Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দাসবংশ ধ্বংস (২০১১) || Samaresh Majumdar

দাসবংশ ধ্বংস (২০১১) || Samaresh Majumdar

ভর বিকেলেই অন্ধকার নেমেছিল। মোষের মতো রাগী মেঘগুলো ছুটে আসছিল আকাশের সব কোণ থেকে, ধাক্কা খাচ্ছিল এ-ওর সঙ্গে। তখনই ছিটকে উঠছিল আলো, গড়িয়ে আসছিল শব্দ। হাওয়ারা যেখান থেকে জন্মায় তার মুখটাকে কেউ বন্ধ করে রেখেছিল বলেই হয়তো গাছগুলো সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যে কোনও মুহূর্তে মেঘগুলো গলে গিয়ে চরাচর ভাসিয়ে দেবে।

আধাপাহাড়ি ছোট্ট স্টেশনে নেমে অর্জুন দেখল, কোথাও মানুষ নেই। একজন স্টেশনমাস্টার, যিনি টিকিট বিক্রেতা আবার পতাকাও নাড়েন, ট্রেন চলে গেলে দৌড়ে ঢুকে পড়েন তার ঘরে। যে ট্রেনে অর্জুন এসেছিল তার কামরায় গোটাপাঁচেক মানুষ ছিল, যার চারজন চলে গিয়েছে ট্রেনের সঙ্গে। জংশন স্টেশনে মেল ট্রেন থেকে নেমে দুপুরবেলায় ওই লোকাল ট্রেনে উঠেছিল সে। চিঠিতে সেরকমই নির্দেশ ছিল। এই পথে সারাদিনে দুটো ট্রেন যায়, ফিরে আসে। অর্জুন মোবাইলে বহুবার চেষ্টা করেছে পত্ৰলেখককে ধরতে, সব সময় শুনতে হয়েছে ‘আউট অফ রেঞ্জ’। শেষ পর্যন্ত ভেবেছে, স্টেশনে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে নিজেই পৌঁছে যাবে ভদ্রলোকের ঠিকানায়। চিঠিতে ভদ্রলোক লিখেছিলেন, যতটা সত্বর সম্ভব চলে আসুন।

এখন এই প্রায়-অন্ধকারে মেঘের গর্জন শুনতে শুনতে শূন্য স্টেশনচত্বর দেখে অর্জুন এগিয়ে গেল স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে। ভেজানো দরজায় শব্দ করতে প্রায় চিৎকার ভেসে এল, কে? কে?

দরজাটা ঠেলে ঘরে পা দিতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল সে। মধ্যবয়সি টাক মাথার স্টেশনমাস্টার হাতে একটা লম্বা শক্ত রুল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন আক্রান্ত হলেই তিনি পালটা আক্রমণ করতে পারেন।

আমি এই ট্রেনে এলাম। আসছি জলপাইগুড়ি থেকে। আমার নাম অর্জুন।

ভদ্রলোক দু-তিন সেকেন্ড জরিপ করে রুল নামালেন, কী উদ্দেশ্যে এখানে আগমন?

এক ভদ্রলোক অনুরোধ করেছেন আসার জন্যে। কিন্তু তিনি জানেন না যে, আজ আমি আসছি। স্টেশনের বাইরে কোনও ট্যাক্সি তো দূরের কথা রিকশাও নেই। তাই…!

ওগুলোর দু-চারটেকে দিনেরবেলায় মাঝে মাঝে দেখা যায়। ভদ্রলোকের নাম কী?

তুলসীদাস চৌধুরী! ঠিকানা…!

হাত তুলে অর্জুনকে থামিয়ে দিয়ে স্টেশনমাস্টার বললেন, বিলক্ষণ চিনি। আপনি বাঙালি, আমিও তাই। সে কারণেই একটা উপদেশ দিচ্ছি। ফিরে যান।

ফিরে যাব? হকচকিয়ে গেল অর্জুন।

একটা মালগাড়ি আসছে একটু পরেই। আমি ওটাকে থামিয়ে গার্ডের কামরায় আপনাকে তুলে দিচ্ছি। ওখানে নিরাপদে থাকবেন। জংশনে পৌঁছোতে ভোর হয়ে যাবে।

কিন্তু চলে গেলে, যে কাজের জন্যে এসেছি সেটা তো হবে না!

কাজটা কী জানাতে আপত্তি আছে?

বিন্দুমাত্র নয়। তুলসীদাসবাবু আমার সাহায্য চেয়েছেন। সেটাই আমার কাজ।

কীরকম সাহায্য?

ওটা ওঁর অনুমতি ছাড়া বলা উচিত হবে?

হুম! আপনি কি আগে এই অঞ্চলে এসেছেন?

না। আজই প্রথম এলাম। অর্জুন দরজার বাইরে তাকাল, যে-কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে। কীভাবে যেতে পারি যদি বলে দেন!

গিয়ে লাভ হবে না ভাই! তুলসীদাস চৌধুরী খুব অসুস্থ। আপনাকে আমি বলতে পারতাম এই ঘরে রাতটা চেয়ারে বসে কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটলে বাইরে যেতে। কিন্তু আমি তা পারছি না। দুঃখিত।

স্টেশনমাস্টারের কথা শেষ হওয়ামাত্র বাইরে সাইকেলের বেল শোনা গেল। তারপরেই দরজার বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, মাস্টারসাব, মালগাড়ি চলে গিয়েছে? লোকটা কথা বলছে দেহাতি হিন্দিতে।

কৌন? স্টেশনমাস্টার চিৎকার করলেন।

হরিরাম।

মেঘ না চাইতেই জল একেই বলে। স্টেশনমাস্টার বললেন, ভিতরে এসো।

প্যান্ট-শার্ট পরলেও যুবকের চেহারায় দেহাতি ভাব একটা। ঘরে ঢুকে একটু আগে করা প্রশ্নটি আবার করল।

স্টেশনমাস্টার মাথা নাড়লেন, না যায়নি। কিন্তু ওটা এখানে থামে না।

আপনি পারেন। দয়া করে ওটা একটুখানির জন্যে থামান। আমাকে শহরে যেতেই হবে। যুবক বেশ কাতর গলায় বলল।

পৌঁছোতে সকাল হয়ে যাবে।

হোক। আমি এখন গেলে দুপুরের ট্রেনে ফিরে আসতে পারব।

কী ব্যাপার?

ডাক্তারজি চারটে ইঞ্জেকশন আনতে বলেছেন। কাল বিকেলের মধ্যে প্রথমটা দেওয়া দরকার। খুব জরুরি। জীবন-মরণের ব্যাপার।

তুলসীদাসজি কেমন আছেন?

ভাল না। একদম ভাল না। ওষুধটা আনা খুব জরুরি, না হলে আমি এরকম অন্ধকারে বেরোতে সাহসই পেতাম না। যুবক বলল।

তুলসীদাসজি কথা বলতে পারছেন?

বলছেন। কিন্তু খুব দুর্বল।

তুমি এখানে কীভাবে এসেছ?

সাইকেলে। ওটা এখানেই থাক। তালাচাবি দিয়ে রেখেছি।

এবার স্টেশনমাস্টার অর্জুনের দিকে তাকালেন, আপনি সাইকেল চালাতে জানেন?

অর্জুন হেসে ফেলল, মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল। স্টেশনমাস্টার হরিরামের দিকে তাকালেন, এই ভদ্রলোক পশ্চিমবাংলা থেকে এসেছেন। তুলসীদাসজি ওঁকে কোনও দরকারে আসতে বলেছেন। অত দূরে তো উনি হেঁটে যেতে পারবেন না। তোমার সাইকেলের চাবিটা দাও। আর ওঁকে বুঝিয়ে দাও কীভাবে যেতে হবে।

হরিরাম খুব অবাক হয়ে তাকাল, আপনার নাম কী?

অর্জন।

অর্জুন! আপনি কি জলপাইগুড়িতে থাকেন?

হ্যাঁ।

আপনাকে উনি যে চিঠি লিখেছিলেন সেটা আমিই শহরে গিয়ে পোস্ট করেছিলাম। কিন্তু কী লিখেছিলেন তা জানি না। আপনার আসার কথা জানলে একটা ব্যবস্থা করা হত। কিন্তু মাস্টারসাব, এই অন্ধকারে সাইকেল চালিয়ে কি উনি যেতে পারবেন? হরিরাম জিজ্ঞেস করল।

স্টেশনমাস্টার কিছু বলার আগেই অর্জুন বলল, আমার সঙ্গে টর্চ আছে।

না না, আলোর কথা বলছি না। থেমে গেল হরিরাম।

স্টেশনমাস্টার বললেন, অন্য কিছু না বলে ওঁকে পথটা বুঝিয়ে দাও। যে-কোনও মুহূর্তে মালগাড়ি এসে পড়বে।

হরিরাম পকেট থেকে একটা চাবি বের করে বলল, এখান থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরবেন। সোজা যাবেন। রাস্তাটা দুটো ভাগ হয়ে গেলে ডান দিকেরটা ধরবেন। পথে সাইকেলের স্পিড কমাবেন না, কাউকে দেখলে কথা বলার জন্যে দাঁড়াবেন না। এই কথাটা ভুলে যাবেন না যেন। ওই পথ ধরে আরও দশ মিনিট গেলে একটা দোতলা বাগানওয়ালা বাড়ির গেট দেখতে পাবেন। দোতলায় আলো জ্বলছে। গেটে তালা দেওয়া থাকে। আপনি ‘রামঅবতার’ বলে চিৎকার করলে ভিতর থেকে লোক বেরিয়ে আসবে।

হরিরামের কথা শেষ হওয়ামাত্র দূরে ইঞ্জিনের হুইসল বাজল। স্টেশনমাস্টার লাল কাগজমোড়া লণ্ঠন আর ফ্ল্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন, পিছনে হরিরাম। অর্জুন অলস পায়ে বাইরে বেরিয়ে দেখল, স্টেশনমাস্টার আলো এক হাতে ধরে ফ্ল্যাগ নাড়ছেন। ধীরে ধীরে মালগাড়িটা অনেকটা এগিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল। টর্চ বের করল অর্জুন। সাইকেলটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা আছে। সে তালা খুলে ওটাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

তখনই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল কাছাকাছি। তার আগে আকাশ-পৃথিবী এক লহমার জন্যে ফোটোর নেগেটিভের মতো অস্পষ্ট হল। বাঁ দিকের পথ ধরল অর্জুন। সাইকেলটা বেশ ভাল। প্যাডেলে চাপ দিতেই গতি বাড়ছে। বাঁ হাতে টর্চ জ্বেলে সাইকেল চালাচ্ছিল অর্জুন। ব্যাগ রেখেছিল সাইকেলের ক্যারিয়ারে। টর্চের আলোয় রাস্তার চিলতে অংশ দেখা যাচ্ছিল। দু’পাশে এবং সামনে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। মেঘের গর্জন ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। এমনকী, একটা নেড়িকুকুরও চোখে পড়ছে না।

মিনিট দশেক পর রাস্তাটা যেখানে দুটো ভাগ হয়েছে, সেখানে পৌঁছোতেই বৃষ্টি নামল। একেবারে হাজার হাজার বর্শার মতো নেমে এল জলরাশি। এক সেকেন্ডেই ভিজে চপচপে হয়ে গেল অর্জুন। জলের বেগ এত প্রবল যে, সাইকেল চালানো অসম্ভব হয়ে উঠল। বিদ্যুৎ চমকাতে রাস্তার দুপাশে কয়েকটা বিশাল ঝাকড়া গাছ দেখতে পেল সে। ওই গাছের নীচে দাঁড়ালে বৃষ্টিতে তেমন ভিজতে হবে না। কিন্তু হরিরাম নামের যুবকটি তাকে সতর্ক করেছে পাশের কোথাও না দাঁড়াতে। কেন নিষেধ করেছে তা জানায়নি। এই স্টেশনমাস্টারের আচরণেই একটা আতঙ্কের ছাপ ছিল। হরিরাম বলেছিল, বাধ্য না হলে সে এখন বাড়ি থেকে বের হত না। এরকম জায়গায় তো ভয় একটা কারণেই হতে পারে। গুন্ডা-বদমাশ ছিনতাই করতে পারে। বাধা দিলে খুন হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু এই কাজ নিশ্চয়ই দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া যায় না। পুলিশ নিশ্চয়ই নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে না। যত অজ পাড়াগাঁই হোক, স্টেশন যখন আছে তখন নিশ্চয়ই থানা দুরে থাকবে না। একটা বড় ঝাকড়া গাছের নীচে চলে এসে অর্জুন সাইকেল থেকে নামল। ইতিমধ্যে যথেষ্ট ভিজে গিয়েছে জামা-প্যান্ট, ব্যাগটা ওয়াটার প্রুফ বলে স্বস্তি, ওটার ভিতরে জল ঢুকবে না।

চারপাশে ঘন কালো অন্ধকার, অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। কিন্তু মাথার উপর পাতার আড়াল থাকায় ফোঁটা ফোঁটা এখন শরীরে পড়ছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। রাস্তাঘাট, গাছপালা, এমনকী, বৃষ্টির ধারাকেও সাদাটে দেখাল। আর তারপরেই কানের পরদা কাঁপিয়ে দিয়ে শব্দ হল। খুব কাছাকাছি বাজ পড়ল এবার। এসময় বিশাল গাছটার আড়াল ছেড়ে পথে নামার কোনও মানে হয় না। অর্জুন আরও সরে এল গাছটার গায়ে। এত বড় গাছে বাজ পড়লে তা উপরে ডালপাতার ক্ষতি করবে, নীচে নিশ্চয়ই নামবে না।

প্রায় মিনিট পনেরো চুপচাপ দাঁড়ানোর পর বৃষ্টি একটু ধরল, কিন্তু মেঘের হম্বিতম্বি কমছিল না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। হঠাৎ সেই আলোর ঝলকানিতে অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল অর্জুন। চারজন মানুষ এই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে চলেছে। প্রত্যেকের আপাদমস্তক ঢাকা। এমনকী, মাথাও ঘোমটার আড়ালে। বোধহয় মাথা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত কালো বর্ষাতি পরে আছে ওরা। মাথা নীচের দিকে ঝুঁকে আছে। এক লহমার মধ্যে এটুকু দেখতেই চরাচর অন্ধকারে ঢেকে গেল। এরা কারা? কোত্থেকে আসছে? কোথায় যাবে?

পরেরবার যখন আবার বিদ্যুৎ চমকাল তখন চারধার শুনশান। মানুষগুলো নেই। এটা ঠিক, ওদের হাঁটার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। হরিরাম কি ওদের কথা ভেবেই তাকে সাবধান করে দিয়েছিল?

শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিটা প্রায় ধরল। প্রায়, কারণ দু’-চার ফোঁটা পড়া শেষ হচ্ছিল না। এত বৃষ্টি ঝরিয়েও আকাশ মেঘমুক্ত নয়। অর্জুন সাইকেলে চাপল। প্রায় মিনিট দশেক চলার পর দূরে আলো জ্বলতে দেখতে পেল সে। টিমটিমে আলো। কাছাকাছি এসে সে বুঝতে পারল, আলোটা জ্বলছে দোতলা বাড়ির বারান্দায়। বাড়িটার সামনে গাছগাছালি এবং প্রাচীর আছে, আছে গেটও। নিশ্চয়ই এই বাড়ির কথা হরিরাম তখন বলেছিল। গেটের সামনে নেমে টর্চ জ্বালতে গিয়ে হতাশ হল সে। জ্বলছে না। টর্চের ভিতরে জল ঢুকল কী করে? অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বোঝা গেল, লোহার গেটে তালা ঝুলছে। সে বাড়িটির দিকে তাকাল। একমাত্র উপরের ওই শীর্ণ আলো ছাড়া প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই। এই বাড়িতেই তুলসীদাসজি থাকেন?

হরিরামের উপদেশ মতো অর্জুন চিৎকার শুরু করল, রামঅবতারজি, রামঅবতারজি। চারবার ডাকার পরও ভিতর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে লোহার গেটে আওয়াজ তুলল সে। নিস্তব্ধ রাতে সেই আওয়াজ বহু দূর থেকে নিশ্চয়ই শোনা যাচ্ছিল। প্রায় হতাশ হয়ে অর্জুন আবার চেঁচাল, রামঅবতার। এবার ‘জি’ জুড়ল না অজান্তেই।

বাড়ির গায়ে একতলার একটা দরজা খুলল। একটা লণ্ঠন উঁচিয়ে ধীরে কেউ চিৎকার করে জানতে চাইল, কৌন?

তুমি রামঅবতারজি?

হ্যাঁ। লোকটার হিন্দি দেহাতি।

দয়া করে গেট খোলো। আমি বাংলা থেকে আসছি।

কেন?

যাচ্চলে! অর্জুন মাথা নাড়ল, এর কাছেও ইন্টারভিউ দিতে হবে নাকি? তুলসীদাসজি আমাকে নেমন্তন্ন করেছেন। এটা তাঁর বাড়ি তো?

আপনার ভাল নাম?

অর্জুন।

সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠন ভিতরে ঢুকে গেল, দরজাও বন্ধ হল। অর্জুন অবাক হল। এই গেট বেশ উঁচু, টপকে যেতে একটু অসুবিধে হবে। কিন্তু সারারাত এখানে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তুলসীদাসজি তাকে এখানে আসতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাকে বাড়ির বাইরে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখবেন, এটা কী ধরনের ভদ্রতা?

মিনিট পাঁচেক পর দরজাটা আবার খুলল। লণ্ঠন এগিয়ে এল গেটের দিকে। ওটাকে নীচে নামিয়ে তালা খুলল লোকটা, মাপ করবেন, আপনাকে একটু দাঁড় করিয়ে রেখেছি বলে। কিন্তু কী করব, অচেনা লোককে গেট খুলে দেওয়ার অর্ডার নেই। আসুন, ভিতরে আসুন।

তা হলে আমার উপর সদয় হলে কেন? অর্জুন বিরক্ত।

আপনার কথা মেজবাবুকে গিয়ে বললাম। শুনে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন উনি। আপনাকে ওঁর কাছে এখনই নিয়ে যেতে বললেন। রামঅবতার বলল।

গেটে তালা দিয়ে রামঅবতার অর্জুনকে নিয়ে যেখান দিয়ে ভিতরে ঢুকল, সেটা খিড়কি দরজা। ভিতরে অন্ধকার ঝিম মেরে রয়েছে। কীরকম থমথম করছে চারধার। লণ্ঠন হাতে নিয়ে ভিতরের বারান্দায় উঠে রামঅবতার বলল, আপনি ওর সঙ্গে যান।

অর্জুন তাকিয়ে দেখল, ভিতরের দরজার ওপাশে সেজবাতি হাতে নিয়ে বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। বৃদ্ধ হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আপনার পরিচয় দেবেন?

অর্জুন মাথা নাড়ল, আমার নাম অর্জুন। পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়িতে থাকি। তুলসীদাসজি আমাকে দুটো চিঠি দিয়েছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন এখানে আসার জন্যে। দ্বিতীয় চিঠির উত্তরও আমি দিয়েছিলাম।

বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, ওই চিঠি দুটোর একটা কি আপনার সঙ্গে আছে?

অর্জুন ব্যাগ খুলে দুটো চিঠিই বের করে বৃদ্ধের হাতে দিল। বৃদ্ধ সেগুলো দেখে নিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না বাবু, এই বাড়িতে নতুন কেউ এলে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হচ্ছে। আপনাকে বিব্রত করেছি বলে আমি দুঃখিত। আসুন আমার সঙ্গে।

বৃদ্ধ তাকে দোতলায় নিয়ে এসে বললেন, দেখছি আপনি বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছেন। আগে জামা-প্যান্ট পালটান, হাত-মুখ ধুয়ে নিন। আসুন, এই ঘরে আপনি থাকবেন। বলে বৃদ্ধ গলা তুললেন, বংশী।

সঙ্গে সঙ্গে বেঁটেখাটো প্রৌঢ় বেরিয়ে এল পাশের অন্ধকার থেকে। বৃদ্ধ বললেন, এই বাবু আমাদের অতিথি। অতিথি নারায়ণের সমান শ্রদ্ধেয়। ওই ঘরে উনি থাকবেন। ওঁর সেবাযত্নের দায়িত্ব তোমার উপর। ওঁকে ঘরে নিয়ে যাও।

বংশী একটুনিচুহয়ে হাত দেখিয়ে অর্জুনকে যে ঘরটিতে নিয়ে গেল, সেখানে একটা সেজবাতি জ্বলছে। বেশ বড় ঘর। আসবাবগুলোয় প্রাচীনকালের গন্ধ থাকলেও বোঝা যাচ্ছে বেশ যত্ন নেওয়া হয়। বিছানা না বলে পালঙ্ক বলাই ভাল। তার পাশে একটা বেশ বড় গোল শ্বেতপাথরের টেবিল। অর্জুনের হাত থেকে ব্যাগ টেনে নিয়ে টেবিলটার উপর রাখল বংশী।

অর্জুন মুখ তুলে দেখল, তিন ডানার ফ্যান স্থির হয়ে আছে। তারপর ঘরের তিন দিকে ইলেকট্রিক লাইটের ব্যবস্থা দেখতে পেল। সে জিজ্ঞেস করল, কারেন্ট নেই কেন?

বংশী বলল, দিনভর থাকে। সন্ধে হওয়ার আগেই লাইন কেটে দেয়।

কেটে দেয় মানে?

বংশী জবাব না দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।

অর্জুন সেটা ঠাওর করে বলল, কতদিন ধরে এরকম হচ্ছে?

আড়াই মাস হয়ে গেল। সকালে বিজলি ডিপার্টের লোকজন গিয়ে কাটা লাইন জুড়ে দেয় বলে পাখা চলে। বলতে বলতে পাশের দরজাটা খুলে দিল বংশী, এখানে জল ভরা আছে। আপনি তৈরি হয়ে নিন। এখন তো বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। তবু যদি বলেন, চা নিয়ে আসতে পারি।

একটু শীত শীত লাগছিল। অর্জুন বলল, চা হলে মন্দ হয় না।

মাথা নেড়ে বংশী বেরিয়ে গেল।

বাথরুমে গিয়ে জামা-প্যান্ট ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নিল অর্জুন। চা খেয়ে তুলসীদাসজির সঙ্গে দেখা করবে সে। ভদ্রলোক প্রথম চিঠিতে লিখেছেন একটু রহস্যের মতো, আমার এখানে সর্বত্র অসত্য, সত্য তার মধ্যে আড়ালে পড়ে গিয়েছে। আপনি তো সত্যসন্ধানী, দয়া করে এসে সত্যসন্ধান করে দিন। দ্বিতীয় চিঠিতে জানিয়েছিলেন, পশ্চিমের এই গ্রামে কীভাবে কোন ট্রেনে আসতে হবে। তাঁকে জানালে স্টেশনে লোক রাখবেন। সত্যসন্ধান করার জন্যে অর্জুনকে সম্মানদক্ষিণা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ইত্যাদি।

এখানে আসার পর প্রথমে স্টেশনমাস্টার তারপর হরিরাম, খোলাখুলি না বলে যথেষ্ট রহস্যের সৃষ্টি করেছেন। বৃষ্টির মধ্যে যে চারজনকে সে হেঁটে যেতে দেখেছে, তারা কি মানুষ? আবার এই বাড়ির দরজা দরোয়ান রামঅবতার যে সতর্কতার সঙ্গে খুলল, সেটাও মনে রাখতে হবে। আর এই বাড়ি, বোঝাই যাচ্ছে বেশ ধনী মানুষের বাড়ি। ইলেকট্রিকের সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এখানে সেজবাতি, হারিকেন জ্বালতে হয়। দিনভর আলো থাকে। কারণ, ইলেকট্রিক সাপ্লাই-এর লোক সন্ধেতে কাটা তার সকালে জুড়ে দেয়। কেন তারা উদ্যোগী হয়ে যারা তার কাটছে তাদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে না? পুলিশ কেন সক্রিয় হচ্ছে না? এক-আধদিনের ব্যাপার নয়, আড়াই মাস ধরে চলছে এই ঘটনা। আবার যারা তার কাটছে তারা কেন কাজটা করছে? কী লাভ হচ্ছে তাদের? গ্রামের কিছু বখে যাওয়া ছেলের বদমায়েশি বলে উড়িয়ে দেওয়া তো যাচ্ছে না। দোতলায় যে আলোটা জ্বলছিল সেটা নিশ্চয়ই বড় হারিকেনের আলো।

বংশী চা নিয়ে এল, সঙ্গে নারকোলের মিষ্টি। ওটা দেখে অর্জুন খুশি হল। এখন একটু খিদে খিদে পাচ্ছে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল বংশী। অর্জুনকে খেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, বাবু, এই বাড়িতে সবাই নিরামিষ খায়। কিন্তু আপনি যদি মাছ-মাংস খেতে চান তা হলে কাল থেকে দিতে পারব। আজ…!

তাকে থামিয়ে দিল অর্জুন, আমার খাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। যা দেবে তাই খাব।

তা হলে আজ রাতের খাবার কখন দেব?

তোমরা যখন খাবে। তুলসীদাসজি কখন খান?

ওঁর খাওয়া হয়ে গিয়েছে। বাবুরা সবাই খেয়ে নিয়েছেন। মায়েরা খেতে বসেছেন। এখন এখানে রাত ন’টার মধ্যেই সবাই খেয়ে শুয়ে পড়েন।

বংশীর কথা শেষ হওয়ার আগে বাইরে পায়ের শব্দ হল। দরজার বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, ভিতরে আসতে পারি?

নিশ্চয়ই। আসুন। অর্জুন চা শেষ করল।

সেই বৃদ্ধ সঙ্গে একজন প্রৌঢ়কে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, আপনার অসুবিধে হচ্ছে না তো?

না না। অর্জুন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

আমি আপনার সঙ্গে অসভ্যতা করেছি। আপনার পরিচয় নিয়েছি, কিন্তু নিজের পরিচয় দিইনি। আমি বিষ্ণুদাস চৌধুরী। তুলসীদাসজির ছোটভাই। হাতজোড় করলেন বিষ্ণুদাস।

নমস্কার ফিরিয়ে দিল অর্জুন।

বিষ্ণুদাসজি বললেন, এঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি ড. রামগোপাল গুপ্তা। আমাদের এখানে একজন হাতুড়ে ডাক্তার আছেন, যিনি সামান্য জ্বর বা পেট খারাপ হলে সারাতে পারেন। দাদা অসুস্থ হওয়ার পর আমরা ওঁকে শহরে নিয়ে যাই। বড় নার্সিংহোমে চিকিৎসা করিয়ে একটু সুস্থ হলে ফিরিয়ে আনি। দিন দশেক হল দাদা আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন ড. গুপ্তাকে অনুরোধ করি এখানে আসার জন্যে। উনি একদিনের জন্যে এসে সাতদিন থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

ভদ্রলোককে নমস্কার জানিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুলসীদাসজির কী হয়েছে?

ড. গুপ্তা বললেন, ব্লাডপ্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে। সকালে লো, তো বিকেলে হাই। প্রচণ্ড টেনশনে ভুগছেন উনি। আর প্রায়ই বলছেন, কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। আর টেনশন থেকেই রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়েছে।

বিষ্ণুদাসজি বললেন, আজকের পরিবর্তনটা বলুন!

হ্যাঁ। এই ক’দিন ধরে রাতে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ না দিলে দেখলাম উনি ঘুমোতে পারছিলেন না। আজ যখন সেটা দিতে যাচ্ছি, তখন বিষ্ণুদাসজি এসে খবর দিলেন, আপনি এসেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে তুলসীদাসজি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। কিন্তু বিষ্ণুদাসজি বললেন, আপনি খুব ভিজে গিয়েছেন। পোশাক বদলে আসতে দেরি হবে। তার চেয়ে আগামীকাল দেখা করলে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারবেন। মেনে নিলেন উনি। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আজ ঘুমের ওষুধ ছাড়াই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ড. গুপ্তা হাসলেন।

অর্জুনের মনে হল, কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে জিজ্ঞেস করল, শোনামাত্র ঘুমোলেন?

ড. গুপ্তা বললেন, আপনি এসেছেন শুনে ওঁর সব টেনশন চলে গেল। এরকম ক্ষেত্রে ক্লান্তি এসে যাওয়া খুব স্বাভাবিক।

বিষ্ণুদাসজি বললেন, একবার যখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, তখন আবার ডেকে তোলা বোধহয় উচিত কাজ হবে না। আপনি বিশ্রাম করে খাওয়াদাওয়া সেরে নিন। আরাম করে ঘুমোন। কাল সকালে ওঁর সঙ্গে দেখা করবেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।

বিষ্ণুদাসজি বংশীকে আবার বললেন অর্জুনকে যত্ন করতে। তারপর ওঁরা বেরিয়ে গেলেন।

চা শেষ হয়ে গিয়েছিল। কাপ-ডিশ তুলে নিয়ে বংশী জিজ্ঞেস করল, রাতের খাবার কখন দেব বলবেন।

ঘণ্টাখানেক পরে দিয়ো।

বংশী বেরিয়ে যেতে অর্জুন দরজার বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বের হওয়ার সময় দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিল। বাইরে এখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সামনের বাগানের গাছগুলো প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে সেই ভারী জলধারার সঙ্গে।

এখানে রাত নামলে বাড়ির ইলেকট্রিক সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। কারা কাটে তা নিশ্চয়ই এতদিনে কারও অজানা নেই। তবু তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সবাই ভয়ে চুপ করে আছে কেন? আসার সময় বৃষ্টির ভিতরে মাথা নিচু করে যে চারজনকে সে হেঁটে যেতে দেখেছিল, তারাই কি ওই কাণ্ড করছে? লোকগুলো নিশ্চয়ই এই গ্রামেই থাকে। তা হলে ওদের এত ভয় পাওয়ার কারণ কী? আব এইসব করে লোকগুলোর কী লাভ হচ্ছে? কেন করছে ওরা? অর্জুন ভেবে পাচ্ছিল না। এই গ্রাম, স্টেশন অঞ্চলে কিছু লোক ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছে। স্টেশনমাস্টার থেকে সবাই ভীত, অথচ পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে, এটা কী করে সম্ভব?

এখানে আসার পর গেট খুলেছিল রামঅবতার। কিন্তু সে দোতলায় ওঠেনি। কারণ, বিষ্ণুদাসজি তার জন্যে নীচের দরজায় অপেক্ষা করছিলেন। উপরের কাজের লোক বংশী। এরা ছাড়া বাড়িতে মহিলারা আছেন। বংশী বলেছিল, মায়েরা খেতে বসেছেন। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব এখনও বোঝা যায়নি। এইরকম গ্রামের মহিলারা রক্ষণশীল হতেই পারেন।

ড. গুপ্তা নিশ্চয়ই ভাল মানুষ। না হলে শহরের প্র্যাকটিস ছেড়ে এই গ্রামের একজন পেশেন্টের জন্যে থেকে যেতেন না। তাঁরই প্রেসক্রিপশন নিয়ে হরিরাম শহরে ছুটেছে ইঞ্জেকশন আনতে। ব্যাপারটা খুব জরুরি। হরিরাম বলেছিল, কাল বিকেলের মধ্যে প্রথমটা দেওয়া খুব জরুরি। জীবন মরণের ব্যাপার। তা হলে তুলসীদাসজি গুরুতর অসুস্থ, ওঁকে বাড়িতে না রেখে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যে ভদ্রলোক তাকে এখানে আনার জন্যে ব্যগ্র ছিলেন, তার আসার খবর পেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন কী করে? চটজলদি তার টেনশন চলে গিয়ে ঘুম এসে গেল? ড. গুপ্তার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না অর্জুন। তুলসীদাসজি তার সঙ্গে দেখা না করে ঘুমিয়ে পড়বেন, এ ভাবা যায় না।

বৃষ্টি পড়েই চলছিল। অর্জুন যখন সাত-পাঁচ ভেবেই চলেছে, তখন নীচে আওয়াজ হল। অন্ধকারে চোখ যেটুকু সয়ে গিয়েছিল তাতে মনে হল, সদর গেট খুলছে। গেটের এপাশে কেউ নেই। তাকে গেট খুলে দিয়েছিল রামঅবতার, তাও অনেক ডাকাডাকির পর। আওয়াজটা গেট খোলার এবং এপাশে রামঅবতার নেই। এই সময় বিদ্যুৎ চমকে উঠল। অর্জুন কিছু ভাল করে বোঝার আগেই অন্ধকার আছড়ে পড়ল। তবু তার মনে হল, চারটে মানুষ গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার যখন বিদ্যুৎ চমকাল, তখন দেখা গেল গেটটা বন্ধ।

হঠাৎ সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। আসার সময় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে যে চারজনকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে দেখেছিল সে, তাদের সঙ্গে এদের বেশ মিল আছে। এরা কারা? কেন এই বাড়িতে এল? এই বাড়িতে ঢোকার জন্যে হাঁকডাক করে গেট খোলাতে হল না ওদের। তা হলে কি ওরা এখানে যায়-আসে অনুমতি নিয়ে? একধাপ নীচে নেমে ওদের উদ্দেশ্য যাচাই করলে কেমন হয়? পরক্ষণেই মাথা নাড়ল সে। তুলসীদাসজির সঙ্গে কথা না বলে সে কোনওরকম কৌতূহল দেখাতে পারে না।

বাবু। ভিতর থেকে বংশীর গলা ভেসে এল। বেশ চাপা গলা।

অর্জুন দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই বংশী বলল, ও, আপনি বারান্দায় ছিলেন? ভিতরে কোথাও দেখতে না পাওয়ায় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

কেন? ভয় পাওয়ার কী আছে?

না, নতুন জায়গা…!

তুমি সত্যি কথা বলছ না বংশী।

না বাবু। আপনি নীচে যাননি, বৃষ্টির রাত, আপনাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না, তাই মন কু গাইছিল।

এখানে কথায় কথায় মন কু গায় নাকি?

বংশী কোনও জবাব না দিয়ে ঘরের কোণে টেবিলের কাছে চলে গেল, খাবার ঢেকে রেখেছি। গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নিন।

খিদেও পেয়ে গিয়েছিল। অর্জুন চেয়ার টেনে বসল। ঢাকা খুলে ভাতের পাশে রুটি দেখে খুশি হল সে। ওড়িশার গ্রামাঞ্চলের মানুষ সাধারণত ভাতই পছন্দ করে। নারকোল দেওয়া ডাল, দু’রকমের তরকারি আর ছোট কাঁচের বাটিতে ঘন ক্ষীর।

খাওয়া শুরু করে অর্জুন বলল, হরিরামের সঙ্গে আলাপহল। তুলসীদাসবাবুর জন্যে ইঞ্জেকশন আনতে শহরে যাচ্ছিল। সে এই বাড়ির ছেলে?

না। বড়বাবুর ভাগনে। বছর পাঁচেক হল, ওকে এখানে এনে রেখেছেন বড়বাবু। পড়াশুনো বেশিদূর হয়নি, চাকরিও পায়নি, কিন্তু মনটা সরল। বংশী বলল।

খাওয়া শেষ হতে সংলগ্ন টয়লেট থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে অর্জুন দেখল, বংশী এঁটো বাসন তুলে দাঁড়িয়ে আছে, আপনার জল ওখানে রেখেছি। আর কিছু?

না। তুমি যেতে পারো।

বংশী দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর গলার স্বর নামাল, বাবু!

অর্জুন তাকাতে বংশী বলল, দরজাটা এখনই ভিতর থেকে বন্ধ করে দিন।

কেন? এখানে চুরিচামারি খুব হয় নাকি?

বংশী কিছু বলল না। চোখ নামাল মেঝেতে।

নীচে তো পাহারাদার আছে। তাদের ফাঁকি দিয়ে চোর কীভাবে উপরে উঠবে? অর্জুন হাসল, বেশ, তুমি যখন বলছ তখন বন্ধ করে দিচ্ছি।

এবার হাসি ফুটল বংশীর মুখে, ভোরের আলো ফোঁটার আগে যেন ভুল করে দরজা খুলবেন না। বলে আর দাঁড়াল না।

শিকল এবং ছিটকিনি তুলে অর্জুন বুঝতে পারল, তার ট্রেনযাত্রার ক্লান্তি, বৃষ্টিতে ভেজা শরীর খাবার পেয়ে এখন দ্রুত ঘুম ছড়িয়ে পড়ছে। সে আলো নিভিয়ে টর্চটাকে পাশে নিয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশে মাথা দিতেই অদ্ভুত শান্তির অনুভব হল। বাইরে তখনও জল নেমে আসছে আকাশ ফুড়ে। তার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

.

ঘুম ভাঙল শব্দ কানে আঘাত করায়। চোখ মেলে বুঝল, দরজার বাইরে যে ‘ দাঁড়িয়ে সে-ই শব্দ করছে। জানলার পরদার ফাঁক গলে আলো ঢুকছে ঘরে। অর্থাৎ সকাল হয়ে গিয়েছে।

তাড়াতাড়ি মুখে-চোখে জল দিয়ে অর্জুন দরজা খুলে দেখল, বিষ্ণুদাসজি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে দেখে হেসে বললেন, আপনার ঘুম দেখে আমি অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। রাতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

বিন্দুমাত্র না। এখানে দরজা বন্ধ করে ঘুমোনোর বোধহয় প্রয়োজন নেই। বছরখানেক আগে আমাদের এক আত্মীয় এসেছিলেন। রাতে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন। ভোরবেলায়ও দরজা খুলছেন না দেখে ওটা ভাঙতে হল। দেখলাম, দরজার পাশেই ওঁর মৃতদেহ পড়ে আছে। হার্ট অ্যাটাক। উঠে দাঁড়াতে পারেননি। হামাগুড়ি দিয়ে দরজা পর্যন্ত এসে আর উঠতে পারেননি। যাকগে, আপনি তৈরি হয়ে নিন। দাদার ঘুম ভেঙেছে। একটু পরে যখন চা খাবেন, তখন আপনি দেখা করতে যাবেন।

বেশ।

আর-একটা কথা। আপনি কাল রাতে এসেছিলেন, ওঁকে খবরটা দেওয়ার পর খুব খুশি হয়েছিলেন, টেনশন চলে গিয়েছিল। ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। আজ সকালে ওঁর কথাবার্তা শুনে মনে হল, ওই ব্যাপারটা ওঁর মাথায় নেই। একদম ভুলে গিয়েছেন।

সে কী! অর্জুন অবাক হল।

ওঁর অসুখটা বেড়ে গেলে স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ মুছে যায়। আমি একটা অনুরোধ করছি। আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় ওঁকে বলব, আপনি ভোরের ট্রেনে পৌঁছেছেন। হাসলেন বিষ্ণুদাসজি। নইলে উনি বেশ লজ্জায় পড়ে যাবেন।

বেশ। অর্জুন ছোট্ট করে বলল।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress