মরা মানুষের হাত
প্রতিদিন সকালে লক্ষ লক্ষ মানুষ সুখের আশ্রয় ছেড়ে বাড়ি থেকে ঘুম-চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে পড়ে। তারপর রওনা হয় রেল স্টেশানের দিকে। ট্রেন এলেই লাফিয়ে উঠে পড়ে। গন্তব্য শহরের অফিস। সেই অফিসের ভিড়ে আমিও থাকি। ভোরবেলা ঘুমজড়ানো চোখে ঘরের আরাম ছেড়ে বাইরে বেরোতে ভালো লাগে না। কিন্তু উপায় নেই। ট্রেনে যাওয়া-আসার কষ্টের ব্যাপারে নতুন করে কিছু আর বলার নেই। গরমকালে যেমন গরম, শীতকালে তেমনই ঠান্ডা। অর্থাৎ, ট্রেন ভ্রমণের আমেজটুকু আর পাওয়া যায় না। তবে একইসঙ্গে কষ্টটাও অভ্যেস হয়ে গেছে।
গত দুমাস ধরে দেখছি ট্রেনগুলো কোন যাদুমন্ত্রবলে ঠিক-ঠিক সময়ে যাওয়া-আসা করছে। কিন্তু হঠাৎই, কিছুদিন আগে, শুরু হল ট্রেন ধর্মঘট। সুতরাং কলকাতায় যাতায়াতের ট্রেন উধাও হল।
ট্রেন বন্ধ থাকলে কলকাতা যাওয়ার একমাত্র উপায় হল গাড়ি অথবা ট্যাক্সি। তা হলে অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন! শত-শত লোক শত-শত গাড়ি, ট্যাক্সি অথবা টেম্পো ধরে রওনা হয়েছে শহরের দিকে। একইসঙ্গে একে অপরকে ডিঙিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এবং রেজাল্ট ট্র্যাফিক জ্যাম। সেসময় মনে রাগ, বিরক্তি ইত্যাদি মিশ্র অনুভূতির যে কী অদ্ভুত খেলা চলে তা এরকম অবস্থায় যে না পড়েছে সে ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। সেই ট্র্যাফিক জ্যামের লম্বা সারিতে আমিও গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। আর তখনই ঘটনার সূত্রপাত।
আমার বউ রুমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। ফলে ড্রাইভারকেও ছুটি দেওয়া আছে। সুতরাং আমি নিরুপায় হয়ে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছি অফিসে। নইলে ট্রেন চললে পর পেট্রলের ক্রমে-বেড়েওঠা দামের কথা ভেবে গাড়ি নিয়ে সচরাচর অফিসে যাই না। এখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়েও দেখছি বিপত্তি।
প্রথম কয়েকমাইল আমাদের সারিটা ধীরে-ধীরে বেশ এগোতে লাগল, কিন্তু একটা মোড় ঘুরতেই প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষলাম। আর-একটু হলেই সামনে দাঁড়ানো একটা সবুজ অ্যামবাসাডরের পেছনে ধাক্কা মারছিলাম। আমার সামনে পাশাপাশি তিন সার গাড়ি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। মনে-মনে বেশ বুঝলাম, শহরে পৌঁছানো পর্যন্ত ওই সবুজ অ্যামবাসাডরের পশ্চাৎদেশ হয়তো সারাক্ষণই আমাকে দেখতে হবে। তবে সবুজ রং দেখাটা শুনেছি ভালো–চোখ তাজা থাকে।
অফিসে পৌঁছোতে কঘণ্টা দেরি হবে সে-ভাবনা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এখন প্রশ্ন, এই গাড়ির জটলা থেকে মুক্তি পাব তো?
হঠাৎই পাশের এক গাড়ির আরোহী জানালেন, সামনে কোথায় নাকি একটা টেম্পো খারাপ হয়ে গেছে। চমৎকার! এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এগোনো পেছোনো সবই বন্ধ। হয়তো গাড়ির সিটে বড়ি কাত করে ঘুমিয়েই পড়তাম, কিন্তু মাঝে-মাঝে সবুজ অ্যামবাসাডারটা কয়েকইঞ্চি করে এগোচ্ছে আর যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ায় আমি সেই মহার্ঘ ইঞ্চিগুলো দখল করছি।
তখনই খেয়াল পড়ল স্টেশান ওয়াগনটার দিকে। মেরুন রঙের গাড়িটা আমার ডানদিকেই অচল হয়ে দাঁড়িয়ে। আমার ডানহাতের কনুই খোলা জানালার কিনারায় রাখা, আর ঠিক জানলা ঘেঁষেই মেরুন স্টেশান ওয়াগনটা। এত কাছে যে, ইচ্ছে করলে জামার হাতা দিয়ে ওটার গা পালিশ করে দেওয়া যায়।
আমরা পাশাপাশি রয়েছি। আমি মাঝে-মাঝে এমনিই তাকাচ্ছি গাড়িটার দিকে।
গাড়ি চালাচ্ছেন একজন অতি আধুনিক মহিলা। সাজগোজ উগ্র। ঠোঁটে লিপস্টিকের আগুন, চোখে কালো সানগ্লাস। একটা ছাই রঙের স্টোল শীতকে রুখতে অলস চেষ্টা করছে। মাঝে-মাঝে তিনি মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে দেখছেন, আবার নার্ভাসভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তবে তারপরেও আড়চোখে আমাকে দেখতে চেষ্টা করছেন।
যখন তার নজর আমার দিকে ব্যস্ত তখন তার সামনের গাড়িটা ফুটকয়েক এগিয়ে গেল। পেছনে দাঁড়ানো গাড়ির দল সম্মিলিতভাবে হর্ন দিয়ে উঠতেই তিনি চমকে উঠে এক প্রচণ্ড হ্যাঁচকায় গাড়িটা এগিয়ে নিলেন সামনে এবং সামনের গাড়িটা হঠাৎ থামতেই তিনিও সজোরে ব্রেক কষলেন। ভয়ংকর ঝাঁকুনি দিয়ে স্টেশান ওয়াগনটা থামল।
ওয়াগনটা সামনে এগিয়ে যাওয়ার ফলে তার পেছনের জানলাটা আমার জানলার পাশে এসে থামল, এবং আমি ওয়াগনের ভেতরটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ভেতরে চাদরে জড়ানো কী একটা যেন রয়েছে। ভদ্রমহিলা সজোরে ব্রেক কষার ফলে চাদরের একটা কোণ সামান্য সরে গেছে। সেই কোণ দিয়ে কিছু একটা বেরিয়ে এসেছে বাইরে।
সেদিকে একপলক তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আমার ক্লান্ত মস্তিষ্ক আমাকে তখন প্রাণপণে বোঝাতে চাইছে যে, আমার চোখ ভুল দেখেনি। সুতরাং আবার তাকালাম ওয়াগনের ভেতরে। না, প্রথমবারে আমি ভুল দেখিনি।
জিনিসটা একটা হাত–মানুষের হাত যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, ওয়াগনের জানালায় কাচ না থাকলে আমি হয়তো হাত বাড়িয়েই ওই হাতটা ছুঁতে পারতাম। হাতটার মাঝের দু-আঙুলে কালচে লাল কী যেন লেগে আছে–বোধহয় রক্ত। তা ছাড়া পুরোনো চাদরে জড়ানো জিনিসটার আকৃতি দেখে এই শীতে আমি ঘামতে শুরু করলাম। চাদরের নীচে অবশ্যই একটা বডি লুকোনো রয়েছে।
কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। আমার গাড়ির চারপাশে গাড়ির সমুদ্র। গাড়ির দরজা খুলব সে-উপায়ও নেই। তা ছাড়া, এই জগাখিচুড়ির মধ্যে গাড়ি ছেড়ে নামাও যাবে না।
হাত নেড়ে স্টেশান ওয়াগনের সানগ্লাস পরা ভদ্রমহিলার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলাম– কিন্তু বৃথাই। তিনি সরাসরি সামনের দিকে তাকিয়ে। এ অবস্থায় মনে পড়ে যায় রাতে দেখা দুঃস্বপ্নের কথা : যে স্বপ্নে কেউ আপনাকে তাড়া করে আসছে অথচ আপনি কিছুই করতে পারছেন না। এমনকী দৌড়তেও পারছেন না। আপনার পা দুটো যেন কেউ বেঁধে রেখেছে।
অবশেষে হর্ন বাজাতে শুরু করলাম। এবং একইসঙ্গে আঙুল দিয়ে স্টেশান ওয়াগনের পেছনটা দেখাতে লাগলাম।
আমার সামনের সবুজ অ্যামবাসাডরের ড্রাইভার রাগী দৃষ্টিতে পেছন ফিরে আমাকে দেখল। ভাবলাম, সে হয়তো নেমে আমাকে দুটো কথা শোনাতে ছুটে আসবে। কিন্তু যেভাবে গাড়িগুলো সব গায়ে-গায়ে দাঁড়িয়ে আছে তাতে সে দরজা খুলে নামতে পারবে বলে মনে হয় না।
এমন সময় স্টেশান ওয়াগনের লাইনের গাড়িগুলো এগোতে শুরু করল। ওয়াগনটা আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। তার চলার ভঙ্গিতে সবসময়েই একটা ব্যস্ত ভাব। ওটার পেছনের গাড়িটা আমাকে আড়াল করার আগেই স্টেশান ওয়াগনের নম্বরটা দেখে নিলাম। পকেট থেকে পেন নিয়ে বাঁ-হাতের তালুতে নম্বরটা লিখে রাখলাম। তারপর চুপচাপ বসে রইলাম। শরীরে একটা অদ্ভুত ক্ষীণ কঁপুনি টের পেলাম।
হঠাৎ আমার পেছনের গাড়ির অধৈর্য হর্নের শব্দে খেয়াল হল আমার লাইনের গাড়িগুলো এগোতে শুরু করেছে।
আরও মাইলকয়েক নির্ভাবনায় এগিয়ে গেল গাড়ির সার। আমি ইতিউতি চেয়ে মেরুন স্টেশান ওয়াগনটাকে দেখতে চেষ্টা করছি, আর একইসঙ্গে সবুজ অ্যামবাসাডরের সঙ্গে আমার সংঘর্ষ কোনওরকমে এড়িয়ে চলেছি।
একসময় রাস্তার কিনারায় দাঁড়ানো একটা লালরঙের দোতলা বাড়ি আমি অন্যমনস্কভাবে পার হয়ে গেলাম। পার হতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে চোখে পড়ল থানা লেখা বোর্ডটা। তক্ষুনি ব্রেক কষে রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলাম। পেছনে ছুটে আসা একটা কালো ফিয়াট বিকট আর্তনাদে ডানদিকে গাড়ি কাটিয়ে অ্যাকসিডেন্ট বাঁচাল। ততক্ষণে আমি গাড়ি থেকে নেমে থানায় ঢুকে পড়েছি।
পুলিশের ইউনিফর্ম পরে একজন সার্জেন্ট একটা টেবিলে বসে কীসব লিখছিল, আমাকে ছুটে ঢুকতে দেখে চমকে মুখ তুলে তাকাল।
কী চাই?
আমি একটা খুনের রিপোর্ট লেখাতে চাই। কথাগুলো বলার সময় নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হল।
তাই নাকি?
সে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ছাপানো ফর্ম মতো কী যেন বের করে নিল। তারপর কলম বাগিয়ে ধরে বলল, কাউকে আপনি চাপা দিয়েছেন?
না–আমি নয়। মানে, আমার পাশের গাড়িতে ওই হাতটা দেখলাম। একটা স্টেশান ওয়াগন, মেরুন রঙের, একজন ভদ্রমহিলা।
একমিনিট। আগে স্থির হয়ে বসুন।
একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল সে। তারপর নীচু গলায় প্রশ্ন করল, আপনার শরীর খারাপ হয়নি তো?
এ-প্রশ্নের জন্যে অফিসারটিকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, আমার এলোমেলো কথায় যে কেউই এ-সন্দেহ করবে। তবুও মুখে বললাম, না, শরীর খারাপ হয়নি।
ঠিক আছে। এবার বলুন। কেউ কি উন্ডেড হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে?
না, তা নয়। মানে, ওই হাতটা হঠাৎ বেরিয়ে–।
ও, বুঝেছি। তা হলে এক কাজ করা যাক। আপনার নাম দিয়েই শুরু করি। কী নাম আপনার?
অফিসার বাধা দেওয়ায় ধৈর্যচ্যুতি হলেও শান্ত কণ্ঠে নিজের নাম বললাম, সান্যাল রুদ্রে সান্যাল।
ঠিকানা?
তাও বললাম।
তখন অফিসারটি লেখার কাজ সেরে মুখ তুলল।
ঠিক আছে, মিস্টার সান্যাল। এবার বলুন কী ব্যাপার? একেবারে প্রথম থেকে ধীরে-ধীরে সব গুছিয়ে বলুন।
অতএব প্রথম থেকে সব গুছিয়ে বললাম।
আমার কথা শেষ হলে সার্জেন্ট থুতনিতে হাত ঘষল। বলল, হুম। আমাদের দেওয়ার মতো সেরকম কোনও তথ্য আপনার হাতে নেই, মিস্টার সান্যাল। ঠিক বলছেন, আপনি একটা হাত দেখেছেন? আপনার ভুল হয়নি তো? মানে, আমি বলছি, ওয়াগনটার পেছনের জানলার কাচটা হয়তো ময়লা ছিল।
ময়লা থাক আর না-ই থাক, ওটা একটা হাতই ছিল। আমার ভুল হয়নি। আর, হাতটায় রক্তের দাগ আমার স্পষ্ট নজরে পড়েছে।
আমি বোধহয় একটু চেঁচিয়েই উত্তর দিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ, সার্জেন্ট বলল, আস্তে, উত্তেজিত হবেন না।
সার্জেন্টের নাম অনুপম বক্সী। তার বুকে লাগানো প্লাস্টিকের চাকতি থেকেই নামটা জানতে পেরেছি। এখন ভাবতে গিয়ে দেখছি, সে তার নিজের কাজ ঠিকমতোই করেছে। তখন মনে হয়েছিল আমার সঙ্গে সময় নষ্ট না করে স্টেশান ওয়াগনের পেছনে তার দৌড়ানো উচিত ছিল। এবং সেকথা তাকে বলেছিলাম।
একবার বাইরে তাকিয়ে দেখুন, মিস্টার সান্যাল। রাস্তার গাড়ির ভিড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বলল, ধরে নিলাম আপনার ওই মেরুন স্টেশান ওয়াগনটা এই ভিড়ের মধ্যেই কোথাও আটকে আছে। কিন্তু হলে কী হবে? আমাদের গাড়ি তো আর উড়তে পারে না।
তা হলে যে করে হোক রাস্তাঘাট আটকানোর ব্যবস্থা করুন।
অসম্ভব। এখন রাস্তাঘাট আটকালে সারা শহর গাড়িতে ছেয়ে যাবে। দাঁড়ান, একমিনিট দাঁড়ান…।
এই বলে অনুপম বক্সী টেবিলে রাখা ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল। তারপর নীচু গলায় কার সঙ্গে যেন কথা বলতে লাগল।
না, চেক পোস্টে বরং খবর পাঠিয়ে দাও।
শুধু এই টুকরো খবরটুকুই আমার কানে এল।
মিনিটকুড়ি পরে সুইংডোর ঠেলে ঘরে ঢুকল টাক মাথা এক ভদ্রলোক। শক্তসমর্থ চেহারা, গালে দিনকয়েকের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে সাধারণ চেক শার্ট, কোট ও টেরিলিনের প্যান্ট।
অনুপম বক্সী নিচু স্বরে আমাকে বলল, ডিটেকটিভ অফিসার চৌধুরী। একটা ডাকাতির কেসে হেডকোয়ার্টার থেকে এখানে এসেছেন। কিছুদিন থাকবেন। ওঁকে সব খুলে বলুন। যা জিগ্যেস করেন জবাব দিন।
চৌধুরী ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। আমার দিকে ভুরু উঁচিয়ে বলল, আপনিই বুঝি মিস্টার সান্যাল? বলার হয়তো দরকার নেই তবু বলে রাখছি : আপনি যা বলতে এসেছেন তা সত্যিকারের জরুরি হলেই আপনার পক্ষে মঙ্গল। ডিউটির জন্যে টানা চোদ্দো ঘণ্টা আমি না ঘুমিয়ে আছি। এখন বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি।
কোনওরকমে বলতে শুরু করলাম, আমি একটা হাতের কথা বলতে এসেছি। আমার পাশের একটা স্টেশান ওয়াগনে হাতটা আমি দেখেছি।
হাত?–চৌধুরী অবাক হয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। তাকাল বক্সীর দিকে। বলল, সবরকমের মালই এখানে জোটে, তাই না বক্সী? ঠিক আছে, মিস্টার সান্যাল, বলুন–শুনি আপনার ওই হতচ্ছাড়া হাতের কথা।
সুতরাং আমার কাহিনির পুনরাবৃত্তি করলাম।
গল্পটা বলার সময় ভেবেছিলাম চৌধুরী হয়তো সামান্য হলেও অবাক হবে, উত্তেজিত হবে। কিন্তু সে একঘেয়ে বিরক্তির ভাব নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। যখন তাকে আমার বাঁ হাতে লেখা স্টেশান ওয়াগনের নম্বরটা দেখালাম, সে হাই তুলে একটা নোটবই বের করে নির্বিকারভাবে নম্বরটা টুকে নিল।
আমার কথা শেষ হলে সে বলল, মিস্টার সান্যাল, জনগণের সেবা করাটাই আমাদের কর্তব্য। সবার প্রতি সমান মনোযোগ ও সম্মান দেখানোটাই আমাদের নীতি। কিন্তু সত্যি কি আপনি বিশ্বাস করেন যে, আপনার এই গাঁজাখুরি গপ্পোটা আমি বিশ্বাস করব? হতে পারে আপনি হয়তো আসলে জানলার কাছে কোনও ছায়া দেখেছেন। হয়তো চাদরের তলা থেকে এমন কিছু বেরিয়ে এসেছে যেটা দেখতে অনেকটা হাতের মতো। কিন্তু এটা তো মানবেন, রাস্তার ভিড়ে গাড়ির পেছনে চাদরে মোড়া ডেডবডি নিয়ে কেউ চলাফেরা করে না। ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে দেখুন, মিস্টার স্যান্যাল। এবার চলুন, আমিও বাড়ি যাই, আর আপনিও বাড়ি ফিরে যান। এসব কথা ভুলে যান।
হয়তো তার কথায় রাজি হতাম। কিন্তু অবাক হলাম চৌধুরীর মুখের ভাব দেখে। তার মুখের অভিব্যক্তি চিৎকার করে যত না পারা যায় তার চেয়েও বেশি জোরে আমাকে পাগল কিংবা মিথ্যেবাদী বলছে। সুতরাং রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম, না। বাড়ি যাব না।
এ-রাগের কিছুটা চৌধুরীর ওপর : আমাকে বিশ্বাস করছে না বলে। আর বাকিটা নিজের ওপর ও এ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি বলে।
একটা হাত আমি দেখেছি। মরা মানুষের হাত। আপনারা পুলিশের লোক। আপনাদের বললাম। এবার যা হোক কিছু একটা করুন।
চৌধুরী গভীর শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর খেঁকিয়ে উঠল, ঠিক আছে, আমি এখুনি লোক লাগাচ্ছি। আপনি বাড়ি যান। যদি কিছু খুঁজে পাই আপনাকে জানাব। কিন্তু যদি স্টেশান ওয়াগনটা খুঁজে পাই এবং দেখি আপনার কথামতো কোনও ডেডবডি ওতে নেই, তা হলে মিস্টার সান্যাল, থিংস উইল বি ভেরি গ্রেভ ফর যু…।
রাগ করছেন কেন, চৌধুরীদা, শান্ত হোন। বক্সী এগিয়ে এসে চৌধুরীর পিঠে হাত রাখল।
ওদের এ অবস্থায় রেখে আমি বেরিয়ে এলাম থানা থেকে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা হলাম। এবং প্রথম সুযোগেই গাড়ি ঘুরিয়ে উলটোদিকে চলতে শুরু করলাম।
একসময় বাড়িতে এসে পৌঁছোলাম।
প্রায় এগারোটা নাগাদ খেয়াল হল অফিসে ফোন করে বলা হয়নি যে, আজ কাজে যাব না। ফোন করলাম। বস মোটেই খুশি হল না। এরকমটাই হবে ভেবেছিলাম।
এরপর ঘণ্টাতিনেক বসে রইলাম টেলিফোনের কাছে। ভাবলাম, এই হয়তো চৌধুরীর ফোন আসবে। কিন্তু এল না।
প্রায় সওয়া দুটোর সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।
দরজায় চৌধুরী দাঁড়িয়ে। কাঁধ অলসভাবে ঝুঁকে পড়েছে দুপাশে, হাত মুঠো পাকানো।
মিস্টার সান্যাল, আপনাকে শুধু বলতে এলাম, ওই গাড়ির নাম্বারটা নিয়ে আমরা খোঁজখবর করেছি।–চৌধুরীর কণ্ঠস্বর মাখনের মতো নরম ও ওয়াগনটাকেও আমরা খুঁজেও পেয়েছি। ওটার রং মেরুন আপনি যেমনটি বলেছেন। ওয়াগনের মালিক এক মহিলা মিসেস কণা মিত্র। তার বাড়ি এখান থেকে মাত্র মাইদুয়েক দূরে!
তাই নাকি? তা হলে তো একেবারে কাছে।অবাক হয়ে বললাম।
এবং আপনার কথামতো সেই ডেডবডিটাও আমরা খুঁজে পেয়েছি, মিস্টার সান্যাল।
ভদ্রমহিলাকে আপনারা অ্যারেষ্ট করেছেন…।–বলতে-বলতে মাঝপথে থেমে গেলাম। কারণ দেখলাম, চৌধুরী মাথা নাড়ছে।
না, গ্রেপ্তার করিনি। কারণ গ্রেপ্তার করার মতো কোনও ক্রাইম তিনি করেননি। কিছুই করেননি। কিন্তু আপনাকে একবার আমার সঙ্গে আসতে হবে, মিস্টার সান্যাল–আমরা মিসেস মিত্রের বাড়িতে যাব।
কিন্তু আপনি যা বলছেন তাতে আমার আর গিয়ে লাভ কী?
আপনাকে আসতেই হবে, মিস্টার সান্যাল, কারণ, না এলে আপনাকে আমি টানতে-টানতে নিয়ে যাব, ঢুকিয়ে দেব গাড়ির পেছনের ডিকিতে। গত পাঁচঘণ্টা ধরে আমি কীসের পেছনে ছুটে বেরিয়েছি সেটা আপনাকে দেখাতে চাই। তারপর, মিসেস মিত্রের কাছে আপনি ক্ষমা চাওয়ার পর, যদি কোনও কেসে আপনাকে ফাসাতে না পারি তা হলে বাধ্য হয়ে হয়তো আপনাকে ছেড়ে দেব।
চৌধুরীর সঙ্গে যাওয়ার পথে রাস্তার ধারের দোকানপাটের সাইনবোর্ডগুলো পড়তে থাকলাম। এ ছাড়া কিছু করারও ছিল না। চৌধুরী আমার দিকে একবার মুখ ফেরাল না পর্যন্ত। শুধু তাকিয়ে আছে উইন্ডশিল্ডের দিকে। চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে এসেছে। ঘন-ঘন নিশ্বাস পড়ছে।
.
মিসেস মিত্রের পাড়াটা ব্যবসায়ীদের পাড়া। সুতরাং জমজমাট।
একটা গলিতে গাড়ি ঢুকিয়ে থামল চৌধুরী। ইঞ্জিন বন্ধ করে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ওই যে, ওই বাড়িটায় আপনার খুনি থাকে।
বাড়ির দরজাটা আংশিক কাচের। এবং সেই ঘষা কাচের প্যানেলে লাল রং দিয়ে লেখা মিত্ৰ ডেকরেটার্স।
দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম আমরা। চৌধুরীই নক করল, আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই খুলে গেল দরজা।
গায়ে কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে যে-মহিলা আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে চিনতে আমার কোনও ভুল হল না। ইনিই ছিলেন সেই মেরুন স্টেশান ওয়াগনে।
মহিলার চেহারা শক্তসমর্থ, লম্বায় প্রায় আমারই সমান। হঠাৎ দেখলে অ্যাথলিট বলে ভুল হতে পারে। চোখে এখন সানগ্লাস নেই। সুতরাং, তেজি ঘোড়ার মতো উদ্ধত ভাবটা অত্যন্ত স্পষ্ট।
মিসেস মিত্র, ইনিই মিস্টার সান্যাল।–চৌধুরী ওঁকে বলল।
ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বরফ মাখানো এক সুদীর্ঘ দৃষ্টি উপহার পেলাম।
তারপর তিনি ঘুরলেন ইন্সপেক্টর চৌধুরীর দিকে। হাসলেন। প্রশ্ন করলেন, এঁর কথাই কি আপনি আমাকে বলছিলেন? যিনি আমার স্টেশান ওয়াগনটা রাস্তায় দেখেছেন?
হ্যাঁ, ইনিই।–চৌধুরীর স্বর আবেগহীন, শান্ত। সে আরও বলল, আমি ভাবছিলাম, আপনি যদি এঁকে…ইয়ে…ডেডবডিটা একটু দেখতে দেন–
নিশ্চয়ই দেখাব। দেখলে হয়তো ওঁর দুশ্চিন্তা কমবে। আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।
ঢুকেই ডানদিকে ভেলভেটের পরদা দেওয়া একটা ঘর। পরদা সরিয়ে সেই ঘরে আমাদের আহ্বান জানালেন মিসেস মিত্র।
ঘরটা বিশাল। দেখলে হঠাৎ করে কোনও কারখানা বলে ভুল হয়। অথবা মনে হতে পারে প্রাচীন কোনও টরচার-চেম্বার। কারণ, ঘরের এখানে সেখানে উলঙ্গ দেহ ও দেহের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পড়ে আছে। তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ তফাত নেই। চোখে স্থির শূন্য দৃষ্টি। ঘরের মাঝখানে একটা কাঠের বড় টেবিল। তার ওপর রং, তুলি, হাতুড়ি, পেরেক ইত্যাদি অগোছালোভাবে পড়ে আছে। এক কোণে চোখে পড়ে হাত-পায়ের স্তূপ। আর, একটা টেবিলে সাজানো সারি-সারি মাথা। তার কোনও-কোনওটায় চুল থাকলেও বেশিরভাগই টাকমাথা।
হাত বাড়িয়ে একটা মাথা ছুঁয়ে দেখলাম। রুক্ষ কঠিন। নিঃসন্দেহে প্লাস্টার অফ প্যারিস।
মিসেস মিত্র এগিয়ে গেলেন ঘরের একটা কোণের দিকে। চৌধুরী পকেট থেকে একটা দোমড়ানো সিগারেটের প্যাকেট বের করে তা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে রাখল। তারপর লাইটার জ্বেলে সেটা ধরাল। ভাবলাম ওর কাছ থেকে একটা সিগারেট চাইব, কিন্তু ও যে-চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সে-নজর ইস্পাতের ঠান্ডা পাতে পড়লে সহজেই সেটা ফুটো হয়ে যেত।
সুতরাং মিসেস মিত্র ফিরে আসা পর্যন্ত মেঝের দিকেই চেয়ে রইলাম। মিসেস মিত্র খালি হাতে ফেরেননি। কোলে করে নিয়ে এসেছেন একটা প্লাস্টারের ম্যানিকিন। তার রং মাখা মুখে বোকা বোকা হাসি।
এই হল রুকি, মিস্টার সান্যাল। মিসেস মিত্র আমাকে বললেন, এখানে তৈরি প্রতিটি মডেলের একটা করে নাম আছে। তাতে কাজের সুবিধে হয়। আজ সকালে আমার গাড়িতে আপনি নির্ঘাত ওকেই দেখেছিলেন। জানেন তো, আমি আর আমার হাজব্যান্ড মিলে নানান দোকানের শো-কেস মডেল দিয়ে সাজাই। বিশেষ করে কাপড়ের দোকান। মডেলগুলো আমরা তৈরি করি। আর দোকান থেকে দেয় মডেলের সব ড্রেস। ব্যস। তারপর আমাদের কাজ হল পোশাক-টোশাক পরিয়ে সেগুলোকে শো-কেসে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া। রুকি হল কলকাতার বিখ্যাত কাপড়ের দোকান যমুনালাল পান্নালাল-এর প্রপার্টি। মাত্র দু-দিন আগে ওকে নতুন করে আবার রং করেছি। আজ সকালে ওকে নিয়ে আমি যাচ্ছিলাম কলকাতায়।
একটু থেমে আবার বলে চললেন মিসেস মিত্র, ন্যুড অবস্থায় স্টেশান ওয়াগনে করে তো আর ডামিগুলোকে নিয়ে যাওয়া যায় না! তা হলে আপনার মতো আরও অনেকেই হয়তো ভুলভাল ভাববে। তাই প্লাস্টিকের কভার হাতের কাছে না পাওয়ায় একটা চাদর চাপা দিয়েই রুকিকে আমি নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রাস্তায় অতবার থামতে আর চলতে গিয়ে চাদরটা সরে যায়। তখনই ওর একটা হাত বাইরে বেরিয়ে পড়ে।
মিসেস মিত্র থামতেই আমি বললাম, কিন্তু আপনি তো রুকিকে যমুনালাল পান্নালালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তা হলে এখানে ওটা এল কী করে?
হাসলেন মিসেস মিত্র। বললেন, ও, এই কথা? আসলে কী হয়েছে জানেন, রং করার সময় ওর হাতে খানিকটা লাল রং চলকে পড়ে যায়। সে অবস্থায় ওকে তো আর শো-কেসে সাজানো যায় না। যমুনালালের দোকানে পৌঁছে যখন রুকিকে বের করতে যাই তখনই ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ে। ওই দেখুন।
আঙুল তুলে রুকির ডানহাত দেখালেন মিসেস মিত্র। সত্যিই তাই। কনুই থেকে শুরু হয়েছে। লাল দাগটা, এবং থেমেছে এসে ডানহাতের মাঝের দু-আঙুলের প্রান্তে।
এই হল আপনার রক্ত, মিস্টার সান্যাল।ব্যঙ্গভরে বলল চৌধুরী।
চৌধুরীর নজরে নজর মেলানোর চেয়ে হিমালয়ের চূড়া থেকে অতলান্ত সাগরে ঝাঁপ দিতেও আমি রাজি। চৌধুরীর গলা দিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত চাপা গর্জন বেরিয়ে এল। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভয় পেলাম।
আপনার তদন্ত শেষ হয়েছে, মিস্টার ব্যোমকেশ বক্সী?–চৌধুরীর তিক্ত ব্যঙ্গ যেন কেটে বসল আমার শরীরে : এবারে আমরা যাব। তার আগে ওই কোণের একটা প্লাস্টারের মেয়েছেলের সঙ্গে আপনি একটু ফস্টিনস্টি করে নেবেন?
কিছুই বলার নেই আমার। একটা সামান্য ডামির জন্যে একজন ক্লান্ত ডিটেকটিভকে দিয়ে আমি কী অমানুষিক পরিশ্রম করিয়েছি। তা ছাড়া একজন নির্দোষ মহিলাকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করেছি। কেন যেন মনে হল, চৌধুরী আমাকে এত সহজে ছাড়বে না।
চৌধুরী আমার বাড়িতে ফিরে এল। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ইঞ্জিন চালু রেখেই মুখ খুলল। মিসেস মিত্রের সামনে যেসব ভাষা চৌধুরী ব্যবহার করতে পারেনি তারই মহড়া দিল প্রায় দশমিনিট ধরে। আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে চুপচাপ সব শুনলাম। ভাবলাম, আমাকে এসব বলে চৌধুরী অন্তত একটু হালকা হোক।
বাড়িতে ঢুকে কাজের লোককে বললাম কড়া করে এক কাপ কফি দিতে। তারপর শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মনে-মনে নিজেকে হাজাররকম গালাগাল দিলাম। ভাগ্যিস রুমা বাড়িতে নেই। থাকলে ওর কাছে থেকেও একপ্রস্ত শুনতে হত।
সারাদিনের ক্লান্তির জন্যেই হোক, বা এতক্ষণের দুশ্চিন্তার জন্যেই হোক, মিনিটকয়েকের মধ্যেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার চোখ ও মন থেকে বাইরের পৃথিবী মুছে গেল।
*
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি মনে নেই, তবে ঘুম ভেঙে দেখি বাইরে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। অনেকে যেমন ঘুম ভাঙতেই লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে, আমি তেমনটা পারি না। ধীরে ধীরে অচেতন জগৎ থেকে আমি উঠে আসি চেতনার জগতে।
চোখ খুলে প্রথম তাকিয়েছি ঘরের জানলার দিকে। তখনই বুঝেছি সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়েছে। তারপর মনে পড়ল অনুপম বক্সীর কথা, এবং পরক্ষণেই ভেসে উঠল টাক মাথা অফিসার চৌধুরীর রুক্ষ মুখটা।
সমস্ত ব্যাপারটা ভুলতে আবার চোখ বুজলাম। চোখ বুজতেই আমার মন ভেসে গেল সারি সারি গাড়িতে টইটম্বুর সকালের রাস্তায়। আমি যেন আবার বসে আছি আমার গাড়িতে। সামনে সবুজ অ্যামবাসাডরটা। আর ডানদিকেই মিসেস মিত্রের মেরুন স্টেশান ওয়াগনটা। আমি তাকিয়ে আছি স্টেশান ওয়াগনের পেছনে রাখা চাদর-ঢাকা অবয়বটার দিকে। হঠাৎই চাদর সরে গিয়ে বেরিয়ে এল হাতটা। কিন্তু না, মানুষের হাত নয়। একটা প্লাস্টারের হাত। মিসেস মিত্রের স্টুডিয়োর সেই হতচ্ছাড়া ডামি, রুকির হাত। তবে
তখনই আমার তন্দ্রার ভাবটুকু নিমেষে মিলিয়ে গেল। স্পষ্ট বুঝলাম, চৌধুরী এবং আমি, দুজনেই বিরাট ভুল করেছি। মিসেস মিত্র চালাকিতে আমাদের টেক্কা দিয়েছেন। সকালের রাস্তার দৃশ্যটা স্পষ্ট আমার মনে ভাসছে। চাদরের নীচে কোনও মৃতদেহের বদলে আমি রুকিকে ভাবতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। কারণ লাল রংটা ছিল রুকির ডানহাতে, আর যে-হাতটা আমি গাড়িতে দেখেছি, সেটা কোনও মানুষের বাঁ-হাত!
বিছানায় বসে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি। চৌধুরীকে ফোন করে সব বলব? সে আমার কথা বিশ্বাস করবে তো? আর করলেও, এখন আমরা কী করব?
কী করব ভাবতে-ভাবতে আধঘণ্টা পার হয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে এল। অতিথি এসেছে আমার কাছে। যে-ই আসুক, সে নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছে। কারণ, কড়া নাড়ার খটখট শব্দটা যে আমার মাথার ভেতর থেকে আসছে না সেটা বুঝতে আমার বেশ সময় লেগেছে।
চৌধুরীকে ডাকব কি ডাকব না ভাবতে-ভাবতে দরজার কাছে গেলাম।
দরজা খুললাম।
দরজার দাঁড়িয়ে মিসেস মিত্র। গায়ে বিকেলের সেই কাশ্মীরি শাল। এবং একটা উলের মাফলার–যেটা তখন দেখিনি। সব মিলিয়ে তাঁর এই সাজ হাস্যকর। তবে তার হাতের মুঠোয় ধরা জিনিসটা মোটেও হাস্যকর নয়।
জিনিসটা একটা ০.৪৫ অটোমেটিক। তার নলের ফুটোটা সরাসরি আমার পেট লক্ষ্য করে তাকিয়ে আছে। এবং ফুটোর আকারটা আমার কাছে জলের পাইপের মতো বিশাল ঠেকল।
আমার প্রথম কথাগুলো যেমন এলোমেলো তেমনই অর্থহীন, তবে আমার সারাদিনের অবস্থার কথা ভাবলে সে-দোষ ক্ষমা করা যায়।
হাতের হিসেবটা আপনার ভুল হয়ে গেছে, তাই না মিসেস মিত্র?
হ্যাঁ। তাই ভাবছিলাম, এটা খেয়াল হতে আপনার কতটা সময় লাগবে। কথাটা বলেই বসবার ঘরে ঢুকে এলেন তিনি। দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন। তারপর বললেন, ইনস্পেক্টর চৌধুরী যখন দোকানে গিয়ে আমাকে আপনার কথা বললেন, তখন তাড়াহুড়ো করে ডামিটা আমাকে রেডি করতে হয়। আপনি কী দেখেছেন সেটা মিস্টার চৌধুরী আমাকে বলেছেন, কিন্তু কোন হাতটা যে চাদরের তলা দিয়ে বেরিয়ে ছিল তা বলেননি। সেটা আমারও ঠিক মনে পড়ল না। সুতরাং আন্দাজেই রুকির ডান হাতে রং লাগাতে হল। এবং আমার আন্দাজ ভুল হল। তবে মাত্র একঘণ্টা আগে সে-ভুলটা বুঝতে পারলাম। মনে পড়ল, চাদরের তলা থেকে যে-হাতটা বেরিয়ে ছিল সেটা বাঁ হাত।
আর আপনি ভাবলেন, আমার হয়তো সেটা খেয়াল পড়বে…।
মিসেস মিত্র হাসলেন। বললেন, রাস্তায় গাড়ির ভিড়ে আপনি আমার এত কাছে ছিলেন যে, এখন তোক পরে তোক এ-ব্যাপারটা আপনার মনে পড়তই। সুতরাং টেলিফোন-বই দেখে আপনার ঠিকানাটা বের করে চলে এলাম।
তা, এখন কী হবে?
আমরা একটু বেরোব, মিস্টার সান্যাল। প্রথমে আমরা আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করব। সে একজন বিল্ডিং কন্ট্রাক্টরের হয়ে কংক্রিট মিক্সার চালায়। আমার কথা সে চোখ বুজে শোনে– অবশ্য ঠিকঠাক দাম দিলে তবেই। তারপর যেখানে যাবেন সেখানে গিয়ে নীতিনের সঙ্গে আপনার দেখা হবে।
নীতিন? আজ সকালে চাদরের নীচে বুঝি উনিই ছিলেন?
মিসেস মিত্র সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন।
হ্যাঁ। নীতিন–আমার হাজব্যান্ড। সে একটা বেহেড মাতাল, লম্পট, কাপুরুষ। শয়তান হাসি ফুটে উঠল ওঁর ঠোঁটে। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, সে যাক, নীতিন তো আর নেই।
নেই? কোথায় গেছেন?
যেখানে গেলে আর ফেরা যায় না। মানে, নেক্সট ইয়ারে এই সময়ে ওর আত্মা ইহলোকের মায়া থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাবে, এবং একইসঙ্গে ওর কবরের ওপর গড়ে উঠবে হাই-ফাই এক লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট। সামনের সপ্তাহেই তার ফাউন্ডেশান স্টোন বসানো হবে।
টের পেলাম, আমার হাতের তালু দরদর করে ঘামছে। কিন্তু মরে গেলেও এই মহিলার কাছে আমি প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে অনুনয়-বিনয় করতে পারব না।
তা হলে আমি ও নীতিনবাবু একইসঙ্গে একই কবরে জায়গা পাচ্ছি?–প্রচণ্ড চেষ্টায় গলার স্বর সমান রাখলাম! কিন্তু হঠাৎ এরকমভাবে আমি উধাও হয়ে গেলে ইনস্পেক্টর চৌধুরী কি সন্দেহ করবেন না? বিশেষ করে আজকের ঘটনার পর?
যত প্রাণ চায় সন্দেহ করুক। চৌধুরী কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। তা হলে আমরা রওনা হই, মিস্টার সান্যাল?
রওনা হব কিনা ভাবছি, এমন সময় দরজার প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ শোনা গেল। বাইরে যে-ই থাকুক না কেন, আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই তার ভীষণ জরুরি দরকার।
মিসেস মিত্র কোণঠাসা বেড়ালের মতো চকিতে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন। কিছুটা যেন অস্থির হয়ে উঠলেন। একবার ভাবলাম, ওঁর হাতের রিভলভারের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু আমাদের মধ্যে দূরত্ব অনেক। চঞ্চল চোখে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে তিনি রিভলভারটা লুকিয়ে ফেললেন শালের আড়ালে। কিন্তু তখনও ওটা তাক করে রইল আমার দিকে।
কিছুটা ভয়ের গলায় মিসেস মিত্র আমাকে বললেন, যে এসেছে তাকে তাড়াতাড়ি তাড়ান। আর চালাকি করে পালানোর চেষ্টা করবেন না। আমি আপনার ঠিক পেছনেই থাকব। দরকার হলে একগুলিতে দুজনের লাশ ফেলে দেব।
দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। গভীর শ্বাস নিয়ে দরজা খুলে পাল্লাটা সামান্য ফাঁক করলাম। বাইরে যে দাঁড়িয়েছিল সে-ই বাকি কাজটা শেষ করল। ছিটকে খুলে গেল দরজা, এবং রকেটের গতিতে ঘরে ঢুকল চৌধুরী। এক প্রচণ্ড ধাক্কা মারল আমাকে। আমি বলতে গেলে উড়ে গিয়ে পড়লাম ঘরের অন্য প্রান্তে। দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে। মিসেস মিত্র অবাক হয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন, রিভলভারটা তখনও শালের আড়ালে লুকোনো।
শালা, শুয়োরের বাচ্চা!–আমার মুখের কাছে এসে খেঁকিয়ে উঠল চৌধুরী, তোমাকে আজ তুলে নিয়ে গিয়ে যক্ষ্মা-ধোলাই দেব। আজ যখন বড়সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছি তখন কী হয়েছে জানো? অপদার্থের মতো কাজ করেছি বলে তিনি আমাকে কথা দিয়ে এক থাপ্পড় মেরেছেন। এখন আমার সব প্রোমোশান সিল হয়ে যাবে, সান্যাল। শুধু তোমার জন্যে।
কথা শেষ হতেই সে আমার একটা হাত চেপে ধরল। এক হ্যাঁচকায় আমাকে তুলে নিয়ে প্রায় ছুঁড়ে দিল অন্য একটা দেওয়ালে। হাত-পা মুড়ে ছিটকে পড়লাম শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে। যন্ত্রণা যত না টের পাচ্ছিলাম তার চেয়ে অবাক হচ্ছিলাম বেশি।
নিরপরাধ নাগরিকদের মিছিমিছি হয়রান করা। বড়সাহেব এই কথা বলে আমাকে হেভি ঝেড়েছেন। চৌধুরী বলল। তারপর ঘুরে তাকাল মিসেস মিত্রের দিকে। উনিও আমার মতোই হতভম্ব, বিস্মিত।
আমি কিন্তু চৌধুরীর প্রমোশনের জন্যে মোটেও চিন্তিত নই। বরং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি।
মিসেস মিত্রকে লক্ষ করে চৌধুরী বলল, ভালোই হয়েছে, আপনিও এখানে রয়েছেন, মিসেস মিত্র। নইলে আমাকেই দেখা করতে যেতে হত। আপনি এই লোকটার নামে মানহানির মামলা করুন। একে পথের ভিখিরি করে ছাড়ুন।
চৌধুরী পায়ে-পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এল। আমি তখন কোনওরকমে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি।
সে চিৎকার করে উঠল, না, শুধু মানহানির মামলায় আমার পেট ভরবে না। তোমাকে সাতজন্মের শিক্ষা দিয়ে তবে ছাড়ব।
পা তুলে সে আমার পিঠে রাখল, তারপর প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল। তিরবেগে দরজা দিয়ে আমি ছিটকে গেলাম শোওয়ার ঘরে। মাথাটা ঠুকে গেল একটা বুকশেলফ-এর কোণে। এবং অবশেষে বিকট শব্দে আছাড় খেয়ে পড়লাম ফ্রিজের পাশে।
এবার ভয়ার্ত চোখে তাকালাম চৌধুরীর দিকে। শুধু রাগ হলে এ-ব্যবহারের মানে বুঝতাম, কিন্তু এ তো রাগ নয়, নৃশংস প্রতিশোধের জ্বালা।
কোটের ভেতর থেকে রিভলভার বের করে এনেছে চৌধুরী। এরা দুজন মিলে যদি আমার এগেইনস্টে যায় তা হলে আমার আর বাঁচার আশা নেই।
কিন্তু চৌধুরী শোওয়ার ঘরে ঢুকেই একপাশে আড়ালে সরে গেল। ইশারায় আমাকে বলল নীচু হয়ে লুকিয়ে থাকতে। তারপর মিসেস মিত্রকে লক্ষ করে চেঁচিয়ে বলল, রিভলভারটা ফেলে দিন, মিসেস মিত্র। মিস্টার সান্যালের আর কোনও ভয় নেই। আর আপনারও পালানোর পথ নেই। আই এম ইন চার্জ নাউ।
বিকট এক কানফাটানো শব্দে চৌধুরীর উত্তর এল। মিসেস মিত্রের রিভলভারের গুলি নিমেষে এসে বিঁধল শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে। কিছুটা সিমেন্ট-বালি খসে পড়ল মেঝেতে।
চৌধুরী সতর্ক ভঙ্গিতে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। রিভলভার ধরা হাতের কবজিটা চেপে ধরল অন্য হাতে। তারপর অত্যন্ত যত্নে নিশানা ঠিক করে নিয়ে একবার গুলি ছুড়ল।
বসবার ঘর থেকে এক ভয়ংকর তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার ভেসে এল। চৌধুরী লাফিয়ে বেরিয়ে গেল শোওয়ার ঘর থেকে। আমি একটু পেছন থেকে তাকে অনুসরণ করলাম।
দেখলাম, মিসেস মিত্র মেঝেতে পড়ে আছেন। ওঁর পাশে পড়ে থাকা রিভলভারটা চৌধুরী কুড়িয়ে নিল। মিসেস মিত্রের শালের সামনেটা আঠালো লাল রঙে মাখামাখি। তিনি জীবিত কি মৃত সেটা বোঝার জন্যে ডাক্তারি পরীক্ষার দরকার।
চৌধুরী আমাকে বলল, ফোন করে অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিন। এখনও হয়তো উনি বেঁচে আছেন।
অবশেষে একসময় মিসেস মিত্রকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার আমাদের আশ্বাস দিলেন যে, ওঁর প্রাণের কোনও আশঙ্কা নেই, এবং শিগগিরই তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মতো সুস্থ হয়ে উঠবেন।
মনে হল প্রায় কয়েকশো সাদা পোশাকের ডিটেকটিভ আসলে আট কি দশজন–আমার বাড়ি ছেয়ে ফেলেছে। সব গোলমাল মিটে যাওয়ার পর তাদের যা করণীয় তারা তাই করতে লাগল। তাদের কাজ শেষ হলে আমার বাড়ির যা অবস্থা হল তা আর বলার নয়। যেন বোমায় বিধ্বস্ত হিরোশিমা। আর চৌধুরী একটানা প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা না ঘুমোনোর ফলে ঘরে চলাফেরা করছে জীবন্ত এবং মাতাল মমির মতো।
ঘর ফাঁকা হলেও সে বিড়বিড় করে বলল, আপনার সঙ্গে একটু গায়ের জোর দেখিয়েছি আর গালিগালাজ করেছি বলে কিছু মনে করবেন না, মিস্টার সান্যাল। কিন্তু এখানে আসতে গিয়ে বাইরে মিসেস মিত্রের মেরুন স্টেশান ওয়াগনটা দেখে আমি চমকে উঠি। তখন উঁকি মারি বসবার ঘরের জানলা দিয়ে। ভেতরের নাটক, মিসেস মিত্রের রিভলভার, সবই আমার চোখে পড়ল। সুতরাং আপনাকে বাঁচাতে যে-বুদ্ধিটা মাথায় এসেছে সেটাই খাঁটিয়েছি।
না, না, ক্ষমা চাইতে হবে না। আমি বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু আপনি এখানে ফিরে এলেন। কেন? বিকেলবেলা তো আমি ভাবলাম, আপনি এ-মামলায় হাত ধুয়ে ইস্তফা দিলেন।
তাই করতাম। শুধু আমার বউয়ের জন্যে।–চৌধুরী জবাব দিল। আপনার বউ?
হ্যাঁ। বাড়ি ফিরে গিয়ে আপনার ওপর রাগে ঘুম এল না। সুতরাং বসে-বসে গোটা গল্পটা বউকে শোনালাম। আমার কাহিনি শেষ হলে ও শুধুই ঠোঁট ওলটাল। ডিটেকটিভের বউ হওয়ার ফলে ও জানে, এরকম হলে মনের অবস্থাটা কী হয়। কিন্তু হঠাৎই ও রেগে গিয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, তোমার কোটটা আবার দোকানে কাচতে দাও। কোটের হাতায় এসব কী লাগিয়ে এনেছ?
গৃহিণীরা যেরকম বলে থাকে সেরকম সুর ওর গলায়। আমার ক্লান্তির কথা, হতাশার কথা, ওর মনেও পড়ল না। কোটে দাগ লাগিয়েছি বলে খাপ্পা হয়ে উঠেছে আমার ওপরে।
ঠিক বুঝলাম না।
আমিও বুঝিনি…অন্তত তখন। তারপর কোটের হাতায় তাকিয়ে কী দেখলাম জানেন?
কী?
লাল রং।
তাতে কী?
সুতরাং, তখন আমি ভাবতে শুরু করলাম। লাল রংটা আমার কোটে একমাত্র যে-জায়গা থেকে লাগতে পারে তা হল রুকির হাত। মানে মিসেস মিত্রের ওই ডামি। আর তা যদি হয়, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই দুদিন আগে ওটা রং করেননি। অথচ তিনি আমাদের তাই বলেছেন। প্রথমে যখন আমি একা ওঁর বাড়িতে যাই তখন আমাকে ওটা দেখানোর মাত্র মিনিটকয়েক আগে তিনি রুকির ডানহাতে ওই লাল রংটা লাগিয়ে দেন। স্পষ্ট মনে আছে, আমাকে দরজার দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি একবার ওই স্টুডিয়োতে ঢোকেন এবং আমি যাতে রুকির হাতে হাত না দিই সে বিষয়ে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন। মনে হয়, ফেরার সময় হয়তো রুকির হাতে আমার কোটের হাতাটা ঘষে গিয়ে থাকবে।
একটু থেমে চৌধুরী আবার বলতে শুরু করল, সে যাই হোক, যদি রুকির হাত থেকেই ওই লাল রংটা এসে থাকে তা হলে এটা বুঝতে হবে মিসেস মিত্র ওই ডামিটা রং করে তৈরি রেখেছেন আমাকে বোকা বানানোর জন্যে–অর্থাৎ, তিনি আমাদের কাছে মিথ্যে কথা বলেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে আমি গাড়ি নিয়ে ছুটে গেলাম ওঁর বাড়িতে, কিন্তু দেখলাম, তিনি বাড়িতে নেই। তখন ভাবলাম, আপনার কাছেই আসি, একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে যাই ব্যাপারটা নিয়ে। এসে দেখি বাইরে মিসেস মিত্রের স্টেশান ওয়াগনটা দাঁড়িয়ে। বাকিটা তো আপনি জানেন।
একটা চেয়ারে এলিয়ে পড়ল চৌধুরী। যেন এই কথাগুলো বলে তার অবশিষ্ট শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার আরও একটা প্রশ্ন রয়েছে।
সুতরাং জিগ্যেস করলাম, ওঁর স্বামীর বডিটা কোথায়? তিনি বলছিলেন, কোথায় একটা বড় বাড়ি তৈরি হবে, সেই জমিতে নাকি পোঁতা আছে?
চৌধুরীর দু-চোখের পাতা যেন দু-দুটো ভারী পাথর। নিছক ইচ্ছেশক্তিতেই সে যেন চোখ খুলে রেখেছে।
এখন শুধু একটা প্রশ্ন নয়, অনেক প্রশ্ন… বিড়বিড় করে বলল চৌধুরী, কে মিসেস মিত্রকে সাহায্য করেছে? কীভাবে ওঁর স্বামীকে খুন করা হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর কাল থেকে খুঁজতে শুরু করব।
কিন্তু ডেডবডিটা খুঁজে পাবেন কী করে?
কোথায়-কোথায় নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেটা আমাদের খোঁজ করতে হবে। আমরা মিউনিসিপ্যালিটিতে গিয়ে খোঁজ নেব…।
সত্যি, এটা আমার মাথায় আসেনি। চৌধুরীকে মনে-মনে সাবাস দিলাম।
মিউনিসিপ্যালিটিতে খোঁজখবর নেওয়ার পর খুঁজে পাওয়া যাবে সেই বিল্ডিং কন্ট্রাক্টরকে। তারপর জানতে পারব কে মিসেস মিত্রের বন্ধু যে ওঁর সব কথা চোখ বুজে শোনে এবং সেই কন্ট্রাক্টরের কংক্রিট মিক্সার চালাতে পারে। তারপর–।
চৌধুরীকে সেকথা বলতে গিয়ে দেখি সে চেয়ারে বসে-বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
অতএব, মনে-মনে শুধু ভাবলাম, ভাগ্যিস ট্রেন স্ট্রাইক হয়েছিল!