Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীলু হাজরার হত্যা রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay

নীলু হাজরার হত্যা রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay

নির্জন এক নদী

০১.

নির্জন এক নদী সারাদিন এলোচুলে পা ছড়িয়ে বসে মৃত্যুর করুণ গান গায়। চারদিকে নিস্তব্ধ এক উপত্যকা, দুধারে কালো পাহাড়ের দেয়াল উঠে গেছে আকাশে। এই বিরলে শুধু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসের মতো হু-হু বাতাস বয়ে যায়। অজস্র সাদা ছোট বড় নুড়ি পাথর চারদিকে অনড় হয়ে পড়ে আছে। খুব সাদা, নীরব, হিম, অসাড় সব পাথরের মাঝখান দিয়ে সেই নদী–উৎস নেই, মোহনা নেই। সারাদিন এখানে শুধু তার করুণ গান, মৃদু বিলাপের মতো। কিছু নেই, কেউ নেই। শুধু হাড়ের মতো সাদা পাথর পড়ে থাকে নিথর হয়ে। উপত্যকা জুড়ে এক মৃত্যুর সম্মোহন। এলোচুলে পা ছড়িয়ে বসে নদী অবিরল গান গেয়ে যায়।

আনমনা আঙুল থেকে আস্ত সিগারেটটা পড়ে গিয়েছিল ফুটপাথে। সিগারেটের আজকাল বড্ড দাম। তার ওপর এটা বেশ দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট। শখ করে কিনে ফেলেছে বৈশম্পায়ন। আনমনেই বৈশম্পায়ন সেটা কুড়োতে নিচু হয়েছিল। শর্মিষ্ঠা দশ পা পেছনে, ছেলের বায়না মেটাতে ফুটপাথের দোকান থেকে মোজা বা গেঞ্জি কিনছে, আর অনবরত মৃদুস্বরে ধমকাচ্ছে ছেলেকে। দশ পা এগিয়ে এসেছে বৈশম্পায়ন। দশ পায়ের বিচ্ছিন্নতা। সিগারেটটা কুড়োতে হাত বাড়িয়েও সে ফিস ফিস করে বলল, ইট উইল নট বি এ ওয়াইজ থিং টু ডু মাইডিয়ার।

কুড়োনো হল না। নতুন একটা যে ধরাবে তাও হল না। এরিয়ালে এসে লাগল সেই মৃত্যু-নদীর গান। সাদা নিথর হিম পাথর সব মনে পড়ে গেল।

ডুমকি এখন অনেক দূরে। কারশিয়াং-এ। ডুমকির জন্য বড় হু-হুঁ করে ওঠে বুক। মানুষ তো পাখি নয় যে, উড়ে যাবে। ডুমকির সঙ্গে এই অনেকটা অসহায় দূরত্ব এই মুহূর্তে ভীষণ টের পায় বৈশম্পায়ন।

দশ পায়ের দূরত্বে শর্মিষ্ঠা এখনও কী যে কিনছে। কই এসো, বলে তাকে এখন একবার তাগাদা দেওয়া যায়। কিন্তু সেরকম কোনও ইচ্ছেই হল না বৈশম্পায়নের। থাক, কিনুক। ছেলে বুবুম একবার ফিরে দেখল বাবাকে। তারপর ঝুঁকে পড়ল দোকানের জিনিসপত্রের ওপর।

বৈশম্পায়নের পকেটে গোদরেজের চাবি। পকেটে হাত পুরে চাবির রিংটা মুঠো করে ধরে থাকে সে কিছুক্ষণ। তার ফ্ল্যাট মোটামুটি নিরাপদ। প্যান্টের চোরা পকেটে বোনাসের দেড় হাজার টাকা। চাবির রিং ধরার ছলে সে দেড় হাজার টাকার ফোলা অংশটাকেও স্পর্শ করে আছে। কিন্তু এরিয়ালে নির্ভুল গানের তরঙ্গ ভেসে আসছে। হারিয়ে যাচ্ছে গোদরেজের চাবির নিরাপত্তা, টাকার মূল্য। বৈশম্পায়ন আর একটা সিগারেট বের করে।

সিগারেটটা ধরানো হল না কিছুতেই। আকাশ এখন কেমন? ছেঁড়া মেঘের তুলো গড়িয়ে যাচ্ছে নীল বেডকভারে। এখনও বৃষ্টির স্যাঁতা ভাব উবে যায়নি ফুটপাথের শান থেকে। শরৎ সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বৈশম্পায়নের। তার প্রিয় হল টাকা, প্রিয় ডুমকি আর বুবুম। প্রিয় হোক বা না হোক অবিচ্ছেদ্য হল ওই শর্মিষ্ঠা। তার আরও কিছু প্রিয় আছে, তবে সবসময়ে একরকম নয়। তার প্রিয় রং সাদা। প্রিয় রাগ হংসধ্বনি। প্রিয় অভ্যাস বসে থাকা বা ঘুম। এই শরতের প্রিয় রোদে বউ আর ছেলেকে নিয়ে পুজোর বাজার করতে বেরিয়ে তার আগাগোড়া ভারী ভাল লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ..

শর্মিষ্ঠা দোকান থেকে জদা পান মুখে দিয়ে তবে এল। হাতের জালের ব্যাগে দুটো ছোট প্যাকেট। আস্তে আস্তে প্যাকেট বাড়বে। জালের ব্যাগ উপচে পড়বে। আজ তারা বাইরেই কোথাও খেয়ে নেবে! সারাদিনের প্রোগ্রাম

কিন্তু এখন বৈশম্পায়নের কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। চোখের দৃষ্টি একটু অবিন্যস্ত, অস্থির। সে বলল, বাড়ি যাবে?

শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে বলল, বাড়ি যাব? এখনও তো কেনাকাটা শুরুই হল না! বলতে বলতেই সে বৈশম্পায়নকে ভাল করে লক্ষ করে এবং গলার স্বর পাল্টে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

ভরা প্যাকেট ঢোকাতে গিয়ে সিগারেটটা দুমড়ে ফেলল বৈশম্পায়ন। চিন্তিত মুখে বলল, খারাপ লাগছে।

তা হলে চলো। ট্যাকসি ডাকি।

ডাকো।

বলে বুবুমের হাত ধরে বৈশম্পায়ন। পরক্ষণেই মনে হয়, ব্যাপারটা অত্যধিক নাটুকে হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর তেমন খারাপ নয় যে, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। কিন্তু বাসায় ফিরলে অন্তত শর্মিষ্ঠার কাছে মুখ রাখতে তাকে অসুস্থতার থিয়েটার করতেই হবে। তা পারবে না বৈশম্পায়ন। বড় অস্থির লাগছে তার, ভয়ানক অস্থিরতা দেখা দেবে।

শর্মিষ্ঠা ট্যাকসি ডাকতে ফুটপাথের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৈশম্পায়ন বলল, শোনো।

কিছু বলছ?

কেয়াতলা চল। মাধবদের বাসায় একটু বসি। হয়তো সেরে যাবে।

শরীর কেমন লাগছে বলো তো!

অস্থির। বোধহয় পেটে গ্যাস-ট্যাস হয়েছে।

শর্মিষ্ঠা জানে, আজকাল স্ট্রোকের কোনও বয়স নেই, এবং মানুষ যখন তখন মরে যায়। দু চোখে ঘনীভূত সংশয় আর ভয় নিয়ে সে স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, বরং কোনও ডাক্তারের চেম্বারে চলো। দেখিয়ে নিয়ে যাই।

বুবুম মুখে আঙুল পুরে উধ্বমুখে বাবাকে দেখছিল। বাবাকে হাতের নাগালে পেলেই বায়না করা তার স্বভাব। কিন্তু এখন সেও কিছু টের পেয়ে গেছে। তিন বছরের বুদ্ধি আজকাল কিছু কম পাকে না। সে চুপ করে চেয়ে ছিল।

বৈশম্পায়ন বলল, ডাক্তার দেখানোর মতো কিছু নয়। একটু রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

শর্মিষ্ঠার সন্দেহ গেল না। তবে সে আপত্তিও করল না।

গড়িয়াহাটা থেকে সামান্য হাঁটতেই কেয়াতলার মোড়। মাধবদের বাসা মোড়ের কাছেই।

দরজা খুলল মাধবদের বাচ্চা ঝি। বাসায় আর কেউ নেই।

শর্মিষ্ঠা এই অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। সে বলল, ওরা তো ফিরবে। আমরা বরং একটু বসি।

ঝি শর্মিষ্ঠা এবং বৈশম্পায়নকে চেনে। মৃদু হেসে বলল, বসুন না।

বাইরের ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে ডবল সোফা রয়েছে। বৈশম্পায়ন লম্বা মানুষ। শর্মিষ্ঠা একটু চিন্তিত হয়ে বলে, তুমি বেডরুমেই চলো। শোবে।

বৈশম্পায়ন মাথা নেড়ে বলে, আর না। পাখা খুলে দাও। একটু বসলেই ঠিক হয়ে যাবে।

জল খাবে?

খাব।

শর্মিষ্ঠা নিজেই ডাইনিং স্পেস থেকে ফ্রিজের জল নিয়ে এল। বলল, আস্তে আস্তে খেয়ো। ভীষণ ঠাণ্ডা।

বৈশম্পায়নের ফ্রিজ নেই। কিনবে কিনবে করছে। খুব সাবধানে সে একটু একটু করে অল্প জল খেল। শরীরটা যে কোথায় খারাপ, কেন খারাপ তা ভেবে দেখতে লাগল সে।

বুবুমকে হিসি করাতে বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিল শর্মিষ্ঠা। ফিরে এসে বলল, এদের সবকিছুই এত ঝকঝকে পরিষ্কার! বাথরুমটায় শুয়ে থাকা যায়।

বৈশম্পায়ন এসব কথা নতুন শুনছে না। মাধব আর তার বউ ভালই থাকে। গুছিয়ে থাকে। সাজিয়ে থাকে। কিন্তু এই থাকা না-থাকার কোনও অর্থ আজ সে খুঁজে পাচ্ছে না। সোফায় ঘাড় হেলিয়ে সিলিং-এর দিকে মুখ তুলে চোখ বুজে সে পাখার বাতাস শুষে নিচ্ছিল। সেইভাবেই রইল।

শর্মিষ্ঠা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে দুধের বোতল আর সন্দেশের বাক্স বের করে ছেলেকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। সারাদিনই তাকে অক্লান্ত চেষ্টা করে যেতে হয়। ছেলে খেতে চায় না। প্রথমে কাকুতি মিনতি বুবুম লক্ষ্মী সোনা! এই একটুখানি..আচ্ছা সেই ছড়াটা বলছি, হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম, তা হলে সেইটে বলি…চলে মস মস মস মস বাঁ ডান মস মস সবচেয়ে ভাল পা গাড়ি, উঃ…সেই সকালে কখন একটু দুধ খেয়েছে, এত বেলা হল, কিচ্ছুটি নয়! খাও বলছি। খাও। দাঁড়া তো..দেব? দেব পিঠে একটা দুম করে?

এসবই মুখস্থ বৈশম্পায়নের! এরপর মৃদু একটা থাপ্পড় এবং বুবুমের কান্না। সে চোখ না খুলেই বলল, আমার শরীর ভাল লাগছে না। একটু চুপ করো।

শর্মিষ্ঠা আর শব্দ করল না। কিন্তু তার এই নীরবতা রাগে ভরা তাও বৈশম্পায়ন জানে। শর্মিষ্ঠা ছেলেকে নিয়ে খাবার ঘরে চলে গেল।

বৈশম্পায়ন চোখ খুলল এবং প্যাকেট থেকে দোমড়ানো সিগারেটটা বের করে সযত্নে সোজা ধরিয়ে ফেলল।

চার বেডরুমের এই ফ্ল্যাটটা মাধব কিনেছে বছর দশেক আগে। তখন ফ্ল্যাটের দাম দু লাখের কাছাকাছিই হবে বোধহয়। বাইরের ঘরটা দেয়াল থেকে দেয়াল পর্যন্ত বুক কেস দিয়ে সাজানো। কিছু পেতল আর পোড়ামাটির বাছাই কাজ রয়েছে। দেয়ালে কয়েকটা তেলের ছবি, কিছু ওরিজিন্যাল প্রিন্ট। মেঝেয় একটা সত্যিকারের উলেন কারপেট। খুব বড় নয়, তবে বসার জায়গাটুকু ঢাকা দিয়েছে। কার্পেটটির বাইরে ছিট ছিট লাল কালো-সাদা মোজাইক করা মেঝে আয়নার মতো ঝকঝকে। মাধব আর ঝিনুকের ছেলেপুলে নেই।

আমাকে পুষ্যি নে না বলে ঠাট্টা করেছে একসময়ে বৈশম্পায়ন। কখনও আর একটু ফাজিল হয়েছে তোর কর্ম নয়, ঝিনুককে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস। কিন্তু এখন আর কিছু বলা যায় না। ওদের আর হবে না তা বোঝা গেছে। তাই আর ঠাট্টা চলে না।

বৈশম্পায়ন খুব বড় একটা শ্বাস ফেলল। গোদরেজের তিন চারটে চাবির গোছা পকেটে থাকায় ফুটছিল। গোছাটা বের করে শর্মিষ্ঠার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে রাখল সে।

আবার চোখ বুজল। তার কি শরীর খারাপ? তার কি মন খারাপ?

খাবার ঘর থেকে বুবুমের অল্পস্বল্প কান্না আসছে। শর্মিষ্ঠা বেশ জোর গলায় ধমক মারল দুটো। বৈশম্পায়ন গ্লাসটা তুলে আবার একটু জল খায়। এখন আর জলটা তেমন ঠাণ্ডা নয়।

মাধবের সঙ্গে আগে যত ভাব ভালবাসা ছিল আজ আর তা নেই। এই পরিচ্ছন্ন ঘরে বসে থেকে বৈশম্পায়ন দূরত্বটা টের পায়। কবে কখন যে আস্তে আস্তে তারা দূরে সরে গেছে তা টেরও পাওয়া যায়নি। কিন্তু আজকাল মানুষের জীবন যাপনের প্রণালীটাই এমন হয়ে গেছে যে, কেউ আর নিকট হয় না কেবলই দূরে সরে যায়।

বৈশম্পায়ন জলের গ্লাসটা নাড়ে। জল ঘুরপাক খায় গ্লাসের মধ্যে। ঠাণ্ডা ভাবটা আরও কমে গেছে। আরও একটু জল খায় বৈশম্পায়ন।

মাধবের বাসায় আসতে তবু ইচ্ছে করে কেন তার? সে রহস্যটা জানে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ঝিনুকও কি জানে?

বৈশম্পায়ন নিঃশব্দে ওঠে। পদা সরালেই ওদের সুন্দর শোওয়ার ঘরটি। বারো বাই চোদ্দো ফুট হবে। চার দেয়ালে চার রকম মোলায়েম রং। দুটো সিংগল খাট। মাঝখানে এক চিলতে কার্পেট। ছোট একটা ক্যাবিনেটের ওপর ফুলের ভাস। তাতে টাটকা রজনীগন্ধাও। ক্যাবিনেটের ওপর স্টিলের ফ্রেমে বাঁধানো স্বামী-স্ত্রীর ফটো। বাঁ ধারে ঝিনুক। কী সুন্দর! ঝিনুকের একটা ফটো বৈশম্পায়নের কাছেও আছে। কেউ তা জানে না। স্বয়ং ঝিনুকও নয়। সেই ফটোগ্রাফ আমৃত্যু গোপন থেকে যাবে বৈশম্পায়নের কাছে। যেদিন টের পাবে মৃত্যু আসছে, সেদিন ফটোটা নষ্ট করে দিয়ে যাবে সে।

দরজার বাঁ ধারে একটা চমৎকার শো-কেস। তার ওপর গাররেডের রেকর্ড চেঞ্জার। তার পাশে নীলুর ছবি। মাধবের কিশোর ভাই। খুন হয়ে গেছে।

নীলুর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে ঝিনুককে বহুক্ষণ ধরে দেখে নেয় বৈশম্পায়ন। এই এক মুখ। দেখতে দেখতে মৃত্যু ভুল হয়ে যায়, জীবনের তুচ্ছতাগুলির কথা মনে পড়ে না, দুঃখবোধ থাকে না। বুক ভরে ওঠে আনন্দে।

সে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করে, এ কি কাম? এ কি পাপ? এ কি বিশ্বাসঘাতকতা?

মাধবের য়খন বিয়ে হয় তখন বৈশম্পায়ন ভবলিউ বি সি এস পাশ করে বাঁকুড়া জেলায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরি করছে। আজও সেই চাকরি করে যেতে পারলে ভাল হত। ঝিনুকের সঙ্গে ফিরে দেখা হত না।

কিন্তু এ কেবল ইচ্ছাযুক্ত চিন্তা। দেখা হতই। দেখা না হলে হত কী করে? আরও কয়েকটা জেলা মহকুমা ঘুরে প্রোমোশন পেয়ে এই কলকাতাতেই আসতে হত তাকে। তার আগেই অবশ্য সে এল। আলিপুরদুয়ার কোর্টে গণধোলাইয়ের পর কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ভাঙা হাত আর জখমে শক্ত হয়ে ওঠা ঘাড় নিয়ে সে কলকাতায় চলে এল পাকাপাকি। একটা ব্যাঙ্কে বরাতজোরে চাকরি জুটে গেল। এ সবই নিয়তিনিদিষ্ট, আগে থেকে ছক বাঁধা।

শর্মিষ্ঠা এসে বলল, শরীর কেমন লাগছে?

ভাল। অনেকটা ভাল।

আর একটু বসবে?

বসলে ভাল হয়। ওরা কি ফিরবে?

ঝি তো বলছে ফিরবে।

একটু বসি। ওরা ফিরলে উঠব।

বুবুমের ঘুম পাচ্ছে।

ঘুম পাড়িয়ে দাও।

আজ আর পুজোর বাজার হবে না মনে হচ্ছে।

তুমি একা গিয়ে কিনে আনো না।

এতে একটু সতেজ হয়ে শর্মিষ্ঠা বলে, যাব? বুবুমকে কে দেখবে?

দেখার কী? আমি বসে থাকব, ও ঘুমোবে।

দোনোমোনো করে শর্মিষ্ঠা বলে, তোমার মায়ের কাপড় যদি তোমার পছন্দমতো কিনতে না পারি?

পারবে।

ঠকে আসলে বকবে না?

মেয়েরা একটু তো ঠকেই। আজ কিছু বলব না। যাও।

কার জন্য কী যেন?

জয়ের জন্য একটা ভাল প্যান্টের পিস আর শার্টের কাপড়।

প্রতিবারই জয়কে দিচ্ছ। এখন তো চাকরি করে।

ও চাকরিতে কী হয়! এনো। সংসারে যখন থাকি না তখন তার কমপেনসেশনও কিছু দিতে হয়।

সংসারের সঙ্গে আজকাল কেউ থাকে না। ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখো।

ও শর্মিষ্ঠা!

টাকা দাও।

কত লাগবে?

হাজার খানেক দিয়ে রাখা।

বুবুমকে ঘুম পাড়িয়ে যাও। বলে চোরা পকেট থেকে টাকা বের করে বৈশম্পায়ন।

শর্মিষ্ঠা ব্যাগে টাকা রেখে ছেলের কাছে যেতে গিয়ে ফিরে বলে, চা খাবে?

ওরা ফিরুক।

ওদের সঙ্গে তোমার কী? ঝি করে দেবে।

তা হলে করতে বলল।

শর্মিষ্ঠা চলে গেলে বৈশম্পায়ন চোখ বোজে। সাদা হিম নুড়ি-পাথর ছড়ানো উপত্যকায় বয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর নদী। কী অদ্ভুত গান।

শর্মিষ্ঠা চলে যাওয়ার পর বেডরুমের পাশের লিভিং রুমে ফোনটা বাজল।

উঠে গিয়ে ধরে বৈশম্পায়ন।

মাধব আছে?

না।

আপনি কে?

আমি ওর এক বন্ধু!

আমি মাধবের বন্ধু। আপনি কে বলুন তো। নামটা কী?

আমি বৈশম্পায়ন।

যাঃ বাব্বা! না মশাই হল না, আমরা কমন ফ্রেন্ড নই।

এরকম হতেই পারে। বৈশম্পায়ন খুব ভদ্র গলায় বলে।

ওর সঙ্গে কি আপনার দেখা হবে?

হতে পারে। আমি ওর জন্যই বসে আছি।

একটু কাইভলি বলবেন কাল সকালে ওর বন্ধু মদন আসছে! ও চিনবে। মদন এম পি।

মদনকে আমিও চিনি।

যা বাব্বা! তবু আমি আপনাকে চিনতে পারছি না কেন?

ফোনের ভিতর দিয়েই ওপাশ থেকে একটু মদের গন্ধ পায় বৈশম্পায়ন।

.

০২.

শিয়ালদা মেন স্টেশনের ছ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গেটের বাইরে ফরসা মতো একটা লোক খুব মাতব্বরি চালে প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে টিকিট নিচ্ছিল। টিকিট নেওয়ার কালো কোট দুজন থাকা সত্ত্বেও ভিড়ের ঠেলায় যাত্রীরা বেরিয়ে আসছে বেনোজলের মতো, কে কাকে টিকিট দেয়। এই লোকটা সেই ছিটকে আসা যাত্রীদের দু চারজনের দিকে হাত বাড়িয়ে টুকটাক টিকিট নিয়ে পকেটে ভরছে।

দার্জিলিং মেল লেটে আসছে। অনেকক্ষণ বাইরের চাতালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল জয়। তার প্রথমে তেমন কিছু মনে হয়নি। ভেবেছিল কালো কোট খুলে রেলের টিকিটবাবুই টিকিট নিচ্ছে। খানিকক্ষণ দেখে-টেখে সন্দেহ হল, করাপশন।

জয়ের বড় জামাইবাবু বলেছিলেন, অন্যায় দেখলেই ফরম্যালি হলেও একটা প্রতিবাদ সবসময়ই করে রেখো। কাজ হোক বা না হোক বড় জামাইবাবু সর্বদাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে থাকেন। তাতে যে বড় জামাইবাবুর খুব ভাল হয়েছে তা নয়। বরং প্রোমোশন হয়নি, মেয়েরা যে যার ইচ্ছে মতো বিয়ে করেছে, তিন ছেলেই আগাপাশতলা দুর্নীতিগ্রস্ত, বড়দির সঙ্গেও বড় জামাইবাবুর বনিবনা। নেই। তবু জয় বড় জামাইবাবুর এই একটা কথা মেনে চলার চেষ্টা করে।

দু দুটো লোকাল ট্রেনের পর প্ল্যাটফর্ম এখন ফাঁকা। করাপটেড লোকটা সাত নম্বরের বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করছে।

ও মশাই শুনুন। জয় লোকটাকে ডাকে।

লোকটা নিমীলিত চোখে চায়। চোখ দুখানা বড় বড়, ডাগর, মুখও ভদ্রলোকের মতো, রং ফরসা তবে গায়ের জামাপ্যান্ট ময়লা। লোকটা ঠোঁট থেকে একটা মাছিকে উড়িয়ে বলল, কিছু বলছেন?

আপনি কি টিকিট কালেক্টর?

আজ্ঞে না।

তবে প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে টিকিট নিচ্ছেন যে!

লোকটা একথায় সুড়ুক করে কাছে সরে আসে, তখুনি এই সাত সকালেও লোকটার মুখ থেকে ভক করে মদের গন্ধ পায় জয়। লোকটা গলাটা ছোট করে বলে, চুরি ছিনতাই করি না। টিকিটে চার আনা করে হয়। খারাপ কিছু করছি দাদা? মনে কিছু করলেন?

জয় কঠিন হওয়ার চেষ্টা করেও পারে না। সে ভারতবর্ষের একটি বড় পার্টির দক্ষিণ কলকাতার একজন মেম্বার। সে দুর্নীতি রুখতে অনেক কিছুই করতে পারে বলে তার ধারণা। যদিও এই রাজ্যে তার দলের কোমরের জোর তেমন নেই, তবু তামাম দেশে তো তার দলই এখন খেলছে। এই লোকটাকে ইচ্ছে করলেই সে ধরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু একটু মায়া হল। বয়সও বেশি নয়। ত্রিশের নীচেই।

জয় বলল, মদ খেয়েছেন?

একটু। সেও কাল রাতে। কিছু মনে করলেন দাদা?

আপনি কাজটা ঠিক করছেন না।

আজ্ঞে না। তবে কিনা পেটের দায়ে করতে হয়। কত লোকে আরও কত খারাপ কাজ করে। চারদিকে করাপশন অ্যান্ড করাপশন।

চার নম্বরে আর একটা লোকাল ঢুকতেই লোকটা সুট করে গেটের বাইরে গিয়ে গোলকিপারের মতো পজিশন নিয়ে নিল।

লোকটাকে ধরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা জয় দমন করল। করাপশন কোথায় নয়? এই যে প্ল্যাটফর্মে ছানাপোনা নিয়ে কুঁদো কুঁদো সব মেয়েছেলে শুয়ে থাকে রাত্রিবেলা সেটাও বে-আইনি। আবার সকালে চাতাল ধোয়ার সময় ভিস্তিওলা যখন ওই ঘুমন্ত মেয়ে আর শিশুর গায়ে নির্বিকারে জল ছিটিয়ে উঠিয়ে দিতে লাগল তখন সেটাকেও খুব ন্যায় মনে হয়নি তার। মুশকিল হল, কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তার কোনও বাঁধাবাঁধি ধারণা সে আজও করে উঠতে পারেনি। গোটা দেশটায় কী যে সব ঘটছে।

দলের কিছু ছেলে-ছোকরা মদনদাকে রিসিভ করতে এসেছে। তাদের সঙ্গে জয় ভেড়েনি। মদনদার সঙ্গে তো তার ভিড়ের সম্পর্ক নয়। বহুকাল আগে হালতু থেকে পালবাজার অবধি মদনদা তাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে ডবল ক্যারি করেছিল। আর, তার সেজদির সঙ্গে মদনদার একটা সম্পর্ক তো ছিলই। সুতরাং জয়ের দাবি অন্যরকম। এম পি হয়েও মদনদা তার সঙ্গে ফাঁট দেখায় না কখনও। অবশ্য মদনদার ফাঁট বলতেও কিছু নেই।

লাউডস্পিকারে বার বার বলছে, ডানকুনিতে পাওয়ার ব্লক থাকার দরুন দার্জিলিং মেল আসতে পারছে না। সোয়া সাতটায় আসার কথা, এখন বাজছে নটা। দাঁড়িয়ে আর পায়চারি করে করে জয়ের হাঁটু দুটো ধরে গেছে। বাড়ি থেকে বেরোতে দেরি হল বলে কিছু খেয়েও আসেনি। স্টেশনের খচ্চরের পেচ্ছাপের চেয়েও খারাপ এক কাপ চা খেয়েছে ত্রিশ পয়সায়। তার মধ্যে পনেরো পয়সাই ফেলা গেছে। ডানকুনিতে পাওয়ার ব্লক বা খচ্চরের ইয়ের মতো চা, এই সবকিছুর মধ্যেই এই দেশটার পচনশীলতা লক্ষ করা যায়। কিছুই ঠিকমতো চলছে না, কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না। একজন এম পি সহ দার্জিলিং মেল আটকে আছে ডানকুনিতে, ভাবা যায়?

টেকো হরি গোঁসাই এতক্ষণ প্ল্যাটফর্মে টানা মারছিল। অধৈর্য হয়ে এবার বেরিয়ে এসে জয়কে বলল, গাড়ি এত লেট! এরপর তো আমার অফিস কামাই হয়ে যাবে!

জয়ের মেজাজ খারাপ ছিল। একটু তেরিয়া হয়ে বলল, দেরির কথা রাখো। বারোটার আগে কোনও দিন দফতরে গেছ?

হরি গোঁসাইকে রসিক মানুষ বলে সবাই জানে। ফিচেল হেসে বলে, তা বারোটার সময়েও তো যেতে হবে নাকি? এখানেই নটা বাজল।

দেরি হয়ে থাকলে চলে যাও।

সে না হয় গেলাম। কিন্তু তা হলে বিশুকে মেডিকেলে ভর্তি করার কী হবে?

করাপশন! করাপশন! মদনদাকে এই লোকগুলোই খারাপ করে ফেলবে। ভারী বিরক্ত হয় জয়। স্টেশনে যে কটা লোক এসেছে সব কটা ফেরেব্বাজ, মতলববাজ। মুখে জয় বিরক্তির রেশটা ধরে রেখেই বলল, ও কথা তো মদনদা মালদায় যাওয়ার আগেই হয়ে গেছে।

দূর পাগল! এম পিদের মন হচ্ছে পদ্মপাতার মত। কিছু থাকে না, গড়িয়ে পড়ে যায়। বার বার মনে করিয়ে দিতে হয়।

ফের বললে চটে যাবে।

চটলেও ভাল। তাতে মনে দাগ থেকে যাবে। চ চা খেয়ে আসি। ডানকুনি থেকে গাড়ি ছাড়লে চল্লিশ মিনিট লাগবে। সময় আছে।

স্টেশনের চা? ও বাব্বা!

না, বাইরে থেকে খাব। চল, হ্যারিসন রোডে ঢুকে একটা ভাল দোকান আছে।

লাউডস্পিকারে গমগমে গলা বলে উঠল, ডানকুনিতে পাওয়ার ব্লক থাকার দরুন..

দুজনে বেরিয়ে আসে।

হরিদা!

উ।

একটু আগে একটা লোককে ধরেছিলাম। প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে টিকিট নিচ্ছে। চার আনায় বেচবে। সারাদিন একটাই টিকিট কতবার যে হাতবদল হবে।

ও তো বহু পুরনো ব্যাপার।

লোকটাকে পুলিশে দিলে কেমন হত?

তোর মাথা খারাপ? ওদের সব সাঁট আছে। ধরিয়ে যদিও বা দিলি গ্যাং এসে মেরে পাট করে দিয়ে যাবে। যা কিছু হচ্ছে হোক, চোখ বুজে থাকবি।

জয় কথাটা মেনে নিতে পারে না। বলে, এরকম করে করেই তো আমরা দেশটার

সর্বনাশ করছি। জয়ের কথাটা টেনে শেষ করে হরি গোঁসাই হাসে, উঠতি বয়সে ওরকম হয়।

বৃষ্টির জলে রাস্তায় থিকথিকে কাদা। তার ওপর খোঁড়াখুঁড়ির দরুন হাঁটা-চলাই দায়। হ্যারিসন রোডের চায়ের দোকানটায় পৌঁছতে গর্দিশ কিছু কম গেল না।

দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। মিনিট পাঁচ সাত দাঁড়িয়ে থেকে যদি বা বসার জায়গা পেল অতি কষ্টে, কিন্তু চা-ওয়ালা ছোকরারা পাত্তাই দেয় না। হরি গোঁসাই দুজনকে চায়ের কথা বলতে গেল, তারা অর্ধেক শুনেই অন্য কাজে ছুটে চলে গেল।

কিছু লোক আছে বুঝলে হরিদা, যাদের দেখলেই সবাই খাতির করতে থাকে। মদনদার কথাই ধরো, গঁড়ে বাজারে যেবার সত্যবাবুকে বাইরের দোকানিরা পেটাল, মদনা গিয়ে দাঁড়াতেই সব জল।

পারসোনালিটি, বুঝলি!

সেই কথাই তো বলছি। আমরা রেশন অফিসে গেলে কেউ পাত্তা দেবে, বলো? মদনদাকে দেখেছি, খুব কড়াকড়ি তখন, গিয়ে দু দিনে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের অফিস থেকে মেজদাদের রেশন কার্ড বের করে দিল। আগে থেকে কেউ চেনাজানাও ছিল না, কিন্তু গিয়ে এমন খাতির করে নিল যে, সবাই কিছু করতে পারলে যেন বর্তে যায়।

ও হল অন্য ধাত। বিশুটাকে মেডিকেলে ভর্তি করাতে যদি কেউ পারে তো মদনদা।

এবার কেন যে খুব উদার গলায় জ্য বলে, হয়ে যাবে। ভেবো না। তবে কথাটা ঠিক, আজকাল মদনদা খুব ভুলে যায়।

এম পি-দের ঠেলা তো জানিস না। সকাল থেকে মাছি পড়ে। কটা মনে রাখবে?

জয় দূরের দিকে চেয়ে ভারী ভালবাসার গলায় বলল, কিন্তু আগে মদনদার সব মনে থাকত। এমন সব কথা মনে থাকত যা ভাবলে অবাক হতে হয়।

হরি গোঁসাই খপ করে এক চা-ওলা ছোকরার কব্জি চেপে ধরে বলল, আমাদের যে গাড়ির তাড়া, দু কাপ চা টপ করে দেবে ভাই?

তাড়া তো সবার। ছোকরা হেসে বলে, শুধু চা?

শুধু চা। একটু দুধ চিনি বেশি করে।

তা অত কথা শোনার সময় ছোকরার নেই, হাত ছাড়িয়ে চলে গেল।

জয় বলে, নীলু হাজরার খুনের কেসটা মনে আছে? মদনদা সাক্ষী দিয়েছিল। খুনের সময় নীলুর জামার রংটা পর্যন্ত হুবহু বলে দিয়েছিল। মদনদার সাক্ষীতেই তো নব হাটির চৌদ্দ বছর মেয়াদ হল।

মুখটা চোখা করে হরি গোঁসাই বলে, খুনটা কিন্তু নব করেনি।

তবে কে করেছে? তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ঝুঁকে বসল জয়।

হরি গোঁসাই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ভাল মানুষের মতো বলে, সে-সব কথা যাকগে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তারপর আরও এক পা গলাটা নামিয়ে নিজেকেই নিজে যেন বলল, এখন বিশুটা মেডিকেলে চান্স পেলেই হয়।

চা এসে যায়। বেশ ভাল চা।

নোনতা বিস্কুট খাবি? হরি গোঁসাই জিজ্ঞেস করে।

আনমনে চায়ে চুমুক দিয়ে জয় বলে, না। তুমি খাও।

দার্জিলিং মেল আট নম্বরে ঢুকল ঠিক পৌনে দশটায়। এর মধ্যে আরও কিছু লোক জুটে গেছে মদনদাকে রিসিভ করতে। জনা দুই রিপোর্টার, দু-চারজন মহাজন, আরও কিছু ছেলেছোকরা ক্যাডার।

শুধু একটা মাঝারি মাপের ভি আই পি স্যুটকেস হাতে, পায়জামা পাঞ্জাবি পরা মদনদা ফার্স্ট ক্লাশ একটা কামরার দরজাতেই বিরক্তমুখে দাঁড়িয়েছিল। ট্রেন থামতেই নেমে পড়ল। ভিড়ের প্রথম হুড়োহুড়িটা কাটানোর জন্য একটু সরে দাঁড়াল। লোকগুলো গিয়ে মাছির মতো হেঁকে ধরেছে মদনদাকে। কে যেন একটা মালা পর্যন্ত পরিয়ে দিল।

দিক। ওসব বাইরের মাখামাখিই তো আর আসল নয়। মদনদার সঙ্গে সত্যিকারে ঘনিষ্ঠতা তো জয়ের। এক সাইকেলে তাকে ডবল ক্যারি করেছিল মদনদা। তারই সেজদির সঙ্গে ভাব ছিল। আর কারও সঙ্গে তো অত গভীর সম্পর্ক নয়। মদনদার বয়স পঁয়ত্রিশ হবে হয়তো টেনেমেনে। এখনও বেশ টান ফরসা টনটনে চেহারা। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে।

ট্রেন লেট ছিল বলে ব্যস্ত এম পি মানুষটার সময়ে টান পড়েছে। ভিড় কাটিয়ে জোর কদমে এগুচ্ছে। ওই হরি গোঁসাইয়ের ছেলেটা দড়াম করে পায়ের ওপর পড়ে প্রণাম ঠুকল! দেখো কাণ্ড! আর একটু হলেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত লোকটা।

কিন্তু মদনদা পড়ল না। মদনদারা পড়ে না অত সহজে। এমনকী অসন্তুষ্টও হল না। লোক নিয়ে কারবার, লোকের ওপর বিরক্ত হলে চলবে কেন।

জয় দেখল, সে পিছনে পড়ে থাকছে। মদনদা তাকে দেখতে পায়নি! গা ঘষাঘষি সে পছন্দ করে না বটে, কিন্তু জানান দেওয়ার জন্য একবার বেশ জোর গলায় ডাকল, মদনদা!

মদনা পিছু ফিরে দেখে একটু হাসল।

দেখেছে! যাক, নিশ্চিন্তি। জয়ের সকালটা সার্থক।

.

০৩.

খবরের কাগজ নিয়ে পায়খানায় যাওয়াটা মোটেই ভাল চোখে দেখে না মণীশ। কিন্তু সংকোচবশে শালা মদনকে কথাটা বলতেও পারে না। মণীশরা চিরকাল এঁটোকাঁটা, শুদ্ধাচার, বাথরুমে যাওয়ার অবশ্য পালনীয় নিয়ম কানুন মেনে এসেছে। তার বাসার সবাই মানে।

খবরের কাগজটার জন্য অস্বস্তি বোধ করছিল মণীশ। সকালের দিকে অফিসের তাড়ায় ভাল করে পড়া হয় না, তাই বিকেলে এসে পড়ে। আজ আর খবরের কাগজটা পড়া যাবে না। এম পি শালাকে কিছু বলাও যায় না।

মণীশ খেতে বসেছে। একটু দেরিতেই অফিসে যাচ্ছে আজ। ডালের মুখে একটু আলু ভেজে দেবে বলে চিরু তাকে আস্তে খেতে বলেছে। আস্তেই খাচ্ছে সে, কিন্তু ভাজাটা সময়মতো পাবে বলে মনে হচ্ছে না। মদনকে যারা স্টেশনে রিসিভ করতে গিয়েছিল তাদের মধ্যে আট-দশজন সঙ্গেই এসেছে। বাইরের ঘরে জোর গলা পাওয়া যাচ্ছে। চা না দেওয়াটা অভদ্রতা, তার ওপর এরা কেউই খুব এলেবেলে লোক নয়। চিরু এখন আলুভাজার কড়াই নামিয়ে চায়ের জল বসিয়েছে। সময় লাগবে।

আস্তে আস্তে খেয়েও মণীশের পাতের ডালভাত শেষ হয়ে এল। রান্নাঘর আর বাথরুমের মাঝামাঝি ছোট্ট এক চিলতে একটু ঢাকা জায়গায় অতিকষ্টে তিন ফুট একটা টেবিল আর দুটি চেয়ার পেতে তাদের খাওয়ার জায়গা। ডানদিকে একটা জানালা। জানালার পাশে গলি। সেদিক থেকে সূর্যালোকহীন স্যাঁতস্যাঁতে গলির সোঁদা গন্ধ আসে। জানালা দিয়ে সিনারি বলতে দেখা যায় শুধু পাশের বাড়ির দেয়াল এবং রেন পাইপ। ইদানীং রেইন পাইপ ঘেঁষে একটা অশ্বথের চারা বেরিয়েছে। ভারী সবুজ, ভারী সতেজ। রোজ ওই সবুজটুকুর দিকে চেয়ে ভাত খায় মণীশ। আজ দেখছিল বড় বড় তিনটে পাতার আড়ালে আর একটা কচি পাতা উঠেছে।

আর একটু বোসো, হয়ে এল। চিরু শোয়ার ঘরে তোলা কাপ প্লেট আনতে যাওয়ার পথে বলে গেল।

মণীশ শেষ গ্রাসটার দিকে চেয়ে রইল। চিরু আবার ভাত দেবে জোর করে, কিন্তু আজ আর তার খেতে ইচ্ছে করছে না।

কাপ প্লেটের পাঁজা নিয়ে চিরু যখন ফের রান্নাঘরে ঢুকছে তখন মণীশ বলল, শোনো, আমার পেট ভরে গেছে। দেরিও হয়ে যাচ্ছে।

সামনের জিনিসটা না খেয়ে চলে যাবে? বোসো না। হয়ে গেছে তো।

কেন ঝামেলায় জড়াচ্ছ? থাক না, রাতেও তো খেতে পারব। শু

শুধু তো ডাল ভাত খেলে!

হোক না, ডালে ঝিঙে আর লাউ দিয়েছিলে যে। শুধু ডাল ভাতের দোষ কেটে গেছে।

এ কথায় চিরু একটু হাসল। রুক্ষ চুল, না-সাজা চেহারায় চিরুকে এই ক্লান্তিতে ভরা হাসি দিয়ে চেনা যায়। কুড়ি বছর ধরে মণীশের সব দুঃখের ভার বহন করছে। এই দু-ঘরের বাসার বাইরের পৃথিবীকে খুব একটা দেখেনি। ভাই এম পি হওয়ার পর একবার দিন দশেকের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে দিল্লি গিয়েছিল। ব্যস।

রান্নাঘরে কাপ প্লেট ধুতে ধুতে চিরু বলে, বাসন্তীকে কখন বিস্কুট আনতে পাঠিয়েছি এখনও এল না।

আসবে। বলে শেষ গ্রাসটা মুখে দিয়ে মণীশ জল খেল।

আসবে তো। চা যে ঠাণ্ডা হবে ততক্ষণে। সরকারদের বাড়ির থেকে নাকি ভাঙানি দিচ্ছে। আজকাল কাজে একদম মন নেই। চলে গেলে কী যে করব। চিরুর গলায় অসহায়তা ফোটে বটে, কিন্তু রাগ বা বিদ্বেষ নেই।

বাসন্তী গেলেও তোক পাওয়া যাবে।

চিরু চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলে, এ চা-পাতাটার কত দাম গো?

মদন আসবে বলে কাল একটু ভাল চা এনেছে মণীশ। বলল, ত্রিশ টাকা।

ভীষণ দাম।

পাঁচ বছর আগেও এই কোয়ালিটির চা ষোলো টাকায় কিনেছি।

দাম নিলেও গন্ধটা বেশ।

লোকজনের সামনে বাইরের ঘর দিয়ে খাবার আনাটা অভদ্রতা বলে চিরু বাসন্তীকে শিখিয়েছে, গলির জানালা দিয়ে খাবারের ঠোঙা গলিয়ে দিতে। মণীশ জলের গ্লাস রেখে যখন উঠতে যাচ্ছে তখন জানালা দিয়ে ঠোঙাসুদ্ধ কচি হাত ঢোকাল বাসন্তী।

মামাবাবু, ধরো।

মণীশ বাঁ হাতে বিস্কুটের ঠোঙাটা নেয়। বলে, এসে গেছে।

চিরু বলে, আজ কি ফিরতে দেরি হবে?

না। রোজ যেমন ফিরি। কেন?

ভাবছিলাম, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে পারলে একবার দমদমে কণাকে গিয়ে খবর দিয়ে আসতে পারবে কিনা।

কেন বলো তো! হঠাৎ কণাকে কেন?

মদনকে ওর সব কথা এসে বলুক। যদি মদন কিছু করতে পারে।

একজন এম পি কী কী পারে তা খুব ভাল করে জানা নেই মণীশের। তবে হয়তো অনেক কিছুই পারে। হুট করে কিছু না বলে সে একটু ভাবল, ভেবে বলল, এ তো অত্যন্ত পারসোনাল প্রবলেম চিরু। মদন কী করবে?

আর কিছু না পারুক, সুভাষকে ভয় দেখাতে তো পারবে। কণা গত রবিবারে এসেও কত কান্নাকাটি করে গেল। বোম্বেতে বদলি হয়ে সেই যে চার মাস আগে গেছে সুভাষ, এখনও একবারটিও আসেনি। মাত্র তিনখানা চিঠি দিয়েছে। টাকা পাঠাচ্ছে খুব সামান্য। তার মানে তো বুঝতেই পারছ। ওখানে আবার কোনও মেয়েকে জুটিয়ে নিয়ে ফুর্তি করছে।

মণীশ একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলে, সুভাষ চিকিৎসার বাইরে। কারও কারও রক্তই ওরকম খারাপ। মদন ইন্টারফিয়ার করলে যদি আরও ক্ষেপে ওঠে তবে কণার ওপর টচার করবে।

টর্চার কি এখনই কম করছে? কণার জন্য আমাদের কিছু করাও তো দরকার। মদনকে বলি, তারপর ও যা ভাল বুঝবে, করবে।

ঠিক আছে।

তা হলে যাবে?

যাব।

গিয়ে বেশি দেরি কোরো না।

দমদম থেকে এই মনোহরপুকুর আসতে একটু সময় তো লাগবেই। চিন্তা কোরো না।

বাথরুম থেকে মদনের কাশির শব্দ আসছে। সঙ্গে জলের শব্দ। এবার বেরোবে। কিন্তু আজকের খবরের কাগজটা আর ভাল করে পড়া হবে না মণীশের।

মণীশ যখন পোশাক পরছে তখন মদন এসে ঘরে ঢুকল। কাঁধে তোয়ালে। হাতে জলের ছোপ লাগা খবরের কাগজ। পায়খানার কাপড়ও ছাড়েনি বোধহয়। ব্যস্ত এম পি, এসব ছোটখাটো ব্যাপারে নষ্ট করার মতো সময় নেই।

জামাইবাবু কি অফিসে বেরোচ্ছেন?

আর কী করি বলো?

আমার অনারে আজ অফিসটা কামাই দিতে পারতেন।

কামাই দিলেও লাভ নেই। তোমাকে পাব কোথায়? এক্ষুনি বাইরের ঘরের ভক্তরা তোমাকে দখল করে নেবে। তারপর প্রেস কনফারেনস আছে, রাইটস আছে, আরও কত কী!

মদনের চেহারাটা ভালই। লম্বা, একহারা, ফরসার দিকেই রং। মুখশ্রীতে একটু বেপরোয়াভাব আছে। একটু চাপা নিষ্ঠুরতাও। মদনের ভয়ডয় বরাবরই কম। কোনও ব্যাপারেই লজ্জা সংকোচের বাই নেই। অবিশ্রাম কাজ করে যেতে পারে, সহজে ক্লান্ত হয় না। কাজ করতে করতে এযাব, বিয়ে করে উঠতে পারেনি। গায়ে একটা গুরু পাঞ্জাবি চড়াতে চড়াতে বলল, বাইরে হালদারের গাড়ি আছে। বলে দিচ্ছি, আপনাকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসুক।

প্রস্তাবটি লোভনীয়। এখন এই দেরিতে বেরিয়েও বাসে উঠতে দারুণ কষ্ট হবে মণীশের। তবু সে মাথা নেড়ে বলে, ওবলিগেশনে যাবে কেন? আমাকে তো রোজই অফিসে যেতে হবে। রোজ তো হালদারের গাড়ি পাব না। তা ছাড়া অফিসের লোক গাড়ি দেখলে বলবে, এম পি শালার খুঁটির জোরে গাড়ি দাবড়াচ্ছি।

আপনাকে আর মানুষ করা গেল না।

চিরু চায়ের ট্রে হাতেই ঘরে ঢুকে বলে, মদন, তুই এখন কিছু খাবি না?

মদন ভ্রূ কুঁচকে বলে, বাইরের ঘরে চা দিচ্ছিস নাকি?

চিরু লজ্জা পেয়ে বলে, দিই একটু।

ডিসগাস্টিং। সারাদিন লোক এলে সারাদিনই চা দিবি নাকি? ওসব ভদ্রতা খবরদার করতে যাবি না। ওদের দরকারেই ওরা আসে, আতিথেয়তার কিছু নেই।

তুই চুপ কর তো। আমার মোটেই কষ্ট হয়নি।

কষ্টের কথা নয়। ফতুর হয়ে যাবি

তোকে এখন খাবার দেব তো!

না, একটু বাদে ভাত খেয়ে বেরোব।

চিরু চলে যেতে মদন চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলে, খাঁদ বঁচি সব কই?

ইস্কুলে। মণীশ বলে, সারা সকাল তোমার জন্য হাঁ করে পথ চেয়েছিল। ট্রেন লেট বলে আর থাকতে পারল না।

ডানকুনিতে পাওয়ার ব্লক থাকায় আটকে গেল গাড়ি। সকালে একটা ইমপরট্যান্ট এনগেজমেন্ট ছিল, রাখা গেল না।

মদন চারদিকে চেয়ে বলে, এ ঘরটায় কী করে যে এতকাল আছেন আপনারা। একে একতলা, তাতে ছোট ঘরে গাদা জিনিসপত্র। এতদিনে একটা বাড়ি করার মতো টাকা আপনার হয়েছে জামাইবাবু।

সতীনের ছেলেকে সবাই মোটা দেখে। টাকা হত, যদি রাখা যেত।

মদন মাথা নেড়ে বলে, আপনার কিছু হবে না জামাইবাবু।

যা বলেছ।

তবু আপনি ভীষণ হ্যাপি।

আবার সেই সতীনপো-এর বৃত্তান্ত! পরের সুখই সকলের চোখে পড়ে।

চুল আঁচড়ে মদন ঘাড়ে গলায় একটু পাউডার দিল। বলল, আর কিছু না করুন, এবার একটা টেলিফোন লাগান। নইলে আমার ভারী অসুবিধে।

ঠিক আছে, অ্যাপ্লাই করব।

আপনাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করবখন।

.

০৪.

ভুলে যাওয়ার এক অতুলনীয় ক্ষমতা আছে মদনের। আবার মনে রাখার ক্ষমতাও তার তুলনারহিত। দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশে সে জীবনের ফালতু ঘটনা, মানুষ বা কথাকে ভুলে যেতে পারে। যা তার প্রয়োজন তা প্রখরভাবে মনে রাখে।

ফিটফাট হয়ে যখন সে বাইরের ঘরে ঢুকল তখন সকালের অনেক ঘটনাই ভুলে গেছে। আবার বেশ কিছু ঘটনা তার মনেও আছে।

মনে রাখার মধ্যে আছে দুজন সাংবাদিক। আগাগোড়া দুই রিপোটার তার সঙ্গে লেগে আছে।

ঘরে ঢুকেই সে বলল, শচী, বলো খবর কী?

শচী লম্বা কালো মোগা এবং ধূর্ত। চারদিকে মিটমিটে চোখে চেয়ে নিয়ে হাসি-হাসি মুখে বলে, খবর তো আপনার কাছে দাদা।

ঘরের কথাবার্তা থেমে গেছে। সকলে এম পির দিকে তাকিয়ে। প্রাইম মিনিস্টার পর্যন্ত এঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।

মদন চারদিকের মনোযোগটাকে খুব উপভোগ করে। দরজার কাছে রোগা ও অল্পবয়সী জয় তার চা এখনও শেষ করতে পারেনি। এবার এক চুমুকে শেৰ আধপেয়ালা মেরে দিল।

মদন বলল, গত জুলাইয়ে মনসুন সেশনে আমি পালামেন্টে একটা বিলের ওপর খুব গুরুতর একটা প্রশ্ন তুলি। দিল্লি, এলাহাবাদ, বোম্বের কাগজে সেটা ফাস্ট পেজে ফ্ল্যাশ করে। তোমাদের কাগজে তার সামান্য উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। কেন শচী! বাঙালি এম পি বলেই কি তোমাদের এরকম মনোভাব?

শচী জিব কেটে বলে, ছি ছি। কে না জানে, আমরা বাঙালি লিভারদের সবচেয়ে বেশি কভারেজ দিই।

আমাকে দাওনি। কভারেজ আমি চাইও না। দি ইসু ওয়াজ ইমপরট্যান্ট। সেটা অস্তৃত কভার করা উচিত।ছল।

এজেন্সি আমাদের খবর দেয়নি তা হলে।

নিশ্চয়ই দিয়েছিল। পি টি আই, ইউ এন আই সকলে কভার করেছে। দেয়নি আমাদের দিল্লির করেসপন্ডেন্ট। আই হেট হিজ গাটস। তবে সনাতন মুখার্জিকে আমি চিনি। ওয়ান ডে উই উইল হ্যাভ এ শো-ডাউন।

সনাতনদার হয়তো দোষ নেই! খবরটা নিশ্চয়ই দিয়েছিলেন, নিউজ ডেসকে বাদ হয়ে গেছে।

তাই বা কেন হবে? নিউজ ডেসক কি ঘাস খায়? খবরের ইমপরট্যান্স বোঝে না?

আমি জেনে আপনাকে বলব মদনদা।

মদন দেখেছে, কনফ্রনটেশন দিয়ে দিন শুরু করলে তার দিনটা ভালই যায়। এইজন্য সে সকালের দিকে একটা ঝগড়া বা চেঁচামেচি বাঁধিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আজ শচীকে ধমকে তার বউনি বোধহয় ভালই হল।

ভোটের সময় মদনের পক্ষে পাণ্ডা ছিল শ্ৰীমন্ত। এতক্ষণ বাইরের রাস্তায় সিগারেট খাচ্ছিল দু-তিনজনে মিলে। মদন বাইরের ঘরে এসেছে টের পেয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরে একধারে একটা গদিআঁটা বড় সোফা, দুটো ছোট সোফা, কয়েকটা অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের পলিথিনের চেয়ার। সবটাতেই ঠাসাঠাসি ভিড়।

শ্ৰীমন্ত এসে মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে কানে কানে বলে, হালদারের সঙ্গে একটু কথা বলে যাবেন। সবার হয়ে গেলে। প্রাইভেট।

শ্ৰীমন্তের কথা মানতেই হয় মদনকে। শ্ৰীমন্ত তার ডান হাত। মদন নিচু গলায় বলে, ফালতু লোক কিছু কাটিয়ে দে।

হরিদা তার ছেলেকে মেডিকেলে ভর্তি করানোর কথা বলতে এসেছে। কাল আসতে বলে দিই?

দে।

আর জয়?

ও কী চায়?

কিছু বলেনি। তবে কিছু চায় নিশ্চয়ই।

কাটিয়ে দে।

তা হলে ওদের নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। দুপুরে কি প্রেস ক্লাবে আসতে হবে?

আসিস।

শ্ৰীমন্ত ওঠে। পেটানো বিশাল চওড়া তার শরীর। একবার তাকালেই তার পেশা সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। সে গিয়ে দরজার ভিড়টাকে প্রায় কোলে নিয়ে রাস্তায় নেমে গেল।

একটা চেনামুখের দিকে চেয়ে মদন হাসে, কী খবর?

আধবুড়ো সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোকটি কিছু তটস্থ হয়ে বলেন, রেল বোর্ডে আমার কেসটার কথা তুলবেন বলেছিলেন।

কাগজপত্র কিছু দিয়েছিলেন আমাকে?

দিয়েছিলাম। গত জানুয়ারিতে।

ওঃ, তা হলে হারিয়ে ফেলেছি। মাঝখানে ফিলিপিনস মালয়েশিয়া সব যেতে হয়েছিল ডেলিগেশনে। ফিরে এসে দেখি, ফাইলে অনেক কাগজপত্র নেই।

তা হলে?

একটা চিঠি করে দিয়ে দেবেন আমার কাছে। দেখব।

কথাটা ভাল করে শেষ করার আগেই বাঁ ধারের বুক কেসের কাছে দাঁড়ানো এক মহিলা বললেন, বাবা, আমার কথাটা একটু শুনে নেবে? বাড়িতে ছোট বাচ্চা রেখে এসেছি। দূরও অনেক, সেই বোড়াল।

বলুন।

আমি মন্টু হাটির মা।

ও। মন্টু কে যেন?

আমার ছেলে। ওই বড়। মেজো নব।

নব?

নীলু হাজরার খুনের দায়ে যে ছেলে জেল খাটছে।

মদন একটু নড়ে বসে, ও, তা কী চাই আপনার? নবর জন্য তো আর কিছু করার নেই।

তার বউ বাচ্চা সব আমার ঘাড়ে। মন্টু এক পয়সাও দেয় না। নব জেলে। আমি কী করে সলাই?

আর্নিং মেম্বার কেউ নেই?

না। নবর বউ একটা সেলাই স্কুলে কাজ করে। কিছু পায়। তাতে হয় না।

আমাকে কী করতে বলেন?

নবর অফিসে যদি ওর বউয়ের একটা চাকরি হয়।

কোন অফিস?

বেহালায়। সি সি পি কারখানা। বউ অনেক ধরাধরি করেছে, হয়নি।

কী বলে ওরা?

খুনের বউকে চাকরিতে নেবে না।

সি সি পি না কী বললেন?

সি সি পিই হবে বোধহয়। তাই তো শুনি।

আচ্ছা, বাইরে শ্ৰীমন্ত আছে। ওকে ডেকে ডায়েরিতে নামটা লিখিয়ে যান। দেখব।

দেখো বাবা।

একটা কথা বলব মাসিমা? নীলু হাজরা ছিল আমার এক বন্ধুর ছোট ভাই। আমরা সবাই ভালবাসতাম তাকে। ভারী ভাল ছেলে ছিল।

নব ঘটির বিধবা মায়ের চেহারাটা খুব নিরীহ ব্রনের নয়। বয়স হলেও ডাকসাইটে স্বভাবের ছাপ আছে। কথাবার্তায় কোনও জড়তা নেই, ভয়ডর নেই। যে কোনও জায়গা থেকে কাজ আদায় করে আনার ক্ষমতা রাখে কিন্তু মদনের এই শেষ কথাটায় বুড়ি একটু কেমনধারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সন্দিহান চোখে মদনের দিকে চেয়ে থেকে বলে, তা হলে কি ওর বউয়ের জন্য একটু বলবে না বাবা?

মদন হাসল, খুন তো করেছে নব, ওর বউ তো নয়। বলব। তবে আমি দিল্লি হলে যতটা পারতাম এখানে ততটা তো পারি না। তবু বলে দেখব। কারখানার মালিক কে জানেন?

কানোয়ার না কী যেন।

এই যে লম্বা চওড়া ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওই শ্ৰীমন্ত। রাস্তায় আছে, একটু খুঁজে নিয়ে তার কাছে সব লিখিয়ে দিয়ে যান। আপনার বউমার নামও।

আচ্ছা।

প্রেস ক্লাব থেকে দুপুরে একটা ফোন করল মদন।

মাধব?

আরে মদনা? কোত্থেকে?

মালদার ইনটিরিয়ারে বান দেখতে গিয়েছিলাম।

দেখলি?

দেখলাম। মেলা জল।

ফি বছরই অক্রুর সংবাদ। এখানে জল, সেখানে জল, মরছে ভাসছে গৃহহারা হচ্ছে। তোরা করছিস কী?

দিল্লিতে বসে মোচ তাওড়াচ্ছি। কী করার আছে? ভেসে যাক, সব ভেসে যাক।

দে ভাসিয়ে তবে শালা, দে ভাসিয়ে। কোথায় উঠেছিস?

আবার কোথায় উঠব। মনোহরপুকুর।

দিদির হাত ছাড়িয়ে আমার গাড়ায় চলে আয়। কদিন আছিস?

পুজোটা থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। হচ্ছে না। দিল্লি থেকে ডেকে পাঠিয়েছে, আবার এক ডেলিগেশনে অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে।

ভ্যানতারা রাখ। তোর ডেলিগেশনও চিনি, তোর অস্ট্রেলিয়াও চিনি। কদিন আছিস তাই বল।

আমি নেই রে। পরশুদিন চলে যাচ্ছি।

তা হলে আজ চলে আয়।

পাগল! আজ দিদি ত্রিশ টাকা কিলোর চিংড়ি আনিয়েছে।

তা হলে কাল?

দেখি। বিনুক কেমন আছে?

ঝিনুক ঠিক ঝিনুকের মতো আছে। ক্যাপটিভ ইন হার ওন শেল।

আমি বাবা তোদের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেমগুলো একদম বুঝি না। মানুষের খাওয়া পরার সমস্যা আছে, আধিব্যাধি আছে, দুঃখ টুঃখও আছে, তবে তোদের সব সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার।

তোর সব কিছু বোঝার দরকার কী? তুই যেমন দেশ কি নেতা মদনকুমার হয়ে আছিস তাই থাক না।

মদন খুব হো হো করে হেসে বলে, ইয়েস, মদন ইজ দেশ কি ন্যাতা। মদনাকে খুব সমঝে চলবি, বুবলি!

আর সমঝাতে হবে না বাবা। ন্যাতাদের খুব ভক্তি মান্যি করি। ভাত কাপড় না দিক, কিলটাও আবার না বসায়।

বটেই তো। মদন গম্ভীর হয়ে বলে। তারপর গলাটা এক পা নামিয়ে বলে, আরে শোন। নব হাটির মা এসেছিল আজ। ছেলের বউয়ের জন্য চাকরি চায়।

ওপাশ থেকে মাধবের সাড়াশব্দ কিছুক্ষণ পাওয়া গেল না। বেশ একটু ফাঁক দিয়ে আস্তে করে বলল, ছেলের বউয়ের জন্য চাকরি চায়? নবর বউ সেই গৌরী না?

হাঁ। মদন একটা চাপা শ্বাস ছেড়ে বলে, খুব টেটিয়া বুড়ি। নব জেলে যাওয়ায় ওর বউ বাচ্চা নিয়ে নাকি বুড়ি বিপদে পড়েছে।

মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যা পারিস করিস। ওদের দোষ কী?

পাগল নাকি? অনেক ব্যাপার আছে।

কী ব্যাপার?

পলিটিকস করতে গেলে সব দিক বিবেচনা করে ডিসিশন নিতে হয়।

তুই কি নবর বউকে চাকরি দেওয়ার মধ্যে পলিটিক্যাল গেইন খুঁজছিস নাকি?

আই অলওয়েজ ওয়ান্ট টু প্লে ইট সেফ, দেখতে হবে মতলবখানা কী। আমাকে ফাঁসাতে চায় কি না।

ধুস শালা। খেতে পাচ্ছে না, তাই তোকে মাতব্বর ধরেছে। এর মধ্যে অন্য মতলবের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?

পাবলিকের মন সবসময়েই ভারী সরল। আমাদের বুদ্ধি একটু প্যাঁচালো।

এই যে একটু আগে বললি মানুষের মনের ঘোরপ্যাঁচ বুঝিস না!

একেবারেই যে বুঝি না তা নয়। একটু একটু বুঝি, তবে তোর বা ঝিনুকের কথা আলাদা, তোদের তো কোনও বাস্তব সমস্যা নেই। তোরা কুঁথে কুঁথে সমস্যা তৈরি করছিস।

আমাদের ঘোরতর একটা বাস্তব সমস্যা রয়েছে। আমাদের কোনও বাচ্চা নেই!

আঃ হাঃ, সে তো আমারও নেই।

তোর নেই কে বলল?

তা হলে আছে বলছিস?

থাকতেই পারে। লেজিটিমেট না তো ইলেজিটিমেট, বিয়ে তো কলি না স্রেফ ভয়ে। পাছে বউ এসে পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার তৈরি করায় বাগড়া দেয়।

বিয়ের বয়স যায়নি ব্রাদার। নাউ আই অ্যাম এ মোর এলিজিবল ব্যাচেলর।

ধুস শালা। এম পি একটা পাত্তর নাকি? আজ আছে কাল নেই।

কেন, লোকের মুখে শুনিসনি, পাঁচ বছর এম পি থাকতে পারলে সাত পুরুষ পায়ের ওপর পা দিয়ে চলে যায়।

তা বটে। তা হলে কাল তোকে এক্সপেকট করছি!

দেখা যাক।

দেখা যাক নয়। আমি আর ঝিনুক কাল বাসায় থাকব তোর জন্য।

খুব চেষ্টা করব, না পারলে ফোন করব, তোর বাসার ফোন ঠিক আছে তো?

কপালজোরে আছে। গত মাসেও পনেরো দিন বিকল ছিল, কালও যে থাকবে না তা বলা যায় না।

জীবনের উজ্জ্বল দিকগুলোর কথাই আমাদের ভাবা উচিত।

মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তোর মতো গাড়লরা গদিতে বসলে কী করে মানুষ উজ্জ্বল দিক নিয়ে ভাববে?

খুব হেসে মদন বলল, আচ্ছা, আজ এ পর্যন্ত।

বলে ফোন রেখে দেয়।

.

০৫.

বাবা আধো অন্ধকার সন্ধ্যায় ঘরের মধ্যে বসে আছেন। মুখটা অস্পষ্ট, গায়ে একটা সাদা হাফশার্ট, পরনে খাকি রংয়ের প্যান্ট। টেবিলে কনুই, হাতের তেলোয় থুতনির ভর। একটু কুঁজো হয়ে চুপ করে চেয়ে আছেন। ভারী নির্জন চারদিক। শুধু পাখিরা ডাকাডাকি করছিল খুব। আর বিবি। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিল ঝিনুক। সে তখন ছোট, বছর দশেকের মেয়ে। দৃশ্যটা আজও সব তুচ্ছাতিতুচ্ছ খুঁটিনাটি নিয়ে মনে আছে।

বরাবরই বাবা চুপচাপ মানুষ! কঠিন, কর্তব্যপরায়ণ, কম কথার মানুষ। চেহারাটা লম্বা, মজবুত হাড়ের চওড়া কাঠামো, কালো, কর্কশ মুখশ্রী। তবু বাবার তুল্য পুরুষ ঝিনুক কখনও দেখেনি।

সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে বাবার কাছে যেতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল তার। কিন্তু সে স্পষ্টই দেখল, বাবা সেই ঘরে ঠিক বসে নেই। শুধু শরীরটা পড়ে আছে, আসল বাবা অনেক দূরে কোথাও বেড়াতে চলে গেছে বুঝি।

ঝিনুক আস্তে আস্তে সাহস করে এগিয়ে গেল কাছে।

বাবা, তোমার কী হয়েছে?

বাবা আস্তে হাতখানা বাড়িয়ে ঝিনুকের চুলগুলো এলো করে দিল, হাঁটুর কাছে বুক চেপে ঊর্ধ্বমুখে ঝিনুক বাবার অস্পষ্ট মুখ দেখছিল। ভারী দুঃখী মুখ।

বাবা, তোমার মন খারাপ?

না তো। এই একটু ভাবছি।

কী ভাবছ?

তোমাদের কথা।

কেন বাবা?

এমনি। আমি মাঝে মাঝে তোমাদের কথা ভাবি।

ব্যস, এর বেশি আর কথা হয়নি, তবু কত গভীর কত স্পষ্টভাবে দৃশ্যটা তার কালের চিহ্ন এঁকে রেখেছে আজও মনের মধ্যে!

তুমি বড্ড বেশি বাবা বাবা করো ঝিনুক, বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই একটু অনুযোগের সুরে কথাটা বলেছিল মাধব। তেমন কিছু নয় তবু তৎক্ষণাৎ নতুন স্বামীকে মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল সে। কোনও জবাব দেয়নি, ঝগড়া করেনি।

ঝিনুক ভাবে, আমার বাবার মতো যে তোমরা কেউ নও।

পুরুষরা ঝিনুককে কী চোখে দেখে তা সে জানে। পথে ঘাটে যেসব পুরুষ তার দিকে তাকায় তাদের কাছে সে স্রেফ গোলাপি মাংস। মাধবের কাছে সে ভারী একঘেয়ে, বিরক্তিকর, খিটখিটে মেয়েমানুষ। তার যদি হেলে থাকত তবে সব অন্যরকম হত, পুরুষমানুষের প্রতি এত ঘেন্না থাকত না।

ঘেন্না? না, তাই বা বলে কী করে? পুরুষমানুষকে ঘেন্না পেলে সে কি বাবাকে অত ভালবাসতে পারত?

বাবার কথা ভেবে আজ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ঝিনুকের।

উদাসিনী ঝিনুক তার বটুয়াটা দোলাতে দোলাতে ভারী আনমনে হাঁটছিল, একজনের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা, হয়তো এক্ষুনি, হয়তো একশো বছর পর। কিন্তু হবে, সে মানুষ কেমন হবে তার একটা ভাসা ভাসা ধারণা আছে তার, স্পষ্ট কিছু জানে না। তবে এটুকু জানে, তার অনেকখানিই থাকবে এক প্রদোষের অন্ধকারের মতো রহস্যে ঢাকা। খানিকটা চেনা যাবে, অনেকখানি থাকবে অচেনা।

গডিয়াহাটা ব্রিজের একদম মাঝখানে অনেকটা উঁচুতে উঠে ঝিনুক একটু ধীর হল। এপাশ ওপাশ দিগন্ত পর্যন্ত তাকিয়ে দেখল। কত দূর! কত দুর! পৃথিবীর অন্ত নেই। দুরন্ত বাতাস এসে লাগছে নাকে মুখে। উজ্জ্বল আলো, নীল আকাশ। মানুষ পাছে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা-টত্যা কিছু করে সেই ভয়েই বোধহয় ব্রিজের মাঝ বরাবর দুধারের রেলিং-এর সঙ্গে মস্ত উঁচু জালের বেড়া। জালের ধারে দাঁড়িয়ে একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু রাস্তার লোকজন তাকাবে, ভাববে। ঝিনুক দাঁড়াল না। কিন্তু খুব ধীর পায়ে ঢাল বেয়ে নামতে লাগল। নীচে একটা নদী থাকলে এই ব্রিজটা আরও কত ভাল লাগত। ঢালুর মুখেই তার মনে পড়ল, মোগলসরাই! মোগলসরাই! সে এক অদ্ভুত ভাল জায়গা। সেইখানে থাকার সময় মাঝে মাঝে জিপ জোগাড় করে তারা পুরো পরিবার বোঝাই হয়ে যেত বারাণসী। মাঝপথে মস্ত ব্রিজ, নীচে গঙ্গা। বাবা সেখানে জিপ দাঁড় করাবেই। আর তখন ওই বয়সে ঝিনুক সেই ব্রিজ থেকে গঙ্গার প্রবহমানতার দিকে চেয়ে মূক হয়ে যেত ভয়ে বিস্ময়ে। শক্ত করে বাবার হাত ধরে থাকত সে। নইলে যে ভীষণভাবে গঙ্গা টানত তাকে। কেবলই মনে হত, অনিচ্ছে সত্ত্বেও হয়তো সে লাফিয়ে পড়বে। আজও উঁচু জায়গা থেকে নীচে জল দেখলে হাত পা কেমন সুলসুল করে তার। সম্মোহিত হয়ে যায়। মনে হয় জল তাকে ডাকে। জল কি প্রেমিক!

আপনমনে একটু হেসে ফেলে ঝিনুক। কী অদ্ভুত সে! জল কি প্রেমিক? একথাটা মাথায় এল কী করে? মনটা বড় উড়ে উড়ে থাকে আজকাল, কোথাও বসতে চায় না। বড্ড বেশি কবিতা পড়ছে বলে নাকি?

ব্রিজ থেকে নেমে ডান ধারে পঞ্চাননতলায় একটু ভিতর দিকে শুক্তির বাসা। অনেক ঘাটের জল খেয়ে কয়েক মাস হল এক কাঁড়ি টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে একতলার ছোট একটা বাসা নিয়েছে। বোন কাছাকাছি আসায় ঝিনুক প্রায়ই একবার ঢু মেরে যায়। বয়সে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট শুক্তি জমাট সংসারী। দুটি ছেলের মা। অজস্র সমস্যায় কণ্টকিত। সবসময়েই মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভয় পাওয়া ভাব।

ঝিনুক ঘরে ঢুকতেই শুক্তি বলে উঠল, উঃ দিদি রে, ঝি-এর অভাবে মরে গেলাম। দে না একটা ভাল দেখে ঝি। আজও আমাদেরটা কামাই করেছে। এঁটো বাসন ডাঁই হয়ে পড়ে আছে, অ্যাতো বাসি জামা কাপড় জমে আছে, ঘর মোছা হয়নি, কী যে করি।

ডানার ভর ছেড়ে ঝিনুক মাটিতে নামল। জাগল। চারদিকে চেয়ে দেখে বলল, একটুও টিপটপ থাকতে পারছিস না। কী যে করে রেখেছিস ঘরখানা।

ছেলে দুটো যে হাড় বজ্জাত। সারাদিন গোছাচ্ছি, সারাদিন লণ্ডভণ্ড করছে।

ঝিনুক সামনের ঘরে সোফা কাম বেডের বিছানায় বসে হাঁফ ছেড়ে বলল, ঠিক আছে, আমি গিয়ে পুনমকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আজকের মতো ঘরদোর সেরে দিয়ে যাক।

ও বাবা! চোখ বড় করে শুক্তি বলে, পুনমকে দিয়ে কী হবে। ও মুসলমান যে!

ঝিনুক আর একটু জেগে ওঠে। তাই তো, মনে ছিল না। মানুষের কতরকম সমস্যা থাকে, যা তার নেই। ঝিনুকের একটু চা খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু শুক্তির অবস্থা দেখে আর খেতে চাইল না। উঠতে উঠতে বলল, আচ্ছা, দেখব।

শুক্তি বাইরের ঘরেই বঁটি পেতে আলুর খোসা ছাড়াতে বসেছে। গলা একটু নামিয়ে বলল, এ বাসাও ছাড়তে হবে। পিছন দিকে রেল লাইনের আশে পাশে গুণ্ডা বদমাস ওয়াগন ব্রেকারদের আড্ডা। কালও একটা ছেলেকে তাড়া করে ওই ভিতর দিকে নিয়ে গেল। মেরেই ফেলেছে বোধ হয়, আর কী বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি গালাগাল, শোনা যায় না।

ঝিনুক চোখ বড় করে চেয়ে থাকে। পৃথিবীতে এসব-ও ঘটে! কত কী ঘটে! মানুষ কতরকম ভাবে বেঁচে আছে। সে নিজে অবশ্য এতসব টেরও পায় না। বালিগঞ্জের অত্যন্ত নির্জন সুন্দর পাড়ায় চমৎকার ফ্ল্যাটে থাকে সে। নিজস্ব ফ্ল্যাট, কোনও দিন ছাড়তে হবে না। তার কাজের লোকের অভাব কদাচিৎ হয়, কারণ সে প্রচুর টাকা মাইনে দিতে পারে। তবে কি শুক্তির চেয়ে সে সুখী?

শুক্তির দিকে একটু চেয়ে থেকে নিজের সঙ্গে মেলাল সে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। এভাবে মেলানো যায় না। সুখ দুখের তুলনা কিছুতেই হয় না কখনও। শুক্তির বাসায় পা দিলেই তার এক ধরনের কষ্ট হয়, হাঁফ ধরে যায়। সে নিজে নিঃসন্তান আর শুক্তি দুটি ছেলের মা বলে তার কখনও হিংসে হয় না। শুক্তির ছেলে দুটোকে সে খুব ভালবাসে। মাঝে মাঝে তার শুধু মনে হয়, একটা ছেলে থাকলে বেশ হত।

ঝিনুক অনেকটা জেগেছে। একটু ভেবেচিন্তে বলে, এবার তোরা একটা ফ্ল্যাট কিনে নে না।

টাকা কই? ফ্ল্যাটের যা দাম। এই তো দেখ, দেড় ঘরের ফ্ল্যাটের জন্য মাসে থোক চারশো টাকার মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। হাতে কী থাকে বল! আমাদের ওসব হবে টবে না। চিরকাল ভাড়া বাড়িতেই পচে মরব।

বাদবাকি সময় অনেক কথা হল, কিন্তু ঝিনুক তখন মাটি ছেড়ে উড়েছে আবার, ভারী আনমনা।

শুধু উঠবার মুখে শুক্তি বলল, একটা খবর শুনেছিস দিদি?

কী রে?

নীলুকে যে খুন করেছিল, সেই নব গুণ্ডা নাকি জেল থেকে পালিয়েছে।

ঝিনুক খুব আনমনে বলে, তাই নাকি? বলেই হঠাৎ চকে উঠল সে। নীলু! নীলুকে কে খুন করেছে?

তোর ভগ্নীপতি কোথা থেকে শুনে এসে কাল রাতে বলল।

ঝিনুকের ভারী মুশকিল। শত চেষ্টাতেও সে মনটাকে কোনও একটা জায়গায় রাখতে পারে না। কত কথা শোনে, ভুলে যায়। রাস্তায় বেরিয়ে নব গুণ্ডর কথাও সে ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু হঠাৎ রুমঝুম নুপুর বাজিয়ে শরতের কিশোরী বৃষ্টি এল। দু মিনিট। একটা সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াল ঝিনুক। আর তখনই ওই সাদা রোদে মাখামাখি এক অপরূপ রুপালি বৃষ্টির দিকে চেয়ে থেকে মনে পড়ল তার। নব হটি। নব টি কী অদ্ভুত নাম। লোকটা জেল থেকে ছাড়া পেল কেন? না, ছাড়া পায়নি তো! পালিয়েছে। তাই তো বলছি শুক্তি! রুপোলি বৃষ্টির নাচ দেখে কেন কথাটা মনে হল? একটা সম্পর্ক আছে নিশ্চয়ই! কিন্তু নবর কথা নয়, বার বার নীলু এসে হানা দিচ্ছে মনের মধ্যে, যেন এক পাগলা বাতাস। ঝিনুকের ভিতরে উড়ে যাচ্ছে কাগজের টুকরো, উড়ছে পর্দা, ভেঙে পড়ছে কাঁচের শার্শি। ওলট পালট। ওলট পালট।

বৃষ্টি থামল। মেঘভাঙা রোদ অজস্র গয়নার মতো পড়ে আছে চারপাশে। গলির মুখে এসে একটা রিকশা নিল ঝিনুক। নইলে চটি থেকে কাদা ছিটকে দামি শিফনের শাড়িটায় দাগ ধরাবে।

বাড়িতে ফিরে ঝিনুক বাইরের ঘরে পাখাটা চালিয়ে একটু বসে। এ তার বহুদিনের অভ্যাস। সেন্টার টেবিলের নীচে থাকে একটা দামি সিগারেটের খালি প্যাকেট।

ঝিনুক ভ্রূ কোঁচকায়। মনে পড়ে না। কার প্যাকেট? কে ফেলে গেল? মাধব তো এ সিগারেট খায় না!

নিচু হয়ে প্যাকেটটা তুলে নেয় ঝিনুক। দু হাতে ধরে চেয়ে থাকে যত্নে। কোনও মানে হয় না। মনে পড়বে না।

কিন্তু চোখ তুলতেই মনে পড়ল। ঠিক এই সোফায় বসে কাল দুপুরে অনেক সিগারেট খেয়েছিল বৈশম্পায়ন। কী অদ্ভুত ওর সেই বসে থাকা! ওর বউ শর্মিষ্ঠা গেছে পুজোর বাজার করতে! ওর ছোট ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। আর ও বাইরের ঘরে অদ্ভূত মুখ করে বসে আছে।

ঝিনুক জানে। সব জানে। বৈশম্পায়ন কেন আসে ফিরে ফিরে। ঈশ্বর।

বার বার উঠি উঠি করছিল বৈশম্পায়ন। বাইরে গিয়ে ঘড়ি দেখছিল শর্মিষ্ঠা ফিরছে কি না। আসলে তো তা নয়। এই একা বাড়িতে ঝিনুকের মুখোমুখি বসে থাকা তার কাছে অস্বস্তিকর। বড় অতিকর।

মনে মনে ভারী হাসে ঝিনুক। অত যদি লজ্জা তবে ফটো তুলেছিলে কেন?

ব্যাপারটা আর কেউ জানে না। এমনকী বৈশম্পায়নও জানে না যে, ঝিনুক জানে। বৈশম্পায়নের কাছে কথাটা কখনও বলেনি সে। স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে যেমন প্রথম পরিচয় এবং তারপর কিছু ঘনিষ্ঠতা হয় তার বেশি কিছুই করেনি ঝিনুক। কিন্তু তার ই একটা ঘটনার স্মৃতি আছে। বৈশম্পায়নকে এই তার প্রথম দেখা নয়, বৈশম্পায়নেরও নয় ঝিনুককে প্রথম দেখা।

গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে থাকতে বলাই সিংহী লেন ধরে আমহার্স্ট স্ট্রিট পেরিয়ে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তে যেত কিনুক। আর তখন ডান দিকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে রামমোহন রায় হোস্টেল থেকে কয়েকটা ছেলে রোজ লক্ষ করত তাকে।

ঝিনুক শুধু একজনকেই লক্ষ করেছে। অনুগত, বিশ্বাসী ভক্তের মত, দোতলার এক জানালায় তার কামাই ছিল না কখনও। তবে সে মাঝে মাঝে নেমে আসত, পিছু নিত। বহু দূর ঘুরে উল্টো কি দিয়ে এসে মুখোমুখি হত। তবে সাহসের অভাবে কখনও কথা বলেনি। সেই নীরব ভালবাসা কিশোরী ঝিনুকে বাজে বকুলের মতো ঝরেছে তখন। এক বছর গড়িয়ে যাওয়ার মুখে একদিন ঝিনুক দোতলায় ছেলেটিকে খুঁজে পেল না। একটু অবাক হয়েছিল সে। ছেলেটা গেল কোথায়?

ছেলেটা আসলে কোথাও যায়নি, শুধু জায়গা বদল করেছিল। নীচের তলায় হোস্টেলের কমনরুমে টুকটাক টেবিল টেনিসের আওয়াজ পেয়েছে ঝিনুক। সেই কমনরুমের খোলা জানালায় চোখের কাছে ক্যামেরা তুলে তাক করে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। ঝিনুক তাকাতেই শাটার টিপল। তারপর খুব ভয়-পাওয়া ক্ষীণ গলায় বলল, আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না।

ঝিনুক জবাব দেয়নি। আজকালকার ছেলেমেয়ে হলে কবে লটরপটর করে ফেলত। কিন্তু তারা পারেনি। শুধু একটু মনখারাপ হয়েছিল ঝিনুকের। আর দেখা হবে না?

অবশ্য না হলেই বা কী? উঠতি বয়সের সুন্দরী ঝিনুক তার পরেও কত পুরুষের দৃষ্টিতে স্নান করেছে।

কিন্তু বৈশম্পায়ন ঠিক বলেনি। দেখা তো হল। কেউ কাউকে চেনা দিল না। কিন্তু চিনতে পারল ঠিকই। ঘটনাটা মনেই থাকত না ঝিনুকের, যদি সেদিন বৈশম্পায়ন ছবি না তুলত। বড় জানতে ইচ্ছে করে, সেই ছবিটা আজও বৈশম্পায়নের কাছে আছে কি না।

সিগারেটের প্যাকেটটা কিনুক আরও কিছুক্ষণ দেখল চেয়ে। তারপর উঠে গিয়ে ট্রাশ বিন-এ ফেলে দিয়ে আবার সময় শুনল, ফোন বাজছে।

ঝিনি?

হ্যাঁ।

একটা খবর আছে।

কী?

মদন এসেছে।

মদনাটা আবার কে?

আরে মদনা, আমাদের মদনা। এম পি।

তাতে কী হল?

না বলছিলাম, ওকে কাল খেতে বললে কেমন হয়।

সে তুমি বুঝবে। আমি কী বলব?

না, না, মানে বাড়িতে তেমন কোনও ঝামেলা কোরো না। ভাবছিলাম, চীনে রেস্টুরেন্টের খাবার নিয়ে যাব।

ভয়টা তো খাবার নিয়ে নয়।

ও হো হো, তুমি যা পাজি হয়েছ না! আচ্ছা, এবার খুব ছোট একটা বোতল খোলা হবে।

সে তুমি খোলো গিয়ে। কাল আমি শুক্তির বাসায় গিয়ে বসে থাকব বিকেলে।

আরে, কী যে মুশকিল। এবার ঝামেলা হবে না, ঠিক দেখো। আরে, আমাদেরও তো বয়স হচ্ছে। আগের মতো বেহদ্দ ছেলেমানুষ আছি নাকি?

তোমার ফ্ল্যাট, তাতে তুমি যা খুশি করবে। আমার কী? আমি থাকব না।

এই কি প্রেম ঝিনি?

সেটাও তুমি বুঝে দ্যাখো।

এটা প্রেম নয়।

আমি তো প্রেম চাই না।

তা বটে। তুমি সত্যিই প্রেম চাও না। মাধবের একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা হলে ড্রাই হোক?

সে তোমার খুশি।

বিয়ারে আপত্তি নেই তো! ওটা তো মদের ক্যাটাগোরিতে পড়ে না।

ওসব আমি জানি না। মদনার গলা জড়িয়ে ধরে তুমি বদনা বদনা খাও। আমি সং সেজে বসে থাকতে পারব না।

না হয় তুমিও একটু খাবে। স্বাদটা জেনে রাখা ভাল।

আমার স্বাদের দরকার নেই।

আচ্ছা তা হলে ড্রাই। এক্সট্রিমলি ড্রাই। ও কে?

কী একটা জরুরি কথা বলা দরকার যেন মাধবকে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। অথচ বলা দরকার। ভীষণ দরকার।

শোনো, একটু ধরে থাকো। জরুরি কথা আছে।

মনে পড়ছে না?

না। তবে পড়বে।

ধরে আছি। তুমি বরং কথাটা মনে করার চেষ্টা না করে বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখে জল দাও। গুনগুন করে একটু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাও। মনটাকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখো। তা হলে হঠাৎ মনে পড়বে।

আঃ, একটু চুপ করো না! এক্ষুনি মনে পড়বে।

চুপ করছি। কিন্তু তুমি একটু অন্য কথা ভাবো না ঝিনি! মনে করো আমরা সেই উশ্রী নদীর ধারে দাঁড়িয়ে হাঁ করে পরেশনাথ পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছি। তুমি উঠতে ভয় পেয়েছিলে বলে ওঠা হল না। মনে পড়ে?

মোটেই ভয় পাইনি। এক সাধু আমাদের উঠতে বারণ করেছিল।

ওই হল। সাধু ভয় দেখিয়েছিল, আর তুমি ভয় পেয়েছিলে।

সাধু ভয় দেখায়নি। সাবধান করেছিল।

এবার মনে পড়েছে?

কী?

জরুরি কথাটা?

না, কিন্তু মনে পড়বে।

মনে করার চেষ্টা কোরো না। খবরদার। বরং আমাদের সেই বীভৎস মধুচন্দ্রিমার কথাটা মনে করো। নিছক বাঙালি বলে কিছু ছেলে সেবার সমুদ্রের ধারে আমাদের কী রকম হেকেল করেছিল। নতুন বউয়ের সামনে আমি একটু রুস্তম হতে গিয়ে কী রকম…

আঃ, চুপ করো না। ওসব কথা বলে আরও সব গুলিয়ে দিচ্ছ আমার। দাঁড়াও আসছি।

এই বলে ক্র্যাডলের পাশে রিসিভার রেখে দ্রুত পায়ে শোওয়ার ঘরে ঢোকে ঝিনুক। খুব ভাল সুগন্ধ মাখলে তার মন স্বচ্ছ হয়ে যায়। নিউ মার্কেট থেকে কেনা দুর্দান্ত একটা জার্মান সেন্ট আছে। ক্যাবিনেট খুলে বুকে সেইটে দুবার স্প্রে করে ঝিনুক। সম্মোহনের মতো গন্ধ। ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।

শিশি জায়গা মতো রেখে উঠে আসতে গিয়ে নীলুর ছবিটা চোখে পড়ল। ভাগ্যিস!

ফোন তুলে ঝিনুক বলে, নীলুকে যে খুন করেছিল তাকে মনে আছে?

একটু চুপ করে থেকে মাধব যখন কথা বলল ফের, তখন সে অন্য মানুষ। এতটুকু রস-রসিকতা নেই গলায়। ধীর স্বরে বলল, আছে। কেন?

তার নামটা কী?

নব হাটি।

সেই নব জেল থেকে পালিয়েছে।

এবার এতক্ষণ চুপ করে থাকে মাধব যে, ঝিনুকের একবার সন্দেহ হয় ওপারে কেউ নেই।

শুনছ?

শুনছি। তোমাকে কে বলল?

শুক্তি।

শুক্তি জানল কী করে?

ওকে বলেছে বিনায়ক।

বিনায়ক কার কাছে খবর পেল?

অত শত জিজ্ঞেস করিনি। তবে মনে হল, খবরটা জরুরি। তোমাকে জানানো দরকার।

খবরটা খুবই জরুরি। ভীষণ জরুরি। তোমাকে ধন্যবাদ ঝিনি।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress