পটকান যখন পটকালো
পটকান পালোয়ান ছিল শেরপুরের গর্ব। সে চেহারা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ষাট ইঞ্চি বুক, আশি ইঞ্চি পেট, গরিলার মতো হাত পা। শরীরটার কোথাও কোনোও ভেজাল নেই। ভুঁড়িখানা ঢালের মতো শক্ত। পটকান পালোয়ান ভূঁড়ি দিয়ে বিস্তর কুস্তিগিরকে চেপে দমসম করে
তিন কুলে পটকান পালোয়ানের কেউ ছিল না। খুব অল্পবয়স থেকে ভীষণ খাই খাই ছিল বলে খিটখিটে বাপ তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। সেই থেকে পটকান বিবাগী। অবশ্য সে বাপ এখন নেই, মাও গত হয়েছেন। পটকান তাই একা আনন্দে থাকে। সকালে দঙ্গলে গিয়ে তেল মাটি মাখে, কসরৎ করে, মুগুর ভঁজে। অসংখ্য ডন-বৈঠক দেয়। একসের ছোলা দিয়ে সকালে জল খায়। বেলা পড়লে রুটির পাহাড় মাংসের পর্বত দিয়ে শেষ করে। বিকেলে একপুকুর দুধ আর এক গামলা বাদাম বাটা খায়, রাতে ফের ঘিয়ের পরোটার বংশ লোপ করে চারটে মুরগি দিয়ে। এর ফাঁকে ফাঁকে এন্তার ডিম, সবজি, মিছরি, শরবৎ চালান হয়ে যায় তার অজান্তে। এসব ছোটোখাটো খাবারগুলো সে খাওয়ার মধ্যে ধরে না।
পটকানের সঙ্গে সেবার লড়তে এল পাঞ্জাবের ভীম সিং, তারও বিশাল চেহারা। খাওয়াদাওয়াও প্রায় পটকানের সমান। জমিদারের কাছারি বাড়িতে লোক ভেঙে পড়ল কুস্তি দেখতে। পটকান ভীম সিংকে তিন মিনিটে চিৎ করে হাত ঝেড়ে বলল–ছেঃ! জমিদারের দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বলল–হুজুর, বেয়াদবি মাপ করবেন। কিন্তু এসব চ্যাংড়া প্যাংড়ার সঙ্গে লড়ার জন্য আমাকে ডাকা কেন?
সবাই ভাবে, ঠিক কথা, কিন্তু মুশকিল হলো পটকান লড়বেই বা কার সঙ্গে? দেশ বিদেশ থেকে যারাই লড়তে আসে, সে যত বড় ওস্তাদই হোক, পটকান তিন মিনিটের বেশি সময় নেয় না। লড়াইয়ের শেষে আবার বলে–ছছাঃ! জমিদারের দিকে চেয়ে অভিমানের সঙ্গে বলে– আনাড়িদের সঙ্গেই কি আমাকে বরাবর লড়তে হবে হুজুর?
জমিদারমশাই মহা সমস্যায় পড়ে বললেন–তা বাপু, তোমার যোগ্য কুস্তিগির পাই কোথায়? এঁরা যারা আসছেন লড়তে তারাও সব নাম ডাকের লোক, কিন্তু তোমার কাছে কেউই ধোপে টেকে না দেখি।
–তার চেয়ে হুজুর বন্দোবস্ত করুন ওরা দুজন করে আসুক লড়তে, আমি একা।
তাই হলো। লড়তে এল বচন পাণ্ডে আর হরি দোসাদ। দুজনকে দু বগলে নিয়ে হা হা করে হেসে ওঠে পটকান। তারপর তাদের মাটিতে ফেলে দিয়ে বলেছেঃ ছেঃ! বলে জমিদারবাবুর দিকে তাকায়–হুজুর, দেশে কি আর মানুষ পাওয়া গেল না!
জমিদারমশাই মিইয়ে গিয়ে বললেন–তাই তো! এরা তো দেখছি তেমন কিছু নয়। অথচ শুনেছিলাম এরা কিলিয়ে পাথর ভাঙে, পাঁচ মন ওজন তোলে এক এক হাতে, হাতি বুকে নেয়। সে সব তো গল্প কথা নয় বাপু, নিজের চোখে দেখেই এনেছি। আচ্ছা দেখি তোমার উপযুক্ত যদি কাউকে পাই।
এরপর তিন পালোয়ান লড়তে এল একসঙ্গে। ভীষণ ভীষণ তাদের চেহারা। গোল্লা গোল্লা করে চায় আর দাঁত কিড়মিড় করে। তা সেই তিনজন যখন লড়তে নামল তখন বেলুন চুপসে আমসত্ত্ব হয়ে গেল ফের। তিনটেকে নিয়ে খানিক লোফালুফি খেলল পটকান, চেঁচিয়ে জমিদার মশাইকে বলল–হুজুর, যখন বলবেন তখনই তিনজনকে মাটিতে ফেলব।
ফেললও তাই, তিনবার ছোঃ দিয়ে জমিদারমশাইয়ের দিকে তাকাতেই জমিদারমশাই বেজায় ভয়-খাওয়া মুখ করে মিন মিন করলেন–তাই তো বাপু, এ তো বড় মুশকিলে ফেললে তুমি। খুব বড় একটা শ্বাস ফেলে পটকান বলল–এরকম চললে আমাকে সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যেতে হবে দেখছি।
এই কথায় সবাই ভারী চিন্তিত হয়ে পড়ে। জমিদারমশাইযের একেই হার্টের ব্যামো, বাঁ পায়ে বাত ব্যাধি, রক্তচাপের রোগ, রাত্রে ভাল ঘুম হয় না, পেটটা ভুটভাট করে সব সময়ে। তার ওপরে পটকানের এই কথা শুনে তিনি প্রায় অন্নজল ছাড়েন আর কি! শেরপুরের গর্ব পটকান পালোয়ান সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেলে লজ্জার সীমা থাকবে না।
শেরপুরের লোকেরা ভীষণ বিমর্ষ। পটকানের সঙ্গে কেউ লড়ে পারে না সে ঠিক, কিন্তু তা বলে একটু লড়াই হবে তো, কিছুক্ষণ কোস্তাকুস্তি করে তবে চিৎ হবি। এ যেন সব হেরোর দল মাটি নেওয়ার জন্যই আসে। এইসব হেরোর দলকে শেরপুরের লোকেরা হারু বলে উল্লেখ করে। জেতে বলে পটকানের নাম তারা দিয়েছে জিতেন। সবাই বলাবলি করে–জিতেনের সঙ্গে এবার কোন্ হারু লড়তে আসছে রে?
তা এল এবার। সারা দেশে লোক পাঠিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে মানুষের চেহারার দশজন দানবকে ধরে আনা হলো। তিনদিনে তারা শেরপুরের সব খাবার খেয়ে ফেলল প্রায়। চারদিকে দুর্ভিক্ষের অবস্থা। দশ পালোয়ান বাঘের মতো গর-র-আওয়াজ ছাড়ে, মানুষের ভাষায় কথাই বলে না। দিনমানে তারা নিজেদের সামলাবার জন্য নিজেরাই নিজেদের শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে। ভীষণ রাগী, কখন কার ঘাড় মটকে দিয়ে জেল হয়। তবু শেষ রক্ষা হয় না বুঝি। তাদের যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল তা মজবুত পাকা ঘর। তবু দশ পালোয়ানের নড়াচড়ায় মেঝে দেবে গেল, দেওয়াল ভেঙে গেল একধারের। হাঁকডাকে চারধারে ভূমিকম্প হলো কয়েকবার।
লড়াইয়ের দিন চারটে রথযাত্রার ভীড় ভেঙে পড়ল কাছারি বাড়িতে। হুলুস্থুল কাণ্ড। দশ দানব দঙ্গলের মাটি কাঁপিয়ে এসে ঢুকল একসঙ্গে। দশজনের সঙ্গে একা লড়বে পটকান।
চোখে দেখেও কারো বিশ্বাস হচ্ছিল না ব্যাপারটা। পটকান দঙ্গলে ঢুকে গুরু প্রণামটা সেরে নিল কেবল। তারপরই দেখা গেল সে এক একটা দানবকে ধরে পটাপট ভীড়ের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, ঠিক যেমন গদাই মালি বাগানের আগাছা তুলে ছুঁড়ে দেয় বেড়ার বাইরে। দু মিনিটে দশ পালোয়ান সাবাড় করে ঠিক দশবার ছোঃ দিল পটকান। তারপর ভীষণ অভিমানের চোখে তাকাল জমিদারমশাইয়ের দিকে। বলল–হুজুর–
রোগা-ভোগা জমিদারমশাইয়ের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে অপমানে। তিনি কয়েকবার গলা খাকারি দিলেন।
পটকান বলল, হুজুর, এরা সব কারা এসেছিল হুজুর? এসব রোগা দুবলা তোক কোত্থেকে আনলেন?
হঠাৎ জমিদারমশাই চেঁচিয়ে উঠলেন–চোপরাও বেয়াদব। রোগা দুবলা লোক? আঁ? রোগা দুবলা লোক এরা সব!
বলতে বলতে রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে জমিদারমশাই বাত ব্যাধির কথা ভুলে, হার্টের ব্যামোর কথা বিস্মরণ হয়ে, রক্তচাপকে পরোয়া না করে, পেটের ভুটভাটকে উপেক্ষা না করে এক লাফে এগিয়ে এলেন দঙ্গলের মাটির ওপর।
কিছুতেই তোমার শিক্ষা হয় না, অ্যাঁ–বলতে বলতে জমিদারমশাই পটকানের ঘাড়টা ধরে এক ঝটকায় তুলে ফেললেন মাথার ওপরে। তারপর সে কী বাই বাই করে ঘোরাতে লাগলেন, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
পটকান প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে তখন–বাবা গো! গেলাম গোয় মেরে ফেললে গো! কে কোথায় আছো ছুটে এসো!
কে শোনে কার কথা! কয়েকবার আচ্ছাসে ঘুরিয়ে জমিদারমশাই পটকানকে এক বেদম আছাড় মারলেন। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন–ছোঃ!