আজ এই রাস্তায় গান গাইব, — এই নগরের শিরা উপশিরার
এই রাস্তার ধূলির গান !
—তার কাঁকর, তার খোয়া তার পাথরের—
আজ কিছু তুচ্ছ নয় |
ভাঙ্গা পেরেক ; ঘোড়ার খুরের নাল,
ছেঁড়া কাগজ, কাঠি, পাতা কিছু তুচ্ছ নয় !
আজ এই রাস্তায় গান গাইব,
যে রাস্তা গেছে আমার ঘরের পাশ দিয়ে—
তার দিনের জনস্রোতের তার নিশীথের নির্জ্জনতার,
তার বৈচিত্র্যের, তার চাঞ্চল্যের,
তার অবসাদের, তার একঘেয়েমির !
তার গ্যাসের বাতির কাঁচে প্রভাতে যে আলোটি চুম্বন করে,
তার টেলিগ্রামের তারে বসে যে শালিকটি দোলা খায়,
যে বৃদ্ধ মুটেটি ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে
তার ধূলির ওপর দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে মোট বয়ে নিয়ে যায়,
যে দুরন্ত শিশুটি তার ধূলি জমা ক’রে খেলা করে,
পথিকদের বিরক্ত করে ও তাদের তিরস্কারে হাসে,
সন্ধ্যা ও সকালে যে শ্রমিকের দল আনাগোনা করে,
তার কিনারায় একটি জীর্ণ ঘরে
যে পীরিত বৃদ্ধ সারাদিন
তার জলের কলে যে সব কুলী যুবতীরা
জল নেয়, ঝগড়া করে, কৌতুক করে,
কুটিল দৃষ্টি হানে আর উচ্চ হাস্য করে |
সমস্ত দিন ও রাত্রি ধরে যত পথিক
যত কথা কয়ে যায়,
তার কারখানা থেকে যত কোলাহল শব্দ ওঠে
যত ধূর্ম ওঠে তার কারখানা-কলের
আকাশস্পর্শী চিম্ নি থেকে,–
সব কিছুর ! যত কিছুর !
এ জীবন ধরে এই পথটিতে যা কিছু দেখেছি,
শুনেছি, ভালবেসেছি, — সব কিছুর গান গাইব |
তার সঙ্গে গান গাইব মানুষের
যে মানুষ পথ সৃষ্টি করেছে,
মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবার পথ !
অরণ্যে পথ আছে |
শ্বাপদেরা যে পথ দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ
তৈরী করেছে বন মাড়িয়ে মাড়িয়ে
শিকারের চেষ্টায় আর জলের অন্বেষণে
—মৃত তৃণের পথ !
সে পথ হিংসার, সে পথ ক্ষুধার, সে পথ কামের |
মানুষ প্রথম মৃত লতা-গুল্ম-তৃণের একটি
অবিচ্ছিন্ন রেখা সৃষ্টি করেছিল – কবে ? –-কেন ?
আমি বলি প্রীতিতে |
মানুষ প্রথম পথ সৃষ্টি করেছিল মানুষের সঙ্গে মেলাবার জন্যে
তাকে নমস্কার !
সে পথ আরো বিস্তৃত হোক,
যে পথ মানুষকে বৃহৎ করেছে |
সমস্ত পথের গান গাইব,
সোজা ও বাঁকা, সরু আর চওড়া—অশেষ অসীম,
কারণ সব পথের মোহানায় যে আমার আসন,
সব পথ এসে মিলেছে এই আমার মেলায়,
যে পথ গেছে উত্তর মেরুতে আর যে পথ গেছে
দক্ষিণ মেরুতে, যে পথ গেছে সাহারায়,
আর যে পথ গেছে কাঞ্চনজঙ্ঘায় !
যে পথ গেছে প্রিয়ার হৃদয়ে –
আর যে পথ মানুষের দুর্দ্ধর্ষ দুরাশার—
আর অসম্ভব কল্পনার !
আমি পথ সৃষ্টি করি—
সব পথই আমার |
আমি সেই নবসৃষ্টির গান গাইব |
আমি শুধু শিলা দিয়ে রাস্তা বানাই না—
শুধু লোহা ও লকড়ি দিয়ে নয়,
শুধু পেশীর বল আর শ্রমের ঘর্ম্ম দিয়ে নয়—
আমি পথ বানাই মর্ম্ম দিয়ে—প্রাণ দিয়ে—
আমি পথ বানালাম পাহাড় চিরে,
আমি নদী ডিঙিয়ে গেলাম,– আমি সাগর বেঁধে দিলাম,
বাতাস জিনে নিলাম,
আমি যুগ থেকে যুগান্তরে দেশ থেকে দেশান্তরে
মনের সড়ক তৈরী করলাম,
আমার তবু থামা হবে না |
পথই যে আমার প্রাণ—আমার অসীম পথের পিপাসা |
শিশু পৃথিবীর কোন্ অনতিগভীর কবোষ্ণ সাগরে
আমার প্রথম ক্ষীণ পদচিহ্ন পাবে,
অসীম সাগরের বালুকার পারে,
তারপর ধরণীর প্রতি স্তরের ধাপে ধাপে আমি
উঠে এলাম,— অসীম অমর জীবান্ত |
নিখিলের বিস্ময় |
দূরতম নক্ষত্রের পথ আমি খুঁজি আজ |
সব পথ-সৃষ্টির একই প্রেরণা |
যে পথে পুষ্পের সুগন্ধ মৌমাছিদের নিমন্ত্রণ করতে বেরোয় ;
আর যে পথে মহাজনদের সওদা আসে নগরের হাটে ;
যে পথে যাযার হংসবলাকা আসে আকাশকে
শুভ্র পক্ষের কল হাস্যে সচকিত করে ;
আর যে পথে পৃথিবীর অন্ধকার জঠর হ’তে
মজুরেরা কয়লা তুলে আনে,
আর ধাতু আর হীরক —–সে প্রেরণা জীবন
এই পথ সৃষ্টিতেই জীবনের সার্থকতা !
এই পথ জীবনকে বৃহৎ করে বৃহত্তর ঘনিষ্ঠতার বন্ধনে ;
নিশ্চিত হতে অনিশ্চিতে, নীড় হতে আকাশে
তার অশেষ অভিযানে |
এই পথ জীবনকে মুক্তি দেয়—অসমাপ্ত অসীমতায় |
এই পথে জীবনের বন্ধনের ছন্দ |
এই পথে জীবনের মুক্তির আনন্দ |