রুগীদের বিশ্রামকক্ষ
ঘরের বাইরে বড় বড় করে লেখা—রুগীদের বিশ্রামকক্ষ। নীরবতা কাম্য। দশ ফুট বাই দশ ফুট বর্গাকৃতি ঘর। বেতের এবং প্লাস্টিকের চেয়ারে ঠাসাঠাসি। কাঠের একটা টেবিলে পুরনো ঘেঁড়া কিছু সিনেমা পত্রিকা। তেরো-চৌদ্দ জন রুগী বসে আছে, সবাই নিঃশব্দ, শুধু একজন গোঙানির মতো শব্দ করছে, বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
এ্যাসিস্টেন্ট জাতীয় এক লোক বিরক্ত গলায় বলল, চুপ করে থাকেন। না ভাই। কুঁ কুঁ করছেন কেন? কুঁ কুঁ করলে ব্যথা কমবে?
রুগী কাতর গলায় বলল, একটু তাড়াতাড়ি করেন।
এর চেয়ে তাড়াতাড়ি হবে না। পছন্দ হলে থাকেন। পছন্দ না হলে চলে যান।
এ্যাসিস্টেন্টের নাম মাসুদ। বয়স ত্রিশ। মুখভর্তি বসন্তের দাগ। কটকটে হলুদ রঙের একটা শাটার গায়ে। কিছুক্ষণ পরপর সে নাক ঝাড়ছে। তার মূল কাজ এক্সপ্লেটে নাম্বার বসিয়ে রুগীদের এক্সরে রুমে পাঠিয়ে দেওয়া। সে এই কাজের বাইরেও অনেক কাজ করছে। নাম লেখার সময় সব রুগীকেই খানিকক্ষণ ধমকাচ্ছে, রুগীর সঙ্গে এক্সরে রুমে ঢুকছে, এক্সরে অপারেটরকে একটা ধমক দিচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। কারণ সবাই জেনে গেছে, এই লোকটির হাতেই ক্ষমতা। এই এক্সরে ইউনিট আসলে সে-ই চালাচ্ছে। ডাক্তার এক জন আছেন, তিনি চেম্বার বন্ধ করে বসে আছেন। রুগীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। এক্সরে প্লেট দেখে একটা রিপোের্ট লিখে দেন। দায়িত্ব বলতে এইটুকুই।
আজ ডাক্তার সাহেব সেই দায়িত্বও পালন করছেন না। অল্প বয়স্ক কামিজ-পরা একটি মেয়ে ঘণ্টা দুই হল তার কাছে বসে আছে। ডাক্তার সাহেব দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। বন্ধ দরজা ভেদ করে দুবার খিলখিল হাসির শব্দ পাওয়া গেল।
মাসুদ সেই হাসির শব্দে মুখ কুঞ্চিত করে বলল, শালাব দুনিয়া! প্রেম শুরু হয়ে গেছে। কথাগুলো সে নিচু গলায় বলল না। শব্দ করেই বলল। এতে বোঝা গেল সে কারোর পরোয়া করে না। তার প্রতি রুগীদের যে প্রাথমিক বিরক্তি ছিল, তাও খানিকটা কাটল। যে তার মুনিবের প্রতি সরাসরি এমন কথা বলে সে এ্যান্টি-এ স্টাবলিশমেন্টের লোেক। সবার সহানুভূতি তার প্রতি।
নিশানাথ বাবু আট নম্বর স্লিপ হাতে বসে আছেন। একসময় তাঁর ডাক পড়ল। তিনি প্রেসক্রিপশন হাতে উঠে গেলেন।
মাসুদ কাচের দেয়ালের পাশে বছে। রেলের টিকিটের ঘুমটি ঘরের মতো ছোট্ট জানালা দি.ে তিনি প্রেক্রিপশন বাড়িয়ে দিলেন।
মাসুদ বলল, নাম বলেন।
নিশানাথ চক্রবর্তী।
হিন্দু নাকি?
নিশানাথ হা-সূচক মাথা নাড়লেন, যদিও বুঝতে পারলেন না এই প্রশ্ন করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। তাসুখের আবার হিন্দু-মুসলমান কি?
হয়েছে কী আপনার?
মাথায় যন্ত্রণা।
মাথায় যন্ত্ৰণা তো পেরাসিটামল খেয়ে শুয়ে থাকেন। এক্সরে কী জন্যে?
নিশানাথ বাবু, ইতস্তত করে বললেন, ডাক্তার এক্সরে করতে বলল, সাইনাস আছে কি-না দেখতে চান।
মাসুদ মুখ বিকৃত করে বলল, বিছু একটা হলেই এক্সরে। আরে বাবা এই যন্ত্র যখন ছিল না, তখন কি রুগীর চিকিৎসা হত না? এই সব হচ্ছে পয়সা কামাবার ফন্দি, বুঝলেন?
নিশানাথ কিছু বললেন না। এই রাগী ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। হয়তো আবার ধমক দেবে। এ সুরে করতে এসে এত বার ধমক খাবার কোনো মানে হয় না।
মাসুদ খাতায় নাম তুলতে বলল, সামান্য পেটব্যথা হলে ডাক্তাররা কী করে, জানেন? এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাম, এণ্ডোসকপি, ব্লাড, ইউরিন–শালার দুনিয়া! এইসব না করে একটা ডাব খেয়ে শুয়ে থাকলে কিন্তু পেটব্যথা কমে যায়। যান, ভেতরে যান।
নিশানাথ বাবু ভেতরে ঢুকলেন। ভয়ে ভয়ে ঢুকলেন। তাঁর ভয় করছে। কেন তাও ঠিক বুঝতে পারছেন না।
এক্সরে রুমে আলো কম। তাঁর চোখ ধাতস্থ হতে সময় লাগছে। ব্যাপারস্যাপার দেখে তিনি খানিকটা ভড়কেও গেছেন। অতি আধুনিক যন্ত্র। শরীরের যে কোনো অংশের এক্সরে করা যায়। কম্পুটারাইজড ব্যবস্থা। ছবি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিগেটিভ তৈরি হয়ে বের হয়।
মাসুদ নিশানাথ বাবুর সঙ্গে ঢুকেছে। নিশানাথ বাবু বললেন ব্যথা লাগবে নাকি?
মাসুদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, আগে কখনো এক্সরে করান নি?
ছোটবেলায় একবার করিয়েছিলাম–বুকের এক্সরে।
ব্যথা পেয়েছিলেন?
জ্বি না।
তখন ব্যথা পান নি, তাহলে এখন পাৱে কেন? এক্সরে কিছুই না। এক ধরনের রেডিয়েশন, লাইট। মাথার ভেতর দিয়ে চলে যাবে, টেরও পাবেন না। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
কী করব?
শুয়ে পড়ুন।
কোথায় শুয়ে পড়ব?
আরে কী যন্ত্রণা! এই বজলু, এঁকে শুইয়ে দে।
বজলু এক্সরে মেশিনের অপারেটর। সে এসে নিশানাথ বাবুকে কোথায় যেন শুইয়ে দিল। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, খুব ঠাণ্ডা লাগছে, ভাই।
মাসুদ বলল, এয়ারকন্ডিশন্ড ঘর, তাই ঠাণ্ডা লাগছে। আপনি খুব যন্ত্ৰণা করছেন। চুপচাপ থাকেন।
জি আচ্ছা।
বজলু এসে সীসার পাতে তৈরি একটা জিনিস নিশানাথ বাবুর ঘাড়ের উপর রাখল। তিনি শুয়েছেন উপুড় হয়ে। কিছু দেখতে পারছেন না, তবে বুঝতে পারছেন, ঘড়ঘড় শব্দ করে ভারী একটা যন্ত্র তাঁর মাথার কাছে চলে আসছে। তিনি সেখান থেকেই বললেন, ভয় লাগছে।
মাসুদ কড়া গলায় ধমক দিল, কচি খোকা নাকি আপনি যে ভয় লাগছে? নড়াচড়া করবেন না, চুপচাপ শুয়ে থাকুন।
নিঃশ্বাস কি বন্ধ করে রাখব?
যা ইচ্ছা করুন।
মাসুদ বজলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ঝামেলা শেষ কর তো। এক জনকে নিয়ে বসে থাকলে হবে না।
বজলু বোতাম টিপল। ছোট্ট একটা অঘটন তখন ঘটল। প্যানেলে একটি লাল বাতি জ্বলে উঠল। যার অর্থ কোথাও কোনো ম্যালফাংশান হয়েছে। বজলুর কোনো ভাবান্তর হল না, কারণ এই অতি আধুনিক যন্ত্রটি যে কোনো ম্যালফাংশানে আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। নির্ধারিত রেডিয়েশনের এক পিকো রেম বেশি ডোজও যাবার কোনো উপায় নেই।
মাসুদ বলল, কী হয়েছে?
বজলু বলল, ম্যালফাংশান। আরেকটা প্লেট দিতে হবে।
মাসুদ বলল, শালার যন্ত্রণা!
ঠিক তখন বজলু অস্ফুট শব্দ করল। কারণ বড়ো ধরনের কিছু ঝামেলা হয়েছে। মেশিন বন্ধ হয় নি। স্ট্যান্ড-বাই বাটনের লাল আলো জ্বলে নি। ডিজিটাল মিটারের সংখ্যা দ্রুত পাল্টাচ্ছে রেডিয়েশন এখনো যাচ্ছে। বজলুর গলা শুকিয়ে গেল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। কত রেডিয়েশন গেল? ২৫০ রেম (REM)? কী সর্বনাশ! বুড়ো মানুষটা বেঁচে আছে তো?
এ রকম হবে কেন? কেন এরকর্ম হবে? এখন কী করা?
বজলু স্টপ বাটন টিপলংঘন্ত্রটির সমস্ত কার্যকলাপ এতে বন্ধ হবে। স্টপ বাটন পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দেবে। পাওয়ার থাকবে শুধু মেকানিক্যাল অংশে। রেডিয়েশন ইউনিটে থাকবে না।
আশ্চর্য! স্টপ বাটন টেপার পরও রেডিয়েশন বন্ধ হল না। বজলুর হাত কাঁপতে লাগল। সে মনে মনে বলল, ইয়া রহমানু, ইয়া রাহিমু।
মাসুদ বলল, কী হল?
বজলু বলল, রুগীকে তাড়াতাড়ি সরান। রেডিয়েশন যাচ্ছে।
কি বলছ ছাগলের মতো?
আল্লাহর কসম।
বজলু স্ট্যান্ড-বাই বাটন টিপে আবার স্টপ বাটনে চলে গেল। লাভ হল না। রেডিয়েশন কন্ট্রোল নবে হাত দিল। কিছু একটা করা দরকার। মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রুগীকে সরানও যাচ্ছে না। রুগীকে সরাতে হলে রেডিয়েশন সোর্স সরাতে হবে। তাও সরানো যাচ্ছে না।
মাসুদ ছুটে গেল ডাক্তার সাহেবের ঘরে।
কামিজ-পরা মেয়েটি এখনো আছে। সে সম্ভবত মজার কোনো গল্প বলছিল। তার মুখ হাসি-হাসি। ডাক্তার সাহেবও হাসছেন। দরজা নক নাকরে ঢাকা ঠিক হয় নি। মাসুদ গ্রাহ্য করল না।
কাঁপা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি আসেন স্যার।
রেডিওলজিস্ট কাটাকাটা গলায় বললেন, কত বার বলেছি হুট করে ঢুকবে না।
আপনি আসেন তো স্যার। কেন? ঝামেলা হয়েছে। বিরাট ঝামেলা।
ডাক্তার সাহেব এক্সরে রুমে ঢুকে দেখলেন সব ঠিকঠাক। মেশিন বন্ধ। রহমান কপালের ঘাম মুছছে। নিশানাথ বারু এখনো শুয়ে আছেন।
মাসুদ কানে কানে ডাক্তার সাহেবকে ঘটনাটা বলল। ডাক্তারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি বললেন, কত রেডিয়েশন পাস করেছে?
বজলু জবাব দিল না। আবার মাথায় ঘাম মুছল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে। ডাক্তার সাহেব ডিজিটাল মিটারে সংখ্যা দেখলেন। রেডিয়েশনের পরিমাণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। রুগী এর পরেও বেঁচে আছে কী করে?
নিশানাথ বাবু বললেন, শেষ হয়েছে?
ডাক্তার সাহেব বললেন, জ্বি জ্বি শেষ। শেষ, ভাই আপনি উঠে বলুন। মাসুদ, ওঁকে উঠিয়ে বসাও।
মাসুদকে উঠিয়ে বসাতে হল না। নিশানাথ বাবু নিজেই উঠে বসলেন। নিচু গলায় বললেন, কোনো ঝামেলা হয়েছে।
মাসুদ শুকনো গলায় বলল, কোনো ঝামেলা হয় নি। একটু দেরি হল আর কি, যন্ত্রপাতির কারবার!
নিশানাথ বাবু বললেন, কোনো ব্যথা পাই নাই।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আসুন তো আমার সঙ্গে, আসুন।
বাসায় চলে যাব। দেরি হয়ে গেছে।
একটু বসে যান। চা খান এক কাপ।
মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছে।
ও কিছু না। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার সাহেব নিশানাথ বাবুকে তাঁর ঘরে নিয়ে বসালেন। কামিজ-পরা মেয়েটি এখনো আছে। তার নাম নাসিমা। আজ তার জন্মদিন। সে অনেক দিন ধরে ভাবছে আজকের দিনটি অন্য রকম ভাবে কাটাবে। যার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে, শুধু তার সঙ্গেই গল্প করবে। ফরহাদ নামের এই ডাক্তারের সঙ্গে গল্প করতে তার ভালো লাগে। শুধু যে ভালো লাগে তাই নয়, অসম্ভব ভালো লাগে। যখন তিনি থাকেন না, নাসিমা মনে মনে তাঁর সঙ্গে গল্প করে। নাসিমা জানে, কাজটা ভালো হচ্ছে না, খুব খারাপ হচ্ছে। তার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই ডাক্তার ফরহাদ বিবাহিত। দুটি ছেলেমেয়ে আছে। ফরহাদ সাহেবের স্ত্রী, যাকে সে এ্যানি ভাবী বলে–তিনিও চমক্কার এক জন মানুষ।
নাসিমা জানে, এই চমৎকার পরিবারে সে ধীরে ধীরে একটা সমস্যার সৃষ্টি করছে। আগে এ্যানি ভাবী তার সঙ্গে অনেক গল্প করতেন। এখন দেখা হলে শুকনো গলায় বলেন কি ভালো? বলেই মুখ ফিরিয়ে নেন। যেন তার সঙ্গে কথা বলা অপরাধ, সে একজন অস্পৃশ্য মেয়ে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, নাসিমা, তুমি বাসায় চলে যাও।
নাসিমার চোখে পানি এসে গেল। আজ তার জন্মদিন। স্কলারশিপের জমান সব টাকা নিয়ে সে এসেছে ফরহাদ ভাইকে নিয়ে সে চাইনিজ খাবে। একটা শাড়ি কিনবে। ফরহাদ ভাইকে বলবে শাড়ির রঙ পছন্দ করে দিতে। তারপর ঠিক সেই রঙের একটা শার্ট সে ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে কিনবে।
নাসিমা, আমার জরুরী কাজ আছে। তুমি এখন যাও। তোমাদের কলেজ কি আজ বন্ধ?
নাসিমা জবাব দিল না। মুখ জানালার দিকে ফিরিয়ে নিল, কারণ চোখ বেয়ে গালে পানি এসে পড়েছে। ডাক্তার সাহেব তা দেখতে পেলেন না। নাসিমা প্ৰায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে কোনো একটা চলন্ত ট্রাকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে, কিংবা কোনো একটা দশ তলা দালানের ছাদে উঠে সেখান থেকে ঝাঁপ দিতে।
নিশানাথ বাবু চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মাঝে মাঝে জিভ বের করে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরপর বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তাঁর বড় ধরনের কোনো কষ্ট হচ্ছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনার নামটা জানা হল না।
নিশানাথ বাবু চমকে চোখ মেলে তাকালেন। মনে হচ্ছে তিনি ডাক্তার সাহেবের প্রশ্ন ঠিক বুঝতে পারছেন না।
আমাকে বলছেন?
জ্বি।
কী বলছেন?
আপনার নাম জানতে চাচ্ছিলাম।
নিশানাথ। আমার নাম নিশানাথ।
শরীরটা কেমন লাগছে?
ভালো।
কিছু খাবেন?
না। বাসায় যাব।
বাসা কোথায়?
মালীবাগে।
বয়স কত আপনার?
ঠিক জানি না। পাঁচপঞ্চাশ-ষাট হবে।
ও আচ্ছা–শরীরটা এখন কেমন লাগছে?
ভালো।
নিশানাথ বাবু খানিকটা বিস্ময় বোধ করলেন। এই লোক সারাক্ষণ তাকে শরীর কেমন শরীর কেমন জিজ্ঞেস করছে কেন? তাহলে কি তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন কিংবা এক্সরে নেওয়ার সময় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন?
ডাক্তার সাহেব বললেন, মালীবাগে কি আপনার নিজের বাড়ি।
না। আমার এক ছাত্রের বাড়ি। আমি ঐ বাড়িতে থাকি। আর আমার ছাত্রের ছেলে-মেয়ে দুটোকে পড়াই।
ও আচ্ছা। আপনার নিকট আত্মীয়-স্বজন কে কে আছেন?
তেমন কেউ নেই। যারা আছেন–ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন।
আপনি যান নি কেন?
ইচ্ছা করল না। আমি এখন উঠি?
আরে না, আরেকটু বসুন, চা খান।
নিশানাথ বাবু বসলেন। তার খুব ক্লান্তি লাগছে। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে। চা এলো। তিনি চায়ে চুমুক দিলেন–কোনোরকম স্বাদ পেলেন না। তবু ছোট ঘোট চুমুক দিতে ল গলেন, এখন না খাওয়াটা অভদ্রতা হয়।
বজলু ডাক্তার সাহেবকে একটা কাগজ দিয়ে গেছে। সেখানে লেখা কত ডোজ রেডিয়েশন এই রুগীর মাথার ভেতর দিয়ে পাস করেছে। সংখ্যাটির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সাহেব ঢোক গিললেন। এ কী ভয়াবহ অবস্থা।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আর কোনো এক্সরে নেওয়া হয় নি তো?
জ্বি না। তবে যন্ত্র এখন ঠিক আছে।
ঠিক থাকুক আর না থাকুক, আর কোনো এক্সরে যেন না করা হয়।
জ্বি আচ্ছা।
নিশানাথ বাবু বললেন, আমি এখন উঠি?
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি ঐ দিক দিয়েই যাব। আপনাকে নামিয়ে দেব। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।
নিশানাথ বাবু ডাক্তারের ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কী অসাধারণ এক জন মানুষ! আজকালকার দিনে এ রকম মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে।
গাড়িতে উঠতে উঠতে ডাক্তার সাহেব বললেন, আমার কার্ডটা রাখুন। টেলিফোন নাম্বার আছে। কোনো অসুবিধা হলে টেলিফোন করবেন।
নিশানাথ বাবু অবাক হয়ে বললেন, কি অসুবিধা?
না, মানে–বয়স হয়েছে তো এই বয়সে শরীর তো সব সময় খারাপ থাকে। পরিচয় যখন হয়েছে তখন যোগাযোগ রাখা। আপনি শিক্ষক মানুষ।
নিশানাথ বাবুর হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হল। কী অসম্ভব ভদ্র এই ডাক্তার। এঁকে ধন্যবাদের কিছু কথা বলা দরকার। বলতে পারলেন না। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। তিনি গাড়ির পেছনের সীটে বসে ঝিমুতে লাগলেন।
বাসায় ফিরে শরীরটা আরো খানিকটা খারাপ হল। নিজের ঘরে ঢুকে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটা ঠিক স্পষ্ট নয়, আবার স্পষ্টও : ছোট্ট একটা ঘর। ঘরে একটা মেয়ে একা একা বসে আছে। মেয়েটিকে তিনি আগে কখনো দেখেন নি। কিন্তু তিনি তার নাম জানেন। মেয়েটার নাম নাসিমা, সে কলেজে পড়ে। তার আজ জন্মদিন। এরকম খুশির দিনেও তার মন খুব খারাপ। সে খুব কাঁদছে।
দীর্ঘ স্বপ্ন। তবে এই স্বপ্নে কোনো কথাবার্তা নেই। এই স্বপ্নের জিনিসগুলি স্থির, কোনো নড়াচড়া নেই! যেন কয়েকটা সাদাকালো ফটোগ্রাফ। আবার ঠিক সাদাকালেও নয়। এক ধরনের রঙ আছে, সেই রঙ পরিচিত নয়। ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।