Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দরোয়ান || Rabindranath Tagore

দরোয়ান || Rabindranath Tagore

আমাদের কর্তা আমাদের যে স্থানে বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠাইয়াছেন, সেখানে এত প্রকারের আপদ-বিপদের সম্ভাবনা আছে যে, আমাদের প্রত্যেকের মনের দেউড়িতে তিনি যুক্তি বা বুদ্ধি বলিয়া এক-একটা দরোয়ান খাড়া করিয়া রাখিয়াছেন। এ ব্যক্তি আমাদের কী ভয়ানক শাসনেই রাখিয়াছে। আমাদের উপরে ইহার কী দারুণ একাধিপত্য! ইনি যাহাদের না চেনেন, এমন কোনো লোককে ঘরে ঢুকিতে দেন না। সদা সর্বদা পাহারা। ইনি যে গণ্ডিটি দিয়া রাখিয়াছেন, তাহার বাহিরে আমাদের কোনো মতেই যাইতে দেন না। রাত্রি হইলে এ লোকটি ঘুমাইয়া পড়ে, সেই অবসরে অনেক প্রকারের লোক পা টিপিয়া পা টিপিয়া আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসে, কখনো বা উৎপাত করে কখনো বা আমোদে রাখে। যেই দরোয়ানটা জাগিয়া উঠে, ঘরের মধ্যে গোলযোগ শুনিতে পাইয়া সে ডাকিয়া উঠে, “কে রে? আমার হকুম না লইয়া ঘরে কে আসিয়াছিস?’ অমনি আমাদের স্বপ্ন-নাটকের পাত্রগণ, আমাদের Dreamatis Person দরজা দিয়া, জানালা দিয়া, খিড়কি দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া পালায়। আমরা সকলে ছেলেমানুষ লোক, যে আসে তাহাকেই বিশ্বাস করি, এই নিমিত্ত দরোয়ান এমন কাহাকেও প্রবেশ করিতে দেয় না যে বিশ্বাসযোগ্য নহে। স্বপ্নে আমরা কাহাকে না বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করাই আমাদের স্বাভাবিক অবস্থা। কিন্তু আমাদের দরোয়ান হাজার হুঁশিয়ার হক-না-কেন, ভদ্রলোকের মতো কাপড়-চোপড় পরিয়া অনেক অবিশ্বাস্য লোক আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করে, তাহারা অনেক লোকসান করিয়া থাকে। অনেক সময়ে আমাদের প্রতিবেশীর দরোয়ান আমাদের দরোয়ানকে সাবধান করিয়া দেয়। যদি দরোয়ানের তাহাতে চৈতন্য হয় তবে তৎক্ষণাৎ তাহাকে ডাকিয়া গলাধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দেন। নানা চরিত্রের দরোয়ান আছে, ভাব অতিথিগণ তাহাদের নানা উপায়ে বশ করিতে পারে। কেহ-বা হীরার আংটি ঘড়ির চেন-পরা বাবুটিকে দেখিলেই ছাড়িয়া দেয়; কেহ-বা মিষ্ট কথা শুনিলেই গলিয়া যায়, অবিশ্বাস মন হইতে চলিয়া যায়; কেহ-বা বিশ্বাস করুক বা না করুক, সন্দেশের লোভ পাইলে চক্ষুকর্ণ বুজিয়া তাহাকে প্রবেশ করিতে দেয়। কত বড়ো বড়ো জাঁকালো-মত, ভুঁড়িবান ভাব হীরা জহরাৎ পরিয়া কত নাবালকের বৈঠকখানায় আদরের সহিত গৃহীত হইয়াছে, অথচ তাহারা আদরের যোগ্য নহে; কত মতকে আমরা মিঠা ভাষা মিঠা গলা শুনিয়া ডাকিয়া আনিয়াছি; আবার অনেক মতকে আমরা ঠিক বিশ্বাস করি না, কিন্তু বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করে বলিয়া, বিশ্বাস করিবার প্রলোভন আছে বলিয়া ঘরে ঢুকিতে দিই। অনেক সময়ে দিনের বেলায় দরোয়ান ঝিমায়। দুই প্রহরে চারি দিক হয়তো ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে, জানালা দিয়া অল্প অল্প বাতাস আসিতেছে, খাটিয়াটির উপরে পড়িয়া দরোয়ানের তন্দ্রা আসিয়াছে, সেই সময়ে কত শত পরস্পর অচেনা ভাব আমাদের হৃদয়ের প্রবেশ-দ্বার অরক্ষিত দেখিয়া আস্তে আস্তে প্রবেশ করে; কত প্রকার অদ্ভুত খেলা খেলিতে থাকে তাহার ঠিকানা নাই; অনেকের এইরূপ অলস দরোয়ান আছে। আবার এক-একটা এমন দুর্দান্ত ভাব আছে যে, আমাদের দরোয়ানদের ঠেঙাইয়া জোর-জবরদস্তি করিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। এই মনে করো, ভূতের ভয় বলিয়া এক ব্যক্তি যখন কাহারো মনের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন যুক্তিসিং হাজার ঢাল-তলোয়ার লইয়া আস্ফালন করুন-না-কেন, তাহার কাছে ঘেঁষিতে পারেন না। কাহারো বা রোগা দরোয়ান, কাহারো বা ভালো মানুষ দরোয়ান, কাহারো বা অলস দরোয়ান।

এক-একটি ছেলে আছে, যাহার এই দরোয়ানটির উপর দৃঢ় বিশ্বাস। তাহাকে না লইয়া কোথাও যাইতে চায় না; সকল কাজেই তাহাকে খাড়া করিয়া রাখিয়া দেয়। সে ভাবে, কে জানে কোথায় কে দুষ্ট লোক আছে, কোথায় কোন্‌খানে গিয়া পৌঁছাইব, তাহার ঠিক নাই। সে যেখানে আছে, যুক্তিও তাহার তক্‌মা পরিয়া পাগড়ি আঁটিয়া আসাসোঁটা ধরিয়া কাছে কাছে হাজির আছে। আবার এমন কে-একটা যথেচ্ছাচারী দুষ্ট ছেলে আছে, যে এই দরোয়ানটাকে দুচক্ষে দেখিতে পারে না। সে ভাবে, এ একটা কোথাকার মেড়ুয়াবাদী আমার স্বাধীনতা অপহরণ করিয়া বসিয়া আছে। একটা যে সংকীর্ণ গণ্ডি টানিয়া দিয়াছে, তাহার মধ্যে কষ্টই থাক্‌ আর দুঃখই থাক্‌, আগুনেই পুড়ি, আর জলেই হাবুডুবু খাই, তাহার বাহিরে কোনো মতেই যাইতে দেয় না। অবশেষে নিতান্ত জ্বালাতন হইয়া দুষ্টামি করিয়া তাহাকে মদ খাওয়াইয়া দেয়; এইরূপে বুদ্ধি যখন মাতাল হইয়া অচেতন হইয়া পড়ে, তাহারা গণ্ডির বাহিরে গিয়া উপস্থিত হয়। অনেক লোকে যে মদ খাইতে ভালোবাসে, তাহার কারণ এই যে, তাহারা স্বাধীনতা পাইতে চায়; বুদ্ধিটাকে কোনো প্রকারে অভিভূত করিয়া ফেলিয়া যথেচ্ছা বিচরণ করিতে চায়; ইহাতে যে বিপদই ঘটুক-না-কেন তাহারা ভাবে না। এই উভয় দলেই কিছু অন্যায় বাড়াবাড়ি করিয়া থাকেন। নিতান্তই যুক্তির নির্দিষ্ট চারটি দেয়ালের মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়ানো মনের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নহে, আবার সর্বতোভাবে যুক্তিকে অমান্য করিয়া যথেচ্ছাচার করিয়া বেড়ানোও ভালো নয় যুক্তির সীমানা ছাড়াইয়া যে নিরাপদ স্থান নাই, এমনত নহে! অতএব মাঝে মাঝে যুক্তির অনুমতি লইয়া কল্পনার রাজ্যে খুব খানিকটা ছুটিয়া বেড়াইয়া আসা উচিত। এইরূপে যুক্তিকে কাজ হইতে অব্যাহতি দিয়া মাঝে মাঝে ছুটি দিলে তাহার শরীরের পক্ষেও ভালো।

“সিদ্ধি খাইলে বুদ্ধি বাড়ে।’ অর্থাৎ বুদ্ধি-দরোয়ান সিদ্ধিটি খাইলে থাকে ভালো। অল্প পরিমাণে সিদ্ধি খাইলে ভালো থাকে বটে, কিন্তু অধিক পরিমাণে খাইলে, খুব বলবান দরোয়ান নহিলে সামলাইতে পারে না; মাথা ঘুরিয়া যায়, ভোঁ হইয়া পড়ে। অল্প সিদ্ধি খাইলে সাবধানিতা বাড়ে, কিন্তু অধিক সিদ্ধি খাইলে এমন যশের নেশা লাগিতে পারে যে, একেবারে অসাবধানী হইয়া পড়া সম্ভব। শুনিয়াছি সিদ্ধি ও ভাঙে প্রভেদ নাই। হিন্দুস্থানীতে যাহাকে ভাঙ্‌ বলে বাঙালিরা তাহাকেই সিদ্ধি বলে। জাতি বিশেষে এইরূপ হওয়াই সম্ভব। একটি জাতির পক্ষে নেশা করিয়া, উদ্যম হারাইয়া, অচেতন হইয়া পড়িয়া থাকায় সিদ্ধি, অর্থাৎ চরম ফল, সেইটি হইলে সে চূড়ান্ত মনে করে; আর-একটি জাতির পক্ষে নেশা করিয়া অজ্ঞান হইয়া থাকা ভাঙ্‌ মাত্র; অর্থাৎ অবসরমতো একটু একটু কাজে ভঙ্গ দেওয়া, সচরাচর অবস্থা, স্বাভাবিক অবস্থা হইতে একটু বিক্ষিপ্ত হওয়া। যাহা হউক, আমাদের বুদ্ধির দরোয়ানদের মধ্যে সিদ্ধি ও ভাঙ্‌ দুই এক পদার্থ নহে। উভয়ের ফল বিভিন্ন। সিদ্ধিতে উত্তেজিত উল্লসিত করিয়া তুলে, ভাঙেতে অবসন্ন ম্রিয়মাণ করিয়া দেয়। লেখকের দরোয়ানটা ক্রমিক ভাঙ্‌ খাইয়া আসিতেছে। সে বেচারির কপালে সিদ্ধি আর জুটিল না।

দরোয়ানদের আর-একটা কাজ আছে। লাঠালাঠি করা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করা। আমোদের জন্যও বটে, কাজের জন্যও বটে। এক-এক জন এমন দাঙ্গাবাজ লোক আছে, তাহারা তাহাদের লাঠিয়াল দরোয়ানটাকে সভাস্থলে, নিমন্ত্রণে, যেখানে-সেখানে লইয়া যায়, সামান্য সূত্র পাইলেই অমনি অন্যের দরোয়ানের সঙ্গে মারামারি বাধাইয়া দেয়। এই লোকগুলা অত্যন্ত অসামাজিক। একটা দরোয়ানকে কাছে হাজির রাখা দোষের নহে, কিন্তু ছুতানাতা ধরিয়া যখন-তখন যেখানে-সেখানে একটা তর্কের লাঠি চালাইতে হুকুম দেওয়া মনের একটা অসভ্য অসামাজিক ভাব। নিজের বুদ্ধিকে যাহারা ভেড়া মনে করে, তাহারাই বুদ্ধিকে লইয়া এইরূপ ভেড়ার লড়াই করিয়া বেড়াক। কিন্তু যাহারা ভেড়া-বুদ্ধি নহে তাহারা যেন উহাদের অনুকরণ না করে। উহারা এমনতরো দাঙ্গাবাজ যে, দাঙ্গা করিবার কিছু না থাকিলে দেয়ালে ঢুঁ মারিয়া থাকে। সর্বত্রই এমনতরো বাহাদুরি করিয়া বেড়ানো সুরুচি-সংগত নহে।

এক-এক জনের দেউড়িতে এমন এক-একটা লম্বাচৌড়া দরোয়ান আছে, তাহাকে কেহ কখনো লড়িতে দেখে নাই, অথচ তাহাকে মস্ত পালোয়ান বলিয়া লোকের ধারণা। মুখে মুখে তাহার খ্যাতি সর্বত্র বিস্তৃত হইয়া গিয়ছে; কী করিয়া যে হইল, তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না। তাহাকে দরোয়ানেরা দেখে, নমস্কার করে, আর চলিয়া যায়। তাহার এক সুবিধা এই যে, তাহাকে প্রায় লাঠি ব্যবহার করিতে হয় না। অন্য লোকদের বড়ো বড়ো ভাব, বড়ো বড়ো মতসকলকে কেবল চোখ রাঙাইয়া ভাগাইয়া দেয়। যদি দৈবাৎ কেহ সাহস করিয়া তাঁহার সঙ্গে লড়াই করিতে যায়, তবেই তাঁহার সর্বনাশ। এক-একটা দরোয়ান আছে, গায়ে ভয়ানক জোর, কিন্তু সাহস কম; কোনো মতেই কুস্তিতে অগ্রসর হইতে চাহে না। কিন্তু কোনো কোনো দরোয়ানের গায়ে জোর কম থাকুক, এত প্রকার কুস্তির প্যাঁচ জানে যে, অপেক্ষাকৃত বলবানদেরও পাড়িয়া ফেলিতে পারে।

যাঁহারা দেউড়ির উন্নতি করিতে চান তাঁহারা দরোয়ানদের ভালো আহার দিবেন, মাঝে মাঝে ছুটি দিবেন, দিনরাত্রি অকর্মণ্য করিয়া রাখিবেন না, আর মদ খাইতে না দেন। আমরা যেরূপ শিশু-প্রকৃতি, যাহা তাহা বিশ্বাস করি, সকলই সমান চক্ষে দেখি; আমরা যে বিপদের দেশে আছি, নানা চরিত্রের, নানা ব্যবসায়ে লোকের মধ্যে বাস; এখানে ভালো দরোয়ান রাখা নিতান্তই আবশ্যক। তাহা ছাড়া, নিতান্ত স্বার্থপর হইয়া নিজের দরোয়ানকে যেন কেবলমাত্র নিজের কাজেই নিযুক্ত না রাখি, আবশ্যকমতো পরের সাহায্য করিতে দেওয়া সামাজিক কর্তব্য। আমাদের দেশে অতি পূর্বকালে পুলিসের পদ্ধতি ছিল। ব্রাহ্মণ, ঋষি ইন্‌স্পেক্টরগণ নিজের নিজের কনস্টেবল লইয়া বাড়ি বাড়ি, রাস্তায় রাস্তায় হাটে-বাজারে, চোর-ডাকাত তাড়াইয়া বেড়াইতেন। তাঁহাদের বেতন ছিল, ওই কাজেই তাঁহারা নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু ইহার একটু কুফল এই হয় যে, স্বার্থ-সাধন উদ্দেশে বা ভুল বুঝিয়া ইন্‌স্পেক্টরগণ যথার্থ ভদ্রলোকদের প্রতিও উৎপীড়ন করিতে পারেন। শুনা যায় তাঁহারা সেইরূপ অত্যচার আরম্ভ করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত বৌদ্ধদলেরা খেপিয়া এমন পুলিস ঠেঙাইতে আরম্ভ করিয়াছিল যে, কন্‌স্টেবলগণ ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়িয়াছিল। কিন্তু বিদ্রোহী-দল বেশি দিন টিকিতে পারে নাই। অবশেষে তাহারা নির্বাসিত হইয়াছিল। আজকাল এরূপ পুলিসের পদ্ধতি নাই। সুতরাং সাধারণের উপকারার্থে সকলকেই নিজের নিজের দরোয়ানকে মাঝে মাঝে পুলিসের কাজে নিযুক্ত করা উচিত। দেশে এত শত প্রকার সিঁদেল চোর আছে, রাত্রিযোগে এমন পা টিপিয়া তাহারা গৃহে প্রবেশ করে যে, এরূপ না করিলে তাহাদের শাসন হইবার সম্ভাবনা নাই। আমার দরোয়ানটা রোগা হউক, তাহাকে এইরূপ অনরারি পুলিস কন্‌স্টেবলের কাজে নিযুক্ত করিয়াছি। অনেক সময়ে লড়াই করিয়া সে বেচারি পারিয়া উঠে না, বলবান দস্যুদের কাছ হইতে লাঠি খাইয়া অনেকবার অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে, কিন্তু তথাপি তাহার উদ্যম ভঙ্গ হয় নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress