Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেনে আধঘণ্টা || Sharadindu Bandyopadhyay

ট্রেনে আধঘণ্টা || Sharadindu Bandyopadhyay

ট্রেন স্টেশন ছাড়িয়া চলিতে আরম্ভ করিয়াছে, এমন সময়ে মণীশ ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া একটা ছোট ইন্টার ক্লাস কামরায় উঠিয়া পড়িল।

রাত্রি এগারটা পঁচিশের প্যাসেঞ্জার ধরিয়া আজ বাড়ি ফিরিবার কোনও আশাই তাহার ছিল না; করুণাকেও বলিয়া আসিয়াছিল যে সকালের গাড়িতে অন্যান্য বরযাত্রীদের সঙ্গে সে ফিরিবে। কিন্তু হঠাৎ সুযোগ ঘটিয়া গেল।

আজ বৈকালের গাড়িতে এক বন্ধুর বিবাহে তাহারা বরযাত্রী আসিয়াছিল। পাশাপাশি দুটি স্টেশন—মাঝে মাত্র পনের মাইলের ব্যবধান, ট্রেনে আধঘণ্টার বেশী সময় লাগে না। কিন্তু অসুবিধা এই যে এগারটা পঁচিশের পর রাত্রে আর গাড়ি নাই। তাই স্থির হইয়াছিল যে, রাত্রে ফেরা যদি সম্ভব না হইয়া উঠে, পরদিন প্রাতে ফিরিলেই চলিবে। সকলেই প্রায় রেলের কর্মচারী-রেল তাহাদের ঘরবাড়ি।

এগারটা বাজিয়া পাঁচ মিনিটের সময় আহার শেষ করিয়া অন্যান্য বরযাত্রীরা যখন গাড়ি ধরিবার আশা ত্যাগ করিয়া পান-সিগারেটের জন্য হাঁকাহাঁকি করিতেছিল, সেই ফাঁকে মণীশ কাহাকেও কিছু না বলিয়া চুপিচুপি সরিয়া পড়িয়াছিল। বিবাহ বাড়ি হইতে স্টেশন পাকা দুই মাইল—এই কয় মিনিটে এতটা পথ হাঁটিয়া আসিয়া সে এই মাঘ মাসের শীতেও ঘামিয়া উঠিয়াছিল। চুরি করিয়া বন্ধুর বিবাহের আসর হইতে পলাইয়া আসার জন্য পরে তাহাকে লজ্জায় পড়িতে হইবে তাহাও বুঝিতেছিল কিন্তু তবু রাত্রেই বাড়ি ফিরিবার দুরন্ত লোভ সম্বরণ করিতে পারে নাই। বাসায় আর কেহ নাই–করুণা সারারাত একলা থাকিবে—দিনকাল খারাপ, এমনি কয়েকটা কৈফিয়ত সে মনে মনে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছিল।

করুণার জন্য বস্তুত ভয়ের কোনও কারণ ছিল না। স্টেশনের কাছেই মণীশের কোয়ার্টার, আশেপাশে অন্যান্য রেল কর্মচারীদের বাসা, আজিকার বরযাত্রীদের মধ্যে তাহার মতো অনেকেই তরুণী স্ত্রীকে একলা রাখিয়া আসিয়াছিল। প্রয়োজন হইলে নাইট ডিউটির সময় সকলকেই তাহা করিতে হয়, কখনো কাহারও বিপদ উপস্থিত হয় নাই। তবু যে মণীশ রাত্রেই বাড়ি ফিরিবার জন্য এত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল তাহার একমাত্র কারণ—; কিন্তু ওটা একটা কারণ বলিয়াই গ্রাহ্য হইতে পারে না। সত্য বটে, মণীশের মাত্র দুই বছর বিবাহ হইয়াছে এবং বৌ ছাড়িয়া থাকিতে পারে না—এমন বদনামও তাহার রটিয়া গিয়াছে; কিন্তু কৈফিয়ত হিসাবে ওকথা উত্থাপন করা অতীব লজ্জাকর।

সে যাহোক, বারটার মধ্যেই সে বাড়ি পৌঁছিয়া যাইবে, আধঘণ্টার পথ। হয়তো করুণা লেপের মধ্যে ঢুকিয়া পরম আরামে ও গরমে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, করুণা মোটে রাত জাগিতে পারে না! মণীশকে হঠাৎ দেখিয়া তাহার ঘুমন্ত চোখে বিস্ময় ও আনন্দ ফুটিয়া উঠিবে। মণীশ পরিপূর্ণ তৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বেঞ্চির উপর বসিয়া পড়িল। ট্রেন তখন সবেগে চলিতে আরম্ভ করিয়াছে।

কামরার মধ্যে দুইটি লোক। একজন একটা বেঞ্চি জুড়িয়া লম্বাভাবে লেপ মুড়ি দিয়া শুইয়া কেবল মুখটি বাহির করিয়াছিলেন; গোলাকৃতি থলথলে মুখমণ্ডলে হপ্তাখানেকের দাড়ি গজাইয়া কৃষ্ণতার একটা গাঢ়তর প্রলেপ লাগাইয়া দিয়াছিল; তিনি শুইয়া শুইয়া অনিমেষ চক্ষে মণীশকে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। অপর ব্যক্তিকে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক বলিয়া বোধ হয়—সেও একটা বিলাতী কম্বল গায়ে দিয়া অন্য ধারের বেঞ্চির কোণে ঠেসান দিয়া বসিয়া ছিল এবং পরম কৌতূহলের সহিত মণীশকে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। তাহার চেহারা রোগা হাড় বাহির করা, গাল বসিয়া গিয়া। চোয়ালের অস্থি অস্বাভাবিক রকম উঁচু হইয়া উঠিয়াছে, দুই চোখের কোলে গভীর কালির আঁচড়। এই দুই যাত্রীর মধ্যে একটা বেশ রসালো গল্প জমিয়া উঠিয়াছিল, মণীশের আগমনে তাহা অর্ধপথে থামিয়া গিয়াছে।

মণীশ বসিলে রোগা লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, কদ্দূর যাওয়া হবে?

মণীশ বলিল, আমি পরের স্টেশনেই নেমে যাব।

একজাতীয় লোক আছে, রেলে উঠিয়াই অন্য যাত্রীদের পরিচয় গ্রহণ করিবার অদম্য আগ্রহ তাহাদের চাপিয়া ধরে। রোগা লোকটি সেই শ্রেণীর। মণীশের রূপালী বোতাম লাগানো কালো রঙের ওভারকোট দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি রেলেই কাজ করেন?

হ্যাঁ, আমি ও স্টেশনের পার্সেল ক্লার্ক।

লোকটি তখন হাসিয়া বলিল, বেশ বেশ। আসুন এই কম্বলের ওপর বসুন। আমি অনেক রকম লোকের সঙ্গে মিশেছি, কিন্তু রেলের বাবুদের মতো এমন মাই-ডিয়ার লোক খুব কম দেখা যায়। কিছুতেই পেছপাও নন। তা মহাশয়ের জলপথে চলা অভ্যাস আছে কি? যদি থাকে মালের অভাব হবে না।

মণীশ একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, জলপথ?

লোকটি রসিক, একটা শিহরণের অনুকরণ করিয়া বলিল, মাঘ মাসের শীত, তার ওপর ট্রেন-জার্নি। শরীর গরম থাকে কি করে, বলুন দেখি!

মণীশ হাসিয়া ফেলিল, ও, বুঝেছি। না, আমার ও-জিনিস চলে না। কিন্তু আপনি যদি চালাতে চান, কোনো বাধা নেই।

লোকটি বেঞ্চির তলা হইতে একটি হ্যান্ডব্যাগ তুলিয়া লইয়া তাহার ভিতর হইতে একটি বোতল ও গেলাস বাহির করিল, বোতলের তরল পদার্থ গেলাসে ঢালিতে ঢালিতে বলিল, একলা এ জিনিস খেয়ে সুখ হয় না। ও-ভদ্রলোককে অফার করলুম, তা উনিও এ রসে বঞ্চিত। বলুন দেখি, এর মতো ফুর্তির জিনিস পৃথিবীতে আছে কি?

মণীশ মৃদুহাস্যে বলিল, তা তো বটেই।

গেলাসের পানীয় গলায় ঢালিয়া দিয়া উৎসাহিতভাবে লোকটি বলিল, সেই কথাই এতক্ষণ ও-ভদ্রলোককে বলছিলুম, দুনিয়ায় আসা কিসের জন্যে! যতদিন বেঁচে আছি, প্রাণ ভরে মজা লুটব কি বলেন।

মণীশ যতই গৃহের নিকটবর্তী হইতেছিল ততই উৎফুল্ল হইয়া উঠিতেছিল, বলিল, ঠিক কথা।

বোতল গেলাস ব্যাগে পুরিয়া নামাইয়া রাখিয়া লোকটি পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিল, একটি নিজে ঠোঁটে ধরিয়া মণীশকে একটি দিল। সিগারেট ধরাইয়া ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, আমার নাম চারুচন্দ্র গুপ্ত, ইন্সিওরেন্সের দালালী করি, ছত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। অনেক বাজার ঘেঁটে বেড়িয়েছি মশায়; কিন্তু এ দুনিয়ায় সার বস্তু যদি কিছু থাকে তো সে ওই বোতল; বুঝেছেন তো?

মণীশ সিগারেট টানিতে টানিতে বলিল, হুঁ।

চারুচন্দ্র গুপ্ত বলিল, এতে লজ্জাই বা কি? পুরুষ হয়ে জন্মেছি কি জন্যে? মজা লুটব বলে। কিন্তু মশায়, একটি বিষয়ে আপনাদের সাবধান করে দি, যদি ফুর্তি করতে চান, বিয়ে করবেন না। খবরদার, খবরদার। ও পথে হেঁটেছেন কি সব ভেস্তে গেছে।

মণীশ কোনও কথা বলিল না, চারু আবার আরম্ভ করিল, এই আমাকেই দেখুন না—পনের বছর বয়স থেকে ফুর্তি করতে আরম্ভ করেছি, কখনো ঠকেছি কি? নিজে রোজগার করি, নিজের ফুর্তিতে ওড়াই, কারুর তোয়াক্কা রাখি না। ক্যা মজায় আছি বলুন তো? কিন্তু বিয়ে করলে এটা হত কি? অ্যাদ্দিনে সতেরটা ছানা গজিয়ে যেত। প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যান, ডাক্তার আর ঘর, একবার ভেবে দেখুন দিকি!

মণীশ এবারও চুপ করিয়া রহিল। লেপের মধ্যে শয়ান লোকটির মুখ দেখিয়া মন হইতে লাগিল, অবিবাহিত জীবনের অপ্রাপ্য সুখৈশ্বর্যের কথা স্মরণ করিয়া এখনি তাঁহার মুখ দিয়া নাল গড়াইয়া পড়িবে। তিনি কোনোমতে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, যে গল্পটা হচ্ছিল সেটাই হোক না।

চারু মণীশকে বলিল, ওঁকে আমার জীবনের ইতিহাস শোনাচ্ছিলুম, ইতিহাস তো নয়, মহাভারত। পনের বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত কত কাণ্ডই যে করলুম! শুনলে বুঝবেন। গলা খাটো করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কখনো ইলোপ করেছেন?

মণীশ সভয়ে বলিয়া উঠিল, না।

লেপ-ঢাকা ভদ্রলোকটি স্মরণ করাইয়া দিলেন, ওটা হয়ে গেছে। শালকের গল্পটা বলছিলেন।

চারু বলিল, হ্যাঁ, শালকের গল্পটা। কিন্তু ওতে নূতনত্ব কিছু নেই মশায়। অমন দশটা আমার জীবনে হয়ে গেছে।

মণীশ ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, শালকের গল্প?

চারু বলিল, হ্যাঁ, তখন আমি শালকেয় থাকি। বছর তিনেক আগেকার কথা। —ঠিক পাশের বাড়িতেই, বুঝলেন কিনা, একটি ষোল বছরের তরুণী। খাসা দেখতে মশায়, রঙ ফেটে পড়ছে, ঠিক বাঁ চোখের নীচে একটি তিল; আর গড়ন—সে কথা না-ই বললুম, মনে মনে বুঝে নিন। এক কথায় যাকে বলে রমণী! বলুন দেখি, লোভ সামলানো যায়?

তার তখনো বিয়ে হয়নি, তবে হব-হব করছিল। আমি দেখলুম, বিয়ে হলেই তো পাখি উড়বে; অতএব তার আগেই—বুঝলেন কি না? মতলব ঠিক করে জানলা দিয়ে চিঠি ফেলতে আরম্ভ করলুম। চিঠি যথাস্থানে গিয়ে পৌঁচুচ্ছে কিন্তু জবাব নেই। সে আগে জানলায় এসে দাঁড়াত, আজকাল আর তাও দাঁড়ায় না; আমাকে দেখে মুখ রাঙা করে সরে যায়। কিন্তু আমিও পুরোনো ঘাগী, অত সহজে ছাড়বার পাত্র নই। লেগে রইলুম। বুঝলুম কিছুদিন খেলবে। তারপর, দিন পনের পরে হঠাৎ একদিন জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে খুব গরম হয়ে বললে, আপনি আমাকে যদি আর চিঠি দেন, বাবাকে বলে দেব।

চারু কিছুক্ষণ মনে মনে হাসিয়া বলিল, বাবাকে বলে দেব কথাটা সব মেয়েরই বাঁধি গৎ, বুঝেছেন। ন্যাকামি। আসলে পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ। আমি আরো প্রেমসে চিঠি চালাতে লাগলুম। কিন্তু এক হপ্তা কেটে গেল, তবু সে কোনও সাড়াশব্দ দিলে না; অবিশ্যি বাপকেও বললে না, সেকথা বলাই বাহুল্য।

বাড়ির ঝিটাকে আগে থাকতেই টাকা খাইয়ে হাত করেছিলুম, ঠিক করলুম, এবার আর চিঠি নয়, অন্য চাল চালতে হবে। খবর পেলুম, রোজ সন্ধ্যের পর ছুঁড়ি খিড়কির বাগানে যায়। একদিন শর্মাও পাঁচিল ডিঙিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির। আচমকা আমাকে দেখে তো আঁতকে উঠল, পালাবার চেষ্টা করল। আমি পথ আগলে দাঁড়ালুম, থিয়েটারি কায়দায় বললুম, বুকে ফেটে যাচ্ছে তোমার জন্যে। সে চেঁচামেচি করে লোক ডাকবার চেষ্টা করলে। আমি তখন নিজ মূর্তি ধারণ করলুম, বললুম, চেঁচালে কোনও ফল হবে না। আমি বড় জোর দুঘা মার খাব, কিন্তু তোমার ইহকাল পরকালের দফা রফা, সেটা ভেবে চেঁচিয়ে লোক জড় কর।

মেয়েটা চেঁচালে না বটে, কিন্তু তবু বাগ মানতে চায় না। তখন আমি ব্রহ্মাস্ত্র ঝাড়লুম, বললুম, আমার দুজন মুসলমান বন্ধু পাঁচিলের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। চেঁচামেচি গোলমাল করেছ কি তারা এসে মুখে কাপড় বেঁধে– বুঝলে? কিন্তু যদি ভাল কথায় রাজী হও তাহলে আর কেউ জানবে না, শুধু তুমি আর আমি। চারু আবার ব্যাগটা বাহির করিল, বোতল হইতে গেলাসে মদ ঢালিতে প্রবৃত্ত হইল!

লেপ-ঢাকা ভদ্রলোকটির চোখ হইতে লুব্ধতা ঝরিয়া পড়িতেছিল, তিনি প্রশ্ন করিলেন, তারপর?

গেলাস গলায় উপুড় করিয়া ঢালিয়া দিয়া চারু একটু মুখ বিকৃত করিল, তারপর হাসি হাসি মুখে বলিল, তারপর আর কি—হে হে রাজী হয়ে গেল।

মণীশের হাতের সিগারেট অর্ধদগ্ধ অবস্থায় নিবিয়া গিয়াছিল, সমস্ত শরীর শক্ত করিয়া সে এই কাহিনী শুনিতেছিল। এখন হঠাৎ সিগারেটের দিকে দৃষ্টি পড়িতেই সে সেটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।

চারু বলিল, কিন্তু হলে কি হবে মশায়, মেয়েটা পোষ মানলে না। তারপর থেকে খিড়কির বাগানে আসাই ছেড়ে দিলে। ওদিকে বিয়ের সম্বন্ধও ঠিক হয়ে গিয়েছিল, আমারও শালকের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। ব্যাগটা আবার বেঞ্চের নীচে রাখিয়া দিল, দিন কয়েক পরে আমিও শালকে ছেড়ে দিলুম, তার বিয়েটা আর দেখা হল না। বলিয়া দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে লাগিল।

ট্রেনের বেগ ডিস্টান্ট-সিগনালের কাছে আসিয়া মন্দীভূত হইল। চারু আর একটা সিগারেট ধরাইয়া বাক্সটা মণীশের দিকে বাড়াইয়া দিল, বলিল, খান আর একটা। আপনার তো এসে পড়ল। শুনলেন তো গল্পটা? এর পর আর কোনও ভদ্রলোকের বিয়ে করতে সাধ হয়? ভাবুন দেখি, আমার কপালেই যদি ওই রকম একটি; নিন না—

মণীশ হাত নাড়িয়া সিগারেট প্রত্যাখ্যান করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মণীশের মুখখানা স্বভাবত খুব ধারালো না হইলেও বেশ সুশ্রী, কিন্তু গত কয়েক মিনিটের মধ্যে তাহা শুকাইয়া কুঁড়াইয়া যেন কদাকার হইয়া গিয়াছিল। গাড়ি প্ল্যাটফর্মে থামিতেই সে কম্পিত হস্তে হাতল ঘুরাইয়া নামিবার উপক্ৰম করিল।

চারু বলিল, আচ্ছা, তাহলে নমস্কার মশায়।

মণীশ নামিতে গিয়া হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইল। তাহার অন্তরে একটা ভীষণ যুদ্ধ চলিতেছিল, সে মনে মনে বলিতেছিল, না, জিজ্ঞাসা করব না, জিজ্ঞাসা করব না; কিন্তু শেষে আর পারিল না,

স্খলিতকণ্ঠে বলিল, মেয়েটির নাম কি?

চারু বলিল, নাম? নামটা-রসুন– করুণাময়ী! কিন্তু নামের সঙ্গে চরিত্রের একটুও মিল নেই মশায়, হ্যাঁ হ্যাঁ, আচ্ছা, নমস্কার নমস্কার!

.

মণিমণ্ডিত-দেহ বিষোদগারী সর্পের মতো অন্ধকার আকাশে গাঢ় ধূম নিক্ষেপ করিতে করিতে ট্রেন চলিয়া গেল।

মণীশও একটা হোঁচট খাইয়া প্ল্যাটফর্মের বাহির আসিল। টিকেট-কলেক্টর তাহার বন্ধু, ডিউটির জন্য সে বরযাত্রী যাইতে পায় নাই, নিদ্রাজড়িত স্বরে তাহাকে কি জিজ্ঞাসা করিল, মণীশ শুনিতে পাইল না।

স্টেশন হইতে একশত গজের মধ্যেই মণীশের ছোট্ট লাল ইটের বাসা; অন্ধকার পথ দিয়া এক রকম অভ্যাসবশেই সে সেই দিকে চলিল। মাথার মধ্যে তাহার রক্ত ঘুরপাক খাইতেছিল! করুণা! করুণা এই! আজ দুবছর ধরিয়া সে অন্যের উচ্ছিষ্ট নারীকে নিজের একান্ত আপনার স্ত্রী বলিয়া ভাবিয়া আসিতেছে! একদিনের জন্যেও সন্দেহ করে নাই যে করুণা তাহাকে ঠকাইতেছে। উঃ, এই করুণা!

একটা শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিয়া সে বাহ্য চেতনা ফিরিয়া পাইল। দেখিল তাহার শরীরের সমস্ত পেশীগুলা শক্ত হইয়া আছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের নখ হাতের তেলোয় বিঁধিয়া জ্বালা করিতেছে। সে জোর করিয়া পেশীগুলা শিথিল করিয়া দিল; তারপর দ্রুতপদে বাড়ির দিকে চলিল। করুণা একটা—

কি করা যায়। এরূপ অবস্থায় মানুষ কি করে। খুন!—হাঁ, খবরের কাগজে তো এমন অনেক দেখা যায়। যাহার স্ত্রী কুমারী অবস্থায় লম্পট দ্বারা উপভুক্ত হইয়াছে, সে আর কি করিতে পারে? করুণাকে খুন করিয়া নিজে ফাঁসি যাওয়া ছাড়া অন্য পথ কোথায়?

কিন্তু—মণীশ থমকিয়া রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িল। সেই লম্পটটাকে সে ছাড়িয়া দিল কেন? তাহাকে আগে খুন করিয়া তারপর করুণাকে—

বাড়ির সম্মুখস্থ হইয়া সে দেখিল, তাহার শয়নঘরের জানালা দিয়া আলো আসিতেছে। আলো কিসের? করুণা তো ঘুমাইয়াছে! তবে কি–?

পা টিপিয়া টিপিয়া চোরের মতো গিয়া মণীশ জানালার কাচের ভিতর দিয়া উঁকি মারিল। দেখিল, করুণা মেঝেয় কম্বল পাতিয়া একটা র‍্যাপার গায়ে জড়াইয়া বসিয়া বই পড়িতেছে।

মণীশ কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর গিয়া দরজার ধাক্কা মারিল, চাপা বিকৃতস্বরে বলিল, দোর খোল।

করুণা দোর খুলিয়া দিতেই মণীশ ঘরে ঢুকিয়া দরজায় খিল আঁটিয়া দিল, তারপর করুণার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল!

করুণা মৃদু হাসিয়া বলিল, আমি জানতুম তুমি এ গাড়িতে ফিরে আসবে, তাই শুইনি।

মণীশের মাথার ভিতরটা যেন ওলট-পালট হইয়া গেল। এই কথাগুলির পরিপূর্ণ অর্থ পরিগ্রহ করিবার শক্তি তাহার ছিল না; তবু সে অস্পষ্টভাবে অনুভব করিল যে, ইহার বেশী আর কেহ কোনও দিন পায় নাই, প্রত্যাশা করিবার অধিকারও কাহারও নাই। নিশীথরাত্রে তাহার জন্য করুণার এই নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষা, ইহার তুল্য পৃথিবীতে আর কি আছে?

করুণা!

সহসা সে দুই হাত বাড়াইয়া করুণাকে বুকে চাপিয়া ধরিল। এত জোরে চাপিয়া ধরিল যে, করুণার শ্বাস রোধের উপক্রম হইল। সে হাঁপাইয়া উঠিয়া বলিল, কি?

মণীশ তাহার গলার মধ্যে মুখ গুঁজিয়া অবরুদ্ধ স্বরে বলিল, কিছু না। ট্রেনে আসতে আসতে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। উঃ! এমন বিশ্রী দুঃস্বপ্ন দেখলুম! চল শুইগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress