Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আকাশে কীসের শব্দ || Anish Deb

আকাশে কীসের শব্দ || Anish Deb

আপনারা সকলেই জানেন, গত ১১ নভেম্বর, শনিবার, বেলা বারোটা নাগাদ দক্ষিণ কলকাতা ও দক্ষিণের শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকায় এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এই শব্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগে গড়িয়াহাট, টালিগঞ্জ থেকে শুরু করে আমতলা, নরেন্দ্রপুর পর্যন্ত সবাইকে জানান দিয়ে গেছে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, কিছুতেই এই শব্দের উৎসের হদিস পাওয়া যায়নি। কোনও বিস্ফোরণের ঘটনাও টের পাননি কেউ, অথবা কেউ যে হতাহত হয়েছেন এমন খবরও শোনা যায়নি। ফোর্ট উইলিয়ামের চিফ অফ স্টাফ জে. কৌশিক বলেছেন, সেদিন কোনও শব্দ তারা শোনেননি। আওয়াজের ধরনের বিবরণ শুনে তিনি বলেন, ব্যাপারটা সনিক বুম হতে পারে। সুপারসনিক কোনও প্লেন আকাশপথে উড়ে গেলে একটা শক ওয়েভ তৈরি হয়। তার ফলে নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় বাজ পড়ার মতো জোরালো শব্দ হতে পারে। অথচ তার আশপাশের মানুষজন সেরকম কোনও শব্দই শুনতে পাবেন না। শনিবার বারবেলার শব্দটা ছিল হয়তো তাই।

শব্দের রহস্যটা রহস্যই থেকে গেছে, কারণ সেদিন বেলা বারোটা নাগাদ কোনও অজ্ঞাতকুলশীল সুপারসনিক প্লেন কলকাতার আকাশপথে উড়ে গেছে এমন কোনও প্রমাণ কেউই দিতে পারেননি।

অথচ প্রচণ্ড শব্দ যে একটা হয়েছে তাতে কোনও ভুল নেই। আর বহু বাড়ির কাচের জানলাও যে তখন ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়েছে তাও তো মিথ্যে নয়!

তা হলে কীসের শব্দ শোনা গিয়েছিল নভেম্বরের ১১ তারিখে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরাও বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন। সনিক বুম, মাক নাম্বার, মাক কোন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা রচনা প্রকাশিত হয়েছে নানান পত্রপত্রিকায়। এমনকী অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী আস্ট মাকের জীবনীও ছাপা হয়েছে একটি কিশোর-পত্রিকায়। তার ফলে, বিজ্ঞানী মাকের নাম থেকেই যে মাক নাম্বার, মাক কোন্–এইসব নামকরণ করা হয়েছে, সেটাও জনসাধারণ জেনে গেছে।

কিন্তু এত সত্ত্বেও শব্দের কারণটা কেউই জানতে পারেনি।

কারণ, এতদিন আমি মুখ খুলিনি। আর শুভদীপের গোপন পরীক্ষার কথাও কাউকে বলিনি। সেইসঙ্গে শুভদীপের স্ত্রী রনিতার কথাও খুলে বলা হয়নি কাউকে। ফলে নিখোঁজ বিজ্ঞানী শুভদীপ পালচৌধুরীর সঙ্গে এই বিস্ফোরণের যে কোনও সম্পর্ক আছে, সে-কথা কেউ বুঝতে পারেনি।

কিন্তু আর অপেক্ষা করার কোনও মানে হয় না। কারণ, গতকালই শুভদীপের পাঠানো একটা মোটা খাম আমার ঠিকানায় এসে হাজির হয়েছে। আমাকে লেখা শুভর শেষ চিঠি।

চিঠিটা আমি যতই পড়েছি ততই অবাক হয়েছি। চিঠি তো নয়, সে যেন শুভদীপের জীবনের এক গোপন অধ্যায়ের বিবরণ। কী করে একটা সাধারণ ব্যাপার থেকে ওর জীবন এরকম বিপজ্জনক দিকে এগিয়ে গেল তা ভাবতে অবাক লাগে। অথচ শুভদীপ উচ্ছল হাসিখুশি ছিল।

ছাত্রজীবন থেকেই ওকে দেখেছি আমি। যেমনই বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা তেমনই প্রিয় ছিল সকলের। আর ওর দাজ দিলখোলা হাসি আমি যেন এখনও শুনতে পাই। যদিও জানি, শুভদীপ আর কখনও হাসবে না, কাঁদবে না। এমনকী আমার পিঠে এক জোরালো থাপ্পড় কষিয়ে আর কখনও বলে উঠবে না, বুঝলি শালা, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কেউ বিজ্ঞানী হয় না।

আমি ওর কথায় মোটেই আহত হতাম না। কারণ, আমরা বেশিরভাগই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করার জন্যে, ভালো-ভালো চাকরি পাওয়ার জন্যে, বিদেশে যাওয়ার জন্যে, অধ্যাপনার দায়সারা কর্তব্য পালনের জন্যে।

আর শুভদীপ? ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করত বিজ্ঞানকে ভালোবেসে।

আমি তাও মজা করে ওকে বলতাম, তুই বুঝি বিজ্ঞানী!

ইয়েস ব্রাদার, আমি রোজ মর্নিং-এ বিজ্ঞান দিয়ে ব্রেকফাস্ট খাই। একথা বলেই শুভদীপ হো-হো করে হেসে উঠত।

শুভদীপ আমাদের অনেকের কাছেই প্রিয় ছিল, কিন্তু আমি বোধহয় ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। আমাদের ভালোবাসা এমনই ছিল যে, সাহেবদের দেশ হলে হয়তো অন্যায় সম্পর্কের অভিযোগে হাজতবাস করতে হত।

শুভদীপ পড়াশোনা আর গবেষণা নিয়ে দিব্যি ছিল। কিন্তু রনিতাকে বিয়ে করার পর ওর জীবনটা হঠাৎই বোধহয় অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই ধীরে-ধীরে ওর জীবনটা এগিয়ে গিয়েছিল গত ১১ নভেম্বরের দিকে।

১১ নভেম্বর সেই ভয়ংকর শব্দটা শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই আমার মনটা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠেছিল। কান্না এসে গিয়েছিল গলায়। বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বহুদিনের প্রিয় বন্ধু শুভদীপ আর নেই। ওই আশ্চর্য শব্দের মাধ্যমে ওর বিচিত্র মৃত্যুটাকে ও যেন ঘোষণা করে গেল।

না, শুভদীপ আত্মহত্যা করেনি। জীবনে অনেক শোক-দুঃখ ও পেয়েছে, কিন্তু কখনও আত্মহত্যার কথা ভাবেনি। বরং আমি কখনও ওই প্রসঙ্গ তুললে হেসে বলত, ব্রাদার, আত্মহত্যা করার সাহস যদি কারও থাকে, তা হলে তার আর আত্মহত্যার প্রয়োজন হয় না।

শুভদীপ হাসত বটে, কিন্তু ওর মুখের আড়ালে আমি অনেক শোকগাথা টের পেতাম। অথচ রনিতাকে বিয়ে করার পর তখন সবেমাত্র বছরদুয়েক কেটেছে।

শুভদীপের ব্যাপারটা নিয়ে এই এক মাস আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। কলেজ-জীবনে তোলা আমাদের গ্রুপ ফটোটা দেখেছি। বারবার। ওর সুন্দর নিষ্পাপ মুখটা যেন আমার চোখে তাকিয়ে নীরবে বলেছে, বুঝলি, আমি চলে গেলাম। তোরা সব দুধে-ভাতে থাকিস।

কথায় কথায় শুভদীপ শুধু বলত, না ভাই, আমি দুধে-ভাতে মানুষ, আমার ওসব পোষাবে না।

একথা শুনে আমাদের আড্ডার নতুন কোনও সঙ্গী ভাবত, ও বুঝি খুব বড়লোক। তখন আমরাই হেসে ওর ঠাট্টার মর্মার্থটা বুঝিয়ে দিতাম তাকে। বলতাম, শুভদীপের কেষ্টপুরের বাড়িতে দুটো গরু ছিল। সেইজন্যেই ওর খাদ্যতালিকার প্রধান আইটেম ছিল দুধ-ভাত। বাবা-মায়ের চাপে এই মেনু ওকে প্রায় বিশ বছর সহ্য করতে হয়েছে।

তারপর ফিজিক্স নিয়ে এম. এসসি. পার্ট টু পরীক্ষা দেওয়ার সময় ও একদিন সগর্বে জানাল, ও আর দুধ-ভাত খাচ্ছে না।

আমরা সবাই জিগ্যেস করলাম, কেন? কেন?

ও বেশ দুঃখ-দুঃখ মুখ করে জানাল, ওদের গরু দুটো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, ওর বাবা বলেছেন, এখন তো তুই-ই বড় হয়ে গেছিস, তা হলে আমার আর ও-গরু দুটোকে রেখে লাভ কী?

ওর কথায় আমরা হো-হো করে হেসে উঠেছি।

গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি শুভর চিঠিটা পড়েছি। চিঠি তো নয়, সুদীর্ঘ এক কাহিনি।

সেই লেখা পড়ার পর বাকি রাতটা আমি আর ঘুমোতে পারিনি। আমার কানের কাছে ১১ নভেম্বরের সেই শব্দটা আবার বেজে উঠেছিল। একবার নয়, বারবার। যেন কামান দেগে ওর মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হচ্ছিল।

আজ সকালে নতুন সূর্য দেখার পর আমার মনটা যেন খানিকটা আশ্বাস পেল। মনে হল, শুভর কথা যদি আমি সবাইকে জানাই, তা হলে শুভর আত্মা বোধহয় তৃপ্তি পাবে। আর রনিতার? রনিতা বোধহয় অখুশি হবে না। কারণ, শুভকে ও ভীষণ ভালোবাসত।

অবশ্য রনিতাও তো এখন আর নেই! শুভর শেষ চিঠি পড়েই ব্যাপারটা জানতে পেরেছি আমি। কারণ, গত একবছর ধরে শুভ আমার সঙ্গে সেরকম যোগাযোগ রাখত না। শুধু মাঝে মাঝে খেয়ালখুশি মতো ফোন করত। কিছু জিগ্যেস করলেই বলত, এখন ও একটা অদ্ভুত গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত আছে। তার বেশি আর কিছু কখনও বলেনি। আর কথা শেষ করার আগে বলত, কোনওদিন যদি একটা জোরালো এক্সপ্লোশানের শব্দ শুনিস তা হলে বুঝবি আমি আর নেই।

এখন আমি সব বুঝতে পেরেছি। শুভর শেষ চিঠি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছে। তাই ওর সম্পূর্ণ কাহিনিটাই আমি আপনাদের কাছে পেশ করতে চাই। অন্তত আমি যেমন করে বুঝেছি। আর আগেই তো বলেছি, এখন আর চুপ করে থাকার কোনও মানে হয় না।

.

বারান্দার টবের গাছগুলোয় জল দিচ্ছিল রনিতা, আর আপনমনে কথা বলে যাচ্ছিল। আসলে ও প্রাণভরে গালমন্দ করছিল হতচ্ছাড়া চড়ুইপাখিগুলোকে। দুষ্টু পাখিগুলো রোজই ওর সাধের গাছগুলোর কচি পাতা আর ফুল ঠুকরে-ঠুকরে খেয়ে যায়।

শুভদীপ ওর পড়ার টেবিলে বসে বই আর কাগজপত্র নিয়ে কাজে ব্যস্ত ছিল। ডানহাতের কাছে চায়ের কাপ। সামনের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সকালের সূর্য। বারান্দার যেটুকু চোখে পড়ে তাতে রঙিন মরশুমি ফুল, দু-একটা চঞ্চল চড়ুইপাখি, সবুজ গাছের পাতা, আর রনিতাকে দেখা যাচ্ছে।

এই সকালবেলার শীতের আমেজ ঘেরা পরিবেশে সবই সুন্দর। রনিতাও। ঠিক এই সময়টা শুভদীপের মনে হয় বিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়াও বেঁচে থাকার অন্যান্য আরও আকর্ষণ চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

কিন্তু রনিতার কথা ওর নরম ভাবনায় বাধা দিচ্ছিল বারবার।

রনিতা, চড়ুইগুলো এখনও এত সভ্য হয়ে ওঠেনি যে, তোমার বাংলাভাষা বুঝবে। শুভদীপ ঠাট্টা করে কথাটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিল।

বাংলাভাষা না বুঝুক, লাঠির ভাষা তো বুঝবে– রনিতা জানলার কাছে এগিয়ে এল। দেখা গেল ওর হাতে চড়ুইপাখি তাড়ানোর জন্য মানানসই একটা কাঠি।

সকালের মন-ভালো করা আলোয় রনিতাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।

শুভদীপ ওকে দেখল একটু অবাক হয়ে। রনিতা এত সুন্দর, অথচ এত কথা বলে!

বিয়ের পর বছরখানেক যেতে-না-যেতেই রনিতার কথা বলার বাড়াবাড়ি বাতিকটা টের পেয়েছে শুভ। রনিতা কখনও অল্পে থামে না। একদিন সন্ধেবেলা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ওকে জিগ্যেস করেছে।

তুমি এত কথা বলো কেন, রনিতা?

আমি বেশি কথা বলি? অবাক হয়ে স্বামীর দিকে ঘুরে তাকিয়েছে রনিতা। ও তখন নিজের শাড়ি-জামাকাপড় ঠিকঠাক করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিল। আলমারির কাছ থেকেই একটু চোখা স্বরে ও আরও বলেছে, শেষকালে তুমি আমার এই বদনাম দিলে! জানো, সত্যি-সত্যি কাদের টকেটিভ বলে? যারা অপ্রয়োজনে বাড়তি কথা বলে। আমি তো দরকার ছাড়া একটি কথাও বলি না। আমাকে তুমি আর যাই বলো, টকেটিভ বলতে পারবে না। জানো তো, আমাদের।

হাত তুলে ওকে বাধা দিয়েছে শুভ ও থাক, থাক, বাবা। আমারই ভুল হয়েছে। তুমি বিন্দুমাত্রও টকেটিভ নও। বরং খুবই লক্ষ্মী মেয়ে।

তুমি কি চাও আমি বোবা হয়ে থাকি?

শুভ বুঝতে পারল রনিতা একটু সিরিয়াস হয়ে গেছে। তাই ও চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে উঠে গেল আলমারির কাছে। দু-হাতে আলমারির ভোলা পাল্লা ধরে রনিতাকে আগলে দাঁড়াল। তারপর গাঢ় গলায় বলল, এখন তোমাকে দু-চার- সেকেন্ড বোবা করে দেব।

রনিতা একটু অবাক হয়ে বলল, তার মানে?

তার মানে এই। বলে রনিতাকে হতভম্ব করে দিয়ে চট করে ওকে চুমু খেল শুভদীপ।

সত্যি-সত্যি দু-চারসেকেন্ড পর ব্যাপারটা শেষ হতেই রনিতা আলতো রাগের ভান করে বলল, এটা কী হল!

শুভদীপ হাসতে-হাসতে জবাব দিল, চুমু খাওয়া হল। এতে তোমার রাগের কী আছে। আমি তোমার অফিসিয়াল চুম্বক, মানে, ম্যাগনেট।

চুম্বক! রনিতা আরও অবাক।

শুভ হেসে বলল, ব্যাকরণ ভালো করে পড়োনি? চুম্বন করে যে সে-ই হল চুম্বক। আমি তোমার হাজব্যান্ড–সো, অফিশিয়াল ম্যাগনেট।

এরপর রনিতা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বেশি কথা বলার অভিযোগটা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।

কিন্তু রনিতার বেশি কথা বলার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে শুভদীপের মাথায় বাসা বেঁধে ফেলল। ও যখন রনিতার সঙ্গে কথা বলত তখনই ওর মাথার ভেতরে বিজ্ঞানী মন তার কাজ করে যেত।

সুতরাং একদিন কাজের বউয়ের বিনা নোটিসে কামাই করা নিয়ে রনিতা যখন সুদীর্ঘ তাৎক্ষণিক বক্তৃতা সবে শেষ করেছে, তখন শুভ বলে বসল, রনি, একটা নতুন আইডিয়া আমার মাথায় এসেছে।

রনিতা প্রায় অপ্রস্তুত হয়ে জিগ্যেস করল, কী আইডিয়া?

শুভ ওকে কাছে ডেকে নিজের পাশে বসাল। তারপর আগ্রহ দেখিয়ে বলল, মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করো। যদিও ব্যাপারটা বিজ্ঞানের, তবু মনে হয় না তোমার বুঝতে অসুবিধে হবে।

রনিতার বিষয় ছিল ফিলজফি। বিজ্ঞান সম্পর্কে ওর বিচিত্র আতঙ্ক আছে। কিন্তু শুভকে ও জানে। বিজ্ঞানের ব্যাপারে শুভ বেশ একরোখা। নতুন আইডিয়ার ব্যাপারটা যখন ও রনিতাকে শোনাতে চায়, তখন ও শোনাবেই।

রনিতা ছোট্ট করে ঘাড় নাড়তেই শুভ বলতে শুরু করল, দ্যাখো, শব্দ হল একরকমের শক্তি। যেমন আলো, তাপ–এসবই হল শক্তি। শক্তির কোনও বিনাশ নেই, তবে রূপান্তর হতে পারে। আমাদের এই মহাবিশ্বে আদিম অবস্থায় যে-পরিমাণ শক্তি ছিল, এখনও তাই আছে। শুধু শক্তির নানারকমের রূপান্তর হয়েছে।

রনিতা বলল, আমার একটু-একটু গুলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নো প্রবেলেম–তুমি বলে যাও।

তোমাকে তো বললাম, শব্দ একরকম শক্তি। এই যে তুমি এতক্ষণ ধরে কাজলের মায়ের কামাই নিয়ে এত কথা বললে, তাতে অনেক শব্দ হল–।

এত কথা আবার বললাম কোথায়! আমি তো শুধু বললাম, ও যে আসবে না সেটা আগে–।

রনিতা, প্লিজ। আমাকে আগে বলতে দাও, তারপর যত খুশি কথা বোলো।

রনিতার মুখ সামান্য গোমড়া হল।

শুভদীপ সেটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল না করে বলে চলল, তোমার উচ্চারণ করা শব্দগুলোকে নিয়ে আমি যদি রূপান্তর ঘটাতে পারি তা হলে হয়তো দেখা যাবে বেশ খানিকটা বিদ্যুৎশক্তি পাওয়া যাবে। মানে, সাউন্ড এনার্জি থেকে ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি। বলা যায় না, তোমার একটু আগের বলা কথাগুলো থেকে হয়তো ১৫ ওয়াটের একটা বাকে মিনিটপাঁচেক জ্বালানো যাবে।

রনিতা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ওর ফরসা মুখে কালচে ছায়া পড়েছে। শুভদীপের দিকে না তাকিয়েই ও বলল, ব্যাপারটা তোমার কাছে খুব মজার মনে হচ্ছে, তাই না?

শুভদীপ একটু সাবধানী গলায় বলল, হ্যাঁ, মানে একটু মজা তো আছেই। তবে…ইয়ে…আসল কথাটা শুনবে? যা বললাম, তা বোধহয় খুব একটা মিথ্যে নয়।

রনিতা সহজ হওয়ার ভান করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। অনেকটা নিজের সঙ্গে কথা বলার ঢঙেই বলল, তুমি উচ্চশিক্ষিত সায়েন্টিস্ট মানুষ। সব ব্যাপারে তোমার কথাই শেষ কথা।

শুভও পালটা জেদ দেখিয়ে বলল, বিজ্ঞান কখনও মিথ্যে কথা বলে না।

বিজ্ঞানীরা কিন্তু মিথ্যে কথা বলতে পারে।

সেই মুহূর্তে ছন্দপতন ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু শুভদীপ একটা হিসেব কষছিল মনে-মনে। আচ্ছা, এটুকু সময়ে কতগুলো শব্দ উচ্চারণ করল রনিতা? দুশো, তিনশো, নাকি আরও বেশি শব্দ উচ্চারণ করেছে?

এইরকম সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে শুভদীপ ঠিক করল গুনে দেখবে। এরপর থেকে হিসেব করে দেখবে চব্বিশ ঘণ্টায় রনিতা কত কথা বলে মানে কটা শব্দ উচ্চারণ করে। তারপর তা থেকে হিসেব করবে, প্রত্যেক শব্দ উচ্চারণের পিছনে ঠিক কত আর্গ বা জুল শক্তি খরচ হয়। তারপর উত্তরটাকে নিয়ে আসতে হবে ওয়াট-ঘণ্টা বা কিলোওয়াট-ঘণ্টা এককে। তখনই বোঝা যাবে, রনিতা কদিন কথা বললে সেই শব্দ-শক্তি থেকে একটা ১৫ ওয়াট পাওয়ারের বাকে পাঁচমিনিট জ্বালানো যাবে।

এরপর থেকে রনিতার উচ্চারণ করা শব্দ গুনতে শুরু করেছে শুভদীপ। তখনই বুঝতে পেরেছে, বলা যত সহজ, বাস্তবে কাজটা তত সহজ নয়। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষক শুভদীপ তাতে পেছপা হয়নি। একটা নতুন বিষয় নিয়ে গবেষণা কোনও খাঁটি গবেষকের কাছে একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। শুভদীপ এই রোমাঞ্চকর নেশায় ডুবে গেল।

ও খুঁটিয়ে লক্ষ করে দেখল, কোনও মানুষ কথা বলার সময়ে উচ্চারণ করা শব্দগুলোর মাঝে সেভাবে কোনও ফাঁক রাখে না–যেমনটা পাওয়া যায় লেখা কথার সময়ে। রনিতার কথা গুনতে গিয়ে ও ঠিক এই সমস্যায় পড়ল। কিন্তু তার চেয়েও সমস্যা হয়ে দাঁড়াল রনিতার মেজাজ।

প্রথম-প্রথম শুভদীপ যখন রনিতার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করত তখন মাঝপথেই কথা থামিয়ে রনিতা বলে উঠত, কী আপনমনে বিড়বিড় করছ! তুমি আমার কথা কিছুই শুনছ না!

গুনলে কখনও আর শোনা যায়। শুভ তখন তাড়াতাড়ি রনিতার কথায় মন দিয়েছে। নিজের সাফাই হিসেবে বলেছে, না..ইয়ে…একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। প্লিজ, আর-একবার বলবে।

এভাবে বেশ কিছুদিন চেষ্টার পর শুভদীপ হাল ছেড়ে দিল। কিন্তু ওর মনে কেমন একটা জেদও চেপে বসল–একটা-না-একটা পথ ওকে বের করতেই হবে। এই চিন্তায় ও দিনরাত ডুবে রইল। বইপত্র আর কাগজ নিয়ে নানান অঙ্ক কষল।

তার পর একদিন ও আর্কিমিদিসের মতো ইউরেকা! বলে চিৎকার করে উঠল। এবং গবেষণাগারে ওর কাজ শুরু করল।

দুধে-ভাতে মানুষ কথাটা শুভদীপ মজা করে ব্যবহার করলেও ওর পৈতৃক সম্পত্তি নেহাত কম ছিল না। এ ছাড়া ও নিজেও ভদ্রস্থ টাকা উপার্জন করে। সুতরাং দক্ষিণ কলকাতার ছিমছাম এলাকায় ওর এই ফ্ল্যাটের মাপ যথেষ্ট বড়। আর সেই কারণেই তার একটা ঘরকে ও একরকম ওর গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছে।

সমস্যাটার চলনসই একটা সমাধান খুঁজে পাওয়ার পর শুভদীপ ওর গবেষণাগারে আরও জোরালো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে উঠল।

ও দেখেছে, রনিতা মোটামুটিভাবে বলতে গেলে চাররকম স্পিডে কথা বলে। আর স্পিড যতই বাড়তে থাকে ওর কথার তীব্রতা ততই উচ্চগ্রামে চড়তে থাকে। এ ছাড়া ওর কথার কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ করে শুভদীপ দেখেছে, কথার স্পিড বেড়ে গেলে কম্পাঙ্কের ঊর্ধ্বসীমা আরও ওপরে উঠে যায়।

সুতরাং, এইসব তথ্য এবং বেশ কয়েকবার ট্রায়াল-অ্যান্ড-এরার করার পর শুভদীপ একটা যন্ত্র তৈরি করতে পারল। যন্ত্রটা খুব নিখুঁত হল না বটে, কিন্তু রনিতার উচ্চারণ করা শব্দের মোটামুটি একটা হিসেব কষতে পারল।

যন্ত্রটার তত্ত্ব খুব সহজ-সরল। প্রথমে উচ্চারণ করা শব্দগুলোর কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ করে উচ্চতম কম্পাঙ্কটি সে নির্ণয় করে। তারপর মেপে নেয় ডেসিবেল তীব্রতা। এই দুটি তথ্য থেকে সে হিসেব কষে বের করে বক্তা কোন স্পিডে কথা বলছে। রনিতার চারটে স্পিডের জন্য প্রতি সেকেন্ডে উচ্চারণ করা শব্দের সংখ্যার চারটি গড় মান যন্ত্রটিকে আগেই জানানো আছে। সুতরাং স্পিড জানার পর যন্ত্রটা হিসেব করে বক্তা কত সেকেন্ড কথা বলল। তারপর সেই সময়কে নির্দিষ্ট গড়মান দিয়ে গুণ করে নিজের মেমোরিতে সঞ্চয় করে রাখে। এইভাবে সঞ্চিত তথ্যকে সে পরপর যোগ করে যোগফল বের করে রাখে। ফলে যে-কোনও সময় উচ্চারিত শব্দের সংখ্যা জানতে চাইলেই যন্ত্রটা সাম্প্রতিকতম যোগফল দেখিয়ে দেয়। এই যোগফলে ভুলের সম্ভাবনা বড়জোর শতকরা ১৭ ভাগ।

যন্ত্রটা যদি নির্দিষ্ট কোনও মানুষের কণ্ঠস্বরে টিউন করা থাকে তা হলে অন্য কারও কথা সে তার হিসেবের মধ্যে ধরবে না।

শুভদীপ যন্ত্রটার নাম দিল ডিজিটাল অডিয়ো ওয়ার্ড কাউন্টার।

নিজে কথা বলে ও বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে যন্ত্রটির দক্ষতা যাচাই করল। যখন দেখল, যন্ত্রের ভুল কোনও সময়েই শতকরা ১৭ ভাগের বেশি হচ্ছে না, তখন ও দারুণ খুশি হল। তারপর সুযোগের অপেক্ষায় রইল, কবে ও ফ্ল্যাটটাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য একা নিজের দখলে পাবে।

সুযোগ এসে গেল আটদিনের মাথায়। রনিতা নীচের ফ্ল্যাটের মিসেস সেনের সঙ্গে পাড়ার মহিলা সমিতির একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গেল। বলল, ঘণ্টাতিনেক পরেই ফিরবে। শুভদীপের তখন আনন্দে সাতহাত লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল।

অতএব নদিনের দিন থেকেই শুরু হয়ে গেল আসল পরীক্ষা।

পাঁচটা খুদে-খুদে মাইক্রোফোন ও বসিয়ে দিল ফ্ল্যাটের নানা জায়গায়। সেই মাইক্রোফোনগুলো রনিতার সমস্ত কথা নিখুঁতভাবে ধরে পৌঁছে দিতে লাগল শুভদীপের মূল যন্ত্রে। আর শুভদীপ প্রতিদিন রাতে সেই যন্ত্রে জুড়ে দেওয়া কম্পিউটারের কিবোর্ডে বসে রনিতার উচ্চারণ করা শব্দের হিসেব রাখতে লাগল।

দশদিন পর একটা গড় হিসেব কষল শুভ। তাতে যে সংখ্যা পাওয়া গেল তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো : ১৬৬৪৩।

পরদিন চায়ের টেবিলে রনিতাকে খবরটা জানাল শুভ।

জানো, লাস্ট ১০ দিনে তুমি অ্যাভারেজে ডেইলি সাড়ে ১৬ হাজার শব্দ বলেছ।

রনিতা খবরের কাগজের পাতায় চোখ বোলাচ্ছিল। চোখ না তুলেই বলল, সবসময় ইয়ারকি ভাল্লাগে না।

না, ইয়ারকি না। সিরিয়াসলি বলছি।

এইবার খবরের কাগজ রেখে শুভর দিকে সরাসরি তাকাল রনিতা। কিছুক্ষণ স্বামীকে জরিপ করে জিগ্যেস করল, কী করে গুনলে?

শুভদীপ ওর যন্ত্রের ব্যাপারটা রনিতার কাছে একটুও ভাঙেনি। এখনও ভাঙতে চাইল না। তাই চোখ মটকে বলল, সে একটা কায়দা আছে। এখন বলব না। পরে বলব।

রনিতা আর কোনও কথা বলেনি। আবার খবরের কাগজের পাতায় চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ওর ভাবভঙ্গিতে শুভদীপ এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, রনিতা ব্যাপারটা খুব খুশি মনে নেয়নি।

কিন্তু তা সত্ত্বেও শুভদীপ এই রোমাঞ্চকর নেশায় ডুবে যাচ্ছিল। ওর যন্ত্রে রনিতার সমস্ত কথা টেপ করার ব্যবস্থাও ছিল। কখনও কখনও ও গভীর রাত পর্যন্ত টেপরেকর্ডার চালিয়ে রনিতার কথাগুলো শুনত আর নিজের নানান বৈজ্ঞানিক হিসেব-নিকেশ করত। রনিতার কথার শব্দ শোনা আর শব্দ গোনা ওকে ক্রমশ যেন পাগল করে তুলল।

রনিতাকে ও ঠাট্টা করে মাঝে-মাঝেই ওর কথা বলার হিসেবটা শুনিয়ে দেয়। বলে, ডার্লিং, এই উইকে তোমার টকিং অ্যাভারেজ ১৫ হাজারের কিছু কম।

রনিতা কোনও জবাব দেয় না। কিন্তু দিনের-পর-দিন একই ধরনের হিসেব শুনতে-শুনতে ও ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে আসে। শুভদীপের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না। শুভদীপ কিছু জিগ্যেস করলে দায়সারা ছোট্ট জবাব দেয়। কিন্তু তাতে ওর দৈনিক গড় হিসেবে তেমন কোনও হেরফের হয় না। কারণ শুভদীপ যখন থাকে না, তখন রনিতা কাজের বউ, বারান্দার চড়ুইপাখি, বাথরুমে ঢুকে পড়া পায়রা, আচমকা বৃষ্টি, কিংবা চড়া রোদ্দুর–এদের সঙ্গে বকবক করে ওর ঘাটতি পুষিয়ে নেয়।

রনিতার সুন্দর চোখের তলায় ধীরে-ধীরে একটা কালচে ছোপ পড়ছিল। এখন ও সারাটা দিন কাজে ব্যস্ত থাকে। সে ব্যস্ততা এমনই যে, কাজ না থাকলেও ও সর্বক্ষণ এ-ঘর ও-ঘর করতে থাকে আর আপনমনেই বকবক করে যায়। শুভদীপ যখন ওকে কিছু বলতে চায় তখন কেমন রুক্ষভাবে জবাব দেয়। চেহারা আগের তুলনায় অনেক ভেঙে গেছে। প্রায়ই হজমের গোলমালে ভোগে।

শুভদীপ একদিন ওকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলতেই রনিতা একেবারে কঁঝিয়ে উঠল, বলল, আমি ঠিক আছি, ডাক্তার আমার দরকার নেই, দরকার আসলে– কথা শেষ করেনি রনিতা।

একদিন রাতে, অন্ধকারে, শুভকে পরম আগ্রহে অকুলপাথারে খড়কুটোর মতো জড়িয়ে রনিতা বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?

বলো–।

মেনে নিচ্ছি, আমি বেশি কথা বলি। তুমিই জিতলে, আমি হারলাম। কাল থেকে তোমার ওই এক্সপেরিমেন্ট তুমি বন্ধ করবে?

অন্ধকারে মশারির ছাদের দিকে তাকিয়ে শুভ বলল, দেখি।

কিন্তু ভেতরে-ভেতরে শুভদীপ টের পাচ্ছিল, এই নেশাটা ময়াল সাপের মতো ওকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে। ১৫ ওয়াটের একটা বা পাঁচমিনিট না জ্বালানো পর্যন্ত ওর নিস্তার নেই। একটা বিকৃত জেদ ভেতর থেকে ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

রনিতার উচ্চারণ করা কথা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য পাগলের মতো মেতে উঠল শুভদীপ। প্রায় সাড়ে চারমাসের অক্লান্ত গবেষণায় ও তৈরি করল একটা অভিনব যন্ত্র–তার নাম দিল এনার্জি ট্র্যাপার। এনার্জি ট্র্যাপার বা শক্তি-ফঁদ ওকে এতই খুশি করল যে, ও পাঁচদিন বিজ্ঞানের কাছ থেকে ছুটি নিল আর রনিতার কথাও গুনল না।

কিন্তু তারপর থেকেই ও আবার মেতে উঠল শক্তি-ফঁদ নিয়ে।

রনিতার টেপ করা কথাগুলোকে ও স্বাভাবিক ভলিউমে প্লে-ব্যাক করে তা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে লাগল। চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে স্ট্যান্ডে বসানো একটা ছোট্ট গোলকে শব্দ-শক্তিকে ফোকাস করে কেন্দ্রীভূত করল শুভদীপ। তারপর অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফোর্স ফিল্ড প্রয়োগ করে সেই শক্তিকে বন্দি করল। আর তখনই চকচকে গোলকটা ভেসে উঠল শুন্যে। তার গায়ে আলো পড়ে অদ্ভুত এক বর্ণালী তৈরি করে ওটা যেন একটা স্বপ্নের বুদবুদ হয়ে ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়াতে লাগল।

শুভদীপ অবাক হয়ে দেখতে লাগল রনিতার কথা ভেসে বেড়াচ্ছে ওর ল্যাবরেটরিতে। তার গায়ে বর্ণালীর খেলা।

এরপর অন্তত মাসখানেক ধরে শুভদীপ ওর এনার্জি ট্র্যাপার নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলল।

এখন ওর ল্যাবরেটরি দরজা খুললেই দেখা যায় ছোট-বড় অসংখ্য রঙিন বুদবুদ স্থির হয়ে ভেসে আছে ঘরের ভেতরে। বাতাসে সামান্য আলোড়ন তুললেই সেগুলো হেলেদুলে নড়েচড়ে বেড়ায়। শুভদীপ ঘরের ভেতরে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ওগুলোকে দ্যাখে। আর একটা অদ্ভুত তৃপ্তি ওর বুকের ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে।

একদিন সন্ধেবেলা কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে শুভদীপ রনিতাকে বলল, রনি, আজ একটা গুড নিউজ আছে।

রনিতা নীচুগলায় যান্ত্রিকভাবে বলল, কী?

ডক্টর দত্ত, আমাদের ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর, বলেছেন আমার রিসার্চের থার্ড স্টেজ সাকসেসফুল হলে এই বিষয়ে নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করবেন–আমি হব তার চিফ ইনভেস্টিগেটর।

শুনে খুশি হলাম। রনিতার স্বরে কোনও প্রাণ ছিল না।

জানো, থার্ড স্টেজ মানে কী?

না, জানি না।

শুভদীপের মনে হল, ও যেন কোনও রোবটের সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু তাতেও ও দমে গিয়ে বলল, থার্ড স্টেজ মানে একটা বাল্ব জ্বালানো–পাঁচ মিনিটের জন্যে।

রনিতা কোনও কথা বলল না। কোনওরকম প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না ওর চোখেমুখে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রনিতা বলল, যাই, তোমার জন্যে চা করি গিয়ে।

শুভ ওকে খুশি করার জন্য বলল, একবার ও-ঘরে গিয়ে দেখবে চলো, ঘরময় কতকগুলো রঙিন বল ভেসে বেড়াচ্ছে। ওই বলগুলোর ভেতরে তোমার কথার শক্তি লুকিয়ে আছে। ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দেয় না?

রনিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, আমি যখন থাকব না, তখনও ওগুলো থেকে যাবে, তাই না?

হ্যাঁ। তুমি তো জানো, বিজ্ঞানীরা চলে যায় একের-পর-এক কিন্তু বিজ্ঞান থেকে যায়।

রনিতা হঠাৎই গলা পালটে কেমন অসহায় সুরে বলল, আমার কথা তুমি একটুও ভাবো না ।

শুভদীপ মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বলল, ভাবি। কিন্তু আমার রিসার্চটা যে অনেকটা সময় নিয়ে নেয়…।

রনিতা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আর শুভদীপ ওর গবেষণার তৃতীয় ধাপ নিয়ে ভাবতে লাগল।

একটা ব্যাপার শুভদীপ লক্ষ করছিল। ওর সামনে রনিতা ইদানীং ভীষণ কম কথা বললেও সারাদিনে ওর টকিং অ্যাভারেজ আগের তুলনায় অনেক বেশি। শুভর ডিজিটাল অডিয়ো ওয়ার্ড কাউন্টার সেই তথ্যটাই রোজ-রোজ জানিয়ে দিচ্ছিল ওকে।

রনিতার টেপ করা কথাগুলো রাতে শোনার সময় বেশ তাজ্জব হয়ে যাচ্ছিল শুভদীপ। আগে ওর কথাবার্তার পিছনে যদিও বা কোনও অজুহাত বা কারণ থাকত, এখন সেসবের কোনও বালাই নেই। যখন-তখন যা খুশি বকবক করে যায় ও, কথার কোনও মাথামুন্ডু নেই। একেবারে যেন পাগলের প্রলাপ।

রনিতা কথা বলতে এত ভালোবাসে!

শুভদীপ মাঝে-মাঝেই ভাবে, এ নিয়ে গবেষণা বন্ধ করবে। কিন্তু ওর ভেতরে একটা জেদি আর কৌতূহলী মন ওকে থামতে দেয় না।

একদিন শুভদীপের গবেষণার তৃতীয় ধাপও সফল হল।

একদিন সত্যি-সত্যিই ও একটা ১৫ ওয়াটের বালবকে সাড়ে ছ মিনিটের জন্য জ্বালিয়ে রাখতে পারল। তখন ও খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল বাচ্চা ছেলের মতো। ওর গবেষণা নিয়ে রনিতার সঙ্গে আবোলতাবোল অনেক কথা বলে গেল। আনন্দের ঝোঁকে ও খেয়ালই করল না, রনিতার মুখে এক থমথমে ছাপ–মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে আছে, চোয়ালের হাড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সেদিন রাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

রাত তখন কত হবে শুভদীপ জানে না। জিনিসপত্র ভাঙচুরের শব্দ পেয়ে ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

প্রথমেই যেটা খেয়াল করল, রনিতা পাশে নেই।

তখন শুভদীপ আর দেরি করেনি। পলকে ঘুমের ঘোর কাটিয়ে উঠে রওনা হয়েছে শব্দ লক্ষ করে। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, শব্দগুলো ভেসে আসছে ওর ল্যাবরেটরি থেকে।

ল্যাবে গিয়ে এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখল শুভদীপ।

ঘরের বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ওলটপালট করে ভেঙেচুরে ফেলেছে রনিতা। ঘরের বুদবুদগুলো এপাশে-ওপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর অসহায় ভাঙাচোরা মেয়েটা মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে।

এসব কী হচ্ছে, রনি! কাঁদছ কেন?

রনিতা স্বামীর কথায় ভূক্ষেপই করল না, আকুল হয়ে কেঁদে চলল।

শুভদীপের কাছে ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতো লাগছিল। ও অনেক করে রনিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কোনও লাভ হল না। এক প্রচণ্ড জেদ রনিতাকে একেবারে অন্য মানুষ করে দিয়েছে। ও শুভর কোনও কথায় কান দিল না। শুধু কান্নার ফাঁকে-ফাঁকে জড়ানো গলায় কীসব বলল। কথাগুলো শুভদীপ ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও দেখল ওঁর ডিজিটাল কাউন্টারের ডিসপ্লে প্যানেলে সংখ্যার মান বেড়ে যাচ্ছে।

অনেক চেষ্টার পর ক্লান্ত এবং বিরক্ত হয়ে শুভদীপ শোওয়ার ঘরে ফিরে এল। অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। তখনও ওর কানে রনিতার কান্নার গোঙানি ভেসে আসছে।

ভোরবেলা শুভদীপই রনিতার মৃতদেহ আবিষ্কার করল।

ডাইনিং হলে সিলিং পাখার সঙ্গে শাড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছে ও। লম্বা হয়ে থাকা নিষ্প্রাণ পায়ের নীচে ডাইনিং টেবিল উলটে পড়ে আছে। আর ডাইনিং হলে ভেসে বেড়াচ্ছে দুটো শব্দের বুদবুদ। ল্যাবরেটরি থেকে কীভাবে ওরা এ-ঘরে এল কে জানে! শুভর মনে হল, এই বুদবুদজোড়া রনিতার আত্মহত্যার একমাত্র সাক্ষী।

কয়েকটা চড়ুইপাখি ঘরের জানলায় বসে কিচিরমিচির করছিল, ওদের সঙ্গে কথা বলার আর কেউ নেই।

একটু খোঁজাখুঁজি করতেই সুইসাইড নোটটা দেখতে পেল শুভদীপ। ডাইনিং হলের একপাশে একটা ক্যাবিনেটের ওপরে স্টিলের গ্লাস দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল। তাতে রনিতা লিখে গেছে?

আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।
অনেক কথা বলার ছিল বলা হল না।

শুভদীপ আর সইতে পারেনি। বেপরোয়া কান্নায় ভেঙে পড়েছে রনিতার পায়ের নীচে। ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, সুইসাইড নোটের শেষ লাইনটায় রনিতা যা বলতে চেয়েছে তার মর্ম শুভদীপ ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারবে না।

এরপর থানা-পুলিশ, পাড়া-প্রতিবেশীদের গুজব আর মন্তব্যে বেশ কটা দিন কেটে গেল। তারপর থেকে শুভদীপ একা। ওকে সবসময় ঘিরে থাকে রনিতার কথার রঙিন বুদবুদ। লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি শব্দের বুদবুদ।

মাঝে-মাঝে টেপ চালিয়ে রনিতার কথা শোনে ও। মনে পড়ে, রনিতা বলেছিল, আমি যখন থাকব না তখনও ওগুলো থেকে যাবে, তাই না? আর শুভদীপ উত্তরে বলেছিল, হ্যাঁ, তুমি তো জানো বিজ্ঞানীরা চলে যায় একের-পর-এক–কিন্তু বিজ্ঞান থেকে যায়।

সবসময় এই কথাগুলোই এখন ঘুরে বেড়ায় শুভদীপের মনে। রনিতার কথা থেকে আরও অসংখ্য বুদবুদ তৈরি করতে থাকে ও। এনার্জি ট্র্যাপার নিয়ে কাজ করে যায় পাগলের মতো। যেন শব্দের বুদবুদ তৈরি করা ছাড়া এখন ওর নিঃসঙ্গ জীবনের আর কোনও লক্ষ্য নেই।

শুভদীপ ক্রমশ মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিল। তা ছাড়া ওর সবসময় মনে হত রনিতা ওর কানের কাছে ক্রমাগত বকবক করে চলেছে। ওর বিজ্ঞানী মন বলে উঠত, ব্যাপারটা শ্রুতিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ওর মনের একটা অংশ এই সরল যুক্তি মানতে চাইত না।

রনিতাকে হারিয়ে শুভদীপ একা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও একা থাকতেই চেয়েছিল। অথবা বলা যেতে পারে, ও রনিতার কথার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিল।

এরপর এমন একটা সময় এল যখন শুভদীপ রনিতার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। ল্যাবরেটরিতে বসে রনিতার কথার টেপ চালিয়ে ওর কথার পিঠে কথা বলে যেত। কোনও-কোনও সময় একা-একাই বিড়বিড় করত আপনমনে। রনিতা যে ওর কাছে নেই সেটা ও বুঝতে পারত না।

এইরকম একটা অদ্ভুত মানসিক অবস্থায় ও একদিন ঘোর দুপুরে একটা শব্দের বুদবুদ সঙ্গে করে বেড়াতে গেল লেকের ধারে। প্রায় জনহীন মাঠে দুপুরের রোদে বুদবুদটাকে শূন্যে ভাসিয়ে ও তার গায়ে নানা রঙের খেলা দেখতে লাগল।

ক্রমে-ক্রমে এই দুপুরে বেড়ানোটা শুভদীপকে পেয়ে বসল নেশার মতো। বুদবুদের গায়ে রঙের খেলা দেখতে-দেখতে ও বিড়বিড় করে কথা বলত রনিতার সঙ্গে। মাঝে মাঝে ভাবত, রনিতার অসংখ্য কথা মাঠে-ঘাটে-আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিলে কেমন হয়।

আমি যখন থাকব না তখনও ওগুলো থেকে যাবে, তাই না? শুভদীপের বুকের ভেতরে রনিতা কথা বলে উঠত।

এইভাবে যখন সময় কেটে যাচ্ছে তখন একদিন শুভদীপ ঠিক করল, ঘনীভূত শব্দের বুদবুদগুলোকে দুপুরের খোলা মাঠে নিয়ে গিয়ে সমস্ত শব্দ-শক্তিকে এক মুহূর্তে ছড়িয়ে দেবে আকাশে। বাতাসে। তাতেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি হবে রনিতা। আর শুভদীপের অপরাধবোধও একেবারে হালকা হয়ে যাবে। এইভাবেই বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে মুক্তির পথ।

দুপুরবেলা খোলা মাঠে গাছতলায় বসে শূন্যে ভেসে থাকা দু-একটা বুদবুদের রঙিন শরীরের দিকে তাকিয়ে শুভদীপ এই মুক্তির কথা ভাবত আর রনিতার সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলত আপনমনে।

ওর আশা ছিল শুধু একটাই, ও চলে যাবে, কিন্তু ওর বিজ্ঞান থেকে যাবে সকলের জন্য।

এখন আমি বুঝতে পেরেছি, ১১ নভেম্বর বেলা বারোটা নাগাদ কী হয়েছিল। লেকের মাঠ থেকে রনিতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল আকাশে-বাতাসে। আর সেইসঙ্গে একজন ভেঙে পড়া নুয়ে পড়া আদ্যন্ত বিজ্ঞানী তরুণের ছিন্নভিন্ন দেহ ধূলিকণার মতো মিশে গিয়েছিল বাতাসে।

সেদিন দুপুরে এই ঘটনার সাক্ষীও যদি কেউ থেকে থাকে তা হলে দূর থেকে শব্দের বুদবুদগুলোকে সে নিশ্চয়ই রঙিন গ্যাস-বেলুন বলে ভেবেছে। আর গ্যাস বেলুন থেকে যে এতবড় বিস্ফোরণ হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই কেউই বিশ্বাস করেনি।

চিঠির শেষে শুভদীপ লিখেছেঃ

আমার নিদের্শ মতো এ-চিঠি তোর হাতে পৌঁছোবে চরম ঘটনার বেশ কিছুদিন পর। তবে তার আগেই তুই শব্দ শুনে টের পেয়ে যাবি, আমি আর নেই। না, আমার এই ব্যাপারটাকে তুই সুইসাইড বলে ভুল বুঝিস না। এটা আমার এক্সপেরিমেন্টের একটা পার্ট। যদিও রনিতার কথা আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে গেলে কী হবে তা দেখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। আমার গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র এই সঙ্গে পাঠালাম। এগুলো আমাদের ইন্সটিটিউটের ডিরেকটর ডক্টর দত্তকে দিয়ে দিস।

আমি জানি, এ চিঠি পেলে তুই দুঃখ পাবি। কিন্তু জানিসই তো, বিজ্ঞানী চলে যায়, কিন্তু বিজ্ঞান থেকে যায়।

এটাই ছিল শুভদীপের শেষ চিঠির শেষ লাইন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress