এক.
আজকাল প্রায় প্রতিটি গ্রুপে অণুগল্প লেখা হচ্ছে। পত্র পত্রিকায় অণুগল্প সমাদরে প্রকাশ করা হচ্ছে। অণুগল্পের বই বের হচ্ছে। খুবই ভাল খবর। বাংলা সাহিত্যের একটা নতুন দিক।
এই অণুগল্পকে কি’করে আরও বেশি দিকে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সে চেষ্ট করা উচিৎ। কিভাবে সাহিত্যধারায় আরএ গভীরভাবে সম্পৃক্ত করা যায়,সেই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা উচিত। তার জন্য যারা অণুগল্প লিখছেন তাদের দায়িত্ব অনেক বেশী।
সাম্প্রতিক অণুগল্প লেখায় বহু রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা দেখা যাচ্ছে। এই পরীক্ষা নিরীক্ষা অনেক সময় পাঠকের অনুভবের বাইরে চলে যাচ্ছে, বোধগম্যের হচ্ছে না। আবার সেই লেখাগুলোকেই কিছু পাঠক বলছে অসাধারণ, এটাই হল আসল অণুগল্পের লেখকদের সমস্যা।অনেক সময় এখানে যখন লেখকই পাঠক। যারা শুধুমাত্র পাঠক তারা এ রকম ‘গল্প নয় অথচ অণুগল্প’কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। অথবা না পড়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনায়াসে।
আবার সেইসব পাঠকই ছোট ছোট লেখা, দীপ্ত লেখা, মনগ্রাহী লেখা, অন্য ভাবনার লেখা, ভাল বিষয় ভাবনার লেখা ঠিক পড়ছে। সেগুলো অণুগল্প কি না, গল্পের ফরম্যাটে আছে নাকি অণুগল্পের নিয়ম মানছে কিনা, অণুগল্পের নিয়মটা কি ইত্যাদি নিয়ে ভাবনা সাধারণ পাঠক ভাবে না। তারা শুধু তাদের ভাল লাগা দেখে।
অণুগল্পের ক্ষেত্রে গল্প ‘কিন্তু গল্প নয়’ এটা অণুগল্প, এ’রকম গোলক ধাঁধাঁয় পাঠক হাবুডুবু খেতে চাইবে?এক সময় সে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? যেমন কবিতার ক্ষেত্রে অনেক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার জন্য অবশ্য অনেক লেখক পাঠককেই দায়ী করবে। তাতে সাহিত্যের কি লাভ হবে কিছু?
আসল কথা হল ‘সহজ সরল সাধারণ লেখাই’ পাঠক পছন্দ করে। সহজের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি মগজমারি।
ছোট অথচ সহজ সরলভাবে সুনির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে ভাবনার গভীরে পাঠককে নিয়ে যাওয়াই লেখকের যথার্থ কাজ।পড়ার সময় যেন কোন শ্রেণীর পাঠকের বুঝতে কোন অসুবিধা না হয়।পড়ার পরে বিষয়ের গভীরে পাঠক যেন সহজেই ঢুকতে পারে। সেই লেখাই বোধহয় জনসাহিত্য। না হলে পড়তে পড়তে কিছুই বুঝতে পারলাম না,আবার পড়ে,তবে বুঝতে হবে তাহলে পাঠকের কি আর সে ধৈর্য থাকবে সে লেখা আবারও পড়ে দেখবার?
তাই অণুগল্পের ক্ষেত্রে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার একটা সীমারেখা বজায় থাকা উচিৎ।
আমরা বাঙালীরা হুজুগে জাত। কিছু কিছু গ্রুপে তো কিছুদিন ধরে দেখলাম,মাত্র দশটি শব্দে অণুগল্প লেখার প্রয়াস।কিছুদিন চলার পর সে’সব প্রচেষ্টায় এখন ভাটা পড়েছে মনেহয়। কেউ আবার আরও কেরমতি দেখিয়ে এক শব্দে অণুগল্প লিখেছে। শব্দটা “মা”। এতেই নাকি সব বলা আছে।
একটা গল্প শুনেছিলাম।
শিল্পীদের আঁকা প্রতিযোগিতায় একজন শিল্পী একটা সাদা চিত্রপট জমা দেন। বিচারক চিত্রপটটি দেখে অবাক হন।
তিনি শিল্পীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, এখানে আপনার আঁকা ছবি কই?
শিল্পী উত্তরে বলেন,হ্যাঁ একটা ইঁদুর ছিল।
বিচারক ইজেল দেখিয়ে বলেন,কোথায় ইঁদুর।
শিল্পী- সে পালিয়েছে
বিচারক – কেন?
শিল্পী – বিড়ালের তাড়া খেয়ে
বিচারক – তা’হলে বিড়ালটা কই
শিল্পী- বিড়াল ইঁদুরকে ধরতে তার পিছনে ছুটেছে তাই ইজেল ফাঁকা।
কারও কারও অণুগল্প পড়ে পাঠকের, এ’রকম অভিজ্ঞতাও হয় ।
যাতে অণুগল্পকে আরও পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়া যায়।সেজন্য
লেখকর নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। পাঠকের মনে পৌঁছে যেতে হবে সহজ সরল ভাব প্রকাশের মাধ্যমে।
সাহিত্য পাঠ করার সময় পাঠক কি আর ভেবে পড়ে,এটা গল্পের মত পড়ব , এটা উপন্যাসের মত পড়ব , এটা প্রবন্ধের মত পড়ব , এটা কবিতার মত পড়ব কিংবা এটা অণুগল্পের মত পড়ব । তা কিন্তু পাঠক ভাবে না। পাঠক বিষয় ভাবনায় ডুবে যায়, ভাবনার আবেশে আবেশিত হয়ে ওটে,বিষয় ভাবনায় উদ্বেলিত হয়। সহজ পাঠের গভীর উপলব্ধিতে আরও বেশি সাহিত্য পাঠ করার আকাঙ্খা জাগে তাদের মনে। পাঠকের আরও বেশি সাহিত্য পাঠের আকাঙ্খায়,অণুগল্প তার অবস্থান আরও প্রসারিত করতে পারে।
অণুগল্প এখন –
“আমার কথাটি ফুরালো,
নটে গাছটি মুড়ালো।”
ধাঁচের হয়ে উঠছে।তাই,কে মুড়াল,
কেন মুড়ালো?
তা পাঠক জানতে চাইতেই পারে,
সে দাবী পুরণ করার দায়িত্ব অণুগল্প লেখকদেরই নিতে হবে।
দুই.
অণুগল্প হল আকারে খুবই এক ধরণের গল্প।সাধারণত ২৫০ থেকে ৩০০ শব্দের মধ্যে অণুগল্প লেখা ভালো। তার কমেও আজকাল লেখা হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ শব্দের মধ্যে।বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর স্বাদ এনে দেওয়ার প্রচেষ্টা এক রকমের।কখনো কখনো কবিতার মতো ভাষ্যে, ছোট এক ধরণের গল্প।এতে অভিঘাত বেশি থাকে। স্বল্প বর্ণনায় পাঠককে চমকে দেওয়া কিংবা আনন্দ-বেদনার রস আস্বাদন করানোটাই মূলতঃ অণুগল্পের কাজ। অণুগল্পে সাধারণত তিনটা প্যারা থাকে। প্রথম প্যারা পড়ার পর পাঠক যা ভাববে, দ্বিতীয় প্যারায় সে ভাবনার পরিবর্তন ঘটবে। এবং তৃতীয় ও শেষ প্যারায় গিয়ে পাঠক চমকে যাবে। কিন্তু এতে করে গল্পের বিষয়বস্তুর কোন পরিবর্তন হবে না।
পূর্বসূরীরা অনেকেই অণুগল্প লিখেছেন। তার মধ্যে বনফুল অন্যতম। রবীন্দ্রনাথেরও কিছু অণুগল্প পাওয়া যায়। তাছাড়া ঈশপের গল্প। এরকম আরো অনেকেই এ’রকম আরও কিছু গল্প লিখেছেন সত্তর আশির দশকে তখন তার নাম ছিল মিনি গল্প।ওই সময় “পত্রাণু” নামে একটি মিনি পত্রিকাও বেরতো,অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়।লেখকদের মধ্যে ছিলেন অনেকেই। যেমন,বনফুল, সুবোধ ঘোষ, আশাপূর্ণা দেবী,শিবরাম চক্রবর্তী, নারাযণ গাঙ্গুলী,সমরেশ বসু,জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চ্যাটার্জী, শীর্ষেন্দু মুখার্জী, বরেন গাঙ্গুলী,অতীন ব্যানার্জী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ,দিব্যেন্দু পালিত প্রমূখ।
সেই মিনি গল্পই বর্তমানে অণুগল্প নামে প্রচারিত হচ্ছে।নামের পরিবর্তন ঘটেছে।
অণুগল্প মূলতঃ স্বল্প বর্ণনায় বিস্তর ভাব প্রকাশ করে। হঠাৎ করে গল্পটা শুরু হয়ে যায়, এবং শেষও হয় আচমকা।
অনেকগুলো কথাকে কখনো কখনো এখানে এক লাইনে প্রকাশ করা হয়। এতে করে যদিও স্বাভাবিক প্রাঞ্জলতার কিছু অভাব ঘটে – তবুও পাঠকের বুঝে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয় বলে মনে হয় না। অণুগল্পের ক্ষেত্রে সবসময় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিত –
১. আকারে ছোট,যত কম বর্ণনা হবে।
২. অপ্রয়োজনীয় কথা একটাও থাকবে না।কোন উদাহরণ, উদ্ধৃতি, প্রত্যয়, অণুপ্রাস, উপসর্গ, অণুগল্পে বাদ যাবে।
৩. অণুগল্পে চমক থাকা বাঞ্ছনীয়।
৪. শুরু হবে আচমকা,অথচ শেষ হয়েও এর রেশ থেকে যাবে পাঠকের মনে। যেন মনে হবে ‘গল্পটা এখানে শেষ হলো না।’
৫. অণুগল্প মূলত ভাবারোহ সৃষ্টকারী একধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির গল্প। তাই এখানে বিশেষ করে স্পেস, বানান, যতি ও বিরামচিহ্ন ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
★(অণুগল্পের যে তিন প্যারার কথা, এখানে বলা হয়েছে,সেই নিয়মের বাইরে গিয়েও ইদানিং অণুগল্প লেখার চর্চা চলছে। মন্দ কি?)
*ঋণ স্বীকার : – দীপঙ্কর বেরা ও মেহেদী হাসান।