Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রূপসী || Sharadindu Bandyopadhyay

রূপসী || Sharadindu Bandyopadhyay

আমি অবিবাহিত এবং অনাত্মীয় যুবক। একটি ছোট্ট বাড়ি বাড়া করিয়া থাকি এবং দালালি করি।

আমাকে বোধ হয় ভগবান দালাল করিয়াই পৃথিবীতে পাঠাইয়াছিলেন। পরের মাল পরের কাছে বিক্রয় করিয়া তাহারি ভিতর হইতে দুপয়সা লাভ করিয়া আমার একান্ত অদ্বৈতবাদী সংসার চলিত। নিজের বলিয়া কোনও দিন কোনও বস্তুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি নাই। পৃথিবীর সব জিনিসই আমার কাছে পরস্ব; শুধু দালালিটুকু আমার।

এরূপ জীবন যাত্রার একটা সুখ এই যে ভাবনা চিন্তা বড় একটা থাকে না। মানুষের সহিত যাহার সামাজিক বন্ধন নাই, শুধু টাকার বন্ধন, সে মুক্ত। আমিও ছিলাম মুক্ত। একেবারে ঋষিকল্প পুরুষ ছিলাম এমন কথা বলি না। এ জগতে সেরূপ লোক কজনই বা আছে? তবে ঋষি না হইয়াও যাহারা মুক্ত, যাহারা শরীরটাকে সুখ দিয়াও মনটাকে বন্ধনের জাল হইতে বাঁচাইয়া রাখে আমি ছিলাম তাহাদেরি একজন।

বছরখানেক পূর্বের কথা বলিতেছি। প্রতি রবিবারে একটি স্ত্রীলোক আমার বাড়িতে ভিক্ষা লইয়া যাইত। একদিন হঠাৎ চোখে পড়িয়া গেল। স্ত্রীলোকটির সর্বাঙ্গে বস্ত্রাবৃত; এমন কী মুখ পর্যন্ত পুরু কাপড়ের ঘোমটায় ঢাকা। পা ছাড়া শরীরের কোনও অংশ চোখে পড়ে না। কিন্তু কি অপূর্ব গতিভঙ্গি! পূর্ণ যৌবন না হইলে এরূপ দর্পিত অথচ সুমন্দ, উচ্ছল অথচ সংযত গতিভঙ্গি হয় না! পরিপক্ক ডালিম যেমন বস্ত্র বন্ধনের অন্তরালে থাকিয়াও নিজের পরিপূর্ণ শ্রীকে প্রস্ফুট করিবার চেষ্টা করে, তাহার প্রত্যেক অঙ্গসঞ্চালন যেন তাহার অবরুদ্ধ যৌবনের আভাস ইঙ্গিতে ব্যক্ত করিতেছিল।

আমি তাহাকে নিকটে ডাকিলাম। কাছে আসিলে তাহার ঘোমটার ভিতর একটা ব্যর্থ দৃষ্টি হানিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—তুমি প্রতি রবিবার আস? প্রশ্নটা নিতান্তই অর্থহীন; কিন্তু যখন ডাকিয়াছি তখন কিছু বলা চাইত।

সে ঘাড় নাড়িয়া প্রশ্নর উত্তর দিল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—তুমি একলা আস দেখতে পাই তোমার কী কেহ নেই?

সে ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিল—না নাই! কিন্তু তাহার মুখ দেখিবার চেষ্টা আমার সফল হইল না। ঘোমটা মুখ হইতে এক চুলও সরিল না।

আমি একটু ইতস্তত করিয়া বলিলাম—তোমার বয়স কাঁচা বলে বোধ হচ্ছে। তুমি আর দোরে দোরে ভিক্ষে করে বেড়িও না। যখন অভাব হবে আমার কাছে এসো। বলিয়া তাহার আঁচলের উপর চার আনা পয়সা দিলাম। সে পয়সা লইয়া চলিয়া গেল। আমার কথার ইঙ্গিত বুঝিল কিনা জানি না, কিন্তু তাহার অদৃশ্য দেহটা যেন অদম্য হাসির উচ্ছ্বাসে তরঙ্গায়িত হইতে হইতে দূরে চলিয়া গেল।

পরের রবিবারে সে আবার আসিল। আমি তাহাকে ঘরের ভিতর আসিতে বলিলাম, সে আসিল, দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল।

আমি বলিলাম—তুমি মুখ খোল না কেন?

কোনও জবাব নাই। সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

আমি তাহাকে কথা কহাইবার জন্য বলিলাম—তুমি কথা কও না কেন? বোবা বুঝি!

ঘোমটার ভিতর হইতে হাসির শব্দ আসিল। আমার সমস্ত অন্তরাত্মা সেই হাসির শব্দে তড়িৎপৃষ্টের মতো চমকিয়া উঠিল। কি মিষ্ট অথচ কি বিষাক্ত হাসি! স্বর্গের সুধা যেন নরকের অন্ধকারে পচিয়া পচিয়া বিষ হইয়া উঠিয়াছে! বুক শিহরিয়া উঠে কিন্তু শরীর পুলকিত হয়। আমি তাহার দিকে তাকাইয়া রহিলাম। এ কীরূপ ভিখারিণী?

তাহাকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া আমার চমক ভাঙিল। উঠিয়া তাহাকে আট আনা পয়সা দিলাম। শুধু বলিলাম–আবার এসো।

তারপর সমস্ত সপ্তাহ আমার মন একটা মোহে আচ্ছন্ন হইয়া রহিল। সেই হাসি! এত অল্প যেন একটি আঙুরের রস, এত তীব্র যেন সাপের ছোবল, এত গভীর যেন পাতাল ভেদ করিয়া উঠিয়াছে। এই অবগুণ্ঠনতার দেহই বা কিরূপ, তাহার অন্তঃকরণই বা কেমন! সবই যেন যবনিকার অন্তরালে রহিয়াছে! আমার মুগ্ধ ইন্দ্রিয়গুলা তাহার অন্তর বাহিরের আবরণ উদঘাটন করিয়া দেখিবার জন্য অনুক্ষণ উন্মুখ হইয়া রহিল।

রবিবারে পূর্ববৎ সে দেখা দিল। আমি তাহার প্রত্যাশাতেই বসিয়া ছিলাম। একসঙ্গে অনেকগুলা প্রশ্ন করিয়া ফেলিলাম—তুমি কে? কোথায় থাক! মুখ খোলো নাকথা কওনা কেন? ভিক্ষা কর কেন? আমার মনে হয় তুমি বাস্তবিক ভিকিরি নও—চিরদিন এমন ছিলে না।

সে চুপ করিয়া রহিল।

আমি বলিলাম—আমার কথার জবাব দাও। এই সাত দিন আমি তোমার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবিনি।

আমার কথা শুনে আপনার কী হবে?

তাহার কথা না কহাটা আমার এতই অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল যে এই কথাগুলা ধাক্কার মতো আমার বুকে আসিয়া লাগিল। কিছুক্ষণ অভিভূত থাকিয়া বলিলাম—কী সুন্দর গলা। তুমি কী কণ্ঠস্বর লুকোবার জন্যেই চুপ করে থাক!

হ্যাঁ।

কেন?

শুনে আপনার লাভ কি?

আমি বলিলাম—ও কথা থাক। তুমি মুখ খোল—আমি দেখি।

বস্ত্রান্তরাল হইতে উত্তর আসিল—কেন?

আমি হাসিলাম—কেন আবার! মেয়ে মানুষের মুখ লোকে দেখতে চায় কেন,ভাল লাগে বলে।

আমার মুখ আপনার ভাল লাগবে না।

সে আমি বুঝব। তোমার রূপ কী কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পার? ভরা কলসীর মতো চলতে গেলেই যে চকে ওঠে!

সত্যি? কথাটার আনুসঙ্গিক যে ভঙ্গি ও অধর কুঞ্চন বস্ত্রের মধ্যেই লুকাইয়া রহিল তাহা মনের মধ্যে অনুভব করিলাম। আমি দালাল, জিনিস চিনি। বুঝিলাম এ নারী রসিকা। আরও বুঝিলাম এ সত্যকার ভিখারিণী নয়—এত সুনিপুণ বাক্যভঙ্গি আজন্ম ভিখারিণীর হয় না। কৌতূহল এবং আকর্ষণ দুই-ই বাড়িতে লাগিল। বলিলাম—রূপ লুকিয়ে রাখবার জিনিস নয়।

সে কথার কোনও জবাব না দিয়া সে বলিল—আজ উঠি।

আমি তাহাকে একটা টাকা দিয়া বলিলাম—অন্তত তোমার নাম কি বল।

রূপসী বলিয়া সে দ্রুতবেগে চলিয়া গেল। দূর হইতে সেই তীব্র তিক্ত চাপাহাসি আবার শুনিতে পাইলাম।

যাহা ভাল করিয়া বুঝিতে পারি না তাহার একটা দুর্দমনীয় আকর্ষণ আছে; তাহার উপর আমার আর একটা টান ছিল—ওই অবগুণ্ঠিতার যৌবন। কথায়, কণ্ঠস্বরে, অঙ্গভঙ্গিমায় যেটুকু পাইয়াছিলাম তাহাতে আমার তৃষ্ণা আরও বাড়িয়া গিয়াছিল। নারীর যৌবন ও রূপ এতদিন আমার কাছে কেবল ক্ষণকালের উপভোগের বস্তু ছিল— বিশেষের প্রতি আমার কোনও পক্ষপাত ছিল না। কিন্তু এই নারী আমাকে আমার সমস্তটাকে—সর্বাঙ্গ দিয়া টানিতেছিল। আমি স্থির করিলাম এবার আসিলে তাহাকে আমি মুখ খুলিয়া দেখিব—তাহাকে—যাক, আমার মনের সঙ্কল্প শুনিয়া পাঠকের কাজ নাই।

রবিবার যখন সে আসিল তখন প্রথম চোখে পড়িল তাহার মুখের উপর ঘোমটার এক জায়গায় একটু রক্ত শুকাইয়া আছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—ওকি, রক্ত কিসের। ক্ষণকালের জন্য সে যেন ত্রস্ত হইয়া উঠিল। তারপর স্থির হইয়া বলিল—ও কিছু নয়।

আমার অসংযত মনটা তাহাকে লইয়া একটা উচ্ছুঙ্খল কাণ্ড বাধাইবার জন্য ক্ষুধিত শ্বাপদের মতো ভিতরে ভিতরে গর্জন করিতেছিল। কিন্তু আমি তাহাকে সবলে সংযত করিয়া আস্তে আস্তে আরম্ভ করিলাম— দেখ রূপসী, আমি কদিন থেকে ভাবছি যে তোমাকে একটা প্রস্তাব করব।

সে বলিল—কী প্রস্তাব, বলুন। কথার মধ্যে বোধ হয় একটা নিগূঢ় ব্যঙ্গ ছিল যাহার অর্থ–তুমি যা প্রস্তাব করিবে আমি জানি। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে তখন তরল আগুন ছুটাছুটি করিতেছিল। আমি বলিলাম—তার আগে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। তোমার কি আত্মীয়-স্বজন বাপ ভাই কেউ নেই?

রূপসী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পরে বলিল—আছে।

আমি বলিলাম—তবে তোমার এ দশা কেন? তুমি তো ছোটলোকের মেয়ে নও।

সে বলিল—না। কিন্তু বাপ ভাই থাকতেও কী করে মেয়ে মানুষের এদশা হয় আপনি জানেন না?

আমি সাগ্রহে বলিলাম—বেরিয়ে এসেছ?

সে অস্বাভাবিক কণ্ঠে বলিল—চার বৎসর স্বামীর ঘর করার পর আমি বিধবা হই। বিধবা হবার দুমাস পরে একজন মুসলমানের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। আবার সেই হাসি–তিক্ত মধুর; আমার বক্ষের মধ্যে মদের মতো ফেনাইয়া উঠিতে লাগিল।

আমি গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বলিলাম—তবে আর কোনও কথা নেই। তুমি আমার কাছে থাকবে?

সে বলিল—আমাকে একবার দেখবেন না!

আমি দুহাত বাড়াইয়া তাহার দিকে অগ্রসর হইলাম।

সে দ্রুত সরিয়া গিয়া বলিল-আমাকে ছোঁবেন না। আগে দেখুন—এই বলিয়া ঘোমটা সরাইয়া মুখ খুলিয়া দাঁড়াইল!

অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ তীব্র আলো জ্বলিয়া উঠিলে মানুষের চোখ যেমন ধাঁধিয়া যায় আমারও তাহাই হইল। তারপর চক্ষু পরিষ্কার হইলে দেখিলাম,—মুখ নয়, মুখের পরিবর্তে একটা রক্তাক্ত দগদগে ঘা! সে মুখ কখনও সুন্দর ছিল কিনা বুঝিবার কোনও উপায় নাই। চক্ষুর নিম্নের মাংস পচিয়া খসিয়া গিয়াছে, যেখানে নাক ছিল সেখানে কেবল একটা গভীর রক্তবর্ণ গহ্বর; ঠোঁট দুটা ফুলিয়া অত্যন্ত পুরু এবং শ্বেত হইয়া উঠিয়াছে। গালে ও কপালে রক্তমুখ ব্রণ ফুটিয়া ঘা হইবার অপেক্ষায় আছে। এই জীবন্ত বিভীষিকাকে দেখিয়া আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম——কুষ্ঠ-কুষ্ঠ-কুষ্ঠ—আর কোনও কথা মুখ দিয়া বাহির হইল না। তারপর শরীরের সমস্ত স্নায়ুগুলা যেন শিথিল হইয়া গেল, আমি মুখ ঢাকিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলাম। সেই অবস্থায় অর্ধমূৰ্ছিত ভাবে শুনিলাম—কেমন? চান আমাকে?

আমি মুখ তুলিলাম না—শুধু তাহার তীব্র সূচ্যগ্র সূক্ষ্ম হাসি আমার সর্বাঙ্গে বিঁধিতে লাগিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *