অঙ্গীকার
মেঘমালা তখন আকাশে ঘনিয়ে উঠছিল। বৃষ্টি নামবে যেন পূর্বাভাস দিচ্ছিল প্রকৃতি। আদ্রিতা তখনো জানত না, তার জীবনের এক বড় সত্য তাকে এভাবে পরিবর্তন করতে চলেছে।
আদ্রিতা ছোটবেলা থেকেই অরুণদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছিল। তার মা-বাবা এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর, অরুণের মা সুমিত্রা দেবী তাকে নিজের মেয়ের মতো করে বড় করেছেন। সে জানত না, এই পরিবার তার নিজের নয়। তার শৈশবের সমস্ত স্মৃতি যেন মুছে গিয়েছিল সেই দুঃসহ দুর্ঘটনার ধকল সামলাতে।
আদ্রিতা অরুণকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসত। অরুণও তাকে ছোটবোনের মতো স্নেহ করত। তবে, অরুণের এই ভালোবাসার গভীরে লুকিয়ে ছিল আরেকটি অনুভূতি, যা সে কখনো প্রকাশ করেনি।
একদিন কলেজ থেকে ফিরে আদ্রিতা শুনল, সুমিত্রা দেবী তার সঙ্গে একটি বিশেষ বিষয়ে কথা বলতে চান। তিনি হাসিমুখে বললেন,
“মা, তোমার আর অরুণের বিয়ে ঠিক করেছি। তোমাদের সম্পর্কটাই এমন যে তুমি ওর চেয়ে ভালো জীবনসঙ্গী পাবে না।”
এই কথা শুনে আদ্রিতা স্তম্ভিত হয়ে গেল।
“মা, আপনি কী বলছেন! অরুণ তো আমার ভাই!”
তখন সুমিত্রা দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটি চিঠি আদ্রিতার হাতে তুলে দিলেন। চিঠিটি আদ্রিতার মা লিখে রেখে গিয়েছিলেন, যেখানে বলা ছিল,
“আমার মৃত্যুর পর আদ্রিতাকে আপনি নিজের মেয়ের মতো বড় করবেন। তবে যদি সময় ও পরিস্থিতি ঠিক থাকে, আমার ইচ্ছা ছিল আদ্রিতার বিয়ে আপনার ছেলে অরুণের সঙ্গে হোক। আমি জানি, আপনার পরিবারে ও নিরাপদ থাকবে।”
চিঠিটি পড়ে আদ্রিতার চোখে জল চলে এলো। তার সমস্ত শৈশবের স্মৃতি যেন ঝড়ের মতো ফিরে এলো।
আদ্রিতা রাগান্বিত হয়ে অরুণের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি এই ব্যাপারটা জানো?” অরুন
অরুণ ধীর গলায় বলল,
“হ্যাঁ, জানি। মা আমাকে সব জানিয়ে রেখেছেন। আমি কখনো তোমাকে বোন হিসেবে ভাবিনি, কারণ আমার মনের গভীরে তুমি সবসময়ই অন্য একটি জায়গা দখল করেছ। আমি চেয়েছিলাম, তুমি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নাও। আমি তোমাকে কোনো চাপ দেব না, কিন্তু মা-বাবার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত বলেই মনে করি।”
আদ্রিতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার মনের ভেতর অগণিত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।
আদ্রিতা কয়েকদিন ধরে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করল। তার ভেতরে মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল—কৃতজ্ঞতা, দ্বিধা, এবং ভালোবাসা। একদিন সে সুমিত্রা দেবীর কাছে গিয়ে বলল,
“মা, আমি রাজি। আপনারা যা ভালো মনে করেছেন, সেটাই আমার ভালো হবে।”
বিয়ে হলো আদ্রিতা আর অরুণের। প্রথমদিকে একটু সংকোচ থাকলেও, ধীরে ধীরে তারা একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে গেল।
এইভাবে, দুটি প্রাণ এক হয়ে গড়ল একটি নতুন জীবন, যেখানে ছিল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আর মায়ের দেওয়া অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বাস।