Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নখদর্পণ || Sharadindu Bandyopadhyay

নখদর্পণ || Sharadindu Bandyopadhyay

ঘটনাটি ঘটিয়াছিল পঁচিশ বছর আগে, বিহার প্রদেশের একটি ছোট শহরে। আমার বাল্যবন্ধু শম্ভুনাথের পুত্রের বিবাহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম। বরযাত্রী যাইবার কথা ছিল কিন্তু কাজের চাপে যাইতে পারি নাই; তাই বৌভাতের ভোজ খাইতে স্ত্রী ও ছোট দুটি ছেলেমেয়েকে লইয়া এক রাত্রির জন্য উপস্থিত হইয়াছিলাম।

আমার কর্মস্থল হইতে শম্ভুর বাসস্থান ট্রেনযোগে বেশী দূর নয়, আন্দাজ আশি মাইল। শনিবার দুপুরবেলা যাত্রা করিয়া ভাবিয়াছিলাম বেলা থাকিতে থাকিতে অকুস্থলে পৌঁছিব, কিন্তু ট্রেন দেরি করিয়া ফেলিল। যখন পৌঁছিলাম তখন শীতের রাত্রি নামিয়াছে।

স্টেশনে নামিয়া দেখি শম্ভু উপস্থিত। আশি মাইলের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও বহুকাল শম্ভুর সঙ্গে দেখা হয় নাই। আমার মনের মধ্যে তাহার চেহারার যে চিত্রটি ছিল তাহার সহিত বর্তমান চেহারার তফাৎ হইয়াছে, গোঁফ ও জুলফিতে পাক ধরিয়াছে; গাল শীর্ণ, বুঝিলাম দাঁত পড়িয়াছে। সেও বোধকরি আমার চেহারার অনুরূপ পরিবর্তন লক্ষ্য করিল, কিছু কিছু বলিল না। বলিবার আছে কি? যৌবন বেদনা রসে উচ্ছল দিনগুলি তো আর ফিরিবে না!

শম্ভু গাড়ি আনিয়াছিল। সে সম্পন্ন গৃহস্থ, নিজের মোটর আছে; আমাদের মোটরে তুলিয়া নিজে মোটর চালাইয়া লইয়া চলিল। আমি বলিলাম, তোর নিজের বাড়িতে আজ যজ্ঞি, তুই নিজে এলি কেন? কাউকে পাঠিয়ে দিলেই তো হত।

শম্ভু বলিল, আমি বরকর্তা, আমার আর কাজ কি? তাই চলে এলাম।

বলিলাম, বলিস কি, বরকর্তার কাজ নেই! কত লোক নেমন্তন্ন করেছিস?

তা বাঙালী বেহারী মিলিয়ে শতিনেক হবে।

তবে! বাড়ি ফিরে দেখবি, অতিথিতে ঘর ভরে গেছে।

শম্ভু একটু হাসিয়া বলিল, তা হোক। নটবর আছে।

নটবর! সে কে?

তুই চিনবি না। নটবর মল্লিক, কয়েক বছর হল এখানে এসেছে। চৌকশ লোক, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব জানে। নিজের কাজ ফেলে পরের কাজ করে বেড়ায়। কারুর বাড়িতে বিয়ে পৈতে থাকলে নটবর সেখানে আছেই। নটবর না হলে কাজ কারুর চলে না।

এই জাতীয় সেবক পৃথিবীতে আছে শুনিয়াছি, যাহারা পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করিয়াছে, যাহাদের অফুরন্ত কর্মস্পৃহা কেবল নিজের কাজ করিয়া নিঃশেষিত হয় না। আমার ভাগ্যদোষে আমি এ পর্যন্ত এরূপ মানুষের সাক্ষাৎ পাই নাই। শম্ভুকে ভাগ্যবান বলিতে হইবে।

শম্ভুর বাড়িতে পৌঁছিলাম। গ্যাস-লাইট আলো। শানাইয়ের বাজনায় বাড়ি সরগরম। শম্ভুর বাড়িটি একতলা, কিন্তু বেশ বড়; চারিদিকে আম কাঁঠালের বাগান, মাঝখানে বাড়ি। সম্মুখে খোলা জমির উপর শামিয়ানা পড়িয়াছে।

শম্ভুর স্ত্রী আসিয়া আমার স্ত্রীকে ও নিদ্রালু ছেলেমেয়ে দুটিকে ভিতরে লইয়া গেলেন, শম্ভু আমাকে লইয়া গিয়া শামিয়ানার আসরে বসাইল। কয়েকজন বাঙালী ও বেহারী অতিথি ইতিমধ্যেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। পান সিগারেট চলিতেছে। শম্ভু কয়েকজন বিশিষ্ট অতিথির সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিল। অতিথিদের মধ্যে বাঙালীই বেশী, কয়েকজন বেহারী হিন্দু মুসলমান আছেন।

এইখানে নটবরকে দেখিলাম। দোহারা মজবুত চেহারা, বয়স আন্দাজ চল্লিশ; এই শীতেও হাতকাটা ফতুয়া পরিয়া ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় সমান অধিকার। চাকরদের হুকুম করিতেছে, অতিথিদের সঙ্গে মিষ্টালাপ করিতেছে, আতরদান সামনে ধরিয়া খাতির করিতেছে। আবার অন্দরে গিয়া ফুলশয্যার ফুলের কি ব্যবস্থা হইল তাহার তদারক করিয়া আসিতেছে! লুচি ভাজা কখন আরম্ভ করিলে গরম গরম লুচি অতিথিদের পাতে পড়িবে অথচ লুচিতে টান পড়িবে না, সে-হিসাবও তাহার মাথার মধ্যে আছে। নটবরের তত্ত্বাবধানে কোথাও এতটুকু ত্রুটি হইবার যো নাই। সত্যই দারুণ কাজের লোক।

রাত্রি সাড়ে দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ হইয়া গেল, অতিথিরা পান চিবাইতে চিবাইতে বিদায় লইলেন। তারপর বর-বধূকে ফুলশয্যায় শয়ন করাইয়া মেয়েদের আড়ি পাতার পালা শেষ হইতে মধ্যরাত্রি হইল।

ক্লান্ত দেহে শুইতে যাইতেছি, শুনিলাম বাড়ির বারান্দায় দাঁড়াইয়া নটবর শম্ভুকে বলিতেছে, দাদা, আজ তাহলে চলি। আবার ভোরবেলাই আসতাম, এখনও অনেক কাজ পড়ে রয়েছে, শামিয়ানা ফেরত দিতে হবে, গ্যাস-লাইটের দাম চুকোতে হবে কিন্তু বৌটার শরীর ভাল নয়, ঘুষঘুষে জ্বর হচ্ছে। কদিন ওদিকে মন দিতে পারিনি; সকালে তাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। কিন্তু আপনি কিছু ভাববেন না, সাড়ে দশটার মধ্যেই আমি এসে হাজির হব। আপনার বাড়ির কাজ তুলে দিয়ে তবে আমার অন্য কাজ।

ধন্য নটবর!

যে অতিপ্রাকৃত ঘটনাটি এই কাহিনীর বিষয়বস্তু তাহার পরিবেশ রচনা করিতে গিয়া দেখিতেছি অনেক বাজে কথা বলা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আর নয়, সরাসরি মূল কাহিনী আরম্ভ করি।

বিয়ে বাড়িতে যেমন হইয়া থাকে, রাত্রে যে যেখানে পাইল শয়ন করিল। মেয়েরা শিশুদের লইয়া অন্দরে রহিলেন, পুরুষেরা বার বাড়িতে। আমি ও শম্ভু বৈঠকখানা ঘরের চৌকির উপর শয়ন করিলাম।

পরদিন সকালবেলা আমার অষ্টমবর্ষীয় পুত্র নীলু আমার ঘুম ভাঙাইয়া দিল, গায়ে ঠেলা দিতে দিতে উত্তেজিত স্বরে বলিল, বাবা, ওঠ ওঠ, চোর এসেছে।

ধড়মড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিলাম। আমার কন্যা নবমবর্ষীয়া বুলা উপস্থিত ছিল, সে নীলুকে বিরক্তভাবে সরাইয়া দিয়া বলিল, যা, তুই কিছু জানিস না। বাবা, কাল রাত্তিরে চোর এসেছিল, নতুন বৌয়ের সব গয়না নিয়ে পালিয়ে গেছে।

দেখিলাম শম্ভু আগেই উঠিয়া গিয়াছে। চারদিক হইতে উৎকণ্ঠিত উত্তেজনার গুঞ্জন আসিতেছে। আমিও উঠিয়া পড়িলাম।

খবরটা মিথ্যা নয়।

বর-বধূ রাত্রে যে-ঘরে ফুলশয্যা করিয়াছিল তাহার লাগাও একটা কুঠুরিতে কনে-বৌয়ের যাবতীয় গহনা একটি স্টীলের ট্রাঙ্কে রাখা হইয়াছিল। ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল। রাত্রে চোর আসিয়া বাহিরের জানালার শিক বাঁকাইয়া প্রবেশ করিয়াছে ও গহনার বাক্সটি লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। পাশের ঘরে বর-বধূ কিছুই জানিতে পারে নাই। প্রায় দশ হাজার টাকার গহনা।

খবরটা বাড়ির মধ্যেই আবদ্ধ নাই, পাড়াতেও রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছে; পড়শী আসিয়া জুটিয়াছে। পুলিসেও খবর পাঠানো হইয়াছে। আমরা বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া গুলতান করিতেছি। শম্ভু অত্যন্ত বিচলিত। দশ হাজার টাকার গহনা—

একটা চাকর হাঁপাইয়া হাঁপাইতে আসিয়া খবর দিল, বাড়ির পিছনদিকে আম বাগানের মধ্যে গহনার বাক্সটা ভাঙা অবস্থায় পড়িয়া আছে। সকলে সেই দিকে ছুটিল, ছোট ছেলেমেয়েরা আগে আগে, বয়স্থরা পিছনে। দল বড় কম নয়; পাড়ার নিম্নশ্রেণীর লোক তো আছেই, দু-একজন ভদ্ৰশ্রেণীর লোকও আছেন। মোসীন সাহেব নামক এক মুসলমান ভদ্রলোকের সহিত কাল রাত্রে শম্ভু আলাপ করাইয়া দিয়াছিল; পাড়াতেই থাকেন, গম্ভীর প্রকৃতির প্রৌঢ় ব্যক্তি; মুখে ছাঁটা দাড়ি, চোখে সুরমা। সাহেব তালিমের লোক, ইংরেজী লেখাপড়া অল্পই জানেন। তিনি খবর পাইয়া আসিয়াছেন।

বাড়ির পিছনদিকে বাগানের কিনারায় আমগাছের তলায় ভাঙা ট্রাঙ্কটা পড়িয়া আছে। আমরা গিয়া ঘিরিয়া ধরিলাম। ট্রাঙ্কের তলা চাড় দিয়া ভাঙা হইয়াছে; বধুর কয়েকটা আটপৌরে শাড়ি সেমিজ আশেপাশে ছড়ানো, কিন্তু গহনা ও দামী কাপড়-চোপড় অদৃশ্য হইয়াছে। চোর অতি বিজ্ঞ, খেলো জিনিস লইয়া নিজেকে ভারাক্রান্ত করে নাই।

পুলিস আসিয়া পড়িল। একজন ছোট দারোগা, সঙ্গে দুজন কনস্টেবল। আমাদের দেশের পুলিসের কর্মতৎপরতার কথা কাহারও অবিদিত নাই। যাহার বাড়িতে চুরি হইয়াছে পুলিসের জেরার ঠেলায় সে চোর বনিয়া যায়; তারপর কথায় কথায় থানায় দৌড়াদৌড়ি করিতে করিতে গৃহস্থের কালঘাম ছুটিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চোর অবশ্য ধরা পড়ে না এবং চোরাই মাল কোন্ বিচিত্র পথে কোথায় গিয়া উপনীত হয় তাহা নির্ণয় করা শিবেরও অসাধ্য।

বর্তমান ক্ষেত্রেও ছোট দারোগা অশেষ তৎপরতা দেখাইলেন। শম্ভু শহরের গণ্যমান্য লোক। তাহাকে হুমকি দেওয়া চলে না কিন্তু তিনি বাড়িসুদ্ধ লোককে জেরা করিলেন, সকলের নাম ধাম লিখিয়া লইলেন, চাকরদের ধমকাইলেন, চোরাই মালের ফিরিস্তি তৈরি করিলেন। ঘণ্টা দুই এইভাবে কাটাইয়া তিনি একজন কনস্টেবলকে পাহারায় নিযুক্ত করিয়া অন্য কনস্টেবলকে লইয়া প্রস্থান করিলেন। শঙ্কুকে আশ্বাস দিয়া গেলেন বাড়ির লোকের কাজ বলে মনে হচ্ছে।-– আপনি চিন্তা করবেন না, চোর ধরা পড়বে।

আমরা কয়জন বিমর্ষভাবে বৈঠকখানায় গিয়া বসিলাম। মোসীন সাহেব আমাদের সকলের মনের কথা প্রকাশ করিয়া বলিলেন, পুলিসের দ্বারা কিছু হবে না। চোরকে ধরে যদি ওদের সামনে হাজির করা যেত, তাহলে ওরা তাকে বেঁধে নিয়ে যেত। তার বেশী ওরা পারবে না।

শম্ভু বলিল, তা কি জানি না? কিন্তু উপায় কি বলুন? কাউকে সন্দেহ করাও যাচ্ছে না। চাকরদের মধ্যে কেউ চুরি করেছে আমার বিশ্বাস হয় না। এ পেশাদার চোরের কাজ।

কিছুক্ষণ এই লইয়া আলোচনা হইল। যদি পেশাদার চোর হয় তাহা হইলে বমাল ফেরত পাইবার কোনও আশাই নাই; এতক্ষণে গহনাগুলো চোরা-স্যাকরার কাছে গিয়া সোনার তালে পরিণত হইয়াছে।

হঠাৎ মোসীন সাহেব বলিলেন, আপনারা যে মন্ত্ৰতন্ত্র মানেন না, নইলে চেষ্টা করে দেখা যেত।

শম্ভু চকিত হইয়া বলিল, মন্ত্রতন্ত্র! সে কি রকম?

মোসীন সাহেব বলিলেন, আছে। হিন্দুদের মধ্যেও আগে ছিল। আমাদের মধ্যেও আছে। যে চুরি করেছে তার চেহারা দেখা যায়, চেনা লোক হলে সনাক্ত করা যায়; কি ভাবে চুরি করেছে, কোন পথে গিয়ে কোথায় চোরাই মাল লুকিয়ে রেখেছে তাও দেখা যায়। কিন্তু আপনারা কি এসব বুজরুকি বিশ্বাস করবেন?

বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু বিপাকে পড়িলে বাঘ ফড়িং খায়। শম্ভু কয়েকবার ঘাড় চুলকাইয়া আমার দিকে আড়চোখে চাহিয়া বলিল, তা চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? হাত কোলে করে বসে থাকার চেয়ে ভাল। কী করতে হবে মোসীন সাহেব?

মোসীন সাহেব উঠিয়া বলিলেন, আপনাদের কিছুই করতে হবে না, যা করবার আমি করব। বসুন, আমি এখনি আসছি।

তিনি নিজের বাড়িতে চলিয়া গেলেন। পনেরো কুড়ি মিনিট পরে ভাল কাপড়-চোপড় পরিয়া ফিরিয়া আসিলেন। মাথার পশমের রোমশ টুপি, গায়ে দামী শেরোয়ানি। আমাদের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইয়া তিনি ডান হাতের মুঠি খুলিয়া দেখাইলেন; হাতের তেলোয় একটি আংটি রহিয়াছে।

আংটিটি বোধ হয় চাঁদির, বেশ ভারী গড়নের। তাহাতে বসানো রহিয়াছে একটি আধুলির মতো গোল কালো পাথর। চকচকে কালো সমতল পাথর। আংটি দেখিয়া খুব দামী বলিয়া মনে হয় না।

শম্ভু বলিল, আংটি দেখছি। কী হবে আংটি?

মোসীন সাহেব বলিলেন, মন্ত্রপূত আংটি। প্রায় চারশো বছর এই আংটি আমাদের বংশে আছে। আকবর বাদশার সময় দিল্লীর এক ফকির আমার পূর্বপুরুষকে দিয়েছিলেন। এর গুণ এখনি দেখতে পাবেন।–একটু তেল আনান।

তেল!

হাঁ, যে কোন তেল। এক ফোঁটা হলেই চলবে।

ইতিমধ্যে বাড়ির কচিকাচা ছেলেমেয়েরা আসিয়া বৈঠকখানায় জমা হইয়াছিল; শম্ভুর ইঙ্গিতে একটি মেয়ে ছুটিয়া চলিয়া গেল এবং এক শিশি কেশতৈল লইয়া উপস্থিত হইল। মোসীন সাহেব শিশির মুখে আঙুল ভিজাইয়া আংটির সমতল পাথরের উপর মাখাইয়া দিলেন, মসৃণ কালো পাথরটা আয়নার মতো চকচক করিয়া উঠিল।

তিনি বলিলেন, আসুন, খোলা জায়গায় যাওয়া যাক।

বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় ছেলেবুড়ো সকলে গিয়া দাঁড়াইলাম। আমার ছেলে মেয়ে নীলু ও বুলা বাচ্চাদের দলে আছে এবং খুবই উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। একে তো চোর সম্বন্ধে তাহাদের মনে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নাই, তার উপর চোর ধরিবার এই অভিনব প্রক্রিয়া তাহাদের মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছে। আমরাও কম আকৃষ্ট হই নাই; বাটি-চালা, বাঁশচালা প্রভৃতির কথা শোনা ছিল; সেকালে নখদর্পণ ছিল। মোসীন সাহেবের আংটি বোধ করি তাহারই মুসলমানী সংস্করণ। কিন্তু সত্যই কি ইহার দ্বারা কিছু জানা যায়? না স্রেফ বুজরুকি?

মোসীন সাহেব শিশুর দলকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিলেন, দুটি বাচ্চা দরকার। বলিয়া বুলা ও নীলুকে কাছে ডাকিলেন।

বুলা ও নীলু একটু ভয়ে ভয়ে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলাম; তাহাদের দিয়া কিরূপ প্রক্রিয়া করাইবেন? বলিলাম, বয়স্ক লোক দিয়ে কি হবে না?

মোসীন সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না। মন সরল এবং নিষ্পাপ হওয়া চাই।

আর কিছু বলিলাম না। মোসীন সাহেব আংটিটি বুলার হাতে দিয়া বলিলেন, তোমরা দুজনে এই আংটি ধর, পাথরের দিকে চেয়ে থাকে। যদি কিছু দেখতে পাও বোলো।

বুলা ও নীলু পাশাপাশি দাঁড়াইয়া আংটি ধরিল, বুলা বাঁ হাতে এবং নীলু ডান হাতে ধরিল, একাগ্র চক্ষে আংটির পাথরের দিকে চাহিয়া রহিল।

মোসীন সাহেব দুই পা পিছনে সরিয়া আসিলেন, চোখের উপর করতল আড়াল করিয়া বিড় বিড় করিয়া মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন।

প্রায় দশ মিনিট। বয়স্থ ব্যক্তিরা সকলেই একটু অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিতে লাগিলাম। তারপর বুলা হঠাৎ চিৎকার করিয়া উঠিল, একটা মুখ—একটা মুখ দেখতে পাচ্ছি। নীলুও মুখে একটা সমর্থনসূচক শব্দ করিল, দুজনেই দেখিয়াছে।

আমরা সকলে তাহাদের পানে ছুটিয়া গেলাম। কিন্তু মোসীন সাহেব দুই হাত তুলিয়া আমাদের নিবারণ করিলেন, বলিলেন, আপনারা কেউ দেখবেন না, তাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।

আমরা থমকিয়া গেলাম। তিনি নীলু ও বুলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কার মুখ দেখছ? চেনা লোক?

তাহার দুজনেই মাথা নাড়িল, না, চিনতে পারছি না।

মোসীন সাহেব আবার অনুচ্চকণ্ঠে মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে প্রশ্ন করিলেন, এবার কি দেখছ?

বুলা বলিল, মুখটা মিলিয়ে যাচ্ছে।

নীলু বলিল, যাঃ, অন্ধকার হয়ে গেল।

মোসীন সাহেব বলিলেন, চেয়ে থাকো। কী দেখতে পাও বলো। তিনি আবার মন্ত্র আবৃত্তি করিতে লাগিলেন।

কিছুক্ষণ পরে বুলা একটি তীক্ষ্ণ নিশ্বাস টানিয়া বলিল, অন্ধকার কেটে যাচ্ছে… একটা বাড়ির জানালা…যে লোকটার মুখ দেখেছিলুম সে জানালার গরাদ খুলে ভেতরে ঢুকছে…ওই আবার বেরিয়ে আসছে…হাতে একটা কী রয়েছে…তোরঙ্গ!

নীলু ভীতকষ্ঠে বলিল, দিদি, পালিয়ে আয় দেখতে পাবে!

মোসীন সাহেব বলিলেন, ভয় নেই, ও তোমাদের দেখতে পাবে না। এখন কী হচ্ছে বলো।

বুলা বলিল, চলে যাচ্ছে। তোরঙ্গ কাঁধে তুলে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছে।

মোসীন সাহেব বলিলেন, তোমরাও ওর সঙ্গে যাও, দেখ কোথায় যাচ্ছে।

বুলা ও নীলু আংটি চোখের সম্মুখে ধরিয়া বাড়ির পিছন দিকে চলিল। মোসীন সাহেব তাহাদের অনুসরণ করিলেন, আমরা চলিলাম তাঁহার আশেপাশে। বিচিত্র শোভাযাত্রা। সকলের চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। আমি চুপি চুপি শম্ভুকে প্রশ্ন করিলাম, কিরে, ব্যাপার কি? সে অবোধের মতো হাত উল্টাইল।

গরাদ-ভাঙা জানালার পাশ দিয়া বুলা ও নীলু বাড়ির পিছনের আমগাছতলায় উপস্থিত হইল। বুলা বলিল, গজাল দিয়ে তোরঙ্গের তালা ভাঙছে…ডালা খুলে গেল…পুঁটলি বাঁধছে…পুঁটলি বগলে করে চলে যাচ্ছে।

তোমরাও যাও।

বুলা ও নীলু আবার চলিল। কাছেই বাগানের একটা আগড় ছিল; আগড়ের ওপারে খোলা ময়দান, ঝোপঝাড়। বুলা ও নীলু আগড় পার হইয়া ময়দানের ভিতর দিয়া চলিল। কিছুদূর যাইবার পর একটা ঝোপের কাছে আসিয়া বলিল, এইখানে চোরের পুঁটলি থেকে কি একটা পড়ে গেল— চকচকে জিনিস–

আমরা আসিয়া দেখিলাম ঝোপের নীচে ঘন ঘাসের মধ্যে একটা সোনালী দ্রব্য পড়িয়া রহিয়াছে। শম্ভু সেটা তুলিয়া লইল, বলিল, নতুন বৌয়ের কানের দুল।

আমাদের উত্তেজনা চতুর্গুণ বাড়িয়া গেল, চোর যে পথে গিয়াছিল সেই পথেই আমরা চলিয়াছি। মোসীন সাহেবের আংটি বুজরুকি নয়। এ কী লোমহর্ষণ কাণ্ড!

বুলা ও নীলু কিন্তু দাঁড়ায় নাই, গতি একটু শ্লথ করিয়া আবার চলিয়াছিল। আমরাও দ্বিগুণ উৎসাহে চলিলাম। অদৃশ্য চোর যেন পদচিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে।…আশ্চর্য! জীবনে কিছুই কি নষ্ট হয় না, লুপ্ত হয় না? কোন অদৃশ্য লোকে সঞ্চিত হইয়া থাকে? আমরা যত গোপনেই দুষ্কার্য করি ধরিত্রীর বুকে সেই দুষ্কৃতির পদাঙ্ক অঙ্কিত হইয়া যায়, চর্মচক্ষে দেখা না গেলেও সে দাগ আর মোছে না।

ময়দানের ওপারে ডাইনে বাঁয়ে একটা রাস্তা। বুলা ও নীলু রাস্তায় পড়িয়া বাঁ দিকে চলিতে আরম্ভ করিল। এখানে রাস্তা নির্জন, পাশে ঘরবাড়ি নাই। বাঁ দিকে ফিরিবার পর আমাদের একজন সহযাত্রী খাটো গলায় বলিল, বাজারের দিকে যাচ্ছে। শহুরে চোর।

ক্রমে রাস্তার ধারে ঘর বাড়ি দেখা দিতে লাগিল। দুই চারিজন লোক আমাদের শোভাযাত্রায় আকৃষ্ট হইয়া দলে ভিড়িয়া পড়িল। যতই শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতেছি ভিড় তত বাড়িতেছে। শেষে আমাদের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দল এক বৃহৎ মিছিলে পরিণত হইল।

শহরের এক রাস্তা হইতে অন্য রাস্তা ঘুরিয়া মিছিল চলিয়াছে। আগে আগে বুলা ও নীলু আংটির উপর চক্ষু রাখিয়া যেন স্বপ্নলোকে সঞ্চরণ করিতেছে, তাহাদের পিছনে মোসীন সাহেব ও আমরা, এবং আমাদের পিছনে কলকোলাহলরত উত্তেজিত জনতা। সকলেই ব্যাপার বুঝিয়াছে। তাই এত উত্তেজনা। বেলা আন্দাজ দশটা; শীতের রৌদ্র খর হইয়াছে। কিন্তু সেদিকে কাহারও লক্ষ্য নাই।

শহরের বড় রাস্তা হইতে একটি অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা বাহির হইয়াছে, বুলা ও নীলু তাহাতে প্রবেশ করিল। তাহারা এখন আর কথা বলিতেছে না, নিঃশব্দে চলিয়াছে। অনুমান করা যায়, যে বায়বীয় মূর্তিকে তাহারা অনুসরণ করিতেছে তাহার কার্যকলাপে লক্ষণীয় বিশিষ্টতা কিছুই নাই।

এ রাস্তাটায় নিম্ন-মধ্য শ্রেণীর বসতি। অধিকাংশই খোলার চাল, দুই চারিটি পচনশীল পাকা বাড়ি আছে। শম্ভু এই সময় আমার একটা বাহু মুঠি করিয়া ধরিল। চাহিয়া দেখিলাম তাহার মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়িয়াছে; যেন রাস্তার উপর তাহার পরিচিত কেহ থাকে, আংটির অমোঘ নির্দেশে সেইদিকে আমরা চলিয়াছি। আমি মুখ না তুলিয়া শম্ভুকে প্রশ্ন করিলাম, সে শঙ্কিতভাবে হাত উল্টাইয়া উত্তর দিল।

একটা ছোট পাকা বাড়ি, জীর্ণ এবং গলিত ত্বক; সদর দরজা বন্ধ। এই বাড়ির সম্মুখে আসিয়া বুলা ও নীলু থামিয়া গেল। বুলা সংহতস্বরে বলিল, লোকটা দোরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে…দোরে ধাক্কা দিচ্ছে…দোর খুলে গেল…লোকটা পুঁটলি নিয়ে ভেতরে চলে গেল…দোর আবার বন্ধ হয়ে গেল…

আমি জানি না এ কাহার বাড়ি। শম্ভুর পানে চাহিয়া ছিলাম; তাহার মুখ শীর্ণ হইয়া গিয়াছে।

ভিড়ের মধ্য হইতে এক একজন চেঁচাইয়া উঠিল, ধাক্কা মারো ভেঙে ফেল দরজা।

কিছুক্ষণ সকলে নিশ্চল রহিল। তারপর আমি দৃঢ়পদে সম্মুখে গিয়া দরজায় টোকা দিলাম।

দরজা খুলিয়া গেল। যে দরজা খুলিল তাহাকে আমি চিনি, কাল রাত্রেই দেখিয়াছি। সে ঘুম-ভরা চোখে হতচকিত দৃষ্টি লইয়া জনতার পানে চাহিল।

নীলু ভয়ার্ত চিৎকার করিয়া উঠিল, বাবা—

বুলাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলিল, ওই—ওই চোর!

নটবর মল্লিক সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিল। কাল রাত্রে বুলা ও নীলু তাহাকে দেখে নাই। তাই আজ আংটিতে তাহার মুখ দেখিয়া চিনিতে পারে নাই। এখন আসল মানুষটাকে দেখিবামাত্র চিনিয়াছে।

পুলিস আসিয়া পরম পরোপকারী নটবর মল্লিককে ধরিল, তাহার বাড়ি হইতে চোরাই বস্ত্রালঙ্কার সমস্তই পাওয়া গেল।

আমি সেইদিনই সপরিবারে ফিরিয়া আসিলাম। পরে শুনিয়াছিলাম, আদালতে বিচারকালে হাকিম পুলিস-তৎপরতার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন। তখন ইংরেজের আমল। সাহেব হাকিম নখদর্পণ জাতীয় বর্বরোচিত কুসংস্কার বিশ্বাস করেন নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress