাব বলে,
হায়,উইলোর অগন্য তরু শাখা
হৃদয় বাঁধলো আমাকে মায়ার ছলে।


য়ু-চি-হ্বোয়ান (১৯০৮-৬৭).
————————————
ফুল বাগান
—————-

হেমন্ত এসেছে ফিরে।
ছেলে মেয়েরা আমার কোথা থেকে যেন
কয়েকটা ফুলের বীজ নিলে এলো ঘরে।
সেগুলো সাজাচ্ছে তারা,গুনছে এক এক করে
গোলাপ,গাঁদা,দোপাটি আর মোরগঝুঁটি।

পড়া লেখা সেরে ঘুমোবার আগে
বিছানায় শুয়ে তারা ফুলের কথা ভাবে,
এগুলো বোনার জন্য যদি একটা বাগান থাকত?
কী যে মজা হতো।

রাত্রি গভীর হলে, মা যখন লেপটি টেনে
তাদের শরীর ঢেকে দেয় গভীর যত্নে,
এই দরিদ্র ক্লান্ত ফুলগুলি ঘুমে ঢুলে পড়ে
প্রত্যেকেই এক একটা বিশাল ফুলের বাগান
বুকে জড়িয়ে।


সুহ্ জুং জু (১৯১৫ জন্ম -)
——————————
দ্বিপ্রহর
———-

স্তিমিত মৃত্যুর স্বাদ পাপড়িতে লেগে
দুই পাশে ফুটে থাকা লাল ফুল পথে,

সুদূর সর্পিল পথে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়
আফিংয়ের স্বপ্নে যেন এলানো শরীরে
ছুটে ছুটে চলে যায়, আমাকে পিছনে ডেকে ডেকে।

আর করপুটে ধরে রেখে অনুস্মরণ আমার
বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরা তীব্র গন্ধ নাকে,

নিস্তব্ধ তীব্র তাপে শুষ্ক শান্ত দুপুর রাতে
দগ্ধ করি, দগ্ধ হই দেহের কিনারে পরষ্পর।


কিম চুন সু (১৯২১.জন্ম -)
———————————
ফুল
——–
যতক্ষণ নাম ধরে ডাকিনি তাকে
বস্তু ছিল, তার বেশী কিছু নয়।

যখনই ডেকেছি নাম ধরে
কাছে এসে
হয়ে গেল ফুল।

এ-দেহের বর্ণবাস মিল রেখে তুমি
আমায় ডেকো না কোনো নামে
যেমন ডেকেছি ওই নামে
কাছাকাছি আসব তোমার
তোমার আপন হয়ে যাব।

আমাদের সকলেই কিছু কিছু হবার বাসনা
আমরা যে সকলেই সকলের কাছে
হতে চাই অর্থময়, অবিস্মরণীয়।


কোরিয়োরা ‘ নৃত্য-গীত প্রিয় জাতি ‘।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো কেরিয়াতেও প্রাচীনতম কবিতা সেই দেশের ধর্মমতের সঙ্গে সংপৃক্ত হয়ে পবিত্র
মন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছিল।
তবে কৃষি-জীবন থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা লোক সাহিত্যও প্রাচীন কোরিযো সংস্কৃতির সম্পদ,
এ কথাও অনস্বীকার্য।
কোরিয়ার জনগণ কোরিয়ান কবিতাকে শ্রেষ্ট শিল্পকলা
হিসাবে গণ্য করে থাকেন। তাই কোরিয়াকে ‘কবিতার দেশ’
বলে সেখানকার কবিরা আখ্যা দিয়ে থাকেন, গর্বের সঙ্গে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress