ছেলেবেলাকার শরৎকাল
এই শরতের প্রভাতের রৌদ্রে জানলার বাহির দিয়া গাছপালার দিকে চাহিয়া দেখিলেই আমার মনে পড়ে ছেলেবেলায় চারি দিকের প্রকৃতির শোভা কী একান্ত ভালো লাগিত! ভোরের বেলায় বাড়িভিতরের বাগানে গিয়া পথের দুইধারি ফুটন্ত জুঁই ফুলের গন্ধে কী আশ্চর্য আনন্দ লাভ করিতাম! গাছের গোপন সবুজের মধ্য হইতে একটি আধফুটো জহরী-চাঁপা পাইলে কী যেন একটা সম্পদ লাভ করিতাম মনে হইত। বাহিরের তেতালার টবে অনাহূত অতিথির মতো একটু বুনোলতা কী সুযোগে জন্মিয়াছিল, প্রতিদিন সকালে উঠিয়া যখন দেখিতাম সেই লতা বেগুনি ফুলে একেবারে ভরিয়া গেছে আমার মনে কী এক অপূর্ব বিস্ময়পূর্ণ উল্লাসের সঞ্চার হইত। বাস্তবিক বিস্ময়ের কথা বটে। সকালবেলায় ঘুম হইতে উঠিয়াই একেবারে, দুর্বল কোমল পেলব, কতরকমের সুন্দর ভঙ্গিমায় বঙ্কিম ক্ষীণ লতাটির শাখায় শাখায় ফুল– নবীন, পরিপূর্ণ পরিস্ফুট– সকল রঙগুলি ফলানো, রঙের আভাসগুলি অতি সুকোমলভাবে আঁকা, পাপড়ির অগ্রভাগগুলি অতি সযত্নে বাঁকাইয়া অমনি টুপ করিয়া একটুখানি মুখ করিয়া দেওয়া, সুকুমার বৃন্তটুকুর উপর অতি সরল সুন্দর ভারলেশহীন নিশ্চেষ্ট ভঙ্গিতে বসানো– কোথাও কিছুমাত্র তাড়াতাড়ি নাই, ভ্রম নাই, ত্রুটি নাই, রসভঙ্গ নাই, প্রতিকূল বিমুখ ভাব নাই– সমস্ত বিশ্বসংসার যেন তাহার প্রতি একাগ্র প্রসন্ন দৃষ্টিপাত করিতেছে এবং সে যেন সমস্ত বিশ্বের প্রতি পরিপূর্ণ প্রসন্ন হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে; তাহার প্রত্যেক সুকুমার বঙ্কিমার লেশটুকুর মধ্যে অপরিসীম প্রেমের ইতিহাস যেন লিপিবদ্ধ হইয়াছে। তাহার সর্বাঙ্গের সুকোমল সুগোলতার মধ্যে, বিশেষত তাহার বুকের মাঝখানটিতে যেখানে চারি দিকে রঙের ঘোর অতি ধীরে ধীরে নরম হইয়া একেবারে মোলায়েম সাদা হইয়া আসিয়াছে– যেন অনন্তকালের সযত্ন সোহাগের চুম্বন লাগিয়া আছে। অতিশয় আশ্চর্য! একটি গোপন জহরী চাঁপা একটি গোপন সম্পদ তাহার আর সন্দেহ নাই। ইহা ছেলেমানুষের অপরিণত হৃদয়ের মোহমাত্র নহে। এখন সে বিস্ময়ের আনন্দ চলিয়া গেছে। এখন একটা অনাদৃত বুনোলতার বেগুনি ফুলকে নিতান্ত যৎকিঞ্চিৎ মনে হয়। ফুল তো ফুটিবারই কথা। ফুল সুন্দর বটে এবং অনেক ফুল দুর্লভও বটে, কিন্তু তাহার মধ্যে সেই নিবিড় বিস্ময়ের স্থান নাই। ভিক্ষুকের যখন ভিক্ষা বরাদ্দ হইয়া যায়, তখন তাহার আর কৃতজ্ঞতা জন্মে না। শিশুকালে আমরা ভালো করিয়া জানিতাম না চারি দিকের এ অসীম সৌন্দর্য আমাদের নিত্যনিয়মিত বরাদ্দ। জননী যেমন প্রতি ক্ষুদ্র কাজে অজস্র স্নেহের দ্বারা আমাদিগকে অনুক্ষণ আচ্ছন্ন করিয়া রাখেন, তাহার মধ্যে অনেকটাই আমাদের আবশ্যকের অতিরিক্ত, তাহার অনেকটা আমাদের নজরে পড়ে না, তাহার অনেকটা আমরা অবহেলে গ্রহণ করি, কিন্তু বিচার করি না, কিন্তু উদার মাতৃস্নেহের তাহাতে কিছুই আসে যায় না– ইহাও সেইরূপ।