ব্রহ্মহৃদয়
অনেক আছে, তবু কিছু নেই। অনেক লোক তবু যেন খাঁ খাঁ করছে সব। দিনে রাতে কত কাজ তবু মন পাওয়া তো দূরস্থান কাউকে যেন ছুঁতেই পারি না। বুকের মধ্যেটা কেমন হু হু করে। অথচ বিয়ের আগে সুশান্ত তো সবই বলেছিল। বলত বেশ গর্বের সঙ্গে। একটি কথাও বেচারি মিথ্যে বলেনি। সমস্ত মিলিয়ে। নিয়েছি। মফসসল টাউনে বাড়ি হলে কি হবে, নাকি এককালের জমিদারবাড়ি, বিশাল বাড়ি। একশোবার ঠিক। দেউড়ি পেরোলে বিরাট উঠোন। চকমিলোনো। গাড়িবারান্দার কোলে কোলে উঁচু উঁচু ঘর। কিন্তু গঙ্গার ধারে বাড়ি তো! দোতলাতেও তাই নোনা লেগেছে। তারই ওপর নীলচে চুনকাম। ঘরে ঢুকলে কেমন মন খারাপ হয়ে যায়। সুশান্তর বাবারা সাত ভাই। ছ-জন জীবিত। তাঁদের সাত স্ত্রী বর্তমান। তারও আগের পুরুষের রয়েছেন এক পিসিঠাকুমা। সাত ভাইয়ের ছেলেমেয়ে, তাদের ছেলেমেয়ে সব মিলিয়ে সাকুল্যে কত জন হবে গুনতিতে, আমার ঠিক জানা নেই। সবার হদিস এখনও পাইনি। অর্থাৎ জমজমাট সংসার। অথচ সেরকম আড্ডা তো দেখি না, দেখি না জমিয়ে খাওয়াদাওয়া, পুজো-আচ্চা। হা হা হাসি। হাঁকডাক। ঘরগুলোতে মানুষ যেন চাক বেঁধে বেঁধে আছে। আড্ডার বদলে জটলা। অট্টহাস্যের বদলে গলাখাঁকারি, হাঁকডাকের বদলে ফিশির ফিশির।
হতে পারে আমার এই টাউনে যাকে বলে ভাবের বিয়ে, তাই এমনি অভিজ্ঞতা। বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলা রেজিস্ট্রি করে লোকাল ট্রেনে চেপে আমি শ্বশুরবাড়ি এলুম। সুশান্তর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা। পায়ে চটি। আমার পরনে গোলাপি আর হলুদ চেক-চেক দক্ষিণী সিল্ক। কানে মাকড়ি, গলায় সরু সোনার হার, হাতে একগাছি বালা, আর ঘড়ি। পাতলা সুটকেস হাতে নিয়ে যখন সুশান্তর সঙ্গে ভেতর-উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালুম, কোনো পুরুষ মানুষকে ত্রিসীমায় দেখিনি। সিঁড়ির নানান ধাপে, এ ওকে ধরে কিছু কৌতূহলী নারী জনতা আমাকে অবাক হয়ে দেখছিল। শাশুড়ি গম্ভীর মুখে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা সোনা-বাঁধানো লোহা পরিয়ে দিয়েছিলেন। একটু রাতে দালানে খেতে বসতে বিরাট কাঁসার বগি থালায় অনেক রকম পদ দেখেছিলুম, দিদিশাশুড়ি কাঁসার ফুলবাটিতে রুইমাছের ল্যাজা আর মুড়ো এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, খেতে হয় মা, খেয়ে নাও। সে সময়েও গয়নার ঝমঝম, ঘোমটা, খোঁপা, আলতা-পরা পা, আর চোখ ভরতি কৌতূহল আমার আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছিল। কিন্তু কেউ আলাপ করতে, বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে আসেনি। কে জানে একে ভাবের বিয়ে, তায় বেজাতের মেয়ে, এইসব ভয় বোধহয় দুর্জয় মেয়েলি কৌতূহলের মুখেও কুলুপ এঁটে দিয়েছিল।
পরে আমার নিজের জায়ের মুখে শুনেছি। অমন অনাসৃষ্টির বউ-বরণ নাকি তারা জন্মেও দেখেনি। সে এসেছিল বেনারসী দলমলিয়ে, গয়না ঝলমলিয়ে, দুধে আলতায় পা রেখে। চতুর্দিকে উলু উথলে ছিল। শাঁখের আওয়াজে আর সব আওয়াজ ডুবে গিয়েছিল। হাতের মুঠোয় ছটফটে মাছ, কপালে বরণডালা। গালে দিদিশাশুড়ির চুমো, আর সারা বিকেল, সারা সন্ধে, রাত, পরের দিন সকাল, বিকেল, সন্ধে রাত, খালি জমকালো পোশাকের আসা-যাওয়া আর উপহার, চিবুক ধরে আদর আর আহা চমৎকার বউ হয়েছে।
সুশান্তটা একদম বোকা। আশ্বাস দিয়েছিল, আদর না পাও, খাতির পাবে। পল্লে বাড়ির তিনকুলে কেউ ডক্টরেটওয়ালা কলেজ প্রফেসার বউ দেখেনি। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর দিন থেকেই আমি যথানিয়মে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে কলেজে চাকরি করতে যাচ্ছি। সুশান্তর থিসিস শেষ হয়নি। সে ফিল্ড ওয়ার্কের জন্যে তখন বাঁকুড়া চষে ফেলছে। কদিন ছুটি নিয়ে যে মধুচন্দ্রিমা না হোক মিছরি চন্দ্রিমাও করব সে গুড়ে বালি। দিন পাঁচেক পরে আমার নিজস্ব শাশুড়ি ডেকে বললেন, নতুন বউমা, আমাদের যৌথ পরিবার, মোটা ভাত-কাপড়টা এখনও এস্টেট থেকেই হয়। সবাইকেই কিছু কিছু কাজ করতে হয়। তুমি যদি তোমার ভাগের কাজটুকু না করো আমার মাথা কাটা যাবে।
আমি বললুম, বেশ তো, কী করতে হবে বলুন না, নিশ্চয়ই করব।
সকালটা তো ইস্কুলে বেরোও, বিকেলবেলা জল খাবারের নুচি, রাতে যেটুকু রুটি হয়, তার ময়দাগুলো তুমি মেখে, বেলো।
চারটে, কোনোদিন পাঁচটায় বাড়ি ফিরে, গা ধুয়ে, চুল বেঁধে,—সুতরাং তাল তাল ময়দা মাখি, বেলি। শেষ হতে হতে রাত আটটা তো বটেই। যদি কোনোদিন সন্ধে সাতটা পেরিয়ে যায় ফিরতে, ট্রেনের গণ্ডগোল বা কলেজে মিটিং থাকলে এরকম হয়েই থাকে, শাশুড়ি বলে যান, কাল সকালে একটু ভোর-ভোর উঠো। আজ তোমার ময়দার পালা ন-বউমা সেরে দিয়েছে, ওর সকালের চা-জলখাবারটা তোমায় করে দিতে হবে। পরদিন আমার দশটা পঁয়তাল্লিশে ক্লাস। সাড়ে নটার ট্রেনে যেতে না পারলে সেটা হয়ে গেল। রাতে বা ভোরে কোনো পড়াশোনা নিয়ে বসলে, হঠাৎ যদি কোনো কাজ পড়ে, কেউ কেউ বলেন, এত পড়ে-শুনেও তাহলে তেমন কিছু শিখে উঠতে পারেনি, এখনও ইস্কুলের পড়া করতে হয়! তো এই আমার খাতির।
তখন ভাদ্রমাস। প্রচণ্ড গুমোট, রুটি বেলতে বেলতে সাড়ে আটটা বাজল। কোমর ভেঙে যাচ্ছে। দোতলায় নিজের ঘরে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়ালুম। ঘামে ভিজে শপ শপ করছি। কিন্তু বিকেলে এক বার গা ধুয়েছি, এখন আবার কলঘরে চানের জল পাওয়া যাবে না। জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসছে। দূর দিয়ে একটা নৌকো চলে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রাতের গঙ্গা। যেন হালকা কালি মেড়ে দিয়েছে কে নদী আর আকাশের গায়ে। একটা বাঁকা ডালে দেখলুম তিন চারটে শকুন বসে আছে, অন্ধকারে তাদের সাদা গলা ফুটে আছে। কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি জানলার ধার থেকে চলে এসে বিছানার একপাশে বসে পড়লুম। সুশান্ত টেবিলে কাগজপত্র মেলে লিখছিল। বলল, কী হল?
কী হবে? কিছু না।
একটু পরে ও হাতের কলম নামিয়ে রেখে বলল, তোমার এখানে ভালো লাগছে না, না?
আমি কিছু বললুম না। কী হবে, বলে? ও বলল, কতকগুলো অসুবিধে আছে ঠিকই। কিন্তু ভেবে দেখো, সুবিধের পরিমাণ কিন্তু তুলনায় অনেক বেশি। কিছু কিছু কাজ করে দিতে হয়, কিন্তু দায়িত্ব নেই। অসুখবিসুখ করলে আপনা থেকে ডাক্তার আসবে, ওষুধ আসবে। মুখের গোড়ায় ভাত, যত দেরিতে আস, ঠিক পাবে। বেড়াতে যেতে চাও, ঘর ফেলে চলে যাও, সেফ। যদি নিজেদের এত সব করতে হত, ভাবতে হত তবে কি আর এত নিশ্চিন্তে থিসিসটা শেষ করতে পারতুম। না, নাটকগুলোই লিখতে পারতুম। তারপরে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, একবার থিসিসটা জমা দিতে দাও না, দেখবে যাযাবরের মতো বেরিয়ে পড়ব দুজনে।
মাঝে মাঝে যাযাবরের মতো বেরিয়ে পড়লেই যে আমার সমস্যার কোনো সমাধান হবে না একথা ওকে বুঝিয়ে লাভ নেই। মানুষ একচক্ষু। যে দিকটা দেখতে, ভাবতে অভ্যস্ত সেদিকটাই দেখে, ভাবে। অন্য দিকে চোখ ঘোরাতে পারে না। আমার এত অভিমানই বা কীসের? বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো বই তো নই, বাবা অবশ্য অনেক আগেই গত হয়েছেন। কিন্তু মা-দাদারা কেউ এ-বিয়ে মেনে নিলেন না বলেই তো এত অসম্মানের মধ্যে দিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি আসতে হল। সুশান্ত ভেবেছিল পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি আছে বলে, কলেজে পড়াই বলে আমার খাতির হবে। ও জানে না মেয়েদের সম্মান তাদের চাকরি, শিক্ষা, ডিগ্রি এসব দিয়ে হয় না। সমাজের এমন স্তর এখনও অনেক আছে যেখানে এগুলো বরং মেয়েদের অসম্মান বাড়ায়। চাকরি করে?—এ মা। কলেজ? ওই হল। মাস্টারনি। পি. এইচ. ডি.? এম, এ.-র পরেও আরও পড়েছে? বয়সের কী গাছপাথর নেই গা? মেয়েদের সম্মান হয় তাদের রূপে, তাদের বাবা, স্বামী এদের পদমর্যাদায়, আর যৌতুকে। আমার রূপ? নেই। বাবা? চলে গেছেন। স্বামীর পদমর্যাদা? এখনও তৈরি হয়নি। আর যৌতুক? ভাঁড়ে মা ভবানী।
তাই এঁদের বাড়ির সব বউয়ের গুণ আছে, খালি নতুন বউমার কোনো গুণ নেই। বড়ো বউয়ের চোখ ঝলসানো রূপ। সেজো বউটি কেমন সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, টিপটপ, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মেজো বউমা ছুঁচের কাজে এক্সপার্ট, বড়ো বড়ো শাড়ি, বেডকভার ফুলে লতাপাতায় ভরিয়ে ফেলছে, অবাক মানতে হয়। ন বউমা তো সাক্ষাৎ ষষ্ঠীদেবী, মমতাময়ী জননী, কোলে কাঁখে দেবশিশুর দল। কনে বউমা! হিসেব জ্ঞান টনটনে। কোথাও এতটুক অপচো করো তো। কনে বউমার চোখে না পড়ে পারে না। নতুন বউমা? সব চুপ।
শাশুড়ি একদিন একগোছা সোনার চুড়ি আর একটা মটর দানা দিয়ে বললেন, এগুলো পরো বউমা। ন্যাড়া গায়ে ঘোরো ফেরো, আমার বড়ো লজ্জা করে।
আমি বললুম, ট্রেনে, বাসে যাতায়াত করি, এসব তো ডাকাতি হয়ে যাবে মা।
তো বাড়িতে ফিরে এসে পরো। এইভাবে আমার কিছু গহনা বা সম্মান লাভ হল। আদর করে উপহার দেওয়া নয়, দায়ে পড়ে নিতান্ত ব্যাজার হয়ে হাত উপুড়। তা তা-ই সই। সঙ্গগুণে আমারও কেমন একটা হীনম্মন্যতা জন্মে গেছে। গয়নাগুলো পরে মনে হল জাতে উঠলুম।
জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন দুপুরবেলা দিদিশাশুড়ি বললেন, ভাই ভাত-পাতে আগে ঠাকুরের প্রসাদটুকু খেয়ে তারপর অন্যসব খেও। খিচুড়ি আর পায়েস, একমুঠো। খেয়ে চমৎকৃত হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, এ প্রসাদ কোথাকার দিদি?।
ও মা, জানো না? বামুন বাড়ির! বামুনকর্তা বারোমাস সমস্ত শক্তি পুজো নিজের হাতে করেন যে। বামুনমা নিজের হাতে ভোগ রাঁধেন।
বড়ো জাকে জিজ্ঞেস করে জানলুম বামুনবাড়ি আমাদের পেছনেই। নাম তারানাথ ভট্টাচার্য। পেশায় পুরোহিত বা পণ্ডিত কিছু নন, কোনো মার্চেন্ট অফিসে কাজ করেন। কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। ভক্তিমান। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই। তাই আজ সারাদিন ধরেই খুব শঙ্খ ঘন্টা কাঁসর ইত্যাদির আওয়াজ পাচ্ছি। এ বাড়ি থেকেও ঠাকুরের পুজো বাবদ শাড়ি, মিষ্টি ইত্যাদি কীসব গেল। দিদিশাশুড়ি জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, পুজো তো কতই হয় কিন্তু বামুনকর্তার পুজো একেবারে সাক্ষাৎ ঠাকুরের আবাহন করে এনে প্রতিমার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া। এমন জায়গায় পুজো পাঠাতে পারাও অনেক পুণ্যি, অনেক ভাগ্যির কথা।
ফরসা মতো ছোটোখাটো একজন লালপেড়ে শাড়ি পরা মহিলা আমাকে আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন বটে এ বাড়ি আসার পর। শুনলুম তিনিই বামুনমা। আর তারানাথবাবুকে আমি মাঝে মধ্যেই ট্রেনে দেখি। যাওয়ার সময়েই বেশি। আসবার সময়েও কখনও কখনও। ফরসা দোহারা চেহারা, চমৎকার প্রশান্ত মুখ। চুলগুলো বেশিরভাগই সাদা হওয়ায় খুব সৌম্য লাগে। শার্ট-প্যান্ট পরে প্রৌঢ় মানুষ ভিড় ট্রেনে ওঠানামা করেন, সৌম্যদর্শন হওয়া সত্ত্বেও কোনোদিন আঁচ করতে পারিনি তিনি এত ভক্তিমান, কিংবা নিজের হাতে সব মাতৃপুজো করবার মতো শক্তি ধরেন।
খুব কৌতূহল হল। পুজো অর্চনার আমি বিশেষ কিছুই জানি না। আমার বাপের বাড়িতে খুব একটা রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু আমার ওই ধূপ-ধুনো, শঙ্খ-ঘন্টা, মন্ত্র পাঠ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে আবহাওয়া তৈরি হয় সেটা ভীষণ ভালো লাগে। স্কুল কলেজে পড়তে সরস্বতী পুজোয় আলপনা দেওয়া, ফল-কাটা, প্রসাদ-বিতরণ, অঞ্জলি বা আরতির সময়ে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকা—এসব আমার ভালো লাগত।
সরস্বতী পুজোর দিন শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলুম, ভটচার্য বাড়ির পুজো দেখতে যাব কি না। এ বাড়িতে আবার বড়োদের অনুমতি না নিয়ে পাড়ার কোনও বাড়ি যাবার নিয়ম নেই। উনি সানন্দেই সম্মতি দিলেন। যখন পৌঁছেলুম তখন তারানাথবাবু আরতি করছেন, বিচিত্রভাবে পঞ্চপ্রদীপ নাচিয়ে নাচিয়ে। বামুনমা শাঁখে ফু পাড়ছেন। কাঁসর বাজাচ্ছে ওঁদের নাতি, বড় মেয়ের ছেলে, আরও দু চারজন নাতিনাতনি দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো মেয়েও রয়েছেন। কিন্তু পরিবেশ সত্যিই অপূর্ব।
শুধু ধূপ-ধুনোর পবিত্র ভাবদ্যোতক গন্ধই নয়, মঙ্গলবাদ্যই নয়, গাঁদা ফুলের মালায় সজ্জিত ছোট্ট সরস্বতী বিগ্রহের দেবীভাব, উপস্থিত সকলের মগ্নতা, তারানাথ ভট্টাচার্য মশাইয়ের বাহ্যজ্ঞানশূন্য তদগত তন্ময় পুজোর ভঙ্গি সব মিলিয়ে আমাকে মুগ্ধ করে দিল।
উপুড় হয়ে প্রণামের মন্ত্র উচ্চারণ করে, পুজো শেষ করে এদিকে ফিরলেন ভট্টাচার্যৰ্মশাই। আমাকে দেখবামাত্র ওঁর মুখে আনন্দের আভা ছড়িয়ে গেল। কেমন একটা উল্লাসের সঙ্গে বললেন, জানতুম, আমি জানতুম, মা আমার ডাক শুনেছেন, সশরীরে এসে নিজেই নিজের পুজো নিচ্ছেন সন্তানের হাত থেকে, আমাকে জোড় হাতে নমস্কার করলেন উনি।
এগুলো বয়স্ক মানুষের অভ্যস্ত কথার কথা বলেও ধরে নেওয়া যেতে পারত, যদি না তাঁর মুখের সেই দ্বিধাহীন প্রত্যয়ের ভঙ্গিটা থাকত। বামুনমা বলে উঠলেন, উনি ঠিকই বলেছেন মা, তুমি যে একাধারে লক্ষ্মী-সরস্বতী। তোমার সব কথা শুনেছি মা আমরা, ঠিক চিনেছি তোমাকে।
আমার চোখ-ভরতি করে জল এসেছিল, মুখ নীচু করে কোনোমতে বললুম, কী যে বলেন কাকিমা, কবে থেকে ভাবছি আপনাদের পুজো দেখব, আজ এসে এত ভালো লাগল।
ওঁরা তিনজনে স্বামী-স্ত্রী ও কন্যা আমাকে যত্ন করে বসিয়ে প্ৰসাদ না খাইয়ে ছাড়লেন না। খিচুড়ি, বাঁধাকপির ডালনা, বেগুনি, কুলের অম্বল, পায়েস। কী অসাধারণ যে সেই প্রসাদের স্বাদ! আমি বললুম, এমন রান্না আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে। কাকিমা বললেন, নিশ্চয়ই দেব মা। তুমি আবার এসো, তুমি এলে আমরা ভাগ্যি মানব।
বাড়ি ফিরে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি কেঁদে ফেললুম। জীবনে অনেক দিন পর, কিংবা বোধহয় এই প্রথম কেউ আমার বড়ো সমাদর করল, বড়ো সম্মান! আমার সব কথা শুনেছেন ওঁরা? কোন কথা? অসবর্ণবিবাহ, পিতৃকুল শ্বশুরকুল উভয়েরই অসম্মতি, তৎসত্ত্বেও জোর করে কাগজের বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে পড়া, স-ব? চিনেছেন আমাকে? কী চিনেছেন? কী দেখলেন যে অত আদর! আমার এতদিনের মুখের স্লানিমা, চোখের জল, অন্তরের গ্লানি সব যে একেবারে ধুয়ে গেল। কোনকালে বাবাকে হারিয়েছি। মায়ের মুখখানা দেখিনি কতদিন হয়ে গেল। বাপের বাড়ির কারুর সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে চোখ-ফিরিয়ে নেয়। এখানে আমি আছি যেন অনাহুত অতিথির মতো। আর এই রক্ষণশীল, ভক্তিমান দম্পতি কি না অনায়াসে বলে দিলেন, তোমাকে ঠিক চিনেছি। তুমি একাধারে লক্ষ্মী-সরস্বতী। অন্য কিছু না, কত বড়ো মন, কত স্নেহ-গড়া অন্তর হলে তবে কেউ একথা বলতে পারে!
এতদিন পরে আমার বোধহয় একটা জুড়োবার জায়গা হল। মাঝে মাঝেই যাই। ভট্টাচার্য দম্পতিকে কাকাবাবু কাকিমা ডাকি। গল্প করি। আমি আর কী গল্প করব, আমার জগতের লোকই নন ওঁরা। আমি শুধু শুনি। কাকিমার বাপের বাড়ির গল্প। শ্বশুরবাড়ির দেশের গল্প। একটা কোনো সূত্র পেলেই হল, সেটাকে উপলক্ষ্য করে উনি অনর্গল কথা বলে যেতে পারেন, সব কথা বুঝতে পারি না, তাড়াতাড়ি বলেন, তার ওপর ঢাকাই টান, কিন্তু স্নেহ আর আন্তরিকতা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। একেকদিন কাকাবাবু এসে বসেন, হেসে বলেন, কাকিমা তোমার কানের পোকা বার করে দিচ্ছেন, না? কাকিমা তখন বলেন, সত্যি! তুমি কত বিদুষী। তোমার কাছে আমি মূখ বকবক করে মরি। কিছু মনে করো না তো মা। আমি বলি, বিদুষী-টিদুষী বলে আমায় লজ্জা দেবেন না কাকিমা। আন্তরিকভাবেই বলি। বিদ্যার মূল্য কতটুকু? তা যদি ভাব দিতে না পারে?
কাকিমা একদিন বললেন, তোমায় প্রথমদিন দেখেই লক্ষ্মীঠাকরুন বলে বুঝতে পেরেছিলাম মা। উঠোনে এসে দাঁড়ালে মুখ নীচু করে কিন্তু কেমন সোজা, কোথাও কোনো মিথ্যে সংকোচ নেই। লক্ষ্মী যে! নিজের সিংহাসনে দাঁড়াতে কি মায়ের মনে সংকোচ আসে? আমি আর থাকতে পারলুম না। আস্তে আস্তে বললুম, কিন্তু কাকিমা আমাকে তো কেউ লক্ষ্মী ভাবে না। আমি তো উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা আপদ,
লক্ষ্মী যখন কাউকে দয়া করেন, তখন সব সময়ে তাঁকে চিনতে পারবে, এত সৌভাগ্য মানুষের হয় না মা। দেখি কাকাবাবু এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, লক্ষ্মী কে? লক্ষণ কী? শ্ৰী-সম্পদ যখন কল্যাণের সঙ্গে, সংযমের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখনই লক্ষ্মীর আবির্ভাব হয় মা। তোমার শ্বশুরগৃহে সম্পদ ছিল মা, শ্রী ছিল না, কল্যাণ ছিল না, সংযমও ছিল না। এবার হল। আমি মায়ের পূজা করি, টের পাই কখন তাঁর অকারণ কৃপা প্রকাশিত হয়। তোমার মধ্যে দিয়ে সেই কৃপা প্রকাশ পেয়েছে। বিদ্যার সঙ্গে সংযম, বিনয়, সম্পদের সঙ্গে মঙ্গল। তাই বলেছিলাম তোমাকে চিনেছি। তুমি নিজে চেনো না মা নিজেকে। মেয়েদের মধ্যে যখন শক্তির প্রকাশ হয় তাঁরা কি নিজেদের চিনে কাজ করেন?
কাকিমা আসবার সময়ে বললেন, তোমার কাকাবাবু যে তোমাকে কী চোখে দেখেছেন মা! আমাকে সবসময়ে বলেন তোমাকে যেন বিশেষ যত্ন করি।
আমি হেসে বলি, আপনাকে কি যত্ন করা শেখাতে হয় কাকিমা?
তা নয়, কিছুই তো পারি না। উনি বললেন, কিন্তু তোমাকে বড়ো ভালো লাগে।
ধীরে ধীরে ভটচায্যি বাড়ির বিশেষ আদরের হাওয়া আমার শ্বশুরঘরেও লাগল। প্রথমদিককার সেই বিরূপতা, উদাসীনতা, অশ্রদ্ধা এখন যেন আর নেই। বরং জায়েরা মাঝে মাঝে আমার পরামর্শ নিয়ে যান, শাশুডিও আমার মতামত উপেক্ষা করেন না। দিদিশাশুড়ি কথায় কথায় বলেন, বাববা, বামুনকর্তা স্বয়ং তোমাকে যা মান্যি করেন নাতবউমা! বুঝতে পারি ওঁদের মতামতই এ বাড়ির হাওয়া পালটে দিচ্ছে।
কাকা-কাকিমার স্নেহ যে অকৃত্রিম, যে-কোনো কারণেই হোক আমাকে যে তাঁরা শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন, এ বিষয়েও কোনো সংশয় নেই। খালি একটা কথা আমার মনে বার বার উঠতে থাকে। ওঁরা যেমনি ভক্তিমান, শাস্ত্রজ্ঞ তেমনি কিন্তু নিষ্ঠাবানও বটে। অর্থাৎ আচার-বিচার মানেন। খুব বেশি রকম। অতিরিক্ত আচারপরায়ণতা থেকেই তো মনুষ্যত্বের যত অপমান! আমাকে ওঁরা মা বলছেন, আমার মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখতে পেয়েছেন। অব্রাহ্মণ বলে আমার আত্মার অপমান ওঁরা করেননি। ঠিক কথা। এই সহনশীলতা, মমতা, অন্তদৃষ্টি যদি ওঁরা ভক্তি থেকে পেয়ে থাকেন তো ওঁরা সত্যিই অসামান্য। কিন্তু আমার পরীক্ষা করে দেখতে খুব ইচ্ছে হয় কতটা উদারতা ওঁদের আছে। আমি যে যুক্তিবাদী। পরীক্ষানিরীক্ষা আর গবেষণাই আমার স্বভাব! তাই একদিন বললুম, কাকিমা, আমাকে তো আপনারা যখন-তখন খাওয়ান। আমারও কিন্তু নিজের হাতে আপনাদের খাওয়াতে ইচ্ছে করে।
কাকাবাবু হাসি-হাসি মুখে বললেন, আমি যে স্বপাক ভিন্ন খাই না মা, নেহাত অসুখে-বিসুখে অপারগ হলে তোমার কাকিমা বেঁধে দ্যান।
কাকিমা বললেন, সে-ও কি কম হাঙ্গামা! তসর পরতে হবে। সদ্য চান করে তবে রাঁধতে হবে। রান্নার সময়ে কথা বলতে পারব না।
আমি বললুম, রান্নার সময়ে কথা না বলা, খুবই বৈজ্ঞানিক নিয়ম। কিন্তু তসর কেন কাকিমা? তসরের শাড়ি কি কেচে নিয়ে পরেন?
না, তোলা থাকে, পুজো-টুজোর সময়ে বার করে পরি, ময়লা হলে কাচি।
আমি বললুম—এটার কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। পবিত্র মানে যা একেবারে পরিষ্কার। সাবান দিয়ে কাচা কাপড় যত শুদ্ধ, তুলে রাখা সিল্ক কাপড় কি তত শুদ্ধ হতে পারে? কাকিমা বললেন, নাও এবার কী জবাব দেবে দাও। সরস্বতীর সওয়াল এ। শক্ত ঠাঁই। কাকাবাবু বললেন, সুতিবস্ত্রে যত সহজে ময়লা লাগে, তসরে তত সহজে লাগে না মা। অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ, ব্যাকটেরিয়ার কথা ভাবতে গেলে পরিষ্কার সাবান-গরম জলে কাচা বস্ত্রই শুদ্ধ। তবে কি জানো মা, শাস্ত্রের অনেক বিধানের পিছনেই কিন্তু যুক্তি আছে। যুক্তিগুলো কালের প্রভাবে হারিয়ে গেছে। আমরা অন্ধের মতো আচার বলে পালন করে যাই সবাই। যেমন তুলসী গাছকে পবিত্র বলা হয়ে থাকে। বাড়িতে তুলসী রাখার নিয়ম। আমি শুনেছি তুলসীর অক্সিজেন উৎপাদন করার ক্ষমতা অন্য গাছের থেকে বেশি। তা ছাড়াও তুলসী ওষধি। বহু রোগের নিরাময়ের উপায় আছে তুলসীর পত্রে, ছালে। বাড়িতে সব সময়ে যদি একটি ওষধিবৃক্ষ থাকে গৃহস্থের কত সুবিধে বলো তো?
আমি হেসে বললুম, বুঝলুম। নিশ্চয়ই তুলসী-ভক্তির পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে। কিন্তু আমি যদি চান করে পরিষ্কার শাড়ি পরে, না হয় তসরই পরলুম, আপনাকে বেঁধে দিই আপনার না খাওয়ার কোনো শাস্ত্রীয় বা বৈজ্ঞানিক কারণ থাকে কী?
চোখ বুজিয়ে কাকাবাবু স্মিত মুখে বললেন, যা দেবী সর্বভূতেষু অন্নরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ। আমি কারও হাতে খাই না মা, শাস্ত্রীয় অন্ধতাই হবে হয়তো, কিন্তু অভ্যাস হয়ে গেছে, তবে তুমি আমার মা, তোমার যখন এত আগ্রহ নিশ্চয়ই খাব।
আমার মনের ভেতরটা আলোয় আলো হয়ে গেল। চান করে, বাড়িতে থোয়া সাদা কাপড় পরে বেঁধে দিলুম, খেতে বসে আমার দিকে চেয়ে বললেন, তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে, না মা?
আমি শুধু হাসলাম। উনি বললেন, আনন্দরূপং যদ্বিভাতি… আনন্দই ঈশ্বর। আমাকে খাইয়ে যদি তুমি আনন্দ পাও মা, তো সেও একরকম ঈশ্বরকেই পাওয়া। তোমার সেই পাওয়ার উপলক্ষ্য হতে পেরেছি বলে আমি ধন্য।
মনে মনে ভাবি আমিও ধন্য, এমন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের দেখা পেলুম যিনি আবেগের বশেই অব্রাহ্মণ-কন্যাকে মানুষের অধিক সম্মান দেননি, মনেপ্রাণে যিনি আচারবিচারের ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে, সত্যিকারের শ্রেয় লাভ হলেই মানুষ এমন হয়। বিজ্ঞানশিক্ষার বাইরেও হয়।
কাকাবাবুর মধ্যে আমি আমার বাবাকে ফিরে পেলুম, কাকিমার মধ্যে মাকে। ওঁরাও আমাকে মেয়ে বলে মনে করেন। কাকিমার অসুখ করলে আমি ওঁদের বাড়ি গিয়ে যতদূর পারি সেবা-শুশ্রুষা করে আসি। ওঁরা আমার কাছ থেকে সেবা নিতে কোনোরকম কুণ্ঠা করেন না।
শীতকালটাতে কাকাবাবুর হাঁপানি বাড়ে। খুব কষ্ট পান। কলকাতা থেকে আমার এক সহকর্মিণীর চেনা ভালো ডাক্তারকে সেবার আনলুম। তাঁর চিকিৎসায় থেকে উনি খুব আরাম পেলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু আমাকে আড়ালে ডেকে বলে গেলেন, এতদিন ফেলে রেখেছেন, চিকিৎসা করাননি কেন? এ তো কার্ডিয়াক অ্যাজমা। হার্টের অবস্থা মোটেই ভালো নয়, যে কোনোদিন খারাপ টার্ন নিতে পারে। ওষুধপত্রর ব্যবস্থা হল, খাওয়াদাওয়ার নিয়ম হল। শিশুর মতো উনি আমার সব কথা মেনে নিলেন। ওঁদের ছেলে নেই। তিনটি মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড়োজন ছাড়া বাকি দুজন খুবই দূরে দূরে থাকে। হার্টের কথা কী করে ওঁদের বলি! মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে কাকাবাবু প্রেসক্রিপশনটা হাতে করে ভালো করে দু-তিনবার পড়লেন। কিছু বললেন না।
আগস্ট মাসের সন্ধেবেলা। সারাদিন মেঘ করে আছে। ভীষণ গুমোট। বিকেলের দিকে ঠিক বেরোবার মুখে ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। গরম কমল না। মাঝখান থেকে রাস্তাগুলো কাদায় কাদা হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে সবে গা ধুয়ে বেরিয়েছি, বিজলি চলে গেল। গঙ্গার দিকের জানালাগুলো খুলে দিয়ে একটু দাঁড়িয়েছি, আমার এক ভাসুরের মেয়ে বলে গেল, ও বাড়ির বামুনমা তোমায় সকাল থেকে খোঁজাখুঁজি করছেন কাকিমা।
কেন রে?
কী জানি! বোধহয় বামুনকর্তার শরীর ভালো নেই।
মনের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সুশান্তকে বললুম, চলো তো আমার সঙ্গে।
অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে ওঁদের দোতলায় উঠতে কাকিমার গলা পেলুম, এখন কেমন বোধ করছ? কথা বলছ না কেন?
উত্তর নেই। তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয় দেখলুম কাকাবাবুর মারাত্মক টান উঠেছে। চোখ বেরিয়ে আসছে একেকবারের টানে। সুশান্ত সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার আনতে চলে গেল। কাকিমাকে জিজ্ঞেস করলুম, কখন থেকে এমন হয়েছে?
কাঁদো-কাঁদো গলায় উনি জানালেন, কাল রাত থেকে জ্বর, সকালে প্রায় কিছুই খাননি। খালি দুধ। শেষ দুপুর থেকেই টান উঠেছে। কাকিমা ওঁর বুকে মালিশ করে দিচ্ছিলেন। বারণ করলুম, হার্টের ব্যাপার! দেখতে দেখতে টানটা প্রচণ্ড বেড়ে গেল। ওষুধপত্র যা খাওয়ার ছিল খাওয়ালুম, জিজ্ঞেস করলুম, কাকাবাবু, কষ্ট হচ্ছে খুব? একটু ধৈর্য ধরুন, এক্ষুনি ডাক্তার এসে পড়বেন। বললে কী হবে, দেখছি বুকটা ওঁর হাপরের মতো ওঠানামা করছে। অনেক কষ্টে বললেন, জল, একটু জল। কাকিমা তাড়াতাড়ি গ্লাসে করে জল নিয়ে এলেন। তাঁর হাত কাঁপছে, বললেন, আমার বড্ড ভয় করছে শান্তা, তুমিই খাইয়ে দাও। আমি ফিডিং ক্যাপে জলটা ঢেলে ওঁর গলায় একটুখানি ঢেলেছি কি না ঢেলেছি, হঠাৎ উনি প্রাণপণ শক্তিতে কাপটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন। বুকে ভর দিয়ে উঠে বসেছেন। যন্ত্রণায় চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তারপর খানিকটা জল গলায় ঢেলে দিয়েই বিছানার ওপর কাত হয়ে পড়ে গেলেন। চোখ আধখোলা, নিশ্চল।
কাকিমা কেঁদে উঠলেন, কী হল? কী হল? শান্তা এ কী ওঁর পা এমন ঠান্ডা কেন? অজ্ঞান হয়ে গেলেন, না কী? কী হল, বুঝতে পারলুম, কিন্তু কোন প্রাণে বলি? ওঁকে সান্ত্বনা দিতে নিজের চোখের জল সামলে ঠান্ডা সাদা পা ঘষে ঘষে গরম করবার চেষ্টা করতে লাগলুম। সুশান্ত ডাক্তার এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ফিরল। ডাক্তার ওঁর ডান হাতখানা একবার তুলে ধরেই নামিয়ে রাখলেন।
এমনি করেই শেষ হয়ে গেল কয়েক বছরের সুন্দর সম্পর্কের গল্প। বেচারি কাকিমা! খালি বলেন, জল খাবার জন্যে অমন তেড়েফুঁড়ে উঠতে গেল বলেই বোধহয় প্রাণটা বেরিয়ে গেল, না? জলটা বোধহয় গলায় আটকে গিয়েছিল। না? কীভাবে শোকার্ত মানুষটিকে বোঝাই যে বিশাল হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, তার থেকে পরিত্রাণ পাবার কোনো আশাই ছিল না কাকাবাবুর।
শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে গেছে। কাকিমা একদম একা। ওঁর বড়ো মেয়ে কলকাতায় থাকেন, তিনিই আপাতত ওঁকে নিয়ে যাবেন। বাড়ির বিলিব্যবস্থা হচ্ছে। ওঁর অন্য দুই মেয়েও উপস্থিত। সবাই মিলে গোছগাছ চলছে। আমিও রোজ সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরেই যাই। যতদূর সম্ভব সাহায্য করি। দিন কয়েক পর। পরদিনই কাকিমা চলে যাবেন, মনটা বিহ্বল হয়ে রয়েছে, কাকিমার বড়ো মেয়ে একটা সুন্দর লালপাড় শাড়ি আমার হাতে তুলে দিলেন, কাকিমা বললেন, শেষ সময়ে মুখে জল দিলে একটা শাড়ি দিতে হয় মা আমাদের, নাও। শেষ সময়ে? মুখে জল? সহসা শেষ দিনের শেষ দৃশ্যটা নির্মমভাবে ঝলসে উঠল আমার চোখের সামনে। বাকরোধ হয়ে গেছে, চোখ ঠিকরে আসছে, কাকাবাবু তাহলে ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন মহাকাল সামনে। বিদ্যুচ্চমকের মতো এক লহমায় আমি সমস্তটা বুঝতে পারলুম। গলা বুজে আসছে, শাড়িটা ফেরত দিয়ে বললুম, আপনি ভুল দেখেছেন কাকিমা, শেষ জল দেবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। জলটা উনি নিজে নিজেই খেয়েছিলেন।
পরলোকের আধখোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গতি সম্পর্কে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন আজীবন শক্তির পূজারি। শূদ্রাণীর হাতের জল পান করবার ঝুঁকিটা কিছুতেই নিতে পারেননি।