যুদ্ধক্ষেত্রে একজন
ছয় ক্রোশ কাদা ভেঙে জোড়খালি গাঁয়ে বাইরের লোক বড় একটা আসে না। শীতকাল হলে তবু গরুর গাড়ি চলে, জলের সময় তো কথাই ওঠে না। তবু পার্টির বাবুরা এসে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে সবাইকে ডেকেডুকে। সমস্ত পৃথিবীটা এখন বদলে যাচ্ছে, জোড়খালির মানুষজনের পিছিয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। লাঙল যার জমি তার। কে একজন কয়েক পুরুষ আগে গাঁয়ের সব জমি কিনে নিয়েছিল আর সেই সুবাদে পায়ে পা দিয়ে তিন ভাগের দুভাগ ফসল তুলে নেবে এ। আর হতে পারে না। যারা রক্ত দিয়ে জমির মুখে হাসি ফুটিয়েছে তাদেরই হক সবচেয়ে বেশি। হিসেবটা উলটে যাওয়া উচিত। দুনিয়ার না খেতে পাওয়া মানুষরা এখন এক।
তিন দলে ভাগ হয়ে গেল জোড়খালির মানুষ। একদল, যাদের বয়স একটু বেশি, তারা কথাটা ঠিক মেনে নিতে পারল না। হরিশ রায় চার পুরুষ ধরে এই গ্রামের জোতদার কিন্তু কখনই ওদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। ঠিক বাইরের লোক বা শত্রুপক্ষ হিসেবে হরিশ রায়কে চিন্তা করা যাচ্ছে না। খামোকা একটা হুজ্জৎ বাধিয়ে কি লাভ? দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে তাতে জোড়খালি গাঁয়ের কি এসে গেল? গরীব মানুষ চাষ করে দুবেলা পেটপুরে খেতে পাচ্ছে এই তো বেশ। পুজো-পার্বণ যে কটা গাঁয়ে হল তার সব খরচ হরিশ রায়ের। কারও অসুখ-বিসুখ করলে হরিশ রায় ছয় ক্রোশ রাস্তা পালকি চড়িয়ে ময়নাগুঁড়ি নিয়ে যায়। যে প্রাইমারি স্কুলটা আট বছর চলছে সেটাও হরিশ রায় করেছে।
দ্বিতীয় দল মুখ খুলল না। দুভাগে ফসল পেলে কার না লাভ হয় কিন্তু তাই বলে সরাসরি এই গাঁয়ের মাথার সঙ্গে লড়াই করা? সেটা ঠিক ভালো লাগছিল না ওদের।
তৃতীয় দল একটুতেই উত্তেজিত। ওদের বয়স কম, ময়নাগুঁড়ির পার্টি অফিসের রমরমা ব্যাপার। ওরা দেখে এসেছে। মেহনতি মানুষের লড়াই বাঁচার লড়াই–কথাগুলো ঠিক স্পষ্ট নয় কিন্তু এটা তো ঠিক, ওদের চাষ-করা জমির ধান শুধু বীজধান, সার আর জমির সুবাদে হরিশ রায়ের ঘরে চলে যাচ্ছে। যদিও এখন কংগ্রেস সরকার কিন্তু তাই বলে পার্টির বাবুদের কথা মিথ্যে তো নয়। লাল ঝান্ডার দল আর দিদিমনির দল এর আগে এসেছে জোড়খালিতে ভোটের সময় শুকনো রাস্তা ডিঙিয়ে। এবার জলের মধ্যে পার্টির বাবুরা তো কেবল স্বার্থে আসেনি। তৃতীয় দলের শিবু রায়ের মনে একটা কথা খুব ধরেছে, দুনিয়ার না খেতে পাওয়া মানুষ এক হোক। এটা ঠিক, সারা বছরের খাবার ওই এক ভাগের চলে যায়। টানাটুনির সংসার তাদের। তিনকুলে শিবুর কেউ নেই।
আর। বউটাকে ঘাড়ে গছিয়ে দেওয়ার পর গেল শীতে তার মামা পটল তুলেছে। সব ঠিক, শুধু। একটা ব্যাপারে শিবু বউ-এর কাছে মাথা নীচু করে থাকে। মামার সঙ্গে ময়নাগুঁড়ি গিয়ে সিল্কের শাড়ি দেখে এসেছিল বউ। প্রায়ই বায়না ধরে। এই গাঁয়ের কোনও মেয়েছেলে সিল্ক হাত দিয়ে। দ্যাখেনি, এমন কি অত যে বড়লোক হরিশ রায় তার বাড়ির মেয়েদেরও কেউ পরতে দেখেনি। গেলবার জলপাইগুঁড়িতে পুজোর সময় হরিশ রায়ের সঙ্গে গিয়েছিল শিবু। তখন একটা দোকানে ঢুকে দাম জিজ্ঞাসা করে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার দাখিল। সারা বছরে ওই টাকা তার হাতে উদ্বৃত্ত হয়ে থাকে না। হরিশ রায় শুনে বলেছি, বাবা শিবু, তেলাপোকাও পতঙ্গ আবার সেও আকাশে ওঠে। কিন্তু বাজপাখির সঙ্গে তুলনা করা কি উচিত কাজ? তা সেই হরিশ রায় যে বেগুনটুলির পাশের গলিতে গিয়ে দুঘণ্টা কাটিয়ে এল তাকে একটা মুদির দোকানে বসিয়ে, পা। যে তার টানছিল, সেটা কি উচিত কাজ?
কচি পালংশাকের আঁটি নিয়ে হরিশ আসছে, পথেই দেখা হয়ে গেল। হেসে বলল, ও বাবা, সব দলবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিস কোথায়? এই শিবু বনমালীর মাকে এই শাকগুলো দিয়ে দিস তো, বড় মুখ করে খেতে চেয়েছিল, কবে ফট করে চলে যাবে। নধর পালংগুলো হাতে নিয়ে শিবু দলের হয়ে বক্তব্য পেশ করল। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় নেড়েছিল হরিশ রায়, ঠিক আছে, তাই হবে। একথা তো সোজা আমাকেই বললে পারতিস। বাইরের বাবুরা এসে না শেখালে মাথায় ঢুকছিল না? এত বড় বোকা পাঁঠা তোরা!
কথা শুনে হকচকিয়ে গেল সবাই। একটুও প্রতিবাদ নেই, চোখরাঙানি নেই। এক কথায় দানসাগর। হরিশ রায় বলল, আমার বাপ-পিতামহ তোদের বাপ-পিতামহের সঙ্গে কোনওদিন ঝগড়া করেনি, আমি করি কোন সাহসে? তবে আধাআধি হলে বীজধান, সার দুগগাপুজোর খরচ, এসব বাপু দিতে পারব না।
এই নিয়ে তর্ক উঠল। হরিশ রায় কোনও কথা না শুনে যাচ্ছে দেখে শিবুর মুখফসকে বেরিয়ে গেল, দুনিয়ার খেতে না পাওয়া মানুষ এক হোক।
কথাটা শুনে চমকে ফিরে দাঁড়াল হরিশ রায়। দলের সবাই বেশ অবাক হয়েছে শিবুর মুখে কথাটা শুনে। কেন যে ওই কথাগুলো জিভ থেকে ছিটকে এল এখন বুঝতে পারছেনা শিবু। সে জুড়ে দিল, মানে যারা খেতে পায় না তারা এক দলের।
তুই খেতে পাস না?
পাই। তবে–। শিবুবলি-বলি করেও সিল্কের শাড়ি কিংবা নিত্য অভাবের কথা তুলতে পারল না। সর্বাঙ্গে শিবু রায়কে দেখে নিয়ে হনহন করে ফিরে গেল হরিশ রায়। যাওয়ার আগে বলে গেল, আজ বারের পুজো, সবাই যেন সিন্নি নিয়ে আসে। এক কথায় মেনে নিল লোকটা দলের সবাই এখন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে। বীজধান বা সার–তার দাম কত! সেটা হরিশের কাছ থেকে আদায় করা যাবে? স্বীকার করতে বাধ্য সব মানুষই খারাপ নয়। পার্টির বাবুরা যাদের শত্রু ভাবে, হরিশ রায় সে জাতের নয়।
ভোররাত্রে জোড়খালি গাঁয়ে পুলিশ এল। একজন কনস্টেবল একাই একশ। এর আগে দেশে কত কি ঘটে গেছে, জোড়খালিতে পুলিশ আসেনি। কাল সন্ধে থেকে বৃষ্টি, সেই ফাঁকে হরিশ রায়ের বাড়ির সামনে যে ছটা শালগাছ পুরুষানুক্রমে বেড়ে চলেছিল তার একটা কে কেটে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রহরে পালকি পাঠিয়ে থানায় খবর গিয়েছিল, ভোরে সেই পালকি চেপে। কনস্টেবল গাঁয়ে ঢুকল। হরিশ রায়ের শোকটা খুব বড় ধরনের। গাছের দাম নিশ্চয়ই আছে কিন্তু তা থেকে মূল্যবান হল ওটা তার প্রপিতামহ লাগিয়েছিলেন।
বৃষ্টি একটু ধরলেই পুলিশ সাহেবকে সামনে নিয়ে গাছ খুঁজতে বের হল হরিশ। যেহেতু চারপাশে জলকাদা তাই চোর প্রমাণ লোপ করতে পারেনি। একটা মোটা দাগ খানিকটা দূর ঘুরে শিবু রায়ের বাড়ির সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ভেঙে পড়া গলায়। হরিশ উচ্চারণ করল, শিবু, এই শিবু!
পুলিশ গিয়ে শিবুর ঘুম ভাঙাল। খড়ের চালের ঘর জলে ছপছপ করছে। দরজা খুলে শিবুব্রহ্মাণ্ড দেখল। কোনওরকমে বলতে পারল, আই বাপ, গাছ কে কাটল? এ যে দেখি পুলিশ!
পুলিশ বলল, আই, তুম গাছ কাটা হ্যায়?
হতভম্ব শিবু কোনওরকমে বলতে পারল, আমি? আমি তো বউ-এর সঙ্গে ঘুমুচ্ছিলাম!
তব কোন কাটা হ্যায়?
আমি জানি না। মাইরি বলছি, আমি কাল বেহুলার মতো ঘুমুচ্ছিলাম!
তব ও গাছ ইঁহা কাহে?
ও হরিশদাদা, একি বলে গো?
পুলিশ শুনল না, কোমরে দড়ি বেঁধে শিবুকে থানায় নিয়ে চলল। পেছনে দরজায় দাঁড়িয়ে শিবুর বউ মড়াকান্না কাঁদতে লাগল। গাঁয়ের লোক ভিড় করে এসেছে। অনন্ত এগিয়ে এসে বলল, বোকার মতো কেউ পরের গাছ কেটে নিজের ঘরে রাখে? তাছাড়া অতবড় গাছ একা কেউ টেনে। আনতে পারে? হরিশদা, শিবুকে ছাড়ান। ওর কোনও দোষ নেই।
কথাটা যেন মাথায় ধরল হরিশের। সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সে ছুটল পুলিশের কাছে। পুলিশ তখন পালকিতে চেপেছে। তার হাতে দড়ির শেষপ্রান্তে শিবু হাপুস কাঁদতে-কাঁদতে মাটিতে দাঁড়িয়ে। হরিশ কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে পুলিশকে বলল, ভুল হয়ে গেছে বাপ। শিবু তো একা অত বড় গাছ টানতে পারবে না। ওকে ছেড়ে দিন।
পালকি থেকে গলা বাড়িয়ে পুলিশ বলল, থানামে যাকে বলল। হামরা কেস চাহিয়ে। কোনও কথা না শুনে পালকি ফিরে গেল শিবু রায়কে নিয়ে।
অনন্ত বলল, ঠিক আছে, আমরা সাক্ষী দেব। শিবু কিছু করেনি। হরিশদা, এটা ভালো হল না।
হরিশ বলল, আরে আমার কি দোষ! গাছটা আমার, আর সেটা কাটা হয়েছে এ কথা তোঠিক? আচ্ছা তোমরা আমার সঙ্গে থানায় চলো, আমিই ছাড়িয়ে আনছি।
থানার নাম শুনে দেখা গেল সবাই এক একটা জরুরি কাজের কথা বলছে। অগত্যা সেই জলকাদা ভেঙে হরিশ রায় নিজেই যাওয়া সাব্যস্ত করল।
বড়বাবু বললেন, ব্যাপারটা খুব কাঁচা কাজ হয়ে গেল হরিশবাবু। অতবড় গাছ একজনের পক্ষে কাটা সম্ভব নয়। সাক্ষী পাবেন? তাছাড়া আমার বাড়ির সামনে পাওয়া গেছে বলেই আমি কেটেছি তার কোনও প্রমাণ নেই। না, এ কেস টিকবে না।
হরিশ বলল, কোনও রকমে একটা ব্যবস্থা করুন বড়বাবু। ছেলেটা খারাপ নয়, শুধু ওর যে দাঁতে একটু বিষ জমেছে সেটাই খসিয়ে দিতে চাই। এই বয়সে আর নতুন দাঁত গজাবে না।
বড়বাবু বললেন, তা তো হল, কিন্তু ওই কেস আদালতে গেলে আমারই বদনাম হয়ে যাবে। আমি বরং তিন দিন ওকে হাজতে রেখে দিই। একটুমারধোর করে ছেড়ে দেব। আগে থেকে। আলোচনা করলে ভালো একটা গ্রাউন্ড দিতে পারতাম আপনাকে। আমারটা খেয়াল আছে তো?
গাঁয়ে ফিরে খবরটা জানিয়ে দিল হরিশ রায়। তিনদিন এমন বেশি কিছু না। বাহাত্তর ঘণ্টা মাত্র। তিন কেজি চাল ডাল ডিম পাঠিয়ে দিল সে শিবুর বউকে। কথাটা শুনে সবাই একটু নিশ্চিন্ত, যাক। ছোঁড়াটার জেল হল না। কিন্তু দুদিনের মাথায় খবর এল হরিশকে বড়বাবু ডাকছেন। হন্তদন্ত হয়ে থানায় এলে বড়বাবু সংবাদটা জানালেন, সারা দেশের মানুষ উদ্ধৃঙ্খল হয়ে গেছে। নেতারা জনতাকে উত্তেজিত করছে সরকারের বিরুদ্ধে যেতে। কেউ কোনও কথা শুনছে না। তাই দিল্লির সরকার সারা দেশে জরুরি অবস্থা চালু করেছেন। কেউ এখন কোনও ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারবে না। সবার সব অধিকার বাতিল এখন। বড়বাবুর কাছে নির্দেশ এসেছে, এই তল্লাটে যেসব লোক রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক তাদের একটা তালিকা পাঠাতে। কোনও হ্যাপা নেই, কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। সারা জীবন জেলে পচবে অথচ আদালতে যেতে পারবে না। আইনটার নাম হল। মিসা। এ মশাই ক্যান্সারের চেয়ে মারাত্মক।
মিইয়ে গেল হরিশ রায়। দেশে এতসব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে অথচ জোড়খালিতে কেউ জানেই না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভালোমতন শিক্ষা দেওয়া উচিত, কিন্তু–
বড়বাবু বললেন, জোড়খালির সবাইকে চিরকাল একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া দরকার। এই লোকটির নাম আমি সদরে পাঠাচ্ছি।
আঁতকে উঠল হরিশরায়, না না, শিবু ছেলেটা খারাপ নয়। সারা জীবন জেলে থাকলে–।
থামিয়ে দিলেন বড়বাবু অত দুর্বল হচ্ছেন কেন? অধিকার পেতে হলে পাকাঁপাকি পাওয়াই ভালো। তাছাড়া আমার এখানে বেশি লোকও পাচ্ছি না।
শিবু রায়ের মিসা হবার খবর জোড়খালি গাঁয়ে পৌঁছাল। মিসা হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার যা একবার ছুঁলে আর ছাড়ে না। সারা জীবন জেলে পচতে হয়, মৃত্যুর পর কবর দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শিবুকে ওই আইনে ধরা হল কেন? সে তো কোনও অন্যায় করেনি। কে একজন খবর আনল, গেল পুজোয় শিবু রায় জলপাইগুঁড়িতে গিয়ে এমন কিছু করেছিল, এতদিনে সেটা ধরা পড়ে গেছে। অনন্তরা খুব উত্তেজিত হয়ে ছয় ক্রোশ রাস্তা ভেঙে পার্টি অফিসে গিয়ে দেখল সেখানে বড় তালা ঝুলছে। শুনল, জরুরি অবস্থার ভয়ে বাবুরা সব গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাহলে মিসাকে বাবুরাও ভয় পান! খবর এল যার মিসা হয়েছে তার সংস্পর্শে থাকলে অন্যেরও মিসা হবার সম্ভাবনা। ভালো আলু খারাপ আলুর পাশে থাকলে পচে যায়। দিশেহারা হয়ে গেল জোড়খালি। হরিশ রায় খুব বিপর্যস্ত অবস্থায় কদিন ঘোরাফেরা করল। তার এক কথা, যদি থানায় খবর সে না দিত তাহলে বড়বাবু শিবু রায়ের হদিস পেত না। জলপাইগুঁড়ি শহরে গিয়ে দুঘণ্টা শিবু তার চোখের বাইরে ছিল। তখন সে কী করেছে হরিশ জানে না। কেউ-কেউ সন্দেহ করল কিন্তু মুখ খুলতে পারল না। থানার বড়বাবু তার মধ্যে একদিন পালকি চেপে হরিশরায়ের বাড়ি ঘুরে গেছে। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়াল যে শিবু রায়ের বাড়ির চারপাশে কেউ মাড়ায় না। জোড়খালির মানুষ শান্তিপ্রিয়, শিবুর বউ-এর সঙ্গে মেলামেশা রাখলে যদি কিছু অশান্তি হয়। শিবুকে জলপাইগুঁড়ি সদরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একদিন খবর এল, সেখানেও শিবু নেই। সেই গঙ্গার ওপারে বহরমপুর না কোথায় শিবু আছে এখন। সেখানকার জেল খুব মারাত্মক। আলো হাওয়া ঢুকতে পারে না। এক নম্বর আসামিরা সেখানে থাকে।
হরিশ রায় মিটিং ডাকল। এক গাঁয়ে থেকে এ দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। শিবু নেই, ধান উঠেছে, অথচ তার ভাগটা করা যাচ্ছে না। এদিকে শিবুর বউ-এর খাবার জুটছে না, কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। বেচারা না খেতে পেয়ে মরে যাবে সেটা এ গাঁয়ের লজ্জার কথা। একটা কিছু বিহিত। করা দরকার। কেউ একজন এগিয়ে এসে ভার নিক শিবুর বউ-এর। না, এ-কথায় জোড়খালির কেউ রাজি হল না। নিজে পায় না আবার অন্যকে দান করা! তাছাড়া অমন জোয়ান সমস্থ বউকে ঘরে নিতে কারও সাহস নেই। গাঁয়ের বেশির ভাগ মানুষই বিবাহিত এবং তারা বউদের যথেষ্ট ভয় করে।
হরিশ বলল, তাহলে মেয়েটা না খেয়ে মরবে? ওর তো শুনেছি তিনকুলে কেউ নেই। আর শিবে হতচ্ছাড়াটা তো কোনওদিন জেল থেকে ফিরবে বলে মনে হয় না। এক কাজ করা যাক, শিবুর বদলে যে জমি চাষ করবে সে মেয়েটাকে সংবচ্ছরের খাবার দেবে।
একটু গুঞ্জন উঠল। অনন্ত হরিশের প্রস্তাব সমর্থন করা মাত্রই বনমালী আপত্তি জানাল, এটা ঠিক হবে না। ওই বয়সের মেয়েছেলের কোন কাজকর্ম না থাকলে, মাথার ওপর পুরুষ না থাকলে দুদিনে সারা গাঁয়ে পেত্নিনৃত্য শুরু করে দেবে। কথায় বলে বলা ছাড়া ঘোড়া আর পুরুষ ছাড়া মেয়েমানুষ একই জিনিস।
কথাটা অনেকের মনঃপূত হল। হঠাৎ একজন বলে উঠল, শিবু যদি আর নাই ফেরে তবে ওর বউ-এর আবার বিয়ে করতে কোনও দোষ নেই। সেরকম করলেই মঙ্গল।
হরিশ রায় বলল, কিন্তু যদি ফিরে আসে, তাহলে পরিস্থিতিটা চিন্তা কর।
বনমালী একটা উপায় বাতলাল, সবচেয়ে ভালো হয় যদি শিবুর বউ তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকে। তুমি বয়স্ক মানুষ–খারাপ দেখাবে না। তাছাড়া বউদি তো সাত বছর দেহ রেখেছেন, ছেলের বউদের সেবা আর কত নেবে? তাদের রান্নার কাজেও সাহায্য হবে। সবাই সমস্বরে এই প্রস্তাব সমর্থন করল। হরিশ রায় ইচ্ছে করলে দশটা মানুষ খাওয়াতে পারে, মিসায় ভয় পাওয়ার লোক নয় কারণ বড়বাবুর জানাশোনা। সবচেয়ে বড় কথা ঘরে বউ নেই যে চোখ রাঙাবে। নিরুপায় হরিশ প্রস্তাব মেনে নিল, ঠিক আছে, তোমরা যখন বলছ–।
২.
পৃথিবীটা এতদিন এত ছোট ছিল যে শিবু মনে করত সে যা জানে সেটাই শেষ কথা। যেমন, যত কষ্টই হোক জোড়খালি গ্রামে বেশ শান্তিতে থাকা যায়। ময়নাগুঁড়িটা মোটামুটি দেখার মতো জায়গা, কারণ সেখানে একটা সিনেমা হল আছে, স্কুল কলেজ আছে আর বড় বাজার বসে, কিন্তু জলপাইগুঁড়ি হল সত্যিকারের শহর। সেখানে তিন-তিনটে সিনেমা হল, মেয়েরা প্রজাপতির মতো সেন্ট মেখে ঘুরে বেড়ায়, গাড়িঘোড়া হরদম ছুটছে, এমন কি বেগুনটুলির পাশের গলিতে পয়সা দিয়ে মেয়েমানুষ কেনা যায়। এসব ঠিকঠাক জানা ছিল। কিন্তু এখন বুঝল তার জানাটার পর অনেক অজানা জিনিস পড়ে আছে। এটা আবিষ্কারের পরই মন দুর্বল হল। ডাঙায় তোলা মাছের মতো লাগছে নিজেকে। প্রথম কথা, সে জীবনে কোনও অন্যায় করেনি তবু থানায় যেতে হয়েছিল। বিনা কারণে যথেষ্ট ধোলাই খাওয়ার পর যখন আশা হচ্ছিল ছেড়ে দেবে তখনই শুনল তার মিসা হয়ে গেছে। একজন পুলিশ বলল যে, রাষ্ট্রদ্রোহী হলে, ভেজালদার হলে মিসা হয়। যার মিসা হয় তার জীবনটাই বরবাদ। প্রথমটার মানে বোঝা গেল না। কারণ রাষ্ট্র জিনিসটাই শিবুর মাথায় ঢুকছিল না। সে আজ অবধি চাষবাস করেছে, বিয়ের পর বউকে ভোগ করেছে এবং একবারই হরিশ রায়ের সঙ্গে জলপাইগুঁড়ি ঘুরে এসেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী হওয়া কি যায়? তাছাড়া সে ভেজাল দেবেই বা কী করে? তার তো কোনও দোকান নেই? তাহলে? প্রথম-প্রথম পাগলের মতো চেঁচিয়েছে শিবু, হাপুসনয়নে কেঁদেছে, কিন্তু একসময় বুঝেছে এতে কোনও লাভ নেই। বরং চুপচাপ সব দেখা যাক। একজন পুলিশ বলেছিল, মিসার বন্দি জেলখানায় জামাই এর মতো থাকে। কাজকর্ম তেমন করতে হয় না চোর-ছ্যাঁচোরদের মতো। ময়নাগুঁড়ি থেকে জলপাইগুঁড়ি জেলে যখন তাকে আনা হল তখন চারধারে কেমন গা-ছমছমে ভাব। দু-দুটো পুলিশ বন্দুক হাতে তার সঙ্গে। রাস্তার তোক অবাক চোখে তাকে দেখেছে। একজন তোক বলেছিল, ব্যাটা নিশ্চয়ই খুনি। পুলিশটা শুধরে দিয়েছিল, নাহে, মিসা হয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার মুখের চেহারা, চোখের চাহনি পালটে গিয়েছিল। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে খুব ধন্দে পড়ে গেছে। শিবু। চাহনিটার মধ্যে ঘেন্না নেই কেন?
জলপাইগুঁড়ি জেলের খাবার খেয়ে কান্না পেয়ে যেত শিবুর। অন্যান্য বন্দির আত্মীয়রা কত কি। খাবার নিয়ে আসে কিন্তু তাকে দেখতে কেউ আসে না। গাঁয়ের একটা লোকও আসতে পারল না? অন্তত-অনন্ত তো সাহসী ছিল। একদম শেষ দিনে হরিশ রায় এল। এত অবাক হয়ে গিয়েছিল শিবু যে মুখ থেকে বাক্য বের হয়নি। গরাদের ফাঁক দিয়ে হরিশ রায় খুব কষ্টের গলায় বলেছিল, এ কি হল শিবু!
কথা বলতে পারেনি সে। ময়নাগুঁড়ি থানায় যাওয়ার পর মনে হয়েছিল হরিশরায় ছল করে তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। নিজের গাছ নিজে কেটে তার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে ধরিয়ে দিয়েছে। কেন ধরিয়ে দিল? পার্টির বাবু চলে যাওয়ার পর সে হরিশ রায়ের মুখের ওপর কথাগুলো বলেছিল বলে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় কিন্তু এছাড়া অন্য কোনও কারণ মনেও পড়ছে না। ভেতরে-ভেতরে তাই হরিশ রায়ের বিরুদ্ধে একটা আক্রোশ জমেছিল তার। কিন্তু জলপাইগুঁড়ি জেলে সেই লোকটাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল শিবু। কেউ যখন এল না তখন হরিশ রায় এল কেন? তাকে ধরিয়ে যদি মজা করতে চায় তো খামেকা আসতে কে ওকে মাথার দিব্যি দিয়েছে?
শিবু, আমার ওপর তোর খুব রাগ, না? কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এসব চাইনি। হরিশ রায় বলল।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। শিবু কোনওরকমে বলতে পারল।
আমি উকিলবাবুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম কিন্তু কেউ আশা দিল না। তোর কোনও ইচ্ছেটিচ্ছে থাকলে বল আমাকে, যত টাকা লাগুক আমি করতে চেষ্টা করব। হরিশ রায় বলল।
কী বলি বল, সব আমার কপাল। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কোনও অন্যায় করিনি। শিবু কেঁদে ফেলল।
আমি জানি, আমার চেয়ে বেশি আর কে জানবে। হরিশ রায়ের কথা জড়িয়ে গেল।
খানিক বাদে হরিশ রায়ের দিকে চেয়ে শিবু বলল, তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে।
কাকে? ওঃ, তোর বউকে? কিন্তু শুনলাম তোকে কালই বহরমপুর জেলে নিয়ে যাবে! সেখানে কী করে নিয়ে যাব? হরিশ রায়ের কথাটা শুনে হাঁ হয়ে গেল শিবু। বহরমপুর? সেটা আবার কোথায়? কেউ তো তাকে খবরটা দেয়নি? হরিশ রায় ভাগ্যিস তাকে জানাল।
সে মাথা নেড়ে বলল, তাহলে থাক, কিন্তু আমি থাকব না, তাকে যদি একটু দেখাশোনা করা যায়!
হরিশ রায় তাড়াতাড়ি বলে উঠল, সে চিন্তা তুই করিস না, আমি আছি রে, আমি আছি।
তা তার পরদিনই ট্রেনে চেপে চলে এল বহরমপুর। প্রথম ট্রেনে চাপা, উত্তেজনাটা মনে আনন্দ জাগালো না। শুধু বোবা চোখে চারধার চেয়ে-চেয়ে দ্যাখা। হঠাৎ শিবুর মনে হল চারধারে নানান শ্রেণির মানুষ, সবাই ব্যস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। এদের মধ্যে কারা-কারানা খেতে পাওয়া মানুষ? কারা এক হয়ে কাজ করবে? কী কাজ? কিন্তু কাউকেই যেন -খেতে পাওয়া মানুষ বলে মনে হয় না! বাবুরা কি ভিখিরিদের কথা বলেছে?
বহরমপুরে এসে শিবু হকচকিয়ে গেল। এখানকার জেলে যেমন চোর-গুন্ডা-পকেটমার দিনরাত খিস্তি করে যাচ্ছে তেমনি অনেক ভদ্রলোক বাস করেন। তাঁদের কেউ-কেউ কলকাতা থেকে এসেছেন। রাজনীতির জন্যে এঁদের নাকি মিসা হয়েছে–সবাই রাষ্ট্রদোহী। শিবু রায়কে সেই দলে ফেলা হয়েছে তাই বাবুদের ছায়ায় আসতে হল তাকে। সব গুলিয়ে যাচ্ছে শিবুর। তাহলে ভদ্রলোকদের মিসা হয়? মিসা হলেও অমন হেসে-হেসে কথা বলা যায়? কী কথা বলে ওরা? শিবু একটা বড় দলের কাছাকাছি গিয়ে বসা শুরু করল।
কলকাতার বাবু বললেন, ইমার্জেন্সি চালু করে একটা দেশকে চুপ করিয়ে কতদিন রাখা যায়? একটা সময় আসবেই যখন মানুষ মুখ খুলবে, তখন?
দ্বিতীয়জন বলল, ওদের আর্মস আছে। মিলিটারি আছে।
কলকাতার বাবু বললেন, থাকুক। কিন্তু পেছনে মানুষ নেই। ওদের এই অত্যাচার দেখে রেভলিউশন আনতে হেল্প করবে। তুমি দেখে নিও সুপ্রিয়, নকশালরা যা পারেনি এই ইমার্জেন্সি তাই পারবে।
কিন্তু এদেশে মার্কস কতটা সত্যি? মার্কসের ব্যাখা ভারতীয় সমাজে প্রয়োগ সম্ভব? –তৃতীয়জন বলল।
কলকাতার বাবু বললেন, এই অর্থনৈতিক কাঠামোতে কিছু অসুবিধে আছে। যখন জনতা তৈরি হয়নি তখন যদি আমরা আঘাত হানতে চাই তবে সেটা হবে অ্যাডভেঞ্চার করা আর যখন জনতা তৈরি তখন যদি চুপ করে বসে থাকি তবে সেটা প্রকৃত সুবিধেবাদী।
সুপ্রিয় বলল, কথাটা মাওসে-তুং-এর, না?
কলকাতার বাবু বললেন, হ্যাঁ। এই রকম ইমার্জেন্সি যত আসবে মানুষ তত তৈরি হবে।
তৃতীয়জন বলল, চিনে যেভাবে মাওসে-তুং মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন অথবা রাশিয়াতে লেনিন যেভাবে হাল ধরেছিলেন এখানে সে রকম নেতৃত্ব কোথায়?
কলকাতার বাবু বললেন, নেতৃত্ব কখনও আকাশ থেকে পড়ে না, প্রয়োজনই নেতা সৃষ্টি করে। যেমন চে গুয়েভারা। যিনি বলতে পারেন, যুদ্ধে জিতি কি হারি সে প্রশ্ন নয় কিন্তু আমরা যে লড়াই করেছি এটাই সত্য। চারুবাবুর একটা কথা আমার খুব ভালো লাগে, যে নিজে স্বপ্ন দেখে না বা অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে পারে না, সে কখনই বিপ্লবী হতে পারে না।
মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল শিবুর। এরা কী ভাষায় কথা বলে? মাও সে-তুং, লেনিন, মার্কস কোন দেশের মানুষ? সেই সেবার যখন ছেলেদের সঙ্গে পুলিশের খুব লড়াই হয়েছিল ময়নাগুঁড়িতে তখন প্রথম লোকটার নাম দু-একবার শুনেছিল বটে। কিন্তু বাবুরা দেশের মানুষের কথা বলছে। দেশের মানুষের কথা যারা চিন্তা করে তারা কি মিসায় জেলে আসে?
পরদিনই ধরা পড়ে গেল শিবু। একজন বাবু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, এই, তুমি এখানে বসে কী শুনছ? ।
কিছু না বাবু। অস্বীকার করার চেষ্টা করল শিবু।
তুমি কি চোর না পকেটমার?
না বাবু, তার চেয়ে খারাপ।
খারাপ! খুন করেছ নাকি?
না, মিসা হয়েছে।
মিসা? কেন হল?
জানি না বাবু। আমি দোষ করিনি। একজন বলল, রাষ্ট্রদ্রোহী!
অ্যাঁ? হো-হো করে হেসে উঠল বাবু, সেটা খুনের চেয়ে খারাপ? কী বুদ্ধি তোমার! ও সুপ্রিয়, এই আর একজন মিসা বন্দিকে দ্যাখ। তাকে ধরে বাবুদের কাছে নিয়ে আসা হল।
সুপ্রিয় জিজ্ঞাসা করল, কেন ধরেছে তোমাকে।
জানি না বাবু। আমি কোনওদিন কোনও পাপ করিনি বিশ্বাস করুন। শিবু হাতজোড় করল।
দূর ছাই, পাপের কথা কে বলেছে? রাজনীতি, মানে কোনও পার্টি করতে?
আমি পাটি-মাটি করি না বাবু, আমাদের জোড়খালির কেউ করে না।
কলকাতার বাবু এবার কথা বললেন, দ্যাখো কাণ্ড! ওহে, তুমি পার্টি করতে না, খাদ্যে ভেজাল দিতে না, তবু তোমার মিসা হয়ে গেল?
হ্যাঁ বাবু।
রাষ্ট্রদ্রোহী নাকি একটা কথা বলছিলে? রাষ্ট্র বলতে কী বোঝ?
ফ্যালফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে শিবু ঘাড় নাড়ল, না, সে বোঝে না কিছু।
কলকাতার বাবু বললেন, মজা দেখুন। একটা নিরপরাধ লোককে মিসায় পুরে দিয়েছে। তোমার গাঁয়ের নাম কী বললে ভাই?
জোড়খালি, ডাকঘর ময়নাগুঁড়ি।
আর একজন বাবু এতক্ষণ কথা শুনছিলেন, জায়গার নামটা কানে যেতেই বলে উঠলেন, ময়নাগুঁড়ি? আরে তুমি আমার জেলার লোক। কী করে দিন চলত?
চাষ করতাম বাবু।
সুপ্রিয় বলল, দাদা, একদম সন অব সয়েল। এর কাছ থেকে একদম খাঁটি খবর পাওয়া যাবে। দেশের কৃষকদের রিঅ্যাকশন কী জেনে নিন।
কলকাতার বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, নিজের জমি চাষ করো?
ঘাড় নাড়ল শিবু, না, হরিশদার জমি।
জলপাইগুঁড়ির বাবু বললেন, খুব খারাপ অবস্থা আমাদের জেলার চাষিদের। জোতদারগুলো রক্ত চুষছে বাদুড়ের মতো। এক একটা গ্রাম আছে যেখান রাজনীতি প্রবেশ করতে পারেনি। খুব। রক্ষণশীল ওরা। শোষিত হবে কিন্তু মাথা তুলবে না।
কলকাতার বাবু বললেন, ওকে রাজনীতি-সচেতন করা দরকার। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সেখানে কৃষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ওকে জানাতে হবে। বিশ্বের সর্বহারা এক। পতাকার তলায় সামিল হচ্ছে এ খবর না জানলে ও পা ফেলবে কী করে? সুপ্রিয়, তুমি ওর দায়িত্ব নাও। একদম নরম কাদা পাচ্ছ, ইচ্ছেমতন তৈরি করতে পারবে। গ্রামে ফিরে গিয়ে ও যেন আরও দশটা গ্রামকে তৈরি করতে পারে এটা লক্ষ রেখো। জেলখানায় যদি বেশি দিন থাকে তা হলে চোর-বদমাস হয়ে বেরুবে, সেটা হতে দেওয়া ঠিক নয়।
শিবু রায় স্বীকার করে, তার জানাটা খুব কম ছিল। পৃথিবীতে এত সব ব্যাপার হচ্ছে, আরে ব্বাস! সেই পার্টির বাবুরা যে বলেছিল পৃথিবীতে দুটো দল আছে, একদল খেতে পায় অন্য দল পায় না, সে কথাটা খুব ঠিক। সুপ্রিয়দা ওকে একটা নতুন জগতে হাত ধরে নিয়ে এসেছেন। যারা এতদিন শোষিত ছিল তারা আজ মাথা তুলছে। শোষিত কে? না যারা রক্ত দিয়ে পরিশ্রম করে। শোষক কে? না যারা সেই পরিশ্রমের ফসল পায়ে পা দিয়ে ঘরে তোলে। তার মানে হরিশ রায় শোষক,
আবার বড়-বড় ব্যবসাদার শোষক। এই সরকার যে তাকে মিসা করেছে সেও শোষক। কারণ সে ব্যবসাদারের বন্ধু। গাঁয়ের হরি মুদি বেশি দাম নেয়, অতএব সে একজন শোষক। প্রতিটি মানুষ প্রয়োজনে ধর্মঘট করতে পারে, এটা তার অধিকার। শহরের মেয়েছেলেরা যেমন সিল্কের শাড়ি পরে, তার বউ-এর তেমনি সেই শাড়ি পরার অধিকার আছে। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়? সেই জন্যে গরিব বড়লোকের অবস্থা সমান করতে মার্কস বলে একজন সাহেব কতগুলো পথ বলে দিয়েছেন। সেই পথে চলতে হবে।
কলকাতার বাবু একদিন তার সামনে সুপ্রিয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ছাত্রটি কেমন হে?
সুপ্রিয় বলল, খুব ভালো প্রগ্রেস করেছে। এতটা ভাবিনি। ওকে বক্তৃতা দেওয়া শেখাচ্ছি। যখন ফিরে যাবে তখন দেখবেন কী কাজের হবে। শুনবেন নাকি ওর বক্তৃতা?
বক্তৃতা? না না, ঠিক আছে। তবে দেখো, একবারে ক্লাস থ্রিতে ভরতি করো না। অ আ ক খ শিখিয়ে দিও। কলকাতার বাবু বললেন।
সুপ্রিয় বলল, মুশকিল তো ওইখানে। শুরুটাই যে আমার গুলিয়ে যায়।
কলকাতার বাবু বললেন, তা অবশ্য ঠিক। ডক্টরেট করলে কেজি ক্লাস ম্যানেজ করা কঠিন।
৩.
জলপাইগুঁড়ি জেলে আজ সেই রাত। কাল সকালে ছাড়া পাবে ওরা–শিবু রায় এবং সেই জলপাইগুঁড়ির বাবু যিনি বহরমপুর জেলে ছিলেন। বহরমপুর জেলটা ছিল বড় ভালো। জোড়খালির শিবু রায় অত বড়-বড় বাবুদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছে, কত খবর জেনেছে। কিন্তু হঠাৎ নাকি ইমার্জেন্সিটা উঠে গেল। কলকাতার বাবু আফসোস করে বলেছিলেন, খুব বুদ্ধিমতী মহিলা, যদি আরও কিছুদিন ইমার্জেন্সি থাকত তাহলে দেশে যে বিপ্লব আসত তাতে সন্দেহ নেই। সেটাই পিছিয়ে দিলেন উনি। যাক, ইলেকশন কল করছে যখন তখন বুঝবে ঠ্যালা। এবার। দেশের মানুষ ওঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে সাগরে। ভোটের বাক্সে হবে বিপ্লব। শিবু, তুমি ভাই নর্থবেঙ্গলের দশটা গ্রামের দায়িত্ব নাও। প্রত্যেক চাষীকে বোঝাও, ভোটের বাক্সই হল বিপ্লবের হাতিয়ার।
জলপাইগুঁড়ির বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কালই গ্রামে ফিরে যাবে হে?
শিবু রায় বলল, যদি কোনও কাজ থাকে তো যাব না। কাজ আগে তারপর অন্য কিছু।
জলপাইগুঁড়ির বাবু বললেন, গুড। কাল রাত্রে পার্টি অফিসে এসো। আলাপ পরিচয় হবে।
সকালবেলা তাজ্জব হয়ে গেল শিবু রায়। জেল থেকে বেরিয়ে এত লোক দেখে সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। জলপাইগুঁড়ির বাবু হাসলেন, আমাকে রিসিভ করতে এসেছে হে। তুমিও সঙ্গে চল। মিসার ক্যান্ডিডেট যখন তখন তুমি সম্মান পাবেই।
শতিনেক লোক বাবুর নামে জিন্দাবাদ দিয়ে গলায় মালা পরিয়ে দিল। বাবুর কথায় শিবুর গলায় মালা দিতে ওর মনে হল সে গলে-গলে পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে অন্যরকম লাগছে এখন। একমাত্র বউ ছাড়া আর কেউ মালা দেয়নি গলায়। সে মেজাজি পা ফেলে বাবুর সঙ্গে একটা খোলা জিপে উঠল। তারপর যেটা হল সেটা শিবু কখনও স্বপ্নেও দ্যাখেনি। অতগুলো লোক শোভাযাত্রা করে সারা শহর ঘোরাল তাদের। আইব্বাস, কি লোক কি জিন্দাবাদ আর কি হাতনাড়া! বাবুর দেখাদেখি সেও হাত নাড়ল আর হাসিমুখ করে দাঁড়িয়ে থাকল। জিপটা চলছে আস্তে-আস্তে। হঠাৎ নজর পড়ল হরিশ রায় রাস্তার পাশ ধরে হাঁটছে। চোখাচোখি হতে হরিশ তাকে নমস্কার। করতে শিবু সঙ্গে-সঙ্গে হাতজোড় করল। এবং এই প্রথম তার মনে হল, ভাগ্যিস মিসা হয়েছিল নইলে এতদিন সেই জোড়খালিতে গড়াতে হত। এই যে এত লোক হাত নাড়ছে, মালা পরাচ্ছে, জিপ চড়াচ্ছে–এসব হত? হরিশ রায় জন্মে তাকে নমস্কার করেছে? মন খুব প্রফুল্ল হয়ে গেল। শিবু রায়ের। নিজের খুব বড় মনে হচ্ছে।
পার্টি অফিসের সামনে মিছিল শেষ হতেই হরিশ রায় এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। সবাই শিবুকে দেখছে। হরিশ গদগদ গলায় বলল, ও শিবু, দ্যাখ আনন্দে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। জোড়খালি গাঁয়ের আর কেউ একরকম সম্মান পায়নি। তুই গাঁয়ের মুখ রাখলি।
শিবু গম্ভীর গলায় বলল, ছাড়ুন। এখন আমার অনেক কাজ। তাছাড়া আপনি একজন শোষক।
হরিশ মিইয়ে গেল, মানে? আমি খারাপ মানুষ?
শিবু বলল, খারাপ ভালো বলিনি, কিন্তু আপনি শোষক। গ্রামের লোকের রক্ত খান। ঠিক আছে, এসব কথা পরে হবে। প্রত্যেককেই সুযোগ দিতে হবে পরিবর্তনের।
হরিশ ফ্যাসফেসে গলায় বলল, তা এখন গাঁয়ে যাবি তো! আমি সবাইকে বলেছি।
মাথা নাড়ল শিবু, না না, আমার এখন অনেক কাজ। সারা দেশের মানুষ আজ শোষিতদের সঙ্গে সামিল। এখন গল্প করার দিন নয়। গ্রামে তো যেতেই হবে। দশটা গ্রামের ভার আমার ওপর। শিক্ষিত করতে হবে তাদের ভোটের আগে। আজ হবে না, কাল যাব দশটা নাগাদ।
হরিশ রায়ের মুখের ওপর দিয়ে শিবু পার্টির অফিসে ঢুকে গেল বাবুর খোঁজে। একজন হরিশকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার কে হন উনি?
হরিশ বলল, কে হয় বুঝতে পারলেন না? ভাই, ভাই হে, ভাই ভাই!
ঠিক দশটাদশ মিনিটে ময়নাগুঁড়ির তেমাথায় শিবু রায় বাস থেকে নামল। আসার সময় একটা দারুণ কাণ্ড ঘটেছে। জলপাইগুঁড়ি শহরে বাসে চাপতেই একটা লোক তাকে নমস্কার করল। ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে প্রতিনমস্কার করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে না থাকতেই লোকটা বলল, কাল আপনারে দেখছি। ওই যে, মিছিল কইর্যাম যাইতেছিলেন!
শিবু গতরাত্রে পার্টি অফিসের কর্মীদের ব্যবহারে মনে করেছিল ওই মিছিল করে আসাটা নিয়ে তেমন গর্ব করার নেই। কারণ ওটা রোজ-রোজ ঘটবে না। বিয়ের কনে বিয়ের দিনেই মাথায় থাকে, দুদিন বাদেই হাঁড়ি ঠেলতে হয়। কিন্তু এই লোকটার ব্যবহারে যেন বাহারি গন্ধ লাগল মনে। কন্ডাক্টর টিকিট চাইতে এলে সেই লোকটি হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে তার কানে ফিসফিস করতেই সে প্রতিমা দেখার মতো শিবুকে দেখতে লাগল। সকালের বাসে ভিড় কম। বাসের অনেকেই তাকে লক্ষ্য করছে। শিবুর মনে পড়ল সুপ্রিয়দা বলেছিল, পাঁচজন অজ্ঞ মানুষ একসঙ্গে থাকলেই তাদের রাজনীতি-সচেতন করবে। তা এই সুযোগে বাসের লোকদের কিছু নিবেদন। করলে কেমন হয়! কিন্তু কোত্থেকে শুরু করবে এটা সে বেছে উঠতে পারল না। মুশকিল হল, পেটের ভেতর সদ্যজমা কথাগুলো সব একসঙ্গে বের হয়ে আসতে চায়। সুপ্রিয়দার মতন ঠিকঠাক সাজাতে পারে না শিবু।
এইসব ভাবতে-ভাবতে ময়নাগুঁড়ি চলে এল। অবাক কাণ্ড, টিকিট লাগল না। শিবু শুনেছে বাসে নাকি পুলিশের টিকিট লাগে না। তাহলে মিসা যাদের হয় তাদের সম্মানটা দ্যাখো! জোড়খালি। গ্রামের কোনও মানুষ স্বপ্নে ভাবতে পারবে না। গম্ভীর মুখে বাস থেকে নামতেই একটা হই-হই শুনতে পেল শিবু। এই এতগুলো মাসে ময়নাগুঁড়ির চেহারাটা একই রকম আছে। চারপাশে তাকাতেই হরিশ রায়কে দেখতে পেল সে। সঙ্গে অনন্ত, বনমালী, গ্রামের আরও জনদশেক আর সেই পার্টির বাবুরা যারা গাঁয়ে গিয়েছিল।
বিস্তর ভিড়ের মধ্যে হরিশ রায় একছাড়া নয়নতারা ফুলের মালা শিবুর গলায় পরিয়ে দিতে পার্টির এক বাবু চিৎকার করে উঠল, শিবু রায় জিন্দাবাদ, বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা নিপাত যাক।
যদিও কণ্ঠটা একাকী তবু শিবুর শরীর টলতে লাগল। গতকাল জলপাইগুঁড়ির নেতার নামেই জয়ধ্বনি হয়েছিল, তাকে কেউ মুখে আনেনি। আজ সেই কাজটা হল। সুপ্রিয়ার কথা মনে পড়তেই শিবু বেঞ্চির ওপর লাফিয়ে উঠল। তার সামনে এখন ছোট জনতা। আশেপাশের দোকানের লোক সাগ্রহে দেখছে। জীবনে প্রথমবার সুপ্রিয়দার অনুপস্থিতিতে বক্তৃতা দেবার জন্য হাত তুলে সে সবাইকে থামাল, বন্ধু, আজ আনন্দের দিন নয়, এখন সংগ্রাম করতে হবে। দুনিয়ার মেহনতী মানুষ আজ লড়ছে। বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। হঠাৎ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে শিবুর। কথাগুলো সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে যেন। একসঙ্গে পেট থেকে বেরিয়ে আসার সময় ঠোকাঠুকি লেগে পেটের ভেতরই দলা পাকাচ্ছে। শিবু একটু থেমে বলল, আজ এই পর্যন্ত, আমার অনেক কাজ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। হাততালির মধ্যে হরিশরায় এসে শিবুর হাত ধরল, বাবা শিবু এবার চলো।
শিবু বলল, কোথায়?
হরিশ আঁতকে উঠল। কোথায় মানে? তোমার গাঁয়ে! এই দ্যাখো অনন্ত এসেছে, বনমালী এসেছে। গাঁয়ের সবাইকে আমি কালকের কথা বলেছি। আহা কি দৃশ্য!
বনমালী এগিয়ে এসে বলল, শিবে, চিনতে পারছিস? হেঁ-হেঁ, তুই গেলি শোঁপোকা হয়ে আর ফিরে এলি একদম প্রজাপতির মতো ডানা মেলে।
শিবু বলল, কিন্তু এখন আমার অনেক কাজ। রংমালি বটেশ্বর ধোয়ালি–এইসব গ্রাম ঘুরতে হবে। আমাকে। পার্টি থেকে দায়িত্ব দিয়েছে।
অনন্ত বলল, তা হোক, জোড়খালি গ্রামও তো তোর। সেখানেই যাওয়া উচিত আগে।
পালকি এনেছিল হরিশ রায়। এখন যদিও জলকাদা নেই তবু গাঁয়ের সম্মান বলে কথা, কিন্তু শিবু পালকিতে চড়ল না, সেকি কথা, আপনারা হেঁটে যাবেন আর আমি যাব মানুষের কাঁধে চেপে? দুনিয়ার মেহনতী মানুষ এখন এক। তা হয় না।
শিবু আর হরিশের পেছন-পেছন গাঁয়ের মানুষ ফিরে চলল। অন্যমনস্ক হয়ে শিবু হাঁটছিল। অতগুলো মানুষ তার বক্তৃতা শুনল? কদিন আগে অবধি সে পাঁচজনের সামনে গলা খুলে কথা বলতে পারত না, আর আজ কেমন পালটে গেছে সে! নিজেকে একদম আলাদা মনে হচ্ছে। এবার ভোট আসছে। এই ভোটটা অন্য বছরের ভোটের থেকে একদম অন্য ধরনের। এই ভোট বাঁচা কিংবা মরার। ভোটের বাক্সে বিপ্লব করলে দেশের মানুষের আর কোনও অভাব থাকবে না।
হরিশ রায়ের গলা শুনে চমক ভাঙল শিবুর, কিছু বলছিলেন?
হরিশ হাসল, কী ভাবছিলে বাপ? হ্যাঁ বলছিলাম কি, অতশত কথা শিখলে কী করে? তুমি যে একদম বাবুদের মতো শিক্ষিত হয়ে গেছ।
শিবু বলল, আপনারা তো চান চিরকাল গরিব পড়ে-পড়ে মার খাক!
হরিশ বলল, ছি-ছি! তা চাইলে কি আর তোমার কাছে আসতাম? হরিশ পেছনদিকে তাকিয়ে দেখে নিল, বাকি দল বেশ দূরত্বে রয়েছে। সে গলা নামিয়ে বলল, আমাকে ওইসব কথাবার্তা একটু শিখিয়ে দেবে শিবু?
কীসব কথা? শিবু ধরতে পারল না।
ওই যে গরম গরম কথা! শুনলেই রক্ত কেমন করে। তুমিও তো জানতে না, শিখেছ, তাই আমাকে শিখিয়ে দিলে ক্ষতি নেই। হরিশ যুক্তি দেখাল।
মনে-মনে খুশি হল শিবু। সুপ্রিয়দা বলেছিলেন মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে। অবশ্য হরিশ রায় একজন শোষক, কিন্তু সে যদি বদলে যায় তাহলে তো অর্ধেক কাজ শেষ। তা ছাড়া সুপ্রিয়দা এও বলেছেন, বড় শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে ছোট শত্রুর সঙ্গে সাময়িক বন্ধুত্ব করতে হবে। সে শান্ত মুখে বলল, বেশ তো, কী জানতে চান বলুন?
হরিশ বলল, ওই যে একটা কথা শুনি, কালকেও শহরে শুনলাম, আজও পার্টির বাবু চিৎকার করে বলল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ! এই কথাটার মানে কি?
শিবু রায় চোখ বন্ধ করল। কথাটা তো বহুবার শোনা। বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করলে বুকে বল আসে। কিন্তু কথাটার অর্থ তো সুপ্রিয়দা বলেননি। শিবু বুঝতে পারছিল দুধ কেটে ছানা হয়ে। যাচ্ছে কিন্তু সেটা হতে দেওয়া ঠিক নয়। সে গম্ভীর গলায় বলল, জিন্দা মানে জানোনা? হিন্দি কথা, জিন্দা মানে বেঁচে থাকা।
অ। আর ইনকিলাব? হরিশ রায় আগ্রহ দেখাল।
এইবার হোঁচট খেল শিবু কিলাব বোঝ না? শহরের বাবুরা কিলাব করে, মানে একসঙ্গে সবাই বসে খেলে। কথাটার মানে দাঁড়াল, একসঙ্গে সবাই এসো তাহলে বেঁচে থাকবে। ইনকিলাব। জিন্দাবাদ। সুন্দর লাগল নিজেরই কানে এই ব্যাখাটা।
জোড়খালি গ্রামের মানুষ তাজ্জব হয়ে গেছে। শিবু রায়ের মিসা হওয়ার পর সবাই নানারকম জল্পনা করেছিল। লোকটা জেল থেকে আর ছাড়া পাবে না, মিসা যার হয় তার ছায়া মাড়ানো মানে নিজের মাথা নিজে কাটা। এসব তো বেশ চলছিল। হঠাৎ শোনা গেল আবার ভোট হবে আর মিসা যাদের হয়েছিল তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। কাল হরিশ রায়রা জলপাইগুঁড়ি গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এসেছে সেই শিবু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোটরে চেপে শহরের বাবুদের সঙ্গে মালা পরে ঘুরছে। তার মানে মিসা হলে লোকের সম্মান বেড়ে যায়? আজ যে ফকির কাল সে। রাজা? একি অদ্ভুত নিয়ম! শিবুর নাকি হাবভাবও পালটে গেছে। আজ সে গাঁয়ে ফিরছে। দলে দলে লোক এসে গ্রামের প্রান্তে ভিড় করল।
শিবু রায় গ্রামে ঢুকে সকলকে নমস্কার জানাল। এইসব চিরপরিচিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল, বেচারারা এখনও কি অন্ধকারে আছে! এদের শিক্ষিত করতে হবে। সবাইকে এক করতে হবে। তার চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে সে গলা তুলে বলল, বন্ধুগণ, আবার আমি ফিরে এলাম। সরকার আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। কারণ পৃথিবীর মেহনতী মানুষ এখন জেগেছে। এখন আপনাদের আর অলসভাবে থাকলে চলবে না। নিজেদের অধিকার আদায় করুন। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
সবাই হই-হই করে উঠল। সেই শিবু আর নেই, কী সুন্দর বলছে শিবু! হরিশ হাত ধরল, বাবা, এবার একটু বিশ্রাম করো।
শিবু মাথা নাড়ল, এখন বিশ্রামের সময় নয়, হাতে অনেক কাজ।
হরিশ বলল, কাজ তো আছেই। তবু একটু জল খেলে গাঁয়ের লোক খুশি হত।
শিবু বলল, ওই তো আপনারা ভুল করেন। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, আমাকে এখন দশটা গাঁয়ে যেতে হবে। সব মানুষকে এক করতে হবে।
অনন্ত বলল, তবু একটু বসে যা। হরিশ বলল, এদিকে এসো বাপ, আমার বাড়িতে চলো।
শিবু বলল, আপনার বাড়ি কেন? আমার বাড়ি কী দোষ করল?
অনন্ত বলল, সে বাড়িতে এখন ঢুকতে পারবি না। গেল ঝড়ে খড় উড়ে গেছে, সারাতে হবে। তোর বউ ওখানে থাকে না।
সে কোথায়?
হরিশ বলল, আমার বাড়িতে বাপ। সেই যে জেলে তোমায় বলে এসেছিলাম।
অনন্ত জানাল, হরিশদা না থাকলে বেচারা খুব বিপদে পড়ত।
একটু ভেবে নিয়ে শিবু বলল, বেশ চলুন, তার সঙ্গে দেখা করে আসি।
হরিশ রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে সবাইকে সরিয়ে দিল। তার বাইরের ঘরে শিবুকে বসিয়ে বলল, এবার হাত-মুখ ধুয়ে নিলে হয়।
শিবু বলল, না-না, আগে তাকে খবর দিন। জেলখানায় যাওয়ার পর প্রথম-প্রথম বউটার জন্য খুব কষ্ট হত। বেচারা কিছুই বোঝে না, সরল। বহরমপুরে যাওয়ার পর এতরকম আলোচনা হত। দিনরাত, আর মনে করার সময় পাইনি।
বউ এসে দরজায় দাঁড়াতে হরিশ রায় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শিবু বউয়ের দিকে তাকাল। একমাথা ঘোমটা, মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে চেহারা দেখে মনে হয় একটু মোটা। হয়েছে। শিবু বলল, ফিরে এলাম।
বউ সামান্য নড়ল, কথা বলল না। শিবু বলল, জেলখানায় কষ্ট হয়নি। আমার চেহারা কেমন লাগছে?
বাবুদের মতো ফরসা। বউ কথা বলল।
ভালো লাগল শুনে, এখন আমার অনেক কাজ। দশটা গাঁয়ের ভার আমার ওপর। কাল শহরে আমায় নিয়ে কী কাণ্ড, শুনেছ?
ঘাড় নাড়ল বউ, হ্যাঁ, সে শুনেছে। তা
হরিশখুড়ো ভালো মন্দ খেতে দেয়?
ঘাড় নাড়ল বউ, হ্যাঁ।
শুনলাম ঘরটা নাকি পড়ে গেছে, এখন সারাবার সময় নেই। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
কোথায়? ঘোমটা সরে গিয়ে চোখ দেখা গেল।
সারা দেশে ভোট আসছে, আমাকে খুব খাটতে হবে। তুমি এখন কী করবে?
যা বলেন। চোখ দুটো খুঁটিয়ে দেখছিল।
চলো আমার সঙ্গে। অবশ্য খাওয়া থাকা নিয়ে অসুবিধে হবে।
আপনি চাষ করবেন না?
দূর পাগল। এখন আমার অনেক কাজ। শিবু হাসল।
তাহলে যাব না। বউ ঘুরে দাঁড়ল।
মানে? আমি তোমার স্বামী না? বিরক্ত হল শিবু রায়।
ইস! বউ-এর পেটে যে ভাত দিতে পারে না সে আবার কীসের ভাতার–কথাটা শেষ করেই হন হন করে ফিরে গেল বউ, ঘোমটা সরিয়ে।