অমল জেঠু
বাবা মারা যাবার পর থেকে পাঁচটা পনেরোর শ্রীরামপুর লোকাল ধরি। পড়ন্ত বিকেলে আমাদের মফস্সলে ফিরে আসি। এই বিকেল আলোর মধ্যে এসে মনে হয় আমার ছাত্রবেলায় এলাম। ভালই লাগে। বাবা যেন একটু তড়িঘড়ি করে সংসারটা আমার ঘাড়ে ফেলে গেল। সংসার বলতে তেমন কিছু না, একটা মস্ত বাড়ি, রুমালি বাগান, শূন্য শূন্য চেয়ার টেবিল, বিছানা। বিশাল বিশাল ফটো, পূর্বপুরুষদের। মায়ের ফটো অনেকদিন ধরেই দেওয়ালে ঝুলছে। রাশি রাশি বোবা বই, পড়ি না। আর দিতি, আমার বউ। এক বছরও হয়নি আমাদের বিয়ে হয়েছে। দিতির একা একা লাগে। ওর জন্যেই তাড়াতাড়ি ফিরে আসি। আমাদের বাড়িতে একসময় একান্নবর্তী পরিবার বাস করত। এখন আমরা স্বামী-স্ত্রীতে ঠেকেছে। অফিস ফেরতা এরকমই এক বিকেলে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট হচ্ছিল, দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ,— বরুণদা ধরো। দেবেশ বলটা ছুড়ে দিয়েছিল, যেন চ্যালেঞ্জ। পারিনি লুফতে। দেবেশ হাসতে হাসতে বলেছিল, তোমাদের চর্বি হয়ে গেছে। গায়ে লেগেছিল কথাটা। তার থেকেও বেশি খটকা লেগেছিল ‘তোমাদের’ কথাটা। ‘তোমাদের’ বলতে কাদের মিন করতে চাইল দেবেশ? তো যাই হোক ইদানীং পাড়ার মাঠ এড়িয়ে ঘুরপথে বাড়ি ফিরি। আজও ফিরলাম…
দিতি জল, চা দিয়ে সামনে বসেছে। স্বামী অফিস ফেরামাত্র অন্যান্য স্ত্রীদের মতন— জানো তো আজ না… বলে দিতি হামলে পড়ে না। এসব ব্যাপারে ওর আধঘণ্টা পজ আছে। আমিই জিজ্ঞেস করলাম, কোনও চিঠি আসেনি?
না। তবে দুপুরে অদ্ভুত এক ভদ্রলোক চাঁদা নিতে এসেছিলেন। বুড়ো। এই রোগা (কনিষ্ঠ আঙুল দেখাল)। চোখে হাইপাওয়ারের চশমা, হাঁটু অবধি ঢলঢলে পাঞ্জাবি, ঢোবকা পাজামা, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ, হাতে চাঁদার বিল। বিলটাও বেশ আশ্চর্যের, ছোট্ট বিল জুড়ে একটা এক টাকার কয়েনের ছাপ দেওয়া। চেহারা দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম এক্ষুনি হয়তো ভাঁজ খাওয়া কিছু প্রেসক্রিপশান দেখিয়ে বলবে, চিকিৎসা করাতে পারছি না, কিছু দিন মা। তা না বলে,কয়েনের ছাপ মারা দুটো বিলের পাতা ফট করে ছিঁড়ে এগিয়ে দিলেন। বললেন, নাইট স্কুল। কোনও ভূমিকা ছাড়া এভাবে কেউ চাঁদা চায়! আমি একটু রেগেমেগেই বলে দিলাম, বাড়িতে কেউ নেই, পরে আসুন। একটু থতমত খেয়ে গেলেন হয়তো, মুখটা নিভে গেল। আর কিছু না বলেই চলে গেলেন। তারপর থেকেই মনটা কীরকম খচখচ করছে। লোকটার সঙ্গে বোধহয় এ বাড়ির পুরনো সম্পর্ক, আমিই চিনি না। কে গো ভদ্রলোক?
দিতির বর্ণনা এত নিখুঁত, আমি সরাসরি বুঝতে পারলাম, ও অজান্তেই অমল জেঠুকে
ফিরিয়ে দিয়েছে। বিচ্ছিরি ব্যাপার। জেঠু হয়তো দুঃখ পেয়েছেন। দিতিকে নিয়ে এক্ষুনি একবার নাইট স্কুলে যেতে হবে। আলাপ করিয়ে দিতে হবে জেঠুর সঙ্গে। চাঁদাটাও দিয়ে আসব। অচেনা ভদ্রলোকের নাম জানার জন্যে দিতি এখনও আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। আমি বললাম, শাড়ি পালটে নাও চলো, তোমার সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দিই। সত্যিই ওঁর সঙ্গে এ বাড়ির বহু পুরনো সম্পর্ক। দিতি কিছুই বুঝতে পারছে না। চোখে বিস্ময় নিয়ে শাড়ি পালটাতে চলল। আমি বললাম, চলো রাস্তায় যেতে যেতে ওঁর সম্বন্ধে বলছি।
আমাদের বাড়ির পেছনে আমগাছতলায় একটা বিরাট মাটির হাঁড়ি আজও আছে। বিয়ের পর পর অত বড় হাঁড়ি দেখে দিতি চমকে গিয়েছিল। বলেছিল, ওরে বাবা তোমাদের সংসার এত বড় ছিল নাকি৷ আমি হেসে বলেছিলাম, হ্যাঁ সেসব পুরনো দিনে সংসার কখনও সখনও বেশ বড় হয়ে উঠত। প্রায়ই দু’বাংলা এক হয়ে যেত… তারপর কোনও কারণে হয়তো ওই হাঁড়ি বিষয়ে দিতিকে আর কিছু বলা হয়নি। বলা থাকলে ভাল হত। কেননা বিশাল হাঁড়িটার মধ্যেও অমল জেঠুর অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। গল্পগুলো আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে শোনা। দুর্ভিক্ষের সময় পাড়ার সবক’টা বাড়িতে একটা করে মাটির হাঁড়ি দিয়ে অমল জেঠু, মা-কাকিমাদের বলেছিলেন, মা-বোনেরা রোজ অল্প অল্প চাল, আলু এতে জমা করো। আমি হপ্তায় একবার এসে নিয়ে যাব।… অমল জেঠুর বৃত্তান্ত দিতে দিতে দিতিকে নিয়ে নাইট স্কুলে চলেছি। বাড়ি থেকে নাইটস্কুল বউকে নিয়ে হাঁটলে মিনিট পাঁচেক, একা হাঁটলে মিনিট তিনেক। সন্ধে গাঢ় হয়ে এসেছে। আলো অন্ধকার এবড়ো খেবড়ো গলি। আশপাশের বাড়ি থেকে টিভির পিকচার টিউবের ঝলকানি দেখতে পাচ্ছি, যেন আকাশের বিদ্যুৎ তৈরি করছে পরিবারগুলো। এ সবের মধ্যেই ব্রতকথা পড়ার মতো করে কোনও এক কিশোর পড়া মুখস্থ করছে।
জানো দিতি অমল জেঠু সেইসব বিরল ব্যক্তিদের একজন যারা দু’পর্যায় জেলে গেছেন; প্রথমবার স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, পরে কমিউনিস্ট পার্টি ব্যানের সময়। আমাদের এখনকার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওঁর একসময় তুই তোকারির সম্বন্ধ ছিল।
বাব্বা এত বড় লিডার! কিন্তু বাবার মুখে তো ওঁর নাম শুনিনি। (দিতি আমাদের পার্টির ওপরতলার নেতা সমীর রক্ষিতের মেয়ে)
লিডার বলতে যে গ্ল্যামার বোঝায় তা কোনওদিনই জেঠুর ছিল না। তিনি আজন্ম সামাজিক কর্মী। তবে ওঁর নাম করলে হয়তো তোমার বাবা চিনতেও পারেন। কথাটা বলে মনে হল, চিনতে পারবে কি দিতির বাবা? এখনকার লিডাররা অমল জেঠুকে মিউজিয়াম পিস করে দিয়েছে। তা ছাড়া পার্টি ভাগ হওয়ার পর জেঠু সিপিআইতেই থেকে যান। মফস্সলগুলোতে সিপিআই ক্রমশই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে, অমল জেঠুও সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হতে থাকেন। তখন তাঁর একমাত্র আঁকড়ে ধরার মতো বিষয় হল নাইটস্কুল। অকৃতদার মানুষটার ওই একটাই সন্তান।
বাবা কতদূর গো তোমার নাইট স্কুল? বলল দিতি। গলির পর তস্য গলির মধ্যে আমরা ঢুকে যাচ্ছি, যেন অতীতে চলেছি।
এই তো এসে গেছে। জানো দিতি একসময় নাইট স্কুলে আমিও পড়েছি।
নাইট স্কুল ব্যাপারটা ঠিক আমার মাথায় ঢুকছে না। একটু বুঝিয়ে বলবে? ওটা ঠিক স্কুল নয়। কোচিং ক্লাস বলতে পারো। বিভিন্ন ক্লাসের, বিভিন্ন বয়সের ও মেধার ছেলেরা একসঙ্গে একটা হলঘরে বসে পড়াশুনা করে। ক্লাস শুরু হয় সন্ধে ছ’টায়, শেষ রাত দশটায়। আমি যেমন ওই স্কুলে পড়েছি তেমনি আবার মাস্টারিও করেছি, বেকার অবস্থায়। মূলত গরিবদের স্কুলই বলতে পারো। সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় পড়ানো হয়। স্কুলের টুকিটাকি খরচা জেঠু বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে জোগাড় করেন।
তা তোমরা তো গরিব ছিলে না। তুমি ওই স্কুলে পড়তে কেন?
আমাদের ছোটবেলায় বাবারা ছেলেকে নাইট স্কুলে পড়ানো আদর্শ মনে করতেন। কেননা নাইট স্কুল স্বাধীনতার পরে পরেই তৈরি হয়। তখন স্কুলের গায়ে একটা বিপ্লব বিপ্লব গন্ধ ছিল। তবে একথা স্বীকার করতেই হয় কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরাই নাইট স্কুল প্রকৃত যত্নে গড়ে তোলে। সে সময় থেকেই অমল জেঠু আছেন। নাইট স্কুলের ছাত্রদের প্রত্যেককে পুজোর সময় নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয়। আমরাও একসময় পেতাম। তবে সে জামাকাপড় আমরা বাড়ির কাজের লোকেদের দিতাম।
কথা বলতে বলতে কখন যেন স্কুলবাড়ির সামনে পৌঁছে গেছি। ‘অন্নদা প্রাথমিক বিদ্যালয়’ টিনের বোর্ডের ওপর লেখা। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় কোনওক্রমে পড়া যাচ্ছে। দিনে প্রাইমারি স্কুল চলে। স্কুলের কর্তৃপক্ষ রাতে একটা হলঘর নাইট স্কুলকে ব্যবহার করতে দেয়। হলঘরের দরজার কাছে আমি আর দিতি দাঁড়িয়ে আছি। ‘এই স্কুলে একদিন পড়েছি’ কথাটা দিতির কাছে চেপে গেলেই ভাল হত। রাস্তায় আসতে আসতে নাইট স্কুলের যে বর্ণনা আমি দিতিকে দিয়েছি তা এক বর্ণাঢ্য কৈশোর স্মৃতি। সেই স্মৃতির সঙ্গে আমাদের সামনে এই হলঘরের কোনও মিলই নেই। এখানকার পড়ুয়াদের চেহারা আর আমাদের সময়কার ছাত্র-ছাত্রীদের চেহারার মধ্যে অনেক তফাত। এদের নোংরা পোশাক-আশাক। হলঘর জুড়ে একটা বোটকা গন্ধ। আসলে এখনকার পড়ুয়ারা সবাই অশিক্ষিত গরিবঘরের ছেলেমেয়ে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই দিনে রুটি রুজির জন্যে কোথাও না কোথাও কাজ করে আর রাতে পড়তে আসে। এখন একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখছি, অমল জেঠু পড়াচ্ছেন। আমাদের সময় কি তারও পরে জেঠুকে কখনও পড়াতে দেখিনি। উনি সব সময় সব ছাত্রছাত্রীর পেছনে লাস্ট বেঞ্চে বসে আমাদের পড়ানো দেখতেন আর ঘুমে ঢলে পড়তেন। উদয়াস্ত বনের মোষ তাড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে কখনও বা ঘুমিয়েই পড়তেন টেবিলে মাথা রেখে। তখন তাঁর মুখে পরম প্রশান্তি, একটা প্রজন্ম পড়াচ্ছে। কিন্তু আজ জেঠু পড়াচ্ছেন কেন! যত না পড়াচ্ছেন তার চেয়ে বেশি হইচই সামলাতেই ব্যস্ত। বেশ বিধ্বস্ত লাগছে জেঠুকে। আমাদের দেখে পড়া থামিয়ে এগিয়ে এলেন— কী ব্যাপার বরুণ তুমি হঠাৎ !
এ হচ্ছে আমার বউ দিতি। দুপুরে আপনাকে চিনতে পারেনি, তাই আলাপ করাতে নিয়ে এলাম।
না না তাতে কী হয়েছে। ওকে আবার সন্ধেবেলায় টেনে নিয়ে এলে কেন। একদিন না
একদিন ঠিকই আলাপ হয়ে যেত। তা তোমার বউটি কিন্তু বেশ হয়েছে। হ্যাঁ মা এবার চাঁদা নিতে গেলে ফিরিয়ে দেবে না তো?
দিতি হেসে ফেলে। বলে, আমায় মাফ করে দেবেন।
জেঠু বলেন, না না ছিঃ ছিঃ। তোমারই বা দোষ কী, তুমি তো আমাকে চেনোও না। আর তা ছাড়া আমার চেহারাটা কোনওদিনও খুব একটা ইমপ্রেসিভ নয়… জেঠু হাসছেন। আমি দু’টাকার নোট জেঠুকে বাড়িয়ে দিলাম। জেঠু পাঞ্জাবির পকেট থেকে কুপন বই বার করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার জেঠু আপনি পড়াচ্ছেন? আগে তো কখনও আপনাকে পড়াতে দেখিনি। দুটো এক টাকার কুপন কেটে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, এখন তো শুধু একটা ছেলেই পড়ায়, শ্যামল। তুমি চেনো। শ্যামল একা পেরে ওঠে না। আগের সেই অবস্থা তো আর নেই, এসব কাজের জন্যে ছেলে ছোকরারা আর এগিয়ে আসে না।
ফেরার পথে দিতি বলল, স্কুলটাকে ওরকম গরিব গরিব দেখতে কেন গো? অমল জেঠু তো একজন কমিউনিস্ট, রাজ্যেও কমিউনিস্ট সরকার। স্কুলটাকে অনুদান টান দেয় না কেন? দেখো দিতি, সরকারের কাজ এখন অনেক ব্যাপ্ত। এই ছোটখাটো জায়গায় নজর না পড়াই স্বাভাবিক। আমাদেরই উদ্যোগ নেয়া উচিত।
অ্যাই আমি যদি নাইট স্কুলে পড়াই, আমায় পড়াতে নেবে?
নেবে।
ব্যস তারপর নাইট স্কুল নিয়ে দু’মাস আমাদের মধ্যে কোনও কথা হয়নি।
দুই
আজ রবিবার। বাজার বেরোচ্ছি। গেট খুলে সাইকেল বার করতে করতে দেখি, অমল জেঠু এগিয়ে আসছেন। পরনে সেই একই পাজামা-পাঞ্জাবি। কাঁধের ব্যাগটা মাটি ছুঁই ছুঁই। বললেন, বরুণ, আজ ভাই একসঙ্গে দশটা কুপন নিতে হবে। বোঝোই তো, আজকাল সব কাজই আমায় একা একা করতে হয়। তাই এ মাসে একযোগে সামনের ক’মাসের চাঁদা নিয়ে নিচ্ছি। আবার সেই পুজোর সময় আসব।
আমি পার্স বার করতে করতে বললাম, জেঠু, আমি না হয় দিচ্ছি, বাকি সবাই কি দেবে?
অনুরোধ তো করছি, এখন অবধি কেউ ফেরায়নি।
জেঠুকে দশটাকা দিলাম। বললাম, জেঠু পাড়ায় তো এখন অনেক অনেক বাড়ি বেড়েছে, ফ্ল্যাটবাড়িও হয়েছে, ক’বাড়ি রেগুলার চাঁদা পান? তা প্রায় শ-চারেক বাড়ি।
বাব্বা। সে তো অনেক বাড়ি!
বাড়ি তো অনেক, কিন্তু বেশিরভাগই তো একটা কুপন নেয়। মাসে শ-চারেক মতো হয়। ওই ক’টা টাকায় কী হয় বলো? নেহাত আমি আর সাধনবাবু স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশনটা পুরো ডোনেট করি, তাই কোনওরকমে চলে যায়।
এটা আমি জানতাম, কিন্তু বিস্মরণ ঘটেছিল। জেঠুর এই ক্রমশ ঝুঁকে আসা ছোট্ট শরীরটা আবার আমার সামনে বড় হয়ে উঠতে লাগল। সকালের রোদ বেশ চড়া। জেঠু আমাদের বাড়ি সেরে পাশের বাড়ি যেতে যেতে বললেন, মাঝে মাঝে স্কুলে এসো বরুণ। তোমরা এলে ভাল লাগে, মনে হয় অ্যালবাম দেখছি।
সন্ধেবেলায় মনোজ আমাদের বাড়ি এল, অফিস ফেরতা। অবাক হলাম। ও এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত, পার্টির ওপর মহলে চলে গেছে। আমরা একসঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করেছি। আপাতত মনোজ অনেকগুলো অফিস ইউনিয়নের নেতা।
কী রে তুই হঠাৎ, এতদিন পরে!
কেন, আসতে নেই?
না মানে, তুই যা বিজি।
তো কী হয়েছে, একটা আড্ডা ফাড্ডা না মারতে পারলে মাথা পরিষ্কার হয় না। তোর বউ কোথায়, বউকে ডাক। বলে নিজেই ‘বউঠান’ করতে করতে ঘরে ঢুকে গেল। মনোজের চরিত্রে এই একটা বিরাট প্লাস পয়েন্ট, খুব সহজেই পরিস্থিতি নিজের আয়ত্ত করে নিতে পারে। মনোজ যে শুধুমাত্র আড্ডা মারতে আসেনি এ ব্যাপারে আমি শিয়োর। প্রচণ্ড করিতকর্মা ছেলে, কত অল্পদিনেই কোথায় উঠে গেল। কিন্তু আমার সঙ্গে ওর কাজটা কী! অবশেষে চা খেতে খেতে মনোজ আসল কথাটা পাড়ল।
হ্যাঁরে, তোদের পাড়ার অমলবাবু শুনছি কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছে? ভ্যাট।
না রে সত্যি, খবর আছে। সামনের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশানে কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হতেই পারে না। জেঠুকে আমি যতটুকু চিনি তাতে আমার মনে হয় পৃথিবী রসাতলে গেলেও অমল জেঠু কোনওদিন কংগ্রেসে যাবে না।
না গেলেই ভাল। শোন তোকে একটা কাজ দিচ্ছি। পার্টিই দিচ্ছে ধরতে পারিস। বুড়োটার ওপর লক্ষ রাখ। বুড়োটা চিরকালই তোকে একটু বেশি পছন্দ করে, যে করে হোক ওঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে চেপে দে, দুম করে না কংগ্রেসে চলে যায়।
দেখি, তবে আমার বিশ্বাস হয় না। এখনও যদি দু’-চারজন সাচ্চা কমিউনিস্ট এদেশে থাকে, তাদের মধ্যে অমল জেঠু অবশ্যই একজন।
দেখ বরুণ, তুই ওঁর প্রতি সফট আমি জানি। কিন্তু ওঁরও তো বয়স হয়েছে, এ সময় একটু আধটু ভীমরতি দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।
বয়স! ভীমরতি! জ্যোতিবাবুর বয়স কত? নরসিমা রাও?
ওঁদের কথা ছাড়। ওঁরা ট্যালেন্ট। তা ছাড়া সব সময় একটা সিস্টেমের মধ্যে আছেন, প্রসেসের মধ্যে আছেন।
আমি আর তর্কে গেলাম না। মনোজ চলে গেল। তবে যাবার আগে দিতিকে শুনিয়ে একটা খোঁচা দিয়ে গেল।
দিতি, তোমার বরের গলাটা স্বরটা কীরকম যেন পালটে গেছে মনে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে একটু আদা দেওয়া চা-ফা করে দিয়ো।
যতই মনোজকে উড়িয়ে দিই, ও কিন্তু ওর কাজ করে গেল। আমার মাথায় সন্দেহের বীজ পুঁতে দিল। একবার ভাবছি নাইট স্কুলে গিয়ে অমল জেঠুর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করি, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে বিষয়টা ওঁর কাছে সাংঘাতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। উনি অপমানিত বোধ করতে পারেন। মাঝখান থেকে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যাবে। ব্যাপারটা তাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। আবার যেমন অফিস আর বাড়ি। মাঝেমধ্যে পাড়ার পার্টি অফিস। ইলেকশান আসছে পার্টি অফিসে যোগাযোগ রাখতেই হচ্ছে। রোজ সন্ধেয় বসা হয়। পাড়ার ইয়ং ছেলেরাও আসছে, এমনকী দেবেশও! যে আমাকে এক পড়ন্ত বিকেলে আচমকা একটা ক্রিকেট বল ছুড়ে দিয়েছিল, লুফতে পারিনি। বলেছিল, তোমাদের চর্বি হয়ে গেছে। দেবেশের বাবা নিখিলস্যার, সদ্য রিটায়ার করেছেন। পেনশন আটকে গেছে। পার্টি অফিসে কিন্তু অমল জেঠুর কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার বিষয়টা এখনও এসে পৌঁছোয়নি। এটা মনে হচ্ছে একটু ওপর মহলের সন্দেহ। আমিও কোনও কথা তুলছি না।
সেদিন পার্টি অফিস থেকে বের হতে রাত দশটা বেজে গেল। সঙ্গে দেবেশ। ওই দেখাল আঙুল তুলে, একটু দূরে সুবোধদার মুদিখানার সামনে দিয়ে অমল জেঠু আর সনাতন হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে। সনাতন পাঁড় কংগ্রেস। ওদের অ্যাকটিভ কর্মী। দেবেশ বলল, ব্যাপার কী বরুণদা, সনাতনের সঙ্গে অমল জেঠু!
তাতে কী হয়েছে, জেঠুর সঙ্গে সবারই রিলেশান ভাল।
না রিলেশান অন্য জিনিস, আর রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসঙ্গে হাঁটা অন্য জিনিস। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলছিস কেন? হয়তো এক্ষুনি দেখা হয়েছে।
আরে না না দেখছ না, কীরকম আলোচনা চালাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আলোচনাটা ক’দিন ধরেই চলছে। আর সনাতন ধান্দা ছাড়া টাইম নষ্ট করে না।
অমল জেঠু আর সনাতন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। জেঠু হয়তো লক্ষ করেনি, সনাতন আড়চোখে দেখে নিয়ে বীরদর্পে জেঠুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে পেরিয়ে গেল। এই প্রথম আমার গা জ্বালা করে উঠল। অনেক দিন পর আবার পার্টির স্বার্থ আমার স্বার্থ একাকার হয়ে গেল। কাল একবার জেঠুর কাছে যেতেই হবে।
অফিসে মনোজের ফোন।
কী রে ব্যাপারটা খোঁজ নিয়েছিলি? কোন ব্যাপারটা?
আরে অমলবাবু!
ও হ্যা। তবে ডিটেলে আরও খোঁজ নিতে হবে।
কোনও ডিটেল খোঁজের দরকার নেই। আমরা খোঁজ নিয়েই তোকে বলেছি। তুই স্ট্রেট অমলবাবুকে ধর। মিউনিসিপ্যাল ইলেকশান অবধি যেন চুপচাপ থাকে।
দেখ, আমার মনে হয় জেঠু স্কুলটাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে। আমিও ক’দিন আগে নিজের চোখে স্কুলটা দেখে এসেছি। সত্যিই হতাশ হবার মতো অবস্থা। জেঠু পাশে কোনও ছেলে পাচ্ছে না। আর এই সুযোগটাই বোধহয় কংগ্রেসের ছেলেরা নিচ্ছে।
রাইট। ইটস এ রিয়েল অবসারভেশন। তা তোরা, পার্টির ছেলেরা কী করছিস? অমলবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়া।
হুঁ, দেখছি কী করা যায়।
দেখছি নয়, দেরি হয়ে যাবে। এইসব ইলেকশানে অমলবাবুর মতো পার্সোনালিটি যদি পাল্টি খায়, আমাদের রেজাল্ট ঘুরে যাবে। উনি একাই অনেক ক’টা ওয়ার্ডের ফলাফল ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। যাক ফোন রাখছি। টোটাল ব্যাপারটা নজরে রাখবি, প্রয়োজনে নিজেই সিদ্ধান্ত নিবি।
ফোন ছেড়ে দিল মনোজ। এখন আমার দুটো কাজ। কিন্তু কোনটা আগে করা উচিত হবে বুঝতে পারছি না। কাজ দুটো পর্যায়ক্রমে এই যে, পার্টি অফিসে অমল জেঠু ও তাঁর স্কুল নিয়ে আলোচনা করা এবং স্কুল পরিচালনার জন্যে কিছু ছেলেকে রিক্রুট করা। যারা ছায়ার মতো জেঠুর সঙ্গে লেগে থাকবে। আর একটা কাজ, কাউকে কিছু না বলে, একদম একা গিয়ে জেঠুর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করা। তবে সব থেকে উচিত হবে মনে হয়, জেঠুর সঙ্গেই আগে দেখা করা। তাঁর এই মুহূর্তের মানসিক অবস্থানটা বুঝে নেওয়া।
অফিস থেকে ফিরেই দিতিকে বললাম, তাড়াতাড়ি চা দাও। এক্ষুনি বেরোতে হবে। এই শুরু হল, চলবে ইলেকশান শেষ না হওয়া অবধি। বাবাকেও দেখেছি, তোমাকেও দেখতে হচ্ছে। তা কোথায় যাবে এখন শুনি? ইলেকশানের তো এখনও অনেক দেরি। নাইট স্কুল।
ওমা, আমিও যাব।
না আজ যেয়ো না। অমল জেঠুর সঙ্গে একটু পার্টি বিষয়ক আলোচনা আছে। দিতির মুখটা ভার হল। আবার পরক্ষণেই উৎফুল্ল হয়ে বলল, থাক যাব না। আজ টিভিতে স্বাভিমান আছে, তারপরই ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড।
আমার হাসি পেল। ভাবলাম, আজ সন্ধেতে আমিও চলেছি জেঠুর বহুদিনের অভিমান ভাঙাতে।
এখনও স্কুলে পৌঁছোতে মিনিট দুয়েক বাকি, স্কুলের হইচই এখান থেকেই কানে আসছে। রাস্তার হাল সত্যিই বেশ খারাপ। তার ওপর ল্যাম্পপোস্টগুলো কানা ভিখিরির মতন দাঁড়িয়ে আছে। এতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে এই রাতে স্কুল থেকে বেরিয়ে এমন জঘন্য রাস্তা দিয়ে কী করে যে বাড়ি ফেরে! স্কুলটাকে নিয়ে এবার ভাবতেই হবে। মিউনিসিপ্যালিটির
চেয়ারম্যান সিতুদাকে বলে রাস্তাটা ঠিক করিয়ে নিতে হবে।
স্কুলঘরে এসে পৌঁছালাম। আজ শ্যামল পড়াচ্ছে। আর অমল জেঠু সেই আগের মতো লাস্ট বেঞ্চে বসে ঢুলছেন। আমাকে দেখেননি।
শ্যামল পড়া থামিয়ে এগিয়ে এল, আরে বরুণদা। এসো এসো। বেশ কিছুদিন আগে একবার বউদিকে নিয়ে এসেছিলে শুনেছি। আজকাল তো কেউ আর বড় একটা আসে না এদিকে।
শ্যামলের সম্ভাষণে জেঠুর ঘুমঘোর কেটে গেছে। একদম লাস্ট বেঞ্চ থেকে মোটা কাচের চশমা সুদ্ধু আমার দিকে তাকালেন। কাচটা জ্বলজ্বল করছে, ঘরের কোনও একটা বাল্বের রিফ্লেকশান। কাচের আড়ালে চোখটা দেখা যাচ্ছে না। মুখে অর্থপূর্ণ হাসি। চোখটা দেখা গেলে হয়তো আন্দাজ করা যেত, উনি কী বলতে চাইছেন। জেঠুর হাসিটা সামান্য হলেও চওড়া হচ্ছে। হাসিটা হয়তো নেহাতই সৌজন্যমূলক, আসলে আমিই আমার প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী কল্পনা করে যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। উনি ইশারায় কাছে ডাকলেন। গেলাম। পাশে বসতে বললেন, বসলাম। শ্যামল পড়াতে শুরু করে দিয়েছে। যথারীতি হইচই আবার চালু। বুঝলাম এই চিৎকার চেঁচামেচিতে কথা বলা যাবে না। আবার যদি জেঠুকে বাইরে ডেকে নিয়ে কথা বলি, বিষয়টা প্রথম থেকেই সিরিয়াস দিকে চলে যাবে। তাতে জেঠুকে কনভিন্স করা কঠিন হয়ে যাবে। তার থেকে স্কুল ছুটি হোক, তারপর খুব ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচে কথা শুরু করতে হবে। এইসব যখন ভাবছি ঠিক তখনই জেঠু আমার কানে কানে বললেন, তুমি আসবে আমি জানতাম।
চমকে উঠলাম, কী করে জানলেন?
সেদিন কংগ্রেসের সনাতন আর আমি একসঙ্গে আসছিলাম, তুমি দেখেছ। তাই আর না থাকতে পেরে চলে এসেছ। এমনিতেই হয়তো কানাঘুষো শুনছিলে, আমি কংগ্রেসের সঙ্গে একটু মাখামাখি করছি।
আমার সমস্ত প্রস্তুতি ভেঙে খানখান হয়ে গেল (যেন আওয়াজ পর্যন্ত পেলাম)। থ হয়ে বসে আছি। কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। কেউ কি বিশ্বাসঘাতকতা করল? কেই বা করবে, কেনই বা করবে! এখানে তো ব্যাপারটা কেউ জানে না। জেঠু আবার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, একটু পরে কথা বলছি। এক্ষুনি ছুটি হয়ে যাবে। কেন? আজ এত তাড়াতাড়ি!
টিভিতে হয়তো আজ কিছু একটা ধুন্ধুমার আছে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে এসেই বলেছে, আজ তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবে। এসব ছেলেমেয়েদের দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে, যে এদের অনেকের বাড়িতেই টিভি আছে, কেব্ল লাইন আছে? এদের বাবা-মা’রা বাজারে মাছ বেচে, রিকশা চালায়। ছেলেমেয়েকে খেতে পরতে ঠিকমতো দিতে না পারুক, টিভি দেখার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। দেখো না সন্ধেবেলা রাস্তাঘাট কীরকম ফাঁকা হয়ে যায়।
তা বলে আপনিও সবাইকে ছুটি দিয়ে দেবেন! টিভির জন্যে! ওদের তো এসময় স্কুলেই রাখা উচিত।
তা হলে কাল থেকে স্কুলে আসবে না।
না আসুক, এদের নিয়ে কিছু করার থেকে না করাই ভাল। আগ্রহ না থাকলে এরা তো পড়াশুনা কন্টিনিউ করতে পারবে না। আপনার পরিশ্রমটাই জলে যাবে! তা হলে আমি কী করব? কী নিয়ে থাকব?
আপনি তো এরকম ছিলেন না জেঠু! নিজের ইনভল্ভমেন্ট বজায় রাখার জন্যে, আপনি এতটা আপস করবেন!
করব। তোমাদের সময় ছিল আলাদা, তখন অনেক বড়ঘরের ছেলেমেয়ে এখানে পড়তে আসত। এখন আসে না। কিছু ছাত্র আসে যাদের অভিভাবকদের প্রাইভেটে টিউশান পড়ানোর সামর্থ্য নেই, বাকি বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই আসে অশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবার থেকে। সারাদিন এখানে ওখানে কাজ করার পর, তারা যখন বই খাতা নিয়ে এই ঘরে এসে দাঁড়ায়, শ্রদ্ধায় আমার মাথা নিচু হয়ে আসে। আমি আর হিসেব করি না, তারা এতক্ষণ ধরে শিখল, কতটা শিখল। তো এইসব ছেলেমেয়ের জন্যে তোমরা কী করেছ? কিচ্ছু না। অথচ এরকম কথা ছিল না। ফলে আমি একা এবং ক্রমপর্যায় আপস করেই চলেছি। কিছু তো একটা করতে হবে বরুণ।
অমল জেঠু থামলেন। শ্যামল ছেলেদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সব একে একে অমল জেঠুকে বলে যাচ্ছে, জেঠু আসি। জেঠু মিষ্টি হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিচ্ছেন। এ নিয়মটা আমাদের সময়ও ছিল। এখনও আছে দেখে বেশ ভাল লাগল। শ্যামল ঘরের চারটে বাল্বের মধ্যে তিনটে নিভিয়ে দিল। তিনটে ফ্যানের মধ্যে দুটো অফ করে দিল। শুধু আমাদের মাথার একটা বাল্ব আর একটা ফ্যান চলছে। জেঠু আসি, বরুণদা আসি, বলে শ্যামলও চলে গেল। আমরা চুপচাপ। আমি ভাবছি, জেঠু শুরু করবেন। আর উনি ভাবছেন, হয়তো আমি শুরু করব। দূর রাস্তা থেকে এখনও ছাত্রদের বাড়ি ফেরার উল্লাস ভেসে আসছে। আমি শুরু করলাম, জেঠু আপনার তো বয়স হল, এই স্কুল চালানো সত্যিই এখন আপনার ওপর চাপের হয়ে যাচ্ছে। তাই ভাবছি এবার পার্টির ছেলেদের নিয়ে একটা মিটিং করব। স্কুল পরিচালনা ব্যাপারটা সবাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দেব। তবে আপনিই থাকবেন প্রধান।
আমি এতদিন যা পারিনি, তা তুমি একটা মিটিং করেই করে দেবে!
না, মানে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
হঠাৎ এতদিন পর স্কুল নিয়ে পড়লে কেন? আরও তো অনেক কাজ আছে, শিল্পায়ন, হকার উচ্ছেদ…
এবার আমি কী বলি? চুপ হয়ে গেছি। মনে পড়ল মনোজের কথা, শালা বড় লিডার হয়েছে, পড়ত এরকম প্রাজ্ঞর পাল্লায়, দেখতাম কী করে বেরোয়। পাখার একটানা ঘটঘট শব্দের মধ্যে জেঠুই আবার শুরু করলেন, বরুণ তোমার জন্মেরও দশবছর আগে থেকে আমি রাজনীতি করছি। আমি জানতাম তোমরা আসবে। তবে ভালই হয়েছে তুমি এসেছ। তুমি তবু কথাগুলো মন দিয়ে শুনছ, ওরা শুনবে না। একটা কথা স্পষ্ট বলেই দিই তোমাকে, নাইট স্কুলকে কিছুতেই আমি তোমাদের পার্টির কৃতিত্বের ঝুলিতে ফেলব না। নাইট স্কুল কোনও দেয়ালে সাঁটা ভোট চাওয়ার পোস্টার নয়।
আর কীই বা আমার বলার থাকতে পারে। আরও কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর জেঠু বললেন, চলো যাওয়া যাক, বেশ রাত হল। তারপর একে একে লাইট, পাখা বন্ধ করে, দরজায় তালা দিয়ে দিলেন। আমরা আধো অন্ধকার রাস্তায় নেমে এলাম।
পরের দিন সোজা মনোজের অফিসেই চলে গেলাম। যথারীতি সিটে নেই। তবে ওর চেয়ার টেবিল ঘিরে ছ’জন ও পাঁচজনের দুটো দল দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে মনোজ সম্ভবত এক্ষুনি ফিরবে। ছেলেগুলো নিশ্চয়ই কোনও প্রাইভেট কোম্পানির ইউনিয়ন মেম্বার। এদের প্রেসিডেন্ট মনোজ। এই অফিসপাড়ায় অগুনতি দোকান ও অফিসের ইউনিয়ন মনোজই সামলায়। এলেম আছে! অথচ ওর অফিসটা সরকারি। ও নিজেই এক গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে। থোড়াই কেয়ার… ঘণ্টাখানেক পর মনোজ ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলো ওকে ঘিরে ধরল। ওদের উদ্বেগকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে, ছোট্ট ধমক দিয়ে অপেক্ষা করতে বলে, আমায় ডাকল, গেলাম। ওর পাশের চেয়ারে বসে সবিস্তারে অমল জেঠুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বৃত্তান্ত দিলাম। অতঃপর জিজ্ঞেস করলাম, এরপর আমার কী করণীয়? এর মাঝে চা-ও এসে গিয়েছিল। মনোজ চা খেতে খেতে চোখ কুঁচকে প্রত্যেকটি কথা শুধু শুনলই না, পড়লও। তারপর বলল, ঠিক আছে তুই যা, আমি দেখছি। কাল কি পরশু তোদের পাড়ার পার্টি অফিসে যাব। তখন কিছু একটা পরিকল্পনা করা যাবে। মনোজকে অনেকদিন পর আবার বেশ ক্লাসমেট মনে হল। ও বুঝেছে, যে দায়িত্ব আমাকে ও দিয়েছিল তার যোগ্য আমি নই। বেশ হালকা লাগল নিজেকে। চা-সিগারেট শেষ করে চলে এলাম।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে পার্টি অফিস যাইনি। মনটা কীরকম তেতো হয়ে আছে। ওদিকে মনোজ কী করল না করল কিছুই খবর পাইনি। অফিস আর বাড়ি। মাঝে একদিন দিতিকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাকাডেমিতে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম। পাড়াতে, পার্টিতে কেন জানি মিসফিট হয়ে গেছি। অথচ আমাদের মতো মফস্সলে ফ্ল্যাটবাড়ির লোকেদেরও অনেক সামাজিক থাকতে হয়। শনিবার সন্ধেয় দেবেশ এসে খবর দিল, কাল সকাল ন’টায় স্কুলের ঘরে মিটিং আছে। মনোজ নিজে আসছে, আমাকেও যেতে বলেছে। অগত্যা যেতে আমাকে হবেই। তার মানে রবিবারে সকালটা গোল্লায় গেল।
স্কুলঘরের বাইরে প্রচুর চটি। বিভিন্ন রকম দেখতে। এরা সবাই একমত হতে এসেছে। ঘরে ঢুকে দেখি, বেঞ্চে বসে বেশির ভাগ ছেলেপুলেই আমাদের পার্টির। আর জনা চারেক যে কজন বয়স্ক মাথা আছেন, তাঁরাও আমাদের সমর্থক। মনোজের সাংগঠনিক তৎপরতা তারিফ করার মতো! ইদানীং কোনও মিটিং ডাকলে জনা সাত-আটের বেশি লোক হয় না। আজ পুরো পাড়া হাজির। দু’-একটা কংগ্রেসি বাড়ি অবশ্য বাদ পড়েছে। মিটিং-এর অ্যাজেন্ডা এখনও জানি না। কিছুটা হয়তো ধারণা করতে পারছি। মনোজ কমরেড পরিবেষ্টিত হয়ে
তিন
বসে আছে। আমায় ইশারায় ডাকল। ওর পাশে গিয়ে বসলাম। চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার কীসের মিটিং?
অপেক্ষা কর, এক্ষুনি জানতে পারবি।
হঠাৎ সমস্ত গুঞ্জন থেমে গেল। চোখ তুলে দেখি অমল জেঠু ঘরে ঢুকছেন, সঙ্গে শ্যামল। জেঠু সকলের উদ্দেশে হাত জোড় করে প্রণাম জানালেন। তারপর টিচারদের চেয়ারে বসে সামনের টেবিলে ঝোলাটা তুলে রাখলেন। এখন উনি আমাদের মুখোমুখি। শ্যামলের হাতেই কিছু ফাইলপত্তর ছিল, সেগুলো শ্যামল টেবিলের ওপর রেখে অমল জেঠুর পাশে দাঁড়াল। চোখ থেকে ভারী চশমাটা খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে জেঠু বললেন, মূলত আমাকে নিয়েই যখন এই মিটিং, তখন আশা করি আমার এই বিশেষ চেয়ারটি দখলদারিতে আপনাদের সুবিধেই হবে। আলোচনাটা সরাসরি হবে।
বুঝলাম জেঠু বেশ ফর্মে আছেন। প্রত্যেকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অমল জেঠুর দিকে। হয়তো গতকালই একটা বিবর্ণ পাঞ্জাবি পরে পাড়ায় পাড়ায় চাঁদার কুপন নিয়ে জেঠু ঘুরেছেন। আজ সবার দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ার জন্যে বেশি উজ্জ্বল লাগছে। একেই বোধহয় বলে লাইমলাইট। কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর অমল জেঠু মনোজের উদ্দেশে বললেন, কী মনোজ তুমি শুরু করবে, না আমি করব?
আপনিই বলুন।
জেঠু নিজের ঝোলা থেকে পিন আঁটা তিন-চারটে ফুলস্কেপ পাতা বার করলেন। এবার সেটা ডানহাতে উঁচু করে তুলে সবাইয়ের উদ্দেশে বললেন, আমার নিশ্চিত ধারণা এই কাগজক’টা আপনারা দূর থেকে দেখেই চিনতে পারছেন। কারণ এতে আপনাদের প্রায় প্রত্যেকেরই সই আছে, সামান্য দু’-একজন ছাড়া। যে কয়েকজনের স্বাক্ষর এতে নেই, তাঁরা ঘটনাচক্রে আমার খুব কাছের লোক। আমাকে অপমান করার জন্যে তাঁদের মনে এখনও ততটা প্রস্তুত নয়, সেই প্রস্তুতি নিতে তাঁরাও এখানে এসেছেন দেখতে পাচ্ছি।
আমার পাশ থেকে মনোজ ফোঁস করে উঠল, ওই চিঠিতে কোথাও আপনাকে অপমান করা হয়নি।
ভাই মনোজ, ধরো তোমার বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ, তুমিই একমাত্র রোজগেরে। সেই রোজগারও যথেষ্ট নয়। এদিকে তোমার বোনের বিয়ে। জ্যাঠা, মামা হয়তো বা কিছু অর্থ সাহায্য করলেন। তোমারই ব্যয় হল প্রচুর, খাটুনিও গেল অনেক। বিয়েটা উতরে গেল। তারপর যদি কোনও ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়, যিনি বিয়েতে শুধু একটা শাড়ি নিয়ে খেতে এসেছিলেন, তিনি যদি বোনের বিয়ের খরচা খরচের হিসেবটা তোমার কাছে দেখতে চান, সেটা কি অপমানজনক নয়? তোমার কি আঁতে লাগবে না? হয়তো লাগবে না, আমার লাগে। যাঁরা নাইট স্কুল নিয়ে মাসে একবারও ভাবেননি, শুধু আমি যখন চাঁদার কুপন নিয়ে যাই তখনই তাঁদের মনে পড়ে, আরে তাই তো, নাইটস্কুল বলে পাড়ায় একটা ব্যাপার আছে তো। তো তাঁরা যখন আচম্বিতে নাইট স্কুলের অর্থবিষয়ক হিসাব চায়, আমার আঁতে লাগে।
মনোজ বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, চিঠিতে কিন্তু আপনাকে কখনও কোথাও অবমাননা
করা হয়নি। চিঠিটা ঠান্ডা মাথায় পড়লেই বুঝতে পারবেন।
এই পঁচাত্তর বছর বয়সে, এখন কি আর মাথা গরম থাকে? আমি ঠান্ডা মাথাতেই পড়েছি, দারুণ ভাষা! চিঠি জুড়ে সব সময় চেষ্টা করা হয়েছে, আমি যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হই। কে লিখেছে চিঠিটা? বড় ভাল তার ভাষা, অনেকটা ফাঁসুড়ের মতন, যেন দড়িতে মোম লাগাচ্ছে।
আপনিই যথার্থই সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ছেন। নাইট স্কুল নিয়ে একা একা কাজ করে, স্কুলটা আপনার কাছে সন্তানের মতো হয়ে গেছে। বাস্তবে তা তো নয়, স্কুলটা পাবলিক মানিতে চলে। তাই যখন চলে, তখন একটা কমিটি দরকার, হিসাবপত্তর রাখা দরকার। এটাই তো স্বাভাবিক। আর এই কথাই তো চিঠিতে লেখা আছে। ধরুন আজ যদি এই মিটিং-এ কোনও কমিটি তৈরি হয়, সেই কমিটি তো সংস্থার আর্থিক পরিস্থিতি বুঝে নেবেই। সেই কারণেই আপনাকে আজকের মিটিং-এ বিগত বছরগুলোর হিসেবপত্তর নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। বলল মনোজ।
আমি এনেছি। এই নাও। বলে, ঝোলা থেকে একতাড়া জেরক্স কপি বার করলেন। শ্যামল সবার মধ্যে একটা একটা করে বিলিয়ে দিল। আমিও পেলাম একটা কপি। বিগত পাঁচ বছরের হিসেব, পড়লাম। একদম পাই টু পাই মেলানো আছে। জেরক্স কপি থেকে চোখ তুলে একবার মনোজের দিকে তাকালাম, একবার জেঠুর দিকে। জেঠু প্রথমে আমাকেই বেছে নিয়ে বললেন, কী বরুণ, ঠিক আছে হিসেবটা? আমিও সোৎসাহে বলে উঠলাম, হ্যাঁ, সব তো ঠিক আছে! এবার অমল জেঠু বাকিদের জিজ্ঞেস করলেন। সেখান থেকেও ক্ষীণ হ্যাঁ বাচক শব্দ ভেসে এল। মনোজও বলল, হ্যাঁ ঠিকই তো আছে। এবার তা হলে পরের প্রসঙ্গে আসা যাক…
মনোজের কথার মধ্যে জেঠু যেন কোনও অতল থেকে বলে উঠলেন, মনোজ, প্রসঙ্গটা এখনও শেষ হয়নি, হিসেবটা ঠিক নেই। যে হিসেবটা আমি দিয়েছি, সেটা একটা ধাপ্পা। অনেকটা তোমার এই চিঠির সইগুলোর মতো জালি। তুমি তো অনেকদিন এ পাড়ায় আসো না, তাই লক্ষ করতে পারোনি যে, এই চিঠির নীচে এমন কিছু লোকের সই আছে, যারা অনেকেই এখন জীবিত নেই, এবং আরও কিছু লোকের সই আছে তারা এ পাড়া থেকে অনেকদিন আগেই উঠে গেছে। কাকে দায়িত্ব দিয়েছিলে, ভোটার লিস্ট দেখে নামগুলো চিঠিতে তুলে দিতে? তবে ছেলেটার এলেম আছে বলতে হবে, নকল সইগুলো সে বেশ আলাদা আলাদা করে করতে পারে! আর আমার হিসেবটাও একজন ধুঁদে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্টকে দিয়ে করানো। সে দুয়ে দুয়ে চার করে দিয়েছে।
সারা হল নিস্তব্ধ। পুরনো ফ্যানেরাও যেন চুপ। রাস্তা থেকেও সাইকেল ঘণ্টি, রিকশার আওয়াজ কিছুই ভেসে আসছে না। জেঠু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, সকলের দিকে আবার জোড় হাত করলেন, মুখে কিছু বললেন না। তারপর পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বার করলেন, শতচ্ছিন্ন সেটা। এবার একদম অন্য গলায় বললেন, এই নোটবুকটায় আমার গত পাঁচ বছরের সব হিসেব আছে। অথচ আমি আর শ্যামল গত দুদিন দু’রাত জেগেও হিসেবে মেলাতে পারিনি। আমায় মাফ করবেন। বলেই জেঠু ধপ করে চেয়ারে
বসে পড়লেন। ভাবলাম দৌড়ে যাই, উঠতেই পারলাম না, পা দুটো কখন জানি আমাকে না জানিয়েই স্থবির হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙে মনোজ অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় শুরু করল (যেন কিছুই হয়নি তো), আমরা এতক্ষণ অমলবাবুর কথা অনুযায়ী স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ওঁর এখন যা বয়স এবং শারীরিক, মানসিক ক্ষমতা যা, তাতে এত বড় একটা কাজ তাঁর একার ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমাদের এগিয়ে আসতেই হবে, তাঁর নির্দিষ্ট পথেই আমাদের চলতে হবে। তাঁর পরামর্শই আমাদের পাথেয়।…
মনোজকে মাঝপথে থামিয়ে জেঠু বললেন, ভাই মনোজ, এখন আমি উঠি। বাড়িতে কয়েকজন পুরনো বন্ধু আসবেন। তা ছাড়া এখন বোধহয় এখানে আমাকে খুব একটা দরকার নেই। তুমি তো আছই। আর হ্যাঁ, ওই প্রেসিডেন্ট পদটা আমায় দিয়ো না, ওটার যোগ্য আমি কোনওদিনই নই।
অমল জেঠু ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমার পায়ে সাড় ফিরে আসছে, উঠে এলাম। উনি রাস্তায় নেমে পড়েছেন। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছু বলবে?
না। তবে আপনি তো আরও কিছু বলতে পারতেন, আরও অনেককিছুই তো বলার ছিল আপনার।
আজ আর কিছুই বলার দিন নয় বরুণ, আজ শেখার দিন। এতদিন পার্টি করার পর এই প্রথমবার আমি নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করলাম, সর্বহারা আসলে কাকে বলে!
অমৃতলোক, ১৯৯৭