স্বাধীনতা লাভের পর পনেরো বছর
স্বাধীনতা লাভের পর পনেরো বছর অতীত হইয়াছে। সনাতন ভারতীয় আইন অনুসারে আমাদের স্বাধীনতা দেবী সাবালিকা হইয়াছেন, পলায়নী মনোবৃত্তি ত্যাগ করিয়া কঠিন সত্যের সম্মুখীন হওয়ার সময় উপস্থিত। সুতরাং এ কাহিনী বলা যাইতে পারে।
নেংটি দত্ত নামধারী অকালপক্ক বালককে লইয়া কাহিনী আরম্ভ করিতেছি, কারণ সে না থাকিলে এই ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটিত না। নেংটি একরকম জোর করিয়াই আমাদের বাসায় আসিয়া ব্যোমকেশের সহিত আলাপ জমাইয়াছিল। অত্যন্ত সংপ্রতিভ ছেলে, নাকে-মুখে কথা, বয়স সতেরো কি আঠারো, কিন্তু চেহারা রোগা-পাটকা বলিয়া আরো কম বয়স মনে হইত। এই বয়সে সে যথেষ্ট বুদ্ধি সংগ্রহ করিয়াছিল, অথচ সেই সঙ্গে একটু ন্যাকা-বোকাও ছিল; একাধারে ছেলেমানুষ এবং এঁচড়ে-পাকা। অল্প পরিচয়ে অত্যন্ত ফাজিল ও ডেপো মনে হইলেও আসলে সে যে মন্দ ছিল না। তাহার পরিচয় আমরা পাইয়াছিলাম। ব্যোমকেশকে সে মনে মনে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করিত, কিন্তু তাহার কথা শুনিয়া মনে হইত। ব্যোমকেশের সমস্ত চালাকি সে ধরিয়া ফেলিয়াছে, ব্যোমকেশের চেয়ে তাহার বুদ্ধি অনেক বেশি।
যখনই সে আমাদের বাসায় আসিত, ব্যোমকেশের সঙ্গে অপরাধ-বিজ্ঞান লইয়া পরম বিজ্ঞের মত আলোচনা করিত। ছেলেটা লেখাপড়ায় বহুদিন ইস্তফা দিয়াছে কিন্তু একেবারে অজ্ঞ নয়, ব্যোমকেশ হাসি মুখে তাহাকে আস্কারা দিত। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে প্রীতি-কৌতুক মিশ্রিত একটা সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল।
দুচার দিন আনাগোনা করার পর নেংটি হঠাৎ একদিন হাত বাড়াইয়া বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, একটা সিগারেট দিন না।’
ব্যোমকেশ বিস্ফারিত চক্ষে চাহিল, তারপর ধমক দিয়া বলিল, ‘এতটুকু ছেলে, তুমি সিগারেট খাও।‘
নেংটি বলিল, ‘পাব কোথায় যে খাব? মাসিমা একটি পয়সা উপুড়-হস্ত করে না, মাঝে-মধ্যে মেসোমশাইয়ের টিন থেকে দুএকটা চুরি করে খাই। তাছাড়া বাড়িতে কি সিগারেট খাওয়ার জো আছে? ধোঁয়ার গন্ধ পেলেই মাসিমা মারমার করে তেড়ে আসে। দিন না একটা।’
ব্যোমকেশ তাহাকে একটা সিগারেট দিল, সে তাহা পরম যত্নে সেবন করিয়া শীঘ্র আবার আসিবার আশ্বাস দিয়া প্রস্থান করিল।
অতঃপর সে যখনই আসিত তাহাকে একটা সিগারেট দিতে হইত।
একদিন নেংটি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে আসিয়া বলিল, ‘জানেন ব্যোমকেশদা, আমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছে, ঠিক বিলিতি মেমের মত দেখতে।’
ব্যোমকেশ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া বলিল, ‘তাই নাকি।’
নেংটি বলিল, ‘হ্যাঁ, এত সুন্দর মেয়ে আমি আর কখনো দেখিনি। আপনি যদি দেখেন ট্যারা হয়ে যাবেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে দেখব না। কে তিনি?’
নেংটি বলিল, ‘মেসোমশাইয়ের বন্ধুর মেয়ে। পূর্ববঙ্গে থাকত, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় বাপ-মা মরে গেছে; মেয়েটা কোন মতে প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। মেসোমশাই তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমারই মত অবস্থা।’
মনে মনে নেংটির মেসোমশাই সন্তোষ সমাদ্দারকে সাধুবাদ করিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকিলেও নেংটির মারফৎ তাঁহার কথা জানিতাম। তিনি খ্যাতিমান ব্যক্তি, তাঁহার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কীর্তিকলাপ বাংলাদেশে কাহারও অবিদিত নয়। আমরা তাঁহার পারিবারিক পরিস্থিতির কথাও জানিতাম। বস্তুত, যে কাহিনী লিখিতেছি তাহা সন্তোষবাবুরই পারিবারিক ঘটনা।
ঘটনার পূর্বকালে ও উত্তরকালে এই পরিবারের মানুষগুলি সম্বন্ধে যাহা জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহা স্থূলভাবে এখানে লিপিবদ্ধ করিতেছি। আকস্মিক মৃত্যু আসিয়া এই সমৃদ্ধ পরিবারের সহিত আমাদের সংযোগ ঘটাইয়াছিল। আবার আকস্মিক মৃত্যুই নাটকের শেষ অঙ্কে যবনিকা টানিয়া দিয়াছিল। অনেক দিন নেংটিকে দেখি নাই–। কিন্তু যাক।
সন্তোষ সমাদ্দার ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। চৌরঙ্গী হইতে দক্ষিণ দিকে কিছুদূর যাইলে একটি উপ-রাস্তার উপর তাঁহার প্রকাণ্ড দ্বিতল বাগান-ঘেরা বাড়ি। সন্তোষবাবু কিন্তু বাড়িতে কমই থাকিতেন; সারা দিন ব্যবসা-ঘটিত কাজে-কর্মে এবং রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে কাটাইয়া সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিতেন। তাও শনিবার সন্ধ্যার পর তাঁহাকে বাড়ি পাওয়া যাইত না, অফিসের কাজ-কর্ম সারিয়া তিনি এক কীর্তন-গায়িকার গৃহে গান শুনিতে যাইতেন; তারপর একেবারে সোমবার সকালে সেখান হইতে অফিসে যাইতেন। তখন তাঁহার বয়স ছিল আন্দাজ আটচল্লিশ বছর।
তাঁর স্ত্রী চামেলি সমাদ্দার বয়সে তাঁর চেয়ে দুতিন বছরের ছোট। শীর্ণ লম্বা স্নায়ুবিক প্রকৃতির স্ত্রীলোক, যৌবনকালে সন্ত্রাসবাদীদের সহিত যুক্ত ছিলেন। সন্তোষবাবুর সহিত বিবাহের পর কয়েক বছর শান্তভাবে সংসারধর্ম পালন করিয়া ছিলেন, দু’টি যমজ পুত্রসন্তানও জন্সিয়াছিল। ক্রমে তাঁহার চরিত্রে শুচিবাই দেখা দিল, স্বভাব তীক্ষ্ণ ও ছিদ্রান্বেষী হইয়া উঠিল। বাড়িতে মাছ-মাংস রহিত হইল, স্বামীর সহিত এক বাড়িতে থাকা ছাড়া আর অন্য কোন সম্পর্ক রহিল না। এইভাবে গত দশ-বারো বছর কাটিয়াছে।
ইঁহাদের দুই যমজ পুত্র যুগলচাঁদ ও উদয়চাঁদ। বয়স কুড়ি বছর, দু’জনেই কলেজে পড়ে। যমজ হইলেও দুই ভাইয়ের চেহারা ও চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত; যুগলচাঁদের ছিপছিপে চেহারা, তরতরে মুখ; উদয়চাঁদ একটু গ্যাঁটা-গোটা ষণ্ডা-গুণ্ডা ধরনের। যুগলচাঁদ ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলে; লেখাপড়ায় ভাল, লুকাইয়া কবিতা লেখে। উদয় দাম্ভিক ও দুদন্তি, সকলের সঙ্গে ঝগড়া করে, মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোটেলে গিয়া মুর্গী খায়। শ্ৰীমতী চামেলি তাহাকে শাসন করিতে পারেন না, কিন্তু মনে মনে বোধহয় দুই ছেলের মধ্যে তাঁহাকেই একটু বেশি ভালবাসেন।
এই চারজন ছাড়া আরো তিনটি মানুষ বাড়িতে থাকে। প্রথমত, নেংটি ও তাহার ছোট বোন চিংড়ি। বছর দুই আগে তাঁহাদের মাতা পিতা একসঙ্গে কলেরা রোগে মারা গিয়াছিলেন, নেংটি ও চিংড়ি অনাথ হইয়া পড়িয়াছিল। শ্ৰীমতী চামেলি তাঁহাদের সাক্ষাৎ মাসি নন, কিন্তু তিনি তাহাদের নিজের কাছে আনিয়া রাখিয়াছিলেন; সেই অবধি তাহারা এখানেই আছে। নেংটির পরিচয় আগেই দিয়াছি, চিংড়ি তাহার চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট। তাহার চেহারাটি ছোটখাটো, মোটের উপর সুশ্ৰী; এই বয়সেই সে ভারি বুদ্ধিমতী ও গৃহকর্মনিপুণা হইয়া উঠিয়াছে। মাসিমা শুচিবাই-এর জন্য অধিকাংশ সময় কল-ঘরে থাকেন, চিংড়িই সংসার চালায়। যুগলচাঁদ তাহার নাম দিয়াছে কুচোচিংড়ি।
তৃতীয় যে ব্যক্তিটি বাড়িতে থাকেন তাঁহার নাম রবিবর্মা। পুরা নাম বোধকরি রবীন্দ্রনাথ বর্মণ; কিন্তু তিনি রবিবর্মা নামেই সমধিক পরিচিত। দীর্ঘ কঙ্কালসার আকৃতি; মুখের ডৌল, চোখের বক্রতা এবং গোঁফ-দাড়ির অপ্রতুলতা দেখিয়া ত্রিপুরা অঞ্চলের সাবেক অধিবাসী বলিয়া সন্দেহ হয়; বয়স আন্দাজ চল্লিশ। ইনি সন্তোষবাবুর একজন কর্মচারী, তাঁহার রাজনীতি-ঘটিত ক্রিয়াকলাপের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি। নিজের সংসার না থাকায় তিনি সন্তোষবাবুর গৃহেই থাকেন, বাড়ির একজন হইয়া গিয়াছেন; প্রয়োজন হইলে বাড়ির কাজকর্মও দেখাশোনা করেন।
এই সাতটি মানুষের সংসারে হঠাৎ যেদিন একটি অপরূপ সুন্দরী যুবতীর আবির্ভাব ঘটিল, সেদিন মৃত্যু-দেবতার মুখে যে কুটিল হাসি ফুটিয়াছিল তাহা কেহ দেখিতে পায় নাই। নেংটি প্রথম দিনই আসিয়া যুবতীর আবিভাবের খবর দিয়াছিল; তারপর যতবারই আসিয়াছে মশগুল হইয়া যুবতীর প্রসঙ্গ আলোচনা করিয়াছে, পরিবারের মধ্যে যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের প্রবল আবহ সৃষ্টি হইয়াছিল তাহার বর্ণনা করিয়াছে। শুনিতে শুনিতে আমার মনে হইয়াছে নেংটিদের সংসারে একটি দুর্যোগ ঘনাইয়া আসিতেছে, কিন্তু তাহা যে এমন মারাত্মক আকার ধারণ করিবে তাহা কল্পনা করি নাই।
যুবতীর আবিভবের মাস ছয়েক পরের কথা। দুৰ্গাপূজা শেষ হইয়া কালীপূজার তোড়জোড় আরম্ভ হইয়াছে, এই সময় একদিন সন্ধ্যার পর ব্যোমকেশ আমাদের বসিবার ঘরে আলো জ্বালিয়া একমনে রামায়ণ পড়িতেছিল। রাজশেখর বসু মহাশয় মূল বাল্মীকি রামায়ণের চুল ছটিয়া দাড়ি-গোঁফ কামাইয়া তারতরে ঝরঝরে করিয়া দিয়াছেন, ব্যোমকেশ কর্মহীন দিবসের আলুনি প্রহরগুলি তাহারই সাহায্যে গলাধঃকরণ করিবার চেষ্টা করিতেছিল। আমি তক্তপোশে চিৎ হইয়া অলসভাবে এলোমেলো চিন্তা করিতেছিলাম। সাম্প্রতিক শারদীয়া পত্রিকায় যে কয়টি রচনা পড়িয়াছি, তাহা হইতে মনে হয় বাঙালী লেখক বাংলা ভাষা লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছেন; রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা যেমন স্বাধীনতা পাইয়াছি, ভাষার ক্ষেত্ৰেও তেমনি-শাসনহীন অবাধ স্বৈরাচার.মানুষের মন আজ উন্মাৰ্গগামী, জলে-স্থলে-আকাশে সর্বত্র সে ধৃষ্টতা করিয়া বেড়াইতেছে…আজ সকালে সংবাদপত্রে দেখিলাম একটা এরোপ্লেন চাটগাঁ হইতে কলকাতা আসিতেছিল, বানচাল হইয়া সমুদ্রে ডুবিয়াছে. পাকিস্তান এয়ার লাইনসের প্লেন—একটি লোকও বাঁচে নাই, মৃতদেহের দীর্ঘ ফিরিস্তি বাহির হইয়াছে…আমরা আকাশচারী হইয়া উঠিয়াছি, মাটিতে আর পা পড়ে না…কবি সত্যেন দত্ত এরোপ্লেন সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, ‘উদ্গত-পাখা জাঁদরেল পিপীলিকা’–উপমাটা ভারি চমকপ্রদ।
‘পাৰ্বতীর দাদার নাম জানো?’
তক্তপোশে উঠিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ রামায়ণ রাখিয়া সিগারেট ধরাইতেছে। বলিলাম, ‘পার্বতীর দাদা! কোন পার্বতী?
ব্যোমকেশ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, ‘মহাদেবের পার্বতী, হিমালয়-কন্যা পার্বতী।’
‘ও, বুঝেছি। পার্বতীর দাদা ছিল নাকি?’
‘ছিল।’ ব্যোমকেশ তর্জনি তুলিয়া বক্তৃতার ভঙ্গীতে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘তার নাম মৈনাক পর্বত। সেকালে পাহাড়দের পাখনা ছিল, উড়ে উড়ে বেড়াতো, যখন ইচ্ছে নগর-জনপদ প্রভৃতি লোকালয়ের ওপর গিয়ে বসতো। নগর-জনপদের কী অবস্থা হত বুঝতেই পারছি। দেখে-শুনে দেবরাজ ইন্দ্র চটে গেলেন, বজ্র নিয়ে বেরুলেন। পৃথিবীর যেখানে যত পাহাড় পর্বত আছে, বজ্র দিয়ে সকলের পাখনা পুড়িয়ে দিলেন। কেবল হিমালয়-পুত্র মৈনাক পালানো, সেতুবন্ধ রামেশ্বরে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে রইল। সেই থেকে মৈনাক সমুদ্রের তলায় আছে, মাঝে মাঝে নাক বার করে, আবার ডুব মারে। অনেকটা ফেরারী আসামীর মত অবস্থা।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ইন্দ্র এত বড় দেবতা, তিনি মৈনাককে ধরতে পারলেন না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ইন্দ্র দেবরাজ ছিলেন বটে, কিন্তু সত্যান্বেষী ছিলেন না। তাছাড়া, তিনি প্রচণ্ড মাতাল এবং লম্পট ছিলেন।’
প্রচণ্ড মাতাল এবং লম্পট হওয়া সত্ত্বেও ইন্দ্র দেবতাদের রাজা হইলেন কি করিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় পাশের ঘরে কিড়িং কিড়িং। শব্দে টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। অনেকদিন এমন মধুর আওয়াজ শুনি নাই; মনটা নিমেষে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। নিশ্চয় কেহ বিপদে পড়িয়া ব্যোমকেশের শরণাপন্ন হইয়াছে। ব্যোমকেশ চেয়ার ছাড়িয়া উঠিবার আগেই আমি তড়াক করিয়া গিয়া ফোন ধরিলাম। বিপন্ন শরণার্থীকে দাঁড় করাইয়া রাখা ঠিক নয়।
ফোনে নেংটির গলা শুনিয়া একটু দমিয়া গিয়াছিলাম, তারপর তাহার বাতা শুনিয়া আবার চাঙ্গা হইয়া উঠিলাম। নেংটি বলিল, ‘অজিতবাবু্, শীগগির ব্যোমকেশদাকে নিয়ে আসুন। হেনা মল্লিক মরে গেছে।’
হেন মল্লিক, অর্থাৎ সেই অপূর্ব সুন্দরী যুবতী। উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, ‘মরে গেছে। কী হয়েছিল?’
নেংটি বলিল, ‘তেতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মরে গেছে। পুলিস এসেছে। মেসোমশাই বাড়ি নেই-আজ শনিবার—আপনারা শীগগির আসুন।’
ব্যোমকেশ আসিয়া আমার হাত হইতে টেলিফোন লইল, বলিল, ‘কে, নেংটি! কী হয়েছে?’
সে কিছুক্ষণ ধরিয়া শুনিল, তারপর–’আচ্ছা-দেখি’–বলিয়া টেলিফোন রাখিয়া দিল। আমরা বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। ঘড়িতে তখন সাতটা বাজিয়া পঁয়ত্ৰিশ মিনিট হইয়াছে।
ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া পায়চারি করিতে লাগিল। আমি কিছুক্ষণ তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলাম, যাবে কি না ভাবছ?’
সে বলিল, ‘যাওয়া উচিত কি না ভাবছি। গৃহস্বামী ডাকেননি, হয়তো ব্যাপারটা অপঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়; এ অবস্থায় নেংটির ডাক শুনে যাওয়া উচিত হবে কি?’
আমি বিবেচনা করিয়া বলিলাম, ‘গৃহস্বামী বাড়ি নেই। আর যারা আছে তারা ছেলেমানুষ। বাড়িতে পুলিস এসেছে। নেংটিকে হয়তো তার মাসিম আমাদের কাছে খবর পাঠাতে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধু হিসেবে আমরা যদি যাই, খুব অন্যায় হবে কি?’
ব্যোমকেশ আরো কিছুক্ষণ ভ্রূকুটি করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘তা বটে। চল তবে বেরুনো যাক।’
সন্তোষবাবুর বাড়িতে পৌঁছিলাম সাড়ে আটটা নাগাদ। ফটকের দেউড়িতে কেহ নাই। বাড়িটা অন্ধকারে দেখা গেল না, কেবল বাড়ির বহিভাগে দেওয়ালের গায়ে ভারা বাঁধা হইয়াছে চোখে পড়িল। বোধহয় দেওয়ালির আগে মেরামত ও চুনকামের কাজ চলিতেছে।
বাড়িতে প্রবেশ করিলেই বড় একটি সাজানো হল-ঘর, মাথার উপর চার-পাঁচটা তীব্র বৈদ্যুতিক বালব ঘরটিকে দিনের মত উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে। ঘরের মাঝামাঝি স্থানে একটু নীচু গোল টেবিল, তাহাকে ঘিরিয়া কয়েকটা চেয়ার এবং সোফা। আমরা ঘরে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম সেখানে আট-দশ জন পুরুষ রহিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই ইউনিফর্ম-পরা পুলিস।
আমরা প্রবেশ করিলাম কেহ লক্ষ্য করিল না। একজন ইন্সপেক্টর টেবিলের সামনে বসিয়া নত হইয়া ডায়েরিতে কিছু লিখিতেছিলেন, বাকি সকলে টেবিল ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল; সকলের
তাহাদের মধ্যে নেংটিকে চিনিতে পারিলাম। বাকি তিনজনের মধ্যে একজন যে সেক্রেটারি রবিবর্মা তাহা তাহার মঙ্গোলীয় মুখ দেখিয়া সহজেই বোঝা যায়। অবশিষ্ট দুইজন অল্পবয়স্ক যুবক, সুতরাং নিশ্চয় যুগলচাঁদ ও উদয়চাঁদ। দু’জনের মুখেই শক-খাওয়া জবুথবু ভাব, এখনো প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয় নাই।
আমরা প্রবেশ করিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইলাম। ব্যোমকেশ একবার ঘরের চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল। বাঁ দিকে আসবাব কিছু নাই, কেবল দূরের কোণে উচু টিপয়ের উপর টেলিফোন, মাঝখানে গোল টেবিল ঘিরিয়া কয়েকজন লোক, ডান দিকে প্ৰায় দেওয়ালের কাছে সাদা কাপড়-ঢাকা একটি মূর্তি মেঝোয় পড়িয়া আছে; তাহার ওপারে দ্বিতলে উঠিবার সিঁড়ির নিম্নতম ধাপে দুইটি স্ত্রীলোক ঘেঁষাৰ্ঘেষি হইয়া বসিয়া আছে; নিশ্চয় শ্ৰীমতী চামেলি ও চিংড়ি। তাঁহাদের চোখে অবিমিশ্র বিভীষিকা; তাঁহারা চাদর-ঢাকা মৃতদেহের পানে চাহিতেছেন না, একদৃষ্টি ঘরের মাঝখানে সমবেত মানুষগুলির পানে চাহিয়া আছেন।
ব্যোমকেশও এক নজরে সব দেখিয়া লইয়া সেইদিকেই অগ্রসর হইল, টেবিলের সম্মুখস্থ হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘আরো! এ কে রে!’
ইন্সপেক্টর ডায়েরি হইতে মুখ তুলিলেন; অন্য সকলে ঘাড় ফিরাইয়া চাহিল। ইন্সপেক্টর ডায়েরি বন্ধ করিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশ! তুমি কোত্থেকে?’
ব্যোমকেশ তাঁহার হাতে হাত মিলাইল, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিল না; আমার সহিত পরিচয় করাইয়া দিল। জানিতে পারিলাম, ইহার নাম অতুলকৃষ্ণ রায়, সংক্ষেপে এ কে রে। কলেজে ব্যোমকেশের সহাধ্যায়ী ছিলেন, এখন কলিকাতায় আছেন। আমার সহিত ইতিপূর্বে দেখা না হইলেও ব্যোমকেশের সহিত কলে-ভদ্রে দেখাশোনা হয়। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, খুব আমুদে লোক, কিন্তু কাজের সময় গম্ভীর ও মিতভাষী।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ব্যাপার কি? শুনলাম একটি মেয়ের মৃত্যু হয়েছে!’
‘হ্যাঁ।’ কিছুক্ষণ নত-চক্ষে চিন্তা করিয়া এ কে রে বলিলেন, ‘এস, তোমাকে বলছি।’
আমরা দল হইতে একটু দূরে সরিয়া গিয়া দাঁড়াইলাম, এ কে রে অল্প কথায় ঘটনা বিবৃত করিলেন।–তিনি এখন এই এলাকার থানার দারোগা। আজ সন্ধ্যা সাতটা বাজিতে দশ মিনিটে তিনি টেলিফোনে খবর পান যে, সন্তোষবাবুর বাড়িতে একটি অপঘাত মৃত্যু ঘটিয়াছে; ফোন করিয়াছিলেন। সেক্রেটারি রবিবর্মার্ণ। এ কে রে তৎক্ষণাৎ লোকজন লইয়া উপস্থিত হইলেন। বাড়ির পশ্চিমদিকে, যেদিকে ভারা বাঁধা হয় নাই, সেইদিকে বাড়ির ঠিক ভিতের কাছে মৃত্যু যুবতীর দেহ পাওয়া গিয়াছে। এ কে রে পুলিস ডাক্তারকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন, ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, উচ্চ স্থান হইতে পতনের ফলে ঘাড়ের কশেরু ভাঙিয়া মৃত্যু হইয়াছে, মৃত্যুর কাল অনুমান একঘন্টা আগে, অর্থাৎ সাড়ে ছাঁটার সময়। এ কে রে তখন তিনতলার খোলা ছাদে গিয়া দেখিলেন, ছাদের মাঝখানে একটি ছোট মাদুরের আসন পাতা রহিয়াছে, তার পাশে এক জোড়া মেয়েলি চপ্পল। খবর লইয়া তিনি জানিতে পারিলেন যে, মেয়েটি প্রত্যহ সূৰ্য্যস্তের সময় ছাদে আসিয়া বসিত। সন্দেহ রহিল না যে আজও মেয়েটি ছাদে গিয়াছিল এবং ছাদ হইতে পড়িয়া মরিয়াছে।
বিবৃতি শেষ করিয়া এ কে রে পুনশ্চ প্রশ্ন করিলেন, ‘কিন্তু তোমাকে খবর দিল কে?’
ব্যোমকেশ নেংটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘ওই ছেলেটি। ওর নাম নেংটি দত্ত। ও আমার কাছে যাতায়াত করে। বোধহয় ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে ফোন করেছিল।’
নেংটি কিছু দূরে দাঁড়াইয়া আমাদের দিকেই তাকাইয়াছিল, এ কে রে কিছুক্ষণ তাহাকে নিবিষ্ট চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘হুঁ। তা, তুমি এখন কি করতে চাও?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি আর করব। নেহাৎ পারিবারিক বন্ধু হিসেবেই এসেছি, সত্যান্বেষী হিসেবে নয়। তোমার কী মনে হচ্ছে? অপঘাত মৃত্যু?
এ কে রে বলিলেন, ‘অ্যাকসিডেন্টই মনে হচ্ছে। তবে—’ তিনি বাক্যটি অসমাপ্ত রাখিয়া দিলেন, তাঁহার চোখে একটু হাসির আভাস দেখা দিল।
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল। বলিল, ‘বাড়ির সকলের জবানবন্দী নিয়েছ?’
এ কে রে বলিলেন, ‘হ্যাঁ। কেবল গৃহস্বামীকে এখনো পাইনি। তিনি কোথায় তাও কেউ সুপ্রিয় না। শুনলাম উইক এন্ডএ তিন বাড়ি থাকেন না।‘ আবার তাঁহার চোখের মধ্যে হাসি ফুটিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘জবানবন্দীর নকল তৈরি হলে আমাকে এক কপি দেবে?’
এ কে রে বলিলেন, ‘দেব। কাল বিকেলে পাবে। লাশ দেখতে চাও?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখতে পারি। ক্ষতি কি?’
যেখানে চাদর-ঢাকা মৃতদেহ পড়িয়াছিল। এ কে রে আমাদের সেখানে লইয়া গেলেন, চাদরের খুঁট ধরিয়া চাদর সরাইয়া দিলেন। আত্মজ্জ্বল আলোকে মৃত্যু হেনা মল্লিককে দেখিলাম।
সে রূপসী ছিল বটে, নেংটি মিথ্যা বলে নাই। গায়ের রঙ দুধে আলতা, ঘন সুকৃষ্ণ চুল অবিন্যস্ত হইয়া যেন মুখখানিকে আরো ঘনিষ্ঠ কমনীয় করিয়া তুলিয়াছে, ভুরু দু’টি তুলি দিয়া আকা। চক্ষু অর্ধ-নিমীলিত, গাঢ়-নীল চোখের তারা অর্ধেক দেখা যাইতেছে, দেহে ভরা যৌবনের উচ্ছলিত প্রগলভতা। মৃত্যু তাহার প্রাণটুকুই হরণ করিয়া লইয়াছে, দেহে কোথাও আঘাতচিহ্ন রাখিয়া যায় নাই, যৌবনের লাবণ্য তিলমাত্র চুরি করিতে পারে নাই। এই দেহ দুদিনের মধ্যে পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইবে ভাবিতেও কষ্ট হয়।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া দেখিতেছি, হঠাৎ পিছন দিকে শব্দ শুনিয়া ঘাড় ফিরাইলাম। যুগল ও উদয় আমাদের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। উদয়ের চক্ষু রক্তবর্ণ, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ, সে যুগলের দিকে ফিরিয়া গর্জন করিয়া উঠিল, ‘যুগল, তুই হেনাকে মেরেছিস।’
যুগল আগুন-ভরা চোখ তুলিয়া উদয়ের পানে চাহিল, শীর্ণ কঠিন স্বরে বলিল, ‘আমি—হেনাকে-মেরেছি! মিথ্যেবাদী! তুই মেরেছিস।’
এক মুহুর্ত বিলম্ব হইলে বোধকরি দুই ভাইয়ের মধ্যে শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ বাধিয়া যাইত। কিন্তু সিঁড়ির উপর উপবিষ্ট দু’টি স্ত্রীলোকই তাহা হইতে দিল না। শ্ৰীমতী চামেলি এবং চিংড়ি একসঙ্গে ছুটিয়া আসিয়া তাঁহাদের মাঝখানে দাঁড়াইলেন। চামেলি উদয়ের বুকে দু’হাত রাখিয়া তাহাকে ঠেলিয়া দিতে দিতে তীক্ষ্ণ ভাঙা-ভাঙা গলায় বলিলেন, হতভাগা! এসব কী বলছিস তুই! চলে যা এখান থেকে, নিজের ঘরে যা। হেনাকে কেউ মারেনি, ও নিজে ছাদ থেকে পড়ে মরেছে।’
ওদিকে চিংড়ি যুগলের হাত চাপিয়া ধরিয়া ব্যগ্র-হ্রস্ব কণ্ঠে বলিতেছে, ‘দাদা, দু’টি পায়ে পড়ি, চলে এস, এখানে থেকে না। চল তোমার শোবার ঘরে-লক্ষ্মীটি!’
যুদ্ধ থামিল বটে, কিন্তু দু’জনের কেহই ঘর ছাড়িয়া গেল না, রক্তিম চক্ষে পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
ব্যোমকেশ বা পুলিসের লোকেরা কেহই এই সহসা-স্ফরিত কলহ নিবারণের চেষ্টা করে নাই, সম্পূর্ণ নির্লিপ্তভাবে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল। তাঁহাদের ভাব দেখিয়া মনে হয় তাহারা প্রতীক্ষ্ণ করিতেছে এই ঝগড়ার সূত্রে যদি কোন গুপ্তকথা প্রকাশ হইয়া পড়ে। কিন্তু ঝগড়া যখন অর্ধপথে বন্ধ হইয়া গেল তখন এ কে রে উদয়ের কাছে গিয়া বলিলেন, ‘আপনি এখনি অভিযোগ করলেন যে, আপনার ভাই হেনাকে মেরেছে। এ অভিযোগের কোন ভিত্তি আছে কি?’
উদয় উত্তর দিল না, গোঁজ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শ্ৰীমতী চামেলি তীব্রদূষ্টিতে ইন্সপেক্টরের দিকে চাহিলেন, কিন্তু তিনি কোন কথা বলিবার পূর্বেই হঠাৎ ঘরের আবহাওয়া যেন মন্ত্রবলে পরিবর্তিত হইল।
সদর দরজার সামনে একটি আধাবয়সী ভদ্রলোক আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। মধ্যমাকৃতি মানুষ, একটু ভারী গোছের গড়ন, কিন্তু মোটা নয়; মুখে লালিত্য না থাক, দৃঢ়তা আছে। বেশভূষা একটু শৌখিন ধরনের, গিলেকরা পাঞ্জাবি ও কোঁচানো থান-ধুতির নীচে সাদা চামড়ার বিদ্যাসাগরী চটি। খবরের কাগজে তাঁহার অজস্র ছবি দেখিয়াছি; সুতরাং সন্তোষ সমাদ্দারকে চিনিতে কষ্ট হইল না। কিন্তু ছবিতে যাহা পাই নাই তাহা এখন পাইলাম, লোকটির একটি প্রবল ব্যক্তিত্র আছে, তিনি যেখানে উপস্থিত আছেন সেখানে তিনিই প্রধান, অন্য কেহ সেখানে কলকে পায় না।
তাঁহাকে দেখিয়া শ্ৰীমতী চামেলি বাঙুনিস্পত্তি করিলেন না, দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া উপরে চলিয়া সুন্ন ক্ষক পরে উন্নয়ও উপরে চলিয়া গেল। বাকি সকলে যেমন ছিল তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল।
আমি যখন সন্তোষবাবুকে দেখিলাম তখন তিনি দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া নির্নিমেষ চক্ষে ভূমি-শায়িত মৃতদেহের পানে চাহিয়া আছেন। কোন দিকে লক্ষ্য না করিয়া তিনি মৃতের পায়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। চাহিয়া চাহিয়া তাঁহার মুখের পেশীগুলি কঠিন হইয়া উঠিল, চোখের দৃষ্টি একবার বাষ্পাচ্ছন্ন হইয়া আবার পরিষ্কার হইল। তিনি কাহাকেও সম্বোধন না করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘যাক, বাপ-মা-মেয়ে সবাই অপঘাতে গেল! আশ্চর্য ভবিতব্য।’
আশ্রিতা বন্ধুকন্যার মৃত্যুতে তিনি শোকে অভিভূত হইবেন কেহ প্রত্যাশা করে নাই, তবু তাঁহার এই অটল সংযমের জন্যও প্রস্তুত ছিলাম না; একটু বেশি নীরস ও কঠিন মনে হইল। যাহোক, তিনি মৃতদেহ হইতে চক্ষু তুলিয়া একে একে আমাদের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন।
ব্যোমকেশ একটু অপ্রস্তুতভাবে গলা-ঝাড়া দিয়া বলিল, ‘অনাহূত অতিথি বলতে পারেন। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী, ইনি আমার বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের আপনি চেনেন না, কিন্তু নেংটি—‘
সন্তোষবাবু বলিলেন, না চিনলেও নাম জানি। নেংটি আপনাদের ডেকে এনেছে? তিনি নেংটির দিকে চক্ষু ফিরাইলেন।
নেংটি পিছনে দাঁড়াইয়াছিল, শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল, ‘আমি-মাসিমা খুব ভয় পেয়েছিলেন—’
‘বেশ করেছ তুমি ব্যোমকেশবাবুকে খবর দিয়েছ। বিপদের সময় বন্ধুর কথাই আগে মনে পড়ে।’ তাঁহার কণ্ঠস্বরে প্রসন্নতার আভাস পাওয়া গেল, তিনি ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘নেংটি বুঝি আপনার বন্ধু?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বলতে পারেন।’
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘ভাল ভাল।’ এ কে রে’কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘আপনার কাজ কি শেষ হয়েছে?’
এ কে রে বলিলেন, ‘আর সব কাজই শেষ হয়েছে, লাশ চালান দিয়েই আমরা চলে যাব।’
কথাটা বোধহয় সন্তোষবাবুর মনে আসে নাই, তিনি থমকিয়া বলিলেন, ‘ঠিক তো। পোস্ট-মর্টেম করতে হবে।’ তিনি একবার চকিতের জন্য মৃতদেহের পানে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিলেন, ‘আমার কিছু বলবার নেই, আপনার যা কর্তব্য তাই করুন।’
তিনি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াইলে এ কে রে বলিলেন, ‘যদি আপত্তি না থাকে, আপনাকে দুচারটে প্রশ্ন করতে চাই।’
সন্তোষবাবু থামিয়া গিয়া বলিলেন, ‘আপত্তি কিসের? আপনারা বসুন, আমি এখনি আসছি। রবি, এঁদের খাবার-ঘরে বসাও। আর চিংড়ি, তুমি এঁদের জন্যে চা-জলখাবারের ব্যবস্থা কর।’
তিনি উপরে চলিয়া গেলেন। রবিবামী সামনে আসিয়া বলিল, ‘আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।’
এ কে রে একজন অফিসারকে মৃতদেহের কাছে দাঁড় করাইয়া রবিবর্মার অনুসরণ করিলেন, আমরাও তাঁহার সঙ্গে চলিলাম।
পাঠকের সুবিধার জন্য এইখানে বাড়ির একটি প্ল্যান দেওয়া হইল।
সন্তোষবাবুর ভোজন-কক্ষটি বেশ বড়, লম্বা টেবিলে বারো-চৌদ্দ জন একসঙ্গে বসিয়া আহার করিতে পারে। আমরা গিয়া চেয়ারগুলিতে উপবিষ্ট হইলাম। লক্ষ্য করিলাম, যুগলচাঁদ, নেংটি ও চিংড়ি আমাদের সঙ্গে আসে নাই। রবিবর্মা বসিল না, কর্তার আগমনের প্রতীক্ষ্ণয় দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল।
এ কে রে’র পাশের চেয়ারে ব্যোমকেশ বসিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, ‘হেন মল্লিকের ঘরটা দেখেছি নাকি?’
এ কে রে বলিলেন, ‘মোটামুটি দেখেছি! অতি সাধারণ একটা শোবার ঘর। আসবাবপত্রও বেশি কিছু নেই।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চিঠিপত্র?’
এ কে রে বলিলেন, ‘এখনও ভাল করে দেখা হয়নি। যাবার আগে আর একবার দেখে যাব। তুমি দেখবে?
‘দেখব।’
এই সময় যে অফিসারটি লাশ পাহারা দিতেছিল, সে আসিয়া এ কে রোর কানের কাছে খাটো গলায় বলিল, ‘ভ্যান এসেছে, লাশ রওনা করে দেব?
এ কে রে বলিলেন, ‘দাও।’
অফিসার চলিয়া গেল। আমরা নিস্তব্ধ বসিয়া রহিলাম। খোলা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রবিবর্মা হল-ঘরের দিকে অপলক চাহিয়া ছিল, আমরা তাহার চক্ষু দিয়াই যেন মৃতদেহ স্থানান্তরণের কার্যটা দেখিতে পাইলাম। ক্ষণেকের জন্য তাহারা মঙ্গোলীয় চোখে একটা ক্ষুধিত অতৃপ্ত লালসা দেখা দিয়াই মিলাইয়া গেল। এই পলিকের দৃষ্টি জানাইয়া দিয়া গেল, সেক্রেটারি রবিবর্মার মন হেনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ছিল না।