Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অনুভূতিতে আঘাত না করে সমাজ বদলানো যায় না || Taslima Nasrin

অনুভূতিতে আঘাত না করে সমাজ বদলানো যায় না || Taslima Nasrin

অনুভূতিতে আঘাত করতেই হবে, বিশেষ করে ধর্মানুভূতিতে। এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সমাজকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখলে চলবে না। সমাজকে এগোতে হবে। যারা সমাজটাকে যেমন আছে তেমন রাখতে চায়, তারা সবরকম অগ্রসরতাকে রোধ করে। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস বর্বর হয়ে ওঠে না, যত হয়ে ওঠে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে। ধর্মীয় অনুভূতিকে এত গুরুত্ব কেন দেওয়া হচ্ছে। অনেকে বলে, যেহেতু ধার্মিকের সংখ্যাটা দুনিয়াতে বেশি। প্রায়ই শুনি দেড় বিলিয়ন লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা ঠিক নয়। বুঝি যে, মানুষের সংখ্যাটাকে খুব বড় করে দেখা হয়। ব্যাপারটা যেন এরকম, সংখ্যায় কম হলে তাদের ধর্মানভুতিতে আঘাত দেওয়া যেতে পারে, সংখ্যায় বেশি হলে দেওয়া উচিত নয়। দেড় বিলিয়ন না হয়ে দেড়শ বা দেড় হাজার হলে ঠিক ছিল কি?

অনেকে যারা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে, তারা ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে হামেশাই বলছেন, ব্লগাররা মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেননি। তাহলে কি তারাও ধর্মান্ধদের মতো মনে করেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ্য করেছি, এটা মেনে নিতে প্রগতিশীলদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।

মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কেউ যদি বলে, তার অনুভূতিতে কোনও রকম আঘাত সে চায় না, সুতরাং কারও অধিকার নেই তার অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার! নিশ্চিতভাবেই সে বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না। তাছাড়া, অনুভূতিতে কোনওরকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবি অত্যন্ত অন্যায় দাবি। আমরা এমন মানুষ কখনও পাবো না, যার কোনও অনুভূতিতে আজ অবধি কোনও আঘাত লাগেনি। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত। মানুষের সঙ্গে ওঠা বসা এবং চলাফেরা করলে আমাদের অনুভূতি সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি শতবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। এভাবেই আমরা জীবন যাপন করি। ধরা যাক, ক যদি বলে সে সমাজবাদি দলের আদর্শে বিশ্বাস করে, এবং খ যদি উত্তরে বলে, সমাজবাদি এক নেতার চরিত্রের ঠিক নেই বা সমাজবাদির আদর্শ কোনও আদর্শই নয়, তাহলে কি ক দাবি করবে যে খ তার রাজনৈতিক অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে? এবং এই নিয়ে কোর্ট কাছারি করবে, জবাই চাপাতি করবে? ক আসলেই খ-এর রাজনৈতিক অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, তাতে হলোটা কি? মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে অনুভুতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মাথা ঘামালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকে।

আগেই বলেছি, অন্য কোনও অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হলে এত অঘটন ঘটে না, যত অঘটন ঘটে ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হলে। ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন আমাদের বিশেষভাবে সমীহ করতে হয়? যেহেতু ধর্মের গল্পগুলো সত্যি নাকি প্রচুর লোক এই ধর্মটাকে ভালোবাসে, সে কারণে? ধর্মের গল্পগুলোকে যারা সত্যি বলে মানে, তাদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হতেই পারে ধর্মের গল্পগুলোকে যারা সত্যি বলে মানে না, তাদের দ্বারা। তবে আর সব অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হলে তারা যেভাবে শুশ্রূষা করে, ধর্মানুভূতিও আঘাত প্রাপ্ত হলে ঠিক এভাবেই শুশ্রূষা করতে হবে।

অনুভূতির রাজনীতি অনেককাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। এখন দেখতে হবে আমরা কোন পক্ষ নিতে চাই। ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে চাই নাকি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার ইত্যাদি রক্ষা করতে চাই?

ধর্মানুভূতি নিয়ে রাজনীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এখন। এর সমাধান কিন্তু ধর্মানুভূতিতে আঘাত না করে হবে না। বরং উল্টো। ধর্মানুভূতিতে ক্রমাগত আঘাত করে যেতে হবে। আগের চেয়ে অনেক বেশি। ক্রমাগত আঘাতের ফলেই এই আঘাত গা সওয়া হবে। ধর্মানুভূতিকে নিয়ে ধর্ম ব্যবসা এক্ষুণি বন্ধ না করলে অসৎ ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজের যেটুকু বাকি আছে ধ্বংস হওয়ার, সেটুকুও ধ্বংস করবে।

পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকারবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এইসব পুরোনো পচা নিয়ম দূর করে সমাজ বদলাতে হলে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা অত্যন্ত জরুরি।

নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষ নিতে চাইলে ওরা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেনি, এটা বলাটা ঠিক নয়। বরং বলা উচিত, ওরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, কারণ আঘাতটা জরুরি ছিল। ধর্মান্ধরা চাইছে নাস্তিক শব্দটিকে এখন গালি হিসেবে ব্যবহার করতে। নাস্তিক শব্দটি যদি গালি হয়, আস্তিকও কিন্তু গালি।

গালি যত ইচ্ছে দাও। কিন্তু ভায়োলেন্স বন্ধ করো। আইডিওলজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ আহিডিওলজি দিয়েই হতে হবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সংঘাত ধর্মের চিরকালের। বিজ্ঞানীরা, বিজ্ঞান যে মানে না, তাদের ধারালো ছুরি শানিয়ে কোপাতে যায় না। কিন্তু ধার্মিকরা, ধর্ম যে মানে না তাদের কোপাতে যায়। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে। পৃথিবীতে মুসলমান ছাড়া আর কোনও সম্প্রদায় নেই যারা নিজেদের কোপাচ্ছে, জবাই করছে, বোমা ছুড়ছে, উড়িয়ে দিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress