Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মণিমণ্ডন – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

মণিমণ্ডন – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

প্রসিদ্ধ মণিকার রসময় সরকারের বাড়ি হইতে একটি বহুমূল্য জড়োয়ার নেকলেস চুরি গিয়াছে। সকালবেলা খবরের কাগজ পড়িবার সময় বিলম্বিত সংবাদের স্তম্ভে খবরটা দেখিয়াছিলাম। বেলা আন্দাজ আটটার সময় টেলিফোন আসিল।

অপরিচিত ব্যগ্র কণ্ঠস্বর‌, ‘হ্যালো। ব্যোমকেশবাবু?’

বলিলাম‌, ‘না‌, আমি অজিত। আপনি কে?’

টেলিফোন বলিল‌, ‘আমার নাম রসময় সরকার। ব্যোমকেশবাবুকে একবার ডেকে দেবেন?’

নাম শুনিয়া বুঝিতে বাকি রহিল না যে‌, চোর ধরিবার জন্য ব্যোমকেশের ডাক আসিয়াছে। বলিলাম‌, ‘সে বাথরুমে গিয়েছে‌, বেরুতে দেরি হবে। কাগজে দেখলাম। আপনার দোকান থেকে নেকলেস চুরি গেছে।’

উত্তর হইল‌, ‘দোকান থেকে নয়‌, বাড়ি থেকে।–আপনি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়‌, ব্যোমকেশবাবুর বন্ধু?’

বলিলাম‌, হ্যাঁ। ব্যোমকেশকে যা বলতে চান‌, আমাকে বলতে পারেন।’

ক্ষণেক নীরব থাকিয়া রসময় বলিলেন‌, ‘দেখুন‌, যে নেকলেসটা চুরি গেছে‌, তার দাম সাতান্ন হাজার টাকা। সন্দেহ হচ্ছে বাড়ির একটা চাকর চুরি করেছে‌, কিন্তু কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিসে অবশ্য খবর দিয়েছি‌, কিন্তু আমি ব্যোমকেশবাবুকে চাই। তিনি ছাড়া নেকলেস কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।’

বলিলাম‌, ‘বেশ তো‌, আপনি আসুন না। আপনি আসতে আসতে ব্যোমকেশও বাথরুম থেকে বেরুবে।’

রসময় একটু কাতরভাবে বলিলেন, ‘দেখুন, আমি বেতো রুগী, বেশি নড়াচড়া করতে পারি না। তার চেয়ে যদি আপনারা আসেন তো বড় ভাল হয়।’

যাহারা বিপদে পড়ে তাহারাই ব্যোমকেশের কাছে আসে‌, সে আগে কাহারও কাছে যায় না। আমি বলিলাম‌, ‘বেশ‌, ব্যোমকেশকে বলব।’

রসময়ের মিনতি আরও নির্বন্ধপূর্ণ হইয়া উঠিল‌, ‘না না‌, বলাবলি নয়‌, নিশ্চয় আসবেন। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি‌, আপনাদের কোনও অসুবিধা হবে না।’

‘বেশ।’

‘ধন্যবাদ‌, ধন্যবাদ। এখনি গাড়ি পাঠাচ্ছি।’

মিনিট কয়েক পর একটি ক্যাডিলাক গাড়ি আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ বাথরুম হইতে বাহির হইলে সকল কথা বলিলাম এবং জানোলা দিয়া গাড়ি দেখাইলাম। দেখিয়া শুনিয়া সে আপত্তি করিল না। আমরা ক্যাডিলাকে চড়িয়া যাত্ৰা করিলাম।

কলিকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে রসময় সরকারের গোটা পাঁচেক সোনাদোনা হীরা-জহরতের দোকান আছে‌, কিন্তু তাঁর বসতবাড়ি বৌবাজারে। অল্পকাল মধ্যে গাড়ি তাঁহার দ্বারে গিয়া দাঁড়াইল।

রসময় সরকারের বাড়িটি সাবেক ধরনের‌, একেবারে ফুটপাথের কিনারা হইতে তিনতলা উঠিয়া গিয়াছে। মাঝখানে উপরিতলায় উঠিবার দ্বারমুক্ত সিঁড়ি‌, দুই পাশে দোকানের সারি। গৃহস্বামী উপরের দুইতলা লইয়া থাকেন।

সিঁড়ির দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল‌, গাড়ি গিয়া থামিতেই দ্বার খুলিয়া একটি যুবক বাহির হইয়া আসিল। শৌখিন সুদৰ্শন চেহারা‌, বয়স সাতাশ আটাশ! নমস্কার করিয়া বলিল‌, ‘আমার নাম মণিময় সরকার। বাবা ওপরে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আসুন।’ .

আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিলাম। দ্বিতলে আছে রান্নাঘর‌, ভাঁড়ার ঘর‌, চাকরদের থাকিবার স্থান এবং তক্তপোশাপাতা একটি বসিবার ঘর। আমরা দ্বিতল ছাড়াইয়া ত্রিতলে উঠিয়া গেলাম। এই ত্রিতলে গৃহস্বামী সপরিবারে বাস করেন।

তৃতীয় তলে উঠিলে গৃহস্বামীর বিত্তবত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বিলাতি তালা লাগানো ভারী দরজায় রেশমী পর্দা, মেঝেয় পুরু গালিচা; ড্রইংরুমটি দামী আসবাব দিয়া সাজানো, গদি-মোড়া দেয়ালে পারসিক ছবি-আঁকা ট্যাপেস্ট্রি ইত্যাদি। উপস্থিত ঘরটি একটু অবিন্যস্ত। মণিময় আমাদের ঘরে লইয়া গিয়া বলিল‌, ‘বাবা‌, ব্যোমকেশবাবু এসেছেন।’

দেখিলাম রসময় সরকার একটি চেয়ারে বসিয়া ডান পা সম্মুখদিকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছেন এবং একটি বিবাহিতা যুবতী তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার আঙ্গুলে সেঁক দিতেছে। রসময়বাবুর বয়স অনুমান পঞ্চাশ‌, ভারী গড়নের শরীর‌, মাংসল মুখ এখনও বেশ দৃঢ় আছে। আমাদের দেখিয়া তিনি তাড়াতাড়ি উঠবার চেষ্টা করিয়া আবার বসিয়া পড়িলেন‌, আমার ও ব্যোমকেশের পানে পর্যায়ক্রমে চক্ষু ফিরাইয়া দুই করতল যুক্ত করিয়া ব্যোমকেশকে বলিলেন‌, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু। আমি সব দিক দিয়েই বড় কাবু হয়ে পড়েছি। আপনি-আপনারা এসেছেন‌, আমি বাঁচলাম। বসুন‌, বসুন অজিতবাবু।’

আমাদের মধ্যে কে ব্যোমকেশ তাহা প্রশ্ন না করিয়াও তিনি বুঝিয়াছেন। রসময় সরকার বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি তাহাতে সন্দেহ নাই।

আমরা সোফায় পাশাপাশি বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পায়ে বাত ধরেছে দেখছি। বাত রোগটা মারাত্মক নয়‌, কিন্তু বড় কষ্টদায়ক।’

রসময় বলিলেন‌, ‘আর বলবেন না। আমার শরীর বেশ ভালই‌, কিন্তু এই বাতে আমাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। ছেলেবেলায় ফুটবল খেলতাম‌, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা ভেঙে গিয়েছিল। এখন এমন দাঁড়িয়েছে‌, আকাশের এক কোণে রুমালের মত একটি টুকরো মেঘ উঠলে বুড়ো আঙুলে চিড়িক মারতে থাকে।–কিন্তু সে যাক‌, বৌমা এঁদের জন্যে চা নিয়ে এস।’

বধূটি এতক্ষণ হেঁট মুখে বসিয়া শ্বশুরের পায়ে সেঁক দিতেছিল। সুন্দরী মেয়ে‌, কিন্তু তাঁহার মুখে পারিবারিক বিপদের ছায়া পড়িয়াছে। সে উঠিবার উপক্রম করিতেই ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না না‌, চায়ের দরকার নেই‌, আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি। উনি শ্বশুরের পদসেবা করছেন করুন।’

রসময় একটু হাসিলেন‌, বধূ আবার বসিয়া পড়িল। রসময় বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, তবে থাক। মণি‌, সিগারেট নিয়ে এস।’

মণিময় এতক্ষণ একটা চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া ছিল‌, সে চলিয়া গেলে রসময় বধূর পানে সস্নেহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন‌, ‘বড় লক্ষ্মী বৌমা আমার। গিন্নী ছোট ছেলেকে নিয়ে তীর্থদর্শনে বেরিয়েছেন‌, এখন ওর হাতেই সংসার। অবশ্য ওকে দিয়ে পদেসেবা আমি করাই না‌, কিন্তু চাকরটা–’

এই বলিয়া রসময় থামিয়া গেলেন, তারপর গলার স্বর পাল্টাইয়া বলিলেন, ‘বাজে কথা থাক‌, কাজের কথা বলি। আপনি অনুগ্রহ করে এসেছেন‌, আপনার অমূল্য সময় নষ্ট করব না। ব্যোমকেশবাবু্‌, কাল রাত্রে আমার বাড়িতে অঘটন ঘটে গেছে‌, যা কখনও হয়নি তাই হয়েছে। একটা হীরের নেকলেস—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সব গোড়া থেকে বলুন। সংক্ষেপ করবেন না। মনে করুন আমি কিছু জানি না।’

মণিময় একটি ৫৫৫ মার্কা সিগারেটের টিন ঢাকনি ঘুরাইয়া খুলিতে খুলিতে ঘরে প্রবেশ করিল‌, টিন আমাদের সম্মুখে রাখিয়া জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। আমরা সিগারেট ধরাইলাম।

রসময় বলিতে আরম্ভ করিলেন—

‘কলকাতা শহরে আমার পাঁচটা জুয়েলারির দোকান আছে। বড় কারবার‌, বছরে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকার কেনা-বেচা। অনেক বিশ্বাসী প্রবীণ কর্মচারী আছেন। আমার যখন শরীর ভাল থাকে। আমি দেখাশোনা করি। দু’বছর থেকে মণিও যাতায়াত শুরু করেছে।

‘কলকাতার বাইরে, ভারতবর্ষের সর্বত্র আমাদের কাজ কারবার আছে। বোম্বাই মাদ্রাজ নয়াদিল্লী, যেখানে যত বড় জহুরী‌, সকলের সঙ্গে আমাদের লেন-দেন। কখনও আমাদের কাছ থেকে তারা হীরে জহরত কেনে‌, কখনও আমরা তাদের কাছ থেকে কিনি। জহুরী ছাড়া সাধারণ খরিদ্দার তো আছেই। রাজারাজড়া থেকে ছাপোষা গৃহস্থ, সবই আমাদের খদ্দের।

‘মাসখানেক আগে দিল্লী থেকে রামদাস চোকসী নামে একজন বড় জহুরী আমার কাছে এল। রাজস্থানের কোন রাজবাড়িতে মেয়ের বিয়ে‌, দশ লাখ টাকার গয়নার ফরমাশ পেয়েছে। কিন্তু সব গয়না সে নিজে গড়তে পারবে না‌, আমাকে দিয়ে একটা হীরের নেকলেস গড়িয়ে নিতে চায়। ডিজাইন দেখে‌, হীরে বাছাই করে দাম কষা হল। সাতান্ন হাজার টাকা। এক মাসের মধ্যে গয়না গড়ে দিল্লীতে রামদাসের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

‘গয়না তৈরি হল। আমার ইচ্ছে ছিল আমি নিজেই গিয়ে গয়নাটা দিল্লীতে পৌঁছে দিয়ে আসব‌, কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে আমার বাতের ব্যথা চাগাড় দিল। কী উপায়! অত দামী গয়না। কর্মচারীদের হাতে পাঠাতে সাহস হয় না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল মণিময় যাবে আমার বদলে। আজ ওরা যাবার কথা।

‘আমি এ ক’দিন বাড়ি থেকে বেরুতে পারিনি‌, মণিই কাজকর্ম দেখছে। নেকলেসটা তৈরি হবার পর বড় দোকানের সিন্দুকে রাখা ছিল‌, কাল বিকেলবেলা মণি সেটা বাড়িতে নিয়ে এল।

‘এখন আমার বাড়ির কথা বলি। আমার স্ত্রী ছোট ছেলে হিরন্ময়কে নিয়ে তীর্থ করতে বেরিয়েছেন‌, অর্থাৎ দক্ষিণাত্য বেড়াতে গেছেন। বাড়িতে আছি আমি‌, মণিময় আর বৌমা। দোতলায় থাকে দু’জন চাকর, বামুন, ড্রাইভার, আর আমার খাস চাকর ভোলা। এই ক’জন নিয়ে বর্তমানে আমার সংসার।

‘কাল বিকেলে মণি যখন নিকলেস নিয়ে বাড়ি এল, আমি তখন এই চেয়ারে বসে ছিলাম, আমার খাস চাকর ভোলা পায়ে মালিশ করে দিচ্ছিল। মণি নেকলেসের কেস্‌ আমার হাতে দিয়ে বলল‌, ‘এই নাও বাবা।’

‘আমি ভোলাকে ছুটি দিলাম‌, সে চলে গেল। তখন আমি কেস খুলে গয়নাটা পরীক্ষা করলাম। সব ঠিক আছে। তারপর বৌমাকে ডেকে বললাম‌, ‘বৌমা‌, কাপড় দিয়ে এটাকে বেশ ভাল করে সেলাই করে দাও।’ বৌমা এক টুকরো কাপড় এনে এখানে বসে বসে ছুঁচ-সুতো দিয়ে সেলাই করে দিলেন।’

ব্যোমকেশ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়া শুনিতেছিল‌, এখন মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘মাফ করবেন‌, গয়নার বাক্সটা আকারে আয়তনে কত বড়?’

রসময়বাবু দ্বিধাভরে এদিক ওদিক চাহিয়া বলিলেন‌, ‘কত বড়? মোটেই বড় নয়। এই ধরুন—’

পিতা ইতস্তত করিতেছেন দেখিয়া মণিময় বইয়ের শেলফ হইতে একটি বই আনিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিল‌, বলিল‌, ‘এই সাইজের বাক্স।’

রসময় বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, ঠিক ওই সাইজের। অবশ্য বাক্সটা কুমিরের চামড়ার‌, তার ভেতরে মখমলের খাঁজ-কাটা ঘর।’

বইখানা ষোলপেজী ক্রাউন সাইজের‌, পৃষ্ঠা-সংখ্যা আন্দাজ তিনশত। ব্যোমকেশ বইখানা মণিময়কে ফিরাইয়া দিয়া বলিল‌, ‘বুঝেছি‌, তারপর বলুন।’

রসময় আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন—

‘তারপর মণি চা খেয়ে ক্লাবে চলে গেল। আমি গয়নার কেসটা হাতে করে আবার অফিস-ঘরে গেলাম। পাশেই আমার অফিস-ঘর। বাড়িতে বসে কাজকর্ম করার দরকার হলে ওখানে বসেই করি। একটা সেক্রেটারিয়েটু টেবিল আছে‌, তার দেরাজ্যে দরকারী কাগজপত্র থাকে। আমি গয়নার কেস দেরাজে রেখে দিলাম। বাড়িতে একটা লোহার সিন্দুক আছে বটে‌, কিন্তু গিন্নী তার চাবি নিয়ে চলে গেছেন।

‘আমার অন্যায় হয়েছিল‌, অত বেশি দামী জিনিস খোলা–দেরাজে রাখা উচিত হয়নি। কিন্তু আমার বাড়ির যে-রকম ব্যবস্থা‌, তাতে আশঙ্কার কোনও কারণ ছিল না। চাকর-বাকির দোতলায় থাকে‌, ডেকে না পাঠালে ওপরে আসে না; অন্য লোকেরও যাতায়াত নেই। তাই এখান থেকে গয়না চুরি যেতে পারে। এ-সম্ভাবনা মনেই আসেনি।

‘রাত্ৰি আন্দাজ ন’টার সময় আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য দোতলায়‌, কিন্তু এই বাতের ব্যথাটা হয়ে অবধি বৌমা ওপরেই আমার খাবার এনে দেন। খাওয়া সেরে আমি একটা বই নিয়ে বসলাম‌, বৌমাও খেয়ে নিলেন। মণির ক্লাব থেকে ফিরতে প্রায়ই দেরি হয়‌, তাই তার খাবার বৌমা শোবার ঘরে ঢাকা দিয়ে রাখলেন।

‘দশটার সময় আমি ভোলাকে ডাকবার জন্যে ঘণ্টি বাজালাম‌, তারপর শুতে গেলাম। আমার বেতো শরীর‌, শোবার পর হাত-পা টিপে না দিলে ঘুম আসে না। ভোলাই রোজ টিপে দেয়‌, তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লে চলে যায়।

‘ভোলা খুব কাজের চাকর। বছর দেড়েক আমার কাছে আছে; জুতো বুরুশ করা‌, কাপড়-জামা গিলে করা‌, ফাই-ফরমাশ খাটা‌, হাত-পা টেপা‌, সব কাজ ও করে। কাল বৌমা সদর দোর খুলে দিলেন‌, ভোলা এসে আমার হাত-পা টিপে দিতে লাগল। আমি ক্রমে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর সে কখন চলে গেছে জানতে পারিনি।

‘হঠাৎ ঘুম ভাঙল মণির ডাকে। ও আমার বিছানার ওপর ঝুকে ডাকছে‌, ‘বাবা! বাবা? আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বললাম‌, ‘কী রে? মণি বলল‌, ‘নেকলেসটা কোথায় রেখেছেন?’ আমি বললাম‌, ‘টেবিলের দেরাজে। কেন?’ ও বলল‌, ‘কই‌, সেখানে তো নেই।’

‘আমি ছুটে গিয়ে দেরাজ খুললাম। নেকলেসের বাক্স নেই। সব দেরাজ হাঁটকালাম। কোথাও নেই। মনের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। মণিকে জিজ্ঞেস করলাম‌, ‘তুই এত রাত্রে কী করে জানলি?’ সে বলল–’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া রসময়কে নিবারণ করিল‌, মণিময়ের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘রাত্রি তখন ক’টা?’

মণিময় অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিল‌, ‘প্রায় বারটা। বারটা বাজতে পাঁচ মিনিট কি দশ মিনিট হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘রাত বারটার সময় কোনও কারণে আপনার সন্দেহ হয়েছিল যে‌, নেকলেস চুরি গেছে। কী করে সন্দেহ হল সব কথা খুলে বলুন।’

মণিময় যেন আরও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল‌, পিতার প্রতি একটি গুপ্ত কটাক্ষপাত করিয়া ঈষৎ স্বলিত স্বরে বলিতে আরম্ভ করিল‌, ‘কাল আমার ক্লাব থেকে ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাবে ব্রিজ-ড্রাইভ চলছে‌, আমি-’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কোথায় ক্লাব? নাম কী?’

‘ক্লাবের নাম-খেলাধুলো। খুব কাছেই‌, আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। সব রকম ঘরোয়া খেলার ব্যবস্থা আছে‌, তাস পাশা পিংপং বিলিয়ার্ড। কাল ব্রিজ-ড্রাইভ শেষ হতে রাত হয়ে গেল–’

‘আপনি হেঁটে ক্লাবে যান?’

‘আজেজ্ঞ হ্যাঁ‌, খুব কাছে‌, তাই হেঁটেই যাই। কাল যখন ক্লাব থেকে বেরুলাম তখন পোনে বারটা। রাত নিযুতি। আমাদের বাড়ির সদর দরজার ঠিক সামনে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। আমি যখন বাড়ির প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ গজের মধ্যে এসেছি তখন দেখলাম‌, আশেপাশের দোকান সব বন্ধ হয়ে গেছে‌, কিন্তু একটা লোক ঠিক আমাদের দোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বোধ হয় আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল‌, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল‌, তারপর চট্ট করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

‘দূর থেকে দেখে মনে হল‌, ভোলা চাকর। কাছে এসে দেখলাম দরজা ভেজানো রয়েছে। অন্যদিন আমি দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরি‌, কিন্তু সদর দরজা তার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। আজ খোলা রয়েছে। আমার খটকা লাগল। সদর দরজায় হুড়কো লাগিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। দোতলায় চাকরেরা ঘুমোচ্ছে‌, কারুর সাড়া শব্দ নেই।

‘তোতলায় উঠতেই স্ত্রী এসে দরজা খুলে দিলেন। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেছেন‌, তেতলার দরজায় বিলাতি গা-তালা লাগানো; ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলে বিনা চাবিতে বাইরে থেকে খোলা যায় না। আমি স্ত্রীকে বললাম‌, বাড়ির সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। উনি বললেন‌, উনিও দেখেছেন—’

‘উনিও দেখেছেন?’ ব্যোমকেশ বধূর পানে চোখ ফিরাইল।

বধূ লজ্জা পাইল‌, তাহার মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। রসময় তাহাকে উৎসাহ দিয়া বলিলেন‌, ‘লজ্জা কী বোমা? যা দেখেছ ব্যোমকেশকে বল।’

বধূ তখন লজ-স্তিমিত কণ্ঠে থামিয়া থামিয়া বলিল‌, ‘কাল রাত্তিরে—আমি—ওঁর ক্লাব থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছিল—আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলুম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর—হঠাৎ দেখলুম‌, ঠিক আমাদের দরজার সামনে ফুটপাথের ওপর কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি বুকে দেখবার চেষ্টা করলুম‌, কিন্তু ভাল দেখতে পেলুম না। তারপরেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হল দরজায় ঢুকে পড়ল। সেই সময় দেখতে পেলুম উনি আসছেন‌, লোকটা যেন ওঁকে দেখেই ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর আমি গিয়ে তেতলার দরজা খুলে দিলুম। উনি এলেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘লোকটাকে চিনতে পেরেছিলেন?’

বধূ মাথা নাড়িল‌, ‘না‌, ওপর থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তবে মনে হয়েছিল‌, চাকরদের মধ্যেই কেউ হবে।’

‘হুঁ, ব্যোমকেশ মণিময়কে বলিল‌, ‘তারপর কী হল?’

মণিময় বলিল‌, ‘স্ত্রীর কথা শুনে সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। নেকলেসটা বিকেলবেলা এনেছি‌, সেটা বাবা নিশ্চয় টেবিলের দেরাজে রেখেছেন‌, কারণ সিন্দুকের চাবি নিয়ে মা চলে গেছেন। আমি চুপি চুপি বাবার অফিস-ঘরে গেলাম। আলো জ্বেলে দেরাজগুলো খুলে দেখলাম। নেকলেসের কেস নেই। আরও যেখানে যেখানে রাখা সম্ভব সব জায়গায় খুঁজলাম। কোথাও নেই। ভীষণ ভয় হল। তখন বাবাকে ডেকে তুললাম।’

মণিময় চুপ করিলে ব্যোমকেশ নিবিষ্ট মনে আর একটি সিগারেট ধরাইল‌, তারপর সপ্রশ্ন চক্ষে রসময়ের পানে চাহিল। রসময় আবার কাহিনীর সূত্র তুলিয়া লইলেন–

‘যখন নিঃসংশয়ে বুঝলাম নেকলেস চুরি গেছে তখন সব সন্দেহ পড়ল ভোলার ওপর। ভেবে দেখুন‌, আমার তেতলার সদর দরজায় ইয়েল লক লাগানো; ভেতর থেকে বাইরে যাওয়া সহজ‌, কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরে আসা সহজ নয়। রাত্রি দশটার পর চাকরীদের মধ্যে একমাত্র ভোলাই ভেতরে ছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম‌, ভোলা কখন উঠে গেছে জানি না। হয়তো সে পৌঁনে বারটার সময় উঠে গেছে‌, দেরাজ থেকে নেকলেস নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে হয়তো তার ষাড়ের লোক ছিল-‘

ব্যোমকেশ মণিময়কে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনি একটা লোকই দেখেছিলেন?’

মণিময় বলিল‌, ‘হ্যাঁ। দ্বিতীয় জনপ্ৰাণী সেখানে ছিল না।’

ব্যোমকেশ বধূর দিকে ফিরিয়া বলিল‌, ‘আপনি?’

বধূ বলিল‌, ‘আমিও একজনকেই দেখেছিলুম। আমি সারাক্ষণ নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলুম‌, আর কেউ থাকলে দেখতে পেতুম।’

ব্যোমকেশ কিয়াৎকাল সিগারেট টানিল‌, শেষে রসময়কে বলিল‌, ‘তারপর আপনি কী করলেন?’

রসময় বলিলেন‌, তখন বারটা বেজে গেছে। বাপ-বেটীয় পরামর্শ করে থানায় টেলিফোন করলাম। মণি নিচে নেমে গিয়ে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল‌, যাতে বাড়ি থেকে কেউ বেরুতে না পারে। থানার বড় দারোগা অমরেশবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে‌, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। ভাগ্যক্রমে তিনি থানায় উপস্থিত ছিলেন‌, ফোন পেয়ে তক্ষুনি তিন-চারজন লোক নিয়ে এসে পড়লেন।

‘প্রথমে দোতলার ঘরগুলো খানাতল্লাশ হল। চাকরেরা সকলেই ঘুমোচ্ছিল ভোলাও ছিল। পুলিস তন্নতন্ন করে তল্লাশ করল‌, কিন্তু নেকলেস পাওয়া গেল না।

‘অমরেশবাবু তখন তেতলা খানাতল্লাশ করলেন। বলা যায় না‌, চোর হয়তো নেকলেস চুরি করে এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। পরে তাক বুঝে সরাবে। কিন্তু এখানেও নেকলেস পাওয়া গেল না।

‘অমরেশবাবু তারপর ভোলাকে জেরা আরম্ভ করলেন। ভোলা স্বীকার করল‌, সে নিচে নেমে গিয়েছিল। সে বলল‌, আন্দাজ এগারটার সময় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি দেখে সে দোতলায় নেমে যায়। অন্য চাকরেরা তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোলাও শুয়ে পড়ল‌, কিন্তু তার ঘুম এল না। তখন সে খোলা হাওয়ার খোঁজে নিচে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়াল। মণিময় যে ক্লাব থেকে ফেরেনি তা সে জানত না। সে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল মণি আসছে। তখন সে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ল কারণ রাত্তিরে চাকর-বাকরের বাইরে যাওয়ার কড়া বারণ আছে। এই তার বয়ান। নেকলেসের কথা সে জানে না।

‘অমরেশবাবুর জেরায় আরও জানা গেল‌, ভোলার দুই ভাই কলকাতায় থাকে‌, মেছুয়াবাজারে তাদের বাসা। ভায়েদের সঙ্গে ভোলার বিশেষ দহরম-মহরম নেই‌, তবে হাতে কাজ না থাকলে মাঝে মাঝে তাদের বাসায় দেখা করতে যায়।

‘অমরেশবাবু যতক্ষণ ভোলাকে সওয়াল জবাব করছিলেন ততক্ষণ তাঁর সঙ্গীরা রাস্তার দু’ পাশে তল্লাশ করছিল; আনোচ কানাচ ডাস্টবিন সব খুঁজে দেখছিল। মণিও তাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। এইসব ব্যাপারে ভোর হয়ে গেল‌, অমরেশবাবু দোতলায় একজন লোক রেখে চলে গেলেন। ভোলাকে বলে গেলেন‌, এ-বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা করলেই গ্রেপ্তার করা হবে।

‘তারপর–তারপর যত বেলা বাড়তে লাগল ততাই আমার মন অস্থির হয়ে উঠল। অমরেশবাবু কাজের লোক‌, চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। কিন্তু আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না ব্যোমকেশবাবু। আপনাকে ফোন করলাম। আপনি আমার নেকলেস উদ্ধার করে দিন। আপনি ছাড়া এ-কাজ আর কেউ পারবে না।’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল‌, ‘আমার ওপর আপনার এত বিশ্বাস‌, আশা করি বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারব! —ভোলা চাকর তো বাড়িতেই আছে?’

‘হ্যাঁ‌, দোতলার ঘরে আছে।’

‘তাকে একবার ডেকে পাঠালে দু-চারটে প্রশ্ন করে দেখতাম।’

‘বেশ তো।’ রসময় পুত্রের দিকে চাহিলেন।

মণিময় চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে ভোলাকে লইয়া ফিরিয়া আসিল।

ভোলা চাকরের চেহারা সাধারণ ভৃত্য শ্রেণীর লোকের চেহারা হইতে পৃথক নয়। একজাতীয় মুখ আছে যাহা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীর্ণ ও অস্থিসার হইয়া পড়ে‌, উচু নাক ও ছুচলো চিবুক প্রাধান্য লাভ করে। ভোলার মুখ সেই জাতীয়। দেহও বেউড় বাঁশের মত পাকানো; বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তাহার চোখের দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্ন নাই‌, কিন্তু সংযত সতর্কতা আছে।

ব্যোমকেশ তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘তোমাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

ভোলা সহজভাবে বলিল‌, ‘আজ্ঞে।’

‘নাম কী?’

‘ভোলানাথ দাস।’

‘দেশ কোথায়?

‘মেদিনীপুর জেলায়।’

‘কলকাতায় কতদিন আছ?’

‘তা পনর বছর হবে।’

‘তোমার দুই ভাই কলকাতায় থাকে?’

‘আজোব হ্যাঁ‌, মেছোবাজারে বাসা নিয়ে একসঙ্গে থাকে।’

‘তুমি ভায়েদের সঙ্গে থাক না?’

‘আজ্ঞে‌, আমি যেখানে চাকরি করি সেখানেই থাকি।’

‘ভায়েদের সঙ্গে বনিবনাও আছে?’

‘আজ্ঞে‌, বে-বনিবনাও নেই। তবে দাদারা লেখাপড়া জানা লোক। আমি মুখখু

‘তোমার দাদারা কী কাজ করে?’

‘বড়দা পোস্ট-অফিসে কাজ করে‌, মেজদা কপোরেশনের জমাদার।’

‘তুমি বিয়ে করনি?’

‘করেছিলাম‌, বৌ মরে গেছে।’

‘এ-বাড়িতে কতদিন কাজ করছি?’

‘দেড় বছর।’

‘তার আগে কোথায় কাজ করেছ?’

‘অনেক জায়গায় কাজ করেছি।’

‘কী কাজ?

‘আজেরি‌, পা-টেপ চাকরের কাজ। অন্য কাজ করবার বিদ্যে আমার নেই।’

বিদ্যা না থাক‌, বুদ্ধি যথেষ্ট আছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। যে-বুদ্ধি নিজেকে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারে‌, সেই বুদ্ধি। ব্যোমকেশ আবার আরম্ভ করিল‌, ‘সকলে সন্দেহ করেন তুমিই হীরের নেকলেস চুরি করেছ।’

‘কাল যখন মণিময়বাবু নেকলেসের বাক্স এনে রসময়বাবুকে দেন‌, তখন তুমি তাঁর পায়ে মালিশ করে দিচ্ছিলে।’

‘একটা বাক্স এনে দিয়েছিলেন। বাক্সে কী আছে আমি জানতাম না।’

‘কিছু আন্দাজ করতে পারনি? রসময়বাবু যখন বাক্স খোলবার আগে তোমাকে চলে যেতে বললেন তখনও কিছু আন্দাজ করনি?’

‘আজ্ঞে না।’

ব্যোমকেশ ক্ষণেক ভ্রূকুটি করিয়া নীরব রহিল‌, তারপর সহসা চক্ষু তুলিয়া বলিল‌, ‘কাল সন্ধ্যের পর তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে?’

এতক্ষণে ভোলার চোখে একটু উদ্বেগের চিহ্ন দেখা দিল‌, কিন্তু সে সহজ সুরেই বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, বেরিয়েছিলাম। একটা গামছা কেনবার ছিল‌, তাই বৌদিদির কাছে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছিলাম।’

ব্যোমকেশ বধূর দিকে চাহিল‌, বধূ ঘাড় হেলাইয়া সায় দিল। রসময়বাবুর মুখ দেখিয়া মনে হইল‌, তিনি এ-খবর জানিতেন না। মণিময়ও জানিত না‌, কারণ সে তৎপূর্বেই ক্লাবে চলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু ব্যোমকেশ জানিল কী করিয়া? অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়িয়াছে?

সে ভোলাকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কতক্ষণ বাইরে ছিলে?’

‘ঘণ্টাখানেক।’

‘গামছা কিনতে এক ঘণ্টা লাগল?’

‘আজ্ঞে‌, গামছা কিনে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।’

‘কারুর সঙ্গে দেখা করনি?’

‘আজ্ঞে‌, না।’

‘তোমার বন্ধুবান্ধব কেউ নেই?

‘চেনাশোনা দু-চারজন আছে‌, বন্ধু নেই।’

‘যাক।–কাল রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তুমি রসময়বাবুর পা টিপে দিয়েছিলে?’

‘আজ্ঞে। রোজ টিপে দিই।’

‘কাল ক’টা অবধি পা টিপে দিয়েছিলে?’

‘ঘড়ি দেখিনি। আন্দাজ এগারটা হবে।’

‘তুমি যখন দোতলায় নেমে গেলে‌, অন্য চাকরেরা জেগে ছিল?’

‘আজ্ঞে না‌, ঘুমিয়ে পড়েছিল।’

‘কেউ জেগে ছিল না?’

‘কেউ না।’

‘ভারী আশ্চর্য। যাহোক‌, তুমি তারপর কী করলে? শুয়ে পড়লে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তবে রাত বারটার সময় রাস্তায় বেরিয়েছিলে কেন?’

‘অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ঘুম এল না‌, তখন নিচে নেমে গেলাম। ভেবেছিলাম‌, খোলা জায়গায় খানিক দাঁড়ালে ঘুম আসবে।’

‘কতক্ষণ ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিলে?

‘দু-তিন মিনিটের বেশি নয়। দাদাবাবু যে কেলাব থেকে ফেরেননি তা জানতাম না। দেখলাম। তিনি আসছেন‌, তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।’

‘সিঁড়ির দরজা বন্ধ করেছিলে?’

‘আজ্ঞে‌, দাদাবাবু আসছেন‌, তাই বন্ধ করিনি।’

ব্যোমকেশ আর একবার ভোলার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল‌, বোধ করি মনে মনে তাহার স্থিরবুদ্ধির প্রশংসা করিল‌, তারপর শুষ্কম্বরে বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, তুমি এখন যেতে পার।’

ভোলা চলিয়া গেল। সদর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ আসিলে রসময় জিজ্ঞাসুনেত্রে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন‌, ‘কী মনে হল?’

ব্যোমকেশ বিমৰ্ষভাবে বলিল‌, ‘ভারী হুঁশিয়ার লোক। তবে কাল সন্ধ্যেবেলা যে বেরিয়েছিল‌, তা স্বীকার করেছে।’

‘তাতে কী প্রমাণ হয়?’

‘প্রমাণ কিছুই হয় না। তবে ওর যদি কেউ ষাড়ের লোক থাকে‌, চুরির আগে তার সঙ্গে নিশ্চয় দেশৃঙ্খল। নইলে নেকলেসটা লোপাট হয়ে গেল কী করে?’

‘তা বটে।’

ভোলা সম্বন্ধে আর বেশি আলোচনা হইতে পাইল না‌, দ্বারে টোকা পড়ায় মণিময় চলিয়া গেল। এবং অবিলম্বে পুলিস দারোগার পোশাক-পরা এক ভদ্রলোককে লইয়া উপস্থিত হইল। লম্বা চওড়া চেহারা‌, ব্যক্তিত্রবান পুরুষ। দারোগা অমরেশবাবু সন্দেহ নাই।

রসময় উঠিবার উপক্রম করিয়া সবিনয়ে বলিলেন‌, ‘এ কী অমরেশবাবু্‌, কী খবর! আপনি আবার এলেন যে!’

ভায়েদের বাসা খানাতল্লাশ করতে। কিন্তু–’ এই সময় আমাদের উপর নজর পড়ায় তিনি থামিয়া গেলেন।

রসময়বাবু অপ্রতিভভাবে পরিচয় করাইয়া দিলেন‌, ‘ইন্সপেক্টর মণ্ডল‌, ইনি— ইয়েব্যোমকেশ বক্সী। বোধ হয় নাম শুনেছেন।’

অমরেশবাবু খাড়া হইয়া বসিলেন‌, বিস্ময়োৎফুল্প স্বরে বলিলেন‌, ‘বিলক্ষণ! ব্যোমকেশ বক্সীর নাম কে না শুনেছে? আপনিই! আপনার নাম প্রমোদ বরাটের কাছেও শুনেছি‌, মশাই। প্রমোদকে মনে আছে? গোলাপ কলোনীর ব্যাপারে তদন্ত করেছিল। প্রমোদ আমার বন্ধু।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘প্রমোদীবাবুকে খুব মনে আছে। ভারী বুদ্ধিমান লোক।’

অমরেশবাবু বলিলেন‌, ‘সে আপনার পরম ভক্ত। তার আছে আপনার অদ্ভূত ক্ষমতার গল্প শুনেছি।–তা আপনিও এই নেকলেস চুরির ব্যাপারে আছেন নাকি? বেশ বেশ‌, আপনাকে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা; প্রমোদের মুখে শুনেছি আপনার খ্যাতির লোভ নেই‌, কেবল সত্যান্বেষণ করেই আপনি সন্তুষ্ট। হা হা।’

ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিল‌, ইন্সপেক্টর মণ্ডল‌, যার যা আছে সে তা চায় না‌, এই প্রকৃতির নিয়ম। এ-ব্যাপারে খ্যাতি যদি কিছু প্রাপ্য হয় আপনিই পাবেন। আমি মজুরি পেলেই সন্তুষ্ট হব।’

রসময়বাবু গাঢ়স্বরে বলিলেন‌, ‘মজুরি বলবেন না‌, ব্যোমকেশবাবু্‌, সম্মান-দক্ষিণা। যদি আমার নেকলেস ফিরে পাই‌, আপনার সম্মান রাখতে আমি ত্রুটি করব না।’

‘সে যাক‌, ব্যোমকেশ আমরেশবাবুর দিকে ফিরিল‌, ‘আপনি ভোলার ভায়েদের বাসা সার্চ করেছেন‌, কিন্তু কিছু পেলেন না?’

অমরেশবাবু বলিলেন‌, ‘কিছু পেলাম না। ওর ভায়েরা কাজে বেরিয়েছিল। দুই বৌ ঘরে ছিল। কিন্তু অতিপতি করে খুঁজেও কিছু পাওয়া পাওয়া গেল না।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ তাঁহার পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘তাহলে আপনার সন্দেহ ভোলা তার ভায়েদের সঙ্গে ষড় করে একাজ করেছে।’

নইলে নেকলেসটা লোপাট হয়ে গেল কী করে?

‘মণিময়বাবু এবং তাঁর স্ত্রী কিন্তু অন্য লোক দেখেননি।’

‘ওঁরা যখন ভোলাকে দেখেছেন‌, তার আগেই হয়তো ষাঁড়ের লোক মাল নিয়ে সরে পড়েছে।’

‘মণিময়বাবুর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ষাড়ের লোক এলে উনি তাকে দেখতে পেতেন না কি?’

দুইজনে কিছুক্ষণ পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিলেন‌, তারপর অমরেশবাবু দ্বিধাভরে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘আপনার কি মনে হয় ভোলার কাজ নয়?’

‘এখন কিছু মনে হচ্ছে না। তত্ত্বতল্লাশ যা করবার সবই আপনি করেছেন‌, কিছুই বাকী রাখেননি। এখন শুধু ভেবে দেখতে হবে।’ সে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘এখন উঠি। যদি ভেবে কিছু পাওয়া যায় আপনাদের জানাব।’

Pages: 1 2 3
Pages ( 1 of 3 ): 1 23পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress