Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লেখা কুমারী ও ছাপা সুন্দরী || Rabindranath Tagore

লেখা কুমারী ও ছাপা সুন্দরী || Rabindranath Tagore

গুটিকতক কবিতা লেখা ছিল, অনেক দিন ধরিয়া খাতায় পড়িয়াছিল, যতই দিন যাইতে লাগিল, ততই সে লেখাগুলিকে ভালো বলিয়া জ্ঞান হইতে লাগিল। অবশেষে সম্প্রতি সেগুলি ছাপা হইয়া গেছে। ধারণা ছিল, নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে পড়িতে বুঝি বড়োই আনন্দ হইবে।

কিন্তু কই, তাহা তো হইল না! আজ সমস্তদিন ধরিয়া মুদ্রাযন্ত্রের লৌহগর্ভ হইতে সদ্যপ্রসূত বইখানি হাতে লইয়া এ-পাত ও-পাত করিতেছি, কিছুই ভালো লাগিতেছে না।

লেখাগুলির পানে চাহিয়া চাহিয়া আমার প্রাণ বলিতেছে “বাছারা, আজ তোদের এমনতর দেখিতেছি কেন? অক্ষরগুলি মাথায় মাথায় সমান, কাষ্ঠের মতো খাড়া দাঁড়াইয়া আছে। একটু কিছুই এদিক-ওদিক হয় নাই। লাইনগুলি সমান, দুই ধারে মার্জিন, উপরে পাতার সংখ্যা। এ-সব তো সিপাহিদের মতো ছোরা-ছুরি-সঙ্গিন ওচানো সার-বাঁধা পোশাক-পরা অক্ষর। এ-সব তো সীসা ঢালা ছাঁচের অক্ষর, যেখানে যত বই দেখি, সকলই তো এইরকম অক্ষরের দেখিতে পাই। আমার সে বাঁকাচেরা সরু-মোটা অক্ষরগুলি কী হইল? কোনোটা-বা শুইয়া, কোনোটা-বা বসিয়া, কোনোটা উপরে, কোনোটা-বা নীচে। সেগুলি তো এমনতর কোণ-ওয়ালা খোঁচা-খোঁচা রেখা-রেখা খাড়া-খাড়া অক্ষর নহে; গোল, মোলায়েম, আঁকাবাঁকা, জড়ানো, অক্ষর। প্রত্যেক অক্ষরগুলি স্ব-স্ব প্রধান নয়। সকলেই সকলের গায়ে পড়িয়া, গলা ধরিয়া, হাতে হাতে জড়াইয়া ঘেঁসাঘেঁসি করিয়া থাকে। তাহাদরে পানে চাহিলে ভাবের কোট চেহারা দেখিতে পাওয়া যায়, ভাবটিকে রক্তমাংসের বলিয়া মনে হয়। সে লেখা আমার প্রিয়জনেরা সকলেই ভালো করিয়া জানে,সে লেখা পথের প্রান্তে কুড়াইয়া পাইলেও তাহারা আমার বলিয়া চিনিতে পারে, সে লেখা বিদেশে পাইলে তাহাদের মন আনন্দে নাচিয়া উঠে। তাহারা সে লেখার মধ্যে আমার মুখ দেখিতে পায়, আমার স্পর্শ অনুভব করে, আমার কণ্ঠধ্বনি শুনিতে পায়। সে আমার চিরপরিচিতগণ গেল কোথায়? আর এরা কে রে! এরা তো সব দাসের জাতি। সীসার কঠিন শৃঙ্খলে বাঁধা, ভাবশূন্য মুখে খাড়া রহিয়াছে, টাকার লোভে কাজ করিতেছে। ইহাদের সহিত আমার ভাবের নাড়ির টান নাই, ইহারা আমার ভাবগুলির প্রতি মমতার দৃষ্টিতে চায় না। আমার কাজ সমাধা করিয়া দিয়াই আবার তখনই হয়তো আমার সমালোচকের কাজ করিতে যায়! এ-সকল হৃদয়হীন দাসগুলিকে দেখিয়া আমার মন খারাপ হইয়া গেছে।

ওরে, তোদের সে কাটাকুটিগুলি গেল কোথায়! তোদের সে কালির দাগগুলো যে দেখি না! পূর্বে তো তোদের এমনতর নিখুঁত ভদ্রলোকটির মতো চেহারা ছিল না। ঘরের ছেলের মতো গায়ে ধুলা-কাদা মাখা, কাপড়ে দাগ, সেই তো তোকে শোভা পাইত। আর আজ সহসা তোদের এমনতর পরিপাটি বিজ্ঞভাব দেখিলে যে জেঠামি বলিয়া মনে হয়। বাপু, তোরা কি জানাইতে চাস তোদের মধ্যে একেবারে বানান ভুল ছিল না? কোথাও দন্ত্য সয়ের জায়গায় তালব্য শ ছিল না? আজ বড়ো লজ্জা বোধ হইল? পাড়াগাঁয়ে ছেলে শহরে আসিয়া যেমন প্রাণপণে শহুরে উচ্চারণে কথা কহিতে চায় তোদেরও কি সেই দশা হইল? তোরা আমার পাড়াগেঁয়ে ছেলে, তোদের উচ্চারণ শুনিয়া শহরশুদ্ধ লোকের পেট ফাটিয়া যাইবে, কিন্তু বাপের কানে অমন মিষ্ট আর কী আছে! তোদের সে বানান-ভুলগুলি আমার পরিচিত হইয়া গেছে, তোদের মুখের সহিত, আমার স্নেহের সহিত তাহারা জড়িত হইয়া গেছে। তাহাদের না দেখিলে আমি ভালো থাকি না। তাহাদের না দেখিলে তোদের যে ভাবে লিখিয়াছিলাম, সে ভাব আমার ঠিক মনে পড়ে না।

আগে তোদের আদর কম ছিল? জলটি লাগিলে তোদের অক্ষর মুছিয়া যাইত, একটি পাতা দৈবাৎ ছিঁড়িয়া বা হারাইয়া গেলে হাজার টাকা দিলেও আর সেটি পাওয়া যাইত না। ছাপার অক্ষর ধোয় না মোছে না, একটা বই হারাইয়া গেলে একটা টাকা দিলেই তৎক্ষণাৎ আর-একটা বই আসিয়া পড়ে। তোরা এখন আর অমূল্য নহিস, একমাত্র নহিস, তোদের গায়ে দোয়াত-শুদ্ধ কালি উল্টাইয়া পড়িলেও কেহ আহা-উহু করিবে না।

আসল কথা, এখন তোরা যে নতুন কাগজে, নতুন অক্ষরে প্রকাশিত হইয়াছিস, ইহাতে তোদের আজন্মকালের ইতিহাস লুপ্ত করিয়া দিয়াছে। তোদের দেখিলেই মনে হয় যেন তোরা এই নির্ভুল নির্বিকার অবস্থাতেই একেবারে হঠাৎ আকাশ হইতে পড়িলি! যে মানুষকে ভাবিতে হয়, যাহাকে সংশোধন করিতে হয় তাহার ঘরে যেন তুই জন্মগ্রহণ করিস নাই! কেহ যদি তোকে তোর খাতা-নিবাসী সহোদরটির কথা জিজ্ঞাসা করে, তুই যেন এখনই লজ্জিত হইয়া বলিবি, ও আমার বাড়ির সরকার! এইজন্যই কেহ তোকে মায়া করে না, তোর একটা দোষ দেখিলেই সমালোচকেরা ঝাঁটা তুলিয়া ধরে। কাঁচা কালির অক্ষর ও কাটাকুটির মধ্যে তোকে দেখিলে কি কেহ আর তোকে অমন কঠোর নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন করিতে পারে! তুই এমনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান অক্ষরে সাজসজ্জা করিয়াছিস যে তোর সামান্য ভুলটিও কাহারো বরদাস্ত হয় না।

সেই কাঁচা অক্ষর, কাটাকুটি, কালির দাগ দেখিলেই, আমার সমস্ত কথা মনে পড়ে; কখন লিখিয়াছিলাম, কী ভাবে লিখিয়াছিলাম, লিখিয়া কী সুখ পাইয়াছিলাম, সমস্ত মনে পড়ে। সেই বর্ষার রাত্রি মনে পড়ে, সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর, এক-একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়াছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটাকতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল! তোদের সেই সুখদুঃখপূর্ণ শৈশবের ইতিহাস আর তেমন স্পষ্ট দেখিতে পাই না, তাই আর তেমন ভালো লাগে না।

তোরা আমার কন্যা। যখন তোরা খাতায় তোদের বাপের বাড়িতে থাকিতিস, তখন তোরা কেবলমাত্র আমারই সুখ-দুঃখের সহচরী ছিলি। মাঝে মাঝে তোদের কাছে যাইতাম, তোদের সঙ্গে কথাবার্তা কহিতাম, মনের ভার লাঘব হইত। বন্ধু-বান্ধবরা আসিলে তোদের ডাকিয়া আনিতাম, তাহারা আদর করিত। তাহারা কহিত এমন মেয়ে কাহারো আজ পর্যন্ত হয় নাই, শীঘ্র হইবে যে এমন বোধ হয় না, শুনিয়া বড়ো খুশি হইতাম। এখন আর তোরা আমার নহিস, তোদের রাজশ্রী শ্রীমান সাধারণের হাতে সমর্পণ করিয়াছ! তোরা এখন দিনরাত্রি ভাবিতেছিস আমার এই দোর্দণ্ড-প্রতাপ জামাতা বাবাজি তোদের আদর করে কি না! যদি দৈবাৎ কোথাও একটা ভুল হয়, পান হইতে চুন খসে,অমনি অপ্রস্তুত হইয়া তাড়াতাড়ি শুদ্ধিপত্রে মার্জনা ভিক্ষা করিস। রঙকরা পাড়ওয়ালা মলাটের ঘোমটা দিয়া মনোরঞ্জনের চেষ্টা করিস! শ্বশুরবাড়ি পাছে কেহ তোকে ভুল বোঝে এই ভয়েই সারা, সর্বদা ভূমিকা, সূচীপত্র, পরিশিষ্ট প্রভৃতির আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়। সমালোচনা শাশুড়িমাগী উঠিতে বসিতে খুঁত ধরে। কথায় কথায় তোদের বাপের বাড়ির দৈন্য লইয়া খোঁটা দেয়। বাপের বাড়ির নিঃসংকোচ লজ্জাহীনতা, ঘোমটাহীন এলোথেলোভাব যত্নপূর্বক দূর করিয়াছিস, শ্বশুরবাড়ির খোঁপা-বাঁধা পারিপাট্য ও ঘোমটা-দেওয়া বিনীত ভাব অবলম্বন করিয়াছিস। এক কথায়, বাপের বাড়ির আর কিছু রহিল না। এখন আর একমাত্র আমার কথাই ভাবিস না, কে কী বলে তাই ভাবিয়া সারা।

আবার আমার চিরায়ুষ্মান জামাইটির মতো খামখেয়ালি মেজাজের লোক অতি অল্পই আছে। সে আজ আদর করিল বলিয়া যে কালও আদর করিবে তাহা নহে। এক-এক সময় তাহার এক-একটি সুয়ারানী থাকে তাহারই প্রাদুর্ভাবে আর বাকি সকল রূপবতী গুণবতীগণ দুয়ারানীর শ্রেণীতে গণ্য হইয়া যায়। তাহার রাজান্তঃপুরে কত আদরের মহিষী আছে, তাহাদের মধ্যে আমার এই গুটিকত ভীরু স্বভাব দুর্বল কুসুম-পেলবা কন্যা স্থাপন করা কি ভালো হইল! একবার চাহিয়া দেখো, অপরিচিত স্থানে গিয়া, অনভ্যস্ত অলংকার পরিয়া উহাদের মুখশ্রীর স্বাভাবিকতা যেন চলিয়া গিয়াছে। উহাদিগকে যেন এক সার কাঠের পুতুলের মতো দেখাইতেছে। আর যাহাই হউক, আমার এ সাদাসিধা পাড়াগেঁয়ে কবিতাগুলিকে এরকম ছাপার অক্ষরে মানায় না। দম্ভোলি, ইরম্মদ ও কড়কড় শব্দ নহিলে যেন ছাপার অক্ষর সাজে না।

এমন কাজ কেন করিলাম! কবিতাগুলি যখন খাতায় ছিল তখন আমার সুখের কি অভাব ছিল! এখন সে সকলেই বিদেশীর মতো ইহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিবে! কেহ বলিবে ভালো, কেহ বলিবে মন্দ, কেহ সম্মান করিবে, কেহ অপমান করিবে, কিন্তু ইহার ত্রুটি তো কেহই মার্জনা করিবে না; ইহাকে আপনার লোক বলিয়া কেহই তো কোলে তুলিয়া লইবে না! আপনার ধন পরের সম্পত্তি হইয়া গেল, যে যাহা করে, যে যাহা বলে চুপ করিয়া সহিতেই হইবে। আয় রে ফিরিয়া আয়– তোদের সেই কাঁচা অক্ষর, বানান-ভুল, কালির দাগের মধ্যে ফিরিয়া আয়, স্নেহের আরামে থাকিবি। চব্বিশ ঘণ্টা সোজা লাইনের নীচে অমনতরো খাড়া হইয়া থাকিতে হইবে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress