আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার ; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপ দাঁড়ায়েছে চাঁদ – কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত- রাত্রিটিরে ভালো ,
খড়ের চালের’পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার ;
পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ ;- অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো !
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ ,- মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে – ডালে ডাকিয়াছে বক ;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক;
আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের’পরে হাত,
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ , মাছরাঙা , নক্ষত্র , আকাশ
আমরা পেয়েছি যারা ঘুরে-ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারো-মাস;
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু’বেলা
নির্জন মাছের চোখে;- পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ – মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;
মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে বার-বার তরীটিরে মাখে ,
খড়ের চালের ছায়া গাড় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে ;
বাতাসে ঝিঁঝিঁর গন্ধ- বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাড় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে ;
আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল
প’ড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে ;
যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর’পরে ;
আমরা দেখেছি যারা শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ ,
প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;
আমরা বুঝেছি যারা বহু দিন মাস ঋতু শেষ হলে পর
পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
ক’য়ে গেছে ;- আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো এক আলো আছে :দেহে তার বিকেলবেলার ধূসরতা ;
চোখের –দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির :
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর ;
আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর ? জানি না কি আহা,
সব রঙ কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ ;- একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল – সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়;- যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে ।
কি বুঝিতে চাই আর ? … রৌদ্র নিভে গেলে পাখি – পাখালির ডাক
শুনিনি কি ? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক !