Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হত্যাপুরী (১৯৭৯) – ফেলুদা || Satyajit Ray

হত্যাপুরী (১৯৭৯) – ফেলুদা || Satyajit Ray

ডুংরু পাশেই শিশির ভেজা ঘাসের উপর বাজনাটা রেখে শুধু গলায় গান ধরল। ওর কান ভাল, তাই দুদিন শুনেই তুলে নিয়েছে গানটা। হনুমান ফটকের বাইরে বসে যে ভিখিরি গানটা গায়, সে অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে বাজনাও বাজায়। তাই ডুংরুর শখ হয়েছিল সেও বাজাবে। এই বাজনাটা সবজিওয়ালা শ্যাম গুরুঙের। ডুংরু একবেলার জন্য চেয়ে এনে রেখে দিয়েছে তিনদিন। ছড় টেনে সুর বার করা যে এত শক্ত তা কি ও জানত?

ডুংরু গলা ছাড়ল। সামনে ভুট্টা খেতের ওপরে দুটো মোষ আর কয়েকটা ছাগল ছাড়া কাছে পিঠে কেউ নেই। ডুংরুর ঠিক পিছনেই খাড়া পাহাড়, তার নীচে একটা বাদাম গাছ, তারই ঠিক সামনে ডুংরুর বসার টিবি। ওই যে দূরে ইটের তৈরি টালির ছাতওয়ালা দাতলা বাড়ি, ওটা ডুংরুদের বাড়ি। ভুট্টার খেতটাও ওদের। উত্তরে কুয়াশায় আবছা পাহাড়ের পিছনে তিনটে বরফে ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে যেটার চূড়ো মাছের লেজের মতো দু ভাগ হয়ে গেছে, যেটার নাম মাচ্ছাপুছরে, সেটার ডগা এখন গোলাপি।

প্রথম দুটো লাইন গাইবার পর তিনের মাথায় যেখানে সুরাটা চড়ে, সেখানে আসতেই আকাশ ভাঙল। গুড গুড শব্দটা শুনেই, ডুংরু এক লাফে পাঁচ হাত পাশে সরে গিয়েছিল, নইলে ওই হাতির মাথার মতো পাথরটা বাজনাটার সঙ্গে সঙ্গে ওকেও থেতলে দিত।

ওরে বাব্বা; ওটা কী–বাদামগাছটার মাথা ফুঁড়ে সেটাকে তছনছ করে একরাশ ডালপালা খুবলে নিয়ে মাটিতে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল ওটা কী?

একটা মানুষ।

না, একটা বাবু।

মাথায় রক্ত, থুতনিতে রক্ত, একটা পা হাঁটুর কাছ থেকে দুমড়ে আছে যেন খড়ের পুতুল। লোকটা মরে গেছে কি?

না, ওই যে মাথাটা নড়ল।

ডুংরুর ধাঁ করে মনে পড়ে গেল ওদের কথা। ওই পুবের গমের খেতটা পেরিয়ে রাস্তার ওপারে পাহাড়ের গায়ে ঝরনার ধারে তাঁবু ফেলে যে চারজন আছে-যাদের দাড়ির দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ডুংরু, কারণ ওর নিজের বাপ খুড়ো দাদু মামা মেসে কারু দাড়ি নেই—যদি কেউ কিছু করতে পারে তো ওরাই পারবে। ওরা চেনে ডুংরুকে; ডুংরু ওদের গান শুনিয়েছে, খেত থেকে ভুট্টা নিয়ে গিয়ে দিয়েছে, ওরা ডুংরুকে পয়সা দিয়েছে—এক টাকা, দুটাকা, এক’দিন পাঁচ টাকা।

ডুংরু দিল ফুট।

হাই, হাই-কাম, জো, কাম।

হোয়াটস আপ?

ডুংরু জিভ বার করে মাথা চিতিয়ে চোখ উলটিয়ে দেখিয়ে দিল। এরা বুঝল। এ ভাষা সকলেই বোঝে।

গো!-জিপ, জিপ!-গো!

এদের জিপের গায়ে রামধনুর রং। এমন গাড়ি ডুংরু দেখেনি কখনও। অনেক গাড়ি সে। দেখেছে বড় প্লান্ত দিয়ে পোখরার দিকে যেতে।

জো, মার্ক, ডেনিস আর ব্রুস উঠে পড়ল জিপে। ডুংরুকে তুলে নিল সঙ্গে। একটা কিছু হয়েছে; দেখা দরকার।

হ্যাঁ, হয়েছেই বটে;

জাম্পিং জেহোশাফ্যাট! সর্বনাশের মাথায় বাড়ি।

চারজনে ঝুকে পড়ল লোকটার উপর। মার্ক মিনেসোটায় ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে নেপালে।

বেহুঁশ রক্তাক্ত লোকটাকে ধরাধরি করে তুলল। ওরা জিপে।

হাসপাতাল কাঠমাণ্ডুতে। এখান থেকে তেত্রিশ কিলোমিটার।

মানুষের হাতে যে রেখাটাকে বিলিতি মতে হেডলাইন বা বুদ্ধির রেখা বলে, ফেলুদার যে সেটা আশ্চর্যরকম লম্বা। আর স্পষ্ট, সেটা আমি জানি। ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলে বলে ও পামিস্ট্রিতে বিশ্বাস করে না, অথচ পামিস্ট্রির বই ওর আছে, আর সে বই ওকে পড়তেও দেখেছি। একবার এটাও দেখেছি—ফেলুদা ওর মাকৰ্দমারা একপেশে হাসিটা হেসে লালমোহনবাবুকে ওর বুদ্ধির রেখািটা দেখাচ্ছে। লালমোহনবাবু অবিশ্যি এ সব ষোলো আনা বিশ্বাস করেন। তাই ফেলুদার হেডলাইনের বহর দেখে দুবার চাপা গলায় অ্যামেজিং কথাটা বলেছিলেন, আর মিনিটখানেক পরে কথার ফাঁকে নিজের ডান হাতের মুঠে খুলে চোখ নামিয়ে রেখাগুলোর দিকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন।

হাত দেখে মোটামুটি অতীত-ভবিষ্যৎ বলতে আমার ছোট কাকাই পারেন। এমনকী মুখ দেখে ভাগ্য বলে দেবার ক্ষমতাও কারুর কারুর আছে বলে শুনেছি। কিন্তু কোনও লোকের কপালের ঠিক মধ্যিখানে কড়ে আঙুলের ডগা ঠেকিয়ে রেখে চোখ বুজে। সেই লোকের ভাগ্য গণনার ক্ষমতা যে কারুর থাকতে পারে, সেটা এই পুরী এসে প্রথম শুনলাম।

কলকাতায় লোডশেডিং-এ নাজেহাল অবস্থা, তার উপর একটানা গরম চলেছে একশো দশ ডিগ্রি। ছাপাখানায় লোডশেডিং-এর জন্য রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর নতুন উপন্যাস বৈশাখে বেরোতে পারেনি। ভদ্রলোকের আরও আপশোঁস এই জন্য যে, এটা ওঁর প্রথম ভীতিক উপন্যাস। ফেলুদাই ওঁকে বলেছিল যে মোমবাতির আলোয় রহস্য-কাহিনীর চেয়ে ভূতের গল্প জমবে বেশি। সত্যি বলতে কী, পিঠাপুরমের পিশাচ গল্পের আইডিয়াটা ফেলুদাই জটায়ুকে দিয়েছিল। কিন্তু সে বই সময় মতো বেরোল না দেখে লালমোহনবাবু রীতিমতো খাপ্পা হয়ে এক রোববারের সকালে আমাদের বাড়িতে এসে বললেন, নাঃ, এ শহরে আর থাকা চলবে না। আর শুনোচেন তো স্কাইল্যাবের ব্যাপার?

স্কাইল্যাব কলকাতায় পড়বে এ খবর কোথাও বেরোয়নি, কিন্তু লালমোহনবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস কলকাতার উপর শনির দৃষ্টি পড়েছে, তাই স্কাইল্যাবের একটা বড় অংশ এখানে না পড়ে যায় না। ফেলুদাকে দেখেছি ও প্রায় যে কোনও অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলতে পারে। ওয়েটিং রুমে জায়গা না পেলে প্লাটফর্মে চাদর বিছিয়ে শুয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে রাত কাটাতে দেখেছি কতবার। বালিশও লাগে না-হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা। কিন্তু বাড়িতে বিছানায় শুয়ে ঘণ্টাখানেক না পড়লে যার ঘুম আসে না, তার পক্ষে সেই অভ্যাসটা বন্ধ হয়ে গেলে আর কতদিন মাথা ঠিক রাখা যায়? বই পড়া ছেড়ে কিছুদিন তাস নিয়ে হাত সাফাই অভ্যোস করল। তারপর কিছুদিন মুখে মুখে লিমেরিক বানাল, তার একটা লালমোহনবাবুকে নিয়ে—

বুঝে দেখ জটায়ুর কলমের জোর
ঘুরে গেছে রহস্য কাহিনীর মোড়
থোড় বড়ি খাড়া
লিখে তাড়াতাড়া
এইবারে লিখেছেন খাড়া বড়ি থোড়।

এটা অবিশ্যি জটায়ুকে বলা হয়নি, আর এই লিমেরিক লেখাও বেশিদিন চলেনি। ভাবলে মনে হয়, শহরে রাত্তিরে বাতি না থাকলে হয়তা খুন-রাহাজানি অনেক বাড়বে; কিন্তু দুঃখের বিষয় গত তিন মাসে ফেলুদার কোনও কেস জোটেনি, আর ক্রাইমও যা হয়েছে, সেগুলোর কিনারা পুলিশেই করেছে।

তাই বোধহয় ফেলুদা লালমোহনবাবুর কথায় সায় দিয়ে বলল, সত্যি, কল্লোলিনী তিলোত্তম বড় জ্বালাচ্ছে। শারীরিক অস্বাচ্ছন্দৰ্যটা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ক্ৰমাগত কাজের ব্যাঘাত, পড়াশুনার ব্যাঘাত, মশার কামড়ে চিন্তার ব্যাঘাত—এগুলো বরদাস্ত করা কঠিন।

উড়িষ্যাতে তো একসেস তাই না?

লালমোহনবাবুর এই প্রশ্ন থেকে এল পুরীর কথা, আর পুরী থেকে এল সি-বিচের কাছে নতুন তৈরি নীলাচল হোটেলের কথা, যার মালিক শ্যামলাল বারিক লালমোহনবাবুর বাড়িওয়ালা সুধাকান্তবাবুর ক্লাস-ফ্রেন্ড।

কিন্তু তা হলে কী হবে? সুধাকান্তবাবু খোঁজ নিয়ে জানলেন জুনের মাঝামাঝির আগে ঘর পাওয়া যাবে না।

তাতেও অবিশ্যি আমরা পেছপা হইনি। জুনের মধ্যে কলকাতার অবস্থার উন্নতির কোনও আশা নেই। একুশে জুন আমরা পুরী এক্সপ্রেসে দিয়ে দিলাম রওনা। একবার কথা হয়েছিল যে লালমোহনবাবুর অ্যাম্বাসডরে যাওয়া হবে, শেষে ভদ্রলোক নিজেই এই সময়টায় লং জানিতে মাঝপথে ঝড়বাদল হলে ফ্যাসাদ হতে পারে মশাই বলে পিছিয়ে গেলেন। গাড়ি যাবে, তবে সেটা ড্রাইভার হরিপদবাবু নিয়ে যাবেন; আমাদের এক’দিন পরে পৌঁছবে। পুরী ছাড়াও আরও দু-একটা জায়গা ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে, সেটা নিজেদের গাড়ি থাকলে সুবিধে হবে।

ট্রেনের ঘটনার মধ্যে একটাই লেখার মতো। আমাদের ফোর-বাৰ্থ কামরার একটা আপার বার্থে একজন ভদ্রলোক ছিলেন যিনি সিগারেট খাচ্ছিলেন একটা হাল্ডারে যেটা ফেলুদা বলল সোনার। যে লাইটারে সিগারেট ধরাচ্ছিলেন সেটা নাকি গোন্ড-প্লেটেড, আর তার দাম নাকি তিন হাজার টাকা। যে কেস থেকে সিগারেট বার করলেন সেটা সোনার, চশমা সোনার, শার্টের কাফ-লিংকস সোনার। দুহাত মিলিয়ে তিনটে আংটি সোনার, আর ওপর থেকে পা বুলিয়ে নীচে নামতে গিয়ে লালমোহনবাবুর কাঁধে বুড়ো আঙুল লাগাতে যখন হেসে সরি বললেন, তখন দেখলাম একটা দাঁত সোনার। পুরী স্টেশনে নেমে কুলির মাথায় জিনিস তুলে ভদ্রলোকটি যখন ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন, তখন লালমোহনবাবু বললেন, ইস, এমন সোনায় মোড়া ভদ্রলোকটির নামটা জিজ্ঞেস করা হল না। ফেলুদা বলল, সেটা জানার একটা সহজ উপায় ছিল। কামরার বাইরে রিজারভেশন চার্ট টাঙানো ছিল হাওড়া থেকেই। ভদ্রলোকের নাম এম. এল. হিঙ্গোরানি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
Pages ( 1 of 12 ): 1 23 ... 12পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress