Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড || Shirshendu Mukhopadhyay

কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড || Shirshendu Mukhopadhyay

শশীদাদুর হাতটা

শশীদাদুর হাতটা যতদিন ক্রিয়াশীল ছিল, ততদিন এলাকাটা ছিল শান্তির জায়গা। চোর, ডাকাত, গুণ্ডাদের উৎপাত ছিল না। কেউ কোনও অন্যায় কাজ করার আগে দু’বার ভাবত। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ছিল খুবই ভাল। সবাই বলত, কুঞ্জপুকুরের মতো এমন নিরাপদ জায়গা আর হয় না।

কিন্তু শশীদাদুর হাত ঝিমিয়ে পড়ার পর থেকেই কুঞ্জপুকুরের আশপাশে যেন পাজি বদমাশদের মাথাচাড়া দেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সবই অবশ্য ছোটখাটো ঘটনা, আমল না দিলেও চলে। কিন্তু এগুলো হচ্ছে পূর্বলক্ষণ। চোর-বদমাশরা একটু বাজিয়ে দেখছে পরিস্থিতিটা। এই তো সেদিন হাফিজুল মিঞা হরিপুরের হাট থেকে সন্ধের পর ফিরছিল। রাম দত্তর বাঁশবনের ভেতর দিয়ে আসার সময় কে যেন তার মাথার চুবড়ি থেকে টুক করে ডালের পোঁটলাটা সরিয়ে ফেলল। আবার দিন-দুই পরেই হরিবল্লভ রায় বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। বড় ঝিলের ধারে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ একটা মুষকো মতো লোক কোথা থেকে এসে তাঁর হাতের রুপোর বাঁধানো লাঠিখানা কেড়ে নিয়ে হাওয়া।

সরকারবাড়ির ঘটনাটাও খারাপ। সেদিন মাঝরাতে সরকারবাড়ির একতলার জানলা ভেঙে চোর ঢুকেছিল। লোকজন উঠে পড়ায় বেশি কিছু নিতে পারেনি, দুটো কাঁসার থালার ওপর দিয়ে গেছে।

কিন্তু কথা হল, শশীদাদুর হাত যদি ক্রিয়াশীল থাকত, তা হলে এসব হতেই পারত না। কুঞ্জপুকুরের মোড়ল-মুরুব্বিরা এবং আশপাশের সাত গাঁয়ের লোক চিন্তায় পড়ে গেছে। ঘন-ঘন সবাই বৈঠকেও বসছে। নন্দ কবিরাজকেও ডাকা হয়েছে বৈঠকে। নন্দ কবিরাজ বলছে, “শশীখুড়োর বয়স এই একশো সাত পুরে একশো আট বছর চলছে। এত বয়সের মানুষ সম্পর্কে কোনও ভরসা দেওয়া যায় না। তবে আমি সাধ্যমতো চিকিৎসা করে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়!”

শশীদাদু থাকেন একখানা খোলামেলা ঘরে। পাশেই মস্ত বাগান, হরেক ফুল, হরেক গাছ সেখানে। শশীদাদুর ঘরে মস্ত মস্ত জানলা। অনেক আলো-হাওয়া খেলে। জানলার পাশেই একটা মস্ত চৌকিতে শশীদাদু শুয়ে থাকেন সারাদিন। মস্ত চুল আর দাড়ি, সব সাদা ধবধব করছে। শশীদাদুর গায়ের রঙও খুব ফরসা, লম্বা শীর্ণ চেহারা। ক’দিন আগেও তিনি যুবকের মতো দ্রুতপায়ে এ-গাঁ ও-গাঁ ঘুরে বেড়াতেন। সকলের খোঁজখবর করতেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল, কোনও অসুখেই হোক, বা বার্ধক্যের জন্যই হোক, উনি একেবারে শয্যা নিয়েছেন। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। সবসময়ে চোখ বোজা। ডাকলে সাড়া দেওয়া দূরের কথা, চোখ মেলে তাকান না পর্যন্ত। শশীদাদুর মেয়ে বিধবা ক্ষান্তমণিই তাঁকে আগলে রাখে।

শশীদাদু শয্যা নেওয়াতে সকলেরই মনখারাপ। বিশেষ করে গাঁয়ের ছেলেপুলেরা। শশীদাদু রোববারে চণ্ডীমণ্ডপে বাচ্চাদের

নিয়ে ভারি ভাল একটা আসর জমাতেন। তাতে গল্প, ম্যাজিক, ধাঁধা, কত কী হত! সব বন্ধ হয়ে আছে। আর শশীদাদুর সেই বিখ্যাত হাতখানাও বিছানার পাশে একটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে চুপচাপ। নড়েও না, চড়েও না।

হাতটা দেখতে হাত-ভরা একটা দস্তানার মতো। সলিড জিনিস। সাইজেও বেশ বড়, সাধারণ মানুষের পাঞ্জার দেড়গুণ হবে। কবজির কাছটা কাটা। কাটা অংশের কোনও ফাঁকফোকর নেই। যেন রবারে তৈরি জিনিস। রঙখানা ধবধব করছে সাদা।

ইতিবৃত্তান্ত কেউ কিন্তু জানে না। শশীদাদু কখনও কিছু বলেন। হাতটা নিয়ে প্রশ্ন করলে মিটিমিটি হাসেন আর বলেন, “দুনিয়ায় কত আশ্চর্য ব্যাপার আছে।”

হাতটা নিয়ে গাঁয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। হরিবল্লভ রায় বলেন, “শশীখুড়ো ভবঘুরে লোক। সারা পৃথিবী চষে বেরিয়েছেন। জাহাজে, এরোপ্লেনে, রেলগাড়িতে, মোটরে, সাইকেলে আর পায়ে হেঁটে কোনও জায়গা বাকি রাখেননি। দুর্গম সব অঞ্চলে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ঘুরতেন। একবার আপস পাহাড়ে ওঠার সময় একজন পর্বতারোহীকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন। পর্বতারোহী এক সাহেব। পাহাড়ের একটা খাঁজ ধরে ঝুলছিল। শশীখুড়ো তার ডান হাতখানা শক্ত করে ধরে যখন টেনে তুলবার চেষ্টা করছিলেন তখন বুঝতে পারেননি যে, সাহেব আসলে অনেকক্ষণ আগেই ঠাণ্ডায় জমে মারা গেছে। হাতটা ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে যাওয়ায় দেহটা পড়ে যায়নি। কিন্তু যেই শশীখুড়ো টেনে তুলতে গেলেন, তখনই টানাহ্যাঁচড়ায় হাতটা শরীর থেকে খসে এল। সাহেবও পড়ে গেল নিচে। তবে হয়েছিল কী, সাহেবের আত্মাটা আশপাশেই ঘুরঘুর করছিল। শরীরের একটা মায়া আছে তো, সহজে ছাড়তে চায় না। আত্মাটার খুব ইচ্ছে ছিল শরীরে আবার ঢুকে পড়ে। কিন্তু শরীরটা পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ায় আত্মাটা তখন বাধ্য হয়ে হাতটার মধ্যেই ঢুকে পড়ল।”

দিনু সরকার অবশ্য বলেন, “ওরে না, না। ও গল্প ঠিক নয়। শশীজ্যাঠার যৌবনে গায়ে ছিল পেল্লায় জোর। আমরাও দেখেছি, শশীজ্যাঠা একবার একটি বড় আমগাছ স্রেফ জাপটে ধরে টেনে উপড়ে ফেললেন। একবার তো কেঁকি তুলে সেইটে বনবন করে ঘোরাতে-ঘোরাতে একদল ডাকাতকে তাড়া করেছিলেন। তা হয়েছিল কী, সেবার আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে-বেড়াতে এক মস্ত গরিলার মুখে পড়ে গিয়েছিলেন। শশীজ্যাঠা তার সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়ায় না গিয়ে বন্ধুত্ব পাতাতে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন, বললেন, মিস্টার গরিলা, হাউ আর ইউ? কিন্তু গরিলাটা ছিল ত্যাঁদড়। হ্যান্ডশেক করার ভান করে সে শশীজ্যাঠার হাত ধরে এমন হ্যাঁচকা টান মারল যে, শশীজ্যাঠা উলটে পড়লেন। তারপর আবার শশীজ্যাঠাকে হাত ধরে আর-একটা আছাড় মেরেছিল সে। শশীজ্যাঠার খুব রাগ হল। গরিলার এত সাহস! তিনিও তখন দিলেন হ্যাঁচকা টান। ব্যস, গরিলার হাত কবজি থেকে খসে শশীজ্যাঠার হাতে চলে এল, আর গরিলা ব্যাটা ‘বাপ রে, মা রে’ বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে হাওয়া! শশীজ্যাঠা হাতটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেন। অনেকদিন বাদে গরিলাটা মারা যায়। তার আত্মাটা শশীজ্যাঠার কাছে ক্ষমা চাইতে আসে। তখন শশীজ্যাঠা আত্মাটাকে ওই হাতটার মধ্যে ভরে রাখেন।”

রতন বোস বিজ্ঞানের শিক্ষক, তিনি এসব গল্প শুনে নাক সিঁটকে বলেন, “ভূতপ্রেত, আত্মা বলে কিছু নেই। ওসব গাঁজাখুরি গল্প। আসলে হাতটা হল রোবট। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলার একজন ইহুদি বৈজ্ঞানিককে আটক করে খুব অত্যাচার করেন। তারপর তাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে একটা আবিষ্কারের কাজে লাগান। হিটলারের খুব ইচ্ছে ছিল, চার্চিলের মোটা নাকে কষে একখানা ঘুসি বসান। কিন্তু চার্চিলের নাক তো আর তাঁর নাগালের মধ্যে নয়। তাই ওই হাতখানা তাঁর দরকার ছিল। ইহুদিদের বিজ্ঞানে খুব মাথা। সেই বৈজ্ঞানিক কয়েক মাসের চেষ্টায় এই আশ্চর্য হাত আবিষ্কার করে ফেললেন। কিন্তু বিপদ হল, একদিন হিটলার যখন বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটরিতে হাতটা কতদূর হল জানতে গেছেন, তখন হাতটা পট করে লাফিয়ে উঠে হিটলারের নাকেই একখানা ঘুসি বসিয়ে দেয়। হিটলার তো প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বৈজ্ঞানিককে পাঠিয়ে দিলেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। হাতখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ডাস্টবিনে। শশীদা তখন জার্মানিতেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। যুদ্ধের বেড়াজালে আটকে পড়ে পালানোর পথ খুঁজছেন। হাতটা তিনিই একদিন কুড়িয়ে পেলেন। হাতটা যে সামান্য নয়, তা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি। হিটলার যে এরকম একটা কিছু আবিষ্কার করতে একজন বৈজ্ঞানিককে লাগিয়েছিলেন, তাও শুনেছিলেন। তখন তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নাৎসি সোলজার সেজে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গিয়ে সেই বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে দেখাও করেন। বৈজ্ঞানিক তাঁকে হাত সম্পর্কে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দেন। তবে তিনিও হাতটার কার্যকারিতা যে কতটা, তা ভাল করে বুঝে উঠতে পারেননি। দুঃখের বিষয়, সেই বৈজ্ঞানিককে সেইদিনই গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হয়। হাতটার এলেম বুঝতে এবং শিখতে শশীদার আরও কয়েকদিন সময় লেগেছিল। নইলে ওই হাত দিয়েই বৈজ্ঞানিককে উদ্ধার করতে পারতেন। শুধু তাই নয়, ওই হাতখানা দিয়েই হিটলারকে তাঁর নাৎসিবাহিনী-সহ জব্দ করা যেত।”

কুঞ্জপুকুরের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি হলেন মহিম ঘোষ। একশো পনেরো পার হয়ে ষোলোয় পড়েছেন। তিনি বলেন, “ওরে, চার্চিলের নাকখানাই এমন যে, সকলেরই ঘুসি মারতে ইচ্ছে করবে। তাই বলে ওই রোবটের গল্পটা আবার তোরা বিশ্বাস করে বসিসনি। ও কার হাত, সবাই না জানলেও আমি জানি। জাদুকর রাখহরি মজুমদার ছিলেন নমস্য পুরুষ। কী যে মারাত্মক খেলা দেখাতেন, তা বলার নয়। অশৈলী সব কাণ্ডকারখানা। সাগরদিঘির জল এক চুমুকে খেয়ে ফেললেন। আকাশে সবুজ মেঘ ভাসিয়ে আনলেন। শূন্যে পায়চারি করা তো ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। হাতখানা তাঁরই। রাখহরি মজুমদার শেষ যে-খেলাটা দেখিয়েছিলেন সেটা হয়েছিল ওই কুঞ্জপুকুরেই। হাই স্কুলের মাঠে শামিয়ানা টাঙিয়ে খেলা হচ্ছিল। দুর্দান্ত-দুর্দান্ত সব ম্যাজিক দেখানোর পর বললেন, ‘এইবার আমার শেষ খেলা। বলে স্টেজের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর একে-একে তাঁর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খসে-খসে পড়ে যেতে লাগল, মুণ্ডু গেল, হাত গেল, পা গেল, বুক আর পেট কিছুক্ষণ শুন্যে ভেসে থেকে তারপর খসে পড়ল। শুধু গলার স্বরটা শোনা গেল, রাখহরি বলছিলেন, “আমার মৃত্যু নেই। আমি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলাম। বাস্তবিকই তাই, আমরা হুড়মুড় করে স্টেজে উঠে দেখলাম, একমাত্র ডান হাতের পাঞ্জাখানা ছাড়া আর কিছুই নেই। সব অদৃশ্য। রাখহরিকে আর পৃথিবীতে দেখাও যায়নি কখনও। ওই হাতখানা গোলেমালে কুড়িয়ে নিয়েছিল আমাদের শশীভায়া। তাতে দস্তানা পরিয়ে নিয়েছে, এই যা। রাখহরি মজুমদারই এই হাতখানায় মাঝে-মাঝে ভর করে।”

শশীদাদুর হাত নিয়ে আরও নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। কোনটা সত্যি, কোনটা নয়, কে বলবে? হাতের রহস্য যা-ই হোক, হাতটা এখানকার মানুষের পরম বন্ধু। কেউ কোনও মুশকিলে পড়ে শশীদাদুর কাছে গিয়ে হাজির হলেই হল, শশীদাদু অমনই তাঁর হাতটাকে মুশকিল আসান করতে পাঠিয়ে দিতেন।

ওস্তাদ বিলু খাঁ সেবার পাশের গাঁ হরিহরপুরে জমিদারবাড়িতে গান গাইতে এলেন। কিন্তু গানের দিন সকাল থেকেই তাঁর তবলচির ম্যালেরিয়া। সে কাঁপতে কাঁপতে সাতখানা লেপ চাপা দিয়ে চি-চি করছে। অথচ এদিকে আসর-ভর্তি সব গণ্যমান্য লোক। বহু দূর-দূর থেকে সব এসেছেন। কিন্তু তবলচি ছাড়া গান হবেই বা কী করে? আসরে দু-চারজন তবলচি যে না ছিল, তা নয়, তবে তারা বিলু খাঁর সঙ্গে বাজানোর সাহস রাখে না। একজনকে ধরেবেঁধে তবলায় বসানো হল বটে, কিন্তু বাঘা ওস্তাদ বিল্ল খাঁয়ের ভয়ে তাঁর দাঁতে-দাঁতে এমন খটখটি হতে লাগল যে, বাধ্য হয়ে তাকে তুলে দিতে হল। এদিকে তবলচির অভাবে আসর পণ্ড হওয়ার জোগাড়। জমিদার রাঘব রায়চৌধুরী তখন শশীদাদুকে ডেকে বললেন, “আপনি না বাঁচালে আর উপায় নেই। আমার লজ্জায় মাথাকাটা যাবে।”

শশীদাদু বললেন, “তবলা বাজাতে তো দুটো হাত লাগে, আমার তো মোটে একটা হাত। দেখা যাক চেষ্টা করে।”

তা হাত তো চলে এল। কিন্তু হাত দেখে ওস্তাদজি এমন হাঁ হয়ে গেলেন যে, আধঘণ্টা তাঁর গলা দিয়ে শব্দই বেরোল না। পরে তাঁকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শরবত-পান ইত্যাদি খাইয়ে একটু সুস্থ করে তোলা হল। গানও তিনি ধরলেন বটে, কিন্তু সুর লাগাতে পারছিলেন না। কিন্তু যখন তবলায় বোল ফুটতে শুরু করল তখন ওস্তাদজীর গানেও সুর লেগে গেল। একখানা হাত যে একই সঙ্গে ঝড়ের গতিতে তবলা আর ডুগিতে যাতায়াত করে এরকম দুরূহ বোল তুলতে পারে, তা চোখে না দেখলে এবং কানে না শুনলে বিশ্বাস হওয়ার কথাই নয়। গানের শেষে ওস্তাদজী খুশি হয়ে বললেন, “বহু তবলচি দেখেছি, কিন্তু এরকম সঙ্গত আর পাইনি।”

ভৈরবী নদীতে সেবার বর্ষাকালে নৌকোডুবিতে অন্তত ষাট-সত্তরজন তলিয়ে গিয়েছিল। সেই ভীষণ স্রোতে কারও বাঁচার আশা ছিল না। শশীদাদুর হাত টপাটপ জলে ডুবে এক-একজন ডুবন্ত মানুষকে চুলের মুঠি ধরে তুলে এনে তীরে ফেলতে লাগল। একটা মানুষকেও মরতে দেয়নি।

তবে হাতের সবচেয়ে বড় অবদান হল কুঞ্জপুকুরের পুব দিকে শ্মশানঘাটের কাছে পঞ্চবটীর কুখ্যাত ডাকাত সর্দার ভীম দাসকে ঢিট করা। ভীম দাস ছিল এলাকার ত্রাস। ডাকাতি করার জন্য তার রাতের অন্ধকার দরকার হত না। দিনমানেই গিয়ে যে-কোনও বাড়িতে লুটপাট করে আসত। দারোগা-পুলিশও তাকে যমের মতো ভয় খেত।

সারা পৃথিবী ঘুরে যেবার শশীদাদু গাঁয়ে ফিরলেন, সেবারকার ঘটনা। গাঁয়ের পরেশ পাল গরিব মানুষ। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরেশবাবু অতি কষ্টে ধার-দেনা করে মেয়ের জন্য গয়না গড়িয়েছেন। সেই গয়নায় সাজিয়ে মেয়েকে বিয়ের আসরে নিয়ে এসেছেন। এমন সময়ে ভীম দাস দলবল নিয়ে রে-রে করে হাজির। ডাকাতদের হাতে সড়কি, বল্লম, টাঙি, খাঁড়া, বন্দুক দেখে নিমন্ত্রিতরা পালিয়ে গেল। বরযাত্রীরা গিয়ে ঝাঁপ খেল পুকুরে। বরকতা সুপুরিগাছে উঠে পড়লেন। বরও পালানোর চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু গাটছড়া বাঁধা থাকায় পারেনি। ভীম দাস কনের গা থেকে গয়না খুলে নিল, বরকে দিয়ে পা টেপাল, তারপর দলবল নিয়ে নেমন্তন্নবাড়ির সব আনন্দ মাটি করে দিয়ে রওনা

দিল। ঠিক সেই সময়ে শশী গাঙ্গুলি এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। বললেন, “কেমনধারা লোক মশাই আপনি? একটা মেয়ের বিয়ে পণ্ড করে দিলেন? এমন একটা শুভ কাজে বিঘ্ন ঘটানো কি মানুষের কাজ?”

লোকটার স্পর্ধা দেখে ভীম দাস এমন অবাক হল, কিছুক্ষণ বাক্য বেরোল না। তারপর একটা হুঙ্কার দিয়ে সে বলল, “কার সঙ্গে কথা বলছিল, জানিস?”

শশী গাঙ্গুলি একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বললেন, “জানি। আপনি একটা ছুঁচো, ডাকাতদের মধ্যেও অনেক সহবত জানা ডাকাত আছে, তারা অনেকে দান-ধ্যানও করে। কিন্তু আপনি একটি নোংরা লোক। ভাল চান তো গয়নাগাটি, বাসনকোসন সব ফিরিয়ে দিন। নইলে ভাল হবে না।”

এই কথা শুনে ভীম দাসের সে কী অট্টহাসি! হাসির দমকে ঝাড়বাতি অবধি দুলতে লাগল, কুকুরেরা কেঁউ-কেঁউ করতে করতে পাড়া ছেড়ে পালাল।

হাসি থামার পর ভীম দাস মোলায়েম গলায় বললে, “ফিরিয়ে দিলে কী করবি? মারবি নাকি রে? অ্যাাঁ। মারবি? তা মারবি যে, হাতে তো একটা লাঠিও নেই দেখছি। আর ওই রোগাপটকা হাত দিয়ে যদি মারিসও, তা হলে যে তোর হাতটাই জখম হবে। আমার এই শরীর এত শক্ত যে, বল্লম অবধি গাঁথতে চায় না। আয় না, কাছে আয়, একটু ধরেই দেখ না আমার হাতখানা, আমার গা টিপে দ্যাখ।”

শশী গাঙ্গুলি ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বললেন, “তোমার মতো পাপীকে ছুঁলে চান করতে হবে। এই শীতের রাতে আমি তা পেরে উঠব না বাপু। যা বলছি ভালয়-ভালয় করো, গয়নাগাটি যার যা নিয়েছ সব ফিরিয়ে দাও, তারপর নাকে খত দিয়ে বাড়ি যাও। আর ডাকাতি-টাকাতি কোরো না, কথা না শুনলে মুশকিল আছে।”

ভীম দাসের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাতের তলোয়ারখানা তুলে তবে রে’ বলে বনবন করে কয়েক পাক ঘুরিয়ে সে শশী গাঙ্গুলির ওপর লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, লাফ মেরে সে সেই যে শূন্যে উঠল, আর নামল না। দেখা গেল ভীম দাস ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে তো উঠেই যাচ্ছে। ভীম দাসের চোখ ছানাবড়া, হাত-পা ছুঁড়ছে আর চেঁচাচ্ছে “ওরে তোরা আমাকে নামা, নামা। এসব কী হচ্ছে! পড়ে যাব যে। আমার ঘাড়টা এমন সাপটে ধরেছে কে বল তো?” ঘাড়ে যে হাতখানা চেপে বসেছে, তাকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করল ভীম দাস। পারল না। প্রায় তিনতলা সমান উঁচুতে তুলে তারপর খানিক দূর নিয়ে গিয়ে হাতটা দুম করে ছেড়ে দিল তাকে। আর ভীম দাস তার পর্বতপ্রমাণ শরীরটা নিয়ে গদাম করে পড়ল পুকুরে। ফলে পুকুরে সমুদ্রের মতো ঢেউ উঠল। এই দৃশ্য দেখে ডাকাতরা চো-চাঁ দৌড়তে শুরু করল। কিন্তু পারল না।

দুমদাম ঘুসি খেয়ে সব ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল। মাত্র কয়েক মিনিটেই কাজ শেষ।

এর পর ঘাবড়ে-যাওয়া ডাকাতরা শশী গাঙ্গুলির হুকুমে বরযাত্রীদের খাওয়ার সময় পেছনে দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করল, এঁটো পরিষ্কার করল, কুয়ো থেকে জল তুলে আনল। স্বয়ং ভীম দাস আর তার পয়লা নম্বর শাগরেদ বটু কীর্তনিয়া বরকতা আর কন্যাকতার পা টিপল বসে বসে। শেষমেশ বিয়েবাড়ির নেমন্তন্নও তারা খেল। যাওয়ার সময় ভীম দাস বিনয়ে বিগলিত হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে শশীদাদুকে বলল, “জিনিসটা বড়ই সরেস ওস্তাদজি, আমার দু’ঘড়া খাঁটি মোহর আছে, যদি জিনিসটা দেন তো দু’ঘড়া মোহরই আপনাকে প্রণামী পাঠিয়ে দেবখন। এরকম একখানা জিনিস থাকলে আমার কাজকারবারে বড় সুবিধে হয়। রোজ-রোজ ঝুটমুট লোকজনের ওপর হামলা-হুঁজ্জত করতে আমারও আর ভাল লাগছে না। হাতখানা পেলে তাকে দিয়েই সব কাজকারবার করাব, আর আমি বসে বসে টাকা আর মোহর গুনব।”

শশী গাঙ্গুলি একটু হেসে বললেন, “এ তো খুব ভাল প্রস্তাব। আগে নাকে খতটা দাও, তারপর হাতজোড় করে সকলের কাছে। কবুল করো যে, আর জীবনে ডাকাতি করবে না, তারপর কথা হবে।”

ভীম দাস নাকে খত দিল, কবুলও করল।

“এবার দু’ঘড়া মোহর নিয়ে এসো।”

ভীম দাসের শাগরেদরা তক্ষুনি গিয়ে মোহর নিয়ে এল। শশী গাঙ্গুলি খুশি হয়ে বললেন, “দুঘড়া মোহরে অনেক কাজ হবে। গাঁয়ের রাস্তাঘাট মেরামত, পুকুর সংস্কার, গরিব মেয়েদের বিয়ে, গরিব ছেলেদের লেখাপড়া শেখা, আরও কত কী! ওহে ভীম দাস, যাও, হাতখানা তুমিই নিয়ে যাও।”

ভীম দাস মহা উল্লাস করতে করতে ফিরে গেল হাতখানা নিয়ে। দু’দিন বাদে এক সকালে হাতখানা নিয়ে শশী গাঙ্গুলির পায়ে এসে আছড়ে পড়ে বলল, “হাত ফেরত নিন ওস্তাদজি, গত দু’দিন আমাকে দিনে রাতে তিষ্টোতে দেয়নি। খেতে বসেছি, অমনই হতচ্ছাড়া এসে এমন কাতুকুতু দিল যে, খাওয়া মাথায় উঠল! ঘুমোতে গেলেই মাথায় এসে তবলা বাজায়। শাগরেদদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছি, কথা নেই বাত নেই হঠাৎ এসে গলা টিপে ধরল। গতকাল ডাকাতি করতে বেরোতে যাচ্ছি ব্যাটাকে সঙ্গে নিয়ে, এই দেখুন গালে এমন চিমটি দিয়েছে যে, কালশিটে পড়ে গেছে। এ-বেয়াদব হাত আমার চাই না। আমার দলও ভেঙে যাচ্ছে। বিয়েবাড়ির ঘটনার পর থেকে আমাকে আর কেউ মানছেও না। আমি আমার মামাশ্বশুরের গাঁ মনসাপোঁতায় চলে যাচ্ছি। চাষবাস করেই বাকি জীবন খাব।”

তা শশীদাদুর সঙ্গে-সঙ্গে সেই হাতখানাও ঝিমিয়ে পড়ায় তল্লাটে মহা দুশ্চিন্তা।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress