আপনি একজন বড় স্কলার
আপনি একজন বড় স্কলার, তাই না?
এসব কথা থাক। একগাদা ডিগ্রি কোনও কাজে লাগে না।
কিন্তু এ ব্যাপারটাকে আমি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখছি।
কেন দেখছেন? ডিগ্রি দিয়ে কিছু হয় না।
আপনি মাধ্যমিকে প্রথম কুড়িজনের মধ্যে ছিলেন। সাধারণত এই পর্যায়ের রেজাল্ট যারা করে তারা সায়েন্স নিয়ে পড়ে এবং ডাক্তারি বা প্রযুক্তির লাইনে যায়, আপনি তা যাননি। আপনি আর্টস পড়েছেন। কেন বলুন তো?
আমার কলকবজার ব্যাপারও ভাল লাগত না, ডাক্তারিতেও আগ্রহ ছিল না। ইতিহাসে আমার খুব ইন্টারেস্ট ছিল বরাবরই। ইতিহাসে আমি সবসময়ই ভাল নম্বর পেতাম।
ভাল কথা। সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক এটা কাম্যও নয়। বিশেষ করে এখন ইঞ্জিনিয়ারদের বাজার পড়তির দিকে। গত কয়েক দশকে নানা ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বহু ছাত্র পাশ করে বেরোনোর ফলে চাকরিতে টান পড়েছে। বিদেশেও তাদের ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে। ডাক্তারদের অবস্থা হয়তো একটু বেটার। কিন্তু নাম না করলে ডাক্তারদের পশার নেই।
আপনি প্রফেশনের কথা ভাবছেন তো! আমি যখন লেখাপড়া করতাম তখন পেশা নিয়ে কিছু ভাবিনি। পড়াশুনো করতাম নেশার মতো। তবে আমি জানতাম ইতিহাস পড়ে খুব মোটা মাইনের চাকরি পাওয়ার আশা নেই, বড়জোর একটা অধ্যাপনা।
শেষ পর্যন্ত আপনি তাই পেয়েছেন, এতে কি আপনি খুশি?
হ্যাঁ, অখুশি হওয়ার কী আছে বলুন। আমি তো স্বেচ্ছায় আমার বিষয় নির্বাচন করেছি। ভবিষ্যৎ জানাই ছিল।
আপনি তো ল-ও পড়েছেন। যতদূর জানি এলএলবি-তেও আপনি ভালই ফল করেছিলেন।
হ্যাঁ। আমাদের সম্পত্তিঘটিত একটা দীর্ঘস্থায়ী মামলা ছিল। আমরা উকিলের আর আদালতের পিছনে অনেক খরচ করেছি। বাবা আমাকে ল পড়তে বলেন ওই মামলা চালানোর জন্যই।
মামলা কি আপনি চালিয়েছেন?
খানিকটা সাহায্য করেছিলাম বইকী!
মামলাটা আপনারা শেষ পর্যন্ত জিতেও যান।
হ্যাঁ।
তা হলে আপনি ওকালতিও খারাপ করতেন না।
করলে হয়তো ভালই করতাম। কিন্তু আপনাকে তো বলেছি, আমার ওসব ভাল লাগে না। আমি লেখাপড়া নিয়ে থাকতে ভালবাসি। আর আমার প্রিয় বিষয় হল ইতিহাস। কিন্তু আপনি যে কেসটার তদন্ত করছেন তাতে আমার কোয়ালিফিকেশন কোন প্রসঙ্গে আসছে?
নিরুপমবাবু, আমার কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে তাতে দেখা যাচ্ছে ইতিহাস আপনার প্রিয় বিষয় হলেও অনার্সে আপনি খুব টেনেমেনে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। আর এমএ-তে তাও নয়, সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট।
আপনার তথ্য ভুল নয়, ও দুই পরীক্ষাই আমার খারাপ হয়েছিল। অনার্সের আগে আমি চোখের একটা অসুখে পড়েছিলাম, ডাক্তার সন্দেহ করেছিল রেটিনা ডিট্যাচমেন্ট, শেষ অবধি অবশ্য তা হয়নি। এমএ পরীক্ষার আগে আমি একটি মেয়ের পাল্লায় পড়ে খানিকটা গোল্লায় গিয়েছিলাম।
মেয়েটির নাম কি স্বপ্না?
আপনি কী করে জানলেন?
জানাই যে আমার কাজ।
তাই দেখছি। আর কিছু জানতে চান?
হ্যাঁ। আমার অনেক কিছু জানার আছে। স্বপ্না সেন সম্পর্কে যদি একটু ডিটেলস ইনফর্মেশন দিতে পারেন তা হলে ভাল হয়।
স্বপ্না! সে তো অতীত, তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল প্রায় দশ-বারো বছর আগে। তখন আমার বোধহয় বাইশ-তেইশ বছর বয়স। কিংবা আরও একটু কম হতে পারে। এমএ ফার্স্ট ইয়ারে আমার বয়স বোধহয় ছিল একুশ।
হ্যাঁ, তাই ছিল।
স্বপ্নার সঙ্গে তখন আমার একটা রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বপ্না খুবই সুন্দরী ছিল। একটা মিষ্টি ঝগড়ার ভিতর দিয়ে আমাদের ভাব হয়। সেটা দ্রুত ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কে পরিণত হয়।
ঝগড়াটা কী নিয়ে হয়েছিল?
ছেলেমানুষি ব্যাপার। অবশ্য তখন আমরা তো ছেলেমানুষই ছিলাম। আমাদের একটা প্রাচীর পত্রিকা বেরোত। পবিত্র সেন নামে একটি ছেলে হাতে লিখে পনেরো দিন পর পর সেটা আমাদের ক্লাসরুমের করিডরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিত! সেটা সবাই খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে পড়তও। তাতে আমি স্বপ্ন নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম। স্বপ্না সেটা পড়ে ভীষণ চটে যায়। তার ধারণা হয়েছিল ওটা ওকে নিয়ে লেখা এবং তাই নিয়ে ঝগড়া। রেগে গিয়ে স্বপ্না অধ্যাপকের কাছেও নালিশ করেছিল। যাই হোক, শেষ অবধি মিটমাট হয় এবং ভাবও হয়।
তারপর?
তারপর যা হয় আর কী। কফি হাউস, ময়দান, সিনেমা আর থিয়েটার, আর্ট এগজিবিশন এইসব করে বেড়াতাম দুজনে।
কোনও ফিজিক্যাল সম্পর্ক?
আরে না মশাই, না, দশ-বারো বছর আগে আমাদের নীতিবোধ খানিকটা অবশিষ্ট ছিল। আর আমার মনে হয়, স্বপ্না কোনওদিনই আমাকে সিরিয়াসলি নেয়নি, বড়লোকের মেয়ে এবং বেশ বুদ্ধিমতী, সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যে আমি হচ্ছি তার স্টপ গ্যাপ কম্প্যানিয়ন। যথারীতি এমএ পরীক্ষার পরেই সে দুঃখপ্রকাশ করে ভোকাট্টা হয়ে যায়। এখন সে সুইজারল্যান্ডে এক সফল একজিকিউটিভের ঘর করছে। আর সেই প্রেম থেকে বুরবক আমি লাভ করলাম একটা সেকেন্ড ক্লাস এবং খানিকটা তিক্ততা। কিন্তু আপনার তদন্তে স্বপ্নাকে কেন প্রয়োজন হচ্ছে সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
হয়তো পরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে, আপাতত আমি আপনাকে এরকম কিছু কিছু প্রশ্ন করেই যাব।
কিন্তু কেন?
আপনার সাইকোলজিটা বুঝবার জন্য। স্বপ্নার রিফিউজালের ব্যাপারটা আপনি এখন যেমন ক্যাজুয়ালি বললেন তখনও কি ঠিক এরকম ক্যাজুয়ালি ব্যাপারটা নিয়েছিলেন?
না মশাই, তখন আমার বয়স কম, হৃদয় ভরা আবেগ। তখন তো পাগল হয়ে যেতে বসেছিলাম। মরার কথাও ভেবেছি। মদ খেয়ে দেবদাস হওয়ারও চেষ্টা করেছি। স্বপ্নাকে ছাড়া কী করে বেঁচে থাকব সেটাই তখন প্রশ্ন ছিল।
প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবেননি?
হ্যাঁ, তাও ভেবেছি বইকী।
কীরকম প্রতিশোধ? খুন করাটরা?
হ্যাঁ, সে কথাও এক-আধবার মনে হয়েছিল। কিন্তু বেসিক্যালি আমি একজন ভিতু মানুষ। ওসব চিন্তা করতে পারি না। ওরকম ইচ্ছা হলেও পরে তার জন্যে অনুতাপ হয়।
আপনার কি মনে হয় আপনি খুন করতে অপারগ?
হ্যাঁ, অবশ্যই। একজন ছটফটে জ্যান্ত মানুষকে খুন করার কথা আমার তো কখনও মনে হয়নি। আমি কোনও ভয়ানক দৃশ্য বা ঘটনা সহ্য করতে পারি না। রক্তপাত দেখলে আমি অসুস্থ বোধ করি।
ঠিক এক মাস আগে বালিগঞ্জ প্লেসে নেহা মজুমদার নামে একটি মেয়ে খুন হয়। পত্র পত্রিকায় তার মৃত্যুর খবর ছাপাও হয়েছিল। মাত্র একুশ বছর বয়স, অত্যন্ত সুন্দরী, মোটামুটি বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী, স্মার্ট এবং হবু ফিল্ম স্টার এই মেয়েটির সবে বিয়ে হয়েছিল। হাজব্যান্ড অত্যন্ত প্রসপারাস আইটি ম্যান। বছরে ছয় মাস তাকে বিদেশে থাকতে হয়। বিয়ের পর মাত্র এক বছরের মধ্যেই এই ঘটনা।
সবই জানি। নেহা আমার ছাত্রী ছিল। নেহার মৃত্যুর পর লোকাল পুলিশও আমার কাছে আসে। বোধহয় নেহার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে যে রসালো গল্পটি প্রচলিত আছে তার জন্যই আমাকে জেরা করা হচ্ছে।
রসালো গল্পটা প্রচলিত হল কেন নিরুপমবাবু?
তা কী করে বলব বলুন। লোকে কাদা ভালবাসে। বেশিরভাগ লোকেই তো নিষ্কর্মা, অ্যান্ড আইডল ব্রেন ইজ ডেভিল’স ওয়ার্কশপ।
আপনার ডিভোর্স কতদিন হয়েছে?
ডিভোর্সের রায় এখনও বেরোয়নি। তবে আমার স্ত্রী ডিভোর্স পেয়ে যাবে। মামলা স্ট্রং, আইন তো এখন মেয়েদের পক্ষেই।
মামলায় আপনার উকিল কি আপনি ছিলেন?
না। বরং উলটো। আমার বউ যখন ডিভোর্সের প্রস্তাব দিল তখন আমিই ওকে বলি, কোন কোন পয়েন্টে মামলা করলে ডিভোর্স তাড়াতাড়ি পাবে।
কেন, ডিভোর্সটা কি আপনার কাছেও প্রার্থিত ছিল?
ছিল। যে সম্পর্কটা নেই, তাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে কী লাভ? আমার স্ত্রীর বয়স কম, গানবাজনায় উন্নতি করতে চায়, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, আমার মতো নীরস লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে তার জীবনটা তো নষ্টই হচ্ছিল। আমার বীথিকার জন্যে দুঃখই হয়। আমি ওকে কী দিতে পারতাম বলুন! আমার যথেষ্ট টাকাপয়সা নেই, আমি রূপবান নই, আজকালকার পুরুষদের মতো যথেষ্ট স্মার্ট আর চটপটে নই, আমার ভবিষ্যৎ অনুজ্জ্বল। উপরন্তু আমি গানের সমঝদার নই, আমার স্ত্রীকে মাঝেমধ্যে রান্নাবান্নাও করতে হত। তার এরকম জীবন ভাল লাগার কথা নয়।
বীথিকাদেবী একজন বেশ নামী ভোকালিস্ট। খেয়াল, ঠুংরি আমিও ভাল বুঝি না। কিন্তু যারা বোঝে তারা বলে, মহিলার ভবিষ্যৎ আছে।
হ্যাঁ, আপনি ভুল শোনেননি। ইদানীং বিভিন্ন প্রেস্টিজিয়াস মিউজিক কনফারেন্সে সে পারফর্ম করছিল। বীথিকার উপার্জনও বেশ ভাল।
আপনার সঙ্গে বীথিকাদেবীর তো প্রেম করেই বিয়ে হয়, তাই না?
হ্যাঁ। নইলে বামুন কায়েতের এমনি বিয়ে এখনও এদেশে হয় না। বীথিকা কায়স্থ বলে আমার পরিবারে ওকে ঠিকমতো গ্রহণও করা হয়নি।
সেজন্যই কি আপনি আলাদা বাসা নিয়ে আছেন?
ঠিক তা নয়, আমার মা বাবা চাকদহে থাকেন। পার্টিশনের পর আমার দাদু ওখানেই বাড়ি করেন। সেই বাড়িতে বাবা আর কাকার পরিবার একসঙ্গে থাকে। অবশ্য পৃথগন্ন। হাঁড়ি আলাদা, বাড়িও বিভক্ত। ওখানে জায়গাও হয় না, আর আমার সুবিধেও হয় না। আমি কলকাতায় বহুকাল ধরেই আছি।
বীথিকাদেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ-পরিচয় কীভাবে হয়?
সেটাও শোনা দরকার বুঝি?
কোনটা যে কখন দরকার হবে কিছুই বুঝি না।
বীথিকা ট্যালেন্টেড মেয়ে হলেও খুব অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে নয়। ওর বাবা বেঙ্গল গভর্নমেন্টের একজন অফিসার। ল্যান্ড রিফর্ম দপ্তরে। নদিয়ায় আমাদের কিছু চাষের জমি ভেস্ট হয়ে যাওয়ায় বাবার নির্দেশে আমি রাইটার্সে যাতায়াত করেছিলাম কিছুদিন। তখনই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়, সেটা একটু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেমে আসে। আমি ব্যাচেলার শুনে উনি ওঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে একদিন খাইয়েছিলেন। ইনসিডেন্টালি ওঁদের দেশ আমাদের ফরিদপুর জেলাতেই। উনি আমার দাদুকে চিনতেনও। যাই হোক, ওঁদের বাড়িতেই বীথিকার সঙ্গে পরিচয়। শুনে হয়তো অবাক হবেন মাত্র ছয় মাসের পরিচয়েই আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিই।
বীথিকাদেবীর বাড়ি থেকে আপত্তি ওঠেনি।
না, ওঁরা খুশিই হয়েছিলেন।
কতদিন আপনাদের বিয়ে হয়েছে?
তিন বছর কয়েক মাস।
নেহার সঙ্গে আপনাকে জড়িয়ে যা রটেছে তা কি বীথিকাদেবী জানেন?
জানে।
ওটা নিয়ে অশান্তি হয়নি?
অশান্তি বিয়ের পর থেকেই চলছিল। স্ক্যান্ডালটা তাতে ইন্ধন দেয়।
আপনার বিয়ের আগে কোনও গার্লফ্রেন্ড ছিল কি?
আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে আপনি আমার সম্পর্কে খুব ভাল হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। কাজেই আপনার কাছে হয়তো কিছু লুকোনোর চেষ্টা বৃথা।
হ্যাঁ। আমি ইম্পর্ট্যান্ট সাসপেক্টদের জেরা করার আগে হোমওয়ার্ক সেরে নিই।
সেটা টের পেয়েছি। আমার কোনও লিভ ইন গার্লফ্রেন্ড কখনও ছিল না। আমি কো এডুকেশনে পড়াই বলে কখনও কখনও বিভিন্ন ছাত্রীর সঙ্গে হয়তো একটু আধটু ইন্টিমেসি হয়েছে। কোনও গুরুতর ব্যাপার নয়।
বিয়ের আগে আপনি এই বাসায় একাই থাকতেন?
হ্যাঁ। ছোট এই বৈঠকখানা আর ভিতরে একটা বেশ বড় শোওয়ার ঘর, একটা কিচেন আর টয়লেট নিয়ে এই ফ্ল্যাটে আমি আছি বছর সাতেক। বইপত্রই আমার সাথি।
কাজের লোক?
আছে। ঠিকে। একজন প্রৌঢ়া। পুরনো লোক। সে-ই রেঁধেবেড়ে ঘরদোর সাফ করে দিয়ে যায়। চাবি তার কাছেই থাকে। খুব বিশ্বাসী।
এখনও আছে?
হ্যাঁ। অনেকটা মা-মাসির মতোই হয়ে গেছে।
বুঝেছি। ব্যাক টু বীথিকাদেবী।
আপনি কি বীথিকাকেও জেরা করেছেন?
না। তবে উনি আমার লিস্টে আছেন। খবর নিয়েছি, উনি দিল্লিতে একটা কনফারেন্সে গান গাইতে গেছেন।
হ্যাঁ। রাহুর ছায়া সরে গেছে। বীথিকা এখন আলো ছড়াচ্ছে।
আপনাদের কোনও সন্তান হয়নি।
না।
কেন?
সন্তানধারণের সময় বীথিকার ছিল না। গান নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
আপনি তার জন্য কোনও জোরাজুরি করেননি?
না। সন্তানের জন্য তাড়া ছিল না। বীথিকার সময় হলে হবে–এরকমই ধরে নিয়েছিলাম।
এবার নেহা সেনের বিষয়ে দু-চারটি কথা।
শবরবাবু, লোকমুখে আপনি কী শুনেছেন জানি না, নেহার সঙ্গে কিন্তু আমার প্রেম ছিল না।
আপনারা একসঙ্গে খাজুরাহোতে একবার, অজন্তা ইলোরায় একবার এবং রাজগিরে আরও একবার এক্সকারশানে গিয়েছিলেন?
ওরকম তো যেতেই হয়। একসঙ্গে বলতে আমি আর নেহাই তো শুধু নয়, আরও একগাদা ছাত্রছাত্রী ছিল। এক্সকারশান মানে স্পট স্টাডি।
আপনাদের সম্পর্কটা ঠিক কীরকম ছিল?
তেমন কিছুই তো ছিল না মিস্টার দাশগুপ্ত। অধ্যাপনার কাজেও আমার প্রায় আট বছর কেটে গেল। হাজার কয়েক ছাত্রী পার করেছি। অধ্যাপকরা ছাত্রীদের সঙ্গে প্রেম শুরু করলে যে কুল পাওয়া যাবে না।
কথাটা খুব ঠিক। তবু এরকম ঘটনা তো ঘটেও যায়।
ঘটে না বলছি না। কিন্তু খুব কম। এতই কম যে ব্যাপারটা চিন্তার বিষয়ই নয়।
নেহার সঙ্গে তা হলে আপনার কিছুই ছিল না।
না। একটু বাস্তব সত্যগুলোকেও দেখুন মিস্টার দাশগুপ্ত। আমি বত্রিশ বছর বয়স্ক একজন মাঝারি মানের অধ্যাপক। ধুতি পাঞ্জাবি পরে ক্লাস নিই। আমার ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই। আমার মতো সাদামাটা মানুষের প্রতি নেহার কোনও দুর্বলতা থাকাটাই তো অবাস্তব। আর আমি নিজেও প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। অকারণ রোমান্স করতে গিয়ে পা পিছলে পড়বার মতো নির্বোধ নই।
সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু খটকাও যে একটা আছে।
কীসের খটকা?
নেহা আপনার প্রেমে নাই পড়তে পারে। কিন্তু আপনার দিক থেকে একতরফা প্রেম হতে তো বাধা নেই।
আপনি কি বলতে চান আমি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিবাহিতা ছাত্রীকে গলা টিপে মেরেছি? মেরে লাভটা কী হবে বলুন তো? এইজন্যই তো বোধহয় আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন স্বপ্নাকে খুন করার ইচ্ছা আমার হত কিনা। সে না হয় বয়স অল্প ছিল, আবেগ বেশি ছিল বলে এক-আধবার ওরকম ইচ্ছে হয়েও থাকতে পারে। কিন্তু সে বয়সটা তো আমি ছাড়িয়ে এসেছি।
প্রেম কি এত লজিক মেনে হয়?
কম বয়সে লজিক থাকে না, কিন্তু অভিজ্ঞতার পর লজিক আসে। নেহাকে তার বিয়ের পর খুন করাটা কি লজিক্যাল ব্যাপার? নেহা অনেকদিন আগেই আমাকে তার বিয়ের কথা বলেছিল। আমি ওকে অভিনন্দন জানাই। বিয়ের নেমন্তন্নেও আমি গিয়েছিলাম। চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠান। নেহার বাবা বোধহয় কোটি টাকার বেশি খরচ করেছিলেন।
তিনি এখন মেয়ের খুনের ব্যাপারে অপরাধীদের ধরার জন্য আরও কোটি টাকা খরচ করতে রাজি। উনি সিবিআই-কে দিয়ে তদন্ত করানোর জন্য অলরেডি আবেদন করেছেন। মন্ত্রী আমলাদের ধরেছেন। কলকাতার ছয়-সাতজন, প্রাইভেট ডিটেকটিভকেও আসরে নামিয়েছেন।
বাবা হিসেবে করতেই পারেন। বিশেষ করে উনি টাকাওয়ালা বাবা। কিন্তু নেহার মতো একটা ফুটফুটে মেয়েকে খুন করার একটা মোটিভ থাকবে তো। লোকাল থানা থেকে স্পষ্ট করে না হলেও এরকম একটা ইশারা ইঙ্গিত করা হয়েছে। আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ মশাই, আপনারা না গোয়েন্দা পুলিশ? ঘটে কি একটু বুদ্ধি থাকবে না আপনাদের? স্পষ্ট করে বলুন না, নেহাকে আমি খুন করতে যাব কেন?
শবর একটু হেসে বলল, প্রশ্ন তো আমি করব। আপনি নয়।
কিন্তু মশাই তাতে ব্যাপারটা একতরফা হয়ে যাবে না কি?
ঠিক আছে, তা হলে আপনিই বলুন নেহাকে কে খুন করতে পারে।
আমার পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। নেহা কেমন জীবনযাপন করত, ব্যক্তিগত জীবনে ও কীরকম মেয়ে ছিল তা আমার জানা নেই। অনেক বয়ফ্রেন্ড ছিল জানি। অন্য কারণও থাকতে পারে। আমি কিন্তু এটা নিয়ে চিন্তা করিনি। খবরটা পেয়ে খুব শকড হয়েছিলাম।
খবর পেয়ে কি আপনি ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন?
না, মার্ডার কেস, নিশ্চয়ই পুলিশ তদন্ত করছে ভেবে যাইনি। তবে ফোন করেছিলাম। খবর পেলাম ওর হাজব্যান্ড এখানে নেই, বাঙ্গালোরে গেছে। তাকে খবর দেওয়া হয়েছে, সেদিনই আসছে। নেহার বাবাও বিদেশে ছিলেন। তারও খবর পেয়ে সেদিনই আসার কথা।
এসব কথা কে বলল ফোনে?
বোধহয় কাজের মেয়েটেয়েই হবে।
নেহার হাজব্যান্ডকে আপনি চেনেন?
সামান্যই। বিয়ের রাতে পরিচয় হয়েছিল।
কীরকম লেগেছিল?
ভালই তো। চেহারা খুব হ্যান্ডসাম নয়, কিন্তু ঠিক আছে। শুভ্র দাশগুপ্ত খুবই ভাল চাকরি করে বলে শুনেছি। অবিশ্বাস্য নাকি তার বেতন এবং পৈতৃক সম্পত্তিও প্রচুর।
হ্যাঁ, আপনার ইনফর্মেশন নির্ভুল, শুভ দাশগুপ্ত খুবই ব্রাইট ইয়ং ম্যান। ইউ ডোন্ট ফিল জেলাস অ্যাবাউট হিম? ডু ইউ?
নিরুপম করুণ হেসে বলল, আপনারা আমাকে ফাঁসিতে লটকানোর জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দেখছি। শুভ্র আইটি জিনিয়াস বলে আমার জেলাস হওয়ার কী আছে? আমি তো ও লাইনের লোক নই।
বুঝেছি। কিন্তু সামান্য একটা প্রবলেম আছে।
জানি। নেহার ডায়েরি।
হ্যাঁ।
ডায়েরিতে নেহা কী লিখে রেখেছে তা আমি জানি না। যে কেউ ব্যক্তিগত ডায়েরিতে যা খুশি লিখতে পারে। তার জন্য আমার কী দায় বলুন তো?
সে যে আপনার কথাই লিখেছে।
তাও শুনেছি এবং ভীষণ অবাক হয়েছি। আমি ওর ইতিহাসের অধ্যাপক, এ ছাড়া নেহার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না।
ছিল নিরুপমবাবু। শেষ যে এক্সকারশনটায় আপনি নেহাকে রাজগিরে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই ট্রিপে নেহার যাওয়ার কথাই নয়। নেহা তখন পাশ করে বেরিয়ে গেছে।
আমি নেহাকে নিয়ে গেছি কে বলল? আর অধ্যাপক তো আমি একাই ছিলাম না, আরও দু’জন ছিল।
সব জানি। নেহার ওই গ্রুপে থাকার কথা নয়, তবু সে গেল কেমন করে এবং কেন?
ইজি। নেহা যেতে চেয়েছিল এবং নিজের সব খরচ নিজেই বিয়ার করেছিল বলে আপত্তি ওঠেনি।
কেন গিয়েছিল?
সিম্পল ইন্টারেস্ট, হয়তো রাজগির ওর প্রিয় জায়গা।
ঠিক আছে। মেনে নিচ্ছি। কিন্তু খিঁচ থেকে যাচ্ছে।
মুশকিলে ফেললেন। যাই হোক, আমি কারণটা জানি না।
কারণটা হয়তো আপনি।
অত সুন্দরী ধনীকন্যাকে যদি আকর্ষণ করে থাকি তা হলে তো সেটা সাংঘাতিক বাহাদুরি। তাই না? অ্যাম আই অ্যাট্রাক্টিভ? ডোন্ট লাই প্লিজ।
.
আপনি কি নেহা দাশগুপ্তকে চিনতেন?
না।
আপনার ঠিক নীচের ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন।
হ্যাঁ, শুনেছি।
কবে শুনেছেন?
উনি মার্ডার হওয়ার পর।
সেদিন আপনি কি এই ফ্ল্যাটে ছিলেন?
না। আমার কাজটা ঘুরে বেড়ানোর। আমি তখন মুম্বাইতে ছিলাম। তবে সেইদিন রাতেই ফিরে আসি।
আপনার কাজটা ঠিক কী ধরনের?
আমি একটা কালচারাল গ্রুপের সঙ্গে আছি।
ব্যান্ড মিউজিক?
হ্যাঁ।
বাংলা ব্যান্ড?
বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ। তা ছাড়া প্রয়োজনে অন্য ভাষাতেও আমরা প্রোগ্রাম করি।
এই ফ্ল্যাটে আপনি কতদিন আছেন?
আট মাসের একটু বেশি।
এই ফ্ল্যাটের মালিকের নাম বীরেন সানা। তার কাছ থেকে কি ফ্ল্যাটটা আপনি ভাড়া নিয়েছেন?
বলতে পারেন। উনি আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছেন।
তাতে ওঁর স্বার্থ কী?
জাস্ট আউট অব ফ্রেন্ডশিপ।
মিস্টার সানা একজন পয়সাওয়ালা লোক। বিরাট ব্যাবসা। তাই না?
হ্যাঁ।
তার সঙ্গে একজন পপ গায়িকার বন্ধুত্ব হল কী করে?
উনি আমাদের একজন প্যাট্রন।
আপনি কি কলকাতার মেয়ে মিস আহুজা?
না। কলকাতায় ছেলেবেলা থেকে আছি।
তার মানে কি কলকাতায় আপনারা সেটল করেছেন?
না। আমার বাবা এখানে চাকরি করতেন। আমরা ভাইবোনেরা এখানেই পড়াশোনা করেছি। এখানেই বড় হয়েছি। তারপর রিটায়ার করে বাবা দেশে ফিরে গেছেন। ভাইবোনরা স্ক্যাটার্ড। কলকাতায় আমার কোনও বাসা এখন আর নেই।
কিছু মনে করবেননা, আপনার রোজগার কেমন?
আই অ্যাম স্টিল স্ট্রাগলিং ফর আ ফুটহোন্ড। ব্যান্ড মিউজিক, পপ গান এখনও এ দেশে খুব পপুলার নয়, বাজারটা আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে।
তা হলে আপনার চলে কীসে?
চলে যায়। গানবাজনা নিয়ে থাকতেই আমি বেশি ভালবাসি।
মিস্টার সানার বয়স পঁয়তাল্লিশ বা ছেচল্লিশ। আপনার কত মিস আহুজা?
চব্বিশ। আর ইউ হিন্টিং সামথিং? হ্যাঁ
। মিস্টার সানার সঙ্গে আপনার কোনও রোমান্টিক?
ওসব বোগাস ব্যাপার। রোমান্টিক সম্পর্ক কিছু নেই। তবে টু বি ফ্র্যাঙ্ক, উই হ্যাভ সেক্সুয়াল রিলেশন।
তাই বলুন।
নইলে এত বড় ফ্ল্যাটটা উনি আমাকে ছেড়েই বা দেবেন কেন এবং আমার খরচপত্রই বা চালাবেন কেন?
উনি তো বিবাহিত?
হ্যাঁ। তিন ছেলেমেয়ের বাবা।
তা হলে এই রিলেশনটার কোনও ভবিষ্যৎ নেই?
না। অ্যাবসোলিউটলি নো।
এত খোলাখুলি বলার জন্য ধন্যবাদ।
লুকোনোর কিছু নেই তো।
ঘটনার দিন আপনি তা হলে মুম্বাইতে ছিলেন?
সেইদিনই আমি বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে আসি। ফ্লাইট লেট ছিল। ব্যাগেজ কালেক্ট করে বাড়ি আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। প্রায় দশটা। এখানে এসে দেখি চারদিক থমথম করছে।
এই ফ্ল্যাটে আপনি একদম একা থাকেন?
হ্যাঁ, তবে মাঝে মাঝে মিস্টার সানা থাকেন। পার্টি হয়, আমাদের ব্যান্ডের রিহার্সালও হয় মাঝে মাঝে, তবে মোটামুটি একাই থাকি।
কাজের লোক নেই?
না। এই ফ্ল্যাটটা দু’হাজার স্কোয়ার ফুট। এই হলঘরটা ছাড়া বাকিটা ব্যবহার করা হয় না। আর আমি তো রাতটুকুই থাকি। তাই কাজের লোকটোক নেই। একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে মাঝে মাঝে হলঘরটা পরিষ্কার করে নিই, ব্যস।
রান্নাবান্না?
আমি বাইরেই খাই। ফোন করলে হোম সার্ভিস বাড়িতেও খাবার পাঠিয়ে দেয়। নো প্রবলেম। কিন্তু নেহা দাশগুপ্তর মার্ডারের ব্যাপারে আমার তো কিছুই জানা নেই। আমাকে ক্রস করছেন কেন মিস্টার দাশগুপ্ত? আর ইউ রিলেটেড টু হার? আপনিও দাশগুপ্ত, উনিও।
শবর দাশগুপ্ত মৃদু হেসে বলল, না। নেহা দাশগুপ্তর সঙ্গে আমার কোনও আত্মীয়তা ছিল না। আমি গোয়েন্দা পুলিশ, আমাদের সবরকম খোঁজখবর নিতে হয়। এখন একটা প্রশ্নের সোজাসুজি জবাব দেবেন কি?
কেন দেব না?
নেহা দাশগুপ্তের স্বামী শুভ দাশগুপ্ত। আপনি কি তাকে চেনেন?
চিনি।
কীভাবে?
এই ফ্ল্যাট নিয়ে উনি একটা অবজেকশন দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে বেশ একটা খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
কীরকম?
অবশ্য উনি একা নন। আরও কয়েকজন রেসিডেন্ট জোট পাকিয়ে কমিটিকে অ্যালার্ট করেন। ওঁদের কমপ্লেন ছিল যে, এই ফ্ল্যাটে অবৈধ কাজটাজ হয়। গানবাজনার ফলে ডিস্টার্বেন্স হয়। কমিটি মিস্টার সানাকে ডেকে পাঠায়। খুব হইচই হয়েছিল।
এটা কতদিন আগেকার ঘটনা?
মাস চার-পাঁচ হবে। সেই মিটিং-এ আমাকেও ডেকে পাঠানো হয়।
আপনি কি সেখানে স্বীকার করেছিলেন যে, আপনার সঙ্গে মিস্টার সানার এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন আছে।
না। তাতে মিস্টার সানা বিপদে পড়তেন। আমি বলেছিলাম যে আমি এই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি।
কথাটা সবাই বিশ্বাস করেছিল কি?
না। খুব চেঁচামেচি হয়েছিল। শুভ্র দাশগুপ্ত সবচেয়ে বেশি হোস্টাইল ছিলেন।
ব্যাপারটা মিটল কীভাবে?
মেটেনি তো! বীরেন সানাকে বলা হয়েছে আমাকে সরিয়ে দিতে হবে। উনি রাজি হয়েছেন। কমিটি ছয় মাস সময় দিয়েছে।
শুভ্র দাশগুপ্তকে কি আপনি ওই একবারই দেখেছেন?
না। দু-চারবার দেখা হয়েছে।
কীভাবে?
লিফটে, কিংবা ল্যান্ডিং-এ।
শুধু দেখা?
হ্যাঁ।
কোনও কথা হত না?
ওই হাই বা হ্যালো।
উনি কি আপনার প্রতি আর হোস্টাইল ছিলেন না?
না।
সেটা কীভাবে হল? হাউ ডিড ইউ রিকনসাইল?
আমার ওপর পারসোনাল গ্রাজ তত ছিল না। মিস্টার সানার ওপর হয়তো ছিল। তা ছাড়া আমি চলে যাব বলেই হয়তো ওঁর আর রাগ ছিল না।
লোকটিকে আপনার কেমন লাগে?
কিছু খারাপ তো নয়।
এখন একটা কথা। আপনি এখানে যে জীবনযাপন করেন সেটা আপনার মা বাবা অনুমোদন করেন কি?
আমার মা একসময়ে বারসিঙ্গার ছিলেন। মেয়েদের পবিত্রতা নয়, ক্যারিয়ার এবং আত্মনির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী। তাই মা তেমন তপত্তি করেন না। তিনি বলেন, ইফ আই অ্যাটেন সাকসেস তা হলে আর এসব কথা কেউ মনেও রাখবে না। সাকসেস হল আসল কথা, আর তার জন্য সবকিছুই করা যায়।
বাবারও তাই মত?
না। বাবা প্রাচীনপন্থী। তবে পিউরিটান নন। অ্যাপ্রুভ না করলেও কখনও জোর খাটাননি বা চেঁচামেচি করেননি। চুপচাপ থাকেন। আমার বাবা একজন শান্তিপ্রিয় ঠান্ডা মানুষ।
এবার শুভ্র দাশগুপ্তর কথায় আসা যাক। আপনার সঙ্গে তার হাই-হ্যালোর বেশি কোনও সম্পর্ক ছিল না, তাই তো বলছেন?
হ্যাঁ।
শুভ্র দাশগুপ্ত মাঝেমাঝেই বাইরে যেতেন। অফিশিয়াল ট্যুর। মুম্বাই, বাঙ্গালোর, দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, চণ্ডীগড়। আপনিও প্রায় ট্যুরে যান, তাই না?
হ্যাঁ।
এইসব টুরে কখনও কলকাতার বাইরে শুভ্রবাবুর সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
না তো!
একটু ভেবে বলুন।
ভাববার কী আছে বলুন।
মিস কামনা আহুজা, এ প্রশ্নটা শুনে আপনার মুখের ভাব একটু পালটে গেল কিন্তু।
আপনি কী মিন করছেন?
আপনি একজন অত্যন্ত অ্যাট্রাক্টিভ মহিলা। তার ওপর আপনি একজন বাডিং পপ সিঙ্গার, মুক্তমনা, বীরেন সানার সঙ্গে প্রকাশ্যেই অবৈধ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন। আপনার লুকোবার কিছু নেই বলছেন। তবু লুকোতে চাইছেন কেন?
আমি কিছু লুকোচ্ছি না।
লুকোচ্ছেন কামনাদেবী।
না। আপনি ভুল সন্দেহ করছেন।
তাই বুঝি?
ওকে। আপনি কলকাতার কোন কলেজে পড়তেন?
আমরা সব ভাইবোনই একই কলেজে পড়েছি।
সেটা কি…কলেজ?
হ্যাঁ।
আপনি কি আর্টসের ছাত্রী?
হ্যাঁ।
গ্র্যাজুয়েট?
হ্যাঁ। পরে আমি মাস্টার্সও করেছি।
নিরুপম লাহিড়ী কি আপনার মাস্টারমশাই?
হা, উনি ইতিহাস পড়াতেন।
আপনি কি জানেন যে নেহা দাশগুপ্তও ওই কলেজের ছাত্রী?
না। নেহা অন্য ব্যাচের হতে পারে।
তখন উনি নেহা মজুমদার ছিলেন।
না, চিনতাম না।
ভাল করে ভেবে বলছেন তো?
ব্যাচটা দেখলেই তো হয়।
ওসব দেখা হয়ে গেছে। আপনি নেহার পরের বছর পাশ করেন। সুতরাং আপনার ওকে চেনা উচিত। বিশেষ করে উনিও গানবাজনার লোক।
আমি কলেজ লাইফ থেকেই প্রোগ্রাম আর ট্যুর নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। কলেজে কামাইও হত খুব, ফলে হয়তো নামটা কানে আসেনি।
রিগার্ডিং নিরুপম লাহিড়ী।
হিস্ট্রি প্রফেসর? তার সম্পর্কে কী বলতে হবে?
লোকটা কেমন?
তা কী করে জানব? আপনাকে তো বললাম আমি খুব নিয়মিত ক্লাস করতাম না।
বলেছেন, অথচ কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে, আপনি কলেজের সোশ্যাল ফাংশনে গান গেয়েছেন। ইউনিয়নের অ্যাক্টিভিটিতেও ছিলেন। আপনার হিস্ট্রিতেও অনার্স ছিল, পরে আপনি অনার্স ছেড়ে দিয়ে পাশ কোর্সে পাশ করেন।
হ্যাঁ, এসব ইনফর্মেশন ঠিকই আছে।
নিরুপমবাবু সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না এটা কি হতে পারে?
কী জানব বলুন। ক্লাসে দেখা হত, এইমাত্র। উনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন, বেশ ভাল কণ্ঠস্বর, পড়াতেনও খুব ভাল।
ওঁর সম্পর্কে কোনও রটনা বা কানাঘুষো কানে আসেনি?
তেমন কিছু নয়।
উনি কি একটু মেয়ে-ঘেঁষা ছিলেন?
এবার কামনা একটু মৃদু হাসল, বলল, পুরুষেরা বেশিরভাগই তো তাই। আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না।
কিন্তু আমাদের ঘামাতে হচ্ছে। নেহা মজুমদারের সঙ্গে ওঁকে জড়িয়ে একটা রটনা আছে, শুনেছেন কি?
না।
একেবারেই না?
আমার তো তেমন কিছু মনে পড়ছে না।
কামনাদেবী, আপনি ঠিক মুখ খুলতে চাইছেন না। কেন বলুন তো?
দেখুন, আমি আমার স্ট্রাগল নিয়ে আছি। আমাকে কেরিয়ার তৈরি করতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়। আমার একটা অ্যামবিশন আছে। তার বাইরে আর কিছু নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর সময় হয় না।
ওটা যুক্তি হল না, হল অজুহাত।
নিরুপমবাবু সম্পর্কে কোনও স্ক্যান্ডাল থাকলে তা কলেজে খোঁজ নিলেই তো জানা যাবে। হোয়াই আর ইউ গ্রিলিং মি?
নেহা কীভাবে খুন হয় আপনি জানেন কি?
টিভিতে সেই রাতেই খবরে ওটা দেখানো হয়েছে। পরদিন খবরের কাগজেও ফাস্ট পেজ-এ ছিল। দুপুরবেলা ফ্ল্যাটে ঢুকে কেউ ওকে গলায় ফাঁস জড়িয়ে খুন করে।
পুলিশ আপনার কাছে আসেনি?
এসেছিল। আমি প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। ওঁরা স্টেটমেন্ট লিখে নিয়ে চলে গেছেন।
আপনি সেই রাতে একা এই ফ্ল্যাটে ছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনার কি সত্যিই এই ফ্ল্যাটে নেহার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি?
না। সবই তো আপনাকে বলেছি। আই অ্যাম এ ভেরি বিজি ওয়ার্কিং গার্ল। ফ্ল্যাটে আর কতক্ষণ থাকি? ফিরতে অনেক সময়ে মধ্যরাত হয়ে যায়।
আপনি কখনও চাকরি করেননি?
না, সেই অর্থে করিনি।
তার মানে?
বীরেন সানার ব্যাবসার ব্যাপারে আমি কিন্তু সাহায্য করি। তার জন্য আমাকে অবশ্য অফিসে যেতে হয় না। ওঁর একটা কম্পিউটার এখানে আছে। অন লাইন কিছু অফিস ওয়ার্ক করে দিই। সেইজন্য একটা অ্যালাউন্স পাই।
সেটা কত?
বারো হাজার টাকা।
খুব কম নয় তো? কীরকম কাজ? বে
শিরভাগই করেসপন্ডেস, সেক্রেটারিয়াল ওয়ার্ক।
সানা কি মাত্র বারো হাজার টাকাই দেয়?
কামনা ফের একটু হাসল, তা তো বলিনি, বারো হাজার টাকা একটা ফিক্সড অ্যালাউন্স। তা ছাড়া হি পেইজ মি।
এই জীবনযাপন করতে আপনার ভাল লাগে?
না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা স্টেপিং স্টোন। দিস ইজ নট দি এন্ড অফ দি রোড। আমি যেদিন সাকসেস পাব সেদিন আর এসব উচ্ছবৃত্তি করব কেন? বীরেন সানার প্রতি আমার কোনও সেন্টিমেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট তো নেই।
সেন্টিমেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট তবে কার সঙ্গে আছে?
আমার কাজের সঙ্গে, আমার গানের সঙ্গে।
ব্যস?
হ্যাঁ।
কোনও পুরুষমানুষের সঙ্গে নেই?
প্রেমের কথা বলছেন তো! না, ওসব নেই। কম বয়সেই আমাকে শরীর কাজে লাগাতে হয়েছে। বীরেন সানা প্রথম নয়। আমাদের ব্যান্ডের যিনি টপ ম্যান তাকে খুশি করতে হয়েছিল। যাদের শরীর বিলোতে হয় তাদের প্রেম খুব সহজে আসে না।
এত সব দিয়ে যা পেয়েছেন তা কি আপনাকে খুশি করে?
না। আই হ্যাভ মাইলস টু গো৷ কিন্তু এই যে আপাতত আমি বেশ ভালভাবে বেঁচে আছি, টাকাপয়সার টানাটানি নেই এবং মোটামুটি একটা ব্রাইট ফিউচার দেখতে পাচ্ছি এটাও তো কম নয়।
আপনি কি শিয়োর যে একদিন আপনি খুব বড় পপ গায়িকা হবেন?
আমি তো তাই হতে চাই। না হতে পারলে হয়তো সুইসাইড করব।
আগেই সুইসাইডের কথা ভাবছেন কেন?
আমি প্ল্যান্ড লাইফে বিশ্বাস করি। তাই ওটাও ভেবে রেখেছি। কিন্তু তার আগে আমি আমার নিজের ব্যান্ড ক্রিয়েট করছি। আমার দলে কয়েকটা দারুণ ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ে এসে গেছে। ব্যান্ড ক্রিয়েট করার জন্য অনেক টাকার দরকার। সেটাই প্রবলেম। আমি সেইজন্য টাকা জমাচ্ছি।
কত টাকার দরকার?
অনেক। মিউজিক্যাল হ্যান্ডস, ইনস্ট্রমেন্ট, একটা রিহার্সাল রুম এবং যোগাযোগ। ফান্ডা থাকলে ব্যান্ডকে লোকে ডাকবে কেন বলুন। ট্যালেন্টেড আর্টিস্টরা টাকাও তো অনেক চায়।
তা হলে ওটাই আপনার স্বপ্ন?
প্যাশন, ওটাই আমার প্যাশন।
.
এই ফ্ল্যাটে আপনি কতদিন আছেন?
এক বছরের ওপর।
এটা কি আপনার নিজের ফ্ল্যাট?
না। কোম্পানি লিজ।
আপনার বাড়ির লোকজন?
আমার বাবা-মা কানপুরে থাকেন। চার পুরুষের বাস। আমরা কানপুরের বাঙালি।
তা হলে তো আপনার বাংলা ভুলে যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ, এখনও বাংলা লিখতে বা ভাল পড়তে পারি না। তবে মা কলকাতার মেয়ে বলে বলতে পারি।
আপনি কলকাতায় কি চাকরি করতেই এসেছেন?
হ্যাঁ। কানপুরে আমাদের মার্বেল পাথরের ব্যাবসা। সেটাও চার পুরুষের ব্যাবসা। বলতে গেলে আমিই প্রথম চাকরি করতে এসেছি।
কেন? ব্যাবসা ভাল লাগে না?
লাগে। হয়তো শেষ অবধি ব্যাবসাতেই ফিরে যাব। এখনও কিছু ভাবিনি।
কয় ভাইবোন?
আমি এক সন্তান। সেইজন্য কানপুরে ফিরে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আপনার মা বাবা কেউ আসেননি?
না। মা বাতে পঙ্গু। নড়াচড়াই করতে পারেন না। বাবাও খুব সুস্থ নন, হার্ট পেশেন্ট।
কানপুরে আপনাদের আর কে কে আছে?
অনেকে। চার পুরুষের বসবাস বলে আমাদের সেখানে জ্ঞাতিগুষ্টি অনেক।
একসঙ্গে থাকেন কি?
না। সবাই আলাদা।
নেহা মজুমদারের সঙ্গে আপনার বিয়ে হয় কতদিন আগে?
এক বছর তিন মাস।
লাভ ম্যারেজ?
না। নেগোশিয়েটেড ম্যারেজ।
আপনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন?
কানপুরেই। আইআইটি থেকে পাশ করে বেরোনোর পর বাঙ্গালোর, তারপর ক্যালিফোর্নিয়া।
সিলিকন ভ্যালি?
হ্যাঁ।
কলকাতায় আছেন কতদিন?
বছর দেড়েক।
শুনতে পাই কলকাতায় নাকি টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের প্রসপেক্ট খুব খারাপ। এখানে চাকরির স্কোপও কম বলে বদনাম আছে।
আমি গোটা কলকাতার কথা তো জানি না। তবে আমার কোম্পানি তো সল্ট লেকে বিরাট অফিস করেছে। কাজও তো ভালই হয়। তবে কলকাতা বেসড হলেও আমাকে সারা ভারতবর্ষেই ঘুরে বেড়াতে হয়।
নেহা মজুমদারের সঙ্গে আপনার বিয়ে এবং সম্পর্কের কথা কিছু বলুন।
ওদের পদবি মজুমদার হলেও ওরা বদ্যি। আসল পদবি সেন। আমাদের ফ্যামিলিতে ওসব খুব মানা হয়। এখনও আমাদের ক্ল্যানে যত ছেলেমেয়ে আছে তাদের অধিকাংশেরই বিয়ে হয়েছে বাঙালি পরিবারে এবং সবর্ণে। নেহার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন আমার মামা জগৎ সেন।
কোন জগৎ সেন? ফিল্ম ডিরেক্টর?
হ্যাঁ। আমার মামাবাড়ি বাগবাজারে।
তারপর বলুন।
বলার কিছু নেই। উইদাউট এনি ফাঁস বিয়েটা হয়ে যায়।
বিয়ের পর নেহাকে স্টাডি করে কিছু বুঝতে পেরেছিলেন?
কী বুঝব? ঠিক কী ব্যাপারে জানতে চান বলুন?
নেহাকে আপনার কেমন মেয়ে বলে মনে হয়েছিল?
বড়লোকের মেয়েরা যেমন হয়।
আপনারাও তো বড়লোক।
সেটা অস্বীকার করছি না। তবে আমাদের পরিবারে সাহেবি কেতা নেই, একটু সাবেক বনেদি ব্যাপার আছে। যেমন এখনও আমাদের বাড়িতে পুজোআচ্চা হয়। আমাদের বাড়ির মেয়েরা ঘরের কাজকর্ম করে। নেহাদের পরিবার অনেক বেশি আধুনিক।
আপনার সঙ্গে কি বনিবনা হত না?
না না, সেসব কিছু নয়। আমি সব পরিস্থিতিতেই অ্যাডজাস্ট করতে পারি। আমার কোনও অসুবিধা হত না।
আপনাদের মধ্যে ভাবসাব ছিল?
অভাবও কিছু ছিল না।
আপনারা হানিমুন করতে যাননি?
হ্যাঁ। হংকং।
আপনার প্রতি নেহার মনোভাব কীরকম ছিল? ওয়াজ শি ইন লাভ উইথ ইউ?
শুভ্র একটু হাসল। নেহার তো একটা কেরিয়ার ছিল। আপনি বোধহয় সেটা জানেন। শি ওয়াজ ভেরি বিজি ইন হার সোশ্যাল এনগেজমেন্ট। আর আমিও তো বড় একটা এক জায়গায় থাকতাম না। ট্যুরে যেতে হয়।
এইসব ট্যুরে কি নেহাও যেত?
খুব কম। হংকং থেকে ফেরার পর বোধহয় একবার দিল্লি আর একবার মুম্বাই গিয়েছিল। আমার সঙ্গে। তারপর আর যায়নি।
আপনি আমার প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি জানতে চাই আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে লাভ রিলেশনটা গ্রো করেছিল কি না।
প্রশ্নটা করেছেন বটে, কিন্তু এককথায় এর জবাব দেওয়া শক্ত। আমার নিজস্ব একটা ধারণা আছে।
সেটা বলুন।
আমার মনে হয় নেগোশিয়েটেড বা লাভ ম্যারেজ যাই হোক না কেন, বিয়ের পর দুজনে যদি দু’জনের জন্য কিছু না করে তা হলে ভালবাসাটা তৈরি হয় না। যেমন মেয়েরা রান্না করবে, ভাত বেড়ে দেবে, ঘরদোর সামলাবে, পুরুষেরা নেবে কেয়ার অ্যান্ড সিকিউরিটি। প্রেম তো শুধু আবেগ নয়,হার্ডশিপ। আমার মা-বাবার মধ্যে তো তাই দেখেছি।
নেহার মধ্যে আপনি আপনার মাকে খুঁজে পাননি তো?
সেটা সম্ভব নয়। নেহা অন্যরকম সোসাইটিতে মানুষ।
এবার মার্ডারের কথাটা।
আপনি তো জানেন, তখন আমি বাইরে ছিলাম।
কোথায়?
বাঙ্গালোর।
কীভাবে খবর পেলেন?
পুলিশ আমার মোবাইল ফোনে ঘটনাটা জানায়।
আপনার রিঅ্যাকশন?
ভেরি শকিং। এরকম তো ঘটবার কথা নয়। অবশ্য নেহার প্রি-ম্যারিটাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।
আপনি কি জানেন যে, নেহা ডায়েরি লিখতেন?
না। নেহার সঙ্গে ইদানীং আমার একটু কম দেখা হচ্ছিল। মাত্র দিন দশেক আগে আমি এক মাস ট্যুরের পর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফিরেছি।
নেহাকে নিয়ে যাননি কেন?
বিয়ের আগে ও বার দুই আমেরিকা ঘুরে এসেছে। ইউরোপ টুর করেছে। আমি এবার ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হয়নি। বলেছে, তুমি একাই যাও। আমেরিকা আমার ভাল লাগে না।
আপনার কি কখনও মনে হয়েছে, আপনার স্ত্রীর কোনও এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন আছে?
না তো! সেরকম কিছু মনে হয়নি কখনও।
কখনও সন্দেহ হয়নি?
না। আমি সন্দেহপ্রবণ মানুষ নই। তবে একথাও স্বীকার করি, নেহার মতো মেয়ের ওরকম রিলেশন থাকা বিচিত্র নয়। ওরা তো পারমিসিভ সোসাইটির মেয়ে।
যদি জানতে পারতেন যে, আপনার স্ত্রীর প্রেমিক আছে তা হলে কী করতেন?
পরিস্থিতি বুঝে নেগোশিয়েট করতাম। অনেক সময়ে প্রেমটা হয়তো খুব হালকা ধরনের, সিরিয়াস নয়, কারও সঙ্গে সিরিয়াস প্রেম থাকলে নেহা আমাকে বিয়ে করতে যাবেই বা কেন? ওকে তো ধরেবেঁধে বিয়ে দেওয়া হয়নি। স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে।
খুনের ব্যাপারে আপনার কাকে সন্দেহ হয়?
কাউকেই নয়। এ ব্যাপারটায় আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
এবার আর একটা প্রশ্ন।
বলুন।
কামনা আহুজা নামে কাউকে চেনেন?
হ্যাঁ। আমাদের ঠিক ওপরে থাকে।
কেমন আলাপ?
জাস্ট সুপারফিশিয়াল।
মেয়েটা কেমন বলে মনে হয়?
খুব বেশি কিছু তো জানি না। তবে মেয়েটা ট্র্যাপে পড়ে একজনের উপপত্নী হিসেবে এখানে থাকে। আমরা ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম। মেয়েটা মুচলেকা দিয়েছে চলে যাবে বলে।
মেয়েটি কী করে তা জানেন?
শুনেছি পপ সিঙ্গার।
আপনার সঙ্গে তার কি ইদানীং কিছু ইন্টিমেসি হয়েছিল?
হোয়াট ডু ইউ মিন?
রাগ করার কিছু নেই। ফরগেট ইট। আপনি কি সরাসরি কলকাতা থেকে বাঙ্গালোরে গিয়েছিলেন?
না। প্রথমে মুম্বাই, তারপর বাঙ্গালোর।
মুম্বাইতে কোথায় ছিলেন?
আমি সবসময়ে তাজ-এ উঠি। কখনও সখনও সান অ্যান্ড স্যান্ডস-এ।
এবার কোথায় ছিলেন?
তাজ।
একা?
হোয়াট ডু ইউ মিন এগেন?
শুধু প্রশ্নটার জবাব দিলেই খুশি হব।
হ্যাঁ একা।
শুভ্রবাবু, আপনি কি অধ্যাপক নিরুপম লাহিড়ীকে চেনেন?
হ্যাঁ। আমার স্ত্রীর কলেজের অধ্যাপক।
আপনার সঙ্গে কেমন আলাপ?
তেমন কিছু নয়। বিয়ের সময় আলাপ হয়েছিল।
মাত্র একবারের আলাপ। তাও বিয়ের আসরে?
হ্যাঁ। এত সামান্য আলাপে কাউকে মনে রাখা বেশ শক্ত।
তা ঠিক। তবে উনি মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলতেন।
আপনি কি জানেন যে ওঁর সঙ্গে আপনার স্ত্রীর একটা স্ক্যান্ডাল আছে?
ঠিক জানি না। তবে আপনাকে তো বলেইছি নেহা পারমিসিভ সোসাইটির মেয়ে। আর দ্বিতীয় কথা, সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে স্ক্যান্ডাল করাটা মানুষের একটা হ্যাবিট।
আপনি কি ব্যাপারটা বিশ্বাস করেননি?
এখন আর এই প্রশ্ন করে কী লাভ? শি ইজ বিয়ন্ড এভরিথিং।
আর একটা কথা।
বলুন না।
রিগার্ডিং কামনা আহুজা।
হ্যাঁ। কী জানতে চান?
কামনা কি কখনও আপনার সঙ্গে কলকাতার বাইরে দেখা করেছে?
সে কী? কামনা কেন দেখা করবে? মেয়েটার সঙ্গে আমার খুব সামান্যই চেনা। এসব কী বলছেন।
কতগুলো ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়ার জন্যই প্রশ্ন করতে হয়। আপনি কি জানেন যে কামনা আহুজা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় একই সময়ে একই কলেজে পড়ত?
না তো। তবে তাতেই বা কী?
এটা খুবই স্বাভাবিক যে তারা পরস্পরের চেনা। অথচ কামনা বলছে সে নেহা মজুমদারকে চিনত না। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
হতেই পারে।
কামনা কি কখনও আপনার ফ্ল্যাটে আসেনি?
আমি তো জানি না। কখনও দেখিনি।
আপনি যখন বাইরে যেতেন অর্থাৎ ট্যুরে তখন নেহা কি এই ফ্ল্যাটেই থাকতেন?
সবসময়ে নয়। কখনও থাকত, কখনও বাপের বাড়ি যেত। এ বিষয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না।
আপনার কাজের লোক নেই?
ডোমেস্টিক সারভেন্ট? হ্যাঁ, তা আছে। তবে আমি তাদের চিনি না। হোলটাইম কাউকে রাখা হত না বলেই জানি। এসব নেহার ডিপার্টমেন্ট। যতদূর শুনেছি সকালের দিকে একজন এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যেত।
ব্যস?
হ্যাঁ। আমাদের রান্নাবান্নার ঝামেলা ছিল না। কারণ আমি সকালে একটা সিরিয়াল খেয়ে বেরিয়ে যাই। নেহাও ব্রেকফাস্ট করত না, শুধু ফলের রস খেত। দুপুরে আমি অফিসে লাঞ্চ করতাম। নেহাও বাইরে কোথাও খেয়ে নিত।
রাত্রে?
ডিনার আমরা তো রোজই বাইরে করতাম। কখনও নেহা আর আমি একসঙ্গে। কখনও আলাদা। প্রায়ই কোথাও না কোথাও ডিনারের নেমন্তন্ন থাকতই। আমরা একেবারেই ইন্ডোর পিপল ছিলাম না।
ফ্যামিলি লাইফ ছিল না বলছেন?
অনেকটা তাই। ব্যাপারটা ভাল করে তৈরি হয়নি। হয়তো আরও কিছুদিন পর হত।
এরকম জীবনযাপন করতে কি ভাল লাগে?
তা বলিনি। কিন্তু পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়েও তো নিতে হবে। সকলের লাইফ স্টাইল তো একরকম নয়।
আমি জানতে চাই, আপনি এরকম সিস্টেম পছন্দ করতেন কিনা।
না মিস্টার দাশগুপ্ত। করতাম না।
তবু বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিলেন?
সে তো অ্যাডজাস্ট করতেই হয়।
নেহার বাপের বাড়ির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীরকম?
খারাপ কিছু নয়। তবে প্রত্যেকেই ব্যস্ত বলে দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। মাঝে মাঝে ওঁরা ডিনারে ডাকতেন।
নেহার মৃত্যুর পর সম্পর্কটা কীরকম দাঁড়িয়েছে?
এই তো মাত্র পঁচিশ দিন আগে নেহা মারা গেছে, এর মধ্যে আর সম্পর্কের কী বদল হবে?
আপনি কি জানেন যে, নেহার বাবা ইনভেস্টিগেশনের জন্য প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগিয়েছেন?
জানি। দু’জন আমার কাছে এসেছিল।
তারা কী বলছে?
কিছু প্রশ্ন করেছিল। আমি যা জানতাম বলেছি।
এবার নেহা সম্পর্কে কয়েকটা কথা।
বলুন।
নেহা কীরকম টাইপের মেয়ে? সেক্সি, কোন্ড, ক্রুয়েল বা অন্যরকম?
ফ্র্যাঙ্কলি নেহা সম্পর্কে আমি তেমন স্টাডি করার সময় পাইনি। শুধু বলি সি ওয়াজ এ বিট প্যাসিভ ইন সেক্স। মনে হত ব্যাপারটা খুব পছন্দ করে না। মুডি একটু ছিল। ক্রুয়েল কিনা তা বলতে পারব না।
ওর কোন গুণটা আপনাকে অ্যাট্রাক্ট করত?
অ্যাট্রাকশন? বলা মুশকিল। তবে আমি ওকে অপছন্দ করতাম না।
ও আপনাকে?
প্যাশনেট ছিল না, তবে আমাকে ঘেন্নাও করত না।
ঝগড়া হত?
কী নিয়ে?
এনিথিং।
না, ঝগড়াও তেমন হয়নি। মাঝেমধ্যে একটু আধটু অল্টারকেশন, দ্যাট মাচ।
মিস্টার দাশগুপ্ত, আপনি খুব আলগা উত্তর দিচ্ছেন।
তা হবে। কী বললে ভাল হয় তা বুঝতে পারছি না।
নেহার মৃত্যুতে আপনার কতখানি শক হয়েছে?
খুব।
কিন্তু আপনি ভেঙে পড়েননি।
না। লোকে বলে আমি শক্ত ধাতের মানুষ।
আপনার বয়স কত?
উনত্রিশ।
লাস্ট ট্রিপে আপনি মুম্বাইতে কতদিন ছিলেন?
চারদিন, না পাঁচদিন।
পাঁচ দিনই তাজ-এ ছিলেন?
হ্যাঁ।
বাঙ্গালোরে কতদিন?
দু’দিন। তারপরই নেহার খবর পেয়ে চলে আসতে হয়।
গত পঁচিশ দিনে আপনি কোনও ট্যুরে গেছেন কি?
হ্যাঁ। লাস্ট উইকে দিল্লি যেতে হয়েছিল।
কোথায় ছিলেন?
মেরিডিয়েনে।
কতদিন?
সাত দিন।
.
আপনি কে বলছেন?
আমি আমার নামটা বলতে চাইছি না।
কেন বলুন তো?
আপনি যদি কথা দেন আমাকে কোনও রকমের ঝামেলায় জড়াবেন না তা হলে বলতে পারি।
সেরকম কথা কি দেওয়া যায়?
আমি যে ভয় পাচ্ছি।
আপনাকে আমার ফোন নম্বর কে দিয়েছে?
আপনি নেহা মার্ডার কেস ইনভেসটিগেট করছেন জেনে আমি লালবাজারে ফোন করে আপনার লাইন পেলাম।
হ্যাঁ, ঠিক আছে। এই মার্ডার কেসে আপনি কোনও সাহায্য করতে পারেন কি?
তা জানি না। তবে আপনাকে দু-একটা ইনফর্মেশন দিতে পারি। সেগুলো আপনার কাজে লাগতেও পারে। আমি কামনা আহুজাকে চিনি।
কীরকম চেনেন?
ভালই চিনি।
এবার বলুন।
আমি আপনাকে যা বলব তা থেকে আপনি আমার আইডেন্টিটি ধরে ফেলবেন। আমাকে আগে কথা দিন যে, আপনি এই কেসে আমাকে ড্র্যাগ করবেন না।
কিন্তু
কথা না দিলে আমি লাইন কেটে দেব।
কথা দিলে যে কথা রাখব তার কি নিশ্চয়তা আছে?
আমি শুনেছি আপনি এক কথার মানুষ। এ ভেরি টাফ ম্যান, এ ভেরি স্টাবোর্ন ম্যান।
ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি।
আমি খুব কাছেই আছি। বিবাদী বাগে। দশ মিনিটের মধ্যেই আমি আপনার দপ্তরে পৌঁছে যাব। আমার নাম জাহিরা। সিকিউরিটিকে বলে রাখবেন একটু।
ওকে।
ফোনটা রেখে শবর দাশগুপ্ত একটা কাগজে জাহিরা কথাটা লিখে রাখল। তারপর সিকিউরিটির লোককে ফোনে নামটা বলে দিল।
জাহিরা এল সাত মিনিটের মাথায়। একটু মোটাসোটা আহ্লাদি চেহারা। পরনে সবুজ রঙের শালোয়ার কামিজ, মাথার চুল বব করা, মুখে চোখে একটু উদ্বেগের ছাপ।
প্লিজ, আমি কিন্তু এক্সপোজও হতে চাই না মিস্টার দাশগুপ্ত।
ঠিক আছে। বলুন, আগে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবেন কি?
না, আমি ওসব খাই না। দেখছেন না ফ্যাট হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে জল আছে।
কাঁধের চামড়ার ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল বের করে জল খেল জাহিরা। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়। খুব ফরসা।
শবরের দিকে চেয়ে একটু নার্ভাস হাসি হেসে বলল, পরশু কামনার সঙ্গে দেখা হতেই বলেছিল, আপনি ওকে পুছতাছ করেছেন।
হ্যাঁ।
আপনি ওকে কেন জেরা করেছেন মিস্টার দাশগুপ্ত?
উনি একজন নেবার বলে। ভিকটিমের নেবারদের জেরা করতেই হয়।
দেখুন, কামনা সম্পর্কেই আমি দু-একটা কথা বলতে চাই।
বলুন না।
আমি আর কামনা একই ব্যান্ডে আছি। আমি কম্পোজার।
তা হলে তো কামনাকে ভালই চেনেন?
হ্যাঁ।
কামনার সবই আমি জানি। ও বীরেন সানার সঙ্গে থাকে।
হ্যাঁ।
আপনি হয়তো জানেন না সি ইজ মিলকিং সানা। কামনা ওকে রেগুলার ব্ল্যাকমেল করে।
সেটাই স্বাভাবিক।
আমি অবশ্য একথাটাই বলবার জন্য আসিনি। গত মাসে বাইশ তারিখে আমরা মুম্বাই যাই। আমরা সাধারণত মুম্বাইতে সস্তা হোটেলে উঠি। কারণ আমাদের তেমন পয়সা নেই। আমাদের ব্যান্ড এখনও তেমন দাঁড়ায়নি। কিন্তু আমরা হোটেলে ওঠার পরই কামনা এক আত্মীয়ের বাড়ি থাকবে বলে চলে যায়। কোথায় যায় তা আমরা জানি না। শুধু বলে গিয়েছিল মহালক্ষ্মীতে থাকবে।
তারপর?
অবশ্য প্রোগ্রামে ঠিকঠাকই চলে আসত। আমরা কিছু সন্দেহ করিনি। কিন্তু একদিন আমি ওকে হোটেল তাজ থেকে বেরোতে দেখি।
তাজ?
হ্যাঁ।
সঙ্গে কেউ ছিল?
না। ও বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ধরল দেখলাম।
আর কিছু?
হ্যাঁ। সেটাই ইম্পর্ট্যান্ট। আমরা সাধারণত ট্রেনেই ট্রাভেল করি। কারণ আমাদের পয়সা নেই। ট্রেনে এবং থ্রি টায়ারে। যেদিন আমাদের ফেরার ট্রেন ধরার কথা তার আগের দিন সকালে কামনা আমাদের হোটেলে এসে পিউ নামে একটা মেয়েকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা প্লেনের টিকিট দিয়ে বলল, পরদিন বিকেলের ফ্লাইটে তার কলকাতায় ফেরার কথা কিন্তু সে কোনও বিশেষ কাজে সেদিনই চলে আসবে। তাই টিকিটটা নিয়ে পিউ যেন প্লেনে চলে যায়। ব্যাপারটা আমরা কেউ জানতাম না।
তা হলে কামনা আগের দিনই চলে এসেছিল?
তাই তো জানি। তবে আমি শিয়োর নই। এই ইনফর্মেশনটা দিয়ে কি আমি কোনও অন্যায় করলাম?
না। আপনাদের ব্যান্ডে অন্যরাও কি এটা জানে?
না। পিউ ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়। কারণ পিউকে ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলা হয়েছিল। পিউ আমাদের হঠাৎ বলল যে আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না। মহালক্ষ্মীতে কামনার আত্মীয়ের বাড়িতে দু’দিন গিয়ে থাকবে। ফলে ওর টিকিট ক্যানসেল করা হয়। পরদিন পিউ মালপত্র নিয়ে চলে যায়। কিন্তু কলকাতায় ফিরে আসার পর আফটার দি মার্ডার পিউয়ের বোধহয় একটু অস্বস্তি হতে থাকে। ও আমাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানায়।
আপনাকে কেন?
পিউ আমার খুব বন্ধু।
পিউকে কোথায় পাওয়া যাবে?
সে ভীষণ ভিতু মেয়ে। আমি ওকে বলেছিলাম পুলিশকে জানাতে। শুনে ওর মুখ শুকিয়ে গেল।
আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
নো প্রবলেম। ও বাইরেই পঁড়িয়ে আছে। ওর মোবাইল ফোনের নম্বর দিচ্ছি। ডায়াল করলে চলে আসবে।
শবর ডায়াল করে বলল, কোনও ভয় নেই, চলে আসুন।
খুব শীর্ণ গলায় পিউ বলল, আসব?
হ্যাঁ।
.
আপনার স্টেটমেন্ট আপনি নিজেই সংশোধন করবেন কি কামনাদেবী?
তার মানে?
মানে খুব সহজ ও সরল। আপনি আমার কাছে যা বলেছেন তার সব সত্যি নয়।
আমি তো সত্যিই বলেছি।
শুভ্র দাশগুপ্তের সঙ্গে আপনার কতকালের সম্পর্ক?
কামনা চুপ
আপনি না বললেও আমরা তো জানবই। খামোখা পুলিশের টর্চার সহ্য করবেন কেন? আমাদের মেয়ে পুলিশ যথেষ্ট ট্রেনড।
বেশি দিনের নয়।
কতদিনের?
ছয়-সাত মাস।
আর ইউ ইন লাভ?
হ্যাঁ। শুভ্রকে তো নেহা কিছুই দেয়নি।
আপনি দিয়েছেন?
শুভ্রকে আমি সব দিয়েছি। একটা মেয়ের পক্ষে একজন পুরুষকে যা যা দেওয়া সম্ভব।
শুভ্রবাবু আপনাকে কী দিয়েছেন?
সব।
নেহা কি বাধা দিয়েছিল?
নেহা ওয়াজ আ বিচ।
দোষটা কী?
দোষ? খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। আমি তো খারাপ, বড়লোকের কেপট হয়ে আছি। কিন্তু সেটা পেটের দায়ে, কেরিয়ারের দায়ে। আর নেহা যা করত তা স্বেচ্ছাচার, শুভ্র বাইরে গেলে ও ওর ওই প্রফেসর নিরুপম লাহিড়ী থেকে শুরু করে এক-একদিন এক একজনের সঙ্গে মেলামেশা করত।
কিন্তু শুভ্রবাবু বলেন উনি নাকি সেক্সি ছিলেন না।
শুভ্র ঠিকই বলে, সি ডিজলাইকড শুভ্র। তাই ফ্রিজিডনেসের ভান করত। আপনি নেহাকে খুব সামান্যই চেনেন।
আপনি মুম্বাইতে শুভ্রবাবুর সঙ্গে তাজ-এ ছিলেন?
ছিলাম।
আর কোথাও?
মোট তিনবার আমরা বাইরে থেকেছি। তিন-চারদিন করে।
এই ফ্ল্যাটে?
কখনও সখনও। আই লাভ হিম।
নেহাকে মারতে হল কেন?
নেহাকে আমি মেরেছি কে বলল। কোনও প্রমাণ আছে?
না।
তা হলে বলছেন কেন?
প্রমাণ পাওয়া যাবে। আপনি স্বীকার না করলে আমার পরিশ্রম বাড়বে, এই যা।
পরিশ্রম করুন। বিনা পরিশ্রমে কেস সলভ হবে বলে ভাবছেন কেন?
থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি সাজেশন, পরিশ্রম আমি করব সন্দেহ নেই, কিন্তু যতদিন সলভ না হচ্ছে ততদিন যে আপনাকে পুলিশ কাস্টডিতে থাকতে হবে।
আপনি আমাকে অ্যারেস্ট করবেন?
অবশ্যই।
শুনুন, নেহার মরা উচিত ছিল, তাই মরেছে, ড্রপ দি কেস।
আমি মনে করি না যে কারও মরা উচিত। আমি আপনার সঙ্গে একমত নই।
আমি ওকে মারিনি।
কে মেরেছে?
আমি জানি না। জানার কথা নয়।
যদি না বলেন তা হলে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে চার্জ দেবে। শুভ্রবাবুও ফেঁসে যাবেন। দু’জনকেই চালান দেওয়া হবে। বলুন।
কলকাতায় ভরদুপুরে কত ফ্ল্যাটেই তো ডাকাতি হয়, খুন হয়। হয় না?
হা হয়।
এটা তো সেরকম হতে পারে। আপনারা এই অ্যাঙ্গেলটা ভেবেছেন?
লোকাল পুলিশ ভেবেছে, আমাকেও কি তাই ভাবতে বলেন?
হ্যাঁ। কলকাতার পুলিশ তো কত কেসই সলভ করতে পারে না। কত খুনি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হ্যাঁ, ঠিক কথা। আমি জানতে চাই, আপনিও কি বিশ্বাস করেন যে, নেহাকে ডাকাতের হাতে মরতে হয়েছে।
করি।
তা হলে আমার কিছু করার থাকবে না। আপনাকে চালান দেওয়া ছাড়া।
কেন, আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ কোথায়?
প্রমাণের জন্য ব্যস্ত হবেন না।
নেহার বাবা আপনাকে অনেক টাকা দিয়েছে, না? নইলে পুলিশ এত অ্যাকটিভ হয় না। আপনারা তো করাপ্টেড। সবাই জানে।
খুব মিথ্যে বলেননি। এই সমাজে সর্বস্তরেই করাপশন। কিন্তু সেটা ভেবে সান্ত্বনা পাবেন না। ব্যাপক করাপশনের মধ্যেও দু’-একজন থাকে যারা ইনকরাপটিবল।
আপনি কি তাদের একজন?
কী মনে হয়?
আপনার মতো লোককে আমি ভালই চিনি। নিজেকে আপনি যত খুশি ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিন না কেন, আপনি যে নেহার খুনিকে ধরার জন্যে জান লড়িয়ে দিচ্ছেন সেটা নিশ্চয়ই বিনা স্বার্থে নয়। শুধু মাইনের টাকায় এত ডেডিকেশন আসে না। মিস্টার পুলিশ, আপনাদের চরিত্র আমার জানা আছে।
জেনেই যখন গেছেন তখন কী আর করা যাবে। আর একথাও ঠিক যে নেহার খুনিকে ধরার জন্য আমি শেষ অবধি যাব।
ঠিক আছে মিস্টার পুলিশ। নেহার খুনিকে কষ্ট করে তবে আপনিই ধরুন। আপনার পরিশ্রম বাঁচাতে তার নাম আমি আপনাকে বলতে যাব না। আর আমি জানিও না, নেহাকে কে খুন করেছে।
আমার পরিশ্রম বাঁচানোর জন্য নয়, আপনাদের হ্যারাসমেন্ট থেকে বাঁচানোর জন্যই নামটা বলে দেওয়া ভাল।
আই অ্যাম স্যরি মিস্টার দাশগুপ্ত। আপনি আমাকে বারবার ভয় দেখিয়ে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। আর সেটাই প্রমাণ করে যে আপনি ডিটেকশন করতে জানেন না। গোয়েন্দা পুলিশের কী দুরবস্থা হয়েছে তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। যদি ক্ষমতা থাকে তা হলে নিজেই খুনিকে খুঁজে বের করুন। আমাকে ডিস্টার্ব করছেন কেন?
এরকম কথার থাপ্পড় বহুকাল খায়নি শবর দাশগুপ্ত। সে মনে মনে মেয়েটিকে বাহবা দিল। মুখে একটু গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, ঠিক আছে ম্যাডাম। আমি আজ যাচ্ছি। পরে হয়তো আবার আসব।
সেটা আপনার খুশি। মানুষকে অকারণে উৎপাত করার লাইসেন্স তো পুলিশের আছেই।
শবর বেরিয়ে এল, লিফট নিল না। সিঁড়ি বেয়ে একটা ফ্লোর নেমে এসে শুভ দাশগুপ্তর দরজার বেল টিপল, বেল অনেকক্ষণ বেজে গেল। কেউ দরজা খুলল না।
ঘড়িটা দেখল শবর। রাত প্রায় দশটা বাজে। এ সময়ে শুভ্র দাশগুপ্তের ফেরার সম্ভাবনা কম। হয়তো ডিনার আছে। হয়তো আর কিছু।
ভাবতে ভাবতে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল শবর। নেহাকে মারা হয়েছিল গলায় ফাঁস দিয়ে। সিল্কের কর্ড। গলায় সিল্কের ফাঁসও পাওয়া গেছে। ঘরে ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল। অর্থাৎ নেহা সহজে মরতে চায়নি। কাজটা মেয়ে বা পুরুষ যে কেউ করে থাকতে পারে। নেহার পিঠে একটা চটিজুতোর ছাপ পাওয়া গেছে। খুনি ফাঁসটা ভাল করে টানার জন্য ওকে উপুড় করে ফেলে পিঠে পা দিয়ে চেপে ধরেছিল। চটির ছাপে কোনও বৈশিষ্ট্য ছিল না। খাঁজহীন ছাপ। কোলাপুরি বা চামড়ার সোলের চটি। পুলিশ কুকুর ঘরের মধ্যে ঘুরে লিফট অবধি যায়। নীচে নেমে ফটক অবধি গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। দারোয়ানরা কোনও হদিশ দিতে পারেনি। কারণ, দশতলা এই বাড়ির প্রথম চারটে তলায় বেশ কয়েকটা অফিস আছে। প্রচুর লোকের যাতায়াত। দারোয়ানরা কার্যত নিষ্কর্মা বসে থাকে। পুলিশ কুকুর একবারও ওপরের তলায় কামনা আহুজার ফ্ল্যাটে যায়নি।
মোটিভ নিয়ে ভেবেছে শবর। নেহাকে খুন করার জোরালো মোটিভ ভেবে পায়নি। তবে হ্যাঁ, নেহা যে জীবন যাপন করত তাতে হিংসা, ব্যর্থ প্রেম, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ অনেকের অনেকরকম মোটিভ থাকতে পারে। পুলিশের একটা থিয়োরি আছে। কোনও গৃহবধু খুন হলে শতকরা পঁচানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে তার স্বামীই অপরাধী। শুভ্রর মোটিভও আছে, কিন্তু ঘটনার সময়ে সে ছিল বাঙ্গালোরে। ভাড়াটে খুনিকে লাগালেও এতদিনে কি একটা গন্ধ অন্তত পাওয়া যেত না? সুতরাং নেহা-হত্যার ধাঁধাটা কাটছে না। শেষ অবধি ব্যর্থ হলে ফের খবরের কাগজে লেখালেখি হবে। যেমনটা রোজই হচ্ছে।
আরও লজ্জায় পড়তে হবে যদি প্রাইভেট গোয়েন্দাদের কেউ রহস্যের সমাধান করে ফেলে, কিংবা সত্যিই যদি সিবিআই নামে। যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই কম।
লিফট নামছিল। দরজা খুলে যেতেই ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে শবর দেখল কামনা দাঁড়িয়ে।
এই যে ম্যাডাম। এত রাতে কোথায় চললেন?
যেখানে আমার খুশি।
সে তো বটেই। তা খুশির জায়গা কোথায়?
এটাও কি তদন্তের মধ্যে পড়ে?
অবশ্যই।
তা হলে আমাকে ফলো করতে হয় আপনার।
শবর হাসল, আপনাকে ফলো করা হয় না বলে মনে করেন নাকি?
একটু অবাক হয়ে কামনা বলল, ফলো করা হয়?
নিশ্চয়ই। আপনি যেখানেই যাবেন আপনার পিছনে আমাদের লোক সবসময়েই ফলো করবে।
সত্যি বলছেন? আপনারা তো ক্রিমিন্যাল।
যা বলেন।
আমি বিশ্বাস করি না।
না করলে করবেন না।
বলুন কাল রাতে আমি কোথায় গিয়েছিলাম?
ইজি, কাল এবং পরশু দু’দিনই আপনি পার্ক স্ট্রিটে বার-এ গিয়েছিলেন। পরশু রাত আটটা থেকে বারোটা। কাল রাত নটা থেকে সাড়ে দশটা। পরশু আপনি শ্যাম্পেন খেয়েছিলেন। কুণাল সরকার আর শ্যামলী বরাটের সঙ্গে। কাল…
মাই গড!
অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজও আপনাকে ফলো করা হবে।
ইউ বাস্টার্ড!
বটেই তো। পুলিশ খুব খারাপ প্রজাতি। তবে মানুষের তাকে খুব প্রয়োজনও হয় কখনও সখনও।
ল্যান্ডিং-এ লিফট থামতেই নেমে পড়ল শবর। কামনা নামল না।
নামবেন না?
না। আমি অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাচ্ছি।
সেই ভাল।
থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি সাজেশন। গুড নাইট।
.
রাত বারোটা নাগাদ শবরের টেলিফোন বাজল।
বলুন।
আমি কামনা আহুজা বলছি।
বলুন ম্যাডাম।
আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
না।
অ্যাম আই ডিস্টার্বিং ইউ?
আরে না। বলুন না।
আপনি একবার আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসতে পারবেন?
এখন?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে।
আধঘণ্টা বাদে ফের মুখোমুখি কামনা আহুজা আর শবর দাশগুপ্ত।
মনে হচ্ছে আমি অকারণে বড্ড বেশি দায়িত্ব আর ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। অকারণে কিছু কমপ্লিকেশনে জড়িয়ে পড়ার মানে হয় না। আর আরও একটা সন্দেহ হচ্ছে, একজন আমাকে ফাঁসাতে চাইছে।
শবর চুপ করে চেয়ে রইল। প্রশ্ন করল না।
মুম্বাই থেকে কলকাতায় আসার প্ল্যান চেঞ্জ করা এবং এবং ঠিক তারিখে কলকাতায় পৌঁছানো এবং নিজের ফ্ল্যাটে ওইদিন দুপুরে অপেক্ষা করে থাকা সবই আমি একজনের নির্দেশে করেছিলাম। কয়েক ঘণ্টা আগেও তাকে আমি গম্ভীরভাবে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু এখন আর করছি না।
শবর চুপ।
তার নাম কি আপনাকে বলতে পারি মিস্টার দাশগুপ্ত?
শবর মৃদু একটু হাসল, আপনি বলতে চাইলে বলবেন, বলেছি তো আপনি স্বীকারোক্তি করলে আমার পরিশ্রম বাঁচবে।
আপনি একজন অদ্ভুত মানুষ। এতদিন এত প্রশ্ন করলেন, অথচ যখন আমি কনফেস করতে চাইছি তখন আপনি নির্বিকার।
তার কারণ, নামটা আমি জানি। আপনাকে এই ঘটনার জন্য প্ল্যান্ট করা হয়েছিল।
সেটা আগে বুঝিনি। শুভ্র মুম্বাইতে তাজ হোটেলে আমাকে আমার মুভমেন্টের প্ল্যানটা বলে। কথা ছিল ওইদিন অর্থাৎ যেদিন মার্ডার হয় সেদিন দুপুরের আগেই সে বাঙ্গালোর থেকে ফিরে আসবে এবং বিকেলের ফ্লাইটে আমরা দুজনে সিঙ্গাপুর যাব। শুভ্র আসেনি। দুপুরে সে আমাকে ফোন করে জানায়, কাজে আটকা পড়েছে। রাতে ফিরবে। সিঙ্গাপুর যাওয়া একদিন পিছিয়ে যাবে। এসব যখন ও বলেছে ঠিক সেই সময়ে বা হয়তো একটু আগে বা পরে নীচের তলায় খুন হয় নেহা।
ছকটা মিলে যাচ্ছে।
আপনার কাছে বলতে বাধা নেই, আমার শুভ্রকে নিয়ে এখন অস্বস্তি হচ্ছে। অ্যাম আই ইন ডেনজার?
শুভ্র কি ফ্ল্যাটে আছে?
না। এখনও ফেরেনি। খুনটার জন্য আমি কি কোনওভাবে দায়ী?
না। খুন করেছে ভাড়াটে খুনি, টাকা খেয়ে, আপনি দায়ী কেন হবেন?
শুভ্রকে কি আপনারা অ্যারেস্ট করবেন? ও কেন আমাকে ফ্রেম করতে চেয়েছিল বলুন তো? আমাকে মার্ডার স্পটে অপেক্ষা করতে বলা এবং সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখানো, এসব কী বলুন তো?
আপনি অ্যারেস্টেড হয়ে গেলে শুভ্রবাবুকে নিয়ে পুলিশ আর মাথা ঘামাবে না।
তা হলে এখন আমি কী করব?
কাল সকালেই বীরেন সানার ফ্ল্যাট ছেড়ে কোনও বান্ধবীর বাড়িতে চলে যান। এ জায়গাটা আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়।
আমার এখন শুভ্রকে বড্ড ভয় করছে।
লিভ এ ক্লিন লাইফ ম্যাডাম। ভয় কীসের?
ভরসা দিচ্ছেন?
দিচ্ছি। আপনার প্রোটেকশনের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে। গুড নাইট।
গুড নাইট।
শবর দাশগুপ্ত নীচের তলায় নেমে এসে শুভ্র দাশগুপ্তর দরজার বেল টিপল। কেউ দরজা খুলল না।
শবর পকেট থেকে একটা স্কেলিটন চাবি বের করে নিঃশব্দে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকার ঘরে একটা সোফায় বসল চুপ করে। অপেক্ষা করতে লাগল।