দাগের বাইরে যাবেন না
ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল।
রাজরীতা টিভিতে ক্রাইম ডট কম প্রোগ্রামটা দেখছিল। রিমোটটা হাতে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল।
ফ্ল্যাটের দরজার অন্তত বারো ফুট দূরে দাঁড়িয়ে রিমোটের বোতাম টিপল রাজরীতা। স্পেশাল মেটাল ফাইবারের তৈরি দরজার মাঝখানের অংশটা পলকে স্বচ্ছ হয়ে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোককে দেখতে পেল রাজরীতা। কিন্তু ও জানে, বাইরে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখা যায় না। কারণ, দরজার এই স্বচ্ছতা একমুখী।
লোকদুটোর পরনে নীল রঙের ইউনিফর্ম। নামি কোম্পানির সার্ভিস বা মেইনটিন্যান্সের লোকজনদের যেমন পোশাক হয়। ওদের একজনের হাতে একটা মাঝারি মাপের পেটমোটা ব্যাগও আছে।
রাজরীতা দোটানায় পড়ল : দরজা খুলবে, কি খুলবে না?
এখন কলকাতায় খুন-জখম-চুরি-ডাকাতি ভীষণরকম বেড়ে গেছে। এইসব খবর নিয়েই ক্রাইম ডট কম প্রোগ্রাম। তাতে রোজ আধঘণ্টা ধরে পশ্চিমবঙ্গের যত ক্রাইমের খবর দেখানো হয়। সিকিওরিটি পুলিশ যেসব ক্রিমিনালকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের ছবিও দেখানো হয়। একটু আগে রাজরীতা সেইসব ছবিই দেখছিল।
দুজন লোকেরই চোখে চশমা, ঠোঁটের ওপরে পুরু গোঁফ। বয়েস খুব বেশি হলে তিরিশ বত্রিশ। একজনের মাথায় টুপি, আর-একজনের মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কাজের একঘেয়েমিতে মানুষের মুখে যে-বিরক্তির ছাপ পড়ে ওদের দুজনের মুখেই সেই ছাপের জেরক্স কপি।
দরজার কাছে গিয়ে ভয়েস সিস্টেম অন করল রাজরীতা। তারপর জিগ্যেস করল, কী চাই?
উত্তরে একজন বলল, ম্যাডাম, আমরা বিটা রেফ্রিজারেশান কোম্পানি থেকে আসছি। এই ফ্ল্যাট থেকে… পকেট থেকে একটা কম্পিউটার প্রিন্ট-আউট বের করে দেখল সে ও মিস্টার শত্রুজিৎ সোম আমাদের সার্ভিস কল দিয়েছিলেন। কল নাম্বার আর ডেট হল…।
শেষ কথাগুলো আর মন দিয়ে শুনল না রাজরীতা। ওর চট করে মনে পড়ে গেল। ওদের ফ্রিজটা কিছুদিন ধরেই গণ্ডগোল করছে। ফ্রিজের বাইরের পাইপ মেট্রিক্সে বরফ জমে যাচ্ছে। শত্রুজিৎ গত সপ্তাহে কোম্পানিতে খবর দিয়েছিল। নিশ্চয়ই তারাই লোক পাঠিয়েছে।
তা সত্ত্বেও লোকদুটোকে যাচাই করার জন্য রাজরীতা প্রশ্ন করল, বলুন তো, আমাদের ফ্রিজের রং কী? মডেল নাম্বার কত?
কম্পিউটার প্রিন্ট-আউট হাতে লোকটি দরজার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসল। রাজরীতাকে সে দেখতে পাচ্ছে না, তাই মুখে কেমন যেন একটা অস্বস্তির ছাপ।
আপনার ফ্রিজটা ব্লু রঙের, ম্যাডাম–অবশ্য যদি না আপনি ওটা এর মধ্যে প্রাইভেটলি অন্য রং করিয়ে থাকেন। আর মডেল নাম্বার বিটা-টু ওয়ান ফাইভ জিরো-এম। প্রিন্ট-আউটটা দেখতে দেখতে লোকটা আরও যোগ করল? আপনার ফ্রিজের সিরিয়াল নাম্বার হল…।
রাজরীতা সিরিয়াল নম্বরের জন্য আর অপেক্ষা করল না। কারণ, অন্য দুটো প্রশ্নের উত্তরে ওরা ফুল মার্কস পেয়েছে।
রিমোটের একটা বোতাম টিপে ও বলল, আসুন–ভেতরে আসুন।
দরজার পাল্লা একপাশে সরে যেতেই মুখে সৌজন্যের হাসি নিয়ে দুজন কর্মী মসৃণ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে পড়ল।
দরজার পাল্লা আবার ফিরে এল আগের জায়গায়। তারপর নিজে থেকেই লক হয়ে গেল।
বিশাল ড্রইং-ডাইনিং স্পেসের ওপরে একপলক চোখ বুলিয়ে নিল দুজনে। ওদের চাহনিতে সতর্কভাবে জরিপ করার দৃষ্টি। রাজরীতার কেমন যেন খটকা লাগল।
ঘরের একপাশে সাজানো টি-টেলের কাছে গিয়ে ব্যাগটা টেবিলে নামিয়ে রাখল একজন। তারপর সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে চোখে-চোখে কী যেন কথা হল। এবং দুজনেই আয়েসি ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়ল।
ব্যাপারটা রাজরীতার কাছে নেহাতই অসভ্যতা বলে মনে হল। তবুও ও ভাবল, হয়তো ওরা সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত–তাই সৌজন্য না দেখিয়েই সোফায় বসে পড়েছে।
ঘরের পুবদিকের দেওয়ালে টিভিতে ক্রাইম ডট কম চলছিল। ওদের একজন ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে দেখছিল। আর অন্যজন রাজরীতার দিকে তাকিয়ে ভুরু উঁচিয়ে অশালীন ঢঙে হাসছিল।
হঠাৎই হাসি থামিয়ে টিভি-দেখা সঙ্গীর কাঁধে বাঁ-হাতে চাপড় দিল সে। বলল, অত কী দেখছিস! আজ নয় কাল আমাদের পিকচার ক্রাইম ডট কম-এ দেখাবে।
রাজরীতার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ল।
ও কাঁপা গলায় বলল, আপনাদের আইডি কার্ড দেখি।
দেখাচ্ছি। বলে একজন টেবিলে রাখা ব্যাগটা খুলে তার ভেতর থেকে অদ্ভুত চেহারার একটা বন্দুক বের করল।
খট করে একটা বোতাম টিপতেই বন্দুকের মাথায় লাগানো একটা চাকতির ভেতরে উজ্জ্বল লাল আলোর একটা বিন্দু জ্বলে উঠল।
রাজরীতা চিনতে পারল? লেজার পয়েন্টার।
আলোর বিন্দুটা রাজরীতার কপালের ঠিক মাঝখানে তাক করল সে।
রাজরীতাকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও যেন কপালে আগুনের টিপ পরেছে। ওর গলা তখন শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভেতরে ভারী লোহার বল পরপর গড়িয়ে দিচ্ছে কেউ।
বন্দুক-হাতে ধরা লোকটি ঠান্ডা গলায় বলল, ম্যাডাম, আমাদের বাধা না দিলে কোনও প্রবলেম হবে না। তারপর টিভি-দেখা সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি, চটপট কাজ শুরু কর।
নিকি তাড়াতাড়ি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিলে রাখা ব্যাগটা খুলে দুটো জিনিস বের করে নিল। তার একটার চেহারা সফ্ট ড্রিঙ্ক এর ক্যানের মতো। তবে তার গায়ে কতকগুলো বোতাম আর বাতি রয়েছে। আর অন্যটা একটা লম্বাটে কালো বাক্স।
ক্যানের মতো যন্ত্রটা ঘরের এক কোণে বসিয়ে অন করে দিল নিকি। তারপর পটাপট কয়েকটা বোতাম টিপল। ওটার গায়ে একটা ছোট্ট এলইডি বাতি লাল চোখের মতো দপদপ করে জ্বলতে নিভতে লাগল।
নিকি রাজরীতার দিকে তাকিয়ে হাসল এখন আর কোনও রেডিয়ো সিগনাল এ-ঘরে কাজ করবে না। সব সিগনাল জ্যাম করে দিলাম।
নিকির সঙ্গী টেবিলে আঙুল ঠুকতে-ঠুকতে বলল, একদম চেঁচামেচি করবেন না, ম্যাডাম। করলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না, ডাক্তারদেরও আর কিছু করার থাকবে না। আপনি হয়তো ভাবছেন, এ-ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় লুকোনো ভিডিয়ো ক্যামেরায় আমাদের ছবি উঠে গেছে। পরে সেই ছবি দেখে সিকিওরিটি পুলিশ আমাদের খুঁজে বের করবে– বিচ্ছিরিভাবে হাসল : ওসব কিছুই হবে না। যদিও কাল ক্রাইম ডট কম-এ আপনি আমাদের এই ছবিই দেখতে পাবেন। একটু থামল। তারপর তার কারণ কী জানেন? কারণ, আসলে আমরা অন্যরকম দেখতে।
কথা বলতে-বলতেই মাথার টুপি খুলে ফেলল সে। তারপর একে একে পরচুল, চশমা এবং নকল গোঁফ টেবিলে নামিয়ে রাখল।
ন্যাড়া মাথা লোকটিকে এখন সত্যি-সত্যিই একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছিল।
নিকি তখন ফ্ল্যাটের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কালো বাক্সটা হাতে নিয়ে কীসব খুটখাট করছিল। রাজরীতাদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ভিকি, আমাকেও কি উইগ-টুইগ সব খুলতে হবে নাকি?
ভিকি বলল, না, না, আর দরকার নেই। ম্যাডাম, বুঝতে পারছেন।
কালো বাক্সটা দরজার কাছে নামিয়ে রেখে তালি দিয়ে হাত ঝাড়ল নিকি? ভিকি, এদিককার কাজ শেষ। এখন দরজার লকটাকে কেউ হাজার চেষ্টা করেও বাইরে থেকে আর খুলতে পারবে না। এবার এ-ফ্ল্যাটে আমাদের রাজ চলবে। দেওয়ালের টিভি পরদার দিকে একপলক তাকিয়ে তারপর ও ওখানে ক্রাইম ডট কম চলুক, আর এখানে আমাদের ফুর্তি ডট কম শুরু হোক। কী বলো, গুরু!
না, না! ফুর্তি ডট কম নয়–ফুর্তি ডট বেশি! ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হাসল ভিকি। তারপর রাজরীতার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, ম্যাডাম, আপনার হাজব্যান্ড নিশ্চয়ই এখন অফিসে?
হ-হ্যাঁ। কোনওরকমে ঘাড় নাড়ল রাজরীতা। ওর মুখের ভেতরে গিরগিটির চামড়ার তৈরি জিভটা জলের অভাবে ধুকছে।
আমরা অবশ্য কদিন ধরেই আপনার এই একশো তিনতলার ফ্ল্যাটের ওপরে ওয়াচ রেখেছিলাম। এই মালটিস্টোরিড বিল্ডিং-এ আমরা আগেও কাজ করেছি। তবে তখন অন্যরকম মেকাপ নিয়েছিলাম। আপনাকে একদিন সিঁড়িতে দেখার পর থেকেই আমাদের দুজনেরই মাথা ঘুরে গেছে। আপনি যেমন সুইট তেমনই বিউটিফুল। বাগানে গোলাপফুলের জায়গায় আপনাকে দিব্যি সাজিয়ে রাখা যায়।
বিউটিফুল ডট কম! নিকি বলল, রাজরীতার কাছে এসে দাঁড়াল।
না, না, বিউটিফুল ডট বেশি! বলেই হো-হো করে হেসে উঠল ভিকি।
ওদের কথাবার্তা আর হাসির শব্দে দশ-বারো বছরের একটি ছেলে ঘরে এসে ঢুকল। ঢুকেই নিকি আর ভিকিকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।
আপনার ছেলে?
প্রশ্নটা কে করল রাজরীতা ঠিক খেয়াল করল না। শুধু কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে ও জানাল, হ্যাঁ।
ওর বুকের ভেতরে তুমুল হুলস্থুল চলছিল। একটু আগেই কেমন নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন কাটাচ্ছিল ও! আর এখন, মাত্র পনেরো কুড়ি মিনিটেই, চরম বিপদসীমায় পৌঁছে গেছে!
একটু আগে যখন ও এ-ঘরে টিভি দেখতে এসেছিল তখন ওর মনে শুধু স্বপ্ন ছিল–কোনও দুঃস্বপ্ন ছিল না। ও রিমোটের বোতাম টিপতেই ঘরের পুবদিকের দেওয়ালের খানিকটা অংশ টিভির পরদা হয়ে গিয়েছিল। রঙিন ছবিতে একজন সুন্দরী মেয়ে নানান অনুষ্ঠানের খবর বলছিল, আর এককোণে একটা ইলেকট্রনিক ঘড়ি রিয়েল টাইম জানিয়ে দিচ্ছিল।
ঠিক তিনটে বাজতেই শুরু হল ক্রাইম ডট কম মানে, পশ্চিমবঙ্গের যত খুন-জখম রাহাজানির খবর। রাজরীতা প্রতিদিন নিয়ম করে এই প্রোগ্রামটা দ্যাখে। এই প্রোগ্রামটা প্রতিদিন বিকেল তিনটেয় দেখানো হয়–যাতে ঘরে থাকা মানুষজন সতর্ক হতে পারে, নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারে।
২০২০ সাল নাগাদ ভারতে সাইবারস্পেস বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইন্টারনেট, ই-মেইল, ই-কমার্স, আরও কত কী! তারপর ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি যতই লাফিয়ে-লাফিয়ে এগিয়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে জনসংখ্যা আর খুন-জখম-রাহাজানি। এইভাবে দেড়শো বছর পেরোতে-না পেরোতেই পুলিশি ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। ক্রাইম ডট কম প্রোগ্রামে রোজই দু-চারটে পুলিশ খুনের ঘটনা কিংবা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার ঘটনা থাকে। তাই ব্যাঙের ছাতার মতো যত রাজ্যের সিকিওরিটি কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। তাদের ব্যবসা দিনকেদিন বেড়েই চলেছে। আধুনিক থেকে আরও আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
এখন রাস্তায় বেরোলে সবাইকে সিকিওরিটি ভ্যানে করে যাতায়াত করতে হয়। ওগুলোই হল বাসের বিকল্প। এ ছাড়া ট্যাক্সি বা প্রাইভেট কার মানেই আর্মার্ড কার–সবসময় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি। সন্ধের অন্ধকার নেমে এলেই লোকজন যার-যার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তখন শুরু হয় বেপরোয়া উচ্চুঙ্খল ক্রিমিনালদের দিন।
ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এই একই অবস্থা। রোজ কম্পিউটারে ইলেকট্রনিক নিউজপেপার দেখলেই বোঝা যায় আইন-শৃঙ্খলা কী বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে।
ক্রাইম ডট কম দেখতে-দেখতে এসব কথাই ভাবছিল রাজরীতা।
শত্রুজিৎ অফিসে গেছে। ও ক্যালকাটা স্পেস রিসার্চ সেন্টার-এ অ্যাভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার। ওদের একমাত্র ছেলে মনোরম পাশের ঘরে কম্পিউটার টার্মিনালে বসে স্কুলের ক্লাস করছে। ওদের লার্নিং নেটওয়ার্ক-এ একসঙ্গে প্রায় দুশো ছেলে বাড়িতে বসেই ক্লাস করতে পারে। মাঝে-মাঝে শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য ওদের স্কুলে যেতে হয়।
ফুটবল-মাঠের মতো এই বিশাল ফ্ল্যাটে রাজরীতার সময় কাটে টিভি দেখে, কম্পিউটার গেমস খেলে, অথবা সেলফোনে শত্রুজিতের সঙ্গে কথা বলে। বিকেলবেলা ও মনোরমকে নিয়ে কাছেই মিলেনিয়াম পার্ক-এ বেড়াতে যায়। তার জন্য ওর আর্মার্ড কার রয়েছে। আর রয়েছে ঝুমকি ওদের প্রাইভেট সিকিওরিটি গার্ড। গতমাসেই ওকে আলটিমেট সিকিওরিটি কোম্পানি থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছে শত্রুজিৎ। পরিস্থিতি ক্রমশ যেদিকে যাচ্ছে তাতে কোনওরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থাই আর যথেষ্ট নয়।
টিভিতে খবর থামিয়ে বিজ্ঞাপন চলছিল।
আলফা ট্যুর নামে একটা কোম্পানি মাত্র এক লক্ষ টাকায় চাঁদে দু-দিনের জন্য বেড়িয়ে নিয়ে আসবে। এনার্জি পাউডার রোজ এক চামচ খেলেই ক্লান্তি আর অবসাদ ভয়ে পালাবে। স্পিড শু মের মোটর লাগানো জুতো পায়ে দিলে বিনা পরিশ্রমে গাড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোটা যাবে। শনির উপগ্রহ টাইটানে একটা অ্যাডভেঞ্চারের ব্যবস্থা…।
হঠাৎই ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠেছে। তারপর…।
কী হয়েছে, মাম্মি? অচেনা লোকদুটোকে একপলক দেখে নিয়ে মনোরম অবাক হয়ে মা কে জিগ্যেস করল।
কিচ্ছু হয়নি, খোকা। তোমার মায়ের সঙ্গে আমরা একটু জরুরি কথা বলছি। তুমি যাও– তোমার ঘরে চলে যাও।
কথাগুলো বলতে-বলতে ভিকি মনোরমের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল। কখন যে ও বন্দুকটা লুকিয়ে ফেলেছে রাজরীতা খেয়াল করেনি।
আলতো করে মনোরমের পিঠে হাত দিয়ে ওকে ওর পড়ার ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগল ভিকি।
কী করছিলে তুমি?
কম্পিউটারে ইন্টারঅ্যাকটিভ লার্নিং সেশানে বসেছিলাম।
বাঃ, চমৎকার। গুড বয়। যাও, পড়াশোনা করো গিয়ে। এক্ষুনি আমাদের কথা শেষ হয়ে যাবে।
মনোরমকে পড়ার ঘরে ঢুকিয়ে ওর ঘরের দরজাটা লক করে দিল ভিকি।
আর সঙ্গে-সঙ্গে নিকি চটপট পরচুল, চশমা আর গোঁফ খুলে রেখে রাজরীতাকে পিছন থেকে হ্যাংলার মতো জড়িয়ে ধরল। ওর ঘাড়ে গলায় মুখ ঘষতে লাগল পাগলের মতো।
রাজরীতা ধস্তাধস্তি করছিল। ভয় আর ঘেন্না ওকে কাবু করে দিতে চাইছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও লড়াই করতে পারছিল।
ভিকি ছুটে এল ওদের কাছে। দুপাশে দু-হাত ছড়িয়ে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, তুমি একা শেষ কোরো না/আমার জন্যে একটু রেখো। সোনা-দানা আর যা আছে/তন্নতন্ন খুঁজে দেখো।
ছড়া কাটতে কাটতেই রাজরীতাকে টপ করে চুমু খেল ভিকি। তারপর ওকে দু-হাতের দশ আঙুলে আদর করতে শুরু করল।
রাজরীতার পিছনে দাঁড়িয়ে নিকি ওর পিঠে-কোমরে যত্রতত্র মুখ ঘষছিল। ওর দু-হাত বেপরোয়াভাবে যেখানে-সেখানে হামলে বেড়াচ্ছিল।
ভিকির ছড়া কাটার উত্তরে ও কোনওরকমে জড়ানো গলায় বলল, আগে মাম্মি-সোনাকে তন্নতন্ন করে সার্চ করি, পরে মেটাল-সোনা খুঁজে দেখব।
নিকি আর ভিকি জানে, এখানকার সব ফ্ল্যাটের দেওয়াল সাউন্ডপ্রুফ। সুতরাং রাজরীতা চিৎকার করলেও কোনও ক্ষতি নেই। পাশের ঘরে ওর ছেলেও সে চিৎকার শুনতে পাবে না। এর নাম প্রাইভেসি!
টিভিতে একটা গানবাজনার প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাজনার বাজখাঁই জগঝম্পে কানে তালা লাগার জোগাড়। কিন্তু নিকি আর ভিকির তাতে সুবিধেই হচ্ছিল।
মানুষের আদিম প্রবৃত্তির বশে এবার চিৎকার করে উঠল রাজরীতা।
ওর পরনের পোশাক এর মধ্যেই ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। মাথার চুল এলোমেলো। বড়-বড় শ্বাস পড়ছে। চোখে শুধুই আতঙ্ক।
ওর চিৎকার কেউ শুনতে পেল বলে মনে হল না।
হঠাৎই ওর ঝুমকির কথা মনে পড়ল।
মহাশূন্যে ভেসে যেতে-যেতে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো ও ঝুমকির নাম ধরে গলা ফাটিয়ে ডেকে উঠল।
তার দু-চার সেকেন্ডের মধ্যেই একটা বেডরুমের দরজা খুলে ঝুমকি এ-ঘরে উঁকি মারল।
বছর আঠারো কুড়ির মিষ্টি মেয়ে। রোগা, ফরসা। যৌবন চোখে পড়ার মতো। খোলা চুল কী এক শ্যাম্পুর কল্যাণে লম্বা টান-টান হয়ে ঝুলছে। কপালের ওপরেও চুলের পরদা নেমে এসেছে। পরনে আকাশ-নীল চুড়িদার।
আঙুল দিয়ে চোখ ঘষছিল ঝুমকি। বোধহয় ঘুমোচ্ছিল রাজরীতার ডাকে ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে। সাউন্ডপ্রুফ দেওয়াল ওর শোনার ক্ষমতাকে কাবু করতে পারেনি। ওকে ভাড়া দেওয়ার সময় আলটিমেট সিকিওরিটি কোম্পানি ওর এই দারুণ ক্ষমতার কথা জানিয়েছিল। সেইসঙ্গে জানিয়েছিল ওর আরও সব অদ্ভুত-অদ্ভুত ক্ষমতার কথা।
এই হল প্রাইভেট সিকিওরিটি গার্ডের দশা! একে ভাড়া করে নিয়ে এসে দিনের-পর-দিন টাকা গুনে গেছে শত্রুজিৎ! গত একমাস ধরে তো মেয়েটার খাওয়া আর ঘুমোনো ছাড়া কোনও কাজ নেই! আজ যখন বিপদ হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়েছে, তখনও সে দিব্যি ঘুমোচ্ছে!
এইজন্যই ঝুমকির কথা রাজরীতার প্রথমে মনে পড়েনি।
ঝুমকি হর্স নেবুলার কে-২০৪ গ্রহের মানুষ। আলটিমেট সিকিওরিটি অন্তত সেরকমই জানিয়েছিল। শত্রুজিৎকে ওরা বলেছিল, স্যার, আসলে এরা মানুষ নয়, হিউম্যানয়েড–মানে, সাইবারম্যানও বলতে পারেন। ওদের শরীরে আমাদের মতো রক্ত-মাংস আছে বটে, তবে ওদের হার্ট ধুকপুক করে ব্যাটারির জোরে। ওদের এমন সব আশ্চর্য ক্ষমতা আছে যা আমাদের সিকিওরিটির ব্যাপারে মোক্ষম। তবে সত্যি-সত্যি দরকার না হলে ওরা সেইসব স্পেশাল পাওয়ার ব্যবহার করে না। আপনি ওকে ভাড়া নিন–তা হলে সেফটি নিয়ে আপনার আর কোনও চিন্তা থাকবে না। ও আপনার বাড়িতে বাড়িরই একজন হয়ে থাকতে পারবে। কেউ ওকে সিকিওরিটি গার্ড বলে সন্দেহ করবে না।
আপনাদের চার্জটা বড় বেশি। শত্রুজিৎ অনুযোগ করে বলেছিল।
তখন আলটিমেট সিকিওরিটি-র অফিসারটি হেসে বলেছে, উই আর বেস্ট ইন দ্য গেম। কে-২০৪-এর সঙ্গে শুধু আমাদের কোম্পানিরই ইমপোর্ট এগ্রিমেন্ট হয়েছে। সুতরাং আপনি যা পাচ্ছেন তা হল সেরা নিরাপত্তা–আলটিমেট সিকিওরিটি। তারপর গলায় বাঁধা টাইয়ের নটটা ঠিক করতে করতে সামান্য ইতস্তত করে অফিসারটি বলেছে, শুধু একটা ছোট্ট প্রবলেম আছে..।
কী প্রবলেম? কৌতূহলে শত্রুজিতের ভুরু কুঁচকে গেছে।
মানে, ঝুমকির গলার স্বরটা মেটালিক..যেটাকে পরিভাষায় ধাতব কণ্ঠস্বর বলে–মানে, আদ্যিকালের সিনেমাগুলোর রোবটের গলা যেমন শোনায় আর কী!
হাসল শত্রুজিৎ ও গলার স্বর মেটালিক হোক বা পেটালিক হোক, আমার কাজ নিয়ে কথা!
শত্রুজিতের বলা কথাগুলো রাজরীতার মনে পড়ছিল। তবে ওই কোম্পানি থেকে এটা বলে দেয়নি যে, ঝুমকি ঘুমোতে ভীষণ ভালোবাসে। একটু ফাঁক পেলেই চট করে একপ্রস্ত ঘুমিয়ে নেয়।
ঝুমকিকে দেখেই নিকি আর ভিকি থমকে গেল। কিন্তু সে এক লহমার জন্য। তারপরই অশ্লীল উল্লাসে ওদের হাসি চওড়া হল।
নিকি, আমাদের লাক দারুণ! ম্যাডামকে আর শেয়ার করতে হবে না।
নিকি তখন রাজরীতার শরীরের উত্তর গোলার্ধে ব্যস্ত ছিল। হাসতে হাসতে ও জবাব দিল, তুই ওকে নে। ম্যাডামকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
শেষ কথাটা ন্যাকা-ন্যাকা সুরে বলেই রাজরীতার দিকে দ্বিগুণ মনোযোগ দিল নিকি। আর ভিকি অ্যাথলিটের ক্ষিপ্রতায় দৌড়ে গেল ঝুমকির দিকে। এবং কেউ কিছু আঁচ করে ওঠার আগেই এক হ্যাঁচকায় ঝুমকিকে কোলে তুলে নিল।
ভিকি মরশুম-খ্যাপা কুকুরের মতো ঝুমকিকে আদর করছিল। আর হিউম্যানয়েড ঝুমকি অবাক হয়ে লোকটার পাগলামো দেখছিল।
এদিকে রাজরীতা নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিকির সঙ্গে প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করছিল। আর একইসঙ্গে ভাবছিল, ব্যাপারটা কতদূর গড়াবে। রেপ, নাকি রেপ অ্যান্ড মার্ডার? কিন্তু ঝুমকির বেলায় কী হবে? ও তো মানুষ নয়! যদিও বাইরে থেকে ওর সবকিছুই আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো।
আমাকে ছেড়ে দিন। আমি হিউম্যানয়েড। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি হিউম্যানয়েড। আমাকে…। অবাক চোখে ভিকির দিকে তাকিয়ে থেকে একঘেয়ে ধাতব সুরে বলে চলল ঝুমকি।
ওর গলার স্বরে চমকে উঠল ভিকি। এক ঝটকায় ওকে মেঝেতে নামিয়ে দিল।
নিকিও তখন নিজের জরুরি কাজ ছেড়ে হাঁ করে রোগা ফরসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।
ঝুমকি তখন বলছে, আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমি এই ফ্ল্যাটের সিকিওরিটি গার্ড। আপনারা দয়া করে এক্ষুনি ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যান, নইলে আপনাদের বিপদ হবে। সে-বিপদ থেকে আর ফেরা যায় না। আশা করি আপনারা আমার অনুরোধ রাখবেন। আমার অনুরোধ রাখবেন। আমার অনুরোধ…।
রাজরীতাও অবাক হয়ে ঝুমকির কাণ্ড দেখছিল। ভয়ংকর দুজন ক্রিমিনালকে ও যেন নিশ্চিন্তে গীতা পাঠ করে শোনাচ্ছে।
প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কাটা ভিকি সামলে নিয়েছিল। ঝুমকির কথা শুনে ও ব্যঙ্গ করে বলল, আমরা দয়া করে এক্ষুনি ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাব। তার আগে চটপট আমাদের কাজটা সেরে নিতে দাও। এসো, কাছে এসো–।
আমি মানুষ নই হিউম্যানয়েড। হিউম্যানয়েড। হিউম্যানয়েড। ঝুমকি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ার মতো করে কথাগুলো উচ্চারণ করল।
আরে বাইরে তো কোনও ফারাক নেই–ওতেই আমার কাজ মিটে যাবে! অধৈর্যভাবে বলল ভিকি।
আমার ভেতরে ব্যাটারি আছে। আমি মানুষ নই হিউম্যানয়েড। হিউম্যানয়েড। হিউম্যানয়েড..।
এসো, ব্যাটারির সুইচটা একটু খুঁজে দেখি। ঝুমকির দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করে বলল ভিকি, এবং ঝুমকিকে আবার জাপটে ধরল।
ওর গায়ে মুখ ঘষতে-ঘষতে ভিকি বলল, কই, সবই তো দেখছি মানুষের মতো। এতেই আমার কাজ চলে যাবে। দেখি তো, তোমার ব্যাটারির সুইচটা কোথায়!
ঝুমকি যান্ত্রিকভাবে আগের কথাগুলোই বারবার বলছিল, কিন্তু ভিকি ওর কথায় কোনওরকম আমল দিচ্ছিল না। একমনে নিজের কাজ করছিল।
নিকি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। বিপদের জন্য আগাম সতর্ক হয়ে টেবিলে রাখা ব্যাগের দিকে দু-পা এগিয়েও গিয়েছিল–যাতে দরকার হলেই ব্যাগ থেকে একটা অস্ত্র বের করে নেওয়া যায়।
এখন ভিকিকে নিজের কাজে মত্ত হতে দেখে নিকির শরীরের টান-টান ভাবটা ঢিলে হল। ও আবার পা বাড়াল রাজরীতার দিকে।
কিন্তু ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।
নির্লিপ্ত ঝুমকি ওর বাঁ-হাতের তালুটা বইয়ের পাতার মতো চোখের সামনে মেলে ধরল। সঙ্গে-সঙ্গে তালুটা গনগনে আঁচের মতো লাল হয়ে গেল। ওর হাতের পাতায় ফুটে উঠল কয়েকসারি বোতাম–অনেকটা ক্যালকুলেটরের মতো। ডানহাতের তর্জনী দিয়ে চটপট কয়েকটা বোতাম টিপল ঝুমকি।
ভিকি মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে ঝুমকিকে আঁতিপাঁতি করে আদর করছিল। হঠাৎই ও যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে ছিটকে পড়ল তিন হাত দূরে। সঙ্গে-সঙ্গে ঝুমকি হাওয়ায় শিস তুলে চোখের পলকে পৌঁছে গেল সিগনাল জ্যামিং-এর যন্ত্রটার কাছে। ভিকির কাছ থেকে যন্ত্রটার কাছে পৌঁছোনোর সময় রাজরীতা ওকে একটা ঝাপসা নীল ঝিলিকের মতো দেখতে পেল।
ঝুমকি ক্যানটা হাতে তুলে নিয়ে চটপট কয়েকটা বোতাম টিপল। ওর বাঁ-হাতের তালু তখনও লাল ফ্লুওরেসেন্ট বাতির মতো জ্বলছিল। ক্যানটা রেখে দিয়ে ও এবার হাতের তালুর কয়েকটা বোতাম টিপে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে ক্যানের গায়ে দপদপ করতে থাকা এলইডি বাতিটা নিভে গেল।
ঝুমকি রাজরীতার দিকে তাকিয়ে ধাতব গলায় বলল, বউদি, সিগনাল জ্যামিংটা অকেজো করে দিলাম। অকেজো করে দিলাম। অকেজো করে…।
ঝুমকির কাণ্ড দেখে নিকি হতভম্ব হয়ে আবার থেমে গিয়েছিল। এইবার হঠাৎই সংবিৎ ফিরে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল টেবিলে রাখা ব্যাগটার ওপরে। হাঁপাঁক করে কোনওরকমে ব্যাগ থেকে একটা খাটো বন্দুক বের করে নিল। ব্যাগটা উলটে পড়ে গেল টেবিল থেকে। নিকি বন্দুকের লেসার পয়েন্টারটা ঝুমকির দিকে তাক করে ট্রিগার টিপল।
ঝুমকি এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় ওর শরীরটা উলটোদিকে বাঁকিয়ে দিল। ওর ঝুলে পড়া রেশমি চুল মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
বন্দুকের চাপা শব্দে রাজরীতা কেঁপে উঠল। ওর সিকিওরিটি গার্ডের এইসব অদ্ভুত কাণ্ড ওকে অবশ করে দিচ্ছিল। ও ক্লান্ত শরীরে মেঝেতে বসে পড়ল। কপালের পাশটায় হঠাৎই দপদপ করে একটা ব্যথা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও ঝুমকির দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।
নিকি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গুলি করল। ঝুমকি অপার্থিব ঢঙে অনায়াসে সেগুলো এড়িয়ে গেল। তারপর বাঁ-হাতের জ্বলন্ত তালু তুলে ধরল নিকিকে লক্ষ করে।
যেন ভীষণ গরম একটা কিছু ধরে হাতে ছাঁকা লেগে গেছে এইরকম ভঙ্গি করে বন্দুকটা ছেড়ে দিল নিকি। তারপর ডানহাতের কবজি চেপে ধরে ছটফট করতে লাগল।
ঝুমকি তখন বাঁ-হাতের তর্জনী মেঝেতে ঠেকিয়ে চক দিয়ে গণ্ডি টানার মতো দাগ টানতে শুরু করল।
ভিকি ততক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়ে উঠে বসেছে। অবাক হয়ে ঝুমকির কাণ্ড দেখছে।
ঝুমকির তর্জনীর টান মেঝেতে একটা উজ্জ্বল নীল রঙের দাগ তৈরি করেছিল। বাজির সলতে পোড়ার মতো হিসহিস শব্দ হচ্ছিল একইসঙ্গে। যেন ওর আঙুলের ছোঁয়ায় ঘরের মেঝে পুড়ে যাচ্ছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিকি আর ভিকিকে ঘিরে একটা আঁকাবাঁকা গণ্ডি সম্পূর্ণ করল ঝুমকি। তারপর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। বাঁ-হাতের তালুর কয়েকটা বোতাম চটপট টিপে হাসিমুখে তাকাল রাজরীতার দিকে।
আরও কোনও ভয় নেই, বউদি। টাইম লাইন দিয়ে ওদের ঘিরে দিয়েছি। ওরা এখন বন্দি। আপনি ইচ্ছে করলে সিকিওরিটি পুলিশকে খবর দিতে পারেন। খবর দিতে পারেন। খবর দিতে…।
টাইম লাইন মানে! হতভম্ব রাজরীতা কোনওরকমে বলতে পারল।
ঝুমকি ধাতব গলায় জবাব দিল, থ্রি ডায়মেনশন থেকে ফোর্থ ডায়মেনশনে যাওয়ার বরডার। মানে, কেউ এটা পেরোলেই আমাদের এই জগৎ থেকে সোজা ফোর্থ ডায়মেনশনে চলে যাবে। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুঁজে পাওয়া…।
ভিকি চিৎকার করে উঠল : রাবিশ! অল বুলশিট! নিকি, এই হুঁড়িটার একটা কথাও বিশ্বাস করবি না! সব ব্লাফ! মিছিমিছি আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।
ঝুমকি ভিকির দিকে ঘুরে তাকিয়ে নিপ্রাণ ধাতব গলায় বলল, আপনারা কেউ দাগের বাইরে যাবেন না। দাগের বাইরে যাবেন না। দাগের বাইরে…।
ওর কথার প্রতিধ্বনি শেষ হওয়ার আগেই নিকি আর ভিকি দাঁত খিঁচিয়ে ছুটে গেল ঝুমকির দিকে।
এবং দাগ পেরোনোমাত্রই ওরা দুজন স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
রাজরীতা টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল।
ওরা কোথায় গেল! ওরা কোথায় গেল!
ঝুমকি বাঁ-হাতের তালুর বোতাম টিপতে টিপতে জবাব দিল, ওরা ফোর্থ ডায়মেনশনে চলে গেছে। হয়তো মহাকাশের কোনও নির্জন জায়গায় ওরা অন্ধকারে ঠান্ডায় ভেসে বেড়াচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে…।
এবার দরজার কাছে এগিয়ে গেল ঝুমকি। একটু পরেই বলল, দরজার লকটাকে ঠিক করে দিলাম। ঠিক করে দিলাম। ঠিক করে…।
ততক্ষণে ঘরের মেঝেতে আঁকা নীল দাগটাও মিলিয়ে গেছে।
দেওয়ালের টিভির প্রোগ্রাম এক মুহূর্তের জন্যও থামেনি। কিন্তু এতক্ষণ রাজরীতার সে খেয়াল ছিল না। এখন ও হঠাৎ করে যেন টিভির শব্দ শুনতে পেল, দেখতে পেল ছবি। ওর মনে পড়ল মনোরমের কথা, শত্রুজিতের কথা। শত্রুজিতকে এক্ষুনি একটা ফোন করতে হবে। কিন্তু তার আগে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত এই রোগা ফরসা মেয়েটাকে–থুড়ি, হিউম্যানয়েডটাকে।
ঝুমকি!
ঝুমকি রাজরীতার দিকে এগিয়ে আসছিল। রাজরীতা ছুটে গিয়ে ওকে একেবারে জাপটে ধরল। ওর গালে ভালোবাসার চুমু খেয়ে বলল, তোমার জবাব নেই।
ঝুমকি চোখ পিটপিট করল কয়েকবার। তারপর রাজরীতার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি যাই। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে…।