মায়াযৌবন (Mayajouban)
বছর বিশ-বাইশের যুবকটিকে দেখিয়ে বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, ওর আসল নাম প্রতাপ, কিন্তু আমি ওর নাম রেখেছি মৃত্যুঞ্জয়।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন?
হাসলেন বৃদ্ধ–মজা পাওয়ার হাসি। তারপর মাথার একরাশ সাদা চুলে আয়েস করে হাত চালিয়ে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন। খসখসে গলায় বললেন, কারণ, আমি চাই, জরাকে ও জয় করুক। ও কখনও আমার মতো বৃদ্ধ হবে না। ওর চামড়ায় কখনও ভাঁজ পড়বে না। ওর চুলে কখনও পাক ধরবে না। ওর শরীর কখনও আমার মতো অকেজো-অথর্ব হয়ে পড়বে না। আর ওর মনে কখনও বার্ধক্যের ভীমরতি বাসা বাঁধবে না।
আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম বৃদ্ধ মানুষটির দিকে। জরাগ্রস্ত এই মানুষটি জরাকে জয় করতে চান! ওঁর মাথার কোনও গোলমাল হয়নি তো!
বৃদ্ধের নাম প্রলয়নাথ আচার্য। বয়েস প্রায় সত্তর-বাহাত্তর। বয়েসের তুলনায় স্বাস্থ্য মন্দ নয়। শক্তপোক্ত লম্বা কাঠামো। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। চশমার পাওয়ার বোধহয় খুব বেশি। কারণ, কাচের দিকে তাকালে সাদা-সাদা রিঙের মতো দাগ দেখা যায়।
প্রলয়নাথের মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। একইরকম ভাঁজ হাতের পিঠেও। বোঝা যায়, জরা বেশ ভালোরকমই থাবা বসিয়েছে।
প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই মানুষটার বিচিত্র নাম আমাকে অবাক করেছিল। তারপর ওঁর কথাবার্তা যতই শুনছি, ততই যেন অবাক হচ্ছি।
একটা মাঝারি মাপের ঘরে আমরা দুজনে বসেছিলাম। ঘরের সবকটা জানলাই বন্ধ। কারণ, তার ওপিঠেই হাড়কাঁপানো শীত। কিন্তু তবুও আমার শীত করছিল। ফুলহাতা সোয়েটার, মাফলার, ঠিকমতো কাজ করছিল বলে মনে হচ্ছিল না।
আমাদের সামনে কারুকাজ করা শৌখিন চায়ের টেবিল। টেবিলে চায়ের কাপ। কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে প্রলয়নাথ বললেন : জেরাটোলজির নাম শুনেছেন? জরাবিজ্ঞান? মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যাপারটা সাকসেসফুল হলে, জরাবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটা মাইলস্টোন তৈরি হবে।
প্রলয়নাথের ঘোলাটে চোখে আলোর ঝিলিক দেখা গেল। ঠোঁটে একবার জিভ বুলিয়ে নিলেন তিনি। তারপর আমার চোখে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ব্যাপারটা দারুণ হবে, না?
আমি এই বৃদ্ধের মনে আঘাত দিতে চাই না। তা ছাড়া আজ কয়েকদিন হল উনি জোর করে আমাকে নিয়ে আসছেন ওঁর বাড়িতে। চা-বিস্কুট-জলখাবার খাওয়াচ্ছেন। গল্প-সল্প করছেন। এই আতিথেয়তার প্রতিদান কি ওঁর স্বপ্ন-চুরমার করে দেওয়া বাস্তবের রূঢ় আঘাত!
সুতরাং মিনমিন করে জানালাম, ব্যাপারটা সত্যিই দারুণ হবে।
প্রলয়নাথের ব্যাপার কিন্তু তখনও পাথরের মূর্তির মতো ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পুরু গোঁফ, ফরসা রং রোদে পুড়ে তামাটে, নিষ্পাপ সরল মুখে প্রাণবন্ত দুটি চোখ যেন কথা বলছে।
প্রতাপের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের কথাবার্তা ও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু প্রলয়নাথ ডেকেছেন বলে ও বাড়ির অন্দর থেকে যান্ত্রিকভাবে এসে হাজির হয়েছে।
প্রলয়নাথ ওকে ডেকেছিলেন পরতাপ বলে। সেই সম্বোধন আর ওর হাবভাব মিলিয়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল, প্রতাপ বোধহয় স্থানীয় লোক-রাজপুত। এখন বৃদ্ধের কথায় বোঝা গেল সন্দেহটা সত্যি ।
মোহনবাবু– খসখসে গলায় আমার নাম উচ্চারণ করলেন প্রলয়নাথ। শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। তারপর ও পাপ-মানে, প্রতাপ–আমার কাছে আছে আজ প্রায় আট বছর। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি থেকে আজ ও জোয়ান মরদ হয়ে উঠেছে। তাই আমি ঠিক করেছি, ওকেই দেব চিরযৌবন রিওয়ার্ড হিসেবে।
চা খেতে-খেতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা পাগলাঘণ্টি বেজে উঠল মাথার ভেতরে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, প্রলয়নাথের বাড়িতে আমার রোজকার সান্ধ্য চায়ের আমন্ত্রণের পাট এবার বোধহয় ফুরোল। তিনি কাকে রিওয়ার্ড দেবেন-না-দেবেন সেটা তার মর্জির ব্যাপার। না, প্রতাপ অথবা মৃত্যুঞ্জয় ভারতরত্ন উপাধি পেলেও আমার মতো ছাপোষা মানুষের কোনও আপত্তি নেই। আর থাকলেই বা পাত্তা দিচ্ছে কে! কিন্তু রোজ যদি চা-জলখাবারের বিনিময়ে জরাবিজ্ঞানের ছদ্মবেশে চিরযৌবন লাভের গল্পগাথা শুনতে হয় তা হলে বড় সমস্যা। কারণ, হাসি পেলেও গম্ভীর প্রাজ্ঞ প্রলয়নাথের সামনে আমি হাসতে পারব না।
চিরযৌবন লাভের আকাঙ্ক্ষা কি আজকের! মনে পড়ে গেল যযাতির কথা। তারপর সাজগোজ, রূপচর্চা, শরীরের যত্ন, মাথার চুল ধরে রাখা, সবকিছুরই আড়ালে রয়েছে চিরকাল যৌবন ধরে রাখার সাধ। মানছি, আমার তেত্রিশ বছর বয়েসটাকে ধরে রাখতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু সাধ আর সাধ্য কি এক ব্যাপার!
এ কদিন প্রলয়নাথ কখনও জরাবিজ্ঞানের প্রসঙ্গ তোলেননি। শুধু আমার সম্পর্কে কৌতূহল দেখিয়ে নানান খোঁজখবর করেছেন। বাড়িতে কে কে আছেন? বিয়ে করেছি কি না? কলকাতা ছেড়ে রাজস্থানের এই শিল্পনগরীতে চাকরি নিয়ে চলে এসেছি কেন? সে কি বাবা-মায়ের ওপরে রাগ করে?
সত্যি কথা বলতে কি, এই বৃদ্ধ মিশুকে মানুষটি ওঁর আন্তরিক ব্যবহারে কয়েকদিনের মধ্যেই আমাকে একেবারে আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু আজ এই জরাবিজ্ঞানের প্রসঙ্গ আলটপকা শুরু করে তিনি আমাকে বেশ একটা ধাক্কাই দিয়েছেন।
অথচ মানুষটাকে দেখে আমার কখনও পাগল বলে মনে হয়নি।
তা হলে কি তিনি চিরযৌবন পাইয়ে দেওয়ার ফঁদ পেতে কিছু টাকা হাতিয়ে নিতে চান আমার কাছ থেকে?
মোহনবাবু, প্রতাপের মধ্যে আমি ইতিমধ্যেই এমন কিছু-কিছু লক্ষণ দেখতে পেয়েছি যা দেখে বলা যায়, আমার ড্রাগগুলো ঠিকমতো কাজ করছে। ওর বয়েস বাড়ার গতি গত দু-বছরে বেশ কমে গেছে।
আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। হঠাৎ উথলে ওঠা হাসির বেগটা সামাল দিতে গিয়ে বিষম খেলাম। কাশির দমকে হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল চায়ের কাপ। ঘরের মেঝেতে বিছানো ফুল পাতা-হরিণের নকশা কাটা জয়পুর কার্পেট তরলটুকু শুষে নিল, আর কারুকাজ করা কাচের কাপটির প্রাণ বাঁচাল।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। চেয়ার থেকে উঠে কাপটা তুলে নিতে ঝুঁকে পড়েছি, প্রলয়নাথ চাপা গলায় বাধা দিলেন আমাকে, থাক, থাক, ছেড়ে দিন। তারপর প্রতাপের দিকে ফিরে বললেন, পাপ, সাফি মারো–
প্রতাপ যন্ত্রের মতো এগিয়ে এল টেবিলের কাছে। নীচু হয়ে নীরবে কাজ সারতে লাগল।
আপনাকে আর-এক কাপ চা দিই?
প্রলয়নাথের প্রস্তাব আমি বিনীতভাবে ফিরিয়ে দিলাম। দুঃখপ্রকাশ করলাম দুর্ঘটনার জন্যে। তারপর বললাম, আজ চলি। অনেকটা পথ যেতে হবে…।
যাবেন? আমার চোখে সরাসরি তাকিয়ে খসখসে গলায় জিগ্যেস করলেন তিনি।
আমি কোনও উত্তর না দেওয়ায় কয়েক মুহূর্ত পরে বললেন, আচ্ছা, যান। কাল সন্ধেবেলা আসছেন তো? আপনাকে আমার ল্যাবরেটরি দেখাব। জেরাটোলজি ভারী ইনটাররেস্টিং সাবজেক্ট…।
আমি বললাম, দেখি।
প্রলয়নাথ আমার কাছে এগিয়ে এলেন। ওঁর জরাজীর্ণ হাতে আমার হাত চেপে ধরলেন ও মোহনবাবু, কাল আপনাকে আসতেই হবে। বিদেশ বিভুঁইয়ে আপনার মতো একজন আপনজনকে আমি একদিনের জন্যেও খোয়াতে রাজি নই। আপনি এখানে চাকরি নিয়ে এসেছেন একমাস। আর আমি এই কোটা শহরে আছি বাইশ বছর। বাংলা কথা প্রায় ভুলতে বসার জোগাড়। বাড়ির বউ মেয়ের একঘেয়ে কথাবার্তা আর কাহাতক ভালো লাগে? কাল আসবেন কিন্তু। প্লিজ…।
বৃদ্ধের চোখে নীরব মিনতি ছিল। কী যে হল আমার, ঘাড় নেড়ে কথা দিলাম ওঁকে ও আসব। কিন্তু আমি মনে-মনে জানতাম, ওঁর বাড়িতে না এসে আমার উপায় নেই। এমন একজনকে আমি এ-বাড়িতে দেখেছি, যার টানে আমাকে আসতেই হবে।
প্রলয়নাথ আমাকে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। বসবার ঘরে প্রতাপ, ওরফে মৃত্যুঞ্জয়, তখন কার্পেট পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত।
রাস্তায় বেরোতেই শীত আঁপিয়ে পড়ল আমার গায়ে। মাফলারটা ভালো করে গলায় আর কানে মুড়ি দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম প্ল্যান্টের দিকে।
রাজস্থানের কোটা থার্মাল পাওয়ার স্টেশনে চাকরি নিয়ে আমি এসেছি আজ প্রায় একমাস। চাকরি না পালটালে বাকি জীবনটা বোধহয় এখানেই কাটাতে হবে। কলকাতায় পিছুটান বলতে বাবা মা, ছোট ভাই, আর ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি। হয়তো পুরোনো কথা ভুলতে চাই বলেই একরকম জেদ করে এই চাকরি নিয়ে আমি কলকাতা ছেড়েছি। ছোটভাই ভালোই চাকরি করে। সুতরাং সচ্ছলভাবে মা-বাবার দিন কেটে যাবে।
আমি এই নতুন জায়গায় এসে নতুন মানুষজন আর প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা করছি– যাতে কলকাতার কথা বেশি মনে না পড়ে। কিন্তু সেটা হয়ে উঠছে কই! দুঃখ ভুলতে এত কষ্ট হয় কেন কে জানে!
থাকার জন্যে আমাকে আপাতত একটা ছোট কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছে। দিনের বেলা ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়া সারি, আর রাতে ডিমসেদ্ধ, আলুভাজা, আর দুমুঠো ভাত ফুটিয়ে ম্যানেজ করি। রান্নার অভ্যেস কোনওকালেই ছিল না। সুতরাং সে যে কী মর্মান্তিক অগ্নিপরীক্ষা, তা শুধু আমিই জানি। আমার হাতে-পায়ে নানান ফোস্কার দাগ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এক-একদিন বিরক্ত হয়ে মুড়ি, পাঁউরুটি, কিংবা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ি। সঙ্গে ঢকঢক করে দু-গ্লাস জল। তবে কষ্ট যতই হোক, মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, কলকাতায় সহজে ফিরছি না।
ভোরবেলা আমি চম্বল নদীর তীরে বেড়াতে বেরোই।
সময়টা জানুয়ারির শেষ, কিন্তু তাই বলে শীতের ধার কমেনি। তা ছাড়া, আমি বরাবরই বেশ শীতকাতুরে। তাই ডবল সোয়েটার, মাফলার, মাঙ্কি ক্যাপ ইত্যাদি পরে ভোরবেলা চম্বল নদীর তীরে পায়ে হেঁটে শীতের সঙ্গে কুস্তি করি। শরীরের প্রায় সর্বাঙ্গ ঢাকা–শুধু চোখ দুটি ভোলা। ঠিক যেন দস্যু মোহন।
এইরকম সাজে রোজ পায়চারি করি, আর রংবেরঙের পাখি দেখি। ওদের পালকগুলো যেন ঈশ্বর এঁকে দিয়েছেন রামধনু-রং তুলি দিয়ে। নদীর জল, আকাশ, আর পাখি আমাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকে। বুঝতে পারি, প্রকৃতির টান এড়ানো কী কঠিন।
এইরকম এক সকালে, তখন সবে সূর্য উঠেছে, সোনালি রং ঝিলিক মারছে চম্বলের জলে– পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, বাঙালি নাকি?
বেশ অবাক হলাম। শুধুমাত্র চোখ দেখে বাঙালি বলে চিনতে পারে এমন প্রতিভাবান মানুষটি কে।
চোখ ফিরিয়েই দেখি, সুঠাম চেহারার এক বৃদ্ধ। পরে জেনেছি, তার নাম প্রলয়নাথ আচার্য। বিশ বছরের ওপর কোটায় আছেন। কী একটা কসমেটিক্স ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন রিটায়ার করেছেন প্রায় দশ-এগারো বছর।
আমার অবাক দৃষ্টির উত্তরে সামান্য হেসে লোলচর্ম প্রলয়নাথ খসখসে গলায় বলেছিলেন, আপনার মাফলারের আঁচলে নামের প্রথম অক্ষর ম সুতো দিয়ে সেলাই করা আছে। তা থেকেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছি।
আদ্যক্ষর খোদাই করাটা মায়ের কাণ্ড–যাতে আমার আর ভাইয়ের জিনিস ওলটপালট না হয়ে যায়। কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রশংসা করতে হয়। একটা নগণ্য মকারান্ত ব্যাপার দেখতে পেয়েছেন!
এইভাবে প্রথম আলাপের পর প্রলয়নাথ দেখা হলেই গল্প জুড়ে দিতেন আমার সঙ্গে। আর তার সঙ্গে নানান কৌতূহল মেটাতে চাওয়া প্রশ্ন। এ দেশে বহুবছর থাকার জন্যে ভদ্রলোকের বাংলা কথায় এদিককার রাজস্থানি টান জুড়ে গেছে।
ওঁর কাছেই শুনেছি, সমুদ্রতল থেকে প্রায় আড়াই হাজার মিটার উঁচু এই কোটা শহরটা এক বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা–যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে কোট। কোট থেকেই নাকি এসেছে শহরের নাম–কোটা।
এক-দু-দিন আলাপের পরই বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন। চা খেতে-খেতে প্রলয়নাথ বলেন, জানেন তো, মোহনবাবু, দুজন বাঙালি একজায়গায় জুটলেই চায়ের পেয়ালায় রাজা-উজির মারতে থাকে। সুতরাং আমার বাড়িতে আপনার রোজ চায়ের নেমন্তন্ন রইল। প্রতিদিন সন্ধেবেলা বসে ঘণ্টাখানেক কি ঘন্টাদুয়েক রাজা-উজির মারা যাবেখন।
প্রলয়নাথের বাড়িটা আমার প্ল্যান্ট থেকে হাঁটাপথে মিনিটপনেরো। সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। সামনে-পেছনে খানিকটা করে বাগান। পিচের রাস্তা থেকে রুক্ষ পাথুরে রাস্তা খানিকটা ভেতরদিকে চলে গেছে, একেবারে বাড়ির কাছ পর্যন্ত। বাড়ির পাশে একটা বড়সড়ো খাদ। বোধহয় কেউ একসময় মাটি খুঁড়ে পুকুর তৈরি করার চেষ্টা করেছিল।
প্রথমদিন বাড়িতে গিয়ে আলাপ হয়েছে প্রলয়নাথের বৃদ্ধা স্ত্রীর সঙ্গে।
মোহনবাবু, আমার বউ অনুরাধা– বসবার ঘরে আমাকে বসিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি, গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে আমার সহধর্মিনী–এটাই হল লিটারাল টুথ। আর অনুরাধা, ইনি মোহন দাশশর্ম। পাওয়ার প্ল্যান্টে নতুন চাকরি নিয়ে এসেছেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কী, তাই তো?
শেষ প্রশ্নটা আমাকে লক্ষ করে।
আমি নীরবে ঘাড় নেড়ে জানালাম যে, উনি ঠিকই বলেছেন।
অনুরাধাকে দেখছিলাম আমি। ছোটখাটো চেহারা। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। ঠোঁটের ওপরে, ডানদিকে, বেশ বড় একটা কালো রঙের আঁচিল। বয়েসকালে ওটাই বোধহয় বিউটি স্পট ছিল, এখন শুধুই স্পট।
অনুরাধার গাল ভাঙা, মুখের চামড়ায় অগুনতি ভাঁজ। একটা চোখে সাদাটে ভাববোধহয় ছানি পড়েছে। সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর আর কপালে বড় সিঁদুরেরর টিপ।
অনুরাধার গায়ে কালচে সবুজ রঙের একটা কম্বলজাতীয় শাল জড়ানো থাকায় ওঁর পরনের শাড়ির নীচটুকু দেখা যাচ্ছিল। যোধপুরী বাঁধনি শাড়ি। তাতে তেরছাভাবে লাল-হলুদ-নীল রঙের খেলা। ওঁর বয়েসের সঙ্গে শাড়ির উজ্জ্বল রং আমার বেশ বেমানান লাগছিল। তবে এমন হতে পারে যে, ওঁর স্বামী হয়তো এরকম উজ্জ্বল রং-ই পছন্দ করেন।
শুধু মুখটুকু ছাড়া অনুরাধার শরীরের আর কোনও অংশ দেখা যাচ্ছিল না। শাড়ির ওপরে শালটা এতই বড় এবং পুরু যে, ওঁকে ফোলানো-ফঁপানো কোলবালিশ বলে মনে হচ্ছিল। এছাড়া পায়ে মোজা আর অর্ধেক পা-ঢাকা রবারের চটি।
ভদ্রমহিলার গলার স্বর ভারী মিষ্টি। চোখ বুজে কথা শুনলে বয়েস ঠাহর করা মুশকিল অনেকটা লতা মঙ্গেশকরের মতো।
তিনি স্নেহমাখানো গলায় আমাকে বললেন, আপনি রোজ হাত পুড়িয়ে রান্না করে খান?
ওঁর কথায় একেবারে হইহই করে উঠলেন প্রলয়নাথ, আপনি অনায়াসে আমাদের এখানে খাওয়াদাওয়া করতে পারেন।
আমি লজ্জা পেয়ে আপত্তি জানালাম।
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক হল, রোজ সন্ধেবেলা চা-জলখাবার খেতে ওঁদের বাড়িতে আমি আসব। আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে ছাড়লেন প্রলয়নাথ।
অনুরাধা চলে যাওয়ার পর আমরা চা খেতে-খেতে গল্প করছিলাম।
মাঝারি মাপের ঘর ছিমছামভাবে সাজানো। দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো মিনিয়েচার পেইন্টিং এ জাহাঙ্গীর আর নূরজাহানের শয্যাকক্ষ। মেঝেতে ফুলপাতার নকশা করা কার্পেট। ঘরের একপাশে দুটো খাটো টুল। কাঠের ফ্রেমে চামড়া দিয়ে বাঁধানো। চামড়ায় ওপরে ফুল আর জ্যামিতির নকশা। ঘরের একদিকের দেওয়ালে রাধাকৃষ্ণের ফটো বাঁধানো। সেখানে দুটো ধূপকাঠি জ্বলছে। ধূপের উগ্র গন্ধ ছেয়ে গেছে ঘরের বাতাবরণে।
প্রলয়নাথের অনুমতি নিয়ে আমি একটা সিগারেট ধরালাম।
তিনি বললেন, আমি একসময় খুব সিগারেট খেতাম। বুকে কষ্ট হয় বলে ছেড়ে দিয়েছি। তা ছাড়া সিগারেট খেলে বয়েসটা তাড়াতাড়ি বেড়ে যেতে চায়। আপনি পারলে এই বদ নেশাটা ছেড়ে দেবেন।
কথায় কথায় প্রলয়নাথ বলেছিলেন, বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে ওঁর আগ্রহ আছে। কিন্তু জেরাটোলজির কথা স্পষ্ট করে বলেননি।
মনে পড়ছে, প্রতাপ সম্পর্কে তিনি সেদিন মাত্র একটা-দুটো কথা বলেছিলেন।
পরতাপ চওহান বুন্দির ছেলে। আট বছর আগে দশেরার মেলায় কীভাবে কোটায় চলে আসে। তারপর আত্মীয়স্বজন কাউকে আর খুঁজে পায়নি। সোজা কথায়, একা হয়ে যায়। তখন প্রলয়নাথ ওকে আশ্রয় দেন। সেই থেকে এখানেই বড় হয়েছে। ওঁদের কাছে থেকে-থেকে মোটামুটি বাংলা শিখে গেছে।
প্রতাপ তখন বাড়িতে ছিল না। কীসব জিনিসপত্র কিনতে বাজারে গেছে।
না, তখনও মৃত্যুঞ্জয় বা জেরাটোলজির প্রসঙ্গ ওঠেনি। উঠলে সেদিন থেকেই আমি সতর্ক হতাম।
প্রলয়নাথ চোখ থেকে চশমা খুলে চশমার কাচ মুছে নিলেন। তারপর চশমা চোখে দিয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। বললেন, মোহনবাবু, আপনি অলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস করেন?
আমি সিগারেটে টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ধোঁয়া ছাড়লাম। সর্বনাশ! এই বুঝি শুরু হল কোটার ভূতের গল্প!
মনে যা-ই ভাবি, মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে জিগ্যেস করলাম, ভূত-প্রেতের ব্যাপার?
তিনি ইতস্তত করে বললেন, না, ঠিক সেরকম নয়। এমন ব্যাপার, যেটা সহজে বিশ্বাস হওয়ার নয়–অথচ সত্যি।
আমার মতো অতিথির পক্ষে বেশি তর্ক-বিতর্কে যাওয়াটা অশোভন। তাই মিনমিন করে বলেছি, সত্যি হলে বিশ্বাস না করে উপায় কী!
হুঁ– মাথা নীচু করে ঘাড় নেড়েছিলেন প্রলয়নাথ। তবে ও-বিষয়ে আর কথা বাড়াননি।
পরে টুকিটাকি কাজে অনুরাধা ঘরে এসেছেন। যেমন চুপচাপ এসেছেন তেমনই চুপচাপ চলে গেছেন। কিন্তু প্রলয়নাথের মেয়েকে একটিবারের জন্যেও দেখিনি।
জানি, এই কৌতূহল হয়তো বয়েসের দোষ, কিন্তু স্বীকার করছি, মেয়েটিকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছিল।
তাই উঠে আসার আগে বৃদ্ধ মানুষটিকে সেকথা জিগ্যেস করলাম।
সামান্য চমকে উঠে তিনি বলে উঠলেন, কে? সুপ্রিয়া? ও হয়তো ভেতরের ঘরে পড়াশোনা নিয়ে মেতে আছে। ভীষণ একাচোরা কারও সামনে বেরোতে চায় না।
একটু অবাক হলেও আর কোনও কথা বলিনি। কিন্তু কৌতূহলটা আমার থেকেই গিয়েছিল।
আমি চলে আসার আগে প্রলয়নাথ আরও একবার প্রতাপের কথা তুললেন। এলোমেলোভাবে যা বললেন, তার স্পষ্ট কোনও অর্থ আমার মাথায় ঢুকল না।
ওর কথা শুনলে সবাই একেবারে চমকে যাবে…ভীষণ বাধ্য ছেলে…আমাকে খুব মানে…ওকে নিয়ে আমার অনেক আশা…।
বৃদ্ধের প্রলাপ ভেবে সেদিনকার কথাগুলো আমি উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, সেদিন প্রলয়নাথ ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন। কী সেই অলৌকিক ব্যাপার। আর, প্রতাপের কথা শুনলে সবাই কেন চমকে যাবে।
অর্থাৎ, জরাবিজ্ঞান। কসমেটিক্স কোম্পানিতে বিজ্ঞানীর চাকরি করা প্রলয়নাথ হয়তো নিজের বার্ধক্যকে মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই নিজের পছন্দসই গবেষণায় নেমে পড়েছেন। আর হাতের কাছে ভোলাভালা রাজপুত ছেলেটিকে পেয়ে তার ওপরেই যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফলাচ্ছেন।
কিন্তু প্রতাপের পর দ্বিতীয় মৃত্যুঞ্জয় হিসেবে তিনি কি আমাকে টারগেট করেছেন না কি! সেইজন্যেই কি খোঁজখবর নিচ্ছিলেন, আমার বাড়িতে আর কে-কে আছে, কলকাতায় সেরকম কোনও পিছুটান আছে কি না! তারপর রয়েসয়ে ব্যাপারটা আমার কাছে ভাঙবেন।
কোয়ার্টারে ফেরার পর একটা অদ্ভুত ভয় আমাকে জড়িয়ে ধরল।
জরাকে আমি ভয় পাই ঠিকই। সব মানুষই জরাকে ভয় পায়। কিন্তু জরা কি মোটরগাড়ি না কি যে, যখন খুশি প্রলয়নাথ তার ব্রেক কষে গতি কমিয়ে দেবেন! প্রতাপের বেলায় উনি নাকি সেটা করতে পেরেছেন। কোনওদিন হয়তো বলে বসবেন, তিনি ব্রেক কষে গাড়ি একেবারে থামিয়ে দিয়েছেন। প্রতাপের বয়েস আর বাড়বে না।
রাতটা আমার নানান দুশ্চিন্তায় কাটল। কিন্তু ভয় যেমন আমাকে প্রলয়নাথের বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিল, তেমনই ওঁর মেয়ে সুপ্রিয়া আমাকে পাগলের মতো টানছিল।
কারণ, সুপ্রিয়াকে আমি একদিন দেখতে পেয়েছি। তখন ও বাথরুমে গরমজলে গা ধুচ্ছিল। শীতের সময় সন্ধেবেলা এভাবে কেউ গা ধোয় বলে শুনিনি। কিন্তু আমার তখন শোনা নয়, দেখার সময়।
একতলার বাথরুমের ছোট জানলাটা খোলা ছিল। ভেতরে অন্তত চল্লিশ ওয়াটের আলো জুলছিল। আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। প্রলয়নাথ তখন সরস্বতী ভাণ্ডার মিউজিয়াম থেকে ওঁর কপি করে আনা একটি দুষ্প্রাপ্য পুথি আমাকে দেখাবেন বলে ভেতরের ঘরে গেছেন। আর অনুরাধা বোধহয় আমাদের জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে গেছেন। প্রতাপও ধারে কাছে ছিল না।
আমি সুপ্রিয়ার স্নান দেখছিলাম। আর ওর ঢল নামা শরীর দেখছিলাম। জানলা দিয়ে ওর পিঠ, পিঠের নীচ, আর বুকের পাশটা দেখা যাচ্ছিল। ভেজা শাড়িটা ঠিকমতো গায়ে জড়ানো ছিল না। তাই আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নিষ্পলকে তাকিয়ে ছিলাম।
এক মিনিট, দু-মিনিট।
তারপরই বাথরুমের আলো নিভে গিয়েছিল।
সুতরাং সারারাত বহু দোনামনা করেও সুপ্রিয়া জিতে গেল। তাই পরদিন সন্ধেবেলা আমি প্রলয়নাথের বাড়িতে গেলাম।
বেশ বুঝতে পারছিলাম, ওঁর কোনওরকম উদ্ভট চিন্তাই আমাকে আপাতত ওঁর বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
.
পরদিন সন্ধেবেলা প্রলয়নাথের বাড়িতে যখন গেলাম, তখন বৃদ্ধ মানুষটি আমার জন্যে যেন তৈরিই ছিলেন। আমাকে সঙ্গে করে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, আমি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আপনার আশায় বসে আছি। আসুন, বসুন, আগে চা-টা একটু খেয়ে নিন, তারপর ল্যাবে নিয়ে যাব।
আমি রোজকার মতোই বসলাম।
রাধা কৃষ্ণের ফটোর কাছে ধূপ জ্বলছিল। কিন্তু ধূপের গন্ধ ছাড়াও একটা হালকা পারফিউমের গন্ধ নাকে আসছিল। অনুরাধা নিশ্চয়ই সত্তর ছুঁই-ছুঁই বয়েসে পারফিউম ব্যবহার করবেন না। তা হলে আর বাকি থাকে সুপ্রিয়া। ও কি একটু আগেই এসেছিল এই ঘরে?
প্রলয়নাথ জরাবিজ্ঞান নিয়ে কিছু-কিছু কথা বলছিলেন, কিন্তু সেগুলো আমার কানে ঠিকমতো ঢুকছিল না। আমার মাথার ভেতরে তখন বাথরুমের ছোট্ট জানলাটা ভাসছিল। একজন ভরাযৌবন তরুণী সেখানে স্নান করছে।
বারবার ঘড়ি দেখছিলাম আমি। এখন ঘড়িতে প্রায় ছটা পঁচিশ। আগের দিন ব্যাপারটা আমি লক্ষ করেছিলাম সাড়ে ছটা-পৌনে সাতটা নাগাদ। সুতরাং অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার মনটা উসখুস করতে লাগল।
প্রলয়নাথ তখন কপি করে আনা পুথিটার কথা বলছিলেন।
বুঝলেন, মোহনবাবু, পুথিটার নাম স্থিরযৌবন–প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে লেখা। ওটা পড়ে আমার গবেষণায় অনেক সাহায্য পেয়েছি। আমাদের যখন বয়েস বাড়ে, তখন শরীরের সঙ্গে-সঙ্গে মনটাও বুড়ো হতে থাকে। শরীরের বাইরেটায় যেমন ধীরে-ধীরে বয়েসের ছাপ পড়ে, তেমনই ভেতরকার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বুড়ো হয়। আমাদের চামড়ার বাইরেটা ক্রমশ পুরু হতে থাকে, অথচ ডারমিস, মানে, অন্তঃত্বক, ক্রমাগত কুঁচকে যেতে থাকে। তা ছাড়া, ডারমিসের কলাজেন কনটেন্ট কমতে থাকে–ফলে চামড়ার জোরও কমে। এই দেখুন না, যেমনটা আমার হয়েছে বলে নিজের শিরা ওঠা লোলচর্ম হাতের পিঠ দেখালেন প্রলয়নাথ। একটু দম নিয়ে তারপর বললেন, শুধু চামড়া কেন, হাড়গুলো ক্ষয় ধরে কমজোরি হতে থাকে। তলপেটের সবচেয়ে বড় যে-ধমনি, অ্যাওর্টা, তার ইলাস্টিসিটি কমতে থাকে। রিঅ্যাকশন টাইম বাড়তে থাকে, রিফ্লেক্স ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে। চোখের মণির ছোট-বড় হওয়ার ক্ষমতা কমে যায়, ব্রেনের ওজনও যায় কমে। আর নার্ভাস সিস্টেমও ধীরে ধীরে তার তেজ হারিয়ে ফেলে। অল্পবয়েসে…।
প্রতাপ ঘরে ঢুকল। হাতে রোজকার মতো চা-জলখাবার। আমাদের সামনের টেবিলে সেগুলো সাজিয়ে দিয়ে প্রতাপ চলে গেল। যাওয়ার আগে অদ্ভুত চোখে ঘুরে তাকাল আমার দিকে। সে দৃষ্টিতে সহমর্মিতার আভাস পেলাম বলে মনে হল। কিন্তু তার কারণ খুঁজে পাইনি–অন্তত তখনও।
প্রতাপ এসে পড়ায় কথা থামিয়ে দিয়েছিলেন প্রলয়নাথ। হয়তো চান না, প্রতাপ আমাদের সব আলোচনা শুনে ফেলুক। ও চলে যেতেই তিনি আগের কথার জের টেনে বলতে শুরু করলেন, অল্পবয়েসে আমাদের ব্রেইনের নিউরোন, মানে, স্নায়ুকোশ, নষ্ট হয়ে গেলে আবার নতুন কোশ জন্মায়। কিন্তু বয়েস বাড়তে বাড়তে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ হয়ে গেলে নতুন স্নায়ুকোষ জন্মানোর ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য এতে বুদ্ধি সত্যি-সত্যি কমে যায় কি না তা নিয়ে বির্তক আছে, তবে স্মৃতিশক্তি বেশ কমে আসে।
কথা বলতে-বলতে প্রলয়নাথ চায়ের কাপে বড়-বড় চুমুক দিচ্ছিলেন। চা শেষ হয়ে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন : আপনি চা-টা শেষ করুন। আমি গিয়ে ল্যাবটা একটু গুছিয়ে আসি। আপনি ইচ্ছে করলে বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে পারেন।
কথা শেষ করেই প্রলয়নাথ চলে গেলেন। কিন্তু শেষ কথাটা তিনি কেন বললেন কে জানে! আমিও মনে-মনে বোধহয় সেটা চাইছিলাম। তিনি চলে যেতেই তাকালাম ঘড়ির দিকে পৌনে সাতটা বাজে।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এলাম।
এই বারান্দা থেকে রাতের আকাশ দেখা যায়। একইসঙ্গে দেখা যায় পাকা রাস্তার আলো, আর দুরের দোকানপাট।
বারান্দায় ঠান্ডাটা বেশ জমাট, কিন্তু সেইজন্যেই বোধহয় চায়ের আমেজটা আরও ভালো লাগছিল।
বারান্দায় এসে প্রথমেই আমার চোখ গিয়েছিল একতলার কলঘরের দিকে। কিন্তু দেখলাম, চৌকো ছোট জানলাটা অন্ধকার।
হতাশ হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিতে যাব, অমনই দেখি আলো জ্বলে উঠেছে সেখানে। একটি সুঠাম শরীর জানলার ফ্রেম বরাবর এসে পোশাক ছাড়তে শুরু করল।
ক্রমশ কোমল ত্বক প্রকাশিত হচ্ছিল, আর আমার কান গরম হয়ে উঠছিল। চায়ের কাপ হাতে পাথরের মূর্তি হয়ে গেলাম আমি। আকাশ থেকে হয়তো হিম পড়ছিল, কিন্তু সেদিকে কোনও হুঁশ ছিল না আমার।
একটা ফরসা শরীর বেয়ে জলের রেখা কীভাবে উঁচু-নীচু আঁকাবাঁকা পথে নেমে আসে সেটাই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, কাজটা অন্যায়, কিন্তু আমার মনের লোভী অংশটা আমাকে চোখ ফিরিয়ে নিতে দিচ্ছিল না। সুপ্রিয়া, ওঃ সুপ্রিয়া!
ওইভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, হঠাৎই কারও পায়ের শব্দে চমকে উঠে চোখ ফেরালাম আমি।
প্রলয়নাথ।
ওঁর দু-চোখে অপ্রসন্ন দৃষ্টি।
আমার দিকে কয়েক লহমা স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, মোহনবাবু, চলুন…আমার ল্যাবরেটরি দেখবেন চলুন। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমি কি ধরা পড়ে গেছি প্রলয়নাথের কাছে? এই বয়েসে উঁকি মারা টম হিসেবে ধরা পড়লে কে না লজ্জা পাবে! কিন্তু কী করব! ওই চৌকো জানলাটা এখন যেন আমার জীবন-মরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোনও কথা না বলে প্রলয়নাথকে অনুসরণ করলাম আমি।
ওঁর ল্যাবরেটরিটা দোতলার একেবারে পেছনদিকটায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ওঠা-নামা করে সরু একফালি অলিপথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ওর ল্যাবে। যাওয়ার পথে রান্নাঘর থেকে ছ্যাক ছোঁক শব্দ পেলাম। অনুরাধা হয়তো রান্না করছেন।
প্রলয়নাথের ল্যাবরেটরিকে ঠিক প্রথাগত অর্থে ল্যাবরেটরি বলা যায় না। একটা মাঝারি মাপের ঘরে নানান সাজসরঞ্জাম জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছড়ানো। তবে সবমিলিয়ে তার মধ্যে একটা বিজ্ঞান-বিজ্ঞান গন্ধ আছে।
ঘরের সবকটা আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। টিউব লাইটের উজ্জ্বল আলোয় ল্যাবরেটরির দৈন্য আরও বেশি প্রকট হয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রলয়নাথের চোখে তৃপ্তি আর গর্ব দেখতে পাচ্ছিলাম। আর একইসঙ্গে ভাবছিলাম, বৃদ্ধের মস্তিষ্কের বার্ধক্যের তীব্রতা বোধহয় ওঁর শরীরের বার্ধক্যের তুলনায় বেশি।
একপলক নজর বুলিয়ে ঘরে যা-যা আমার চোখে পড়ল সেগুলো হল : বিশাল কাচের বাক্সে ঢাকা কয়েকটা চারা গাছ–তার মধ্যে বনসাইও আছে, বেশ কয়েকটা শিশি-বোতল আর টেস্টটিউব, একটা কেরোসিন স্টোভ, প্রচুর বইপত্র আর কাগজ কোণের একটা টেবিলে উঁই করা, তিনটে ছোট-ছোট খাঁচায় সাদা ইঁদুর আর গিনিপিগ। হঠাৎ ঘরে আলো জ্বলে ওঠায় প্রাণীগুলো কিচকিচ করে ডাকছে।
আসুন, এদিকে আসুন– বলে প্রলয়নাথ আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন চারাগাছগুলোর কাছে।
লক্ষ করলাম, কাচের বাক্সের দিকে তাক করা আছে দুটো হাই পাওয়ারের স্পটলাইট।
প্রলয়নাথ বললেন, মোহনবাবু, আপনি তো জানেন, গাছও বড় হয়–বুড়ো হয়। তাই প্রথমদিকটায় আমি গাছের এজিং প্রসেস স্টাডি করেছি। এই কাচের বাক্সটা হল আমার মিনিয়েচার গ্রিনহাউস। আর এই স্পটলাইট দুটো হল সূর্যের আলোর বিকল্প। দিনে আট-দশ ঘণ্টা করে এগুলো আমি জ্বেলে রাখি।
ওদের ব্যাপারটা স্টাডি করে কী দেখলেন? আমার মধ্যে কৌতূহল ধীরে-ধীরে মাথাচাড়া দিচ্ছিল।
দেখলাম কী জানেন? সামান্য হাসলেন তিনি। মাথার সাদা চুলে হাত চালিয়ে বললেন, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ঠিকই বলেছেন। গাছের অনেক কিছুই মানুষের মতো। দেখলাম, বয়েস বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ওদের রিঅ্যাকশন টাইম বেড়ে যায়। মানে, ধরুন, আপনাকে কেউ পেছন থেকে টাচ করে ডাকল। সেই স্পর্শ পেয়ে আপনি নিশ্চয়ই সেদিকে ঘুরে তাকাবেন। এটাই হচ্ছে আপনার রিঅ্যাকশন। বয়েস বেড়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে স্পর্শের অনুভূতি পেয়ে ঘুরে তাকাতে আমাদের সময় বেশি লাগে। রিফ্লেক্সের ব্যাপারটাও একইরকম। বয়েস বেড়ে গেলে ক্রিকেটার, ফুটবলার বা টেনিস খেলোয়াড় সবারই রিফ্লেক্স ঢিমে হয়ে যায়।
এমনসময় দরজার কাছ থেকে কেউ ডাকল, সাব–।
ফিরে তাকিয়ে দেখি প্রতাপ। হাতে একটা বড় প্লেট, তাতে অনেকগুলো পেঁয়াজি অথবা ফুলকপির বড়া।
অনুরাধার সবদিকে নজর থাকে। জানে যে ল্যাব দেখতে বেশ সময় লাগবে, তাই খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রতাপের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে একটা টেবিলে রাখলেন প্রলয়নাথ। প্রতাপ চলে যেতেই আমাকে বললেন, নিন, মোহনবাবু, খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে।
সত্যিই খিদে পাচ্ছিল। তাই সৌজন্যের লজ্জা না দেখিয়ে একটা বড়া তুলে নিলাম। যা ভেবেছিলাম তাইফুলকপির বড়া। তবে তার মধ্যে নানান মশলা দিয়ে অনুরাধা তাকে আরও সুস্বাদু করে তুলেছেন।
প্রলয়নাথ একটা বড়া মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বললেন, এই বয়েসে এসব বেশি সহ্য হয় না, আবার লোভও ছাড়তে পারি না। অনুরাধা সবসময় আমার খেয়াল রাখে। ও না থাকলে যে আমি কী করতাম… একটু থেমে উদাস গলায় প্রলয়নাথ বললেন, ওর ঋণ আমি জীবনে শোধ। করতে পারব না। ওকে সুখী করার জন্যে আমি চেষ্টার কোনও শেষ রাখি না।
আমি ওঁকে প্রসঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চাইলাম। বললাম, আপনি তখন রিফ্লেক্সের কথা বলছিলেন।
ওহ, হ্যাঁ– সামান্য চমকে যেন চেতনা ফিরে পেলেন বৃদ্ধ ও রিফ্লেক্সের মতোই টেম্পারেচার সেন্স করার ব্যাপারেও ক্ষমতা কমে আসে। যেমন, খুব অল্প ঠান্ডা, বা খুব অল্প গরম কোনও জিনিসের উষ্ণতা ঠাহর করতে অসুবিধে হয়। তারপর ধরুন, যন্ত্রণা। বয়েস বেড়ে গেলে যন্ত্রণা টের পেতে গাছের দেরি হয়। মানুষেরও তাই। এরকম আরও অনেক ব্যাপার আছে। তা সেগুলো আমি গাছের ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছি। তারপর নানারকমভাবে সেগুলোকে অ্যারেস্ট করার চেষ্টা করেছি।
অ্যারেস্ট মানে? আর-একটা বড়া মুখে দিয়ে আমি জানতে চাইলাম।
হাসলেন প্রলয়নাথ, বললেন, বয়েস বেড়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে অনুভূতিগুলোর এইসব পরিবর্তনকে আমি থামাতে চেষ্টা করেছি। বহু বছরের পরিশ্রমের পর আমি সাকসেসফুল হয়েছি, মোহনবাবু। তখন আমি গাছ থেকে চলে এসেছি প্রাণীতে উঁদুর আর গিনিপিগে।
গ্রিনহাউসের কাছ থেকে ইঁদুর-গিনিপিগের খাঁচার দিকে আমাকে নিয়ে গেলেন প্রলয়নাথ। বললেন, সময়ের হিসেবে এই তিনটে ইঁদুর একই বয়েসের, কিন্তু ওদের মধ্যে বয়েস বেড়ে ওঠার লক্ষণগুলো তিনরকমের। কারণ, তিনটে ইঁদুরের বয়েস বেড়ে ওঠার গতি তিন রকমের। বুঝতেই পারছেন, মোহনবাবু, আমার এক্সপেরিমেন্ট কীরকম সাকসেসফুল হয়েছে। এর জন্যে অনেকরকমের সিরাম তৈরি করতে হয়েছে। রাতের-পর-রাত জাগতে হয়েছে। রাসায়নিক সমীকরণের হিসেব কষতে হয়েছে দিনরাত…।
কথা বলতে বলতে বৃদ্ধের ফরসা মুখ লালচে হয়ে উঠেছিল। উত্তেজিতভাবে তিনি হাত নাড়ছিলেন বারবার।
প্রলয়নাথ এরপর বললেন গিনিপিগের ওপরে তাঁর সিরামের সাফল্যের কথা। এবং সব শেষে বললেন তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার চরম ধাপের কথা–মানুষের ওপরে তার এক্সপেরিমেন্টের কথা, পরতাপ চওহানের কথা।
একটানা বহুক্ষণ কথা বলে এবং দাঁড়িয়ে থেকে বৃদ্ধ নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। টেবিলের কাছ থেকে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে একটায় নিজে বসলেন, আর অন্যটায় আমাকে বসতে অনুরোধ করলেন।
আমি আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকালাম : প্রায় সাড়ে আটটা। আজ কপালে ডিনার বলতে নির্ঘাত বিস্কুট কিংবা পাঁউরুটি আছে।
প্রলয়নাথ বোধহয় আমাকে লক্ষ করছিলেন, এবং ওঁর নজর যে যথেষ্ট ধারালো তার পরিচয় আগেই পেয়েছি। তার প্রমাণ হিসেবেই তিনি বললেন, আজ রাতে আমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়া করে যান, মোহনবাবু।
আমি সৌজন্য দেখিয়ে বললাম, না, না–তা কী করে হয়?
কেন তাতে অসুবিধের কী আছে! কথাটা বলে কাশলেন প্রলয়নাথ। কাশির আওয়াজ শুনে বেশ বোঝা যায়, ওঁর বুকে সর্দি বসে গেছে।
বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর দিকে তাকিয়ে আমার ওঁকে কেমন আনমনা লাগছিল। ওঁর চশমার কাছে আলো পড়ে চকচক করছিল। মনে হচ্ছিল, উনি যেন গভীরভাবে কী ভাবছেন।
একটা দুঃসাহসিক মতলব আমার মনের কোণে উঁকি মারছিল। কিন্তু আমার ভেতরের সৎ মানুষটা তাকে প্রাণপণ রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
প্রলয়নাথ আমাকে রোজ চায়ের নেমন্তন্ন করে খাওয়ান, সন্ধেটা আমার সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটান। এতে আমার দিব্যি কেটে যাচ্ছে। কিন্তু এই নিত্যকার নিষ্কলঙ্ক রুটিনে বাদ সেধেছে সুপ্রিয়া। ওকে আমি দেখিনি, ওর সঙ্গে আলাপ করার সুযোগও হয়নি, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওকে দেখার জন্যে আমার মনটা কেমন আকুল হয়ে উঠেছে।
বাথরুমের ছোট্ট জানলাটাই কি এই আকর্ষণের কারণ? বোধহয় না। হয়তো কলকাতার মন ভেঙে যাওয়া ব্যাপারটার পর আমার মন যে-কোনওভাবে শূন্যতা পূরণ করতে চাইছে। তা ছাড়া সুপ্রিয়াকে সামনাসামনি দেখার জন্যে, আলাপ করার জন্যে, আমারও কেমন জেদ চেপে গিয়েছিল।
প্রলয়নাথ-অনুরাধা এত মিশুকে, অথচ তা সত্ত্বেও ওঁরা সুপ্রিয়াকে পরদানশিন করে রাখবেন, এ কেমন ব্যাপার! তা হলে কি প্রতাপের সঙ্গে সুপ্রিয়ার কোনও গোপন সম্পর্ক আছে?
যতই ভাবছিলাম, মতলবটা ততই বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। তাই শেষ পর্যন্ত উন্মুখ বৃদ্ধকে বলেই ফেললাম, না, সেরকম অসুবিধের কিছু নেই, তবে খাওয়া-দাওয়া সারতে রাত হয়ে গেলে কোয়ার্টারে ফিরতে পারব কি না তাই ভাবছি।
আমি জানি, রাতের খাওয়া এখানে সারলে খাওয়ার টেবিলে নিশ্চয়ই সুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা হবে। তা ছাড়া, কে জানে আজকের নিঝুম রাত হয়তো চৌকো জানলার চেয়েও বাড়তি কিছু দিতে পারে আমাকে।
প্রলয়নাথের জেরাটোলজি আমার কাছে যতই একঘেয়ে আর অসহ্য হোক, সুপ্রিয়াকে দেখার জন্যে একটু-আধটু জরাবিজ্ঞান সইতে আমি রাজি আছি।
আমার ভাবনা-চিন্তা যতই ঘূর্ণি তুলতে লাগল সবকিছু ততই যেন জট পাকিয়ে যেতে লাগল।
ল্যাবরেটরি ছেড়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। প্রলয়নাথ ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘরের দরজায় শেকল তুলে দিলেন।
আমার ল্যাবরেটরি কেমন দেখলেন? আচমকা জানতে চাইলেন প্রলয়নাথ।
ভালোই…বেশ অ্যাট্রাকটিভ। বৃদ্ধের মন-রাখা জবাব দিলাম আমি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, এটাই আমার সব। এটার জন্যেই আমি বেঁচে আছি।
আমি নীরবে ঘাড় নাড়লাম।
প্রলয়নাথ এবার বললেন, চলুন, বসবার ঘরে বসবেন চলুন। আমি অনুরাধার সঙ্গে একটু কথা বলে যাচ্ছি।
অলিপথ বরাবর হাতের ইশারা করে আমাকে এগোতে বললেন তিনি। আমি আধো-আঁধারি পথ ধরে রওনা হলাম।
রাতের সঙ্গে-সঙ্গে ঠান্ডাও যে বাড়ছে সেটা এখন টের পেলাম। হাতে হাত ঘষে মুখ দিয়ে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। রান্নাঘরের দিক থেকে ঠিকরে আসা আলোয় দেখলাম, নিশ্বাসের বাষ্প জমাট বেঁধে ধোঁয়াটে দেখাচ্ছে।
নানান চিন্তা মাথায় নিয়ে এক-পা এক-পা করে এগোচ্ছিলাম আমি। আমাকে কি রাতে থেকে যেতে বলবেন প্রলয়নাথ? সে কথা বলার আগে কি স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে গেলেন? কে জানে!
হঠাৎই মিহি ফিসফিসে স্বরে কেউ আমার নাম ধরে ডেকে উঠল–মোহনবাবু।
আমি চমকে ফিরে তাকালাম শব্দের উৎস লক্ষ করে।
অলিপথের বাঁদিকে সিমেন্টের জাফরি বসানো একটা দেওয়াল। তার ওপাশটা অন্ধকার। কিন্তু জাফরির ফঁকফোকর দিয়ে একটা অবয়বের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। অবয়বটা যে কোনও মহিলার সেটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কে এই অবগুণ্ঠিতা?
আমার নীরব প্রশ্ন সে বোধহয় ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে টের পেল। তাই হয়তো মিষ্টি চাপা গলায় সসঙ্কোচে সে বলল, আমি…সুপ্রিয়া…।
বুকের ভেতরে ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে গেল পলকে। কেন জানি না, আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল।
আপনি…আপনি…সামনে আসুন.. কাঁপা গলায় অনুনয় করে উঠলাম আমি। চেনা পারফিউমের গন্ধ আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল।
আমি কারও সামনে যাই না। বলল মায়ারমণী, একটা…একটা অ্যাকসিডেন্টে আমার…আমার মুখ…পুড়ে গেছে। রান্না করার সময়…স্টোভ বার্স্ট করেছিল…।
আশ্চর্য! এই দুর্ঘটনার কথা তো প্রলয়নাথ কখনও বলেননি।
সুপ্রিয়ার কথা শুনে আমার মনটা খুব বিষণ্ণ হয়ে গেল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ওর প্রতি অলৌকিক টানটা ক্রমেই ভয়ংকর চেহারা নিচ্ছে।
আপনাকে আমি…আড়াল থেকে দেখেছি, মোহনবাবু বলল সুপ্রিয়া, আপনার সঙ্গে গল্প করতে ভীষণ ইচ্ছে করে।
আমার হাত-পা তখনও কাঁপছিল। বুঝতে পারছিলাম না, কী বলব, কী বলা উচিত।
সুপ্রিয়া কাঁপা স্বরে ওর নামটা বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে।
আ–আঃ! তৃপ্তির মিষ্টি শব্দ করল অন্ধকারের তরুণী, এই প্রথম কোনও যুবকের মুখে আমার নাম শুনলাম।
আমার মনে হচ্ছিল, এখনই ছুটে যাই জাফরির ওপাশে। তারপর…।
সুপ্রিয়া আবার ওর নাম ধরে ফিসফিসে স্বরে ডেকে উঠলাম আমি।
আজ রাতে থেকে যান, মোহনবাবু। রাতে আপনার সঙ্গে এসে আলাপ করে যাব। একটু থেমে তারপর ও ভয় নেই, আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। বরং লাভ হতে পারে।
কিছুটা দূরে কাশির শব্দ শুনলাম। বোধহয় প্রলয়নাথ আসছেন।
জাফরির ওপাশে সুপ্রিয়ার অবয়ব চকিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু পারফিউমের হালকা গন্ধটা ভারী বাতাসে অলসভাবে ভেসে রইল।
আমি তৎপর হয়ে বসবার ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। পেছনে পায়ের শব্দ এবার শোনা যাচ্ছিল। এবং একটু পরেই প্রলয়নাথ ঘরে ঢুকে ঘোষণা করলেন, আপনি রাতে খাওয়া-দাওয়া করে এখানেই থেকে যান, মোহনবাবু। কাল সকালে চা খেয়ে একেবারে কোয়ার্টারে ফিরবেন। তাতে আপনার মর্নিং ওয়াকটাও হয়ে যাবে।
.
কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামের বিছানায় শুয়ে ছিলাম বটে কিন্তু আমার চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। নানান চিন্তা, নানান কল্পনা বেপরোয়াভাবে ঘাই মারছিল মাথার ভেতরে। সুপ্রিয়া কখন আলাপ করতে আসবে? কতক্ষণ ধরে চলবে সেই আলাপ? আলাপের পর কী হবে?
যতই এসব কথা ভাবছিলাম, ততই মনে পড়ছিল সুপ্রিয়ার কথা। দুর্ঘটনা হয়তো ওর মুখের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু ওর অন্যান্য সৌন্দর্য কেড়ে নিতে পারেনি।
রাতে খাওয়ার টেবিলে ছিলাম আমরা দুজন–প্রলয়নাথ আর আমি। অনুরাধা আমাদের খেতে দিচ্ছিলেন। প্রতাপ ওঁকে থালা-বাটি-গ্লাস এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছিল। যথারীতি সুপ্রিয়ার দেখা মেলেনি।
খেতে-খেতেই আমি জিগ্যেস করেছিলাম, সুপ্রিয়া খেতে আসবে না?
অনুরাধা আমাকে ডাল দিচ্ছিলেন, হঠাৎই থেমে গেলেন, তাকালেন স্বামীর মুখের দিকে। হয়তো ভাবছিলেন, এই বোধহয় সুপ্রিয়ার অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপারটা প্রলয়নাথ আমাকে বলে দেবেন। কিন্তু প্রলয়নাথ চশমার ভেতর থেকে স্থির শান্ত চোখে অনুরাধাকে একবার দেখলেন, তারপর আমাকে বললেন, আপনাকে তো আগেই বলেছি, সুপ্রিয়া একা-একা থাকতে ভালোবাসে। ওর চোখে একটু প্রবলেম আছে–আলো একেবারে সহ্য করতে পারে না।
আমি বৃদ্ধের কথা এমনভাবে শুনছিলাম যেন টিভিতে খবর শুনছি। সত্যিই অদ্ভুত! একটা মিথ্যে ঢাকতে গিয়ে প্রলয়নাথকে কত মিথ্যে কথাই না বলতে হচ্ছে! সত্যি-সত্যি কী হয়েছে সুপ্রিয়ার? স্টোভ ফেটে অ্যাকসিডেন্ট? নাকি ওর চোখে সত্যিই কোনও প্রবলেম আছে?
তখনই আমার হঠাৎ সন্দেহ হল, প্রলয়নাথ জেরাটোলজির কোনও বিপজ্জনক এক্সপেরিমেন্ট চালাননি তো সুপ্রিয়ার ওপরে! তারই প্রকোপে হয়তো মেয়েটার মুখ পুড়ে গেছে। এখন বাবার লজ্জা ঢাকতে অপরিচিত অতিথিকে ও বলে ওর স্টোভ-অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
আমার সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল।
লক্ষ করছিলাম, অনুরাধা বারবার চোরাচাউনিতে আমাকে দেখছেন, জরিপ করার চেষ্টা করছেন যেন।
আর প্রতাপ? সেই তখন থেকে দেখছি মৃত্যুঞ্জয় প্রতাপ কেমন অদ্ভুত অপছন্দের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। অথচ একইসঙ্গে মনে হয় ও যেন কিছু বলতে চায় আমাকে। অনেকক্ষণ ধরে ও আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। যেন কিছু বলার জন্যে সুযোগ খুঁজছে।
খাওয়ার টেবিলে বসে প্রলয়নাথের পরিবারকে আমার কেন জানি না ভীষণ রহস্যময় মনে হচ্ছিল। অনেক গোপন কথা ওঁরা লুকিয়ে রাখতে চান।
খাওয়া-দাওয়ার শেষে অনুরাধা আমাকে বৃদ্ধ প্রলয়নাথের একটি লুঙ্গি ধার দিয়েছেন, তারপর আমাকে শোওয়ার ঘর দেখিয়ে দিয়েছেন।
ঘরটা একতলায়। বাড়ির পেছনদিকে সরু মাপের একটা সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলে ছোট্টমতো উঠোন। উঠোনের একদিকে কলতলা, আর-একদিকে তিনটে ঘর ও একটা সামান্য বড়, অন্য দুটো ছোট-ছোট। বড় ঘরটায় আমার শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।
পরে জেনেছি শেষের ছোট ঘরটায় প্রতাপ থাকে।
ঘরে সব ব্যবস্থাই ছিমছাম। বাঁ-দিকের দেওয়ালে নকশা ছাপা পরদা টাঙানো। ডানদিকে একপাশে ছোট খাটে বিছানা পাতা। বিছানার ওপরে লাল-খয়েরি আর সাদার ছিটে দেওয়া আকোলা প্রিন্টের বেডকভার। বিছানার পাশে মেঝেতে রাখা জলের জগ আর গ্লাস।
আমাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে অনুরাধা নিঃশব্দে চলে গেছেন।
আমি ঘড়ি দেখলাম : প্রায় দশটা বাজে। এখানকার হিসেবে গভীর রাত। সুতরাং জামাকাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পরে বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে পড়েছি। দিনের শেষ সিগারেট আরাম করে শেষ করে তারপর বেডসুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিয়েছি।
অন্ধকারে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। নানান ছবি একের-পর-এক ভেসে উঠতে লাগল মনের পরদায়। একইসঙ্গে জরাবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে রাতের বয়েসও বাড়তে লাগল।
হঠাৎই দরজায় টোকার শব্দ শুনলাম।
আমার বুকের ভেতরে একটা বিশাল পাথর যেন আচমকা টাল খেয়ে গেল।
নিশ্চয়ই সুপ্রিয়া এসেছে! এতক্ষণ পর্যন্ত একমুহূর্তের জন্যেও এই মেয়েটার চিন্তা আমার মন ছেড়ে যায়নি।
কম্বল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চটপট নেমে পড়লাম বিছানা ছেড়ে।
কিন্তু সত্যিই সুপ্রিয়া এসেছে তো?
দরজায় আবার টোকা পড়ল।
আমি দরজার কাছে গিয়ে চাপা গলায় জিগ্যেস করলাম, কে?
আমি…সুপ্রিয়া…।
দরজা খুলতেই শাল মুড়ি দেওয়া ছায়ারমণী ঢুকে পড়ল ঘরে। আমি চেনা পারফিউমের গন্ধ পেলাম। নেশাগ্রস্তের মতো ওকে ধরতে গেলাম, কিন্তু ও চকিতে সরে গেল অন্ধকারে।
আমি দরজায় খিল তুলে দিলাম। তারপর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মেয়েটাকে খুঁজতে লাগলাম। সে এক রোমাঞ্চকর বিচিত্র লুকোচুরি খেলা।
অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ফলে অন্ধের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎই যেন ওর শালের প্রান্ত আমার হাত ছুঁয়ে গেল। কিন্তু তারপরই সব শূন্য।
হঠাৎই ও ডেকে উঠল, মোহন, আমি এখানে…বিছানায়…।
আমার বুকের ভেতরে অন্যরকম আগুন জ্বলে উঠল। একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল বিছানায় দিকে।
যখন ওকে ছুঁলাম তখন আমার আঙুলের ডগা থেকে কাঁধ পর্যন্ত যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
সুপ্রিয়া! সুপ্রিয়া!
কম্বল মুড়ি দিয়ে আমরা দুজনে তখন কাছাকাছি চলে এসেছি। ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম সব মুছে গেছে আমার মন থেকে। সুপ্রিয়াই তখন একমাত্র সত্যি, আর সব মিথ্যে।
শীতের মধ্যে সব পোশাক খুলে ফেলতে বেশ সময় লাগল আমাদের। তারপর আমি পাগলের মতো আঁকড়ে ধরলাম ওর যৌবন। আমার মাথার ভেতরে শিরা দপদপ করছে। রক্তকণিকাদের পাগল করা দৌড় শুরু হয়ে গেছে প্রতিটি ধমনিতে।
সুপ্রিয়ার শরীর যে-কোনও পুরুষকে স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো। মাখনের মতো মোলায়েম, মার্বেল পাথরের মতো মসৃণ, আর ভরা দিঘির মতো টইটম্বুর।
তবে ভালোবাসার সময় ও মুখটা সরিয়ে রাখছিল আমার দিক থেকে। হয়তো দুর্ঘটনার পর থেকেই ওর মুখ স্পর্শকাতর। সেইজন্যেই ওকে একটিও চুমু খেতে পারছিলাম না। কিন্তু তা ছাড়া আর সবকিছুই করতে পারছিলাম।
আমাদের ঠোঁট চিরে অর্থহীন শব্দের টুকরো বেরোচ্ছিল। শরীরের উদ্দাম ঝড়ে আমরা জগৎসংসার ভুলে গিয়েছিলাম। চরম মুহূর্তে সুপ্রিয়া চাপা চিৎকার করে আমাকে আঁচড়ে কামড়ে একেবারে শেষ করে দিল। আমার মুখ দিয়েও চাপা গোঙানি বেরিয়ে এসেছিল। আর সেই সময়কার উত্তাল জোয়ারে আমাদের মধ্যে কোনও নিয়ম, কোনও প্রতিরোধ কাজ করছিল না।
হঠাৎই আমার ঠোঁট চলে গেছে সুপ্রিয়ার গালে। আর সঙ্গে-সঙ্গে একটা বরফের স্রোত নেমে গেছে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। খাটটা দুলে উঠেছে অন্ধকারে। হাত-পা পাথর হয়ে গেছে চোখের পলকে।
আর তখনই, অন্ধকার ঘরে আমি কাশির শব্দ পেলাম।
এই শব্দ আমার খুব চেনা।
হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল বুকের ভেতরে। আর একইসঙ্গে আমার হাত চলে গেল বেডসুইচের দিকে।
দু-একবার দপদপ করে জ্বলে উঠল টিউবলাইট।
তখন আমি প্রলয়নাথকে দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম অনুরাধাকে। আর একইসঙ্গে সুপ্রিয়াকেও দেখতে পেলাম।
অনুরাধা শুয়ে আছেন আমার বিছানায়। চোখে-মুখে অপরাধবোধের ছাপ। কিন্তু এ কোন অনুরাধা! এ কি স্বপ্ন, নাকি সত্যি!
অন্ধকারে সুপ্রিয়াকে আদর করার সময় আমার ঠোঁট স্পর্শ করেছিল অনুরাধার আঁচিল– ওঁর এককালের বিউটি স্পট। আমি অবাক হয়েছিলাম, ভয়ও পেয়েছিলাম। কারণ, মা ও মেয়ের ঠোঁটের ওপরে একই স্থানাঙ্ক আঁচিল থাকাটা আমার কাছে অসম্ভব, অবাস্তব মনে হয়েছিল।
কিন্তু এখন দেখলাম, ব্যাপারটা মোটেই অসম্ভব নয়। কারণ, অনুরাধা ও সুপ্রিয়ার শরীর একটাই। যে-অনুরাধাকে আমি আগে দেখেছি, এখন ওঁকে নগ্ন অবস্থায় দেখে বুঝলাম, আমার এতদিনের দেখাটা অসম্পূর্ণ ছিল।
অনুরাধার জরাগ্রস্ত চেহারা শেষ হয়েছে গলার ঠিক নীচে এসে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে জরাহীন দুরন্ত যৌবন। মুখ-গলা বাদ দিয়ে এই শরীরের দিকে তাকালে এই শরীরের বয়েস পঁচিশ ছাব্বিশ বলেই মনে হয়। এই শরীরকেই আমি বাথরুমের চৌকো জানলা দিয়ে দেখেছি? এই কি তা হলে সুপ্রিয়া? আমার অনুমান অন্তত তাই। বুঝলাম, এই হল প্রলয়নাথের সেই অলৌকিক ব্যাপার।
আমি অবাক হয়ে একই শরীরে জরা আর যৌবনের সহাবস্থান দেখছিলাম। চমক ভাঙল প্রলয়নাথের কথায়।
খসখসে গলায় বৃদ্ধ বললেন, আমাদের মাপ করবেন, মোহনবাবু…।
আমি প্রলয়নাথের দিকে ঘুরে তাকালাম।
বন্ধ ঘরে বৃদ্ধ ঢুকলেন কোথা দিয়ে? খেয়াল করে দেখি, ঘরের সামনের দেওয়ালের পরদা খানিকটা সরানো। আর সেই পরদার পেছনে চোখে পড়ছে একটা ছোট দরজা।
প্রলয়নাথের হাতে চশমাজাতীয় একটা বিদঘুঁটে যন্ত্রও ছিল। সেটার দিকে তাকিয়ে আমি গোটা ব্যাপারটা আঁচ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কূল পাচ্ছিলাম না।
বুঝতে পারছিলাম না, এখন আমার কী করা উচিত। আমি কি প্রাণভরে ভৎর্সনা করব এই দম্পতিকে? কাল সকালে ব্যাপারটা নিয়ে কি শোরগোল তুলব?
প্রলয়নাথ একটা মোড়া টেনে নিয়ে বিছানার কাছে এসে বসলেন। ওঁর বলিরেখাময় মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন তিনি।
আমি এর মধ্যে পোশাক পরে নিচ্ছিলাম। অনুরাধাও দেখলাম শাড়ি জামাকাপড় শাল গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছেন। ধীরে-ধীরে সুপ্রিয়া ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। অবশেষে পড়ে রইল এক পঁয়ষট্টি-সত্তর বছরের মহিলা, যার মাথায় কাঁচাপাকা চুল, গাল ভাঙা, মুখের চামড়ায় অগুনতি ভাঁজ, আর একটা চোখে ছানি পড়েছে।
কে বলবে, এই মহিলার শরীরে বাঁধা পড়েছে অবিশ্বাস্য দুকূল ছাপানো যৌবন।
মোহনবাবু তাকিয়ে দেখি প্রলয়নাথ মুখ তুলেছেন। চশমার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ওঁর চোখে জল–সুক্ষ্ম ধারায় সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে নাকের পাশ দিয়ে।
মোহনবাবু, আপনার কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই–সব খুলেই বলি। প্রলয়নাথ খসখসে ধরা গলায় বলতে শুরু করলেন, সুপ্রিয়া নামে সত্যিই আমাদের একটা মেয়ে ছিল। মাত্র চার বছর বয়েসে স্কুটার অ্যাকসিডেন্টে ও মারা যায়। সে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর হল। তবে, তার সঙ্গে আমার জেরাটোলজির এক্সপেরিমেন্টের কোনও সম্পর্ক নেই।
জরাবিজ্ঞান নিয়ে আমার এক্সপেরিমেন্ট যখন শুরু হয়, তখন গাছপালা আর ইঁদুর গিনিপিগের সঙ্গে-সঙ্গে অনুরাধার শরীরের ওপরেও আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকি। তবে অবশ্যই অনুরাধার অনুমতি নিয়ে। অনুরাধা আমাকে এত ভালোবাসে যে, কখনও আমার কোনও সাধে বাদ সাধেনি। তা ছাড়া বুটুন–মানে, সুপ্রিয়া মারা যাওয়ার পর আমরা দুজনেই বেঁচে থাকার কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন জরাবিজ্ঞানের গবেষণা আমাকে বাঁচিয়ে তুলল। আর অনুরাধাও তাতে সায় দিল।
বিছানার এক কোণে বসে থাকা অনুরাধার দিকে কোমল চোখে দেখলেন প্রলয়নাথ। তারপর ধরা গলায় বললেন, ওর ওপর দিয়ে যে কত ঝড়ঝাপটা গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝড় হচ্ছে আমার তৈরি করা কাউন্টার-এজিং সিরাম–এই সিরাম বয়েস বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে বাধা দেয়। কিন্তু সিরামে মনের মতো কাজ হল না।
অনুরাধার শরীরের সর্বত্র আমি এই সিরাম নিয়ম করে ইনজেক্ট করতাম। আর সাত-দশ দিন পরপর অনুরাধার শরীর খুটিয়ে লক্ষ করতাম। কিন্তু গোলমালটা একটুও টের পাইনি। সেটা টের পেলাম বছরদশেক পর। দেখলাম, ওর মাথা আর গলা বাদে সিরামটা কাজ করেছে। কিন্তু তখন থামারও উপায় নেই, আর ফেরারও পথ নেই। অনুরাধার শরীরের ভেতরে কোনও কোনও অংশে বয়েস ঠিকমতোই বাড়তে লাগল। কিন্তু শরীরের বাইরে–গলা থেকে পা পর্যন্ত ওর তিরিশের যৌবন অটুট রইল।
এই ব্যাপারটা লক্ষ করার পরই আমরা দুজনে স্রেফ খেলাচ্ছলে সুপ্রিয়ার জন্ম দিলাম আবার। অনুরাধাকে বলতাম, তোমার শরীরে সুপ্রিয়া বেঁচে আছে। আমি ওকে কখনও অনুরাধা, কখনও সুপ্রিয়া বলে ডাকি। জানি না, এ আমার পাগলামোনা মেয়েকে হারানোর শোকে তাড়া খাওয়া বাপের সেন্টিমেন্ট!
অনুরাধা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কান্না চাপা দিতে মুখে কাপড় গুঁজে দিলেন।
দেখতে-দেখতে আমি বুড়িয়ে গেলাম। অনুরাধার মনের অনেকটাই বুড়িয়ে গেল, আর শরীরের মধ্যে শুধু মাথা, আর গলা। সুতরাং এই বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে অনুরাধার অতৃপ্ত শরীর রাতের পর-রাত কাটাতে লাগল। ওকে পর্যবেক্ষণ করে আমি প্রতি সপ্তাহে পাতার-পর-পাতা নোট নিতাম। আমার অবাক লাগত। যে-শরীরে মা হওয়ার কোনও ক্ষমতা নেই, সেই শরীরে তৃপ্তির চাহিদা কোথা থেকে আসে! কেমন হতে পারে সেই তৃপ্তির প্রতিক্রিয়া? আমার ভীষণ কৌতূহল হত। আমার গবেষণার সম্পূর্ণ বিবরণ আমি পরের বিজ্ঞানীদের জন্যে রেখে যেতে চাই। তাই আমাকে যে জানতেই হবে! হাত মুঠো করে বিছানার ঠুকলেন প্রলয়নাথ। ওঁর উত্তেজনায় লালচে মুখে সত্যসন্ধানী বিজ্ঞানীর জেদ।
মাথার সাদা চুলে হাত চালিয়ে প্রলয়নাথ আবার বললেন, অনুরাধার অদ্ভুত শরীরের প্রতিক্রিয়া মানে, সেক্সয়াল রিঅ্যাকশন্সজানার জন্যে আমি পাগল হয়ে গেলাম। তখন নানানরকম ফন্দিফিকির করে কোনও যুবককে ডেকে নিয়ে আসতাম বাড়িতে। তাকে সুযোগ বুঝে লোভ দেখানো হত। ওই বাথরুমের জানলা দিয়ে। অথবা, অন্ধকারে জাফরির আড়াল থেকে অনুরাধা ওর মিষ্টি গলায় কথা বলত অচেনা মানুষটির সঙ্গে। তারপর রাতে থেকে যেত সেই অতিথি। এই ঘরটায় তাকে শুতে দেওয়া হত। গভীর রাতের অন্ধকারে অনুরাধা চলে আসত এই ঘরে। অতিথির সঙ্গে মিলিত হত এক অদ্ভুত রমণী।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন প্রলয়নাথ। মাথা নাড়লেন এপাশ-ওপাশ। তারপর চাপা খসখসে গলায় অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই বলে চললেন, অন্ধকারে যখন সেই মিলনের খেলা শুরু হত তখন…তখন আমি…এই হতভাগা জেরাটোলজিস্ট নিজের বুকে আঙুল ঠুকলেন তিনি ও ওই লুকোনো দরজা দিয়ে পরদা সরিয়ে ঢুকে পড়তাম এই ঘরে। তারপর অন্ধকারে এই চশমাটা চোখে দিয়ে সব দেখতাম। দুটো শরীরের প্রতিটি খুঁটিনাটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতাম। তারপর সেইসব তথ্য টুকে রাখতাম গবেষণার খাতায়।
হাতের চশমাটা আমাকে দেখালেন প্রলয়নাথ। ক্লান্ত স্বরে বললেন, এটার নাম সুপারস্কোপ অন্ধকারে দেখার চশমা–এটা দিয়ে ইনফ্রারেড আলো দেখতে পাওয়া যায়। ফলে ছবিগুলো অন্যরকম দেখায়। স্বাভাবিক রঙিন ছবির মতো নয়। কিন্তু তাতে আমার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের কোনওরকম অসুবিধে হয় না।
মোহনবাবু, এইসব যা-যা আমরা করতাম, আপনার সঙ্গেও ঠিক তাই করেছি। আপনি…আপনি দয়া করে এই বুড়ো-বুড়িকে মাপ করবেন। বিজ্ঞানের গবেষণার স্বার্থে আমরা আপনার কাছে অনেক কিছু গোপন করেছি, আপনাকে ঠকিয়েছি, লজ্জায় ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এ ছাড়া আমাদের আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।
অনুরাধার কান্নার শব্দ আমি টের পাচ্ছিলাম। তার সঙ্গে অপরাধবোধ আর গ্লানি মিশে ছিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আমি প্রতাপের কথা জিগ্যেস করলাম।
প্রলয়নাথ সুপারস্কোপটা চাদরের আড়ালে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, পাপের ওপরে আমি সিরাম ইজেক্ট করে গবেষণা করছি। আমার বিশ্বাস, এবারে আর কোনও ভুল হবে না। অনুরাধার বেলায় যে গণ্ডগোল হয়েছে এবারে যাতে সেরকম না হয় সেদিকে আমি খেয়াল রেখেছি। তা ছাড়া পাপ আমাদের ছেলের মতো… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ ও একদিন…আমার আর অনুরাধার ব্যাপারটা ও জেনে ফ্যালে। আমাদের বিপজ্জনক এক্সপেরিমেন্টের খবর পেয়ে যায়। তারপর থেকেই বাড়িতে কোনও তরুণ অতিথি এলে ও সেটা পছন্দ করত না। অথচ আমার মুখের ওপর প্রতিবাদও করতে পারত না। আমি ওর কষ্ট বুঝি, মোহনবাবু। অনুরাধার দুঃখও বুঝি। আর আপনার মনের অবস্থাও বুঝতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু কী করব বলুন! জরাবিজ্ঞানের স্বার্থে আমাকে যে সব জানতেই হবে।
বৃদ্ধ আবার চোখের জল ফেলছিলেন। ওঁর শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠছিল।
হঠাৎই তিনি উঠে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন দুহাতে। আবেগমথিত গলায় বললেন, মোহনবাবু, আপনার কাছে আমাদের একান্ত অনুরোধ, আমাদের এই রিসার্চের কথা আপনি কাউকে বলবেন না। কথা দিন, প্লিজ, কথা দিন…।
আমি কথা দিয়েছিলাম।
সেই বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা সেদিন আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। এবং সেই বিচিত্র রজনীতে আমি ঈশ্বরের কাছে মনে-মনে প্রার্থনা করেছিলাম, প্রলয়নাথের অলৌকিক গবেষণা সফল হোক। সত্যিই প্রতাপ চওহানের চিরযৌবনের কথা শুনে হতবাক হয়ে যাক সারা পৃথিবী।
পরদিন সকালে চোখের জলে ওঁরা দুজন আমাকে বিদায় দিয়েছিলেন।