Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay

অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay

ভাইপো মানিক

ভাইপো মানিক একটা পেল্লায় মোটরবাইক কিনেছে, আর সেইসঙ্গে একটা ঝ চকচকে নতুন হেলমেট। মোটরবাইকটায় দারুণ শব্দ হয়। ভটভট করে সারা শহর দাবড়ে বেড়ায় মানিক। নন্দবাবু এটা লক্ষ্য করেছেন। ভাইপো মানিককে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন না। কারণ মানিক ভূত, ভগবান আর মাদুলিতে বিশ্বাস করে না। কোষ্ঠী বা কররেখা বিচার সম্পর্কে তার মতামত শুনলে যে-কোনও জ্ঞানী মানুষেরই মাথায় খুন চাপবার কথা। সাধু সন্ন্যাসী ফকির ইত্যাদির প্রতি মানিকের ব্যবহার মোটেই ভদ্র নয়। সেই কারণেই মানিকের ওপর নন্দবাবু খুশি নন। তবে তিনি নিজে সাতে-পাঁচে থাকেন না। কারও সঙ্গে তর্ক করতে ভালবাসেন না। মানুষকে ক্ষমা করতে তিনি সর্বদাই প্রস্তুত। কিন্তু মুশকিল হল, ইদানীং মানুষ ক্ষমাটমা বিশেষ চায় না।

যাই হোক, নন্দবাবু মানিকের মোটরবাইক এবং হেলমেটটা লক্ষ করছেন ক’দিন ধরেই। না, মোটরবাইকটাকে ততটা নয়, যতটা লাল টুকটুকে চমৎকার হেলমেটটাকে। নন্দবাবু এমনিতে সাধুগোছের লোক। বিয়ে-থা করেননি। কায়কল্প প্র্যাকটিস করেন। তার এক ভৌত ক্লাব আছে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সেখানে কয়েকজন মিলে ভূত-প্রেত নিয়ে গবেষণামূলক কাজকর্ম করেন। সপ্তাহে দুদিন জ্যোতিষচর্চা আর দু’দিন ধর্মালোচনা। রবিবারটা নন্দবাবু মৌন থাকেন, উপবাসও করেন। জাগতিক মায়া-মোহ তাঁর বিশেষ নেই।

কিন্তু মানিকের লাল টুকটুকে হেলমেটটা দেখার পর থেকেই নন্দবাবু ভারি উচাটন হয়ে পড়েছেন। হেলমেটটা নাকি আছাড় মারলেও ভাঙবে না, এমন শক্ত কাঁচতন্তু দিয়ে তৈরি। সামনে আবার প্লাস্টিকের ঢাকনা আছে। কানে ইয়ার-প্লাগ লাগানোর ব্যবস্থা আছে, যাতে ইচ্ছে করলেই বধির হয়ে থাকা যায়। এইসব শোনার পর থেকেই নবাবুর কেমন যেন মনটা চঞ্চল হচ্ছে। ভারি ইচ্ছে হচ্ছে হেলমেটটা একবার চুরি করে হলেও মাথায় দেন।

অনেকভাবে মনকে সংযত করতে চেষ্টা করেছেন নবাবু। কিন্তু কোনও কাজই হয়নি।

মনকে বলেছেন, “ওরে মন! সবই তো ছেড়েছিস, পৃথিবীর যত মায়া-মোহ বিসর্জন দিয়ে অনেক ওপরে উঠে পড়েছিল গ্যাস-বেলুনের মতো। তা হলে কেন রে ওই তুচ্ছ হেলমেট তোকে টনছে?”

মন সঙ্গে সঙ্গে কুপিত হয়ে জবাব দেয়, “দ্যাখো হে নন্দবাবু, তুমি ভীষণ ঘড়েল লোক। আমাকে গ্যাস-বেলুন বানিয়ে দিব্যি নিজে গাট হয়ে বসে বসে মজা দেখছ। আরে বাপু, ত্যাগ যে করবে, ত্যাগের আগে তো একটু চেখে দেখতে হবে যে, যে-জিনিসটা ত্যাগ করছি সেটা কীরকম।”

“তা তো বটে রে বাপু, কিন্তু ওরে মন, হেলমেট আর এমন কী-ই বা জিনিস!”

“আগে জিনিসটা পরো, দ্যাখো, ওটা দিয়ে কী কাজ হয়, তারপর না হয় একদিন ত্যাগ করে দিও।”

নন্দবাবু সুতরাং হার মানলেন।

শীতকাল। মানিক বাড়িতে নেই। তার মোটরবাইকটাও নেই। শুধু হেলমেটটা পড়ে আছে অবহেলায়। বাড়িতে আজ পিঠে-পায়েস তৈরি হচ্ছে হই হই করে। এলাহি কাণ্ড। সন্ধের সময় নন্দবাবু তার ভুতুড়েক্লাবে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর হেলমেটটার দিকে নজর পড়ল। বারান্দার একটা হুকে সেটা ঝুলে আছে।

দরজার কাছ থেকে ঘরে ফিরে এলেন নন্দবাবু। লোভে বুকটা দুড়দুড় করছে। “ওরে মন!”

“বলে ফ্যালো।”

“কী করব বল।”

“এ সুযোগ ছেড়ো না হে। মানিক রাত দশটার আগে ফিরবে না।”

“কাজটা অন্যায় হবে না তো?”

“আরে না। কত লোক কত বড় বড় অন্যায় করে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।”

“তা বটে। তা হলে পরি?”

“পরো। তবে তোমার ওই ধুতি-পাঞ্জাবির সঙ্গে তো হেলমেট মানাবে না হে। বাক্স খুলে সুট বের করো!”

নন্দবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “স্যুট! বলিস কী রে মন? ওই ম্লেচ্ছ পোশাক যে আমি ছেড়ে দিয়েছি।”

“ছেড়েই যখন দিয়েছ, তখন আর পরতে দোষ কী? কথায় আছে না, “তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’; তার মানে হল, ত্যাগ করে ভোগ করো’। যাও, পোশাকটা পরে ফ্যালো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

নন্দবাবু হার মানলেন। বাক্স খুলে পুরনো স্যুট বের করে লজ্জিতভাবে পরলেন। সুবিধে হল যে, তার ঘরটা একতলায় এবং বাড়ির পেছন দিকে। এদিকটায় কেউ থাকে না। একটু পুরনো অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে কয়েকখানা ঘর বহুঁকাল ধরে পড়ে আছে তালাবন্ধ হয়ে। এই নির্জনতায় থাকার অনেক সুবিধে নন্দবাবুর। কেউ উঁকিঝুঁকি মারে না, ডিস্টার্ব করতে নামে না। সামনের বারান্দায় শুধু মোটরবাইকটা রাখতে মানিক আসে।

স্যুট পরে নন্দবাবু বেরোলেন। তারপর দেওয়াল থেকে হেলমটটা নামিয়ে মাথায় পরলেন। বেশ ভারী। ভিতরে গদি দেওয়া আছে। হেলমেটটার গায়ে কয়েকটা বোম-টোতামও আছে।

হেলমেটটা মাথায় দেওয়ার পরই নন্দবাবুর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। মনে হল, তিনি যেন নন্দবাবু নন। অন্য কেউ।

বাড়ির পেছন দিকে আগাছার জঙ্গলে ছাওয়া একটা বাগান আছে। বেশ বড় বাগান। এখন আর এই বাগানের পরিচর্যা কেউ করে না। কেউ আসেও না এদিকে। সেই বাগানের ভিতরে একসময়ে বেশ চওড়া সুরকির রাস্তা ছিল। এখন সেই রাস্তা ঘাসে ঢেকে গেছে। সাপখোপের আস্তানা হয়েছে ঝোঁপজঙ্গলগুলো। এই পথ দিয়েই নন্দবাবু যাতায়াত করেন।

বাগান পেরিয়ে ফটক। ফটকের ওপাশে একটা গলি। খুবই নির্জন গলি। স্যুট পরা নন্দবাবু হেলমেট-মাথায় গলিতে পা দিয়ে চারদিকটা ভাল করে দেখে নিলেন। না, কেউ কোথাও নেই।

স্যুটের সঙ্গে মানিয়ে আজ বুটজুতোও পরেছেন তিনি। বহুঁকাল পড়ে ছিল বুট দুটো, শক্ত দরকচা মেরে গেছে। পায়ে সাঙ্ঘাতিক লাগছে হাঁটতে গিয়ে। হেলমেটটাও যে এত ভারী, তা কে জানত!

গলিটা পার হয়ে নন্দবাবু রাস্তায় পড়লেন। শীতকাল। মফস্বলের শহরে খুব জেঁকে শীতও পড়েছে এবার। রাস্তায়-ঘাটে লোকজন বিশেষ নেই। থাকলেও ক্ষতি ছিল না, এ রাস্তায় আলো নেই, এবং ঘন কুয়াশা পড়েছে আজ। সুতরাং নন্দবাবুকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

নন্দবাবু ধীর গম্ভীর মানুষ, তার কোনও চপলতা দেখা যায় না কখনও। কিন্তু আজ এই কুয়াশামাখা সন্ধ্যায় সুট, বুট এবং হেলমেট পরে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার শিস দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। একটু ইংরেজি নাচ নাচতে ইচ্ছে করছিল।

নন্দবাবু বললেন, “ওরে মন, মন রে! এসব হচ্ছেটা কী?”

“খারাপটা কী হচ্ছে বাপু! শিস দিতে ইচ্ছে হলে দাও না।”

“খারাপ শোনাবে না?”

“কেন, শিস তো তুমি ভালই দাও। আগে তো শিস দিয়ে বেশ পায়রা ওড়াতে।”

‘দূর পাগল! যখন সংসারী ছিলাম, তখন কত কী করেছি। এখন আর ওসব মানায়?”

“খুব মানায়। কেউ শুনছে না, দাও দেখি একটু শিস।”

নন্দবাবু আবার হার মানলেন। শিস দিতে গিয়ে দেখলেন, শব্দ হচ্ছে না তো!

একটু পরেই অবশ্য ভুল ভাঙল। হেলমেট পরা বলে বাইরের শব্দ আদপেই তাঁর কানে আসছে না। হেলমেটটা একটু তুলতেই তিনি শুনতে পেলেন, তার ঠোঁটে চমৎকার সুরেলা শিস বাজছে।

বেলতলাটা বেশ অন্ধকার! চারদিকে ঝোঁপঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে। বাঁ ধারে শাঁখচুন্নির জলা। তার ওপাশে একটা মস্ত পোড়ো বাড়ি। না, একে পোড়ো বাড়ি বলার চেয়ে ধ্বংসাবশেষ বলাই ভাল। এক সময়ে এক নীলকর সাহেব মস্ত প্রাসাদ বানিয়েছিল আমোদ-ফুর্তির জন্য। সেই বাড়ির এখন ওই দশা। বিস্তর মানুষ ওখানে গুপ্তধন খুঁজতে গেছে। ভূতের বাড়ি বলেও একসময়ে অখ্যাতি ছিল। শীতকালে এক সাধু এসে প্রায়ই ওখানে আস্তানা গাড়ত। কিছুদিন চোর ডাকাতদেরও ডেরা হয়েছিল বাড়িটা। এখন আর কেউই ওখানে যায় না। চারদিকে এক ধরনের কাঁটাগাছের দুর্ভেদ্য জঙ্গল হয়েছে। নন্দবাবু এবং তার ভুতুড়ে ক্লাবের সদস্যরা ও বাড়িতে অনেকবার ভূত খুঁজতে হানা দিয়েছেন। কিন্তু ওবাড়ির ভূতেরা দেখা দেয়নি।

শ্যামবাবু বলেছিলেন, ভূত পুরনো হয়ে গেলে সেয়ানা হয়ে ওঠে। সহজে দেখা দেয় না।

রাধাগোবিন্দবাবু ভূতের ব্যাপারে খুবই বিশেষজ্ঞ লোক। থিওসফিক্যালি সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ভূত দেখেছেন বহুবার। শ্যামবাবুর কথায় তিনিও সায় দিয়ে বললেন, “ওই হয়েছে মুশকিল, পুরনো ভূতরা সহজে দেখা দিতে চায় না। নতুন যারা ভূত হয়েছে, তারা পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারে না কিনা, তাই হকেনকে দেখা দেয়।”

ফটিকাবু কখনও ভূত দ্যাখেননি, তবে ভূতের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। ভূত দেখার জন্য তিনি অনেক ঘুরে বেড়িয়েছেন। পোডড়া বাড়ির সন্ধান পেলেই গিয়ে হাজির হন। শ্মশানে কারখানায় নিশুত রাতে গিয়ে বসে থাকেন। এমন কী, ভূতের দেখা পেলে মা কালীকে জোড়া পাঁঠা দেবেন বলে মানতও করে রেখেছেন। তিনি একটু রেগে গিয়ে বললেন, “নতুন-পুরনো জানি না মশাই, আজ অবধি আপনারা একটা ভূতেরও ব্যবস্থা করতে পারলেন না। এমন চলতে থাকলে শেষ অবধি আমাকে আমার সেজো শালার কাছে একশো টাকা বাজি হারতে হবে। শুধু তা-ই নয়, নিজের কান মলে স্বীকার করতে হবে যে, তার কথাই ঠিক, ভূত বলে কিছু নেই।”

এ-কথায় সাত্যকিবাবু হাঁ-হাঁ করে উঠে বললেন, “দেখা পাননি বলেই যে নেই, এটা তো যুক্তি হল না মশাই। আপনি দ্যাখেন না, কিন্তু আমি তো দিব্যি দেখি। এই পরশু দিন একটা মশার-আকৃতি ভূত মশারির মধ্যে ওড়াওড়ি করছিল। যতবার তালি দিয়ে মারতে যাই, ততবার ফশকায়। শেষ অবধি সেটা নাকের ডগায় এসে খুব যখন নাচানাচি করতে লাগল, তখন ভাল করে দেখলুম, মশা নয় একরত্তি একটা ভূত।”

ফটিকবাবু খ্যাক করে উঠে বললেন, “মানুষ মরে যদি ভূত হতে পারে, তো মশা মরেই বা হবে না কেন? আমি তো গোরুর ভূত, গণ্ডারের ভূত, গাছের ভূতও দেখেছি।”

ফটিকবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমার মেজো শালাকে এসব কথা বললে হা হা করে হেসে উঠবে যে।”

নন্দবাবু বেলতলায় দাঁড়িয়ে হেলমেটের কাঁচের স্বচ্ছ ঢাকার ভিতর দিয়ে অন্ধকার ধ্বংস্তূপের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। নিজের কাছে স্বীকার করতে তার লজ্জা নেই যে, আজ অবধি তিনি জলজ্যান্ত ভূত দেখতে পাননি। ভূতের আভাস অবশ্য পেয়েছেন। ভূত-ভূত অনুভূতিও হয়েছে, কিন্তু চোখের সামনে একেবারে স্পষ্ট দেখা আর হল কই?

ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যেই পা বাড়িয়েছেন, অমনি ধড়াম্ করে মাথার ওপর কী যেন একটা এসে পড়ল।

নন্দবাবু ভীষণ চমকে গিয়েছিলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আর তাজ্জবের কথা, নন্দবাবু ভারি চমৎকার সুরেলা একটা গান শুনতে পেলেন।

হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নন্দবাবু নিচু হয়ে দেখলেন, একটা পাকা বেল পায়ের কাছে পড়ে আছে। গাছ থেকে সদ্য ঘেঁড়া। মাথায় হেলমেট না থাকলে এই বেল তার মাথা ফাটিয়ে দিতে পারত।

বেলটা কুড়িয়ে নিয়ে নন্দবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন। গানটা কোথা থেকে আসছে? হেলমেটের মধ্যে তো বাইরের শব্দ ঢোকে না। তবে এটা ঢুকছে কী করে?

সন্দিহান হয়ে নন্দবাবু হেলমেটটা খুললেন। এবং অবাক হয়ে বুঝতে পারলেন বা বুঝতে পেরে অবাক হলেন যে, দুনিয়ার প্রযুক্তিবিদ্যা অনেক এগিয়ে গেছে। এই হেলমেটটায় টেপরেকর্ডার লাগানো আছে। মাথায় বেল পড়ায় ঝড়াক করে টেপরেকর্ডার চালু হয়ে গান বেরিয়ে আসছে।

নন্দবাবু গানটা বন্ধ করার চাবি খুঁজে পেলেন না। গানসুদ্ধ হেলমেটটা ফের পরে নিয়ে ভুতুড়ে ক্লাবের দিকে হাঁটতে লাগলেন। কানে গান বাজতেই লাগল।

ভৌত ক্লাবটা একটা ভারি জব্বর জায়গায়। মিত্তিরবাবুদের পোড়ো বাড়ির একাংশে একখানা ঘর আছে। চারদিকে আগাছার জঙ্গল। দিনে-দুপুরেও মানুষ আসে না। সন্ধের পর শুধু শেয়ালেরা ঘোরাঘুরি করে। কৃষ্ণপক্ষে জায়গাটা এত ঘুরঘুট্টি অন্ধকার থাকে যে, নিজের হাতখানা অবধি ঠাহর হয় না।

নোনাধরা দেওয়াল, আধভাঙা দরজা-জানলা, সোঁদা গন্ধ মিলে-মিশে বেশ একটা ভূত-ভূত ভাব। ঘরে একখানা কাঠের টেবিলের ওপর মড়ার খুলি আর পাশে একখানা মোমবাতি জ্বলছে। কয়েকখানা কাঠের চেয়ারে ভৌত ক্লাবের সদস্যরা বসে আছেন। তাদের বয়স ত্রিশ থেকে শুরু করে আশি অবধি। শীতকাল বলে সকলেই একটু মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মুড়ি আর গরমাগরম বেগুনি এসে গেছে। দলের সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য গিরিজা একটা কেরোসিন-স্টোভে চা তৈরি করছে। আড্ডা জমজমাট।

এমন সময়ে মাথায় হেলমেট আর হাতে পাকা বেল নিয়ে নন্দবাবু ঘরে ঢুকতেই একটা হইচই গেল।

ফটিকবাবুর ভূত-তৃষ্ণা বা ভূত-ক্ষুধা আজকাল এত বেড়েছে যে, তিনি আজকাল সর্ষের মধ্যেও ভূত দেখার চেষ্টা করেন। নন্দবাবুকে দেখে তিনিই প্রথম সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই তো, এতদিনে বুঝি মা কালী মুখ তুলে চাইলেন…”

রাধাগোবিন্দবাবুর ভয় অন্যরকম। কিছুদিন আগে তিনি সাইকেলে চেপে যাওয়ার সময় রাস্তায় একটা গোরুকে ধাক্কা দেন। তাতে একজন পুলিশম্যান এসে তাঁকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছিল। রাধাগোবিন্দবাবুর প্রতিশোধস্পৃহা সাঙ্ঘাতিক। দু’একদিন বাদেই এক দুপুরবেলা বটগাছের বাঁধানো চাতালে সেই পুলিশম্যানটাকে বসে বসে ঘুমোতে দেখে রাধাগোবিন্দবাবু তার টুপিটা তুলে নিয়ে চম্পট দিয়েছিলেন। অবিমৃষ্যকারিতা আর কাকে বলে! পুলিশ হল স্বয়ং সরকারবাহাদুরের জবরদস্ত প্রতিনিধি। পুলিশের টুপি চুরি করা যে সাঙ্ঘাতিক অপরাধ তা তিনি পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু টুপিটা গিয়ে ফেরত দিয়ে আসার সাহস আর তার হয়নি। পুলিশকে তার ভীষণ ভয় করে আজকাল। সর্বদাই তিনি আশঙ্কা করছেন, কখন এসে পুলিশ তার ওপর চড়াও হবে।

নন্দবাবুকে দেখে রাধাগোবিন্দবাবু তাই তারস্বরে বলে উঠলেন, “আমি চোর না বাবা, আমি চোর না। মা কালীর দিব্যি, টুপিটা বাতাসে উড়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল, আমি ঝেড়েঝুড়ে তুলে রেখেছি যত্ন করে…”

সাত্যকিবাবু খুব ভাল করেই জানেন যে, ভিন গ্রহ থেকে অজানা সব জীব কিভূত সব মহাকাশযানে করে প্রায়ই পৃথিবীতে চলে আসে। খবরের কাগজে প্রায়ই উফো’র খবর থাকে। নন্দবাবুকে দেখে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে, এ হল সেই প্রাণীদেরই একজন। তিনি আঁ-আঁ করে দু’বার দুটো দুর্বোধ্য শব্দ করে উঠলেন। তার মনে হল, ভিন গ্রহের জীব তো সাদামাঠা বাংলা ভাষা বুঝতে পারবে না, তবে সংস্কৃত দেবভাষা, সেটা বুঝলেও বুঝতে পারে। কিন্তু সংস্কৃতে তিনি বেজায় কাঁচা। সুতরাং যা মনে পড়ল, তাই চেঁচিয়ে বলে যেতে লাগলেন, “ভো ভো আগন্তুকঃ অহং সাত্যকি চট্টরাজ্য। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িস্যামি মা শুচঃ। রক্ষ মাম। নরঃ নরৌ নরাঃ।”

শ্যামবাবু ভালমন্দ কিছু না বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি আলোয়ান, সোয়েটার, জামা আর গেঞ্জির ভিতর হাতড়ে পৈতে খুঁজে বারে করে কাঁপতে কাঁপতে গায়ত্ৰীমন্ত্র বেশ চেঁচিয়েই জপ করতে লাগলেন।

হারানবাবুর বয়স আশির ওপর। চোখে ভাল ঠাহর পান না। কিন্তু একটা বিটকেল কিছু যে ঘরে ঢুকেছে, তা আঁচ করে সে-ই যে চোখ বুজে ফেলেছেন, আর চোখ খোলার নাম নেই। চোখ বুজে হুঁহুঁ করে মৃদু মৃদু আওয়াজ ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগলেন, “ই, এর মতো ওষুধ নেই হে বাছাধন। ভূত হও, প্রেত হও, রাক্ষস হও, যমদূত হও, চোখটি বুজে ফেললে আর ভয়টি দেখাতে পারবে না।”

কে একজন ‘পুলিশ, পুলিশ’ বলে চেঁচাচ্ছিল। আর-একজন রামনাম করতে গিয়ে কাশতে লাগল। একজন চেয়ার উলটে পড়ে গেল।

গিরিজা প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গেলেও ততটা ঘাবড়ে যায়নি। সে বলে উঠল, “আচ্ছা, সবাই মিলে যে কী পাগলের কাণ্ড বাধালেন? লোকটা কে আগে দেখুন।”

নন্দবাবু এতটা প্রতিক্রিয়া আশা করেননি। তবে তিনি এতে খুশিই হলেন। বহুঁকাল ভারি সাদামাঠা জীবনযাপন করেছেন। তাকে কেউ ভয় খায় না, সমীহ করে না, বাড়ির চাকর বাকরেরা পর্যন্ত তেমন খাতির দেখায় না তাঁকে। আজ তাকে দেখে যে সকলে একেবারে চমকে উঠে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়, এতে নিজের ওপর তার একটা বিশ্বাস এসে গেল।

নন্দবাবু গম্ভীর মুখে মড়ার খুলিটার পাশে পাকা বেলটা রেখে হেলমেট খুললেন। একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে ফটিকবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনি নাকি এখনও ভূত দ্যাখেননি?”

ফটিকবাবু নন্দবাবুর দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, “না, দেখিনি। আপনার মতো বেরসিকও জীবনে দেখিনি। ভাবলাম মা কালী বুঝি আজ মুখ তুলে চাইলেন। তা নয়, ভূতের বদলে নন্দবাবু। ছ্যাঃ ছ্যাঃ, জীবনটায় ঘেন্না ধরে গেল।”

“তা হলে আমার চেয়ে ভূতের গুরুত্বই আপনার কাছে বেশি?

“আলবাৎ বেশি। খুঁজলে কয়েক লাখ কয়েক নন্দবাবু পাওয়া যাবে, কিন্তু ভূত পাওয়া যাবে কি?”

নন্দবাবু বিজ্ঞের মতো একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “যাবে। এইমাত্র ভূতের হাত থেকে কোনওক্রমে প্রাণ হাতে করে চলে আসতে পেরেছি।”

ফটিকবাবু সোৎসাহে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, “কোথায়?”

“বেলতলায়। ওই পাকা বেলটা আমার মাথা তাক করে ছুঁড়ে মেরেছিল। ভাগ্যিস মাথায় হেলমেট ছিল। নইলে…”

ফটিকবাবু আবার নিরুৎসাহ হয়ে বসে পড়ে বললেন, “তার মানে, ভূত দ্যাখেননি, ভূতের ঢেলা খেয়েছেন।”

“ওই হল।”

“ফটিকবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “মোটেই দুটো জিনিস এক হল না।”

একটা তর্ক বা ঝগড়া বেধে উঠছিল, কিন্তু সকলে মাঝখানে পড়ে ব্যাপারটা আর এগোতে দিল না। সকলেরই কৌতূহল হেলমেট, স্যুট ইত্যাদি নিয়ে।

নন্দবাবু মুড়ি আর বেগুনির সঙ্গে চায়ে চুমুক দিয়ে একটু লাজুক মুখে ঘটনাটা বিস্তারিত বলতে লাগলেন।

কথার মাঝখানে গিরিজা হঠাৎ বলে উঠল, “কিন্তু নখুড়ো, আপনি হেলমেটটা পেলেন কোথায়?

“কেন বাপু, আমার ঘরের দরজায় দরদালানের পেরেকে ঝোলানো থাকে। সেখানেই পেয়েছি।”

“কটার সময়?”

“ওই তো সাড়ে পাঁচটা হবে।”

“হতেই পারে না।”

“তার মানে?”

‘ঠিক পাঁচটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে মানিকের সঙ্গে জামতলার মোড়ে আমার দেখা হয়েছে। মাথায় লাল হেলমেট পরে মোটরবাইকে চড়ে সে কালীতলায় থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে।”

নন্দবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “গিরিজা, বড়দের সঙ্গে ইয়ার্কি করতে নেই।”

গিরিজাও গম্ভীর হয়ে বললে, “নখুড়ো, নেহাত মানিকের কাকা বলেই আপনাকে খুড়ো বলে ডাকি, নইলে স্কুলে কলেজে আপনি আমার মাত্র তিন ক্লাস, ও ওপরে পড়তেন। ইয়ার্কির বাধা নেই। তবে আমি এখন মোটেই ইয়ার্কি করছি না।”

নন্দবাবু আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, “তা হলে ভুল দেখেছ।”

গিরিজাও গম্ভীরতর হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, “আমার চোখ দারুণ ভাল। ভুল দেখার প্রশ্নই ওঠে না।”

“তা হলে বানিয়ে বলছ।”

“আপনি ঘুরিয়ে আমাকে মিথ্যেবাদী বলছেন?”

আবার সবাই হাঁ-হাঁ করে মাঝখানে পড়ে বিবাদটা আর গড়াতে দিল না। ফটিকবাবু বললেন, “এসব নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ কী? ভূত নামানোর চেষ্টা করুন সবাই। শালার কাছে আমার আর মুখ দেখানোর জো নেই।”

শ্যামবাবু বেজার মুখ করে বললেন, “আজ কি ভূত নামানো সহজ হবে? আমার গায়ত্ৰীমন্ত্র জপ আর যোগেশবাবুর রামনামের চোটে ভূতেরা কয়েকশো মাইল তফাতে চলে গেছে।”

ফটিকবাবু লাঠিগাছ হাতে করে উঠে পড়লেন। বললেন, “তা হলে আর এখানে মিছে সময় নষ্ট করে লাভ কী! আজ বাড়িতে কড়াইশুটির কচুরি হচ্ছে, দেখে এসেছি।”

রাধাগোবিন্দবাবু বলে উঠলেন, “দাঁড়ান ফটিকবাবু, আমিও আপনার সঙ্গে ই বেরোব, আজ আমার বেয়াই-বেয়ান এসেছেন। বাজারটা একটু ঘুরে যেতে হবে, যদি টাটকা মাছ-টাছ পাওয়া যায়।”

এমনি করে প্রায় সকলেই একে-একে উঠে পড়তে লাগলেন। ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল একসময়।

একা নন্দবাবু মড়ার খুলির সামনে মোমবাতির আলোয় আনমনা হয়ে বসে রইলেন। মনটায় একটা ধন্দ-ভাব। একটা সন্দেহ। একটু রহস্য।

গিরিজা যদি মিথ্যে কথা না বলে থাকে, তা হলে এই হেলমেটটা এল কোথা থেকে?

তিনি হাত বাড়িয়ে হেলমেটটা তুলে নিলেন। মোমবাতির আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। দেখতে অনেকটা তো মানিকের হেলমেটের মতোই।

রাত বাড়ছে। বাইরে একঝাঁক শিয়াল ডাকল। হু হু করে উত্তরে একটা হাওয়া ভূতের নিশ্বাসের মতো বয়ে গেল। ঝিঝি ডাকছে। টিকটিকি রহস্যময় ভাবে টিকটিক করে উঠল। মোমবাতির শিখা কেঁপে-কেঁপে উঠল হঠাৎ।

নন্দবাবুর হঠাৎ কেমন যেন গা’টা ছমছম করে উঠল। তিনি হেলমেটটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বেরোতে যাবে বলে পা বাড়িয়েছেন, হঠাৎ শুনতে পেলেন, কে যেন জুতোর আওয়াজ তুলে এদিকে আসছে।

দরজাটা ভেজানো। নন্দবাবু দরজার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে দেখলেন, আজ ভৌত ক্লাবের দু’জন সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। নরেনবাবু আর সনাতনবাবু। রাত এখন বেশি হয়নি। হয়তো তাঁদেরই কেউ আসছেন।

নন্দবাবু আবার বসে পড়লেন। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গিয়ে তাঁর কোনও লাভ নেই। এই সময়টা বাড়িতে ছেলেপুলেগুলো ভারি চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করে। সেজদা যদুলাল কানে কম শোনেন বলে খুব জোরে রেডিও ছেড়ে বসে থাকেন। নন্দবাবুর ঠাকুমা’র সঙ্গে বুড়ি দাসী মোদার বচসাও হয় ঠিক এই সময়ে। নন্দবাবুর বাবা ডাকসাইটে ভুবন রায় ঠিক এই সময়েই ছেলেদের ডেকে বকাঝকা করেন। বাড়িটায় শান্তি নেই।

নন্দবাবু পায়ের শব্দটার উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, “আসুন নরেনবাবু, আসুন সনাতনবাবু।”

পায়ের শব্দটা এগিয়ে এল বটে, কিন্তু দরজা খুলে কেউ ঘরে ঢুকল না। নন্দবাবু স্পষ্ট শুনতে পেলেন, ঘরের পাশ দিয়ে পায়ের শব্দটা ভিতরের সিঁড়িঘরের দিকে চলে যাচ্ছে।

এই ভাঙা বাড়িতে বলতে গেলে বাইরের দিকের এই একখানা ঘরই আস্ত আছে। ভিতর বাড়িটা একেবারেই ভাঙাচোরা এবং রাজ্যের ডাঁই করা আবর্জনায় অতিশয় দুর্গম।

“কে? কে যায়?”

নন্দবাবুর চেঁচানির কেউ জবাব দিল না। পায়ের শব্দটা ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে ঢাকা বাড়িটার মধ্যে মিলিয়ে গেল।

নন্দবাবু আর এক সেকেন্ডও দেরি করলেন না। এক লাফে গিয়ে দরজা খুলে ছুটতে লাগলেন। শক্ত জুতোয় পা ছিঁড়ে যেতে লাগল, তবু থামলেন না।

একেবারে নিজের ঘরটিতে পৌঁছে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে লাগলেন। খানিকক্ষণ জিরোবার পর হঠাৎ খেয়াল হল, হেলমেটটা তিনি ভৌত ক্লাবের ঘরেই ফেলে এসেছেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9
Pages ( 1 of 9 ): 1 23 ... 9পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress