বিংশ-শতাব্দীর ফরাসী কবিতা
উনিশ শতকের ফরাসী সাহিত্যের বিশেষ ঘটনা হল ‘প্রতীকিবাদ’।প্রতীকিবাদের মধ্যে দেখা যায় বিভিন্ন প্রবণতা।১৮৮৬ সালে মোরেআ-র ‘প্রতীকিবাদের’ ঘোষণা পত্র প্রচারিত হয়।কিন্তু ‘প্রতীকিবাদী’ কবিদের মধ্যে সকলের কাছে এটা কাব্যতত্বের আদর্শ হিসাবে গৃহীত হয়েছিল বলে মনে হয় না।এই কবিদের মধ্যে, এক দলের লেখার মধ্যে অবক্ষয়, বক্রোক্তি,আক্রমণাত্বক ভঙ্গির সঙ্গে এক ধরণের গীতিময়তার রোমান্টিকর রেশ,আর এক ধরণের কবিদের মধ্যে পার্নাসিঁয়াসদের সহমর্মিতা লক্ষ্য করা যায়।তবে এদের সবারই সীকৃত গুরু ছিলেন বোদলেয়র,রঁ্যাবো, ভের্লন,মালার্মে। এই সূত্রেই তাদের মধ্যে যা কিছু সহমর্মিতা।
বিশ শতাব্দীতে প্রতীকিবাদের বিবর্তন ঘটে
‘শুদ্ধ কবিতা’র আদর্শে।তাদের মধ্যে পল ভালেরি,
পল ক্লোদেল,ফ্রাঁসিস জাম,মিলোজ, স্যাঁ-জন-পের্স প্রমুখ।
এই ধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন- জঁ-জুভ্,পিয়ের এমানুয়েল,পাত্রিস দ লা তুর দ্যু প্যাঁ,জঁ ক্লোদ রনার, জোএ বক্সে, ইভ বনফোয়ার প্রমুখ।
এর পাশাপাশি,প্রথামুক্ত প্রয়াস লক্ষ্যণীয়।
তারা প্রাত্যহিক দৈনন্দিন জীবনের আবিলতা মুক্ত, আন্তরিক স্বরূপের সন্ধানে – কাব্যাদর্শকে পরিচালিত করতে চান।তাদের বত্তব্য হল,
” ঢের হয়েছে, মালার্মে ও বোদলেয়ারের ভক্ত হয়ে,বহুকাল তো কাটল,এবার অন্যরকম কিছুর সন্ধান করা যাক বরং”।
বিশ শতাব্দীর শুরুতে জ্যুল রম্যাঁ-র নেতৃত্বে ‘য়ুনানিমিসম’ আন্দোলন শুরু হয়,যার উদ্দেশ্য ‘একাত্ম ও সমবেত জীবনের’ উপস্থাপনা কাব্যে।১৯০৯ সালে ফরাসী পত্রিকা ফিগারোতে বের হল,ইতালীয়ান কবি মারিনেত্তির ‘ভবিষ্যৎবাণী ঘোষণাপত্র’।এই ঘোষণায় যন্ত্রযুগের উপযুক্ত নতুন শিল্পসৃষ্টির আহ্বান জানানো হলো।
১৯১৬ সালে ফরাসী কবি আপলিনের এরই সমর্থনে একটি ঘোষণা পত্র প্রকাশ করেন।ইতিমধ্যে চিত্রকলায় ‘ক্যুবিসম’ও বস্তুকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার পথ দেখাল।
১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে ব্লেজ সঁদ্রার লিখলেন,
‘ন্যু ইয়র্কে ইস্টার’।ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে গীয়ম আপলিনের বন্ধুদের পড়ে শোনালেন,’চিৎকার’ নামে কবিতাটি।পরে কবিতাটি ‘জোন’ শিরোনামে ১৯১৩ সালে
আপলিনের ‘ সুরাসার’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম কবিতা হিসাবে স্থান পায়।জীবনে জটিলতা, ভিড়, অনিশ্চয়তা, কর্মচাঞ্চল্য,অসংগতি সব কিছু নিয়ে তার বাস্তব রূপ ধরা দিল সঁদ্রার ও আপলিনের কবিতায়।
১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয়,সঁদ্রার-এর “ট্রান্স-সাইবেরিয়ানের গদ্য” নামক তার কবিতা।বোদলেয়ার ও রঁ্যাবোর কল্পিত ভ্রমণের পরিবর্তে বাস্তব ভ্রমণের বিবরণে এখানে কবিতা লেখা হয়েছে।সঁদ্রার ও আপলিনের-এর কবিতায় বাইরের জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা,ট্রেনে কি জাহাজে বেড়ানো,শহরের পথে পথে বৈচিত্রময় ভ্রমণ, আইফেল টাওয়ার, ট্রাম-বাস,দৈনন্দিন জীবন প্রভৃতি সবকিছুই কবিতার বিষয় হয়ে উঠল। এই দু’জন কবি ছাড়া তৃতীয় কবি হলেন,মাক্স জাকব।১৯১৭-১৯২১ সালের মধ্যে দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়ে আলোড়ণ তোলে।
তার কাব্যধারা স্যুরেলিয়াজমের সূচনা ঘোষণা
করে।
ওই সময়ই শিল্প-সাহিত্য ভাঙার আন্দোলন
‘ডাডাইজম’-এর সূচনা হয়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানুষের আশা-আকাঙ্খা,চিন্তা-চেতনা,মূল্যবোধের জগতে যে আঘাত হানে,সেই হতাশা থেকেই ডাডা-ইজমের বিদ্রোহ,সব কিছুকে অস্বীকার করার প্রবণতা শুরু হয়।
ডাডা-ইজম আন্দোলন ছিল প্রধানতঃ নেতিবাচক,যুক্তির পরম্পরাময় ভাষাসংস্থান তথা চিন্তার বন্ধকে গুঁড়িয়ে দেওয়াই ছিল, ডাডা-র প্রয়াস।
” মুক্তি – ডাডা ডাডা ডাডা, কুঁকড়ে যাওয়া রঙগুলোর আর্তনাদ,বৈপরীত্য আর যত রকমের বিরোধ,বীভৎসতা,অপরিণামের জড়িয়ে যাওয়- জীবন ( ত্রিস্তঁ জারা,ঘোষণাপত্র- ১৯১৮)।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর কিছুটা স্তিতি সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ফিরে এলে, ডাডা-ইজমের নঞর্থক আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন হয়ে পড়ে।তখন এই আন্দোলন ছেড়ে কয়েকজন বেরিয়ে গিয়ে,অঁদ্রে ব্রতোঁ-র
নেতৃত্বে স্যুরিয়ালিসম আন্দোলন শুরু হয়।
এই আন্দোলনের চরিত্র বিশেষভাবে সদর্থক।
১৯২৪ সালে স্যুরিয়ালিষ্টিক ঘোষণাপত্রে, স্যুরিয়ালিজমের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে,
” বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা যার দ্বারা প্রকাশ করা যায়,মৌখিক,লিখিত বা যে কোন চিন্তার যথার্থ গতিপ্রকৃতি,যুক্তিদ্বারা কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণহীন, কোন প্রকার নৈতিক বা নান্দনিকতার বাইরে,চিন্তার প্রতিলিপি।”
স্যুরিয়ালিস্টরা ‘ মানসিক চিন্তার জগতে’ প্রবিষ্ট হতে চাইলেন।উদ্ভাবিত হলো স্বয়ংক্রিয় রচনা পদ্ধতি।
ইতিমধ্যে ইয়োরোপীয় বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে মার্কসবাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।বিপ্লবের ধারণা স্যুরিয়ালিস্টিকদের আকর্ষণ করে।
কবি অঁদ্রে ব্রঁতো সব রকম ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর বিরোধিতায় অবিচল রইলেন।ফলে স্যুঁরিয়ালিস্টিক গোষ্ঠীতে ভাঙন দেখা দিল।প্রথমে লুই আঁরাগ,পরে পল এলুয়ার স্যুঁরিয়ালিস্টিক গোষ্ঠী ছেড়ে এসে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন।
এই সময় কবি পল এলুয়ার লিখলেন,” সময় এসেছে যখন সমস্ত কবির অধিকার ও কর্তব্য হলো এ’কথা বলার যে তারা অন্য মানুষের জীবনে,সমষ্টিগত জীবনে গভীরভাবে নিবিষ্ট।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়।১৯৪০ সালে
ফ্রান্স পরাজিত ও জার্মান অধিকৃত হয়।
মার্শাল পেত্যাঁ-র নেতৃত্বে ভিশিতে জার্মান তাঁবেদারী সরকার প্রতিষ্ঠিত হল।প্রতিরোধের আন্দোলনে যোগ দিলেন কবি সাহিত্যিকেরা।
অঁদ্রে ব্রতোঁ আমেরিকায় আশ্রয় নিলেন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্যুঁরিয়ালিস্টিক আন্দোলন থিতিয়ে পড়ল।যুদ্ধ থেমে গেলে, অঁদ্রে ব্রতোঁ ফিরে এসে আন্দোলনকে আবার পুনরুজ্জীবিত করতে চাইলেও,
তা আর আগের মতো উদ্দীপিত হয়ে ওঠেনি।
তবে স্যুঁরিয়ালিসরটিক আন্দোলন ফরাসি শিল্প-সাহিত্য জগতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।এই আন্দোলনের ফলে শিল্প- সাহিত্যে এক নতুন মুক্তির আবহাওয়া তৈরী হয়েছিল।কবিতার ক্ষেত্রে এই আন্দোলনের ফলে বিশেষ গতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
এই সময়টা ছিল ফরাসী কবিতার উজ্জল সময়।এই আন্দোলনে শুরু থেকে ছিলেন, পল এল্যুয়ার,লুই আঁরাগ,রবের দেসনস,অঁদ্রে ব্রতোঁ প্রমুখ।কিছুদিন এই আন্দোলনের সাথে থেকে পরে বেরিয়ে আসেন কবি জাক প্রেভের ও কবি রনে শার।
এই আন্দোলনে শরিক না হয়েও যাদের কবিতায় স্যুঁরিলিজমের প্রভাব পড়েছিল তারা হলেন –
জাঁ ককতো,পিয়ের রদেভি,জ্যুল স্যুপের ভিয়েল প্রমুখ।প্রথা নির্দিষ্ট ফর্ম ও ভাষা রীতির বন্ধন থেকে মুক্তির প্রয়াসে এই আন্দোলনের ফলে ফরাসী কবিতা অনেক পরিণতি লাভ করেছে,এ’কথা অনস্বীকার্য।
কোন গোষ্ঠীভুক্ত না হয়েও যাদের কবিতা ফরাসী সাহিত্যকে মর্যাদাশীল করে তুলেছে, তার হলেন –
অঁরি মিশো,ফ্রঁসিস পোঁজ, য়োজেন গিলভিক প্রমুখ।অঁরি মিশোর কবিতায় তীর্যক দৃষ্টভঙ্গী ও বস্তুজগতের বিরোধ ও বৈপরীত্য ফুটে উঠেছে।পোঁজ ও গিলভিকের কবিতার প্রধান অবলম্বন বস্তুজগৎ।
যুদ্ধ পরবর্তী কালের ফরাসী কবিতায় বৈশিষ্ট সৃষ্টিকারী ঘটনা ইসিদোর ইসুর প্রবর্তনায় ‘লেত্রিস্ত’ আন্দোলন।
শুধু বাক্যসংস্থান নয়, শব্দকে পর্যন্ত ভেঙে চুরে ‘লেত্রিস্ত’-রা যা করতে চেয়েছেন,তা ডাডা-ইজমের শূন্যগর্ভ ভাঙাচোরাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ শতাব্দীর ফরাসী কবিতায় ফরাসীভাষী কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের কবিতা এক নতুন মাত্র সংযোজন করেছে তাদের ঐতিহ্য ও উপলব্দি,যাকে বলা হয়’নেগ্রিত্যুদ’।বিশ শতাব্দীর প্রথমসারীর ফরাসী ভাষার কবিদের নাম করতে গেলে,সেনেগেলের কবি লেওপলদ সেদার সঁগর ও মার্তিনিকের কবি এম সেজার- এর নাম উল্লেখযোগ্য।
জাপানী কবিতা সাধারণতঃ যেমন স্বল্প দৈর্ঘের হয়, ফরাসী কবিতা ঠিক তার উল্টো।বেশীরভাগ কবিতাই দীর্ঘ দৈর্ঘের হয়ে থাকে।
ফরাসী কবিতায় এখন আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের খবর নেই।