Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভয়ংকর ভুতুড়ে || Humayun Ahmed

ভয়ংকর ভুতুড়ে || Humayun Ahmed

আখলাক সাহেব থাকেন কলাবাগানে

আখলাক সাহেব থাকেন কলাবাগানে। অনেকখানি ভেতরের দিকে। দেয়ালঘেরা তিন কামরার একতলা একটা বাড়ি। আশেপাশে ছয়-সাততলা বিশাল বাড়ি ঘর উঠে গেছে। সেখানে এরকম ছোট একটা বাড়ি মাঝে মাঝে তার লজ্জাই লাগে। বাড়ি ভেঙে বড় বাড়ি করার মতো টাকা পয়সা তাঁর নেই। ইচ্ছাও নেই। বড় বাড়ি দিয়ে কী করবেন? তিনি একা মানুষ। একজন মানুষের ঘুমাবার জন্যে তো আর পাঁচটা কামরা লাগে না। একটা কামরাই যথেষ্ট। তিনি বাড়ির চারদিকে গাছপালা লাগিয়েছেন। গাছগুলি চোখের সামনে বড় হচ্ছে। দেখতে তাঁর ভালো লাগে। গত বর্ষায় কাকরুল গাছ লাগালেন–কেঁপে কাকরুল হলো। এতেই তিনি খুশি। তিনি খুব শান্তিতে আছেন।

কিছুদিন হলো তাঁর মনের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। তাঁর বাড়িতে ভূতের উপদ্রব হয়েছে। যে জিনিস তিনি বিশ্বাস করেন না, সেই জিনিস তার ঘরে। ভয় তিনি পাচ্ছেন না। যা পাচ্ছেন তার নাম লজ্জা। এত কিছু থাকতে তাঁর বাড়িতে কিনা ভূতের উপদ্রব। ব্যাপারটা কাউকে বলতেও পারছেন না। যাকে বলবেন সে-ই মুখ বাঁকিয়ে হাসবে। হাসারই কথা। অন্য কেউ তাঁকে ভূতেব কথা বললে তিনিও হাসতেন। হাসাটাই স্বাভাবিক।

উপদ্রবটা গত চাবদিন ধবে চলছে। প্রথম দিনের ঘটনাটা এরকম–রাত এগারোটা, তিনি মশাবি থাটিয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় এসে শুয়েছেন, ওমি বাতি আপনা। আপনি জ্বলে উঠল। তিনি অন্য দশ জনের মতো ভাবলেন সুইচে কোনো গণ্ডগোল। দেশী সুইচগুলি কোনো কাজেব না। কিছু না কিছু গণ্ডগোল থাকবেই। মানুষ যে শুধু বিদেশী জিনিস খোঁজ কবে–এই জন্যেই করে। তিনি আবার উঠে গিয়ে বাতি নেভালেন। বিছানায় এসে শুলেন। শীত শীত লািগছিল, চাদরটা গায়ে টেনে দিলেন, ওমি আবারো বাতি জ্বলে উঠল। তিনি চাদর ফেলে দিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন, তখন একবার মনে হলো ভূতের উপদ্রব না তো? এরকম হাস্যকব একটা কথা তার মনে এসেছে–এই ভেবে তিনি নিজেই নিজের উপর অত্যন্ত বিবক্ত হলেন। বোঝাই যাচ্ছে সুইচে গণ্ডগোল। প্ৰিং ট্রিং কেটে গেছে কিংবা কোনো স্কু টাইট হয়ে গেছে। একজন ইলেকট্রিক মিন্ত্রিকে এনে দেখাতে হবে। আখলাক সাহেব বুঝতে পারছেন না। আবার বাতি নেভাবেন কিনা। লাভ কী, নিভালেই হয়তো আবার জ্বলে উঠবে। এবচে বাতি জুলাই থাকুক। তিনি আবার শুয়ে পড়লেন, তখন বাতি আপনাআপনি নিভে গেল। তিনি ডাকলেন, মোতালেব মোতালেব।

মোতালেব তার কাজের ছেলে। পাশের ঘরে সে ঘুমুচ্ছে। সামান্য ডাকে তার ঘুম ভাঙবে এরকম মনে করার কোনোই কারণ নেই। তার দশ গজের ভেতর মাঝারি সাইজের কোনো এটম বোমা ফাটলে ঘুম ভাঙলেও ভাঙতে পারে। এই সাধারণ তথ্য জেনেও আখলাক সাহেব মোতালেবকে কেন ডাকলেন নিজেই বুঝতে পারছেন না। তিনি কি ভয় পাচ্ছেন? ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি কি না ভূতের ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর কাজের ছেলেকে ডাকছেন! ভাগ্যিস ব্যাপারটা আর কেউ শুনে ফেলে নি। কোনোদিন কারো সঙ্গে আলোচনা করাও ঠিক হবে না। বাহান্ন বছরের একজন মানুষ ভূতের ভয়ে তার কাজের ছেলেকে ডাকাডাকি করছে–কোনো মানে হয়?

আখলাক সাহেব শুয়ে পড়লেন। মনস্থির করে শোয়া। বাতি জ্বলতে থাকুক নিভৃতে থাকুক। তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। তাঁকে সকালে উঠতে হবে। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সকাল আটটায় ক্লাস। তিনি তাদের কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রি পড়ান। কাল তাকে সার্কেলের ইকোয়েশন বুঝাতে হবে। নতুন চ্যাপ্টার। সকাল সকাল উঠতে না পারলে ক্লাস মিস হয়ে যাবে। ছাত্ররা ক্লাস মিস করতে পারে, শিক্ষকরা পারে না। তাঁর ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। বিছানায় যাওয়া মাত্র তিনি ঘুমাতে পারেন। আজ ঘুম চটে গেছে। তিনি একাত থেকে ওকাত হলেন। তাঁর খানিকটা পিপাসাও পেল। পানি খাওয়ার জন্যে এখন উঠলে ঘুম পুরোপুরি চটে যাবে। কাজেই তিনি পিপাসা নিয়েই চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। তাঁর মনে হলো বালিশে কোনো সমস্যা। বালিশটা আরেকটু উঁচু হলে ভালো ছিল। তিনি বালিশ উল্টে দিলেন আর তখন শুনলেন তার মশারির কাছে এসে কে যেন কাশল। একবার দুবাব। দৃষ্টি আকর্ষণ করা জাতীয় কাশি। কে কাশবে তার মশারির কাছে?

স্যার কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

কে?

স্যার আমি।

আমিটা কে?

আমাকে স্যার চিনবেন না। আমি জনৈক বিপদগ্ৰস্ত ভুত। গভীব বাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আন্তরিক লজ্জিত। ক্ষমাপ্রার্থী! স্যার, দযা কবে নিজ গুণে ক্ষমা কববেন। ক্ষমা মানব ধর্ম।

আখলাক সাহেব ধরেই নিলেন তিনি ব্যাপারটা স্বপ্নে দেখছেন। ভূতেব ভযা পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন বলেই ভৌতিক স্বপ্ন। আর কিছুই না। ভূত বিশ্বাস না কবলেও স্বপ্নে ভূতেব সঙ্গে কথা বলা যায়। তাতে অস্বস্তি বা লজ্জা বোধ করার কিছু নেই। এখন তার একটু মজাই লাগল।

তুমি তাহলে ভূত?

জি স্যার। বিপদগ্ৰস্ত ভৃত। অপারগ হয়ে আপনার কাছে এসেছি।!

তুমিই কি বাতি জ্বালাচ্ছিলে নিভাচ্ছিলে?

ইযেস স্যার।

ইংবেজি জানো নাকি?

সামান্য জানি স্যার। ভেরি লিটল। চর্চা নেই বলে মাঝে মাঝে ভুল হয়।

তুমি বিপদগ্ৰস্ত বলছিলে, বিপদটা কী?

সে এক লম্বা ইতিহাস, সময় নিয়ে বলতে হবে। স্যারেব কি সময় হবে?

না, সময় হবে না। আমাকে সকালে উঠতে হবে। সকাল আটটায় আমার একটা ক্লাস আছে। সময়মতো ঘুমাতে না পারলে ক্লাস মিস করব। আগের দুটা ক্লাস হরতালের জন্যে হয় নি।

তাহলে তো স্যার আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

অবশ্যই ঠিক হবে না।

স্যার শুভ রাত্রি।

শুভ রাত্রি।

গুড নাইট স্যার।

গুড নাইট।

স্যার গুটেন নাখাট, স্লেপেনজি গুট।

এইটা আবার কী?

জার্মান ভাষায় শুভ রাত্রি, সুনিদ্ৰা হোক।

তুমি জার্মান জানো নাকি?

না জানার মতোই স্যার। জার্মান কালচারাল ইন্সটিটিউটে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে যা শিখেছি। একেবারেই চর্চা নেই। বিদেশী ভাষা, চর্চা না থাকলে দুদিনেই ভুলে যেতে হয়। তাহলে যাই স্যার। কাল আবার দেখা হবে।

আচ্ছা। ভালো কথা, ঘরে ঢুকেছ কোন দিক দিয়ে?

জানালা দিয়ে ঢুকেছি। স্যার যদি অনুমতি দেন তাহলে চলে যাই।

যাও।

আখলাক সাহেবেব মনে হলো জানালার কপাট একটু নড়ল। তারপর সব চুপচাপ।

আর কোনো শব্দ হচ্ছে না। তখন আখলাক সাহেবের মনে হলো ব্যাপারটা কি আসলে স্বপ্নে ঘটেছে না। তিনি জেগেই ছিলেন, এবং এখনো জেগে আছেন? তিনি আবার ডাকলেন, মোতালেব এই মোতালেব! মোতালেব জবাব দিল না। তার জবাব দেবার কোনো কারণ নেই। একটা গদা দিয়ে মাথায় বাড়ি মারলে যদি ঘুম ভঙ্গে।

পানিব পিপাসা আবাবে হচ্ছে। স্বপ্নে কি পানির পিপাসা হয়? এইসব ভাবতে ভাবতে হয়। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন, কিংবা তার স্বপ্ন দেখা শেষ হলো।

তোব ঘুম ভাঙল সকাল নটা দশ মিনিটে। ক্লাস মিস হয়ে গেল। তার অত্যন্ত মেজাজ খারাপ হলো। ভূতেব উপর রাগে গা জ্বলে গেল। ক্লাস যখন মিস হয়েই গেল তখন তিনি ঠিক করলেন আজ আর কলেজে যাবেন না। মিন্ত্রি ডাকিয়ে সুইচটা ঠিক করবেন যাতে আবাবে ভূত বিষয়ক জটিলতায় ক্লাস মিস না হয়।

নিজেই মিন্ত্রি ডেকে আনলেন। সে সুইচ বদলে বিদেশী সুইচ লাগিয়ে দিয়ে গেলজার্মান সুইচ। জার্মান সুইচের কথায় মনে পড়ল ভূতটা জার্মান ভাষায় কী কী যেন বলছিল। গুটেন নাখািট জাতীয় কিছু। কী হাস্যকর ব্যাপার। কাউকে বলা যাবে না। বিকেলে মালিবাগে তিনি তাঁর ছোট বোনের বাসায় বেড়াতে গেলেন। আত্মীয়স্বজন কারো বাসাতেই তিনি যান না। ভালো লাগে না। একা থাকতেই ভালো লাগে। যে কারণে বিয়ে টিয়ে করেন নি। এখন মনে হচ্ছে বিয়ে করলে ভালো হতো। জার্মান জানা ভূতের গল্প নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে করা যেত। একান্ত আপনজনের সঙ্গে অনেক গল্প করা যায়। তার ছোট বোন মিলি অবশ্যি তাঁর খুবই আপন। সপ্তাহে একবার তাকে না দেখতে পেলে আখলাক সাহেবের দারুণ মেজাজ খারাপ হয়। মিলির সমস্যা একটাই, দেখা হলেই বিয়ের জন্যে আখলাক সাহেবকে চেপে ধরবে। ঘ্যানঘ্যান করে মাথা খারাপ করে দেবে–ভাইয়া, তুমি একা একা কী করে থাকবে? বাহান্ন বছর বয়সে এইসব কথা শুনতে ভালো লাগে না বলে মিলির বাসায় সপ্তাহে একদিনের বেশি তিনি যান না। তাছাড়া মিলির মেয়ে তৃণা হয়েছে মহা দুষ্ট। তৃণা তাঁকে বড় বিরক্ত করে।

মিলি বাসায় ছিল না। তার স্বামীর সঙ্গে কোনো বিয়েতে নাকি গেছে। তবে তৃণা বাসায় ছিল। সে বড় মামা বলে এমন চিৎকার শুরু করল যে আখলাক সাহেবের মাথা ধরে গেল। আখলাক সাহেব মিলিকে যেমন পছন্দ করেন। তার মেয়েকে তারচে বেশি পছন্দ করেন। তবে পছন্দের ব্যাপারটা প্ৰকাশ করেন না। বাচ্চারা একবার যদি বুঝে ফেলে কেউ তাদের পছন্দ করছে তাহলে তার জীবন অতিষ্ঠা করে তোলে। বিশেষ করে সে বাচ্চা যদি দুষ্ট প্রকৃতির হয় তাহলে তো কথাই নেই। তাছাড়া মিলির এই মেয়ে তার মার মতোই বেশি কথা বলে। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয়।

আখলাক সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, খবর কীরে?

তৃণা হড়বড় করে বলল, বড় মামা আমার খবর ভালো। খুব ভালো। আজ তোমাকে যেতে দেব না। আজ তোমাকে আমাদের বাড়িতে থাকতে হবে। সারা রাত গল্প করতে হবে। ভূতের গল্প।

আখলাক সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, অন্য কোনো গল্প করতে পারি, ভূতের 呕可自

উঁহু মামা, ভূতের গল্প শুনব।

ভূতের গল্প তো কিছুতেই বলব না।

বলবে না কেন?

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে ভূতের গল্প বলা যায় না। শোনাও যায় না।

শোনা যায় না কেন?

শুনলে পাপ হয়। মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে ভাইকিং নামিয়ে সয়েল টেস্টিং করছে তখন আমরা ভূত নামক কাল্পনিক প্রাণীর কথা ভেবে ভয় পাচ্ছি–এটা হাস্যকর।

বড় মামা, আসলে তুমি ভূতের গল্প জানো না।

আখলাক সাহেব একবার ভাবলেন। গত রাতের অভিজ্ঞতাটাই গল্পের মতো করে বলেন। শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলালেন। শিশুদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া অপরাধেব মতো। তিনি ইশপের একটা গল্প শুরু করলেন।

এক ধোপার একটা গাধা ছিল। গাধাটা একদিন তার নীল মেশানো পানির গামলায় পড়ে গেল। তার গায়ের রং হয়ে গেল নীল…

তৃণা করুণ গলায় বলল, বড় মামা গাধার গল্প শুনতে ভালো লাগছে না।

তাহলে রাখাল বালকের গল্প শুনবি? এক রাখাল বালক মাঠে মেষ চড়াতো। সে ছিল দারুণ মিথ্যাবাদী। একদিন মজা করার জন্যে বলল, বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে…

তৃণা হাই তুলতে তুলতে বলল, শিক্ষামূলক গল্প শুনতে ভালো লাগছে না মামা। অসহ্য লাগছে।

আখলাক সাহেবকে বাধ্য হয়ে গত রাতের গল্পটা বলতে হলো। তবে ব্যাপারটা যে আসলে স্বপ্ন তা তিনি খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। বাচ্চাদের মনে কোনো খটকা থাকা ঠিক না। তৃণা বলল, মামা আমার ধারণা আসলেই কোনো ভূত তোমার কাছে এসেছিল। দেখবে আজও আসবে। আজও আপনা-আপনি বাতি জ্বলবে নিভবে।

আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, সুইচে। গণ্ডগোল ছিল। সুইচ ঠিক করা হয়েছে। আজ আর কিছুই হবে না। তৃণা বলল, আজ আরো বেশি হবে। ভূতটার সাহস বেড়ে গেছে তো। আজ অনেক বেশি গল্প করবে। মনে হয় গান টান গাইবে। ভূতের গান কেমন হয় কে জানে।

আখলাক সাহেব বাসায় ফিরলেন মন খারাপ কবে। গল্পটা তৃণাকে বলা ঠিক হয় নি। মেয়েটার বেশি বুদ্ধি। সে তিলকে তাল করবে। স্কুলে বান্ধবীদের বলবে। তার বান্ধবীদের মনে (বিশেষ কবে দুর্বল চিত্তের যারা) তৃত ব্যাপারটা গেথে যাবে। এইসব জিনিস একবার মনে ঢুকে গেলে মন থেকে বের করা কঠিন হয়। খুবই ভুল হয়েছে।

রাতে তিনি আজ একটু সকাল সকাল ঘুমুতে গেলেন। বাতি নিভিয়ে বিছানায় উঠার সময় মনে হলো আজ আবার বাতি নিভবে না তো? এটা মনে হওয়াতে নিজের উপরই তার রাগ লাগল। তিনি একজন বয়স্ক মানুষ। ভূতেব ব্যাপারটা যদি তার মধ্যেই গেথে যায় বাচ্চাদেব ক্ষেত্রে তার পবিণাম কী ভয়াবহ হবে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। বাতি নিভল না। তিনি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা কবে আসল ঘুমের প্রস্তুতি নিলেন। তাঁর সামান্য আশাভঙ্গও হলো, একটু যেন মন খারাপও লাগছে। তিনি কেন জানি মনে মনে চাচ্ছিলেন বাতিটা আপনা-আপনি জ্বলে উঠুক।

স্যার কি জেগে আছেন, না ঘুমিয়ে পড়েছেন?

কে?

স্যার আমি। বিপদগ্ৰস্ত ভূত। গতরাতে আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হলো। যাবার সময় জামান ভাষায় বললাম–গুটেন নাখট স্লিপেনজি ওয়েল।

ও আচ্ছা তুমি?

আখলাক সাহেব পোশ ফিরলেন। তিনি নিশ্চিত, ব্যাপারটা স্বপ্ন। স্বপ্লেই যা ঘটার ঘটছে। কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষ ঘুরেফিরে দেখে। ছাত্রাবস্থায় তিনি প্রায় প্রতিরাতেই স্বপ্ন দেখতেন। পরীক্ষাব হলে পবীক্ষা দিতে বসেছেন, পকেটে হাত দিয়ে দেখেন কলম আনেন নি। ভূতেব স্বপ্নও সেরকম কিছু হবে।

তুমি তাহলে এসেছ?

জি স্যার।

কাল তো বাতি জ্বালাচ্ছিলে নেভাচ্ছিলে। আজ কিছু করছ না, ব্যাপারটা কী?

নতুন সুইচ লাগালেন এই জন্যেই কিছু করিনি। একটা জিনিস নষ্ট করার কোনো মানে शं न।

তোমার নাম কী?

আখলাক সাহেব হাসির শব্দ শুনলেন। একেই বোধহয় বলে ভৌতিক হাসি। ভয়ে রক্ত জমে যাওয়ার মতো কিছু হলো না। হাসি শুনতে বরং ভালোই লাগছে। সহজ স্বাভাবিক

হাসছ কেন?

ভূত সম্পর্কে মানুষের কত ভুল ধারণা এই ভেবেই হাসি আসছে। আপনাদের নাম আছে বলে আপনাদের ধারণা আমাদেরও নাম আছে। আসলে তা না। ভূতদের স্যার নাম থাকে না।

আখলাক সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তাই নাকি?

কর্মেই আমাদের পরিচয়, নামে নয়।

বলো কী?

সত্যি কথাই বলছি স্যার। যেমন ধরুন বোকা ভূতদের নাম হচ্ছে–বোকা ১, বোকা ২, বোকা ৩, বোকা ৪… যে যত বোকা তার নাম্বার তত বেশি। নাম্বার দেখেই বলে দিতে পারবেন। সে কত বড় বোকা। মানুষের বেলায় এরকম কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তার নাম থেকে বোঝা যায় না। সে বোকা না বুদ্ধিমান।

আখলাক সাহেবের মুখ হা হয়ে গেল। ভূতটা গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের ব্যবস্থা স্যার খুবই বৈজ্ঞানিক।

তোমাদের নিয়মে তোমার নাম কী?

লেখক ৭8।

তুমি লেখক নাকি?

একটু স্যার বদঅভ্যাস আছে।

বদঅভ্যাস বলছি কেন? লেখক হওয়া তো সহজ ব্যাপার না। লেখক ৭8, তার মানে কি তুমি অনেক বড় লেখক?

দুএকটা ছোটখাট পুরস্কার স্যার পেয়েছি। গত বছর পেলাম তৃত শ্রেষ্ঠ পদক। লৌহ পদক। লৌহ পদক স্যার একটা বিরল ঘটনা।

লৌহ পদক পেয়ে গেছ, বলো কী?

আর স্যার আমার একটা রচনা ভুতস্কুলে পাঠ্য হয়েছে। এটাও একটা বিরল সম্মান।

বিরল সম্মান তো বটেই। তুমি কি দাঁড়িয়ে আছ নাকি? বোস, চেয়ারটা টেনে বোস। এতক্ষণ তুমি তুমি করে বলায় আমার তো নিজেরই খারাপ লাগছে।

আপনি স্যার লজ্জা দেবেন না।

তুমি বোস, চেয়ারে বোস।

চেয়ার টানার শব্দ হলো। কেউ একজন চেয়ারে বসল। ঘর অন্ধকার বলে তিনি কিছু দেখতে পেলেন না। আখলাক সাহেব যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভূতত্ত্বলে তোমার যে রচনাটা পাঠ্য সেটা কী?

একটা প্ৰবন্ধ।

নাম কী প্ৰবন্ধটার?

মানুষদের নিয়ে লেখা প্ৰবন্ধ, নাম হলো ইহা মানুষ।

ইন্টারেস্টিং প্ৰবন্ধ বলে মনে হচ্ছে।

স্যার, গবেষণামূলক প্রবন্ধ। শিশুভূতদের জন্যে একটু কঠিন হয়ে গেছে।

তুমি কি প্ৰবন্ধই লেখ না গল্প-উপন্যাসও লেখ?

গল্প লিখি। সম্প্রতি আমার একটা বই বের হয়েছে, মানুষের গল্প।

তুমি ভূত আর তোমার সব লেখালেখি দেখি মানুষদের নিয়ে।

মানুষরা যেমন ভূতের গল্প লেখে আমিও তেমন মানুষের গল্প লিখি।

দেখি একটা গল্প পড়ে শুনাও তো।

তাহলে স্যার বইটা নিয়ে আসি।

নিয়ে আসা দেখি।

ভূত বই আনতে গেল। আখলাক সাহেব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই রাতে তাঁর আর গল্প শোনা হলো না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *