তুমুল বৃষ্টি পড়েছে
গত চারদিনে তুমুল বৃষ্টি পড়েছে। ঠিক বলা হল না, বৃষ্টিটা তুমুল হচ্ছে রাত্রে, দিনের বেলা টিপটিপিয়ে। আকাশের মুখ হাঁড়িচাচা পাখির চেয়েও কালো। ইতিমধ্যে করলা নদীর পাশের রাস্তাটা ড়ুবে গিয়েছে। সারা শহর ভিজে।
এই চারদিন বাড়ি থেকে বের হয়নি অর্জুন। স্নান এবং খাওয়া ছাড়া বিছানা থেকে নামেনি। এখন তার বালিশের পাশে পৃথিবীর সব বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্পের বই। অবশ্য ইংরেজিতে। সেই সঙ্গে একটা রিডার ডাইজেস্ট পত্রিকা থেকে বের করা সঙ্কলন। পৃথিবীর রহস্যময় ঘটনাবলী। এই বইটাই সে পড়ছিল সকালবেলায়, বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে। গোয়েন্দা গল্পের চেয়ে এই বাস্তব রহস্যকাহিনী অনেক বেশি চনমনে।
এই সময় কেউ একজন কড়া নাড়ল। অর্জুন জানে, মা দরজা খুলবেন। একনাগাড়ে চারদিন ছেলেকে বাড়তে পেয়ে মা খুব খুশি। একটু বাদেই তিনি ঘরে এলেন, তোর চিঠি।
হাত বাড়াল অর্জুন। সাদা খাম। মুখ আঁটা। জিজ্ঞেস করল, কে দিল?
একটা ছেলে এসে দিয়ে গেল। মা বললেন, আজ খিচুড়ি খাবি?
দারুণ। বৃষ্টিটা যা জমেছে না!
কাল কিন্তু বৃষ্টি মাথায় করেও বাজারে যেতে হবে। মা চলে গেলেন।
খাম খুলল অর্জুন। জগুদার চিঠি। স্নেহের অর্জুন, আশা করি ভাল আছ। গতরাত্রে বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ি ফিরেছিলাম। আজ ভোরে যখন বেরোচ্ছি। তখনও বৃষ্টি। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তোমার সঙ্গে দেখা করতে না পেরে চিঠি লিখে যাচ্ছি! তোমার সঙ্গে জরুরি দরকার আছে। তুমি আজ বেলা একটা নাগাদ শিলিগুড়িতে আমার অফিসে আসতে পারবে? শিলিগুড়ির সেবক রোডে আমাদের ব্যাঙ্ক। শুভেচ্ছা রইল। তোমাদের জগুদা।
অর্জুন চিঠিটা দুবার পড়ল। জগুদার মতো মানুষ অকারণে তাকে শিলিগুড়িতে ডেকে নিয়ে যাবেন না। মিনিবাসেই প্রায় পঞ্চাশ মিনিট লাগে।
তার ওপর এই বৃষ্টি। ব্যাপারটা কী? সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। এখন গুঁড়িগুঁড়ি জল ঝরছে। একটুও ইচ্ছে করছে না বাইরে যেতে। চিঠি খামে পুরে পাশে রেখে সে রহস্যকাহিনীতে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। নাঃ, বারেবারে চিঠিটার কথা মনে আসছে। জগুদা খুব সিরিয়াস মানুষ। তাকে বেশ পছন্দ করেন। সে বিছানা থেকে জোরে হাঁক দিল, মা, তাড়াতাড়ি খিচুড়ি করো, আমি বেরোব।
ওমা, এই বৃষ্টিতে কোথায় যাবি? মায়ের গলা ভেসে এল।
শিলিগুড়িতে। জগুদা ডেকে পাঠিয়েছেন।
মায়ের কথাটা নিশ্চয়ই পছন্দ হয়নি। তাই তাঁর গলার স্বর পালটাল। কখন ফিরবি?
সন্ধের মধ্যেই। অর্জন জবাব দিল।
এখন ছাতা হাতে চলা মুশকিল। যা উলটোপালটা হাওয়া বৃষ্টির সঙ্গে বইছে তাতে ছাতা সোজা রাখা যায় না। অর্জুন বর্ষাতি চাপিয়েছিল। মাথায় বারান্দা-দেওয়া টুপি। পায়ে ছোট গামবুট। এই পোশাক পরে দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাস্তায় চললেই নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দাকাহিনীর কথা মনে আসে। বিদেশি দু-তিনটে বইতেও এমন চরিত্র সে পড়েছে। গত বছর এখানে অর্জুনের প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এসেছিলেন। আলাপ করতে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, আপনার সন্তু কাকাবাবুকে ঠিক রহস্যময় গোয়েন্দা মনে হয় না কেন? ভদ্রলোক হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন কীরকম?
এই যেমন ধরুন, একটা বর্ণনা, রাত তখন দুটো, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তায় কেউ নেই। গ্যাসপোস্টের আলোও ঝাপসা। এই সময় লোকটিকে হেঁটে যেতে দেখা গেল। পরনে ওভারকোট, মাথায় ফেল্টহ্যাট, দু হাত পকেটে ঢুকিয়ে মুখ নিচু করে হাঁটায় তার চিবুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। পড়লেই কেমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়, তাই না? অর্জুন বোঝাতে চেষ্টা করছিল।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ওই লোকগুলোকে আজকাল রাস্তাঘাটে তেমন দেখা যায় না। এই যেমন ধরো তুমি, এত নাম করেছ, তোমাকে দেখে মনে হয় কফিহাউসে আড্ডা মারতে পারো, খেলার মাঠেও চিৎকার করতে পারো। এটাই তো ভাল।
রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে অর্জুনের মনে হল তার প্রিয় লেখক এখন তাকে দেখলে কী বলতেন? সে হেসে ফেলল। কদমতলা পৌঁছে সে আবিষ্কার করল বাস নেই রিকশাও বের হয়নি শহরে। পথেঘাটে মানুষ দেখাই যাচ্ছে না। রূপমায়া সিনেমার পাশে একটা মিষ্টির দোকানের শেড-এর তলায় দাঁড়াতেই শুনল ভেতরে বসা কয়েকজন বলছে ড়ুয়ার্সের নদীর জল বেশ বেড়ে গিয়েছে। এমনকী কার্নিশের ওপরের দিকে জল ঢুকে পড়েছে। এসব শুনে সে বুঝতে পারছিল না কী করবে। এই সময় একটা মিনিবাস এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়াল। কন্ডাক্টর চিৎকার করছে, শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি। অর্জুন মিনিবাসে উঠে দেখল দুজন যাত্রী বসে আছেন পুরো গাড়িতে। টুপি আর কোট খুলে সে সিটে বসল। জলে জলময় হয়ে যাচ্ছে বাসের ভেতরটা।
জলপাইগুড়ির মোড় ছাড়িয়ে বাসটা যখন শিলিগুড়ির পথে, তখনও অর্ধেক সিট খালি। বৃষ্টির জন্যই খুব দ্রুত যেতে পারছে না গাড়িটা। যাওয়ার পথে যেকটা ছোট নদী পড়ল সেগুলো টইটুম্বর। শিলিগুড়ির থানার সামনে বাস থেমে গেলে নেমে পড়তে হল। এখানে বৃষ্টি হচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে সকাল থেকেই বৃষ্টি নেই। কিন্তু আকাশের অবস্থা যা, তাতে যে-কোনও মুহূর্তেই প্রলয় হয়ে যেতে পারে। অর্জুন একটা রিকশা নিল। টাউন স্টেশনের পাশ দিয়ে অনেকটা পথ যেতে হবে এখনও।
ঠিক একটা বাজতে দশে সে জগুদার ব্যাঙ্কে পৌঁছাল। জগুদার ভাল নাম অশোক গাঙ্গুলি। জিজ্ঞেস করতেই একজন দেখিয়ে দিল ঘরটা। ঘরে ঢুকতেই জগুদা হাসলেন, যাক, এসেছ তা হলে। বোসো, বোসো। চা খাবে?
খেতে পারি। অর্জুন তার ওভারকোট আর টুপিটা চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে দিল। বেশ শুকিয়ে এসেছে এরমধ্যে। জগুদা চায়ের হুকুম দিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে?
হ্যাঁ। শিলিগুড়িতে দেখছি বৃষ্টি নেই।
ফোরকাস্ট বলছে বিকেলে ভাসাবে। খেয়ে এসেছ?
হ্যাঁ। অর্জুন ঠিক বুঝতে পারছিল না কেন জগুদা তাকে ডেকেছেন। এতক্ষণ যেসব কথা হল তাতে জরুরি কোনও প্রয়োজন আছে। সে নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না বলে ঠিক করল। ব্যাঙ্কে জগুদার ওপরে কাজের চাপ আছে। একের পর এক লোক আসছে খাতাপত্র নিয়ে। তাঁদের বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে সমস্যাগুলো। জগুদা তার মধ্যে বললেন, আর মিনিট পাঁচেক।
ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকতেই জগুদা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে আপ্যায়ন করলেন, আসুন, আসুন। কেমন আছেন?
আর থাকা। এখনও বেঁচে আছি। বিদেশের হাজারো লোভ ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এলাম মন দিয়ে কাজকর্ম করব বলে, তা আর হচ্ছে কই? বসছি। ভদ্রলোক অর্জুনের পাশের চেয়ারটা নিজেই টেনে নিলেন।
নিশ্চয়ই। তিনজনে বসামাত্র তিনকাপ চা এল। ভদ্রলোক বললেন, আমি তো চা খাই না। আপনারা খান। আমার চেকগুলোর কোনও খবর আছে?
আমি খুব দুঃখিত ডক্টর গুপ্ত। একটু আগেও আমি খোঁজ নিয়েছি। আসলে বিদেশি ব্যাঙ্কের চেক বলেই দেরি হচ্ছে। আমি হেড অফিসে ফোন করেছিলাম। ওরাও চেষ্টা করছে। জগুদা বললেন।
ঠিক আছে। আমার যা আছে তাতে দিন পনেরো চলে যাবে।
এই সময় একজন খাতা নিয়ে জগুদার কাছে আসতেই তিনি এক মিনিট বলে তাতে ঝুঁকে পড়লেন। অর্জুন ডাক্তার গুপ্তকে দেখছিল। আশিভাগ চুলই সাদা, ছোট্ট পাকা আমের মতো শরীর। চোখে পুরু চশমা। ডাক্তার হিসাবে নিশ্চয়ই ইনি খুব ভাল, নইলে জগুদা এত খাতির করতেন না।
কাজ শেষ করে জগুদা মুখ ফেরালেন, ডক্টর গুপ্ত, আপনি কী স্থির করলেন? পুলিশের কাছে যাবেন না?
কোনও লাভ হবে না মিস্টার গাঙ্গুলি। পুলিশকে বললে তারা আমার বাড়ির সামনে পাহারা বসাতে পারে। কিন্তু কদিন? তা ছাড়া হাজারটা কৈফিয়ত। এসব আমার ভাল লাগে না। খবরের কাগজ জানতে পারবেই।। আপনাকে আমি বলেছি যে, প্রচার চাই না। আর কটা দিন যদি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি তা হলে আমি নিজেই প্রেসকে বলব। ডক্টর গুপ্তের ডান হাত বারংবার নিজের মাথার চুলে চলে যাচ্ছিল। বোধ হয় কথা বলার সময় চুলে হাত বোলানো তাঁর বদ-অভ্যাস।
এবার জগুদা বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব বলে ওকে জলপাইগুড়ি থেকে আসতে বলেছিলাম। খুব খারাপ আবহাওয়া সত্ত্বেও চলে এসেছে।
ডক্টর গুপ্ত অর্জুনের দিকে তাকালেন, আচ্ছা! এরই কথা সেদিন বলেছিলেন?
হ্যাঁ। দেখতে অল্পবয়সী হলে কি হবে এর মধ্যে দারুণ-দারুণ সমস্যার সমাধান করে বসে আছে। এমনকী ইংল্যান্ড আমেরিকায় গিয়েও অপরাধী ধরেছে।
তাই নাকি? বাঃ। দেখে তো মনেই হয় না। কী নাম ভাই?
অর্জুন।
কি একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক। তারপর কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, বাঃ। চমৎকার নাম। কিন্তু মহাভারতটা কি ভাল করে পড়া আছে? অর্জুন চরিত্রটা কি জানা?
অর্জুন মাথা নাড়ল, সে জানে।
বেশ। এবার আমায় একটা সমস্যার সমাধান করে দাও তো। মহাভারতের অর্জুন একসময় স্বর্গে গিয়েছিলেন। যেখানে উর্বশীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। বেশ কিছুদিন ছিলেন সেখানে। তারপর ফিরে এসেছিলেন। তা স্বর্গ মানে আউটার স্পেস। পৃথিবীর বাইরে। সেখানে কারও বয়স বাড়ে না। এমনকী উর্বশীরও বাড়েনি। অতএব অর্জুন যখন সেখানে কিছুদিন ছিলেন তাঁরও তো বয়স বাড়ার কথা নয়। তা তিনি যখন ফিরে এলেন তখন তাঁর দাদা, ভাই, স্ত্রীর বয়স পৃথিবীতে থাকার দরুন বেশ বেড়ে গিয়েছে। অর্জুন তো বয়সে সবার ছোট হয়ে গেলেন, তাই না?
অর্জুনের বেশ মজা লাগল। মহাভারতে এই ঘটনার কথা সে পড়েছে। কিন্তু এটা যে সমস্যা হতে পারে তা সে ভাবেনি কখনও। কাউকে বলতেও শোনেনি। ডক্টর গুপ্ত তার উত্তরের অপেক্ষা করে আছেন দেখে সে বলল, পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করবে অঙ্কের ওপর।
অঙ্ক? ইন্টারেস্টিং! কীরকম?
প্রথমত, অর্জুন কতদিন স্বর্গে ছিলেন? স্বর্গের একদিন মানে পৃথিবীর কতদিন? এখানে সূর্যের উদয়-অস্তের সঙ্গে দিনের পরিমাপ করা হয়। স্বর্গে নিশ্চয়ই তা হয় না। তা হলে স্বর্গের দিন মাপার পদ্ধতিটা কী? সেটা বের করে স্বর্গের একটা দিনের সমান পৃথিবীর কতদিন হয় বের করে যেকদিন অর্জুন সেখানে ছিলেন সেই কটা দিন দিয়ে গুণ করলেই পৃথিবীর সময়টা বেরিয়ে আসবে। যদি তিন-চার মাস হয় তা হলে ব্যাপারটা ধর্তব্যের মধ্যে থাকবে না। অর্জুনের বেশ মজা লাগছিল বলতে।
চমৎকার। কিন্তু স্বর্গের সময়টা কীভাবে মাপবে?
সেটা মহাভারতে নেই। পৃথিবী থেকে স্বর্গে হেটে যেতে কত সময় লাগে মহাপ্রস্থানের সময় হিসাব করে জানা যেতে পারে।
তাতে কী লাভ? পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদী যদি রথে চেপে যেতেন তা হলে নন-স্টপ পৌঁছে যেতেন। হুম। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগছে। তুমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর?
হ্যাঁ। তাই বলতে পারেন।
এবার ডক্টর গুপ্ত জগুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি একে কিছু বলেছেন?
না। আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তা ছাড়া আপনিও আমাকে সব খুলে বলেননি। জগুদা হাসলেন, অর্জুন, ডক্টর গুপ্ত অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি। আন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক। প্রায়ই বিদেশের সায়েন্স জানালে ওঁর লেখা বের হয়। আমার সঙ্গে আলাপ সেই বাবদ পাওয়া চেক ভাঙানোর সুবাদে। অবশ্য উনি এখন আমাকে বেশ স্নেহ করে ফেলেছেন। উনি একটা সমস্যায় পড়ায় আমার মনে হয় তোমাকে ডেকে আলাপ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। শুনলেই তো উনি পুলিশের কাছে যাবেন না। জগুদা বিস্তারিত বললেন।
সমস্যাটা কী? অর্জুন জানতে চাইল।
সেটা বুঝতে গেলে তোমাকে আমার বাড়িতে যেতে হবে।
মুখে বলা যায় না?
বললেও স্পষ্ট হবে না। অন্তত সত্তরভাগ সমস্যা মানুষ অভিজ্ঞতা ছাড়া। হৃদয়ঙ্গম করে না। তিরিশভাগ শুনে বা পড়ে অনুভব করা যায়। ডক্টর গুপ্ত হাসলেন, আমার আস্তানা এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে। সঙ্গে একটা পুরনো অস্টিন গাড়ি আছে। পাহাড়ি পথ, তাই যেতে মিনিট চল্লিশেক লাগবে। কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর গুপ্ত, চলি মিস্টার গাঙ্গুলি।
অর্জুন ফাঁপরে পড়ল, কিন্তু আমি ওঁর সঙ্গে গেলে কি আজ জলপাইগুড়িতে ফিরতে পারব? এমনিতেই বাস খুব কম।
জগুদা বললেন, যদি না পারে তা হলে আমি মাসিমাকে নিজে গিয়ে বলে আসব কোনও চিন্তা না করতে। তুমি কিছু ভেবো না।
অগত্যা অর্জুন ডক্টর গুপ্তকে অনুসরণ কর। মানুষটিকে তার ইতিমধ্যে বেশ পছন্দ হয়েছে। মনের ভেতরে একটা খুঁতখুতানি ছিল মায়ের জন্য। তবে এখন তো সবে পৌনে দুটো। শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়িতে ফেরার বাস সন্ধে সাতটাতেও পাওয়া যায়। শুধু এখানে বৃষ্টিটা না নামলে হয়।
ডব্লু বি এ নাম্বার দেওয়া একটা কালো গাড়ি ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে। এ-ধরনের প্রাচীন গাড়ি আজকাল বড় একটা দেখা যায় না। ডক্টর গুপ্ত বললেন, এ-গাড়ি খুব বিশ্বস্ত। আমাকে কখনও বিপদে ফেলে না। চলার সময় একটু প্রতিবাদ করে, এই যা।
গাড়িতে উঠে অর্জুন দেখল বাইরে থেকে যতটা মনে হচ্ছিল ভেতরটা কিন্তু ততটা পুরনো নয়। অথচ এই গাড়ির বয়স অন্তত পঁয়ত্রিশ হয়ে গিয়েছে। ডক্টর গুপ্ত ইঞ্জিন চালু করে চলতে আরম্ভ করতেই রাস্তার লোকজন তাকাতে আরম্ভ করল। এত নামী একজন বৈজ্ঞানিক এমন গাড়ি ব্যবহার করেন কেন। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও অশোভন হবে বলে সে চুপ করে গেল।
গাড়ি এখন সেবক ব্রিজের দিকে এগোচ্ছে। শিলিগুড়ি পার হওয়ার পর দুদিকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে জঙ্গলে ঢোকার সময় অর্জুনের মনে হল যে-কোনও মুহূর্তে আকাশ আর মাটি একাকার হয়ে যাবে। এত কালো আকাশ এমন নীচে সে কখনও দেখেনি। এই রাস্তায় অর্জুন বেশ কয়েকবার গিয়েছে এর আগে। ডান দিকে বাগরাকোটে আর ওদিকে তিস্তাবাজারের কাছে বেশ কিছু বসতি আছে। সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?
ডক্টর গুপ্ত বললেন, কালীঝোরা বাংলোটা পেরিয়ে খানিক ওপরে। এক ইংরেজ ভদ্রলোকের বাংলো ছিল ওটা। আমি নিজের মতো করে নিয়েছি।
জগুদা মানে মিস্টার গাঙ্গুলি আপনার সমস্যার কথা বলছিলেন!
হ্যাঁ ভাই। বছরখানেক আছি আমি এখানে। গত বছর আমার এক বন্ধু আমেরিকা থেকে এসেছিল নেহাত গায়ে পড়েই। এখানে আসার পর কাউকে আমি আসতে বলিনি। লোকটার নাম রবার্ট সিনক্লেয়ার। একটা সায়েন্স জানালের সম্পাদক। লেখা পাঠাই, ছাপলে চেক পাঠায়, তাই ঠিকানা ওর জানা ছিল। তা বলা-কওয়া নেই চলে এল দুম করে। আমি কী নিয়ে গবেষণা করছি তা জানার জন্য খুব কৌতূহল ওর। তিনদিন ছিল, আমি জানাতে চাইনি। কারণ জানতে পারলেই গবেষণা শেষ হওয়ার আগেই ও ওর জানালে ছেপে দেবে। কিন্তু মুশকিল করল তাতান।
তাতান কে? অর্জুন জানতে চাইল।
আমার কুকুর। ওকে দেখে বব, মানে রবার্টের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
কেন? অদ্ভুত ধরনের কুকুর বুঝি?
একটু অদ্ভুত। লম্বায় দুই ইঞ্চি, প্রস্থে ইঞ্চিতিনেক। অর্জুনের মনে হল সে নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে। ওটা ইঞ্চি না হয়ে ফুট হবে।
ডক্টর গুপ্ত হাসলেন, কী, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? ববেরও বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু যখন বুঝল ওটা ইদুর নয়, সত্যিকারের কুকুর, তখন নিয়ে যাওযার জন্য কী ঝুলোঝুলি। দশ হাজার ডলার দাম দিয়েছিল সে তাতানের। তার মানে আমাদের দেশের দু লক্ষ টাকা। আমি দিইনি। এমনকী তাতানের ফোটো তুলতেও অনুমতি দিইনি। ব্যাটা করল কী, দেশে ফিরে গিয়ে এ-সবই তার জানালে ছেপে দিল। আর তারপর থেকেই সমস্যা শুরু হয়ে গেল।
কীরকম? অর্জুনের মনে হচ্ছিল সে আষাঢ়ে গল্প শুনছে।
লোক আসতে লাগল একের পর এক। সবাই তাতানকে দেখতে চায়, কিনতে চায়। প্রথম দিকে বুঝিনি, দেখিয়েছি। দু-দুবার চুরির চেষ্টা হল। শেষপর্যন্ত বাড়ির চারধারে ইলেকট্রিক তার লাগালাম। দুটো লোক শক খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদিকে এখন দাম উঠেছে দশ লক্ষ টাকা। এ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল। একাই সামলে নিচ্ছিলাম। তাতানকে আর বাইরে বের করি না। কিন্তু এখন ঘটনা ঘটছে আরও খারাপ।
কী ঘটনা?
সেটা মুখে বললে তুমি বুঝবে না। চলো, গিয়ে দেখবে।
সেবক ব্রিজের গা ঘেঁষে গাড়ি উঠছিল ধীরে-ধীরে। জায়গাটা এর মধ্যেই অন্ধকার-অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। নীচ থেকে তিস্তার আওয়াজ উঠে আসছে। নিশ্চয়ই জল আরও বেড়েছে। কালীঝোরা বাংলো দেখা গেল। অর্জুন দেখল ডক্টর গুপ্ত প্রশান্তমুখে গাড়ি চালাচ্ছেন। ভদ্রলোকের কুকুরের নাম তাতান।। তার উচ্চতা দুই ইঞ্চি। ভাবা যায়? হঠাৎ ডক্টর গুপ্ত বললেন, ওই যে শ্রীমানরা এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মহা মুশকিল।
নির্জন পাহাড়ি রাস্তার একধারে একটা মারুতি জিপসি দাঁড়িয়ে। তার সামনে একজন সাহেব আর দুজন ভারতীয় হাত তুলে তাদের থামতে বলছে। ডক্টর গুপ্ত বাঁ হাত বাড়িয়ে ড্রয়ার থেকে একটা সাইলেন্সর লাগানো রিভলভার বের করে ডান হাতে নিয়ে মারুতি গাড়ির টায়ার লক্ষ করে ট্রিগার টিপলেন চলন্ত অবস্থায়। লোকগুলো হকচকিয়ে গেল। তার মধ্যেই তিনি পেরিয়ে এলেন জায়গাটা। রিভলভার রেখে দিয়ে বললেন, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। থামলে ওরা ঝামেলা করত না থামলে ওভারটেক করে এসে গাড়ি আটকাত। ওরা চাকা বদলাতে বদলাতে আমি বাংলোয় ঢুকে যেতে পারব।
এরা কী চাইছে?
আমাকে ব্যবহার করতে। ডক্টর গুপ্ত চুপ করে গেলেন।
শেষ পর্যন্ত পিচের রাস্তা ছেড়ে গাড়ি বাঁ দিকের কাঁচা পথ ধরল। একটু চড়াই উঠতে গাড়িটা বেদম হয়ে যাচ্ছিল। তবু তাকে তুলে নিয়ে আসতে পারলেন ডক্টর গুপ্ত। লম্বা-লম্বা গাছের পর বাংলোটা দেখা গেল। এককালে সাদা রং ছিল এখনও বোঝা যায়। বাংলোর চারপাশে খালি জমি, তারপর লোহার বিম দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে। পনেরো ফুট উচ্চতার বেড়ার ওপরে অন্তত ফুটচারেক তারের সারি চলে গেছে। অর্জুন বুঝল ওখান দিয়েই বিদ্যুৎ যাচ্ছে। মাঝখানে একটা গেট আছে। ভেতরে থেকে জেনারেটারের আওয়াজ ভেসে আসছে, যদিও এই বাংলোয় সরকারি বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। ডক্টর গুপ্ত পকেট থেকে একটা রিমোট কন্ট্রোলার বের করে কয়েকটা নম্বর টিপতেই গেট খুলে গেল। অর্জুন বুঝতে পারল গেট খোলার জন্য সাঙ্কেতিক নম্বর আছে যা জানা না থাকলে ওটা খুলবে না। ভেতরে ঢুকে আবার নম্বর টিপেই গেট বন্ধ করলেন তিনি। গাড়িটাকে সোজা নিয়ে এলেন বাংলোর গাড়ি বারান্দার নীচে। রিভলভাবটা পকেটে ফেলে বললেন, এই আমার আস্তানা। দাঁড়াও দরজা খুলি।
দরজায় কোনও তালা নেই। কিন্তু রিমোট টিপে ধরতেই সেটা খুলে গেল। ডক্টর গুপ্ত বললেন, পেছনের সিটে সারা সপ্তাহের বাজার আছে, তুমি যদি একটু হাত লাগাও তা হলে তাড়াতাড়ি হয়।
বড় বড় প্যাকেট ভর্তি সবজি, মাংস ইত্যাদি জিনিস। অর্জুন সাহায্য করল। আর এই সময় হাওয়া ছাড়তেই শীত শীত করে উঠল অর্জুনের। টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ শোনা গেল। গাড়ি বন্ধ করে মালপত্র নিয়ে ডক্টর গুপ্ত ভেতরে ঢুকে বললেন, নীচতলাটা বসা আব থাকার ঘর। কিচেন টয়লেটও এখানে। ওপরটা আমার কাজের জন্য। ওখানে আমি ছাড়া কারও যাওয়া নিষেধ। নীচটাকে নিজের মতো মনে করো।