Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শূন্য (১৯৯৪) || Humayun Ahmed

শূন্য (১৯৯৪) || Humayun Ahmed

চোখ দিয়ে পানি পড়ছে

সকাল থেকেই তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শুরুতে ব্যাপারটা তিনি বুঝতে

পারেননি। স্কুলে রওনা হবার আগে আয়নার চুল আঁচড়াতে গিয়ে মনে হল—বা চোখের কোণাটা ভেজা ভেজা। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আয়নায় ভালো করে তাকিয়ে দেখেন শুধু বা চোখ না, দুচোখ দিয়েই পানি পড়ছে। অথচ চোখে কোনো জ্বালা-যন্ত্ৰণা নেই। রহস্যটা কি? বয়সকালে শরীরবৃত্তির নিয়ম-কানুন কি অন্য রকম হয়ে যায়?

খানিকটা বিস্ময় এবং খানিকটা বিরক্তি নিয়ে তিনি স্কুলে গেলেন। প্রথম পিরিয়ডে বীজগণিত। ক্লাস নাইন। সেকশান বি। ফার্স্ট পিরিয়ডে রোলকল করতে হয়। শুধু শুধু সময় নষ্ট। চুয়ান্নজন ছেলে। প্ৰতি ছেলের পেছনে চার সেকেন্ড করে ধরলে—দুইশ ষােল সেকেন্ড। অর্থাৎ তিন দশমিক ছয় মিনিট। পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাসের আঠারো ভাগের একভাগ সময় চলে গেল। সময়ের কি নিদাৰুণ অপচয়! কোনো মানে হয় না।

হেডমাস্টার সাহেবের কঠিন নিয়ম। রোলকল করতে হবে। বত্রিশ বছর মনসুর সাহেব নিয়ম পালন করেছেন। রোলকল করে সময় নষ্ট করেছেন। আজই নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন। রোলকল না করে সরাসরি বোর্ডে চলে গেলেন।

চোখ দিয়ে পানি পড়াটা এই সময় বেড়ে গেল। বোর্ডে যা লেখেন পড়তে পারেন না। চোখের পানির জন্যে সব ঝাপসা দেখা যায়। তিনি এক সময় বিব্রত গলায় বললেন, থাক, আজ আর পড়াব না। চোখে সমস্যা।

ছাত্ররা কেউ শব্দ করল না। আগে যেমন বোর্ডের দিকে তাকিয়েছিল এখনো তেমনি তাকিয়ে রইল। মনসুর সাহেব বললেন—চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বোর্ডের লেখা পড়তে পারছি না।

এই কথার পরেও ছাত্ররা বোর্ডের লেখা থেকে চোখ সরাল না, যেন তারা পাথরের মূর্তি। মনসুর সাহেবের মন কিছুটা খারাপ হল। ছেলেরা তাকে এত ভয় পায় কেন? তিনি তাঁর বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে—কোন ছাত্রকে ধমক পর্যন্ত দেননি। তাহলে এরকম হচ্ছে কেন?

পাশের ক্লাসের বীরেন বাবু জিওগ্রাফি পড়াচ্ছেন–জলবায়ু। পড়ার ফাঁকে ফাকে কি সব বলছেন ছাত্ররা হো হো করে আসছে। হাসি শুরু হয় আর থামতে চায় না। বীরেন বাবু রাগী গলায় ধমকান, থামবি? না ধরে আছাড় দেব? কানে চাবি দিয়ে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দেব, বুঝলি? ছাত্ররা আরো হাসে। মনসুর সাহেবের মনে হল, ক্লাস এরকমই হওয়া উচিত। ছাত্ররা আনন্দে থাকবে। যা শেখার শিখবে আনন্দে। এমন যদি হতবীরেন বাবু বাজে টিচার, ভালো পড়াতে পারেন না, তাহলে একটা কথা ছিল। ব্যাপার মোটেই সে রকম নয়। শিক্ষক হিসেবে বীরেন বাবুর কোনো তুলনা নেই।

মনসুর সাহেব চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করছেন—তাঁর এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে কখনো কি তাঁর কোনো কথায়, কোনো রসিকতায় ছাত্ররা প্রাণখুলে হেসেছে?

তিনি মনে করতে পারলেন না। ছাত্রদের মুগ্ধ করার কোনো বিদ্যা তার জানা নেই। তিনি গল্প করতে পারেন না। গল্প শুনতেও তার ভালো লাগে না। কোনো কিছুই তাঁর বোধহয় ভালো লাগে না। তিনি আগ্রহ বোধ করেন না। এই যে এতগুলি ছাত্র তাঁর সামনে বসে আছে তিনি এদের কারোর নাম জানেন না। রাস্তায় এদের কারোর সঙ্গে দেখা হলে তিনি চিনতে পারবেন না। অথচ তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয়। আজ ছাত্র কতজন আছে? আজ সবাই কি উপস্থিত? তিনি গোনার চেষ্টা করছেন। চোখে অস্পষ্ট দেখছেন বলে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে।

তোমরা আজ কতজন উপস্থিত?

ফর্সা একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে ভীত গলায় বলল—স্যার ৪১ জন।

তিনি একটু চমকালেন—একচল্লিশ জন উপস্থিত। একচল্লিশ একটা মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। একচল্লিশ জন উপস্থিত হলে অনুপস্থিত হল ১৩ জন। ১৩ আরেকটি মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। বাহ্, পরস্পর দুটা প্রাইম সংখ্যা পাওয়া গেল। ইন্টারেস্টিং তো।

মনসুর সাহেবের চোখ দিয়ে পানি পড়া বেড়েছে। চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তিনি রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আবারও বললেন আমার চোখে একটা সমস্যা হয়েছে। পানি পড়ছে। আজ তোমাদের পড়াব না। বাবারা, আমি দুঃখিত ও লজ্জিত।

তিনি নিজের চেয়ারে বসলেন। ক্লাস শেষ হতে এখনো অনেক বাকি। এতক্ষণ কি করবেন? বসে থাকবেন চুপচাপ? এতে ছাত্রদের ক্ষতি হবে। সেটা ঠিক হবে না। উপদেশমূলক কোনো গল্প বলতে পারলে ভালো হত। উপদেশটা গল্পচ্ছলে শিখলেও লাভ। ঈশপের একটা গল্প বলা যেতে পারে। ঈশপের গল্পগুলি কি যেন? একটা গল্প আছে নাথােপাদের নীলের গামলায় একবার এক শেয়াল পড়ে গেল। তার গা হয়ে গেল ঘন নীল—এটা কি ঈশপের গল্প, না অন্য কারো গল্প। এই গল্পের উপদেশটা কি? আশ্চর্য! উপদেশটা মনে পড়ছে না।

মনসুর সাহেব তাঁর সামনের টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা রাখলেন এই ভাবেই গল্পটা মনে করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টা পড়ল। তার ঘুম ভাঙল না। ছাত্ররাও কেউ কোনো শব্দ করল না। পরের পিরিয়ডে হেডমাস্টার সাহেবের ইংরেজি পড়াবার কথা। তিনি মনসুর সাহেবকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?

জ্বি না।

দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। চোখে কি হয়েছে?

বুঝতে পারছি না। পানি পড়ছে।

এই শরীর নিয়ে ক্লাসে এসেছেন কেন? যান যান-বাড়ি যান। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন।

মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, বাসায় কি নিজে নিজে যেতে পারবেন, না কেউ গিয়ে দিয়ে আসবে?

যেতে পারব। নিজেই যেতে পারব।

বজলুর ফার্মেসিতে আগে যাবেন। বজলু আছে। ওকে চোখটা দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে তারপর যাবেন।

জ্বি আচ্ছা।

আপনার বয়স হয়েছে। শরীর দুর্বল। এই বয়সে শরীরের দিকে খুব যত্ন নিতে হয়।

মনসুর সাহেব খুবই লজ্জিত বোধ করছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন সেই কারণে লজ্জা। তারচেয়েও বড় লজ্জা তাঁর কারণে হেডমাস্টার সাহেব কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। ছাত্রদের না পড়িয়ে–অকারণ উদ্বেগ দেখাচ্ছেন অন্যের স্বাস্থ্য নিয়ে। অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়। তিনি চেয়ার থেকে নামলেন, নামতে গিয়ে মনে হল, পায়েও তেমন জোর পাচ্ছেন না। পড়ে যাচ্ছিলেন। হেডমাস্টার সাহেব হাত ধরে ফেলে আবারও বললেন, আমি আপনার উপর খুবই রাগ করেছি মনসুর সাহেব। এক্সট্রিমলি এনয়েড। আগে শরীর, তারপর অন্য কথা। শরীর গেল তো সবই গেল। সংস্কৃতিতে এ বিষয়ে একটা শ্লোক আছে। শ্লোকটা হচ্ছে…। যাই হোক, মনে পড়ছে না। শরীরং…

মনসুর সাহেব দীৰ্ঘ নিশ্বাস ফেললেন—অকারণে একটা মানুষ এত কথা বলে কেন? একই কথা বারবার বলার অর্থ কি? তিনি ক্লাস থেকে বেরুবার সময়ও ধরজায় ধাক্কা খেলেন। ছাত্ররা অবাক হয়ে তাঁকে দেখছে।

হেডমাস্টার সাহেব গ্রামার পড়াবেন। চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গিয়ে তাঁকে থমকে দাঁড়াতে হল। ব্ল্যাকবোর্ড বিচিত্র সব জিনিস লেখা। সাঙ্কেতিক চিহ্নের মতো চিহ্ন বোর্ডের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ঠাসা।

হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, এইসব কি? কে লিখেছে এসব? হু হাজ রিটেন দিজ?

ক্লাস ক্যাপ্টেন উঠে দাঁড়াল।

জবাব দিচ্ছ না কেন? কে এইসব হিবিজিবি লিখেছে? হু ইজ দ্য কালপ্রিট?

মনসুর স্যার।

মনসুর সাহেব লিখেছেন।

জ্বি। কি

এইসব?

জানি না স্যার।

জান না মানে? তোমরা জিজ্ঞেস করনি?

জ্বি না।

তোমাদের জানার আগ্রহ ছিল না?

ভয় লাগে স্যার।

উনার কী পড়াবার কথা ছিল?

এলজেব্র্যা।

হেডমাস্টার সাহেব ডাস্টার হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। বোর্ডের লেখাগুলি মুছে ফেলা উচিত কি-না তিনি বুঝতে পারছেন না। কাউকে কি ডেকে এনে দেখাবেন? মানুষটার হয়েছে কি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ তো বড় চিন্তার বিষয় হল। মানুষটাকে একা একা বিদেয় করা ঠিক হয়নি। একজন কাউকে সঙ্গে দেয়া উচিত ছিল।

মনসুর সাহেব ক্লাস থেকে বের হয়ে কমনরুমে খানিকক্ষণ বসলেন। ছুটির দরখাস্ত লিখে রেখে যাওয়া দরকার। হেডমাস্টার সাহেব ছুটি দিয়েছেন বলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি রওনা হবেন এটা ঠিক না।

কমনরুমে ফজলুর রহমান বসে আছেন। খবরের কাগজ পড়ছেন। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেছে, তারপরেও উনি বসে আছেন কেন? এই মানুষটা সব সময় ক্লাসে যেতে দেরি করেন। অনুচিত একটা কাজ। তার থেকে ছাত্ররা ফাঁকি শিখবে। এই বয়সটা হল তাদের শেখার বয়স। এই বয়সে তারা যা দেখে তাই শেখে।

ফজলুর রহমান সাহেব!

জ্বি!

ক্লাস নেই?

আছে।

যাবেন না?

খবরের কাগজটায় একটু চোখ বুলিয়ে যাই। বাংলা ফার্স্ট পেপার। এটা পড়ানো না পড়ানো একই।

বাংলার কথা শুনে মনসুর সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন ভালো কথা, আপনি কি ঈশপের ঐ গল্পটা জানেন?

কোন্ গল্প?

ঐ যে একটা শেয়াল ধোপার নীলের গামলায় পড়ে গেল। তার গা হয়ে গেল নীল…

শেয়াল না। একটা গাধা পড়েছিল।

ঐ গল্পের মোরালটা কি?

ফজলুর রহমান সাহেব খবরের কাগজ মুড়ে রাখতে রাখতে বললেন, ঈশপের গল্পের মোরাল সবই ফালতু মোরাল। এইসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই—এই যুগের মোরাল হল—Eat, drink and be happy.

মনসুর সাহেব ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। ছুটির দরখাস্ত লিখতে তার কষ্ট হচ্ছে। চোখ দিয়ে খুব পানি পড়ছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *