Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আস্তানায় দস্যু বনহুর || Romena Afaz

আস্তানায় দস্যু বনহুর || Romena Afaz

ঘর্মাক্ত দেহে কালি মাখা অবস্থায় বনহুর ইঞ্জিন-কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। বোম্বে পৌঁছতে আর মাত্র একটি দিন বাকি। বনহুর অধৈর্য হয়ে উঠেছে–শুধু নূরীর সাক্ষাৎ কামনাই তার বাসনা নয়, নূরীকে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে সরিয়ে আনাই তার উদ্দেশ্য।

নির্জন ডেকে দাঁড়িয়ে ভাবছে নানা কথা।

এমন সময় নীহার এসে দাঁড়ালো তার পাশে। বনহুর ওর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো, কেমন যেন বিষাদময় করুণ চেহারা। এলোমেলো চুল, প্রসাধনবিহীন মুখমন্ডল। চোখেমুখে যেন একটা উদাস ভাব পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে তার। এ ক’দিন নীহারের সাক্ষালাভ ঘটেনি একটিবারের জন্যও। বনহুর সহসা কোনো কথা বলতে পারলো না। নীহারের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, তাকালো সম্মুখস্থ সীমাহীন জলরাশির দিকে। বনহুর অন্তর দিয়ে এ ক’দিন উপলব্ধি করেছে নীহার তাকে কতখানি ভালবেসে ফেলেছিলো। যদিও সে ওকে কোনো সময় এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়নি বা প্রশ্রয় দেয়নি তবুও নীহারের মনটা যে সম্পূর্ণরূপে তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে সহজভাবেই অনুভব করেছে সে। অবশ্য আজ শুধু নয়, এমনিভাবে আরও কতদিন কত নারীর মনে সে নিজের অজ্ঞাতে রেখাপাত করেছে যার জন্য বনহুর কিছুমাত্র দায়ী বা অপরাধী নয়।

নীহারের প্রতি করুণায় ভরে উঠে বনহুরের মন। সুন্দর ললাটে চিন্তার ছাপ পড়ে, নিজকে সচ্ছ করে নেবার জন্য প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নি। সংযোগ করে।

নীহার স্তব্ধ প্রতিমার মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ায়।

বনহুর মুখ ফিরিয়ে একমুখ ধোয়া সম্মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলে–শোন।

থমকে দাঁড়ায় নীহার, দৃষ্টি তখনও নত ছিলো ওর।

বনহুর সরে আসে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে, নীহারের নত মুখখানা তুলে ধরে–নীহার, কি হয়েছে তোমার?

চট করে কোনো জবাব দিতে পারে না নীহার শুধু চোখ দু’টো তুলে তাকায় বনহুরের দিকে।

বনহুর একটু হাসবার চেষ্টা করে বলে–তোমাকে কষ্ট দেবার জন্যই আমি এ জাহাজে এসেছিলাম, তাই না? নীহার, আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না তুমি?

হঠাৎ নীহার উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠে বনহুরের বুকে মুখ লুকায়, বলে সেনা না না, আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। কেন তুমি আমার মনকে এভাবে চুরি করে নিয়েছো? কেন তুমি এসেছিলে এ জাহাজে? কেন তুমি ডুবে মরে যাওনি সেদিন ঐ সাগরের জলে।

নীহার, ঠিকই বলেছো। সেদিন সাগরবক্ষে মৃত্যু হলে আমি বেঁচে যেতাম। কিন্তু অদৃষ্ট আমাকে সে সুযোগ দেয়নি আমি তাই আজও বেঁচে আছি–একটু নিশ্চুপ থেকে বলে বনহুর — নীহার, যদি বলো এই মুহূর্তে আমি সাগরবক্ষে নিজকে বিসর্জন দিতে পারি। বনহুর নীহারের হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে–তাহলে তুমি নিশ্চয়ই স্বস্তি পাবে।

নীহার পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ।

বনহুর নীহারের হাতখানা মুক্ত করে দিয়ে পিছন ডেকের দিকে এগিয়ে যায়, দক্ষিণ হস্তের সিগারেটটা ইতিপূর্বে নিক্ষেপ করেছিলো দূরে।

পিছনের নির্জন ডেকে এসে দাঁড়ালো বনহুর, বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছে, মুখমন্ডল তার সচ্ছ-স্বাভাবিক।

নীহার এখনও ঠিক পূর্বের স্থানে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু দৃষ্টি তার চলে গেছে বনহুর যেখানে ডেকের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেইখানে। মনের মধ্যে আলোড়ন চলেছে নাইবা পেলো ওকে, তা বলে মরবে ও! বেঁচে থাকুক, হয়তো আবার সে ফিরে আসবে একদিন। তবুতো মন জানবে, এ পৃথিবীর শামিয়ানার নিচেই যে আছে, যে পৃথিবীর তলায় আছে নীহার। যাকে ভালবাসা যায় তার অমঙ্গল চিন্তা করা যায় না, কি করে ওকে মৃত্যুর হীমশীতল কোলে নির্বাসন দেবে! তা হয় না, আলমকে মরতে দেবে না। আলমই যে তাদের রক্ষাকবচ, কি ভয়ঙ্কর মৃত্যু-বিভীষিকা থেকেই না সে তাদের বাঁচিয়েছে–একবার নয় কতবার। তার পিতার ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ অভিযান সার্থক হয়েছে, সেও ঐ ওরই জন্য। আর সে-ই কিনা মরবে, শুধু তাকে সুখী করার জন্য নিজকে বিসর্জন দেবে?

নীহার ক্ষণিকের জন্য ভেবে নিলো, তারপর দ্রুত ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে ফেললো বনহুরকে–না না, মরতে তোমাকে দেবো না।

বনহুর গম্ভীর-স্থির কণ্ঠে বললো–কোনো লাভ হবে না আমি বেঁচে থাকলে তোমার।

জানি! কিন্তু বেঁচে থাকবে সেটাই যে হবে আমার পরম সান্ত্বনা!

নীহার!

না না, আর তুমি আমাকে নীহার বলে ডেকো না আলম। ঐ ডাক আমাকে পাগল করে তোলে, আমি–আমি হারিয়ে ফেলি নিজেকে।

তাহলে–

তুমি নাবিক, আমি মনিব কন্যা–কাজেই আমাকে–কণ্ঠ আটকে আসে নীহারের, অশ্রু ছলছল চোখ দুটো কেমন যেন তীক্ষ্ণ মনে হয়। মুহূর্ত দাঁড়ায় না আর নীহার সেখানে ছুটে চলে যায়।

বনহুর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটা ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠে তার মুখে। আর কয়েক ঘন্টা আছে সে এ জাহাজে, তারপর এ জাহাজ থেকে বিদায় নিয়ে সে চলে যাবে, কোনো সম্বন্ধ আর থাকবে না এ জাহাজের কারো সঙ্গে। হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না, এদের স্মৃতি তলিয়ে যাবে কোন্ অতলে। তবে এ কথা সত্য পর্যটন জাহাজের প্রতিটি কথা তার মনে আঁকা হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয় হয়ে।

ঐদিনের পর নীহারের সঙ্গে বনহুরের সাক্ষাৎ ঘটেছিলো একবার কিন্তু কোনো কথা হয়নি তাদের মধ্যে। শুধু নীরব দৃষ্টি বিনিময় ঘটেছিলো এই যা। বনহুর বেশ অনুভব করেছিলো– নীহারের ভিতরটা মোটেই সুস্থ বা স্বাভাবিক নয়। একটা অসহ্য জ্বালা ওকে দাহ করে চলেছে তা স্পষ্ট বোঝা যায় ওর মুখোভাবে।

জাহাজ বোম্বের অদূরে কারোইয়া বন্দরে পৌঁছলে নাবিক আলমকে বিদায় জানাতে সমবেত হলো জাহাজ ‘পর্যটন’ এর যাত্রীবৃন্দ। আজ আর আলমের কোনো শত্রু নেই এ জাহাজে। পর্যটনের মালিক আবু সাঈদ সাহেব হতে নাবিক এবং খালাসিগণ সবাই ব্যথা-কাতর অন্তর নিয়ে আলমকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে এগিয়ে এলো। জাহাজের প্রত্যেকেই ওকে বিদায় জানাতে গিয়ে নীরবে অশ্রু মুছলো।

বিদায়ের শেষ মুহূর্তে বনহুর অবাক হলো–সবাই যখন তাকে বিদায় জানাতে এলো তখন তাদের মধ্যে শুধু দেখতে পেলো না বনহুর আবু সাঈদ কন্যা নীহারকে।

বনহুরের অতৃপ্ত আঁখি দুটিও যেন অনন্ত পিপাসা নিয়ে খুঁজে ফিরছিলো একখানা ব্যথা-কাতর করুণমুখ। জাহাজ ‘পর্যটন থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে সে–আর কোনোদিন এ জাহাজে ফিরে আসবে কিনা জানা নেই। তাই বনহুর একবার জাহাজের প্রতিটি প্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ কামনা করে। সহস্র ভীড়ের ফাঁকে একবার দেখতে চায় সেই মুখ খানাকে, যে মুখ তার মনকেও বিচলিত করে তুলেছিলো কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে। অন্তরের নিভৃত কোণে একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করে, ঐ বিদায় যেন তার কাছে সম্পূর্ণ সচ্ছ মনে হয় না।

কেশব সামান্য কিছু আসবাবসহ এসে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে–বাবু, ফুলমিয়া আমাদের সঙ্গে যেতে চায়।

গভীর একটা চিন্তার অতলে তলিয়ে গিয়েছিলো বনহুর, কেশবের কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে। আসে তার চোখ তুলে বলে- ফুলমিয়া আমাদের সঙ্গে যেতে চায়?

হা বাবু।

কিন্তু আমি কোথায় যাব নিজেই তো জানি না এখন।

কেশব কিছু বলবার পূর্বে পিছন থেকে সরে আসে ফুলমিয়া –দেখেন বাবু সাহেব, আমাকে আপনি নিয়া চলেন।

ফুলমিয়া, তুমি আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?

যেখানে আপনি যান সেখানে যাবো। দুনিয়ায় আপনজন বলতে আমার কেউ নেই, আমি চিরদিন থাকবো আপনার সঙ্গে।

বনহুর কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো ফুলমিয়ার দিকে।

সেই অবসরে বললো কেশব–বাবু ওকে ছেড়ে যাবেন না। ফুলমিয়া আমাদের সঙ্গে থাকলে। ভালই হবে।

বেশ, আমার সঙ্গে কষ্ট যদি মাথা পেতে নিতে চাও তবে চলো। তবে হাঁ আমি কোনো সময় তোমাদের দূরে সরিয়ে দেবো না, যদি যাই আমিই যাবো।

ফুলমিয়া অতোশত বোঝে না। আলম যে তাকে সঙ্গে নিতে রাজি হয়েছে এটাই তার বড় সৌভাগ্য। খুশি হলো ফুলমিয়া।

আবু সাঈদ বিদায় মুহূর্তে বনহুরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন –আলম, তোমাকে দেবার মত আমার কিছু নেই। তুমি যে উপকার করেছে তার মূল্য হয় না। আমার যথাসর্বস্ব দিলেও আমি তৃপ্তি পাবোনা। এই নাও এক লক্ষ টাকার একখানা চেক তোমাকে দিলাম–প্রয়োজন হতে পারে।

হাসলো বনহুর–চেকের কোনো প্রয়োজন হবে না স্যার। আপনার অন্তরে স্নেহ আর প্রীতির। কথা চিরদিন স্মরণ থাকবে। বনহুরের চোখ দুটো নিজের অজ্ঞাতে একবার ঝাপসা হয়ে এলো। বনহুর নিজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পুটলিটা পিঠে তুলে নিয়ে অগ্রসর হলো।

কিছুদূর এগুতেই সম্মুখে এসে দাঁড়ালো নীহার ঝড়-বিধ্বস্ত ছিলতার মত বিষণ্ণভাবে।

বনহুর চমকে উঠলো–তুমি!

বললো নীহার–হাঁ আমি। আলম, ফুলমিয়াকে তুমি গ্রহণ করতে পারলে আর আমি তোমার কাছে এতোই তুচ্ছ? ফুলমিয়ার মত এতটুকু কপার পাত্রী নই কি আমি তোমার কাছে?

মেম সাহেব, আপনি শুধু ফুলমিয়া নয়, আমার চেয়ে আপনি অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। আমার মত নগণ্যহীন ব্যক্তি আপনার মত মহৎপ্রাণ নারীর নাগাল পেতে পারে না। আপনি আমাকে মাফ করবেন মেম সাহেব–বনহুর কথা শেষ করে দ্রুত জাহাজ ত্যাগ করে নেমে গেলো।

বজ্রাহতের ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নীহার।

আবু সাঈদ আজ ক’দিন কন্যার মনোভাব অনুভব করেছিলেন, তিনি যে একেবারে এসব জানতেন না তা নয়। কিন্তু নীহার যে আলমকে এতোখানি ভালোবেসে ফেলেছিলো আজ তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করলেন। আলম আর নীহার যখন কথা বলছিলো আবু সাঈদ কন্যার পিছনে এসে দাঁড়ান,হাত রাখেন কন্যার কাঁধে-মা নীহার!

পিতার কোমল কণ্ঠ নীহারের মনের বাঁধ যেন ভেঙে দেয়, হঠাৎ উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠে সে দু’হাতে মুখ ঢেকে।

আবু সাঈদের চোখ দুটোও ভিজে উঠে, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে, কন্যাকে সান্ত্বনা দিতে যান কিন্তু পারেন না, আলম যে তাঁর মনেও গভীরভাবে রেখাপাত করে গেছে, কোনো দিনই ওর কথা। ভুলতে পারবেন না আবু সাঈদ।

বোম্বে শহর।

যদিও এ শহরটা বনহুরের কাছে নতুন তবু সে এতটুকু বিচলিত হলো না। কেশব আর ফুলমিয়াসহ একটা হোটেলে আশ্রয় নিলো।

পাশাপাশি দুটো কামরা ভাড়া নিলো বনহুর নিজেদের জন্য। একটা কামরায় বনহুর স্বয়ং থাকবে আর একটিতে ফুলমিয়া ও কেশব।

বোম্বে পৌঁছেই দরকারী জিনিসপত্র কেনা-কাটা করে নিলো বনহুর নিজের হাতে। কি কিনলো না কিনলো সব জিনিসের সংবাদ রাখলো না কেশব আর ফুলমিয়া।

সবচেয়ে তার সর্বক্ষণের সাথী হলো নাসেরের সেই রিভলরখানা। যথেষ্ট গুলীও বনহুর সংগ্রহ করে নিয়েছিলো আবু সাঈদের নিকট হতে। বনহুর তাই নিশ্চিন্ত, চলাফেরা করতে তার কোনো অসুবিধাই হবে না।

যে হোটেলে বনহুর সঙ্গীদ্বয়সহ আশ্রয় নিয়েছিলো সে হোটেলটি বোম্বের নামকরা না হলেও খুব ছোট নয়। হোটেলটি বোম্বের ফুলাগু রোডের প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থিত ছিলো। রোডের নাম অনুসারেই হোটেলটার নাম করা হয়েছিলো ফুলাগু হোটেল।

ফুলাগু সুন্দর পরিচ্ছন্ন না হলেও মোটামুটি মন্দ নয়। হোটেলের মালিক একজন বার্মিজ। যদিও লোকটা বার্মিজ কিন্তু সে বহুকাল বোম্বে বাস করার দরুণ কথাবার্তা সব খাঁটি বোম্বাই ওয়ালাদের ভাষায় বলতো। ইংলিশও জানতো ভাল। ফুলাগু হোটেলের মালিকের নাম হলো ফাংফালিও।

বনহুর প্রথম সাক্ষাতেই ফাংফালিও এর অন্তরটা দেখে নিয়েছিলো, লোকটা মহৎ এবং ভদ্র তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম দিনই বেশ আলাপ জমে গেলো, খাঁটি ইংলিশে আলাপ আলোচনা হলো বনহুর আর ফাংফালিও এর মধ্যে।

স্বয়ং ফাংফালিও বনহুরের কামরা গুছিয়ে দিলো। বনহুরের আচরণে সেও যে খুব মুগ্ধ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নিজের ক্যাবিনে শয্যা গ্রহণ করে বনহুর আজ স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো। সন্ধ্যার পরই খাওয়া-দাওয়া পর্ব চুকিয়ে নিয়েছিলো, কাজেই এখন বনহুর সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত।

হোটেলে এখনও লোকজন গমগম করছে, বিভিন্ন ক্যাবিন থেকে অবসর-বিনোদ যাত্রীদের হাসি-গল্পের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বনহুর কেশব আর ফুলমিয়াকে তাদের ক্যাবিনে শয়ন করার নির্দেশ দিয়ে নিজেও শয়ন করেছিলো এসে নিজের ক্যাবিনে।

শয্যায় শয়ন করে বনহুর সিগারেটের পর সিগারেট পান করে চললো। গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো–কোথায় কেমনভাবে সন্ধান পাবে সে নূরীর।

বোম্বে শহর ছোটখাট নয়, তা ছাড়াও এ শহরটি বনহুরের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। প্রথমে এ শহরের প্রতিটি জায়গা তাকে বিশেষভাবে জেনে নিতে হবে। এলোমেলো কত কি চিন্তা আজ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো–সব চেয়ে বেশি মনে পড়ছিলো নীহারের কথা, অবশ্য নীহারের কথা নিয়ে এখন ভেবে কোনো ফল হবে না যদিও।

বনহুর যতই নীহারের কথা বিস্মৃত হতে চেষ্টা করছিলো ততই যেন আরও গাঢ় হয়ে ভেসে উঠছিলো ওর মুখখানা মনের পর্দায়। কিছুতেই নিদ্রা আসছিলো না তার চোখে। শিয়রের টেবিলে এ্যাসট্রেটা অর্ধদগ্ধ সিগারেটে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। একটা সুমিষ্ট সুগন্ধযুক্ত ধুম্রকুন্ডলী সমস্ত কক্ষটাকে মোহময় করে তুলেছিলো। বনহুর মন থেকে নীহারের স্মৃতি মুছে ফেলতে চেষ্টা করলো–কিন্তু একি, একটি মুখ সরে যেতে না যেতে আর একটা মুখ তার মনকে আচ্ছন্ন করে তুলছিলো– শ্যালন, লুসি, মিস আরতী–আরও কত নির্মল পবিত্র মুখ–অনেক ফেলে-আসা স্মৃতিগুলো ভীষণভাবে আলোড়ন জাগালো তার হৃদয়মধ্যে। কত নারীই না তার জীবনপথে এসেছে কিন্তু কেউ তো জয় করতে পারেনি–পারেনি পদস্থলিত করতে। বনহুর নিজকে কঠিনভাবে সংযত রেখে সবার সঙ্গে সমানভাবে মিশেছে, স্নেহ-ভালবাসা-প্রেম-প্রীতিও দিয়েছে যতটুকু সে সক্ষম হয়েছে দিতে।

আজ কেন বার বার মনে পড়ছে সেইসব অবলা সরল সহজ তরুণীগুলোর মুখ, কেন যেন আজ সবাই এক সঙ্গে এসে তার মনের পর্দায় ভীড় জমাচ্ছে। তবে কি নূরীর আকর্ষণেই আজ তার মনে এ অস্থিরতা?

বনহুর অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে গুঁজে রেখে উঠে মুক্ত জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। ঘুমন্ত বোম্বে নগরীর দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ নয়নে, এই শহরেরই কোনো এক নিভৃত কোণে লুকিয়ে আছে তার নূরী। এখন কি করছে সে, হয়তো ঘুমিয়ে আছে নয় কোনো ছবির সুটিং নিয়ে ব্যস্ত আছে। জানে বনহুর স্টুডিও ফ্লোরে রাতেও সুটিং চলে কারণ সেও একদিন চলচ্চিত্র জগতে নায়কের অভিনয় করেছে। আজ সে সব কথা মনে করে হাসি পায় তার–দস্যু বনহুর হয়েছিলো। চিত্রনায়ক আর আজ নূরীও সেই জগতে গিয়ে পড়েছে কেমন করে কে জানে—হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো অদূরস্থ একটি লাইট পোষ্টের পাশে কোনো এক দেয়ালের গায়ে। চমকে উঠলো বনহুর, মস্তবড় একটা পোষ্টার দেয়ালের গায়ে আঁটা রয়েছে, পাশাপাশি দুটি নারী মুখ। একটি নারী অপরিচিত, আর একটি নূরীর ছবি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনহুর বিচলিত হয়ে উঠলো, লাইট পোষ্টের উজ্জ্বল আলোতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো।

বোম্বে শহরে প্রথম রাত বনহুরের কাটলো সম্পূর্ণ অনিদ্রায়। শয্যায় শয়ন করেও কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারলো না সে।

গোটা রাত অনিদ্রায় কাটিয়ে চোখ দুটো জ্বালা করছিলো আয়নার পাশে এসে দাঁড়ালো; নিজের উদভ্রান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজেই আঁতকে উঠলো। চোখ দুটো যেন জবা ফুলের মত লাল। হয়ে গেছে, সমস্ত মুখমন্ডলে ক্লান্তি আর অবসাদের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বনহুর কিছুক্ষণ নিজের চেহারার দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে আংগুল দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিলো। তারপর তোয়ালেটা। কাঁধে ফেলে প্রবেশ করলো বাথরুমে।

বাথরুম থেকে বের হলো যখন তখন অনেকটা সুস্থ আর সচ্ছ মনে হলো নিজেকে, চায়ের টেবিলে এসে বসতেই কেশব আর ফুলমিয়া এসে দাঁড়ালো।

বললো কেশব–বাবু, আমাদেরকে কি করতে হবে বলে দিন?

সম্মুখস্থ টেবিলে কলিং বেলটার উপরে চাপ দিতে দিতে বললো বনহুর–বসো, প্রথমে নাস্তা খেয়ে নাও তারপর কাজের কথা হবে।

কেশব আর ফুলমিয়া তাদের বাবুর সম্মুখে চেয়ারে বসতে ইতস্ততঃ করছিলো, বললো বনহুর– বসে পড়ো তোমরা।

ততক্ষণে হোটেলের বয় এসে দাঁড়ালো, খাঁটি উর্দু ভাষায় বললো–নাস্তা আনবো স্যার?

বনহুর বললো–হাঁ,নিয়ে এসো।

বয় চলে গেলো।

কেশব আর ফুলমিয়া আসন গ্রহণ করলো বটে কিন্তু কেমন যেন সঙ্কোচিতভাবে বসে রইলো।

নাস্তা এলো।

বনহুর দু’টি প্লেট ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–নাও।

নাস্তা শেষে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো বনহুর–কেশব, একটা পেপার নিয়ে এসো, দেখো দেখি কোন হলে ‘স্বয়ংবরা’ ছবি চলছে।

কেশব উঠবার পূর্বেই ফুলমিয়া উঠে পড়ে; পা বাড়াতেই বলে উঠে বনহুর–কফিটা শেষ করে যাও, আর পয়সাও নিয়ে যাও বুঝলে?

কেশব বললো–কেন, আমিই তো যাচ্ছি।

ফুলমিয়া বললো–কেন, আমি থাকতে তুমি যাবে কেন? দিন পয়সা দিন—

হাত পাত্বে ফুলমিয়া বনহুরের সামনে।

বনহুর পয়সা দিলে চলে যায় ফুলমিয়া।

অল্পক্ষণ পরে সংবাদপত্র নিয়ে ফিরে আসে। বনহুর কাগজখানা চোখের সামনে মেলে ধরে এবং সিনেমা বিজ্ঞপ্তি গুলোর উপরে দ্রুত দৃষ্টি বুলিয়ে চলে।

হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি সংবাদপত্রের একস্থানে সীমাবদ্ধ হলো, স্বয়ংবরা’ ছবির বিজ্ঞপ্তি এটা। বনহুর দেখলো, ছবিখানা এখন বোম্বের কয়েকটি হলে একযোগে চলছে–মার্জিয়া, শ্যামশাহা, রূপনারায়ণ। বনহুর দশ টাকার দু’খানা নোট পকেট থেকে বের করে বললো কেশব, যাও মার্জিয়া সিনেমা হল থেকে স্বয়ংবরা’র জন্য তিনখানা টিকেট নিয়ে এসো গে।

কেশব আর ফুলমিয়া বনহুরের কথায় অবাক হলো প্রথমে, এই সাত সকালে সিনেমার টিকেট বিস্মিত হবার কথাই তো। কিন্তু বাবুর কথায় তারা কোনোরকম উক্তি উচ্চারণ করলো না। নতমুখে কিছু চিন্তা করছে দেখে পুনরায় বললো বনহুর–সকাল সকাল সিট বুক না করলে এসব শহরে ছবি দেখা মুস্কিল। সময়মত টিকেট পাওয়া যাবে না, তাই তিনখানা টিকেট কেটে এনে রাখবে।

এবার কেশব মাথা দোলালো–আচ্ছা।

গোটা দিন হোটেল থেকে আর বের হওয়া হলো না বনহুরের, সন্ধ্যার পূর্বে ফুলমিয়াকে বললো একটা ট্যাক্সি ডেকে আনতে।

ট্যাক্সি এলো।

বনহুর, কেশব আর ফুলমিয়াকে নিয়ে ট্যাক্সি পৌঁছলো মার্জিয়া হলের সম্মুখে। ট্যাক্সির মধ্য হতেই বনহুরের নজর গিয়ে পড়লো হলের সম্মুখস্থ পোষ্টারগুলোর উপর। নায়িকা শ্যামার পাশে নূরীর ছবিখানার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বনহুর।

কেশবের দৃষ্টি পোষ্টারে পতিত হতেই চমকে উঠলো সে, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো-বাবু, এ ফুল–ফুলের ছবি?

হাঁ কেশব, ফুলই বটে।

বাবু!

কেশব চলো, পরে সব বলবো।

কেশব আর ফুলমিয়াসহ হলে প্রবেশ করলো বনহুর।

ছবি শুরু হতে এখনও কয়েক মিনিট বাকি–বনহুর, কেশব আর ফুলমিয়া এসে বসলো। অল্পক্ষণ পরই ছবি শুরু হলো। বহুরের বুকের মধ্যে আলোড়ন চলেছে, বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।

পর্দায় টাইটেল চলছে।

উন্মুখ হৃদয় নিয়ে দেখছে বনহুর। এই বুঝি নূরী নামটা এবার ভেসে উঠবে পর্দায়। নেমসিন শেষ হয়ে এলো কিন্তু নূরী’ অক্ষর দুটো তো ভেসে উঠলো না। ভড়কে গেলো বনহুর–তবে কি তার মনের ভ্ৰম, ভুল করেছে সে। নিশ্চয়ই ওটা অন্য কোনো মেয়ে হবে। চিত্রজগতে চিত্রতারকাদের তো অভাব নেই। বনহুরের মনটা হঠাৎ বিমর্ষতায় ভরে গেলো।

ছবি শুরু হলো, বনহুর আনমনে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ পর্দায় তার আকাঙিক্ষত জনকে দেখে উন্মুখ হয়ে উঠলোনা না, ভুল তার হয়নি। এ যে তারই নূরী।

কেশব অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–বাবু, এ যে ফুল!

হাঁ কেশব, ফুলই বটে। চুপ করে দেখে যাও।

ছবি দেখা শেষ করে যখন বনহুর বেরিয়ে এলো বাইরে তখন কেশব চঞ্চল কণ্ঠে বললো– বাবু ফুল কি করে সিনেমায় এলো?

বনহুর বললো–আমিও তাই ভাবছি কেশব।

এরপর পথে আর কোনো কথা হলো না, হটেলে ফিরে বনহুর নিজ কামরায় গিয়ে সোফায় বসে পড়লো।

ফুলমিয়া আর কেশব যার-যার নিজ ক্যাবিনে আশ্রয় নিলো বটে কিন্তু কারো মনোভাব সচ্ছ ছিলো না। বনহুরের গম্ভীর হবার সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে পড়েছিলো কেশব, সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলো না, যে ফুলকে তারা হারিয়েছিলো সেই সুদূর পর্বতের নির্জন বনভূমিতে কি করে তার আর্বিভাব হলো বোম্বের রূপালী পর্দায়?

কেশবের চেয়েও বেশি বিস্মিত এবং হতভম্ব হয়েছে ফুলমিয়া। ছবিগৃহে হঠাৎ কেশবকে অস্ফুট ধ্বনি করতে দেখে এবং আলম সাহেব আর কেশবকে অত্যন্ত ভাবাপন্ন হয়ে যেতে দেখে অবাক না হয়ে পারেনি সে। কিন্তু কাউকে কোনো প্রশ্ন করার সাহসও হয়নি তার।

বনহুর ছবি দেখার পর স্থির বিশ্বাসে এলো নূরীকে চিনতে তার ভুল হয়নি একটুও। নূরীকে এবার তার খুঁজে বের করতে মোটেই বিলম্ব হবে না।

পরদিন বনহুর সুন্দর দামী স্যুট পরে তৈরি হয়ে নিলো এবং মাথায় একটা ক্যাপ পরে নিলো। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর গোঁফ, চোখে চশমা। হাতে ব্যাগ আর ছড়ি। মাথায় চুলের পিছন দিকে এবং সামনের কয়েক গাছা চুলে পাক ধরেছে, দাড়ির মাঝেও দু’একটা সাদা মনে হচ্ছে।

ছদ্মবেশ ধারণ করে আয়নার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো বনহুর। এখন তাকে দেখলে পঁয়তাল্লিশের কম মনে হবে না। চেহারা এবং পোশাকে ধনবান ও আভিজাত্যের ছাপ ফুটে উঠেছে।

চশমাটা খুলে সম্পূর্ণ দেহটার দিকে একবার নিপুণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে নিলো, তারপর হোটেলের পিছন সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

একটা ট্যাক্সি ডেকে চেপে বসলো-বোম্বে স্টুডিওতে চলো।

গাড়ি উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো।

বোম্বে শহর।

তেল চকচকে পিচঢালা পথ।

অসংখ্য গাড়ির ভীড়ে বনহুরের গাড়িখানা অগ্রসর হচ্ছে। পিছন আসনে নিশ্চুপ বসে আছে। বনহুর,দক্ষিণ হস্তের আংগুলের ফাঁকে অগ্নিদগ্ধ সিগারেট। পাশেই রয়েছে ছোট্ট এ্যাটাচি ব্যাগটা। পথের দু’ধারে আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকিয়ে সে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিলো। বড় বড় অট্টালিকার সম্মুখে দোকানপাট আর প্রায় মাঝে মাঝেই হোটেল ও রেষ্টুরেন্ট রয়েছে। ফলমূলের দোকানই যেন বেশি মনে হলো। এক্কা ঘোড়ার গাড়ি এবং দোতলা বাস প্রায়ই নজরে পড়তে লাগলো। তবে পথে বেশ শৃঙ্খলার সঙ্গে যানবাহন চলাচল করছে। পথের ঠিক মাঝখান। দিয়ে চলেছে যন্ত্রচালিত গাড়িগুলো। একপাশ কেটে চলেছে ঘোড়া গাড়ি এবং টউরে গাড়ি। রাজপথের দুপাশে ফুটপাত অসংখ্য লোকজন পায়ে হেঁটে চলাচল করছে এই ফুটপাত দিয়ে।

কর্মব্যস্ত জনমুখর বোম্বে নগরী।

বনহুর আপন মনে গভীর চিন্তায় মগ্ন।

বোম্বে আগমন করলেও বনহুর এখনও বোম্বে নগরীর সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হতে পারেনি, কারণ মাত্র দু’দিন হলো তারা এ শহরে এসেছে।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর দূরে সুউচ্চ একটা চূড়া নজরে পড়লো। অনেকগুলো দালান কোঠা ছাপিয়ে মাথাটা দেখাচ্ছে–মস্তবড় গম্বুজের মত দেখতে। আশে পাশে মন্দিরের চূড়ার মত আরও কতগুলি উচ্চচূড়া। বনহুর ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলো–ওটা কিসের গম্বুজ দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভার?

স্যার, ঐ যে গম্বুজ দেখছেন ওটাই তো বোম্বে স্টুডিও। গম্বুজগুলো স্টুডিও ফ্লোরের।

ওঃ তুমি দেখছি স্টুডিওর সব জানো?

পথের বাঁকে হ্যান্ডেলটা দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে বললো ড্রাইভার প্রায়ই আমাকে স্টুডিওতে আসতে হয় কিনা, তাই সব জানি স্যার।

অল্পক্ষণেই গাড়ি এসে বোম্বে স্টুডিওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো। বিরাট ফটক, ফটকের দু’ধারে দু’জন পাহারাদার রাইফেল কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে। একজন পাহরাদার ফটক খুলে দিলো, গাড়ি প্রবেশ করলো ফটকের মধ্যে।

পাহারাদার দু’জন সেলুট করে সরে দাঁড়ালো।

বনহুর স্টুডিওর অফিসে প্রবেশ করলো। ষ্টুডিও সম্বন্ধে সবকিছু পূর্ব হতেই জানা ছিলো, কাজেই আজ নতুন করে তাকে বেগ পেতে হলো না, সোজা সে অফিস-রুমে প্রবেশ করে স্টুডিও ডাইরেক্টর মিঃ রাজেন্দ্র চন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো।

রাশভারী মানুষ মিঃ রাজেন্দ্র। কাগজপত্র নিয়ে কি যেন লিখছিলেন, চশমাসহ চোখ দুটো তুলে ধরে বললেন–বসুন।

বনহুর আসন গ্রহণ করলো।

মিঃ রাজেন্দ্র বললেন–আপনি কোথা থেকে এসেছেন জানতে পারলে

নিশ্চয়ই জানাবো। আমি খান বাহাদুর শামস ইরানী। এতোদিন বিদেশে ছিলাম কোনো ব্যবসা উপলক্ষে, এবার বোম্বে ফিরে এসেছি। ভাবছি অন্য ব্যবসা না করে এবার ছবি করবো।

খুশি হয়ে বললেন মিঃ রাজেন্দ্র চন্দ্র–বেশ তো, ভাল কথা। আজেবাজে ব্যবসার চেয়ে ছবির ব্যবসা অনেক লাভবান। যদি ছবি একবার হিট করে তাহলে কোনো কথাই নেই। একেবারে লালে লাল হয়ে যাবেন। দেখলেন না এ বছরের কয়েকটা ছবি কেমন মার্কেট পেলো?

হাঁ, সব জানি। বনহুর অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর মত মাথা দোলালো। তারপর বললো–আমি আপনার নিকটে এ বিষয়ে পরামর্শ নিতে এলাম।

বেশ ভাল কথা, জিজ্ঞাসা করুন?

বনহুর একথা-সে কথার মধ্য দিয়ে অল্পক্ষণেই গভীরভাবে আলাপ জমিয়ে নিলো মিঃ রাজেন্দ্র চন্দ্রের সঙ্গে। এমন কি, কথায় কথায় স্বয়ংবরা’ ছবির পরিচালকের ঠিকানা লিখে নিলো, তারপর বিদায় গ্রহণ করলো সে ঐ দিনের মত।

স্টুডিও থেকে বেরিয়ে সোজা আসলাম চৌধুরীর বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা দিলো বনহুর। অবশ্য এখন তাকে সর্বক্ষণ ভাড়াটে গাড়িই ব্যবহার করতে হচ্ছে। মিঃ রাজেন্দ্র চন্দ্রের ওখান থেকে সোজা একেবারে পৌঁছে গেলো বনহুর পরিচালক আসলাম চৌধুরী বাসায়।

মস্তবড় দোতলা–ইংলিশ প্যাটার্ণের সবুজ রংয়ের বাড়ি। সম্মুখে বাগান; বাগানের মধ্য দিয়ে। লাল কাকড় বিছানো পথ। পথটা সোজা চলে গেছে গাড়ি বারান্দায়।

বনহুরের গাড়ি গেট পাট হয়ে গাড়ি-বারান্দার নীচে এসে থামলো। একজন ভদ্রলোক। ড্রইংরুমের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন, গাড়িখানা থামতেই এগিয়ে এলেন। ভদ্রলোকের দেহে স্লিপিং গাউন, আংগুলের ফাঁকে দামী চুরুট। বনহুর গাড়ি থেকে নেমে আদাব জানালো।

ভদ্রলোকটিকে দেখে বনহুর বুঝতে পারলো, ইনিই পরিচালক আসলাম আলী চৌধুরী হবেন।

বনহুরের অনুমান মিথ্যা নয়। আসলাম আলী একজন সম্ভ্রান্ত বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখে করমর্দন করলেন, তারপর সঙ্গে করে ড্রইংরুমে নিয়ে বসালেন। অবশ্য কিছুটা যে তিনি বিস্মিত হননি তা নয়, কারণ এ ব্যক্তি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত।

আসলাম আলী যখন আশ্চর্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন বনহুরের দিকে তখন বনহুর নিজকে সংযত করে নিয়ে বললো–আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্যই আমার আগমন। আমার নাম শামস ইরানী, আপনিই বুঝি–

জি হাঁ, আমি আসলাম আলী।

আমি সেই রকমই অনুমান করে নিয়েছিলাম। দেখুন, আমি যা বলবো বা বলতে এসেছি সে কথা হলো–আমি একটা ছবি করবো মনস্থ করেছি, আমার ছবির কাজ আগামী মাস থেকে শুরু করবো। ছবির নাম এখনও ঠিক করিনি তবে ছবির নাম ঠিক করবার পূর্বে ছবির পরিচালক ঠিক করে নিতে চাই।

‘স্বয়ংবরা’ ছবি রিলিজ পাবার পর আলী সাহেব এখন অবসরই আছেন, প্রায় একরকম বসে আছেন তিনি। অবশ্য অন্য ছবির চিন্তা তিনি করছেন। হঠাৎ নতুন একজন প্রযোজকের আগমনে আনন্দ বোধ করলেন। আলী সাহেব জানতেন, তার স্বয়ংবরা’ মুক্তি পাবার পর অমন কত প্রযোজকের আগমন হবে তাঁর বাড়িতে। মনে মনে খুশিই হলেন, আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে উঠলো। তাঁর মুখমন্ডল। শামস ইরানীকে দেখেও তিনি এ রকমই একটা আন্দাজ করে নিয়েছিলেন।

বনহুর শান্ত-ধীর কণ্ঠে বললো এবার–আমার ছবির পরিচালক হিসাবে থাকবেন আপনি, এটাই আমি আশা করি। অবশ্য আপনি যা পারিশ্রমিক চাইবেন আমি তাতেই রাজি হতে পারবো।

আলী সাহেবের চোখ দুটো চক চক করে উঠলো, মাথার চুলে হাল্কাভাবে একটু হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন–এ তো আমার সৌভাগ্য মিঃ ইরানী। আমিও চাই নতুন প্রযোজক যারা চলচ্চিত্র জগতে নতুন আগমন করেছেন। কারণ আমি তাদের অর্থের প্রাচুর্য আরও বাড়িয়ে দিতে চাই, সৃষ্টি করতে চাই নতুন এক বিত্তশালী জগত। যারা কোনোদিন এ জগতে আসেননি বা আসতে সাহসী হননি তাদের মনের ভুল আমি ভেঙে দিতে চাই।

বনহুরের মুখে হাসির আভাস, মনোযোগ সহকারে শোনে সে আলী সাহেবের কথাগুলো। বলে বনহুর–হাঁ, আমিও এর পূর্বে অন্য ব্যবসা করতাম। বিদেশে আমার কয়েকটি ইডাস্ট্রী আছে। তবু আমার ইচ্ছা ছবি করবো।

বেশ তো, অন্যান্য ব্যবসার চেয়ে এ ব্যবসায়ে যথেষ্ট লাভবান হওয়া যায়। অবশ্য খুব চিন্তা করে ছবি তৈরি করলে তাতে পয়সা যেমন আসে সুনামও তেমনি পাওয়া যায়।

আমি তেমনি একটা মনোভাব নিয়েই এসেছি আলী সাহেব। স্বয়ংবরা’ ছবি আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে। নিখুঁত আপনার পরিচালনা, শুধু তাই নয়, এ ছবিতে যারা অভিনয় করেছেন তাদের

অভিনয়ও হয়েছে অত্যন্ত প্রাণস্পর্শী। আলী সাহেব, আমার ছবিতেও আমি এইসব শিল্পীদের গ্রহণ। করতে চাই।

অত্যন্ত আনন্দের কথা। আপনি যাদের পছন্দ করবেন তাদেরকেই চুক্তিবদ্ধ করা হবে।

বনহুর ভিতরে ভিতরে খুশিই হলো, এতো অল্প সময়ে এতোটা অগ্রসর হবে সে ভাবতেও পারেনি। আর বেশি এগিয়ে কাজ নেই, এতে ফল মন্দ হতে পারে। ধীরে এগুনোই শ্রেয় মনে করে সেদিনের মত বনহুর বিদায় গ্রহণ করলো পরিচালক আলী সাহেবের বাড়ি থেকে।

হোটেলে কেশব আর ফুলমিয়া বহুক্ষণ বাবুকে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে সে গেলো কোথায়?

ফুলমিয়া আর কেশব যখন হোটেল থেকে বেরুতে যাচ্ছে ঠিক তখন বনহুরের গাড়ি এসে থামলো হোটেলের সম্মুখে।

বনহুরের পাশ কেটেই চলে যাচ্ছিলো ওরা।

বনহুরকে চিনতে পারে না ফুলমিয়া আর কেশব। বনহুর কিন্তু ওদের দু’জনার মুখোভাব দেখেই বুঝতে পেরেছে, ওরা অত্যন্ত ভাবাপন্ন ও চিন্তিত হয়ে উৎকণ্ঠিতভাবে কোথাও চলেছে। ওদের চিন্তার কারণ যে সে, নিজে সেটাও উপলব্ধি করে নিলো বনহুর।

ফুলমিয়া আর কেশবের সম্মুখে পথ রোধ করে বলে বনহুর –এই তোমরা শোন।

থমকে দাঁড়ালো কেশব আর ফুলমিয়া, দু’জনার মুখেই বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে, প্রথম চলার পথে বাধা।

কেশব বললো–স্যার, আমাকে ডাকছেন?

হা শোন।

বলুন স্যার?

তোমাদের দেখে খাঁটি বাঙ্গালি বলে মনে হচ্ছে, তোমরাই কি এই হোটেলে গত পরশু এসেছো?

হাঁ, আমরা বাঙালি এবং পরশু এসেছি। বললো কেশব।

বনহুর নিজের ছদ্মবেশ নিখুঁত হয়েছে বুঝতে পারলো, কারণ কেশব আর ফুলমিয়া তাকে একটুও সন্দেহ করেনি। বনহুর বললো–ওঃ তোমরাই তাহলে আমার বন্ধু আলমের সঙ্গীদ্বয়?

কেশব আর ফুলমিয়ার মুখটা উজ্জ্বল হলো, যাক এই অজানা অচেনা জায়াগায় তবু পরিচিত একজনকে পাওয়া গেলো। খুশি হলো বটে মুহূর্তের জন্য তারপর মুখোভাব গম্ভীর করে বললো কেশবস্যার, সকাল বেলা তিনি বাইরে গেছেন এখনও ফিরে আসেননি, আমরা তাই তাকে–

খুঁজতে যাচ্ছিলে বুঝি?

হাঁ, স্যার তিনি যে কেন এখনও আসছেন না ভেবে পাচ্ছি না আমরা।

তা তোমরা তাকে কোথায় খুঁজে পাবে? বিরাট শহরে কোথায় কি কাজ নিয়ে গেছে তাই বা কে জানে। যাক, আমি তাকে দেখি কোথাও পাই কিনা। তোমরা যাও, নিজের কামরায় চলে যাও।

কেশব আর ফুলমিয়া এতক্ষণে একজন দরদীর সন্ধান পায়। কতকটা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে যায় হোটেলে।

বনহুর পিছন সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় উপরে নিজ ক্যাবিনে। তারপর দ্রুতহস্তে ড্রেস পরিবর্তন করে নেয়।

বাথরুম থেকে যখন বেরিয়ে আসে তখন তাকে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না এই যুবক কিছু পূর্বের সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক। সুন্দর মুখমন্ডলে বনহুরের নেই কোনো ক্লান্তি বা অবসাদের ছাপ বরং অন্যদিনের চেয়ে আজ তাকে অনেক সচ্ছ মনে হচ্ছে। একটু পরে বনহুর ডাক দেয় কেশব আর ফুলমিয়াকে।

কেশব আর ফুলমিয়া অবাক হয়ে যায়, বিস্ময়ভরা নয়ন নিয়ে ওরা দু’জন তাকিয়ে থাকে বনহুরের দিকে।

কেশব বলে উঠে–বাবু, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? আর এলেনই বা কখন?

কেন, তোমরা বুঝি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে?

তা আর হবে না বাবু, না হয়ে যে উপায় ছিলো না। এই বিদেশ বিভুঁই জায়গায় কি বিপদ যে কখন ঘটে–

আমার জন্য কিছু ভেবো না তোমরা। বসো কেশব আর ফুলমিয়া কথা আছে তোমাদের সঙ্গে।

কেশব আর ফুলমিয়া আসন গ্রহণ করলো।

কেশব বললো–বাবু, বোম্বে শহরে আপনার কোনো বন্ধু আছে কি?

আমার বন্ধু! অবাক হওয়ার ভান করে বলে বনহুর।

ফুলমিয়া বলে এবার–স্যার, আপনার বন্ধুই হবে। বেশ ভদ্রলোক বলে মনে হলো।

হাঁ বাবু, খুব ভদ্রলোক–চোখে চশমা, হাতে ঘড়ি–

কেশবের কথার মাঝখানে বলে উঠে বনহুর–বোম্বে শহরে আমার তো কোনো বন্ধু নেই। শোন কেশব আর ফুলমিয়া তোমরা এ দেশের কাউকেই বিশ্বাস করবে না। হঠাৎ কারো কাছে কোনো কথাও বলবে না কোনো সময়, কারণ কখন যে কে আমাদের বিপদে ফেলার জন্য ওৎ পেতে বসে আছে, বুঝতে পারবে না।

কেশব আর ফুলমিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো। লোকটা যে তাদের কাছে মিথ্যা বলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বনহুর বলে–কেশব, তুমি তো জানো, আমরা এই বোম্বে শহরে কেন এসেছি?

হা বাবু জানি ফুলকে খুঁজতেই আপনি–

শুধু আমি নই, ফুলের সন্ধান করতে গেলে বা তাকে খুঁজে বের করতে হলে তোমাদের উভয়ের সহযোগিতাও আমার দরকার হতে পারে।

কেশব ইতিমধ্যে ফুলমিয়ার কাছে নূরী সম্বন্ধে সব কথা খুলে বলেছিলো। গতরাতে সিনেমা। দেখে আসার পর বনহুর কেশবকে বলেছিলো ফুলমিয়াকে নিভৃতে সব ঘটনা যেন খুলে বলে। সে সঙ্গে আছে। তাছাড়া নূরীকে খুঁজে বের করতে হলে তাকেও প্রয়োজন হতে পারে।

বনহুরের কথাতেই কেশব সব খুলে বলেছে ফুলমিয়ার কাছে। কাজেই আজ বাবুর কথায়। অবাক হলো না, সব সে বুঝতে পারছিলো।

বলে চলে বনহুর–কেশব, আমি নূরীর সন্ধান পেয়েছি। সে যে বেঁচে আছে এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। কিন্তু এখনও জানি না সে কোথায় আছে। কেশব, নূরীকে খুঁজে বের করতে আমার বেশি বিলম্ব হবে না। তবে তাকে উদ্ধার করতে হলে আমাকে যথেষ্ট চেষ্টা করতে হবে এবং তোমাদের সহায়তা একান্ত দরকার হবে আমার।

কেশব বললো–বাবু, ফুলকে উদ্ধার করতে আমরা প্রাণ দিতে পারি। বলুন বাবু, কি করতে হবে আমাদের?

ফুলমিয়া বললো–তিনি এখন কোথায় আছেন সন্ধান পেয়েছেন স্যার? যদি সন্ধান পেয়ে থাকেন আমাকে বলুন, আমি লাঠি দিয়ে তাদের মাথা লাল করে আমাদের বোনকে নিয়ে আসবো।

হেসে বললো বনহুরফুলমিয়া, সে যেখানে আছে সেখানে সহসা কেউ যেতে পারবে বলে মনে হয় না, তাছাড়া লাঠি দিয়ে তাদের মাথা ফাটানোও সম্ভব নয়। কাজেই তোমাদের বোনকে উদ্ধার করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।

কেশব আর ফুলমিয়ার মুখ শুকিয়ে গেলো, তাহলে ফুল নিশ্চয়ই কোনো কঠিন স্থানে আটকা আছে, যেখানে তাদের প্রবেশ অসাধ্য এবং লাঠি কোনো কাজে আসে না।

বনহুর গম্ভীর মুখে চিন্তা করতে লাগলো, কারণ সে নিজেও জানে না নূরী কোথায় আছে, তবে আন্দাজে মনে হয় এমন জায়গায় সে আছে যেখানে সর্বসাধারণের গমনাগমন কঠিন।

বনহুরের চিন্তা অহেতুক নয়, নূরী এখন আসলাম আলীর আয়ত্তে এবং শ্যামারাণীর নাগপাশে আবদ্ধ। নূরীর নিজস্ব শক্তি এখানে কিছুই নেই। আসলাম আলীর হাতের পুতুল এখন নূরী।

‘স্বয়ংবরা’ ছবিতে নূরীকে ক্যামেরার সম্মুখে কাজ করাতে আসলাম আলী চৌধুরী হিমসিম খেয়ে গিয়েছিলেন, তবু নাছোড় বান্দা হয়েছিলেন তিনি। নূরীকে নিয়ে ছবি শেষ করতে অনেক সাধ্য-সাধনা তাকে করতে হয়েছে, তবেই না আজ স্বয়ংবরা’র এতো সুনাম। সত্যিই ছবিটা দর্শক সমাজে একটা সুন্দর সার্থক ছবি বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, নূরীকে দর্শকমণ্ডলী অত্যন্ত প্রীতির সঙ্গে গ্রহণ করেছে। স্বয়ংবরা’ শুধু বক্স অফিস হিট করেনি, পরিচালক আসলাম। আলীকে অনেক দূর অগ্রসর করে দিয়েছে। এ ছবিতে প্রযোজক যেমন পয়সা পেয়েছেন তেমনি সুনাম পাচ্ছেন আলী সাহেব। পরিচালক জানেন, তাঁর ছবির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নতুন মুখ। শশী।

আজকাল আসলাম আলীর কপাল খুলে গেছে যেন একটা কোম্পানি নয়, বহু কোম্পানি থেকে তার ডাক আসছে। আরও একটি ব্যাপার হলো, আসলাম আলীর হাতেই আছে নতুন শিল্পী শশী, শশীকে ছবিতে পেতে হলেই আসলাম আলীর প্রয়োজন।

কাজেই রোজ আসলাম আলীর গাড়ি-বারান্দায় প্রযোজকদের গাড়ির ভীড় জমে উঠতো। কেউ বা আসতো ছবি পরিচালনার দায়িত্ব দেবার জন্য,কেউ বা আসতো নতুন শিল্পী শশীকে তার ছবির নায়িকার চরিত্রে গ্রহণের আশায়। আসলাম আলীর বুক গর্বে স্ফীত হয়ে উঠতো, এমন একটি রত্ন। এখন তার হাতের মুঠায় যার জন্য তার ভবিষ্যত যে আরও উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

শশীকে ‘স্বয়ংবরা’য় কাজ করাতে যদিও আলী সাহেব হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলেন তবু একটা আত্মতৃপ্তি ছিলো, আগামী একদিন একে নিজের মনের মত করে পাবেন। সেই বিশ্বাসেই আলী সাহেব ধৈর্য সহকারে প্রতীক্ষা করছিলেন।

এমন দিনে আবির্ভাব হলো বনহুরের। নূরীর সন্ধানেই আগমন তার, যেমন করে হোক নূরীকে চিত্রজগত থেকে সরিয়ে নিতেই হবে।

গভীর রাত।

বনহুর শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো, পাশের স্যুটকেসটা খুলে বের করে ফেললো জমকালো ড্রেস। পরে নিলো–কতদিন পর আবার বনহুর এ ড্রেসে সজ্জিত হলো। দক্ষিণহস্তে তার রিভলভার। আজও নাসেরের রিভলভারখানা তার নিকটে সযত্নে রয়েছে।

নূরীকে উদ্ধার করতে হলে চাই প্রচুর টাকা। তাকে যে প্রযোজক সেজে কার্য হাসিল করতে হবে! সর্বপ্রথম চাই একখানা গাড়ি, মানে নিজস্ব মোটর কার। একটি ভাল গাড়ি কিনতে হলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। আরও অন্যান্য খরচ আছে। এই মুহূর্তে তার লক্ষ টাকার প্রয়োজন।

পাশের কামরায় কেশব আর ফুলমিয়া নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

বনহুর মাথায় পাগড়িটা তুলে দিয়ে পাগড়ির খানিকটা অংশ দিয়ে মুখের নিচের দিকটা ঢেকে ফেললো, তারপর পিছন সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নিচে নেমে গেলো। পূর্বেই হোটেল-গ্যারেজের। একটা চাবি সংগ্রহ করে নিয়েছিলো বনহুর, গ্যারেজ খুলে বের করে ফেললো সে হোটেলের মালিকের গাড়িখানা যে গাড়ির চাবি আজ মালিকের নিকট হতে সংগ্রহ করে নিয়েছিলো সে।

গাড়ি নিয়ে বনহুর ছুটলো বোম্বের রাজপথ বেয়ে। রাত্রি গম্ভীর হওয়ার জন্য পথ প্রায় নির্জন তবে একেবারে স্তব্দ নয়। মাঝে মাঝে দু’একটা প্রাইভেট কার এদিক-ওদিক ছুটে চলে যাচ্ছে।

বনহুর মাথায় পাগড়িটা অবশ্য এখন খুলে রেখেছে পাশের আসনে কারণ হঠাৎ তার সমস্ত দেহে জমকালো ড্রেস দেখে পাহারারত পুলিশ কোনোরকম সন্দেহ করে নিতে পারে। বনহুর একটা নির্জন স্থানে গাড়ি রেখে নেমে পড়লো। কয়েকটা লৌহ যন্ত্রপাতি ইতিপূর্বেই সে সগ্রহ করে নিয়েছিলো। বনহুর কৌশলে গাড়ির নাম্বার প্লেট খুলে গাড়ির ভিতরে আসনের নিচে রেখে দিলো।

আবার চলতে শুরু করলো গাড়িখানা।

বোম্বে আম্বিয়া হোটেলের সম্মুখে এসে গাড়ি রেখে নেমে পড়লো বনহুর। আম্বিয়া হোটেল এখন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। শুধু একটি কক্ষে তখনও আলো জ্বলছে, এটি হলো আম্বিয়া হোটেলের ম্যানেজার শহীদ আফগানীর কক্ষ। দু’জন সহকারী নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছিলেন। এ হোটেলে প্রতি দিনের আয় প্রায় পঁচিশ হাজারের বেশি।

বোম্বের নামকরা আভিজাত্য ঘরের নারী-পুরুষ এ হোটেলে আগমন করে থাকেন। তাছাড়াও বিদেশী লোকজনের আমদানীও হয়ে থাকে। নানা ধরনের আমোদ-প্রমোদ চলে এ আম্বিয়া হোটেলে, এ হোটেলের বিশেষ আকর্ষণ হলো ফ্যান্সী নাচ আর বিলেতী মদ। গণ্যমান্য এবং ধনবান আগন্তুকদের শুভাগমনে সন্ধ্যার পর থেকে হোটেলটা গমগম করে। বোম্বের অধিবাসিগণই বেশি।

বনহুর বোম্বে সংবাদপত্রে এই আম্বিয়া হোটেল সম্বন্ধে বিশেষভাবে জ্ঞাত হয়েছিলো। আরও বিস্তারিত জেনে নিয়েছিলো সে ফুলাগু হোটেলের মালিক ফাংফালিও-এর কাছে। বলেছিলো ফাংফালিও-সাহেব, বোম্বের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য উপায়ে পয়সা উপার্জন করে থাকে ঐ আম্বিয়া হোটেল। এখানে সবরকম পাপ কাজ সমাধা হয়ে থাকে। তেমনি পয়সাও পায় ওরা প্রচুর।

বনহুর সংবাদপত্রে এ হোটেলের ঠিকানাও জেনে নিয়েছিলো। কাজেই কোনো অসুবিধা হলো না তার এই মুহূর্তে।

বনহুর হোটেলের সম্মুখে গাড়ি রেখে নেমে পড়লো বটে কিন্তু ঠিক সম্মুখ গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো না। পিছন দিক দিয়ে হোটেলের বাবুর্চির ক্যাবিনে প্রবেশ করলো প্রথমে; নাক ডেকে বয় আর বাবুর্চিরা ঘুমাচ্ছে। বনহুর আলগোছে বেরিয়ে এলো হোটেলের সম্মুখ দিকে। দোতলার রেলিং বেয়ে সোজা এগুতে লাগলো আলো প্রজ্জ্বলিত কামরার অভিমুখে।

বনহুর গাড়ির ভিতর হতে এই কামরাটা লক্ষ্য করে নিয়েছিলো। অন্যান্য কামরা অন্ধকার হলেও এই কামরায় তখন আলো জ্বলছিলো। বনহুর ভাবলো, এটাই হোটেলের কর্মকর্তাদের আড্ডা-গৃহ বা রাত্রির বিনোদ ভবন। কিন্তু আসলে তা নয়, এটা ছিলো এই আম্বিয়া হোটেলের ম্যানেজারের কামরা। সমস্ত দিনের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ম্যানেজার ও তার সঙ্গীদ্বয়। পাশেই গাদা গাদা টাকার বান্ডিল সাজানো।

নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে চলেছে ওরা কোনোরকম ভয় বা সন্দেহের কারণ নেই। হোটেলের গেটে সজাগ রাইফেলধারী পাহারাদার রয়েছে।

এমন সময় বনহুর আচমকা প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার উদ্যত করে ধরে সে–খবরদার নড়লে মৃত্যু!

হঠাৎ বজ্রপাতের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে যায় আম্বিয়া হোটেলের ম্যানেজার ও কর্মব্যস্ত সঙ্গীদ্বয়। এতোক্ষণ হিসাব নিকাশের মাঝে বার বার হাই তুলছিলো ওরা, নিদ্রায় তাদের চোখের পাতা এক হয়ে আসছিলো। আচমকা জমকালো একটি মূর্তিকে তাদের সম্মুখে রিভলভার হস্তে দন্ডায়মান দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে যায় তারা।

ম্যানেজার বাবু ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে চিৎকার করতে যায়–ডাকু–ডাকু—

বনহুর চাপা কলায় বলে–চুপ করো! চেঁচালে এক্ষুণি গুলী ছুড়বো।

দক্ষিণ হস্তে রিভলভার উদ্যত রেখে টাকার বান্ডিলগুলো পকেটে পুরে বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ায় পর মুহূর্তে পিছু হটে বেরিয়ে যায় বিদ্যুৎ গতিতে এসেছিলো ঠিক তেমনি করে।

বনহুর বেরিয়ে যেতেই ম্যানেজার এবং তার সহকারীদ্বয় চিৎকার করে উঠে–ডাকু, ডাকু, গ্রেপ্তার করো–গ্রেপ্তার করো–

ততক্ষণে বনহুর হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নিচে নেমে গেছে। উপর তলা হতে চিৎকার-ধ্বনি ভেসে আসতেই মেইন গেটের রাইফেলধারী পাহারাদার উঠিপড়ি করে ছুটলো উপরে।

বনহুর সেই মুহূর্তে লুকিয়ে পড়লো সিঁড়ির আড়ালে।

তার পাশ কেটে পাহারাদার এবং আরও লোকজন ছুটলো সবাই উপরে।

বনহুরের সম্মুখে গেট উন্মুক্ত, অতি সহজে সে গেট পার হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ষ্টার্ট দিতেই ছুটে বেরিয়ে এলো কয়েকজন, বনহুরের গাড়িকে লক্ষ্য করে চিৎকার করতে লাগলো।

ম্যানেজার ও তার সঙ্গের কর্মচারীদ্বয় তখন নেমে এসেছে, চিৎকাররত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললো–গাড়ির নাম্বার দেখেছেন আপনারা? গাড়ির নাম্বার—

লোকগুলো হাবা বনে গেছে যেন, বললো তারা–কই গাড়ির তো কোনো নাম্বার দেখলাম না। গাড়ির নাম্বার তো নেই!

বনহুরের গাড়ি তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে দূরের বাকে।

ফুলাগু হোটেলে ফিরে এলো বনহুর যখন তখন গাড়ির পিছনে নাম্বার প্লেট লাগানো হয়ে গেছে। গ্যারেজ খোলাই ছিলো, গাড়ি রেখে নিজের কামরায় এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। আপন মনেই হাসলো বনহুর, তারপর মাথার পাগড়িটা খুলে ফেলে দিলো বিছানায়। পকেট থেকে টাকার বান্ডিলগুলো বের করে স্যুটকেসে রেখে ফিরে এলো বিছানার পাশে। টেবিলের ড্রয়ার খুলে রিভলভারখানা রেখে দিলো।

বাথরুম থেকে যখন বনহুর বেরিয়ে এলো তখন তাকে দেখলে কেউ বলতে পারবেনা–একটু পূর্বের দস্যু এই মুহূর্তের বনহুর। নাইট ড্রেস পরে শয়ন করলো সে শয্যায়।

ভোরে ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে গেলো বনহুরের।

দরজা খুলে অবাক হলো সে, কেশব আর ফুলমিয়ার চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ বিদ্যমান।

বললো কেশব–বাবু, এতো বেলা অবধি কোনোদিন তো ঘুমান না? কোন অসুখ-বিসুখ করেনি তো?

মৃদু হেসে বললো বনহুর–আজ একটু বেশি ঘুমিয়েছি। আর বেশি ঘুমালেই বুঝি অসুখ বিসুখ হয়? শোন কেশব আর ফুলমিয়া, তোমরা চট করে নাস্তা এবং চা খেয়ে চলে এসো, বাইরে বেরুতে হবে।

কেশব আর ফুলমিয়া বাবুর কথামত কাজ করলো। তারা চা-নাস্তা করে সোজা চলে এলো বাবুর কামরায়। কেশব আর ফুলমিয়াকে বনহুর বসার জন্য ইংগিত করে বললো– বসো আমি আসছি।

বনহুর ড্রেসিংরুমে চলে গেলো, একটু পরে ফিরে এলো হাতে দু’জোড়া স্যুট এবং দুটো ক্যাপ। বললো বনহুর–তোমরা এগুলো পরে তৈরি হয়ে নাও।

অবাক হয়ে তাকালো কেশব আর ফুলমিয়া কারণ তারা ইতিপূর্বে এমন মূল্যবান স্যুট এবং টুপি পরেনি। কেশব হাত বাড়িয়ে নিলো বটে কিন্তু হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো–বাবু, এসব আমরা পরবো?

হাঁ, পরবার জন্যই তো দিচ্ছি; তোমরা আজ থেকে কোনো এক ছবির সহকারী পরিচালক হলে।

ফুলমিয়া আর কেশব অবাক হয়ে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলো–ছবির পরিচালক–বলেন কি বাবু?

তোমরা কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও, আমিও আসছি। কথাটা বলে বনহুর ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করলো।

ততক্ষণে কেশব আর ফুলমিয়া স্যুট পরে তৈরি হয়ে নিলো। যদিও একটু-আধটু ঢিলা এবং আঁটসাট হলো তবু একেবারে কোনোরকম বেখাপ্পা ধরনের হলো না। কেশব আর ফুলমিয়ার পোষাক পরা হয়ে গেলো তবু বাবুর সন্ধান নেই, তিনি ড্রেসিং রুমে যেন আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো বনহুর কিন্তু তাকে দেখে হঠাৎ চমকে উঠলো কেশব আর। ফুলমিয়া। আজ বনহুরের দেহে পূর্বদিনের সেই ড্রেস বিদ্যমান। তাকে দেখলে এই মুহূর্তে চেনা কিছুতেই সম্ভব নয়।

কেশব আর ফুলমিয়া যখন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে–এই ভদ্রলোক কি করে ভেতর কক্ষে প্রবেশ করলেন আর কখনই বা প্রবেশ করেছিলেন ড্রেসিং রুমে।

বনহুর কেশব আর ফুলমিয়ার মুখোভাব লক্ষ্য করে একটু হেসে বললো–তোমরা আমাকে চিনতে পারনি। আমিই তোমাদের বাবু আলম।

অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো কেশব –বাবু!

ফুলমিয়া ঢোক গিলে বললো–স্যার আপনি! আপনিই সেই ভদ্রলোক বুঝি?

হাঁ। শোন আমি এখন কোনো ছবির প্রযোজক বুঝলে? মানে আমার টাকায় ছবি তৈরি করবো।

স্যার ছবি তৈরি করবেন? তা আমরা পারবো আপনার সহকারী হতে?

আঃ শোনোই না। ছবি তোমাদের তৈরি করতে হবে না, করবো আমি। শোন, তোমাদের যা বলবো সেই ভাবে কাজ করবে।

আচ্ছা স্যার। বললো ফুলমিয়া।

কেশব যেমন অবাক হয়েছে, তেমনি হয়েছে হতবাকবাবু কি পাগল হলেন নাকি! ফুলের সন্ধান করতে এসে শেষে কিনা ফিল্ম তৈরি করবেন।

বনহুর কেশবের মনোভাব বুঝতে পেরে হেসে বললো–কেশব, সখ হলো ফিল্ম করার এবং আমার ছবিতে নায়িকা হবে ফুল।

বললো বনহুর–আর বিলম্ব নয় এক্ষুণি বেরুবো। প্রথমে একটা গাড়ির একান্ত দরকার।

ফুলমিয়া ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলো গাড়ি ডাকতে।

বনহুর বললো–গাড়ি কিনতে হবে বুঝলে?

ফুলমিয়া অবশ্য ততক্ষণে দরজায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফিরে দাঁড়িয়ে বললো–গাড়ি কিনবেন স্যার?

হাঁ, ছবি করতে হলে কতক্ষণ ভাড়াটে গাড়িতে কাজ চলবে, একটা গাড়ি কিনতেই হবে।

আজ অবশ্য ভাড়াটে গাড়িতেই বেরুতে হলো। বনহুর ছদ্মবেশে সজ্জিত হয়ে কেশব আর ফুলমিয়াসহ সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছিলো নিচে তখন ফাংফালিও–এর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।

কেশব আর ফুলমিয়ার সঙ্গে অপরিচিত এক ভদ্রলোককে দেখে অবাক হলেন ফাংফালিও বললেন তিনি ইনি কে চিনতে পারলাম নাতো?

ফুলমিয়া আর কেশব ভাল ইংলিশ বোঝে না, কাজেই ফাংফালিও এর কথার এক বর্ণও বুঝতে পারলো না তারা। বনহুর তখন নিজেই ইংলিশে পাল্টা জবাব দিলো–ভদ্র মহোদয়, আমি মিঃ আলমের বন্ধুজন। এসেছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। ফাংফালিও সসম্মানে পথ ছেড়ে দিলেন–ধন্যবাদ।

বনহুর ঐ দিনের মধ্যেই একটা মাষ্টার বুইক গাড়ি কিনে ফেললো। তারপর শুরু হলো তার কাজ।

কেশব আর ফুলমিয়া হলো তার সঙ্গী।

কেশব আর ফুলমিয়াকে সঙ্গে করেই একদিন বনহুর হাজির হলো পরিচালক আলী সাহেবের বাড়িতে। আলী সাহেবের নিকট কেশব আর ফুলমিয়াকে তার পার্টনার বলে পরিচয় দিলো।

এ কথা-সে কথার মধ্যে বললো বনহুর–আলী সাহেব, আমার পাটর্নারদেরও ইচ্ছা আপনি আমাদের ছবি পরিচালনা করবেন।

খুশি হয়ে আসলাম আলী রাজি হয়ে গেলেন। পরদিন চুক্তিবদ্ধ হবেন বলে কথা দিলেন বনহুরের কাছে।

সেদিনের মত বিদায় গ্রহণ করলো বনহুর, কেশব আর ফুলমিয়া।

এখনও বনহুর নিশ্চিন্ত নয় নূরী সম্বন্ধে–সে জানে না নূরীর কোনো সন্ধান। সে যে আসলাম আলী সাহেবের বাড়ি আছে না কোথায় আছে তাই বা কে জানে। তবে বনহুর আন্দাজ করে নিয়েছে নূরী আসলাম আলীর আয়ত্তেই আছে। আলী সাহেবের কথাবার্তায় সে বুঝতে পেরেছিলো, নূরীরই নামকরণ হয়েছে শশী।

বনহুরের সর্বক্ষণের চিন্তা নূরীকে উদ্ধার করা, কোনো সময় সে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না। কেমন করে নূরীর দর্শন পাবে, কবে তাকে নিয়ে বিদায় হবে, ত্যাগ করবে এই বোম্বে শহর, সব সময় এ কথাই ভাবতে লাগলো সে।

আম্বিয়া হোটেল থেকে যে টাকা সে পেয়েছিলো তা দু’দিনেই শেষ হয়ে গেলো। গাড়ি কিনতে এবং ফুলাগু হোটেলের খরচ জোগাতেই প্রচুর টাকা লাগলো বনহুরের। আগামীকাল আলী সাহেবকে ছবির কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ করতে হবে। তখন লাগবে বেশ কয়েক হাজার টাকা। তা ছাড়াও ছবির জন্য নায়িকা–হাঁ, নায়িকাকেও চুক্তিবদ্ধ করতে হবে। টাকা–অনেক টাকার প্রয়োজন।

বনহুর ফুলাগু হোটেলের নিজস্ব কামরায় বসে ভাবছিলো– সম্মুখে এ্যাসট্রে পাশেই সিগারেট কেস আর ম্যাচটা পড়ে আছে। আংগুলের ফাঁকে অর্ধদগ্ধ সিগারেট। টেবিলে খবরের কাগজখানা মেলে মনোযোগ সহকারে দেখছিলো সে, আর মাঝে মাঝে সিগারেটখানা ঠোঁটে চেপে ধরে ধুম গ্রহণ করছিলেন।

বনহুরের মুখমন্ডল অত্যন্ত গম্ভীর ভাবাপন্ন। ললাটে চিন্তা রেখা ফুটে উঠেছে। বেশ কিছুক্ষণ খবরের কাগজের পাতায় মনোযোগ দেবার পর উঠে পায়চারি আরম্ভ করলো সে।

এমন সময় কেশব প্রবেশ করলো তার কামরায়। বললো সে–বাবু, সেই ভদ্রলোক এসেছেন।

ভদ্রলোক! বনহুর পায়চারী বন্ধ করে প্রশ্নভরা দৃষ্টি তুলে তাকালো কেশবের মুখে।

হাঁ, সেই যে আমরা আজ দুপুরে যেখানে গিয়েছিলাম পরিচালক আলী সাহেব–

ওঃ তিনি এসে গেছেন? বনহুরের মুখমন্ডল ক্ষণিকের জন্য ভাবগম্ভীর হলো। চট করে নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললো–কোথায় তিনি?

কেশব বললো–Kনচে অপেক্ষা করছেন।

আচ্ছা নিয়ে এসো। হা শোন, আমাকে এভাবে তিনি দেখেননি, কাজেই আলী সাহেবকে আমার নতুনভাবে পরিচয় দেবে, বলবে আমি খান বাহাদুর শামস ইরানীর ছোট ভাই মাসুম ইরানী–একটু চিন্তা করে বললো বনহুর–আচ্ছা তুমি ওকে নিয়ে এসো, যা বলতে হয় আমিই বলবো।

কেশব চলে গেলো।

বনহুর আসন গ্রহণ করলো, ভুল তারই কারণ সে নিজেই তো আলী সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলো। হোটেলের ঠিকানাটাও তাকে দিতে ভুল করেনি বনহুর, কিন্তু এক্ষণে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে সব ভুলে গিয়েছিলো সে। ছিঃ ছিঃ এ কেমন ব্যাপার হলো! দ্রুত ছদ্মবেশ ধারণ সম্ভব নয়। যাক, কোনো রকমে ব্যাপারটা সহজ করে নিতে হবে।

বনহুর সিগারেট ধরালো।

এমন সময় কেশবসহ আসলাম আলী প্রবেশ করলেন কামরায়।

বনহুর যেন আলী সাহেবকে কোনদিন দেখেনি অবশ্য তার পরিচয় জানে, এমনি ভাব মুখে এনে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো–বসুন আলী সাহেব! আমি খান বাহাদুর শামস ইরানীর ছোট ভাই মাসুম ইরানী। ভাইজানকে বিশেষ জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছে তিনি আপনার সম্বন্ধে আমাকে সব বলে গেছেন।

আলী সাহেব আসন গ্রহণ করলেন, বিশেষ করে মাসুম ইরানীকে দেখে এবং তার ব্যবহারে অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন তিনি। ইতিপূর্বে এমন সুদর্শন ব্যক্তি তাঁর নজরে কমই এসেছে, কিছুক্ষণ তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, সহসা কোনো কথা তিনি বলতে পারলেন না।

বনহুর হেসে বললো–ভাইজান না থাকলেও আপনি আমাকে কোনোরকম সঙ্কোচ বোধ করবেন না যেন।

আলী সাহেবের সম্বিৎ ফিরে এলো, এতোক্ষণ ভাবছিলেন–এমনি একটি যুবককে তিনি যদি চলচ্চিত্র জগতে নায়ক হিসাবে পেতেন তাহলে সত্যিই সে ছবি বাজারে হিট না করে যেতো না। মাসুম ইরানীর কথায় তর চিন্তাধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বলেন আলী সাহেব–না না, সঙ্কোচের কি আছে। খান বাহাদুর সাহেব যখন বিশেষ কারণে বাইরে গেছেন তখন পরে না হয় দেখা করবো আর একবার।

আচ্ছা তা মন্দ নয়। তবে এখন আপনি আমাদের অতিথি, আপনাকে তো ছেড়ে দিতে পারি না। কথাটা বলে বনহুর কলিং বেলে চাপ দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে ফুলাগুর বয় প্রবেশ করে কুর্নিশ জানায়–স্যার।

বনহুর ফুলাগু হোটেলের বিশিষ্ট খাবারের জন্য অর্ডার দেয়।

আলী সাহেব অবশ্য অমত করেন কিন্তু বনহুর সে কথায় কান দেয়না।

অল্পক্ষণেই স্তূপাকারে খাবারে টেবিল পরিপূর্ণ হলো। নানা রকম আপত্তি সত্ত্বেও আসলাম আলীকে খেতে হলো বেশ কিছুটা। কেশব আর ফুলমিয়াকেও এ টেবিলে যোগ দিতে হলো। এ কথা-সে কথার পর আলী সাহেব বিদায় গ্রহণ করলেন।

বিদায়কালে বনহুর বললো–ভাইজান এলেই তাকে আপনার কথা বলবো এবং তিনি দরকার মনে করলেই যাবেন আপনার ওখানে।

আসলাম আলী খুশিমনে তখন বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

বনহুরের মাথার মধ্যে আবার চিন্তাজাল ছড়িয়ে পড়লো। সে ভাঁজ করা পত্রিকাখানা মেলে নিয়ে বসলো। কতক্ষণ মনোযোগ সহকারে পত্রিকাখানায় নজর বুলিয়ে নিয়ে উঠে পড়লো, হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো–এখন রাত্রি আটটা পঁচিশ।

বনহুর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, একটা জুয়েলার্সের দোকানের সম্মুখে গাড়ি রেখে ভিতরে প্রবেশ করলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে একটি তরুণী প্রবেশ করলো দোকানটার মধ্যে। তরুণীর হাতে ভ্যানিটী ব্যাগ।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বোম্বাই-এর অধিবাসী তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ তাদের পোশাক পরিচ্ছদেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক কন্যার ইচ্ছামত কতকগুলো মূল্যবান অলঙ্কার ক্রয় করলেন।

বনহুর ততক্ষণে একটি নেকলেস হার নিয়ে মাপযোক করছিলো এবং দোকানের বিক্রির আয় ব্যাপারে লক্ষ্য করছিলো। তরুণী এবং প্রৌঢ় ভদ্রলোক প্রায় দশ হাজার টাকা মূল্যের অলঙ্কার ক্রয় করে বিদায় গ্রহণ করলো। সেই মুহূর্তে অন্যান্য গ্রাহকও ঐ রকম মূল্যের অলঙ্কার খরিদ করছিলো।

বনহুর একটা নেকলেস হার পছন্দ করে ফেললো কিন্তু নেকলেসের ভিতরে বসানো একটি পাথর পাল্টে নেওয়ার জন্য সে অর্ডার দিয়ে পরে আসবে বলে গেলো। নেকলেস-খানার মূল্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় গ্রহণ করলো যাওয়ার সময় বলে গেলো যতক্ষণ সে ফিরে না আসে ততক্ষণ যেন দোকান খোলা রাখে কারণ সে ভোরের প্লেনেই বোম্বে ত্যাগ করবে। অন্যান্য কাজ ইতিমধ্যে সেরে নিয়ে এসে পড়বে, তবে ফিরতে একটু বিলম্ব হতে পারে।

বনহুর গাড়িতে বসে সিগারেট ধরালো। বোম্বে শহরে সবচেয়ে নামকরা জুয়েলার্স না হলেও একেবারে ছোটখাটো দোকান নয়। এ দোকানের বিক্রি দৈনিক প্রায় এক লক্ষের কম নয়। বনহুর আর একবার দোকানের সাইন বোর্ডের লেখাগুলো পড়ে নিলো। ইংলিশে বড় বড় অক্ষরে লেখা– ঈশিকা জুয়েলার্স, অক্ষরগুলো রঙিন টিউব বাল্বে জ্বলছে আর নিভছে। সাইন বোর্ডের চারপাশে নানা ধরনের রঙিন বাল্ব। সুন্দর ঝলমল করছে দোকানখানা। বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দিলো–এখন দশটা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। ফিরে আসবে বনহুর বারোটার পূর্বে নয়–শুধু নেকলেস নিতেই সে আসবে না চাই, তার প্রচুর অর্থ। এভাবে অর্থ নেওয়ার মোটেই ইচ্ছা ছিলো না তার, কিন্তু না নিলেই যে নয়।

রাত বারোটা বেজে গেলো, ঈশিকা জুয়েলার্সের মালিক উদ্বিগ্নভাবে প্রতীক্ষা করছেন, ভদ্রলোক এতোক্ষণ আসছেন না কেন! তার দোকানের আশেপাশের দোকানগুলো প্রায় সবগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। সোনার দোকান-বেশি রাত অবধি খোলা রাখা নিরাপদ নয়, এ কারণেই এ দোকানগুলো সকাল সকাল বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে কোনো কোনোটা।

পথ নির্জন না হলেও জনসংখ্যা কমে এসেছে অনেক, যানবাহনও হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে শীতের রাত বারোটা বাজলে একেবারে শেষ রাত মনে হয়।

ঈশিকা জুয়েলার্সের লৌহকপাটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সম্মুখে সামান্য একটু খোলা, মালিক। বেচারী চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। ভদ্রলোক এসে নেকলেস ছড়া নিয়ে টাকাগুলো দিয়ে গেলেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে যাবেন।

অন্যান্য কর্মচারী সবাই চলে গেছে, মালিক স্বয়ং রয়েছেন আর আছে তার একজন বিশিষ্ট কর্মচারী।

এমন সময় বনহুরের গাড়ি এসে থামলো জুয়েলার্সের দোকানের সম্মুখে। এখানে বনহুর নিজের গাড়ির নাম্বার প্লেট সরিয়ে ফেলেছে। বনহুর গাড়ি থেকে নামবার পূর্বে পকেটে রিভলভারের অস্তিত্বটা একবার অনুভব করে নিলো। দোকানে প্রবেশ করতেই মালিক শশব্যস্তে বললেন–এসেছেন, এতোক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

বনহুর হাতের অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা নিচে নিক্ষেপ করে জুতো দিয়ে পিষে ফেললো, তারপর এগিয়ে গেলো সম্মুখে–কাজ সেরে ফিরতে বিলম্ব হয়ে গেলো! কথা বলার ফাঁকে একবার চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখে নিলো বনহুর।

দোকানের মালিক তখন নেকলেসখানা বের করে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিলেন। তার কর্মচারী লোকটিও পাশেই দাঁড়িয়েছিলো। দোকানের মধ্যে আর কোনো লোকজন নেই।

বনহুর ক্ষিপ্রহস্তে পকেট থেকে রিভলভারখানা বের করে চেপে ধরলো মালিকের বুকে, তারপর বললো–শীঘ্র ক্যাশের টাকাগুলো দিয়ে দিন। মুহূর্ত বিলম্ব করলে গুলী করবো।

সঙ্গে সঙ্গে দোকানের মালিক এবং তার কর্মচারীর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো। হঠাৎ কিছু বুঝতে পারছেন না, সব যেন কেমন ঘোরালো লাগছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছেন শুধু ওরা।

বনহুর বললো–চিৎকার করলেই আমি হত্যা করবো, কোনোরকম আপত্তি না করে শীঘ্র ক্যাশের সমস্ত টাকা আমাকে দিয়ে দিন।

এতোক্ষণে হুশ হলো যেন, কথা বললেন দোকানের মালিক–আপনি…আপনি ডাকু?

হাঁ, আমি ডাকুই বটে! বিলম্ব করবেন না, দিন?

ডাকু মালিকের বুকে রিভলভার চেপে ধরেছে, কোনোরকম উচ্চবাক্য বের হলো না তার সাথীর মুখে, সে ভয়-বিহ্বলভাবে তাকাচ্ছে শুধু।

মালিকের মুখ মরার মুখের মত বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, কোনো উপায় নেই এর হাত থেকে উদ্ধার পাবার। অগত্যা মালিক তার কর্মচারীকে লৌহসিন্দুক খুলে সমস্ত ক্যাশ টাকা দিয়ে দিতে বললেন।

লোকটা মালিকের কথামত কাজ করলো–সিন্দুক খুলে হাজার হাজার টাকার বান্ডিল এনে রাখলো বনহুরের সম্মুখে।

বনহুর ডান হাতে রিভলভার ঠিক রেখে বাম হাতে টাকার বান্ডিলগুলো কোট আর প্যান্টের পকেটে ভরে নিলো। অত্যন্ত দ্রুতহস্তে কাজ শেষ করে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো–তারপর আর তাকে কে পায়!

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বনহুর গাড়ি নিয়ে ফিরে এলো ফুলা হোটেলে। গাড়ি গ্যারেজে উঠিয়ে রেখে নিজের ক্যাবিনে প্রবেশ করলো। কেশব আর ফুলমিয়া চিন্তিত মুখে বসে আছে তার। প্রতীক্ষায়।

সিঁড়িতে ভারী জুতোর শব্দ শুনেই ওরা খুশিতে উছলে উঠলো, নিশ্চয়ই তাদের বাবু ফিরে এসেছেন।

বনহুর কামরায় প্রবেশ করে কেশব আর ফুলমিয়াকে জেগে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললো–তোমরা এতো রাত জেগে আছো? ঘুমালেই পারতে।

কেশব বললো–নতুন জায়গা, রাত একটা অবধি বাইরে কাটাবেন,–আর আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাবো?

বলে উঠে ফুলমিয়া–এসব শহরে যা চোর-ডাকুর আড্ডা। কখন কোন্ ডাকুর হাতে পড়ে যাবেন স্যার!

হাসলো বনহুর, বললো–ভয় নেই ফুলমিয়া, ডাকু কি নেবে আমার কাছ থেকে? আমি তো আর টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরি না। যাও, তোমরা এবার নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে যাও?

কেশব আর ফুলমিয়া চলে গেলো নিজেদের কামরায়, বনহুর দরজা বন্ধ করে দিলো ভিতর থেকে।

পরদিন খান বাহাদুর শামস ইরানীর বেশে সজ্জিত হয়ে বনহুর গাড়ি নিয়ে রওয়ানা দিলো পরিচালক আলী সাহেবের বাড়ির দিকে। যাবার সময় বেশ কিছু টাকা সে সঙ্গে নিলো।

গ্রীন হাউসে পৌঁছতেই আলী সাহেব সাদর সম্ভাষণ জানালেন, আজ আসলাম আলী চুক্তিবদ্ধ হবেন, শুধু তিনিই নন–শশীকেও চুক্তিবদ্ধ করা হবে শামস ইরানীর ছবির জন্য।

খান বাহাদুর শামস ইরানীকে নিয়ে হলঘরে প্রবেশ করলেন আসলাম আলী।

হলঘরে প্রবেশ করতেই বিস্মিত হলো বনহুর–গত রাতের সেই জুয়েলার্স–চোখেমুখে। বিষাদের ছাপ, রুক্ষ চুল, উদভ্রান্ত চেহারা।

কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেই বললেন আলী সাহেব–ইনি আমার বড় ভাই বশীর আলী জুয়েলার্স। কাল রাতে এর চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে!

বনহুর আসন গ্রহণ করে বললো–সর্বনাশ হয়েছে! কি সর্বনাশ?

হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন বশীর আলী সাহেব–গতরাতে আমার প্রায় লক্ষ টাকা ডাকু হরণ করে নিয়ে গেছে। আমার যথাসর্বস্ব গেছে…আমার যথাসর্বস্ব গেছে…

বনহুর বুঝতে পারলো, এই বশীর আলীই সেই জুয়েলার্স গতরাতে যার যথাসর্বস্ব সে লুট করে নিয়ে এসেছে। বেশ তো, এক ভাই-এর অর্থ আর এক ভাই-এর হাতে চলে আসবে। বনহুর মুখোভাবে বিস্ময় টেনে বললো–পুলিশে খবর দেননি?

হ দিয়েছি, কিন্তু কোনো ফল হবে না, ডাকু সম্পূর্ণ বিদেশী লোক।

কি করে আপনি জানলেন সে বিদেশী? বললো খান বাহাদুর শামস ইরানী-বেশি বনহুর।

বশীর আলী সাহেব গত রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন, আরও বললেন–ডাকু আজ ভোরের প্লেনেই বোম্বে ত্যাগ করেছে তাতে কোনো ভুল নেই।

এবার আশ্বস্ত হলো বনহুর, বললো–ডাকু তাহলে বোম্বে নেই! যাক্ কতকটা নিশ্চিন্ত হলাম।

বশির আলী বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন–তার মানে! আপনি…

মানে, আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়াছিলাম কিনা। দেখুন, গত পরশুর পত্রিকায় একটি ঘটনা দেখেছি, কোনো এক হোটেলে গভীর রাতে একজন জমকালো পোশাক-পরা ব্যক্তি হানা দিয়ে সমস্ত ক্যাশ টাকা লুটে নিয়ে চলে গেছে।

আলী সাহেব বললেন–ঠিক বলছেন খান বাহাদুর সাহেব, বোম্বে শহরে কোনো এক ভয়ঙ্কর দুর্দান্ত ডাকুর আবির্ভাব ঘটেছে, যার বুদ্ধি-কৌশল আর শক্তি অসীম।

হাঁ, আমারও ঠিক সেই রকম মনে হয়। কথাটা এবার চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো বনহুর ডাকুটি আর বোম্বে নেই জেনে সত্যি আমি অনেকখানি স্বস্তি লাভ করছি।

এমন সময় পাশের টেবিলে ফোন বেজে উঠে; আসলাম আলী উঠে গিয়ে রিসিভার হাতে উঠিয়ে নেন–হ্যালো স্পিকিং আলী সাহেব। কি বললেন, বোম্বে এরোড্রামে ডাকু ধরা পড়েছে?…হ্যালো হ্যালো, ডাকু ধরা পড়েছে? আচ্ছা এক্ষুণি ভাইজানকে পাঠাচ্ছি। আচ্ছা, ধন্যবাদ…রিসিভার রেখে এসে বসলেন আলী সাহেব। বললেন–ভাইজান, ডাকু ধরা পড়েছে।

শুনলাম। সত্যি আমার সৌভাগ্য।

আপনি এক্ষুণি এরোড্রামে চলে যান, সেখানে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে আটক রেখেছে, আপনি সনাক্ত করবেন।

হাঁ, আমি ঠিক তাকে চিনে নেবো, কারণ তাকে আমি ভালভাবে দেখেছি।

বনহুরের মুখে হাসির আভাস ফুটে উঠলো, মনে মনে ভাবলো, না জানি কোন্ বেচারী ডাকু নামে গ্রেপ্তার হয়ে বসে আছে। প্রকাশ্যে বললো সে–বশীর আলী সাহেব, আপনার সৌভাগ্যই বটে। না হলে ডাকু এতো বুদ্ধিমান হয়েও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়? যান দেখুন, টাকাগুলো হয়তো এখনও তার হাতের এ্যাটাচীতেই রয়েছে।

আসলাম আলী বশীর সাহেবকে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলেন। এবার আলী সাহেবের অফিস-রুমে বসে কাজ শুরু হলো। অফিস-রুমে আলী সাহেবের সহকারিগণ কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছিলো। আলী সাহেব খান বাহাদুর শামস ইরানীর ছবি পরিচালনার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হলেন। খান বাহাদুর শামস ইরানী-বেশি বনহুর সম্পূর্ণ টাকা একযোগে আসলাম আলীকে প্রদান করলো।

আসলাম আলীর চোখেমুখে ফুটে উঠলো আনন্দোচ্ছ্বাস। কারণ কোনো প্রযোজক ছবি তৈরির পূর্বেই পরিচালকের প্রাপ্য সম্পূর্ণ বুঝিয়ে দেন না। আজ তার ব্যতিক্রম দেখে এবং এতোগুলো অর্থ একযোগে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন।

বনহুর এবার তার ছবির জন্য নায়িকা শশীকে চুক্তিবদ্ধ করার জন্য আগ্রহ দেখালো।

আসলাম আলীর হৃদয়ে অপূর্ব অনুভূতি–শশী তাঁরই, কাজেই শশীর প্রাপ্য অর্থও তার। যদিও এখন সে শ্যামার ওখানেই আছে। আলী সাহেব বনহুরকে সঙ্গে করে শ্যামার ওখানে গেলেন।

সুসজ্জিত ড্রইংরুমে আসলাম আলী বনহুরকে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।

বিপুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো খান বাহাদুর শামস ইরানী-বেশি দস্যু বনহুর। আর একটু পরই সে তার নূরীকে দেখতে পাবে। আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠলো তার বুক।

একটু পরে ফিরে এলেন আলী সাহেব, সঙ্গে তাঁর শ্যামা।

বনহুরের মন দমে গেলো, তাকিয়ে আছে সে নিশ্চুপ দৃষ্টি মেলে।

বললেন আলী সাহেব–এ আমার ছবির নায়িকা শ্যামা আর ইনি খান বাহাদুর শামস ইরানী। ইনার সম্বন্ধেই তোমাকে বলেছিলাম শ্যামা।

শ্যামা আদাব জানালো।

বনহুরও আদাব জানালো শ্যামাকে।

বললেন আবার আলী সাহেব–খান বাহাদুর, বড় দুঃখিত, শশীকে কিছুতেই আনতে পারলাম না।

শ্যামা ও তার কথায় যোগ দিয়ে বললো–আমরা অনেক করে বোঝালাম কিন্তু কিছুতেই ওকে…

বনহুরের মুখ মুহূর্তে কালো হয়ে উঠলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে–কিন্তু শশীকেই যে আমার ছবির নায়িকা করবো ভেবেই আমি…

আলী সাহেব শান্তভাবে বললেন–আমি জানি খান বাহাদুর সাহেব, কিন্তু…

কিন্তু বললে তো চলবে না, যত টাকা সে চায় আমি তাই দিতে রাজি আছি আলী সাহেব।

আলী সাহেব শ্যামার দিকে তাকিয়ে বললেন–শুনলে তো খান বাহাদুর সাহেবের কথা। শ্যামা, তুমিই আমার ভরসা। স্বয়ংবরাতে ওকে ক্যামেরার সম্মুখে আনতে আমি হিমসিম খেয়ে গিয়েছিলাম। এমন কি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ওর ব্যাপারে তুমিই আমাকে সহায়তা করেছিলে বলেই আমি কাজ শেষ করতে পেরেছি। এবারও তুমি ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।

বনহুর তার নকল দাড়িতে হাত বুলিয়ে মিনতির সুরে বললো–মিস শ্যামারাণী, আপনি যান আর একবার চেষ্টা করে দেখুন। আমার খুব ইচ্ছা, তাকে আজই আমি আমার ছবির জন্য চুক্তিবদ্ধা করতে চাই।

অগত্যা শ্যামা আর আলী সাহেব পুনরায় ভিতর বাড়িতে প্রবেশ করলো।

বনহুর মনে মনে খোদাকে স্মরণ করতে লাগলো, নূরী যদি না আসে তাহলে তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

মিনিটের পর মিনিট কেটে চললো, প্রায় ঘন্টা কেটে গেলো–বনহুর ক্রমেই অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বার বার ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকাচ্ছে ওদিকের দরজার মোটা পর্দাটার দিকে। সত্যি কি সে নূরীকে দেখতে পাবে?

বনহুর উঠে পায়চারি শুরু করে দিলো, মনের অস্থিরতা সে কিছুতেই যেন দমিয়ে রাখতে পারছিলো না। মুখমণ্ডলে চঞ্চলতার ছাপ ফুটে উঠেছে।

সামান্য একটু পর্দাটা নড়ে উঠলেই চমকে উঠছিলো–এই বুঝি এলো নূরী, এই বুঝি এলো–

সত্যি এবার পর্দা নড়ে উঠলো, কক্ষে প্রবেশ করলেন আলী সাহেব, শ্যামা আর তার আকাক্ষিতা নূরী।

বনহুর প্রথমে কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, নূরীকে সে দিব্যচোখে দেখছে–এ যেন বাস্তব নয়। নূরী তো হারিয়ে গেছে সেই সুদূর পর্বতের উপরে। জংলিগণ তাকে হত্যা করেছে। না না, নূরী বেঁচে আছে–তার সম্মুখে দন্ডায়মান। বনহুর অতি কষ্টে নিজেকে সংযত রাখলো যদিও তার বুকের মধ্যে ভীষণ একটা আলোড়ন অনুভব করছিলো। কোনো কথা সে চট করে বলতে পারলো না।

আলী সাহেব পরিচয় দিলেন–এর নাম শশী।

বনহুর তখনও নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে, নূরীকে সে কোনোদিন এমন ড্রেসে দেখেনি। বন-দুহিতা নূরীকে আজ বনহুর দেখলো আধুনিক এক তরুণী বেশে। কুঞ্চিত কেশরাশি মাথার উপর ডালা করে বাঁধা! খোঁপার উপরে উজ্জল মতি-বসানো ক্লিপ আঁটা। কানে, গলায় এবং হাতের কব্জিতে সেট করা মূল্যবান গহনা। ফিকে আকাশী রং-এর শাড়ি, ব্লাউজ এবং পায়ের জুতা জোড়াও। সরু বাঁকানো ঠোঁট দুখানা লিপষ্টিকে রঞ্জিত। বাম হস্তের কব্জিতে রিষ্টওয়াচ-বনহুর নূরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিপুণ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো। অভিনেত্রীর ড্রেসে নূরীকে অপূর্ব মানিয়েছে। কিন্তু পূর্বের সেই চঞ্চলতা কই নূরীর মধ্যে! এ যেন আর এক নূরী। ভয়-বিহ্বল চোখে একবার সে বনহুরের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো।

আলী সাহেব বুঝতে পারলেন–শশীর রূপরাশি খান বাহাদুর শামস ইরানীর চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে। হেসে বললেন–খান বাহাদুর সাহেব, শশীকে আপনার কেমন লাগছে?

বনহুর ছোট্ট করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো–অপূর্ব!

সেইদিনই শশীকে বনহুর চুক্তিবদ্ধা করলো তার ছবির নায়িকা হিসাবে।

আজ এই পর্যন্ত কাজ হলো।

আলী সাহেব বলেছিলেন–খান বাহাদুর সাহেব, আপনি যখন খুশি আসবেন এবং শ্যামা ও। শশীর সঙ্গে আলাপ করে যাবেন।

খুশি হলো বনহুর, বললো সে নিশ্চয়ই আসবো, না এলে যে আমার চলবে না।

শ্যামা হেসে বললো–আপনার ছবির নায়িকা যখন শশী তখন সে এখন আপনারই।

বনহুরও হাসলো–আপনিও বাদ যাবেন না, আমার ছবিতে আপনিও থাকবেন বিশিষ্ট এক চরিত্রে।

ধন্যবাদ খান বাহাদুর সাহেব। বললো শ্যামা।

আলী সাহেব বললেন–নিশ্চয়ই শ্যামাও থাকবে।

বললো বনহুর–আপনাকেও আমি চুক্তিবদ্ধা করবো মিস শ্যামা।

সেদিনের মত বনহুর বিদায় গ্রহণ করলো।

বনহুরকে আজ বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। হোটেল ফুলাগুর বেলকনিতে বসে তাকিয়ে আছে সে আলো ঝলমল বোম্বে নগরীর অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে। কর্ম-কোলাহলমুখর রাজপথ, পথের দুধারে সুউচ্চ দালান-কোঠা। অসংখ্য দালান-কোঠার মধ্যে দিয়ে প্রশস্ত পথ এগিয়ে গেছে সম্মুখের দিকে। পথের উপর দিয়ে অসংখ্য গাড়ি চলেছে সারিবদ্ধভাবে।

বনহুর নূরীকে আজ স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছে, বেঁচে আছে নূরী–এ যে তার কাছে কত বড় আনন্দের কথা!

পাশেই বসে আছে দু’খানা আসনে কেশব আর ফুলমিয়া। শ্যামার ওখান থেকে ফিরে এসে সব খোলাসা বলেছে বনহুর কেশব আর ফুলমিয়ার কাছে। কেশবের খুশি আর ধরছে না। তার বোন ফুল জীবিত এ যে সে কল্পনা করতে পারেনি, আজও যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না যতক্ষণ ফুলকে সে নিজ চোখে না দেখেছে ততক্ষণ মনকে বোঝাতে পারছে না কেশব।

আর ফুলমিয়া–সে তো নূরীকে দেখেইনি, কেমন সে তাও জানে না, কাজেই ফুলমিয়া সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে।

বনহুর গভীরভাবে কিছু চিন্তা করে বললো–কেশব, নূরীকে উদ্ধার করার আশায় আমাদের আরও কয়েক দিন বোম্বেতে কাটাতে হবে। তুমি এদিকে প্রস্তুত থেকো, বোম্বে থেকে কবে কখন কোন্ প্লেন দিল্লী অভিমুখে রওয়ানা দেয়, সেইভাবে আমাকে কাজ শেষ করতে হবে।

বাবু, আমি কালই এ সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহ করে আনবো। ফুলমিয়াকে সঙ্গে নিয়েই যাবো।

বেশ, তাই যেও।

আরও কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা চলার পর বনহুর উঠে পড়লো।

কেশব আর ফুলমিয়াও সে রাতের মত চলে গেলো নিজেদের কামরায়।

পরদিন সকালে বাইরে গেলো বনহুর। একটা জুয়েলার্সের দোকান থেকে মূল্যবান দু’ছড়া হার কিনে নিলো। ফিরে এলো বনহুর হোটেলে। সমস্ত দুপুরটা বিছানায় শুয়ে কাটালো সে। বনহুরের দ্যপ্রাণ আজ একটি নারীর সংস্পর্শের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

সন্ধ্যার পূর্বে বনহুর খান বাহাদুর শামস ইরানীর বেশে সজ্জিত হলো, তারপর গাড়ি নিয়ে। সোজা বেরিয়ে পড়লো শ্যামারাণীর বাস ভবনের উদ্দেশ্যে।

গাড়ি শ্যামারাণীর বাড়ির গেটে পৌঁছতেই একটি বয় এসে তাকে ড্রইংরুমে নিয়ে বসালো। তারপর চলে গেলো সে ভিতর বাড়িতে।

একটু পরেই শ্যামা বিচিত্র ড্রেসে সজ্জিত হয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো, সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালো সে খান বাহাদুর শামস ইরানীকে।

শামস ইরানী আসন গ্রহণ করে বললো–মিস শ্যামা, আমি আপনাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি।

সেই কারণেই বুঝি আজ পদধূলি দিলেন?

ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন। আপনাদের সাক্ষাৎ লাভের আশায় এসেছি মিস শ্যামা।

আমাদের, না শশীর সাক্ষাৎ কামনা করেন?

আপনাদের উভয়কেই আমি…

ধন্যবাদ। কিন্তু শশী যে কাল থেকে চরমভাবে বেঁকে বসেছে, কিছুতেই ওকে বাগে আনতে পারছি না!

তাহলে তো বড় মুশকিলের কথা মিস শ্যামা। বিমর্ষ কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করলো খান বাহাদুর শামস ইরানী।

শ্যামা হঠাৎ হেসে উঠলো খিল খিল করে, তারপর হাসি থামিয়ে বলে সে ঘাবড়ে যাবেন না খান বাহাদুর সাহেব, কাজের বেলায় ঠিকই পাবেন। মনে রাখবেন–শ্যামা সব পারে।

শামস ইরানীর মুখে হাসি ফুটে উঠে, বলে সে সত্যি আপনাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না মিস শ্যামারাণী।

আবার হেসে উঠে শ্যামা–উপকার না করতেই আপনি দেখছি ধন্যবাদের ডালা উজাড় করে দিলেন। পরে কি দেবেন!

সেজন্য ভাবতে হবে না মিস শ্যামারাণী।

ওঃ তাই নাকি?

হাঁ। এই দেখুন মিস শ্যামারাণী, আজ আপনাদের দু’জনার জন্য সামান্য কিছু উপহার এনেছি। বনহুর হারের প্যাকেট দুটো বের করে শ্যামার সম্মুখস্থ টেবিলে রাখে।

ড্রইংরুমের উজ্জ্বল আলোকরশ্মিতে হাত দুটো ঝলমল করে উঠলো। হারের পাথরগুলো থেকে, যেন বিদ্যুৎ ছটা ঠিকরে বের হচ্ছে।

শ্যামারাণীর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো চক চক করে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো–অপূর্ব!

নিন, আপনাদের জন্য এ দুটো এনেছি।

শ্যামা একটা হাত তুলে নিয়ে গলায় পরে নিলো। অপরটি নিয়ে ছুটলো ভিতর বাড়িতে।

বনহুর কান পেতে রইলো, শুনতে পেলো শ্যামার খুশিতে ডগমগ কণ্ঠস্বর–শশী, দেখো দেখো, খান বাহাদুর সাহেব আমাদের জন্য কি এনেছেন?

নূরীর কণ্ঠ শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলো বনহুর কিন্তু কোনো শব্দই শোনা গেলো না বিপরীত পক্ষ থেকে। শ্যামার আনন্দ-ভরা গলার পর পর প্রতিধ্বনি–নে নে দেখি, বড় লাজুক মেয়ে তুই। ছবিতে অভিনয় করতে এসে অতো লজ্জা করলে চলে না, বুঝলি?

বনহুর বুঝতে পারলো, নূরী তার হারছড়া উপেক্ষা করছে।

একটু পরে ফিরে এলো শ্যামারাণী, বিমর্ষ তার মুখমন্ডল। হাতে হারছড়া, বললো সে– পারলাম না ওকে কিছুতেই এটা নেওয়াতে–আপনি চলুন, যদি গ্রহণ করাতে পারেন।

এটুকুই চাইছিলো বনহুর, অনুসরণ করলো সে শ্যামাকে। ভিতর কক্ষে প্রবেশ করে দেখলো বনহুর, নূরী একটা খাটের পায়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। আজ নূরীর দেহে কোনোরকম সাজ সজ্জার লেশ নেই। তবে একটা শাড়ি পরিপাটি করে বাঙালি প্যাটার্ণে পরা রয়েছে।

বনহুর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

শ্যামা বললো–কি হলো, আপনি দেখছি শশীর কাছে একেবারে বোবা বনে যান?

সম্বিৎ ফিরে পায় বনহুর, শ্যামার হাত থেকে হারছড়া নিয়ে এগিয়ে যায় শশীর দিকে–মি। শশীরাণী!

না না, ও হার আমি নেবো না। হঠাৎ বলে উঠে শশী।

তা হয় না, তোকে নিতেই হবে শশী। ভদ্রলোক যদি আজ উপহার দিতে এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যান তাহলে আলী সাহেব তোকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। ভুলে যাসনে শশী, শুধু তিনি তোর অভিনয়ের জন্যই…

হঠাৎ শশী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে–থাক আর বলতে হবে না। দিন, ও মালা আমি নেবো।

বনহুর অবাক হয়, সর্প যেমন ঔষধের গন্ধে মুহূর্তে দমে যায় তেমনি শ্যামার ইংগিতপূর্ণ কথায় নূরীর ক্রুদ্ধভাব কোথায় যেন উবে যায় একেবারে। নূরী শামস ইরানীর হাত থেকে হারছড়া হাতে তুলে নেয়।

আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে শামস ইরানীর মুখ।

শ্যামার মুখেও হাসি ফোটে।

শামস ইরানীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয় শ্যামার। শ্যামা এবার নূরীর হাত থেকে হারছড়া নিয়ে পরিয়ে দেয় তার গলায়।

শামস ইরানী বলে উঠে–চমৎকার!

হঠাৎ চমকে উঠে নূরী, এ কণ্ঠস্বর যেন হৃদয়ে প্রচন্ড ধাক্কা দেয়। তার বনহুরের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি যেন সে শুনতে পায় প্রৌঢ় শামস ইরানীর গলায়।

শ্যামা বলে–খান বাহাদুর সাহেব, একদিন আপনার হোটেলে যাবো। আসলাম আলীর কাছে জানতে পারলাম, আপনার ছোট ভাই নাকি আপনার ওখানে থাকেন? অনেক প্রশংসা করলেন তিনি তার।

হ, আমার ছোট ভাই মাসুম ইরানী আমার কাছেই আছে।

আসলাম আলী বললেন–আপনার ছোট ভাইটি নাকি দেখতে অপূর্ব? হিরোর মত নাকি তার চেহারা?

হাসলো বনহুর হতে পারে।

আমি গেলে আপনার ভাই যদি অসন্তুষ্ট হন?

আমার ভাই আপনাকে পেলে খুশিই হবে কারণ বোম্বে এসে সে মিশবার জন্য কাউকে তার সাথী হিসেবে বেছে নিতে পারেনি এখনও।

সত্যি?

হা, মিস শ্যামারাণী।

তাহলে কালকেই আসলাম আলীর সঙ্গে হানা দেবো আপনার হোটেল ফুলাগুতে।

নিশ্চয়ই। কিন্তু মিস শশীকে যেন নিয়ে যাবেন না।

কেন? ওকে এতো ভয় কেন আপনার?

কি জানি আমার ছবির নায়িকা শেষে যদি…থাক পরে বলবো।

ওঃ বুঝতে পেরেছি, আপনার ভাইটিকে যদি পছন্দ করে বসে।

মিথ্যা নয়। হাসলো শামস ইরানী।

শ্যামাও হাসলো তার হাসিতে যোগ দিয়ে।

বনহুর একটা পত্রিকা নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ছিলো, এমন সময় কেশব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে–বাবু, বাবু, একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

পত্রিকা থেকে চোখ তুলে বললো বনহুর–ওঃ মিস শ্যাম? আচ্ছা নিয়ে এসো তাকে।

কেশব চলে গেলো।

ফুলমিয়াও অনুসরণ করলো কেশবকে। মেয়ে মানুষের কথা শুনে ফুলমিয়াও একটু হাবা বনে গিয়েছিলো, তবে কি সেই ফুল এসেছে?

কেশবের সঙ্গে যে মেয়েটি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো উপরে সে যে ফুল নয়–এ ব্যাপারে। নিঃসন্দেহ হলো ফুলমিয়া একটু পরেই, যখন কেশব এসে জানালো, এ আবার কে এসে জুটলো!

মেয়েটির আঁটসাট পোশাক এবং তার অত্যাধুনিক সাজসজ্জা ভাল লাগলো না কেশব আর। ফুলমিয়ার।

তরুণী অন্য কেউ নয়, চিত্রতারকা শ্যামারাণী।

শ্যামা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ালো, একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, তারপর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হলো সম্মুখস্থ যুবকটির উপর।

বনহুর যেন শ্যামাকে এই প্রথম দেখছে, মুখোভাবে এমনি ভাব টেনে বললো–আপনি বুঝি মিস শ্যামারাণী?

হা, কিন্তু খান বাহাদুর সাহেব কই?

একটু হেসে বললো বনহুর–ভাইজান জরুরি একটা কাজে বাইরে গেছেন। তিনি এজন্য অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলেন। তবে আপনার সম্বন্ধে ভাইজান আমাকে বিশেষভাবে বলে গেছেন। বসুন মিস শ্যামারাণী।

শ্যামার চোখেমুখে আনন্দের দ্যুতি, আসন গ্রহণ করে সে।

বনহুরও পাশের আসনে বসে পড়ে।

শ্যামা নিজকে সচ্ছ স্বাভাবিক করে নেয়, বলে–আমি তো আপনার সঙ্গেই আলাপ করতে এসেছি। উনি জরুরি কাজেই বাইরে গেছেন, তাতে দুঃখিত হবার কি আছে।

বনহুর হাতের মধ্যে হাত কচলায়–আপনি আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন, এ যে আমার পরম সৌভাগ্য।

কি যে বলেন, আমি আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে কত সে আনন্দিত হলাম। আসলাম আলীর কাছে আপনার গুণাগুণের প্রশংসা শুনে সত্যি আপনার সঙ্গে পরিচয় করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আলী সাহেবের কাছে এই হোটেলের ঠিকানা জেনে নিয়েছি।

আমার প্রশংসা–কি যে বলেন!

দেখুন মিঃ মাসুম, আপনার গলার স্বরের সঙ্গে আপনার ভাইয়ের স্বরের অনেকটা মিল আছে। একই মায়ের সন্তান তো!

বনহুর শুধু হাসলো একটু, কোনো জবাব দিলো না।

বনহুর বললো–বলুন মিস শ্যামারাণী, আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?

কিছু না। আপনার মহৎ ব্যবহারে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি।

বার বার ওসব মন ভোলানা কথা না বলে বলুন কি খাবেন–ঠান্ডা কিছু, না গরম?

যা আপনার ভাল লাগে।

বনহুর কলিং বেলে চাপ দিতেই বয় এসে দাঁড়ালো।

যে-কোনো ভাল মিষ্টি নিয়ে এসো আর কফি দু’কাপ।

উঁ হুঁ মিষ্টি নয়–ঝাল।

আচ্ছা, গরম বোম্বে সিংগারা আর দুটো রোষ্ট নিয়ে এসো।

বয় চলে যায়।

শ্যামা অল্পক্ষণে অত্যন্ত সহজ হয়ে এসেছে।

বনহুর জানে, চিত্রতারকারা এমনি হয়। অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করাই এদের কাজ।

অল্পক্ষণ পরেই খাবার এলো।

শ্যামা বললো–এতো?

নিন না, এতো আর কি, এই তো সামান্য!

খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। শ্যামা যেন মাসুম ইরানীকে অল্পক্ষণে আপন করে নিলো।

খাওয়া শেষ হলো, শ্যামা বললো–কই খান বাহাদুর সাহেব এখনও তো এলেন না?

হয়তো কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। বললো বনহুর।

শ্যামা ইচ্ছা করেই যে বিলম্ব করছে তা বেশ বুঝতে পারলো বনহুর। এ কথা-সে কথার মাধ্যমে সময় বেড়ে চললো।

শ্যামা আর বনহুর যখন নির্জন কক্ষে আলাপ হচ্ছিলো, তখন কেশব আর ফুলমিয়া রাগে ফেটে পড়ছিলো, অবশ্য রাতটা তাদের ঐ অজানা-অচেনা তরুণীটির উপর। জাহাজে বাবু এক তরুণীর পাল্লায় পড়েছিলেন মিস নীহারের কবলে। কোনো রকমে খেসে এসেছেন বাবু। আবার এক ফ্যাসাদ এসে জুটলো। তবে কেশবের প্রবল বিশ্বাস আছে, তাদের বাবুকে কেউ ফাঁদে ফেলতে পারবে না।

বললো ফুলমিয়া–তুমি জানো না কেশব দাদা, মেয়েরা সব পারে।

কেশব বললো–বাবু তেমন লোক নয়।

ফুলমিয়া বললো–মেয়েদের পাল্লায় পড়লে সাধু-সন্ন্যাসীও নাকি চোর বনে যায়।

রেখে দে ফুলমিয়া ও সব কথা বাবু আমাদের মোম নয় যে গলে যাবে!

আচ্ছা দেখা যাবে। বললো ফুলমিয়া।

ভিতরে গল্প যত গভীরভাবে জমে উঠতে লাগলো ততই কেশব আর ফুলমিয়ার উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগলো। মেয়েটা এলো–তা যায় না কেন? কি এতো কথা আছে যা ফুরাতে চায় না?

শ্যামার কণ্ঠ শোনা যায়–আপনি যদি আমাকে একটু পৌঁছে দিতেন, বড় উপকার হতো।

বনহুর হাতঘড়ির দিকে তাকায়ন’টা পঁচিশ। শীতের রাত, অল্পক্ষণ পর শহরটা ঝিমিয়ে পড়বে। শ্যামা ফাঁদ পাততে চেষ্টা করছে, মনে মনে হাসলো বনহুর, উঠে দাঁড়িয়ে বললো চলুন।

অনেক অনেক ধন্যবাদ মিঃ মাসুম। সত্যি আপনি না গেলে আমি ভয় পেতাম, কারণ পর পর দু’টো চাঞ্চল্যকর ডাকাতি শহরের বুকে লোকজনের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

চলুন আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। বনহুর আলনা থেকে কোটটা গায়ে পরে নিয়ে পা বাড়ালো দরজার দিকে।

কেশবকে লক্ষ্য করে বললো ফুলমিয়া–দেখলে বন্ধু আমার কথা ঠিক কিনা? মেয়ে মানুষের পাল্লায় পড়েছেন, খসতে বিলম্ব হবে।

বনহুর আর শ্যামা সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

কেশব ফুলমিয়ার কথায় কোনো জবাব দিতে পারলো না। কারণ বাবুকে তো এমন কোনোদিন দেখেনি।

বনহুর আর শ্যামা গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো।

শ্যামা বললো ড্রাইভার আসেনি কিনা তাই, নাহলে আপনাকে কষ্ট দিতাম না। আমার গাড়িতেই চলুন, ড্রাইভার আপনাকে পৌঁছে দেবে।

বনহুর কোনো কথা না বলে ড্রাইভ আসনে উঠে বসলো। শ্যামা তার পাশের আসনে বসেছে।

গাড়ি ছুটতে শুরু করলো।

শ্যামা কিছুক্ষণ নীরব রইলো বটে কিন্তু এক সময় হঠাৎ বলে উঠলো–মিঃ মাসুম, অভিনেত্রী বলে আপনি আমাকে ঘৃণা করছেন না তো?

মিস শ্যামা, আমার কাছে সব মানুষের একই রূপ–সে মানুষ। আমি কাউকে ঘৃণা করি না, ঘৃণা করা আমার স্বভাব নয়।

সত্যি মিঃ মাসুম, আপনার সঙ্গে একদিনের পরিচয়ে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছি। আপনার কথা কোনো সময় আমি ভুলবো না।

একটা নগণ্য মানুষ ছাড়া আমি তো এমন কিছু নই মিস শ্যামারাণী।

এই তো একটু পূর্বে বললেন মানুষ সে মানুষই, তার আবার গণ্য আর নগণ্য কি আছে! তাছাড়া আপনি যদি নগণ্য হন তাহলে এ পৃথিবীতে সবাই নগণ্য। মিঃ মাসুম, আপনাকে আমার অত্যন্ত ভাল লেগেছে।

নিজকে গৌরবান্বিত মনে করছি মিস শ্যামা।

আসবেন কিন্তু মাঝে মাঝে, বেড়াবো আমরা।

বনহুর গাড়ির সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বলে–আসবো।

সত্যি বলছেন তো?

হাঁ, কিন্তু আপনার বাড়িতে নয়।

চমকে উঠলো যেন শ্যামা–কেন?

আমার ভাইজান পছন্দ করেন না আমি কারো বাড়ি যাই।

হেসে বলে শ্যামা–ভয়, পাছে ভাইটিকে হারান, এই তো?

ঠিক তা নয়।

তবে?

তার স্বভাব, তিনি পছন্দ করেন না।

শ্যামার মুখখানা কালো হয়ে গেল যেন।

অন্ধকার হলেও বুঝতে পারলো বনহুর, শ্যামার মুখটা গম্ভীর হয়ে পড়েছে।

হেসে বললো বনহুরবাড়িতে না এলেও ঠিক আসবো। আমার কামরার ফোন নং ৫৫০০১, যখন ডাকবেন গাড়ি নিয়ে হাজির হবো।

ঠিক বলছেন তো? আনন্দে উপছে পড়ে যেন শ্যামা।

হা।

শ্যামা বলে উঠে এবার–এই তো সামনেই আমার বাসা।

ওঃ আমি ভুল করে যাচ্ছিলাম। বনহুর ব্রেক কষে গাড়ির মুখটা ফিরিয়ে নেয় দ্রুতহস্তে।

শ্যামার বাড়ির গেটে গাড়ি রাখতেই ড্রাইভার এগিয়ে আসে।

শ্যামা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলে–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মিঃ মাসুম। ড্রাইভার, যাও উনাকে রেখে এসো।

বনহুর শ্যামার পরিত্যক্ত আসনে বসে, ড্রাইভার উঠে বসে তার স্থানে।

পরদিন।

বনহুর বাইরে বের হবার জন্য তৈরি হচ্ছে, আসলাম আলীর কাছে যাবে বলে। এখন সে খান বাহাদুর শামস ইরানী বেশে সজ্জিত হয়েছে। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো, রিসিভার হাতে তুলে নিতেই ভেসে এলো মেয়েলি কণ্ঠ–হ্যালো, মিস শ্যামা বলছি। আপনি কি মাসুম সাহেব বলছেন?

হা, আমি মাসুম বলছি। সেই মুহূর্তে যদিও বনহুরের শরীরে খান বাহাদুর শামস ইরানীর ড্রেস ছিলো, একটুকরা হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁটের কোণে, বলে–হ্যালো মিস শ্যামারাণী, আসুন না, বড় একা লাগছে।

সত্যি বলছেন? খান বাহাদুর সাহেব নেই।

না, বাইরে গেছেন, হয়তো আপনার ওখানে কিংবা পরিচালকের কাছে। আসুন না দয়া করে, প্লিজ…

আচ্ছা আসছি। সত্যি আপনার ডাকে না গিয়ে পারবো না।

অপেক্ষা করবো?

নিশ্চয়ই।

তাহলে রেখে দি?

আচ্ছা ধন্যবাদ।

বনহুর রিসিভার রেখে দিলো, তারপর কেশবকে ডেকে বললো–কেশব, আমি বাইরে যাচ্ছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবো, একটি যুবতী আসবে, মানে ঐ সেদিন যিনি এসেছিলেন, তাকে বসাবে বুঝলে?

আচ্ছা বাবু, বসাবো। বনহুর চলে যায়।

শ্যামা তখন হোটেল ফুলাগুতে আসার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছিলো।

শ্যামা যখন সজ্জিত হচ্ছিলো তখন শশী এসে দাঁড়ায় তার পাশে কোথায় যাচ্ছো শ্যামাদি?

নূরীকে শ্যামা ছোট বোনের মত মনে করতো, সেজন্য নূরী ওকে শ্যামাদি বলে ডাকতো। শ্যামা আয়নায় নিজের যৌবন ঢলঢল দেহটার দিকে নিপুণভাবে লক্ষ্য করে বললো–অজানা বন্ধুর ওখানে।

নূরী বিমর্ষ মনে বললো–শীঘ্র এসো কিন্তু।

শ্যামারাণী যখন বেরুতে যাচ্ছিলো ঠিক ঐ মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করে খান বাহাদুর শামস ইরানী–হ্যালো মিস শ্যামা, কোথাও যাচ্ছেন বুঝি?

খান বাহাদুর শামস ইরানী সাহেবকে দেখে একটু ভড়কে গেলো যেন শ্যামা, ঢোক গিলে বললো–আপনি এসে গেছেন? আমি একটু বাইরে যাচ্ছি বিশেষ একটা জরুরি কাজ আছে কিনা। আপনি অবশ্য বসুন, শশীর সঙ্গে কথাবার্তা বলুন। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।

মনে মনে হাসলো শামস ইরানী-বেশি বনহুর, জানে সে শ্যামা কোথায় চলেছে। মাসুম ইরানীর আকর্ষণে সে ছুটে চলেছে এখন ফুলাগু হোটেলে।

শ্যামা ততক্ষণে শশীকে নিয়ে এলো সঙ্গে করে–এর সঙ্গে গল্প করুন খান বাহাদুর সাহেব।

আচ্ছা ধন্যবাদ।

খান বাহাদুর শামস ইরানী ফিরে তাকায় তার সম্মুখে দন্ডায়মান শশীর দিকে। চোখের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বলে–বসুন মিস শশীরাণী।

শশী সে কথায় কান না দিয়ে বলে–আমার সঙ্গে আপনার কি দরকার বলুন? আমি বেশিক্ষণ বিলম্ব করতে পারবো না।

কি বললেন, বেশিক্ষণ বিলম্ব করতে পারবেন না?

না। গম্ভীর কণ্ঠ শশীর।

বললো খান বাহাদুর শামস ইরানী–কিন্তু আপনি যে এখন আমার। মানে আমার ছবিতে কাজ করার জন্য আপনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। আপনার উপর আমার দাবি আছে। শামস ইরানী খপ করে হাত ধরে ফেলে শশীর।

না, আমি আপনার কোনো দাবি মানতে রাজি নই। ছেড়ে দিন, আমার হাত ছেড়ে দিন বলছি।

এবার বললো শামস ইরানী-আপনি আমাকে বিমুখ করবেন না মিস শশীরাণী। আপনি যা চান তাই দেবো, গাড়ি-বাড়ি-ঐশ্বর্য–যা চান।

ছেড়ে দিন, আমি কিছু চাই না, কিছু চাই না আমি। ছেড়ে দিন বলছি।

শামস ইরানী ছেড়ে দিলো শশীর হাত কিন্তু সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শশীর আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো, বললো–মিস শশী, এ পৃথিবীতে মানুষ কি চায়? কিসের জন্য মানুষ আজ উন্মাদ+অর্থ আর ঐশ্বর্য–আপনি কি এসবের জন্যই অভিনেত্রী বনে যাননি?

না না, আমাকে এরা জোর করে ধরে এনেছে, আমি এসবের কিছু চাইনি, এখনও চাই না।

বনহুর নূরীকে এতো কাছে পেয়েও নিজকে কঠিনভাবে সংযত রেখে ওকে পরীক্ষা করে চললো। এতোদিন নূরী এদের হাতের পুতুল হয়ে আছে। সে কেমন আছে কে জানে। মাঝে মাঝে বনহুরের মনে সন্দেহের দোলা লেগেছে, কিন্তু বেশিক্ষণ সন্দেহ তার মনে স্থায়ী হতে পারেনি। নূরী কোনোদিন অসতী হতে পারে না। তবু বনহুর নিজ মনকে সচ্ছ করে নেবার জন্যই ওকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললো। বললো–আশ্চর্য মেয়ে আপনি! লোভ, মোহ আপনার কিছু নেই? এই সৌন্দর্য, এই ভরা যৌবন আপনি ব্যর্থ করে দেবেন?

আমার সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, সব সখ মুছে গেছে। আমি আর কিছু চাই না, যা পাবার ছিলো পেয়েছি, এখন আর কোনো লোভ, মোহ নেই আমার।

তবে কি অভিনেত্রী জীবন আপনার মিথ্যা?

হাঁ, অভিনেত্রী আমি নই। আমাকে ওরা জোর করে অভিনেত্রী করেছে। একটু থামলো নূরী, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো আবার–খান বাহাদুর সাহেব, আমি বড় অসহায়া, বড় হতভাগী, আমার জীবন কাহিনী অত্যন্ত করুণ, ব্যথা-ভরা।

অসুবিধা মনে না করলে আপনি বলুন, যদি কোনো উপকার করতে পারি। বসুন আপনি।

এতোক্ষণে নূরী যেন নিজের মধ্যে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে নিতে পারলো, খান বাহাদুরের কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হলো সে, বসলো তার পাশের আসনে। তারপর বলে চললো সেই পর্বতের উপরে বনহুরের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ, কি করে আসলাম আলীর ছবিতে এসে পড়লো, তারপর আসলাম আলীর কুৎসিত মনোবাসনা থেকে নিজকে রক্ষা করার জন্য অভিনেত্রী জীবন বেছে নিলো, আরও বললো সে অভিনয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবেই আমি আজও নিজের ইজ্জৎ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি..

বনহুরের মনে উদয় হলো আর একদিন শ্যামার কথা, বলেছিলো শ্যামা…ভদ্রলোক যদি আজ উপহার দিতে এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যান তাহলে আলী সাহেব তোকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। ভুলে যাসনে শশী, শুধু তিনি তোর অভিনয়ের জন্যই…হঠাৎ শশী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলেছিলো–থাক, আর বলতে হবে না। দিন ও মালা আমি নেবো…আজ বনহুরের কাছে সেদিনের রহস্যপূর্ণ কথাগুলো সচ্ছ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো, নূরী নিজের ইজ্জৎ রক্ষার জন্যই বেছে নিয়েছে অভিনেত্রী জীবন। নিষ্পাপ ফুলের মত নূরীর অশ্রুসজল মুখখানার দিকে তাকিয়ে কিছুতেই বনহুরের মন স্থির রইলো না, সে নূরীকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে আবেগভরা কণ্ঠে ডাকলো–নূরী!

নূরী হঠাৎ খান বাহাদুরের এই অদ্ভুত আচরণে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো; পরক্ষণেই তার অতি পরিচিত কণ্ঠে মধুর সম্ভাষণ ভরা ‘নূরী’ ডাক কানে প্রবেশ করতেই বিস্ময়ে অভিভূত হলো। অস্ফুট কণ্ঠে বললো–কে, কে আপনি?

বনহুর নিজের মুখের দাড়ি খুলে ফেললো–নূরী!

হুর তুমি–তুমি…নূরী বনহুরের বুকে মুখ রেখে আকুলভাবে কেঁদে উঠলো–হুঁর, কোথায় ছিলে তুমি এতোদিন?

নূরীকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে বললো বনহুর–নূরী, তোমাকে হারানোর পর থেকে আমি পাগলের মত কত জায়গায় না তোমার সন্ধান করে ফিরেছি। নূরী, তোমাকে যে ফিরে পাবো সে আশা আমার ছিলো না। নূরী–আমার নূরী!

এমন সময় বাইরে গাড়ির শব্দ হলো, বনহুর নূরীকে মুক্ত করে দিয়ে দ্রুতহস্তে দাড়ি-গোঁফ পরে নিলো।

নূরী আঁচলে চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, কিন্তু তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে অভূতপূর্ব এক আনন্দ দ্যুতি। তার চির সাধনার বনহুরকে পেয়েছে–এ যে কত খুশির কথা! নূরী নিষ্পলক নয়নে খান বাহাদুর শামস ইরানী-বেশি বনহুরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

শ্যামা প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে। মুখোভাব তার খুব প্রসন্ন নয়, বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছিলো তাকে।

শ্যামা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই বললো খান বাহাদুর শামস ইরানী–মিস শ্যামা, আমি কিন্তু আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। এসে গেলেন, ভালই হলো।

কেন, শশীর সঙ্গে বুঝি আলাপ জমছে না?

উঁহু বড় নীরস মেয়ে।

হাঁ, শশীটা অমনি বটে।

আপনার কাজ হলো? প্রশ্ন করলেন শামস ইরানী।

বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো শ্যামা–না।

বলে উঠলো শামস ইরানী–ওঃ হাঁ, আপনি চলে যাবার পরই আমার ছোট ভাই মাসুম ফোন করেছিলো আপনার কাছে।

মাসুম সাহেব ফোন করেছিলেন? আনন্দভরা গলায় উচ্চারণ করলো শ্যামা কথাটা। তার মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পড়লো একটা প্রসন্ন ভাব। বললো সে–কি বললেন তিনি?

বললো শামস ইরানী–মাসুম সন্ধ্যায় এখানে আসবে, আপনি যেন তার জন্য অপেক্ষা করেন।

সত্যি?

হাঁ সত্যি। দেখুন, মাসুম এখানে এসে অবধি কারো সঙ্গে মিশবার সুযোগ পায়নি। সে বলেছিলো, আপনাকে নাকি তার খুব ভাল লেগেছে।

শ্যামার মুখে রক্তাভ আভা ফুটে উঠলো। লজ্জিতভাবে বললো সে–আপনি নাকি তাকে কোথাও আসতে দেন না, মানে কারো বাড়িতে যাওয়া পছন্দ করেন না?

সে কথা অবশ্য সত্যি। তবে আপনার বাড়ি এলে আমার তেমন কোনো আপত্তি নেই।

খান বাহাদুর সাহেব, আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব!

এতে আর ধন্যবাদের কি আছে মিস শ্যামারাণী!

আপনি যে আমাকে নিজের মনে করেন এজন্য আমি আনন্দিত। মাসুম সাহেবের বড় ভাই হিসেবে আপনি আমারও সম্মানিত জন।

আচ্ছা চলি আজকের মত মিস শ্যামা? অনেকক্ষণ শশী রাণীকে আটকে রেখেছিলাম, এজন্য আমি…

না না, শশী এতে কিছু মনে করেনি বরং সে খুশিই হয়েছে। কারণ একা একা তার বড় খারাপ। লাগতো।

খান বাহাদুর শামস ইরানী উঠে পড়লো।

সন্ধ্যার পূর্বে বনহুর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, এখন তার দেহে স্বাভাবিক ড্রেস। দামী স্যুট পরে নিয়েছে সে, শ্যামার ওখানেই চলেছে বনহুর।

এদিকে শ্যামাও আজ সেজেছে নিখুঁতভাবে; মাসুম ইরানীকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য উন্মুখ হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করছে সে।

নূরী তখন শামস ইরানী-বেশি বনহুরকে তার ছোট ভাই সম্বন্ধে শ্যামার সঙ্গে আলাপ করতে দেখে অবাক হয়েছিলো, কারণ সে জানে, বনহুরের কোনো ভাই নেই। তবু মনে কেমন যেন একটা সন্দেহ জেগেছিলো তার। নূরীও বিপুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, সন্ধ্যায় নতুন। আগন্তুকটিকে দেখার জন্য।

শ্যামা বার বার হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে, কই এতক্ষণও মাসুম ইরানী তো এলো না? শ্যামার মধ্যে চঞ্চলতা যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

নূরী বিস্মিত হচ্ছিলো, না জানি কে সে মাসুম ইরানী? শ্যামার সঙ্গে কি তার সম্বন্ধ? বনহুরের ভাই-ই বা এলো কোথা হতে? নূরী শ্যামার মতই উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছিলো।

এমন সময় একখানা গাড়ি এসে থামলো শ্যামার বাড়ির দরজায়।

শ্যামা ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছিলো, মাসুম ইরানী-বেশি বনহুর গাড়ি থেকে অবতরণ করতেই। শ্যামা হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালো।

আড়াল থেকে নূরী লক্ষ্য করছিলো, গাড়ি থেকে তার হুরকে নামতে দেখে যেমন আনন্দে হৃদয়। তার নেচে উঠলো তেমনি বিস্মিত হলো। তবে কি বনহুর মিথ্যা বলেছিলো শ্যামার কাছে? নূরী বুঝতে পারলো, এটা বনহুরের একটা চালাকি।

একটু পরে শ্যামা বনহুরসহ প্রবেশ করলো নূরীর কক্ষে। নূরী তখন আড়াল থেকে নিজের বিছানায় গিয়ে বসেছিলো। পদশব্দে মুখ তুলতেই শামার পিছনে বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো, বনহুর চোখ টিপে তাকে ইংগিত করলো।

শ্যামা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো–শশী, ইনি খান বাহাদুর শামস ইরানীর ছোট ভাই মাসুম ইরানী।

নূরী যেন এই প্রথম দেখছে মাসুম ইরানীকে, এমনিভাবে শ্যামা ও পরে বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো, কোনো কথা বললো না। বনহুর নূরীর দিকে তাকিয়ে বললো–ইনিই বুঝি শশী?

হাঁ, বড় লাজুক মেয়ে।

বনহুর বললো–দেখতেই পাচ্ছি।

যেমন লাজুক তেমন মিষ্টি মেয়ে শশী, কিন্তু ঝালও কম নয়। একটু রাগলে নাগকন্যার মত হয়ে যায়।

সর্বনাশ, তাহলে তো ভয়ানক কথা। সাবধানে চলতে হবে, কি বলেন?

তাতো নিশ্চয়ই।

বসুন মিঃ মাসুম। শ্যামা আসন গ্রহণ করে বলে আবার–শশী বসো। তিনজন মিলে গল্প করা যাক।

বনহুর বসে পড়ে, বলে সে–হাঁ, আজকের সন্ধ্যাটা বেশ কাটবে বলে মনে হচ্ছে।

শ্যামা বয়কে চা-নাস্তার জন্য বলে দেয়।

বয় চলে যায়।

শ্যামা বনহুরের পাশের আসনটায় উঠে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে।

নূরী নতচোখে একবার দেখে নেয়।

শ্যামা বনহুরকে লক্ষ্য করে বলে–মিঃ মাসুম, আপনি চুপচাপ বসে বসে কি করে দিন। কাটান?

কেন? বললো বনহুর।

মানে বড় ভাই-এর উপর নির্ভর করেই কি চিরদিন কাটবে আপনার?

আমি ঠিক আপনার কথা বুঝতে পারছি না? বললো বনহুর।

শ্যামা একটু কৌশলে ফাঁদ পাতার চেষ্টা করলো। বললো–খান বাহাদুর সাহেব বললেন, আপনি নাকি এখন সম্পূর্ণ বসে বসেই কাটাচ্ছেন?

হাঁ, আপাততঃ কোনো কিছু করছি না। তা ভাইজান বুঝি কিছু বলেছেন আপনার কাছে?

ঠিক স্পষ্ট করে বলেননি, তবে তার কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম, আপনি এখন সম্পূর্ণ বড় ভাই-এর উপর নির্ভর করছেন।

হা, চাকরী-বাকরী যখন করছি না তখন একরকম তাই। কিন্তু হঠাৎ এ কথাটা বলার পিছনে কি আপনি কিছু বলতে চান?

চাই বইকি!

বলুন?

অলক্ষ্যে একবার নূরীর দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো বনহুর।

বললো শ্যামা–আসলাম আলী সাহেব বলেছিলেন যে, মাসুম ইরানী যখন বসেই আছেন, আর তার ভাইজান যখন ছবি করবেন মনস্থ করেছেন তখন, মানে আপনি আপনার ভাই-এর ছবিতে হিরোর রোলটা না হয় করলেন। অবশ্য এতে যদি আপনার মত থাকে…

একটু হাসলো বনহুর, বড় সুন্দর দেখালো ওকে।

শ্যামা অভিভূতের মত বলেই চললো–আপনার মত হিরো পেলে আলী সাহেবের ছবি অদ্ভুত রকম হিট করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

থামলো শ্যামা।

বনহুর আর নূরীর মধ্যে আর একবার দৃষ্টি বিনিময় হলো।

বনহুর বললো–কিন্তু অভিনয় করতে পারবো কিনা, এতেও তো সন্দেহ আছে?

শ্যামা হেসে উঠলো খিল খিল করে আলী সাহেবের কাছে শশীর মত মেয়ে যদি বাগে আসতে পারে আপনি তো পুরুষ মানুষ। সত্যি আপনি রাজি আছেন আলী সাহেবের প্রস্তাবে?

খুব খুব রাজি, ভাই-এর ছবিতে হিরোর রোল করবো এতে আবার আপত্তি!

শ্যামা বনহুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো–আপনাকে ধন্যবাদ।

বনহুরও অগত্যা হাত বাড়িয়ে দিলো শ্যামার দিকে, শ্যামা ওর করমর্দন করলো। শ্যামার মনে একটা আনন্দ দোলা দিয়ে গেলো। বললো শ্যামা–চলুন না আজ স্বয়ংবরা’ দেখে আসি?

বনহুর তাকালো আবার নূরীর দিকে–মিস শশী যদি যান তাহলে তিনজন মিলে না হয় যাওয়া যেতো।

শ্যামা বললো–শশী বড্ড বেরসিক, ও ছবি দেখতে যাবে না! চলুন আমরা দু’জনাই যাই।

কিন্তু উনাকে রেখে…বললো বনহুর।

নূরী বলে উঠলো–আমি যাব না শ্যামাদি, তুমি যাও।

দেখলেন তো? চলুন মিঃ মাসুম…বনহুরের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নিলো শ্যামা।

বনহুরের কাছে এতোটা বড় খারাপ লাগছিলো–বিশেষ করে নূরীর সামনে, কিন্তু না গিয়ে পারলো না, নূরীকে উদ্ধার করতে হলে শ্যামাকে সন্তুষ্ট রেখে কার্যোদ্ধার করতে হবে।

নূরীকে ছেড়ে যেতে যদিও বনহুরের বাধছিলো তবুও যেতে হলো, শ্যামার পাশে ড্রাইভ আসনে উঠে বসে গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো। হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো বেলকুনিতে, দেখলো নূরীর দু’টি দীপ্ত আঁখি লক্ষ্য করছে তাকে।

দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো গাড়িখানা, নূরীও ফিরে গেলো কক্ষমধ্যে। শ্যামার সঙ্গে বনহুর যন্ত্রণা তার বুকের মধ্যে আলোড়ন তুলছে।

এখানে নূরী যখন বনহুরের সাক্ষাৎলাভ করেও তাকে নিবিড় করে পাচ্ছে না, তখন দিল্লীর বুকে মনিরা স্বামীর জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। সেই যে সাপুড়ে সর্দারের সঙ্গে চলে গেলো আর সে ফিরে এলো না।

কান্দাই থেকে মরিয়ম বেগম বার বার চিঠি লিখছেন, মনিরা যেন এখন দেশে ফিরে আসে, বিশেষ করে তার শরীর দিন দিন ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া নূরও অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে পড়েছে মায়ের জন্য। মনিরা তার মামীমার চিঠি পেয়ে অস্থির হয়ে পড়লো, নূরের কথা সব সময় মনে হতে লাগলো তার।

এদিকে হাশেম চৌধুরী দিল্লী থেকে বদলীর সময় হয়ে এসেছে। মনিরাকে নিয়ে মাসুমা চিন্তায় পড়লো, কারণ, মনিরা এমনভাবে বেঁকে বসলো তাকে কান্দাই রেখে না এলেই নয়। মাসুমা বান্ধবীকে অনেক করে বুঝাতে লাগলো, নিশ্চয়ই তোর স্বামী ফিরে আসবে, ওর জন্য কিছু ভাবিসনে বোন।

মাসুমার সান্ত্বনায় মনিরার অশ্রু কিছুতেই বাধ মানছিলো না–হ্যায়, কতদিন আর তার প্রতীক্ষায় বুক বেঁধে এই সুদূর দিল্লী নগরীতে পড়ে থাকবে। কোথায় গেছে সে, কেমন আছে, তাই বা কে জানে। মনিরা স্বামীর জন্য নতুন করে ভাবতে পারে না আর, কারণ আজ প্রথম নয় তাকে ছেড়ে কতদিন সে উধাও হয়েছে এমনিভাবে। কত যে চোখের পানি ফেলেছে মনিরা স্বামীর জন্য, কত যে ব্যথা অন্তরে চেপে তুষের আগুনে দগ্ধীভূত হয়েছে তার অন্ত নেই। তবু কিছুতেই স্বামীকে সে ধরে রাখতে পারেনি কোনোদিন।

অশ্রু মনিরার সাথী।

স্বামীকে ভালবেসে মনিরা পেয়েছে শুধু ব্যথা আর দুঃখ তবুও মনিরা স্বামী-চিন্তা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। স্বামীই যে তার জীবনের আশা-ভরসা, স্বপ্ন-সাধ–সবকিছু।

মনিরা এবার দেশে ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, হাশেম চৌধুরী বা মাসুমার কোনো কথাই তাকে আর স্থির রাখতে পারলো না।

কান্দাই শহরে মনিরাকে রেখে আসার জন্য হাশেম চৌধুরী মনস্থির করে ফেললেন। ছুটির জন্য ব্যবস্থা করলেন তিনি।

স্বামীর চিন্তায় মনিরা যখন অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছে, তখন বনহুর নূরীকে উদ্ধার ব্যাপার নিয়ে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে চলেছে। কৌশলে হাত করেছে পরিচালক আলী সাহবেকে, শ্যামাকেও হাতের মুঠায় এনে নিতে তার বিলম্ব হয়নি। নূরীর সঙ্গেও সাক্ষালাভ ঘটেছে, এখন তাকে বোম্বে থেকে সরাতে পারলেই নিশ্চিন্ত হবে বনহুর।

আজকাল প্রায়ই আসে বনহুর শ্যামার ওখানে, পরিচালক আলী সাহেবের উপর ভর দিয়েছে ছবির কাহিনী বেছে নেওয়ার জন্য। আসলাম আলী তাই আজকাল কাহিনী খুঁজে বেড়াচ্ছেন, মনের মত কাহিনী না পেলে ছবি করতে রাজি নন তিনি।

কাহিনী ব্যাপার নিয়ে আসলাম আলী যখন ব্যস্ত তখন বনহুর মাসুম ইরানী-বেশে ঘনিষ্ঠভাবে শ্যামা আর নূরীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে বসেছে। আজকাল তাদের দুজনাকেই সঙ্গে করে এখানে সেখানে যাওয়া-আসা শুরু করেছে সে। তবে শ্যামার দিকেই প্রকাশ্য ভাবটা যেন বেশি দেখায় সেদিকে ছিলো বনহুরের বিশেষ লক্ষ্য। অবশ্য নূরী এর কারণ বুঝতো, সে এতে কোনো রকম অসন্তুষ্ট হতো না।

একদিন সুযোগ এলো, কেশব জানালো দিল্লীগামী প্লেনের টিকেট সে ক্রয় করে ফেলেছে। বনহুর, নূরী কেশব আর ফুলমিয়ার। চারখানা টিকেট বুক করে কেশবের আনন্দ আর ধরে না, এবার ফুলকে নিয়ে সরে পড়বে তারা।

সেদিন বললো বনহুর–কেশব, আজ রাতের প্লেনে আমরা রওয়ানা হবো, মনে আছে?

আছে মানে, খুব মনে আছে।

ফুলমিয়া ওপাশে দাঁড়িয়েছিলো, সরে এলো বনহুরের সামনে–স্যার, সব গোছানো হয়ে গেছে।

সব মানে?

মানে আমার জিনিস সব বেঁধে ঠিক করে নিয়েছি।

ওসব তো নেওয়া চলবে না ফুলমিয়া। জিনিসপত্রের মায়া ত্যাগ করে যেতে হবে আমাদের।

অবাক কণ্ঠে বললো ফুলমিয়া–এতো টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র ছেড়ে যাবেন স্যার?

না গিয়ে তো কোনো উপায় নেই। হা শোন, গাড়িখানাও ছেড়ে যেতে হবে, কারণ আমরা যে বোম্বে শহর ত্যাগ করে চলে যাচ্ছি বা চলে যাবার মতলব আঁটছি, এটা যেন কেউ বুঝতে না পারে। এমনকি ফুলাগু হোটেলের মালিকও যেন টের না পায়।

কেশব বলে উঠলো-”বাবু, অতো টাকার গাড়িখানা…

হাসলো বনহুর–শুধু গাড়ির মায়াই ত্যাগ করতে হবে না কেশব, সব কিছু ত্যাগ করে আমরা নূরীকে উদ্ধার করবো।

বাবু সেই ভাল।

শোন কেশব, রাত এগারোটায় তোমরা দু’জন ভাল পোশাক-পরিচ্ছদ পরে এরোড্রামে অপেক্ষা করবে। আমি নূরীকে ঠিক সময় অনুযায়ী নিয়ে হাজির হবো, বুঝলে? হোটেলের মালিককে বলে যাবে আমাদের এক জায়গায় দাওয়াত আছে, ফিরতে রাত হবে। চাবিটা ফুলাগুর মালিককে দিয়ে যাবে।

আচ্ছা!

ঠিকভাবে কাজ করবে, কোনোরকম কেউ যেন টের না পায় যে আমরা আজ বোম্বে ত্যাগ করছি।

আপনার কথামতই কাজ করবে বাবু।

আজ খান বাহাদুর শামস ইরানীর ছবির মহরৎ অনুষ্ঠান বোম্বে স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত হবে। পরিচালক আসলাম ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছেন। ছবির একখানা গান আজ রেকর্ড করা হবে সুগায়িকা দেবীকা রাণীর কণ্ঠে। ছবির নাম রাখা হয়েছে আলেয়ার আলো।’ এ নামটা ইরানী নিজেই পছন্দ করে দিয়েছে।

রাত্রি আট ঘটিকায় মহরৎ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। ছবিতে যে সব আর্টিষ্ট অভিনয় করবেন প্রায় সবাই এসেছেন অনুষ্ঠানে। ছবির উদ্বোধন করবে স্বয়ং খান বাহাদুর শামস ইরানী।

ছবির নায়িকার চরিত্রে থাকবে শশী। শ্যামাও থাকবে এ ছবিতে; কাজেই এরা উভয়েই এসেছে। মহরৎ অনুষ্ঠান শেষ হলো, দেবীকা রাণীর কণ্ঠে গানও রেকর্ড করা হলো একখানা।

শ্যামা অনেক করে বলা সত্ত্বেও আসেনি মাসুম ইরানী। শ্যামা তাই বার বার অনুযোগ করছিলো শামস ইরানীর কাছে–কেন এলেন না মাসুম সাহেব? আপনার ছবি–তিনি না আসার কারণ কি? এলেই তিনি ভাল করতেন, সবার সঙ্গে পরিচিত হতেন এবং তাকে আপনার ছবির হিরো করার চেষ্টা নিতে পারতেন।

খান বাহাদুর শামস ইরানী-বেশি বনহুর মাসুম ইরানীর জন্য শ্যামাকে ব্যস্ত হতে দেখে মনে মনে হাসলো।

উৎসব শেষ হবার অল্পক্ষণ বাকি আছে, এমন সময় হঠাৎ শশী অজ্ঞান হয়ে পড়লো। একি অঘটন, সমস্ত লোকজন উৎকণ্ঠা হয়ে পড়লেন। . উৎসবের কাজ এখনও বাকি আছে। মহরতের মিষ্টি বিতরণ এখনও হয়নি। পরিচালক এমন একটা দুর্ঘটনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। শশীকে নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত তখন খান বাহাদুর শামস ইরানী ডাক্তার আনতে ছুটলো। তার নিজের ছবির নায়িকা, কাজেই তার ব্যস্ত হবার কথাই।

একটু পরেই ডাক্তার নিয়ে ফিরে এলো শামস ইরানী।

ডাক্তার শশীকে পরীক্ষা করে বলেন, অত্যন্ত চিন্তায় হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, এখন সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন।

কিন্তু এখনও যে ফাংশন শেষ হয়নি।

খান বাহাদুর শামস ইরানী স্বয়ং শশীকে তাদের বাসায় পৌঁছে দেবে রাজি হলো। সঙ্গে যাবে শ্যামা।

শশীর সংজ্ঞাহীন দেহটা কয়েকজন মিলে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। শ্যামা শশীর পাশে বসলো।

শামস ইরানী স্বয়ং বসলো ড্রাইভিং আসনে।

গাড়ি বোম্বে স্টুডিও ত্যাগ করলো।

রাত এখন দশটা দশ মিনিট বেজেছে। হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে স্পীডে গাড়ি ছাড়লো শাসম ইরানী।

এ পথ-সে পথ করে গাড়ি চলেছে।

শশীর মাথাটা শ্যামার কোলো ছিলো, এবার নড়ে উঠলো সে। বললো শশী–পানি, একটু পানি দাও।

শ্যামা বলে উঠে–শশী একটু অপেক্ষা করো, এই তো এসে গেলাম বলে।

শ্যামা যখন ঝুঁকে কথাটা জিজ্ঞাসা করছিলো, ঐসময় গাড়িটাও এক ঝাঁকি দিয়ে থেমে পড়ে।

চমকে উঠে শ্যামা–কি হলো খান বাহাদুর সাহেব?

ঐ মুহূর্তে শামস ইরানী পকেট থেকে একখানা রুমাল বের করে অকস্মাৎ চেপে ধরলো শ্যামার নাকের উপর।

কিছু স্মরণ করার পূর্বেই শ্যামা ঢলে পড়ে গাড়ির পিছন আসনে।

শামস ইরানী বেশি বনহুর এবার হেসে উঠে হাঃ হাঃ করে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে– নূরী, তুমি ঠিক আমার কথামতই কাজ করেছ।

সত্যি আমি বড় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, ডাক্তার আমার অজ্ঞান সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেননি।

বললো বনহুর–ডাক্তার অন্য কেউ নয়, কেশব।

কেশব দা?

হাঁ, তাকেই আমি পূর্ব হতে ডাক্তার সাজিয়ে তৈরি রেখেছিলাম।

কোথায় তবে কেশব দা?

সে এখন বোম্বে এরোড্রামে চলে গেছে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে কেশব আর ফুলমিয়া।

ফুলমিয়া! ফুলমিয়া কে?

সেও কেশবের মত একজন। বনহুর আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে গাড়ি নিয়ে শ্যামার বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা দিলো।

শ্যামার বাড়ির দরজায় গাড়ি পৌঁছতেই শ্যামার চাকর ছুটে এলো।

শামস ইরানীকে দেখে সালাম জানালো সে।

শামস ইরানী ব্যস্তকণ্ঠে বললো–শীঘ্র আমাকে সাহায্য করা, মিস শ্যামারাণী হঠাৎ ষ্টুডিওতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো।

চাকরতো অবাক হয়ে গেলো।

শামস ইরানী-বেশি বনহুর সংজ্ঞাহীন দেহটা হাতের উপর তুলে নিলো, তারপর তাকে অন্দর বাড়িতে নিয়ে সচ্ছন্দে শয্যায় শুইয়ে দিলো। চাকরকে লক্ষ্য করে বললো–ওর দিকে খেয়াল রেখো।

স্যার আপনি?

আমি শশীকে স্টুডিওতে পৌঁছে দিয়ে ডাক্তার নিয়ে ফিরে আসবো এক্ষুণি…আসুন মিস শশী রাণী।

বনহুর নূরীর হাত ধরে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

গাড়ির দরজা খুলে ধরে বলে বনহুর নূরী উঠে পড়ো।

নূরী ড্রাইভ আসনের পাশের সিটে উঠে বসে বলে–কোথায় যাবে হুর?

এরোড্রামে। ড্রাইভ আসনে উঠে বসতে বসতে বললো বনহুর।

হুর, ভাবতে পারিনি তোমায় ফিরে পাবো। মনে হচ্ছে, আমি স্বপ্ন দেখছি!

বনহুর ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায় সব কথা–এমন কি প্লেনের সময় আর বেশি নেই, একথাও বিস্মৃত হয় সে। নূরীকে গভীরভাবে কাছে টেনে নেয়, চুম্বনের পর চুম্বন দিয়ে আবেগভরা গলায় ডাকে–নূরী! সত্যি কি তোমায় পেয়েছি নূরী?

হুর, খেয়াল করো, খেয়াল করো হুর। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে পালানো হয়তো সম্ভব হবে না। বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নিতে চেষ্টা করলো নূরী।

কতদিন পর আজ নূরীকে ফিরে পেয়েছে একান্ত নির্জনে, বনহুর কিছুতেই নিজকে সংযত রাখতে সক্ষম হচ্ছিলো না। নূরীর কথা যে মিথ্যা নয় বেশ অনুমান করছিলো সে, কারণ এই মুহূর্তে যদি কেউ এসে পড়ে তাহলে হয়তো পালানো আর হয়ে উঠবে না।

বনহুরের সন্বিৎ ফিরে এলো নূরীর কথায়, এবার সে নূরীকে মুক্ত করে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো, গাড়িতে স্টার্ট দিলো বনহুর।

নূরীর বুকটা আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠেছে। বনহুরের স্পর্শে তার মৃতদেহে যেন জীবন ফিরে এলো। নূরী মাথাটা রাখলো বনহুরের কাঁধে।

গাড়ি তখন উল্কা বেগে ছুটে চলেছে।

নূরী যেন স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করে ফিরছে, মনে তার অফুরন্ত আনন্দ। বনহুরকে পাওয়া তার যেন আকাশের চাঁদ পাওয়ার সমতুল্য।

এরোড্রামে পৌঁছতেই কেশব আর ফুলমিয়া এসে দাঁড়ালো, প্লেন ছাড়বার আর কয়েক মিনিট বাকি, বনহুর নূরসহ কেশব আর ফুলমিয়াকে নিয়ে প্লেনে উঠে বসলো।

ফুলমিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো নূরীর।

নূরীকে ফুলমিয়া প্রথম দেখলো, অবাক হলো সে নূরীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে। এমন মেয়ে সে জীবনে কমই দেখেছে, নিষ্পলক নয়নে দেখতে লাগলো সে তাকে।

কেশবের আনন্দ আর ধরে না, কি করে তার বোন ফুলকে অন্তরের প্রীতি জানাবে ভেবে পায় না। কেশব বললো–ফুল, ভাল আছ তো?

আছি। তুমি কেমন ছিলে কেশব দা?

দেখতেই পাচ্ছো বোন।

এমনিভাবে কথাবার্তা হয় ওদের মধ্যে।

এখনও বনহুরের দেহে শামস ইরানীর ড্রেস–মাথায় আধা পাকা চুল, দাড়িতেও পাক ধরেছে, চোখে চশমা,মাথায় টুপি। নূরীর পাশের আসনে বসলো বনহুর।

প্লেন এরোড্রামের প্লাটফরমে চক্রাকারে ঘুরপাক খেয়ে ধীরে ধীরে আকাশ-পথে উঠে পড়লো।

বোম্বে শহরের বুকে পড়ে রইলো খান বাহাদুর শামস ইরানীর মূল্যবান জিনিসপত্র আর নতুন চকচকে গাড়িখানা। নীরব প্রহরীর মতই এরোড্রামের অদূরে গাড়িখানা দাঁড়িয়ে রইলো যেন উদাস জননী-পুত্রকে বিদায় দিয়ে ভুলে গেছে ফিরে যাওয়ার কথা।

দিল্লী পৌঁছে বনহুর নূরী, কেশব ও ফুলমিয়াসহ একটি হোটেলে উঠে। বনহুর এখানে পৌঁছেই খান বাহাদুর শামস ইরানীর ড্রেস পরিত্যাগ করলো। যদিও বিশ্রামের অবসর তার ছিলো না তবু কতদিন পর নূরীকে সে নিবিড় করে পেয়েছে, একটি দিনের বিশ্রাম আসায় তার মন উন্মুখ হয়ে উঠলো।

হোটেলের জনহীন কামরায় নূরীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো। ওর কোমল দেহটাকে বলিষ্ঠ বাহুতে নিষ্পেষিত করে ফেলতে চাইলো বনহুর।

নূরী নিজেকে মুক্ত করে নেবার বৃথা চেষ্টা করে বললো–হুঁর, ছেড়ে দাও কেউ এসে পড়বে।

বনহুর নূরীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো-দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। কেউ আসতে পারবেনা!

বড় দুষ্ট তুমি!

তার চেয়েও বেশি।

না, তুমি আমায় ছেড়ে দাও হুর।

আমার হাত থেকে তুমি মুক্তি পাবে না আজ।

হুর, তুমি আমায় ক্ষমা করো। যা হবার হয়েছিলো, কিন্তু আর নয়। তোমার-আমার মধ্যে এখনও মস্তবড় প্রাচীর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হুর তোমার-আমার এখনও বিয়ে হয়নি একথা ভুলে যেওনা।

বনহুর ক্ষণিকের জন্য স্থির নয়নে তাকায় নূরীর দিকে।

নূরী বলে–আমার কথা ভেবে দেখো হুর?

বনহুরের বাহুবন্ধন সামান্য শিথিল হয় বটে কিন্তু একেবারে ওকে মুক্ত করে দেয় না সে, বলে–নূরী লৌকিকতাপূর্ণ বিবাহ উৎসব আমাদের হয়নি, কিন্তু মনপ্রাণ দিয়ে তুমি কি আমাকে একদিন স্বামী বলে গ্রহণ করোনি?

করেছিলাম কিন্তু—

বনহুর নূরীর মুখে দক্ষিণ হস্তখানা চাপা দেয়–আর কিন্তু নয় নূরী। তুমি আমাকে বিমুখ করো না লক্ষ্মীটি।

নূরী পারলো না নিজকে কঠিন করতে, বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে বললো–আমি যে তোমারই হুর।

হা নূরী, তুমি আমার। শুধু আমারই–

কতক্ষণ যে নূরী বনহুরের বাহুতে আবদ্ধ ছিলো খেয়াল নেই নূরীর। হুঁশ হলো এবার, বললো–কেশব দা আর ফুলমিয়া কি ভাববে বলো তো?

দস্যু বনহুর কোনেদিন কারো ভাবাভাবি নিয়ে চিন্তা করে না–একথা তুমি আজ শুনছো? শোন নূরী, এবার তোমাকে কাজের কথা বলি।

বলো?

এবার তোমাকে সেই ড্রেস গ্রহণ করতে হবে, যে ড্রেসে তুমি একদিন সাপুড়ে সর্দারের কন্যা সেজে ছিলে।

তুমি যা চাও আমি তাই করবো হুর।

করবে? করবে নূরী। ব্যাকুল কণ্ঠ বনহুরের।

নূরী অস্ফুট কণ্ঠে বললো–হাঁ করবো।

নূরী, মনিরা আর তোমাকে নিয়ে কান্দাই ফিরে যেতে চাই।

বেশতো, এ আনন্দের কথা!

কিন্তু মনিরা আর তোমার মধ্যে আজও আসল পরিচয় ঘটেনি–

নূরী কোনো জবাব দেয় না।

বলে চলে বনহুর নূরী, যদিও কান্দাই-এ আমার আস্তানায় একবার মনিরার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ ঘটেছিলো সে ক্ষণিকের জন্য–মনিরা তোমাকে মোটেই চিনতে পারবে না। কাজেই তুমি তার কাছে নিজকে সাপুড়ে সর্দারের কন্যা বলে পরিচয় দেবে–

বেশ, তাই হবে।

এতে তুমি দুঃখ পাবে না তো?

দুঃখ আমার নেই। হুর, তুমি যাতে সুখী হও এটাই আমার কামনা।

নূরী, জানো তোমার মনি এখন মনিরার কাছেই আছে। কান্দাই ফিরে গেলেই তাকে কাছে পাবে।

সত্যি তাকে পাবো? আমার মনিকে পাবো?

হা পাবে।

নূরী কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো–হুঁর, মনিরার কাছে আমাকে সাপুড়ের মেয়ে বলেই পরিচয় দাও। আমি যেন মনিকেই পাই।

আচ্ছা, তোমার আশাই পূর্ণ হবে নূরী। একটু থেমে বললো বনহুর–মনিরা এখন দিল্লী লালবাগের পুলিশ সুপার মিঃ হাশেম চৌধুরীর বাড়িতে তার বান্ধবীর নিকট অবস্থান করছে।

হাঁ, আমার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটেছিলো।

সে কথা আমি জানি; এটাও জানি, তোমার নাচ দেখে মনিরা আত্মহারা হয়ে নিজ গলার মালা তোমায় উপহার দিয়েছিলো।

এবং সেই মালা উপলক্ষ করেই তুমি খুঁজে পেয়েছিলে বোন মনিরাকে।

সব মনে আছে নূরী।

হুর, আমার আর এক মুহূর্ত এইসব দেশে কাটাতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমার মনির কাছে–

আমার মনও চঞ্চল হয়ে উঠেছে নূরী, কতদিন আস্তানা ত্যাগ করে এসেছি। না জানি আস্তানার সবাই কেমন আছে। আমার অনুচরগণ কে কেমন আছে তাও জানি না। জানিনা আমার তাজের। অবস্থা এখন কি হয়েছে। আমার জন্য কেঁদে কেঁদে তাজ হয়তো শুকিয়ে গেছে, কতদিন তাজকে দেখি না, বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে বনহুরের গলা।

নূরী বনহুরের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। তার চোখ দুটোও তখন অশ্রু ছলছল করছিলো।

অনেক দিন পর স্বামীকে ফিরে পেয়ে মনিরার আনন্দ আর ধরে না। হাশেম চৌধুরী এবং মনিরার বান্ধবী মাসুমাও খুশিতে আত্মহারা হলো। কতদিনের আরাধনার পর ফিরে এসেছে তাদের। প্রতীক্ষিত জন।

কিন্তু মনিরার প্রথম আনন্দোচ্ছস কাটতেই স্বামীর সঙ্গে পূর্বের সেই সাপুড়ে কন্যাটিকে দেখে গম্ভীর হয়ে পড়লো। তাকিয়ে দেখলো নূরীর দেহে সাপুড়ে কন্যার ড্রেস–ঘাগড়া, ব্লাউজ, ওড়না। মাথায় চুলগুলো বিনুনী করে কাঁধের দু’পাশে ঝোলানো। চোখে কাজল, ললাটে সোনা পোকার পাখার টিপ। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে। কিছুক্ষণ নূরীর দিকে তাকিয়ে বললো মনিরা–ওকে সঙ্গে এনেছো কেন?

বনহুর স্বাভাবিক গলায় বললো–মনিরা, সে অনেক কথা, সব তোমাকে পরে বলবো। তবে কিছুটা শুনে রাখো, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা রওয়ানা দিয়েছিলাম তা সফল হয়েছে এবং এই সফলতা অর্জন করতে গিয়ে আমাদের অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো–শেষ পর্যন্ত আমাদের পথ প্রদর্শক সাপুড়ে বাবাজীকে হারাতে হয়েছে। জংলীরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। মনিরা, তাই নিহত সাপুড়ে সর্দারের অসহায়া কন্যা ফুলকে আমি সঙ্গে আনতে বাধ্য হয়েছি।

মনিরা বলে উঠলো–ওকে কি করবে তুমি?

আমার নয়, তোমার অনেক কাজে আসবে–সঙ্গে নিয়ে চলো ওকে। তাছাড়া ও যাবেই বা কোথায়, ওর তো কেউ নেই আর।

বনহুরের কথায় মনিরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারলো না, তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে লাগলো, মুখেচোখে ফুটে উঠেছে গাম্ভীর্যের ছাপ। কোনো কথা বললো না সে।

মাসুমা হেসে বললো–মনিরা, তোর ভালই হলো, একদিন না বলেছিলি মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ, ইচ্ছে হয় ধরে রাখি আর যখন খুশি নাচ দেখি। কেমন, এখন তোর ইচ্ছে পূর্ণ হলো তো? যখন খুশি নাচও দেখতে পাবি।

হাশেম সাহেব বললেন–মন্দ কি, এমন একটি মেয়ে সব সময় পাশে থাকলে অনেক কাজ হবে। যা দিন-সময় পড়েছে, কাজের লোক পাওয়াই মুস্কিল।

হাঁ, ঠিক বলেছো।! মনিরা, তোর বাচ্চা নাকি ভারি দুষ্ট! ওকে সামলাতে এমনি একটি মেয়ের দরকার। ভালই হলো, নিয়ে যা সঙ্গে করে, মেয়েটাকে দেখে বড় মায়া লাগছে কিন্তু।

বনহুর তখন সকলের অজ্ঞাতে একবার নূরীর মুখে তাকিয়ে দেখে নিলো। না, নূরীর মুখে কোনোরকম বিষণ্ণ ভাব ফুটে ওঠেনি। অবশ্য বনহুর পূর্বেই নূরীকে এমনি একটা অবস্থার জন্য প্রস্তুত করেই নিয়ে এসেছিলো। বলেছিলো বনহুর নূরী, মনিরা আজও তোমার আসল পরিচয়। জানে না। কাজেই তোমাকে অনেক ঝুঁকি সামলাতে হবে। যদি মনিকে চাও তবে মেনে নিতে হবে এই সমস্যাময় জীবন। পারবে তুমি নিজের আত্মপরিচয় গোপন করে থাকতে?

বলেছিলো নূরী–তোমার জন্য আমি সব পারবো। আর পারবো আমার মনির জন্য।

নূরীর মনে এখন মনি’র চিন্তা, কাজেই মনিরা ও অন্যান্য সকলের কথা কানে না নিয়ে এক কথায় রাজি হলো–সে সব কাজ করতে পারবে।

কান্দাই ফিরে যাওয়ার দিন ধার্য হয়ে গেল।

মনিরা এক সময় স্বামীকে নিভৃতে পেয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো–তুমি এতোবড় নির্মম প্রাণহীন। কি করে ভুলে ছিলে এতোদিন?

শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় বসেছিলো বনহুর, মনিরার হাতখানা তার হাতের মুঠায়, একটু হেসে বললো–এটাতো নতুন কিছু নয় মনিরা। তুমি জানো, আমি সাধারণ মানুষের নিয়মের বাইরে। কিন্তু এটুকু মনে রেখো, কোনো সময় ভুলিনি তোমায়।

আমি জানি, তুমি এ কথাই বলবে। সব সময় যদি আমার কথা তোমার স্মরণ হবে তাহলে এতোদিন কিছুতেই দূরে থাকতে পারতে না।

তুমি বুঝবে না মনিরা, আমাকে কিভাবে প্রতি মুহূর্ত সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি–এ আমার সৌভাগ্য। নাহলে আর কোনোদিন হয়তো তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটার সম্ভাবনা ছিলো না।

মনিরা স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলে– না না, ও সব কথা বলো না। আমার বুক কেঁপে উঠে। ওগো, তুমি যে আমার জীবনের একমাত্র সম্পদ।

মনিরা! অবেগভরা কণ্ঠস্বর বনহুরের।

মনিরা অশ্রু ছলছল আঁখি দুটি তুলে ধরে বনহুরের মুখে।

বনহুর ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে, মনিরাকে নিবিড়ভাবে বুকে টেনে নিয়ে অশ্রুসিক্ত গণ্ডে এঁকে দেয় চুম্বনরেখা। তার চোখেও পানি। মনিরার অশ্রুর সঙ্গে বনহুরের চোখের পানি এক হয়ে যায়। এতোদিন পর স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন অপূর্ব এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি করে।

স্বামীর বুকে মাথা রেখে মনিরা শুনে যায় বনহুরের সব কথা। সেই অজানা জঙ্গলে জংলীরাণীর কথা, সেই রত্ন-গুহার কথা। তারপর জংলীরাণীর পুনঃ আক্রমণ। কিভাবে মৃত্যু ঘটেছিলো, কথাটা বলতে গলা ধরে আসে বনহুরের। তারপর কাঠের ভেলায় দিনের পর দিন রাতের পর রাত। কাটানো। পরে জাহাজ ‘পর্যটন’ তাদের কিভাবে উদ্ধার করলো। জাহাজ ‘পর্যটনে’ এসে নতুন জীবন লাভ করলো বনহুর আর তার সঙ্গী কেশব। নীহারের কথাও বলতে ভুললো না সে। মেয়েটি। সরল-সহজ উদারমনা, সে যে কখন তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছিলো বুঝতে না পারলেও অল্প দিন পরেই অনুমান করে নিয়েছিলো। ওকে খুশি করবার জন্য যতটুকু পারে ভালবাসা দিতেও সে কসুর করেনি–একথাও খোলাসা বললো বনহুর মনিরার কাছে।

মনিরার মুখ থমথমে হলো সে কথায়।

বনহুর মনিরার চিবুকে মৃদু চাপা দিয়ে বললো–সব তো উজাড় করে দেইনি! তোমার জন্য প্রচুর আছে।

এমনি নানা মান-অভিমানের মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো কয়েকটি দিন।

আগামী কাল তাদের কান্দাই রওয়ানা দেবার তারিখ।

বনহুর সেদিন মনিরাসহ বাইরে থেকে ফিরছিলো, গাড়িখানা রেখে যেমন তারা হলঘরে প্রবেশ করতে যাবে, অমনি শুনতে পেলো বনহুর একটা পরিচিত গলার স্বর। থমকে দাঁড়িয়ে মনিরার হাতখানা মুঠায় চেপে ধরলো, ঠোঁটের উপর আংগুল চাপা দিয়ে তাকে চুপ থাকতে বললো।

হলঘরের মধ্য হতে শোনা গেলো পরিচালক আসলাম আলীর উৎকন্ঠা–ভরা গম্ভীর কণ্ঠস্বর হাঁ স্যার, তার নাম খান বাহাদুর শামস ইরানী।

ফটো আছে?

হাঁ আছে, মহরতের সময় উঠানো হয়েছিলো।

দেখি!

এই দেখুন স্যার।

কিছুক্ষণ কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না, মনে হলো কক্ষ মধ্যে ফটো দেখা নিয়ে ব্যস্ত আছেন হাশেম চৌধুরী। একটু পর পর শোনা গেলো হাশেম চৌধুরীর গলা–বয়স্ক লোক।

হাঁ স্যার, বয়স পঞ্চাশের উপর হবে।

ভদ্রলোকের ছবির নাম কি বললেন?

আলেয়ার আলো।

হাসির শব্দ হলো হাশেম সাহেবের কন্ঠে-আলেয়ার আলোই বটে।

মনিরা ফিস ফিস করে বললো–কোনো কেস ব্যাপারে লোক এসেছে, চলো আমরা ওদিকের পথ দিয়ে ভিতরে যাই।

তুমি যাও, কেসটা বড় রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে—

তা ভিতরে গিয়ে বসে বসেই শোন গে।

সর্বনাশ, তাহলে তোমার স্বামীকে আবার হারাতে হবে।

কি বলছো তুমি?

হাঁ, বোম্বে থেকে পালিয়ে এসেছি দিল্লী, আর ঐ খান বাহাদুর শামস ইরানীও অন্য কেহ নয়– আমি।

তুমি?

হাঁ।

তুমি আলেয়ার আলো ছবি—

এখন মনোযোগ সহকারে শোন পরে সব বলবো, বুঝলে? এখন চুপ করে শোন–বনহুর আর মনিরার কথাবার্তা অত্যন্ত নিম্নস্বরে হচ্ছিলো, কাজেই কক্ষমধ্যে কেউ শুনতে পায়নি।

কান পাতলো বনহুর, শোনা যাচ্ছে আলী সাহেব বলছেন–খান বাহাদুর শামস ইরানীকে দেখে আমি এতোটুকু অবিশ্বাস করতে পারিনি। অতি মহৎ ব্যক্তি বলেই মনে করেছিলাম, কারণ তার ব্যবহার অত্যন্ত প্রীতিজনক ছিলো। ছবি ব্যাপারে তার বিপুল আগ্রহ দেখে আমি অগ্রসর হই, তিনিও টাকা পয়সার ব্যাপারে কোনোরকম কার্পণ্য করেননি। এমনকি ছবি তৈরি করবার পূর্বেই তিনি আমাকে আমার পারিশ্রমিকের সম্পূর্ণ টাকা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমি জানতাম না তার মনে এ রকম একটা উদ্দেশ্য ছিলো। এমন কি ফুলাগু হোটেলেও তাঁর সব জিনিসপত্র তেমনি সাজানো পড়ে আছে।

হাশেম চৌধুরীর গলা–এমনও তো হতে পারে, ধরুন খান বাহাদুর শামস ইরানী তার ছবির নায়িকা শশীকে নিয়ে বোম্বেরই কোনো হোটেলে গিয়ে ফুর্তি চালাচ্ছেন?

আমরাও প্রথমে ঐ রকম সন্দেহ করেছিলাম এবং বোম্বে পুলিশ অফিসে সেইভাবেই ডায়রী দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ মহল বোম্বে শহর তচনচ্ করেও খান বাহাদুর শামস ইরানী বা শশীরাণীর কোনো হদিস পাননি। শেষে বোম্বে পুলিশ এরোড্রাম থেকে একখানা গাড়ি উদ্ধার করে এবং প্লেনের রিপোর্ট অনুযায়ী বোঝা যায়, সেই গাড়িখানাই ছিলো শামস ইরানীর।

পুলিশ আমাকে জানায়, শশীকে নিয়ে শামস ইরানী দিল্লীর পথে গা ভাসিয়েছে। যখন আমি এ সংবাদ পাই তখন দুটো দিন কেটে গেছে। যদিও প্রচুর বিলম্ব ঘটে গেছে,তবু আমি নিরাশ না হয়ে দিল্লী এসেছি। স্যার, কেসটা পুলিশে দেওয়ার পূর্বে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাই।

হাঁ, ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, সেই খান বাহাদুর শামস ইরানী শশীকে নিয়ে এতোদিন নিশ্চিন্ত মনে দিল্লী বসে নাই। সে দিল্লী ত্যাগ করে ভেগেছে। তবু আমরা আপনার। কেসটা গ্রহণ করবো এবং খানা তল্লাসী চালাবো।

স্যার, আমি আপনাদের সাহায্য কামনা করি।

বনহুর এরপর আর দাঁড়ালো না, মনিরাসহ ওদিকের দরজা দিয়ে চলে গেলো ভিতরে।

মনিরাকে সব বললো বনহুর–ঐ আসলাম আলীই হলেন আমার ছবির পরিচালক আর খান বাহাদুর শামস ইরানী অন্য কেউ নয়, আমি এবং শশী হলো সাপুড়ে কন্যা ফুল।

হাশেম চৌধুরী আসলাম আলীর কেসটা গ্রহণ করলেন এবং হুশিয়ারীর সঙ্গে দিল্লী শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুসন্ধান চালালেন। খান বাহাদুর শামস ইরানীর ফটো দিল্লীর সংবাদ পত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় অক্ষরে ছাপা হলো। শহরময় ছড়িয়ে পড়লো সি, আই, ডি, পুলিশ।

সেদিন বনহুরের বিদায় অভিনন্দনের পালা।

পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরী পত্রিকাখানা হাতে বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

বনহুর, মনিরা, নূরী, কেশব আর ফুলমিয়া দিল্লী শহর ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিয়েছে, হাশেম চৌধুরী পত্রিকাখানা মেলে ধরলেন বনহুরের সামনে–এই ছবিটা দেখুন, হঠাৎ যদি আপনাদের দৃষ্টিপথে পড়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সহায়তায় তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলবেন। আসলাম আলী দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন।

বনহুর পত্রিকাখানা হাতে নিয়ে দেখলো, এটা খান বাহাদুর শামস ইরানী-বেশে তারই ফটো, মনে মনে হাসলো বনহুর, বললো–নিশ্চয়ই আপনার কথা স্মরণ থাকবে মিঃ হাশেম।

ওদিকে প্লেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। যাত্রীগণ সবাই প্লেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বনহুর মনিরা, নূরী আর কেশব, ফুলমিয়াকে নিয়ে প্লেনের দিকে এগুলো। বিদায়কালে মনিরা তো মাসুমার গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললো।

নূরীর কিন্তু জড়োসড়ো সঙ্কোচিত ভাব, মনিরার আদেশের প্রতীক্ষায় সদা যেন তটস্থ রয়েছে। সে। কিসে মনিরা খুশি হবে, এই যেন তার মনের ইচ্ছা। অবশ্য বনহুর তাকে এইভাবে আত্মপরিচয় গোপন রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলো, কারণ মনিরা যেন জানতে না পারে তার সঙ্গে ওর কোনো সম্বন্ধ আছে। মানে বনহুর আর নূরী যেন সম্পূর্ণ আলাদা জন।

হাশেম চৌধুরী আর মাসুমার কাছে বিদায় নিয়ে কান্দাই এর পথে রওয়ানা দিলো বনহুর তার দুই সঙ্গিনী আর বন্ধুদ্বয় নিয়ে। বিদায়কালে মনিরা মাসুমার গলা জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন করলো।

সম্পূর্ণ দিনটা কাটলো তাদের প্লেনে, সন্ধ্যায় কান্দাই এরোড্রামে পৌঁছে গেলো তারা। মনিরার আনন্দ যেন ধরছে না, খুশিতে আপুত সে। কতদিন পর ফিরে এলো স্বদেশে। সবচেয়ে মনিরার বড় আনন্দ–স্বামীকে সে সঙ্গে পেয়েছে। এ যেন তার জীবনে এক পরম সৌভাগ্যের কথা।

হঠাৎ স্বামীকে সঙ্গে করে মামীমা আর নূরকে অবাক করে দেবে মনিরা। বহুদিন পর পুত্রকে পেয়ে মামীমার আনন্দ আর ধরবে না। নূরও খুশি হবে তার বাপকে পেয়ে।

কিন্তু সব আশা মনিরার বিফল হলো ট্যাক্সিতে মনিরা আর নূরীকে তুলে দিয়ে বললো বনহুর–তোমরা বাড়িতে যাও মনিরা।

অবাক কণ্ঠে বলে উঠে মনিরা–আর তুমি?

আমি আমার আস্তানায় যাবো।

তা হবে না, তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো না। মনিরা স্বামীর টাইটা এটে ধরে ফেলে।

হেসে বলে বনহুর–জানো না মনিরা, আমার যাওয়া এখন কিছুতেই সম্ভব নয়।

কেন? বললো মনিরা।

আজ নয় পরে বলবো! বললো বনহুর।

মনিরা আর নূরীর সঙ্গে ফুলমিয়াকেও দিয়ে দিলো, ড্রাইভারকে বলে দিলো চৌধুরী বাড়ির ঠিকানা।

মনিরা গম্ভীর হয়ে পড়লো, সে জানে স্বামীকে সে আজ কিছুতেই বাধ্যে আনতে সক্ষম হবে না, কাজেই বনহুরের টাই ছেড়ে দিয়ে বললো–ঠিক কবে আসবে বলো?

নূরীও প্রশ্ন-ভরা উন্মুখ হৃদয় নিয়েই তাকিয়েছিলো বনহুরের মুখের দিকে। বনহুর তাকালো নূরীর দিকে, দুজনার দৃষ্টি বিনিময় হলো, বললো বনহুর–যেদিন স্মরণ করবে সেদিনই হাজির হবো।

বনহুর গাড়ি ছাড়বার জন্য ড্রাইভারকে আদেশ দিলো।

গাড়িতে স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।

মনিরার হাতের মুঠা থেকে খসে এলো বনহুরের হাতখানা। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো মনিরা।

তখন নূরীর চোখ দুটোও শুষ্ক ছিলো না, নিজকে সংযত করে নিয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো সে।

ড্রাইভারের পাশের আসনে বসেছিল ফুলমিয়া।

মনিরা রুমালে চোখ মুছলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো মনিরা–ফুল, তোর কেউ নেই।

না আপামনি, আমার কেউ নেই।

চিরদিন থাকবি আমার কাছে?

যদি রাখেন থাকবো না কেন?

তোর ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই?

থাকলে আর আসি আপনাদের সঙ্গে! এখন আপনারাই আমার সব।

ফুল?

বলুন আপামনি?

না থাক, পরে বলবো।

বাসায় পৌঁছে মনিরা মামীমাকে সব খুলে বললো। ফুল আর ফুলমিয়ার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলো মরিয়ম বেগমের। প্রথম নজরেই ফুলকে বড় ভাল লাগলো মরিয়ম বেগমের।

মরিয়ম বেগম নূরীর মাথায় হাত বুলায়ে স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন–আহা বেচারী কি নাম মা তোমার?

নূরীর কাছেও বড় ভাল লাগলো মরিয়ম বেগমকে। ছোট বেলায় সে মাকে হারিয়েছে, মায়ের স্নেহ সে পায়নি কোনোদিন। নূরী মরিয়ম বেগমের মধ্যে তার বহুদিন পূর্বে হারানো মাকে যেন খুঁজে পেলো। হঠাৎ আপন মনেই কদমবুসি করলো নূরী তাঁর।

ফুলমিয়াও মরিয়ম বেগমকে কদমবুসি করলো।

মরিয়ম বেগম ফুলমিয়াকে বৃদ্ধা সরকার সাহেবের হাতে তুলে দিলেন, কারণ এমনি একটি লোকের তাদের প্রয়োজন ছিলো। সরকার সাহেবের দক্ষিণ হস্ত আকারে সর্বক্ষণের জন্য থাকবে সে তার পাশে।

ফুলমিয়াকে পেয়ে সরকার সাহেব খুশি হলেন।

চৌধুরী বাড়িতে আশ্রয় পেলো ফুলমিয়া। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশ হলেও ভালই লাগলো ওর চৌধুরী বাড়িটা। ফুলমিয়ার বড় আশাবাবুকে সে একদিন না একদিন পাবেই।

অনেকদিন পর নূর মাকে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে।

মনিরা পুত্র নূরকে কোলে তুলে নিয়ে চুমোয় চুমোয় গণ্ড রাঙা করে দিলো।

মনিরা যখন নূরকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা তখন নূরী অদূরে দাঁড়িয়ে পুলকিত নয়নে দেখছিলো, ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর, ছুটে গিয়ে নূরকে বুকে চেপে ধরে কিন্তু পারছিলো না। নূরী অতি কষ্টে নিজকে সংযত রেখে তাকিয়ে ছিলো। বুকটা যেন হাহাকার করে উঠছিলো তার। সেদিনের মনি আজ বড় হয়েছে কি সুন্দর কথা বলতে শিখেছে? ঐ তো চিবুকের পাশে তিলটা যদিও একটু উপরে উঠে গেছে কিন্তু তেমনি আছে। নূরীর বুক ভরে উঠে যেন।

নূরী যদিও তার বাপিকে এখন প্রায় ভুলে এসেছে তবু মাঝে মাঝে দাদীমার কাছে শোনে তার বাপির কথা, তাই মাকে প্রশ্ন করে বসলো নূর”আম্মি, বাপি কোথায়? আমার বাপি এলো না?

মনিরা বললো তোমার বাপি আসবে বাবা। তুমি কিছু ভেবো না আসবে।

কবে আসবে?

যেদিন তুমি ডাকবে।

আমি যখন ডাকবো তখনই আসবে বাপি?

হাঁ বাবা।

এক্ষুণি যদি ডাকি?

আজ নয়, পরে ডেকো।

এগিয়ে আসে নূরী–এসো, আমার কোলে এসো নূর।

মনিরা বলে–যাও, ওর কাছে যাও বাবা।

ও কে আম্মি? মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে নূর।

মনিরা হেসে বলে–ওর নাম ফুল।

ফুল?

হাঁ, আমার নাম ফুল! এসো–কথাটা বলে হাত পাতে নূরী।

মনিরা বলে–যাও বাবা, ওর কোলে যাও, অনেক ফুল ও তোমায় দেবে।

হাসে মনিরা, নূরও হাসে আর হাসে নূরী।

এমনি করে নূরীর সঙ্গে সম্বন্ধ গড়ে উঠে নূরের।

এদিকে যখন চৌধুরী বাড়িতে আনন্দস্রোত বয়ে চলেছে তখন কান্দাই জঙ্গলে দস্যু বনহুরের আস্তানায় সর্দার ফিরে আসায় মহা উৎসব শুরু হয়েছে।

রহমান আয়োজন করেছে এ উৎসবের।

বনহুরের দেহে এখন সম্পূর্ণ জমকালো ড্রেস। মাথায় পাগড়ি কোমরে বেল্টে গুলী-ভরা পিস্তল। সুউচ্চ আসনে বসেছে বনহুর, তার পাশেই দন্ডায়মান রহমান–তার দেহেও দস্যড্রেস। অন্যান্য অনুচর সবাই দন্ডায়মান চারপাশে। রাত এখন কম নয়। কেশব ঘুমিয়ে পড়েছিলো, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তার। কখন যে কেশব কক্ষ ত্যাগ করে দরবার কক্ষের অদূরে এসে দাঁড়িয়েছিলো অবাক হয়ে দেখছিলো সব।

একজন অনুচর কেশবকে দেখে ফেলে, তখনই ধরে আনে ওকে দরবারকক্ষের মধ্যে।

অনুচরটি কেশবকে দেখেনি বা চিনতো না, কেশবকে ধরে ভিতরে নিয়ে আসে–সর্দার, এই লোকটা দরবারকক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলো।

বনহুর তাকালো সম্মুখে, কেশবকে দেখে ব্যাপারটা উপলব্ধি করে নিলো, বুঝতে পারলো– কেশব তাদের কার্যকলাপে অবাক হয়েছে। যদিও নূরীর কাছে কেশব বনহুর সম্বন্ধে পূর্ব হতেই অবগত হয়েছিলো তবুও চাক্ষুস এসব দর্শনে আশ্চর্য না হয়ে সে পারে না।

বনহুরের দিকে তাকায় কেশব, দু’চোখে তার অসহায় দৃষ্টি। না জানি এই মুহূর্তে বাবু তার উপর কেমন ব্যবহার করবে কে জানে। এ ড্রেসে সে বাবুকে কোনোদিন দেখেনি। অদ্ভুত লাগছে। বাবুকে,তাই বিস্ময়-ভরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কেশব তার বাবুর দিকে।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–ছেড়ে দাও ওকে! ও আমাদেরই একজন।

অনুচরটি মুক্ত করে দিলো কেশবকে।

কেশব এবার বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালো, মনোভাব–দেখলে তো ধরে এনে কি ফল হলো।

বনহুর বললো–কেশব এখন যাও।

অনুচরটি বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে কেশবকে লক্ষ্য করে বললো-এসো।

কেশব একবার বনহুরের দিকে তাকিয়ে অনুচরটির সঙ্গে দরবারকক্ষ ত্যাগ করলো।

উঠে দাঁড়ালো বনহুর, তারপর অনুচরগণকে লক্ষ্য করে স্থির কণ্ঠে বললো–বহুদিন আমি আস্তানা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতেও তোমরা যে অতি সুন্দর, এবং সুষ্ঠুভাবে আস্তানার কাজ সমাধা করেছে এজন্য আমি অত্যন্ত আনন্দ বোধ করছি। রহমান এবং কায়েস, তোমরা আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করো।

রহমান আর কায়েস নত মস্তকে বনহুরকে অভিনন্দন জানালো।

দরবারকক্ষে যখন আনন্দস্রোত বয়ে চলেছে, সেই মুহূর্তে দরবার কক্ষের বাইরে শোনা গেলো দ্রুত অশ্ব-পদশব্দ। পরক্ষণেই দরবারকক্ষে প্রবেশ করলো বনহুরের বিশ্বস্ত অনুচর কাওসার। দরবারকক্ষে প্রবেশ করেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো সে দরবারকক্ষের মেঝেতে।

দরবারকক্ষের সবাই বিস্ময়ে চমকে উঠলো, সবাই দেখলো–কাওসারের পিঠে সূতীক্ষ্ণধার একখানা ছোরা গাঁথা আছে। অন্যান্য অনুচরের মধ্যে কেউ এগিয়ে আসবার পূর্বেই বনহুর নেমে এসে কাওসারের পিঠ থেকে ছোরাখানা তুলে নিলো।

রহমান এবং কায়েসও দ্রুত এসে হাঁটু গেড়ে বসলো কাওসারের পাশে। সকলের মুখেই আতঙ্ক আর উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটে উঠলো।

অন্যান্য অনুচরের মুখ ভয়ঙ্কর আর কঠিন হয়ে উঠেছে। সবাই যেন সাংঘাতিক কোনো এক অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো।

বনহুর ছোরাখানা কাওসারের পিঠে থেকে তুলে নিয়ে বললো কাওসার, কে তোমার এ অবস্থা করেছে?

কাওসার বহুদিন পর সর্দারকে দেখতে পেলো, মৃত্যু-যন্ত্রণা ভুলে গেলো সে, মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো চক্ করে উঠলো, অতি কষ্টে বললো–সর্দার–

বলো কাওসার, তোমার এ অবস্থা কেন?

–সর্দার–মঙ্গল ডাকু–আমাকে ধরে–নিয়ে গিয়েছিলো ঝম–শ–হ-র– আমি– পালি–য়ে–আর বলতে পারলো না, কাওসারের মাথাটা কাৎ হয়ে গড়িয়ে পড়লো বনহুরের হাতের উপর।

বনহুর কাওসারের মাথাটা নামিয়ে রাখলো ভূতলে। চোখ দুটি তার জ্বলে উঠলো আগুনের গোলার মত। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো–রহমান, কে এই মঙ্গলা ডাকু?

সর্দার এখনও আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। কিছুদিন হলো কান্দাই-এর বাইরে ঝাম। অঞ্চলে একজন ডাকুর আবির্ভাব ঘটেছে। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর সাংঘাতিক নরহন্তা এই ডাকু। শুধু ঝম শহরে বা ঐ অঞ্চলে নয়, কান্দাই-এর বুকেও অনেক কুৎসিত কাজ সে সম্পন্ন করে চলেছে। নরহত্যা তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রহমান বলে চলেছে, স্তব্ধ নিশ্বাসে শুনছে বনহুর, দক্ষিণ হস্তখানা ধীরে ধীরে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসছে তার।

সর্দার, শয়তান মঙ্গল ডাকুর কার্যকলাপে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। এজন্য তার সঙ্গে আমাদের কয়েকবার লড়াই হয়েছে, কয়েকজন অনুচর জীবনও দিয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে। আজও গ্রেপ্তার করতে পারিনি বা তার আড়র সন্ধান পাইনি। সর্দার, ঝাঁম শহর থেকে কান্দাই পুলিশ বাহিনী হন্তদন্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু কিছুই করতে পারেনি কেউ–

কাওসারের ঘটনা কি তাই বলো রহমান? বললো বনহুর।

রহমান কাওসারের মৃতদেহটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মনের উচ্ছ্বসিত বেদনাকে চেপে নিয়ে বললো–কাওসারসহ আমরা কয়েকজন মিলে একদিন মঙ্গল ডাকুকে আক্রমণ করেছিলাম। ওদের দলের সঙ্গে আমাদের লড়াই হয়, এ লড়াই-এ উভয় পক্ষেরই লোকজন নিহত হয় আর আহত হয়। বন্দীও হয় আমাদের দু’জন–একজন কাওসার অন্যজন মাহবুব।

এ তুমি কি বলছো রহমান।

হাঁ সর্দার।

মঙ্গল ডাকুর হস্তে আমাদের লোক বন্দী হলো আর তোমরা নিশ্চিন্তে বসে আছে বা ছিলে?

সর্দার, নিশ্চিন্ত আমরা ছিলাম না, অহরহঃ আমাদের লোক এই মঙ্গল ডাকুকে সন্ধান করে ফিরছে।

এতেই তুমি নিশ্চিন্ত আছো রহমান?

না সর্দার, আমি নিজেও প্রতিদিন এই নরহত্যাকারী দস্যু এবং তার আড্ডার অনুসন্ধান করে ফিরছি।

আশ্চর্য! এমন একটা নিদারুণ সংবাদকে তোমরা গোপন রেখে আমাকে নিয়ে তোমরা আনন্দে মেতে উঠেছিলে?

সর্দার, আপনার আবির্ভাবে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম সব কিছু। এমন কি আনন্দের আতিশয্যে ভুলে গিয়েছিলাম নিজেদের অস্তিত্ব।

রহমান, আর মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিত নয়। কাওসারের মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি তিল তিল করে নেবো। এক্ষুণি তাজকে প্রস্তুত করো এবং তুমিও আমার সঙ্গে চলো।

সর্দার।

হাঁ, এক্ষুণি আমি রওয়ানা দেবো।

কিন্তু মঙ্গল ডাকুকে এখন কোথায় পাবেন সর্দার? সে অত্যন্ত ধূর্ত আর শয়তান।

রহমান, আমার চেয়ে ধূর্ত আর শয়তান সে বেশি নয়। ঝম শহরে না গেলে তার সন্ধান পাওয়া যাবে না। যাও, তাজ এবং দুলকীকে প্রস্তুত করে নিয়ে এসো। আর কাওসারের মৃতদেহের সকাজের ব্যবস্থা করতে বলো।

বনহুর দরবারকক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে।

বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করে পিস্তল এবং গুলীর ব্যাগটা তুলে নিলো হাতে। কোমরের বেল্টের সঙ্গে সেগুলোকে সংবদ্ধ করে বেরিয়ে এলো। রহমান, কায়েস এবং আরও কয়েকজন অনুচর আস্তানার বাইরে তাজ আর দুলকীকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলো।

বনহুর তাজের পিঠে চেপে বসতেই রহমান উঠে বসলো দুলকীর পিঠে।

উল্কাবেগে ছুটতে শুরু করলো তাজ। পশু হলেও তার মনোভাবে প্রকাশ পেলো অফুরন্ত আনন্দ–কতদিন পর আজ সে প্রভুকে নিজের পিঠে পেয়েছে।

তাজের পিছনেই ছুটছে দুলকী।

বন-জঙ্গল ভেদ করে বেগে চলেছে, ঝম অভিমুখে চলেছে বনহুর আর রহমান। উভয়ের শরীরেই জমকালো ড্রেস।

কান্দাই জঙ্গল ত্যাগ করে তীরবেগে অগ্রসর হচ্ছে। রাত এখন গভীর। নির্জন পথ ধরে ছুটে চলেছে, পথে কোনো জন-মানবের চিহ্ন নেই।

কান্দাই জঙ্গল অতিক্রম করে তারা বহুদূর এসে গেছে। সারথী, তারপর বাসুদেবপুর, তারপর . ঝম শহর। নির্জন প্রান্তর অতিক্রম করে তারা এগুচ্ছে। এখন ওরা সারথী জঙ্গলের পাশ কেটে চলছিলো।

হঠাৎ রহমান উচ্চকণ্ঠে বলে উঠে–সর্দার, ঐ দেখুন।

বনহুর তাজের গতি কমিয়ে দিলো।

রহমানও দুলকি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো স্থির হয়ে।

বনহুর আর রহমান সম্মুখে তাকিয়ে দেখলো, দূরে–বহু দূরে জঙ্গলের মধ্যে অনেকগুলো আলো দেখা যাচ্ছে। আলোগুলো যে জ্বলন্ত মশাল, স্পষ্ট বুঝতে পারলো তারা।

রহমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে বললো–সর্দার, নিশ্চয়ই মঙ্গল ডাকুর দল, কোথাও হানা দিয়ে লুটতরাজ করে ফিরে যাচ্ছে।

হুঁ, সেরকমই হবে। রহমান, আমি এই মঙ্গল ডাকুকে অনুসরণ করবো।

সর্দার, ওদের দলে বহু লোক আছে।

রহমান, তাজ আর দুলকীর গতি লঘু করে নিয়ে সন্তর্পণে এগুতে হবে।

হা সর্দার।

এবার বনহুর আর রহমান অশ্ব ধীরভাবে চালনা করে মশালের আলো অভিমুখে চলতে লাগলো।

রহমান বললো–সর্দার, মঙ্গল ডাকু আজকাল প্রতি রাতেই এভাবে লুটতরাজ করে চলেছে।

তোমরা বাধা দিয়ে কৃতকার্য হওনি!

হা সর্দার, অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এই ডাকু।

সেই কারণেই আজ আমারও আগমন! আর শোন রহমান মঙ্গল ডাকু আজ লুটতরাজে বের হয়নি, তারা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে বন-জঙ্গলে কিছু অন্বেষণ করে ফিরছে।

সর্দার, এ অনুমান আপনার কি করে হলো?

দেখছো না মশালের আলোগুলো কেমন বিক্ষিপ্ত এবং ছড়ানো, মনে হচ্ছে মশালের আলোতে তারা কোনো বস্তুর সন্ধান করে ফিরছে।

ঠিক বলেছেন সর্দার।

মঙ্গল ডাকুও তার দলবল যে কাওসারকেই অনুসন্ধান করছে সে বিষয়ে কোন ভুল নেই। ঐ দেখো, এখন ওরা অনেক নিকটে এসে গেছে।

সর্দার, আমাদের অশ্ব নিয়ে এভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত হবে না।

হাঁ, ঠিক বলেছো রহমান, ওরা যেভাবে সন্ধান চালিয়ে এগুচ্ছে তাতে আমরা অল্পক্ষণেই ওদের। নজরে পড়ে যাবো। এক কাজ করো, তাজ আর দুলকীকে নিয়ে ঐ যে উঁচু টিলাটা দেখা যাচ্ছে। ওখানে তুমি চলে যাও।

আর আপনি?

আমার জন্য ভেবো না রহমান, আমি কোনো গাছে আত্মগোপন করে দেখতে চাই–এই মঙ্গল ডাকু কে এবং কি করম। তুমি মোটেই বিলম্ব করো না যাও।

রহমান তাজ আর দুলকীকে নিয়ে চলে গেলো।

বনহুর পাশের একটা গাছের উপর মাঝডালে বসে রইলো, তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে দেখতে লাগলো–মশালগুলো দ্রুত এদিকেই এগিয়ে আসছে।

অল্পক্ষণেই বনহুরের নজরে পড়লো, কেমন যেন অদ্ভুত ড্রেস পরিহিত ভয়ঙ্কর চেহারার লোক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মশাল হস্তে বন-জঙ্গল অতিক্রম করে এগুচ্ছে।

মশালের আলোতে সব স্পষ্ট দেখতে পেলো বনহুর, দলের অগ্রভাগে দু’জন বলিষ্ঠকায় লোক, তাদের হস্তেও মশাল এবং বল্লম। লোকগুলো দেখতে ঠিক সাক্ষাৎ যমের মত ভয়ঙ্কর।

বনহুর বুঝতে পারলো, এরা কিছু অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে। মশাল উঁচু করে দেখছে এদিক সেদিক এবং নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছে। বনহুরের কানে গেলো একটা কর্কশ কঠিন কণ্ঠস্বর–বেটা মরলে লাশটা তো পড়ে থাকবে?

হাঁ ঠিক বলেছো জয়সিং মরলে লাশটা পাওয়া যেতো।

ঘোড়াটাই বা গেলো কোথায়? লাশটা না হয় বাঘভলুক খেয়ে ফেলেছে।

তাইতো, ঘোড়াও যে দেখছিনা কোথাও! বললো জয়সিং।

বনহুর ভালভাবে কান পেতে শুনলো–বিপরীত জনের নাম রঘুনাথ। এ দু’জনার মধ্যেই। একজনকে বনহুর মঙ্গল ডাকু মনে করেছিলো কিন্তু এখন বুঝতে পারলো মঙ্গল ডাকু স্বয়ং এদের মধ্যে নেই। এরা সবাই মঙ্গল ডাকুর অনুচর। বনহুর তার বিশ্বস্ত অনুচর কাওসারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠলো। দলকে কাবু করতে পারলেই দলপতিকে পাকড়াও সম্ভব হবে। মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ কাওসারের মৃতদেহ খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলেছে। বনহুরের পিস্তল গর্জে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলো সম্মুখে এগিয়ে চলা মশালধারীদের একজন, তৎক্ষণাৎ মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়লো ভূতলে।

এক অদ্ভুত কান্ড ঘটলো মুহূর্তে। সমস্ত মশাল পট পট করে ঝোপ আর আগাছার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলো, তারপর যে যেদিকে পারলো ছুটে পালাতে লাগলো।

বনহুর বুঝতে পারলো ওরা আচমকা গুলীর আওয়াজে অত্যন্ত ভয় পেয়ে গেছে। বিশেষ করে গভীর রাতে গহন জঙ্গলে পিস্তলের শব্দ এলো কোথা হতে। পলাতক কাওসারের নিকটে তো কোনো পিস্তল বা রিভলভার ছিলো না।

বনহুর আরও দুজনকে ভূতলশায়ী করে ফেললো। তারপর দ্রুত বৃক্ষ থেকে নেমে এলো নিচে। একজন উঠিপড়ি করে পালাতে যাচ্ছিলো, বনহুর পিস্তল উদ্যত করে ধরলো–খবরদার পালাতে চেষ্টা করলেই মরবে।

বনহুরের কঠিন কণ্ঠস্বরে এবং তার জমকালো ড্রেস দেখে ভড়কে গিয়েছিলো ডাকুটা, হাত তুলে দাঁড়ালো।

বনহুর পকেট থেকে একটা বাঁশি বের করে ফুঁ দিলো সঙ্গে সঙ্গে রহমান তাজ এবং দুলকীকে নিয়ে হাজির হলো সেখানে।

বনহুর আদেশ দিলো–একে বেঁধে নিয়ে চলো রহমান।

রহমান তৎক্ষণাৎ বন থেকে কতকগুলো লতাপাতার দ্বারা মজবুত দড়ি তৈরি করে ফেললো, তাই দিয়ে বেঁধে ফেললো ডাকুটাকে।

লোকটা যে অত্যন্ত শক্তিশালী বলিষ্ঠ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন ভয়ঙ্কর চেহারা তেমনি বিরাট দেহ। বনহুর নিজের অশ্বের পিছনে উঠিয়ে নিলো ওকে পিছমোড়া করে বেঁধে।

বনহুর ও রহমান মঙ্গল ডাকুর একজনকে বন্দী করে নিয়ে ফিরে এলো আস্তানায়।

আস্তানায় ফিরে আদেশ দিলো বনহুর–ওকে দরবারকক্ষে নিয়ে এসো।

বনহুর তার আসনে এসে বসলো।

কয়েকজন অনুচর সূতীক্ষ্ণধার বর্ষা আর রাইফেল নিয়ে দন্ডায়মান বনহুরের সম্মুখে। রহমান আর কায়েসও দাঁড়ালো বনহুরের আসনের পাশে।

হাত পা শৃঙ্খল অবস্থায় মঙ্গল ডাকুর অনুচরটিকে নিয়ে আসা হলো দরবারকক্ষে।

বনহুর গর্জন করে উঠলো–তোদের দলপতির নাম কি বল?

মঙ্গল ডাকু।

হা, জীবন নিয়ে যদি ফিরে যেতে চাস তবে আমার প্রশ্নের জবাব দে।

লোকটা হাঁপাচ্ছে। সে তাকালো বনহুরের দিকে।

বনহুর বললো–আমাদের দলের দু’জন লোককে তোদের দলপতি ধরে নিয়ে গিয়েছিলো– তারা এখন কোথায়?

বনহুরের কঠিন কণ্ঠস্বরে লোকটার বিরাট দেহটা যেন কেঁপে উঠলো, গোলাকার অগ্নি চক্ষু দুটো কেমন যেন অসহায় মনে হলো, বললো সে–আমাকে যদি প্রাণে না মারেন তবে আমি সত্যি কথা বলবো।

হাঁ, তাই বলো! মনে রেখো, এক বিন্দু যদি মিথ্যা হয় তাহলে তোমার জিহ্বা লৌহ-সড়াসী দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।

লোকটা ডাকু হলেও নিজের প্রাণের মায়ায় সে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছে–কাঁপছে লোকটা।

বনহুর পুনরায় গর্জে উঠলো–বলো দস্যু বনহুরের অনুচর দুটিকে তোমরা কি করেছো?

বলছি বলছি আমি–একটু থেমে বললো লোকটা–হুঁজুর সত্যি কথা বললে আমাকে হত্যা করবে না তো?

না, তোমাকে মুক্তি দেবো।

হুজুর, আপনার অনুচর দু’জনকে আমরা হত্যা করেছি। কারণ তারা কিছুতেই আপনার নাম আর আস্তানার সন্ধান আমাদের বলেনি। একজনের চক্ষু দুটি উপড়ে ফেলা হয়েছিলো। কান কেটে দেওয়া হয়েছিলো। আমরা ভেবেছিলাম সঙ্গীর কঠিন মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে ভয় পেয়ে সব বলবে কিন্তু তবু তারা নির্বাক ছিলো।

তারপর?

তারপর একজন মারা পড়লো, দ্বিতীয় জন তবু এতোটুকু বিচলিত হলো না। তাকেও আমরা মৃত্যুদন্ড দেবো স্থির হলো। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে তাকে। সমস্ত দেহে আগুন ধরিয়ে জীবন্ত পুড়ে মারা হবে। সব প্রস্তুত অশ্বপিঠে তাকে আমারা গহন জঙ্গল মধ্যে নিয়ে চললাম কারণ গভীর রাতে গহন জঙ্গলে তাকে পুড়ে মারা হবে। আমরা বেশ কয়েকজন মিলে চললাম, আমাদের সর্দারও ছিলো। হুজুর, একটি মিথ্যাও বলবো না সব বলবো।

বল্ সব খুলে বল্? বললো বনহুর, তার চোখ দুটি দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে।

লোকটা জীবন রক্ষার জন্য অত্যন্ত আগ্রহশীল, সে বলে চললো সব কথা তবুও যদি জীবনটা ফিরে পায়–হঠাৎ সে আমাদের চোখে ধূলো দিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে ছুটে পালাতে গেলো, ঐমুহূর্তে সর্দার মঙ্গল ডাকু তার সূতীক্ষ্ণধার ছোরাখানা দ্রুত-হস্তে নিক্ষেপ করলো তাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তাকে আমরা রুখতে পারলাম না,ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় অশ্বপৃষ্ঠে গহন জঙ্গলে কোথায় যে চলে গেলো আর তাকে খুঁজে পেলাম না।

হু সে ফিরে এসেছিলো আমার আস্তানায় এবং তার মৃত্যু হয়েছে। এবার বল তোমাদের সর্দারের আস্তানার পথের সন্ধান।

আমাকে মুক্তি দেবেন তো?

দেবো তার সঙ্গে পুরস্কারও পাবি।

সত্যি?

হাঁ, জীবনে আর তোকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।

লোকটার চোখমুখ খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো সে বলতে শুরু করলো সারথী বনের দক্ষিণে ঝাঁম জঙ্গল। এই জঙ্গলে একটা শিব মন্দির আছে, ঐ মন্দিরের মধ্যে আছে একটি সুড়ঙ্গপথ। সেই সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করলে আমাদের মঙ্গল ডাকুর আড়া। জঙ্গলেই পাবেন–

থাক, আর বলতে হবে না। বনহুর এবার এমনভাবে কথাটা উচ্চারণ করলো চমকে উঠলো লোকটা ভীত নজরে তাকালো সে বনহুরের জমকালো পোশাক পরা দেহটার দিকে। একি বনহুরের হস্তে ছোরা কেন শিউরে উঠলো লোকটা।

রহমান, কায়েস এরা জানে, তাদের সর্দার কোনোদিন বিশ্বাসঘাতককে প্রশ্রয় দেয় না। লোকটার পরিণতি সম্বন্ধে পূর্বেই তারা বুঝতে পেরেছিলো, স্তব্ধ নিশ্বাসে দরবারকক্ষস্থ বনহুরের অনুচরগণ কোনো একটা ভয়ঙ্কর কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করছিলো।

যদিও লোকটা তার দলের কেউ নয় বা তার এতে কিছু যায় আসে না তবু সে বিশ্বাসঘাতক বনহুর বিশ্বাসঘাতককে ক্ষমা করে না। সে নিজের দলেরই হোক কিংবা অপর কোনো দলের লোক হোক। মৃত্যুভয়ে লোকটা ভীত না হয়ে মৃত্যুকে যদি বরণ করে নিতো তবুও যদি সে নিজ সর্দার বা তাদের আস্তানার সন্ধান না জানাতো তাতে হয়তো লোকটাকে বন্দী করে রাখতে বনহুর কিন্তু নির্মমভাবে হত্যা করতো না বরং মনে মনে সে তার বিশ্বাসের তারিফ করতো।

বনহুর সূতীক্ষ্ণধার ছোরা হস্তে মঙ্গল ডাকুর অনুচরটির দিকে এগিয়ে আসে, তারপর বিনাদ্বিধায়। ছোরাখানা সমূলে প্রবেশ করিয়ে দেয় লোকটার তলপেটে।

মুহূর্ত মধ্যে একটা করুণ আর্তচিৎকার ভেসে উঠে দরবার কক্ষে, পরক্ষণেই লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ভূতলে, রক্তে রাঙা হয়ে উঠে দরবারকক্ষের মেঝে।

বনহুর দাতে দাঁত পিষে বলে–বিশ্বাসঘাতক, মৃত্যু ভয়ে নিজের সর্দারকে যমের কবলে তুলে দিতে কসুর করলো না। তারপর হেসে উঠলো অদ্ভুতভাবে–হাঃহাঃ হাঃ মঙ্গল ডাকু। মঙ্গল ডাকুকে আমি দেখে নেবো এবার।

ফুলের ব্যবহারে মনিরা খুব খুশি। শুধু মনিরাই নয় চৌধুরী বাড়ির সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছে। মরিয়ম বেগম, এমন কি বাড়ির চাকর-বাকর সবাই এই চঞ্চলা মেয়েটিকে ভালবেসে ফেললো। নূর প্রথম প্রথম ওকে এড়িয়ে চলতো। হঠাৎ ফুল যদি ওকে ধরে ফেলতো তখন কেঁদে কেটে আকুল হতো। কিছুতেই ফুলকে সে দেখতে পারতো না।

একদিন বাগানে খেলা করছিলো নূর, ফুল চট করে ধরে কোলে তুলে নেয়, আদর করে চুমু দেয় নূরের ছোট্ট গালে।

আচমকা ফুলের এ আচরণে নুর হকচকিয়ে যায়, চিৎকার করে কেঁদে উঠে আম্মি আম্মি—

মনিরা পুত্রের চিৎকার শুনে বেরিয়ে আসে–কি হলো, কি হলো নূর, নূর—

মাকে দেখতে পেয়ে ছুটে পালিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নূর মায়ের কোলে।

মনিরা নূরকে বুকে তুলে নিয়ে বলে উঠে–কি হয়েছে বাপ? অদূরে ফুলের দিকে তাকায় মনিরা।

ফুল হেসে বলে– আপামনি আমি বাবুকে একটু কোলে করেছিলাম তাই–

হাসে মনিরা–দুষ্ট ছেলে ও একটু কোলে করেছে তাই অমন করে চিৎকার করতে হয় বুঝি?

নূর কোনো কথা বলে না, তাকায় ফুলের দিকে।

ফুল হাসে।

এমনি করে বেশ কয়েকটা দিন কেটে যায়, ফুলের সঙ্গে নূরের ভাব সম্পূর্ণ জমে না উঠলেও অনেকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে। ফুল যতদূর সম্ভব নূরকে নিজের কাছে পাওয়ার জন্য সদা ব্যাকুল।

আজকাল ফুলমিয়াও এ বাড়িরই একজন হয়ে গেছে। সব সময় সে সরকার সাহেবের সঙ্গে নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। মরিয়ম বেগম অনেক সন্তুষ্ট ফুলমিয়ার উপর।

মনিরা কিন্তু স্বামীর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটা দিন যেন তার কাছে এক একটা যুগ বলে মনে হচ্ছে। রোজই সে ব্যাকুল হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করে চলেছে, কিন্তু আজও তার সাক্ষাৎ নেই।

এ বাড়ির আর একজনও ঠিক মনিরার মতই বনহুরের জন্য উন্মুখ, সে হলো ফুল। সেদিনের পর থেকে রোজই সে রাতের অন্ধকারে মুক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে নিশীথের অন্ধকারে কোন অশ্ব-পদশব্দের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ধরে আসে, অবশ হয় সমস্ত দেহটা। চোখ দুটি বুজে আসে আপনা আপনি। ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে এক সময় ঢলে পড়ে ফুল বিছানায়, একগুচ্ছ হাস্নাহেনার মত নেতিয়ে পড়ে সে।

চৌধুরী বাড়ির নিচের এক কামরায় থাকে ফুল। পাশের কামরায় থাকে অন্যান্য মহিলা ঝি এবং দাসীগণ। সমস্ত দিন পরিশ্রম করে রাতে নিজ কামরায় এসে বসতো। নির্জন কক্ষে বসে ভাবতো তার হুরের কথা।

নূরী যখন ভাবছে তার হুরকে নিয়ে, উপরের একটি কক্ষে তখন মনিরাও ভাবছে তার স্বামীর কথা। কতদিন চলে গেলো তবু আসছে না কেন সে। উভয়ের চিন্তার কারণ একই জন।

অন্যান্য দিনের মত আজও বনহুরের কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নূরী। হঠাৎ একটা চাপা কণ্ঠস্বর–নূরী–নূরী–

আচমকা ঘুম ভেঙে যায় নূরীর, স্পষ্ট শুনতে পায় তার প্রতীক্ষিত জনের কণ্ঠস্বর দড়বড় শয্যা ত্যাগ করে ছুটে যায় মুক্ত জানালার পাশে।

জানালা দিয়ে সন্তর্পণে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে বনহুর, ডাকে সে-নূরী!

নূরী আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বনহুরের বুকে –হুর, তুমি এসেছো?

বনহুর গভীর আবেগে নূরীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে–কেমন আছো নূরী?

ভাল আছি কিন্তু তোমাকে না পেয়ে আমি জীবন্ত হয়ে আছি হুর। কেন তুমি এতোদিন এলে না?

অনেক কাজ ছিলো নূরী।

নূরী বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে বলে–হুর!

বনহুর নূরীর চিবুকটা তুলে ধরে মুখের কাছে, তারপর আরও ঝুঁকে পড়ে বনহুরের মুখখানা নূরীর ওষ্ঠদ্বয়ের উপরে।

চোখ দুটো মুদে আসে নূরীর গভীর আবেশে।

বনহুর নূরীর ললাট থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ডাকে–নূরী!

বলো?

কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো তোমার এখানে?

না, বেশ আছি। মনিরা আপা, আম্মা আর নূরকে নিয়ে বেশ আছি। যাও হুর, মনিরা আপা তোমার জন্য ব্যাকুল হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করছে। যাও, যাও তুমি–

যাবো, কিন্তু–

না না, কোনো কিন্তু নয়, তুমি যাও। আমার চেয়ে সে তোমার জন্য বেশি উদগ্রীব রয়েছে।

নূরী!

হাঁ, যাও হুর।

নূরী অদ্ভুত মেয়ে তুমি।

নিজকে বনহুরের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে নেয় নূরী। বনহুরের জামার বোতামগুলো ঠিকভাবে লাগিয়ে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে চুলগুলো গুছিয়ে দেয়–যাও এবার।

বনহুর যে পথে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেছিলো ঐ পথে বেরিয়ে যায়। সমস্ত চৌধুরী বাড়িটা যেন নিঝুম পুরীর মত ঝিমিয়ে পড়েছে। মনিরার কক্ষের পিছনে এসে দাঁড়ায় বনহুর, তারপর পাইপ বেয়ে উঠে যায় উপরে।

মনিরা এখনও ঘুমাতে পারেনি–সে ভাবছিলো কত কথা। জীবনের কত স্মৃতি ভেসে উঠছিলো তার মনে। পাশেই ঘুমিয়ে রয়েছে নূর।

বনহুর দরজায় মৃদু টোকা দেয় পর পর তিনবার।

মনিরা জানে এ সংকেত তার স্বামীর। মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার চোখ দুটো।

দরজা খুলে দিয়েই অস্কুটধ্বনি করে উঠে মনিরা–উঃ কি মানুষ তুমি।

কেন? ভিতরে প্রবেশ করে বলে বনহুর।

সেই যে চলে গেলে তারপর আর সাক্ষাৎ নেই। নূর তোমার জন্য পাগল।

আর তুমি? বনহুর মনিরাকে টেনে নেয় কাছে।

স্বামীর বুকে মাথা রেখে বলে–না কেঁদে তোমাকে কোনো দিন পেয়েছি বলো? চোখের পানিতেই যে তুমি খুশি।

মনিরা!

জানো নূর সব সময় তোমার কথা বলে।

মাফ করো মনিরা, আমি নূরের কাছ থেকে সরে থাকতে চাই। আর সেই কারণেই সেইদিন আমি আসতে চাইনি তোমার সঙ্গে।

কি নিষ্ঠুর পিতা তুমি! নিজ সন্তানের কাছে আত্মগোপন করে থাকতে চাও।

মনিরা লক্ষীটি জানোনা কেন আমি আত্মগোপন করে নিজ সন্তানের কাছে লুকিয়ে থাকতে চাই? কেন আমি নূরের কাছে পরিচয় দিতে চাই না?

জানি, তাই বলে তুমি–

আমি দস্যু, আমি ডাকু নরহন্তাকারী–আমার সন্তান যেন এ কথা কোনোদিন জানতে না। পারে। মনিরার হাত মুঠায় চেপে ধরে বনহুর–বলো মনিরা নূরের কাছে কোনোদিন তুমি আমার পরিচয় দেবে না, বলো? বলো মনিরা? যেদিন জানবো নূর জানতে পেরেছে তার পিতা দস্যু নর হন্তাকারী সেইদিন চিরকালের জন্য তুমিও আমাকে হারাবে–

স্বামীর মুখে হাতচাপা দেয় মনিরা, ব্যাল কণ্ঠে বলে–না না, শপথ করে বলছি, কোনোদিন আমি তোমার পরিচয় তাকে জানাবো না। তবু আমি হারাতে পারবো না তোমাকে।

মনিরা! বনহুর আবেগ-ভরা চাপা কণ্ঠে ডাকে, তারপর ঘনিষ্ঠভাবে টেনে নেয় বলিষ্ঠ বাহু। দুটির মধ্যে।

মনিরা বলেছিঃ নূর হঠাৎ যদি জেগে উঠে?

বনহুর সুইচটা টিপে ঘর অন্ধকার করে ফেলে, শোনা যায় তার চাপা শান্ত কণ্ঠস্বর–জেগে উঠার পূর্বেই আমি পালিয়ে যাব মনিরা!

মনিরার কণ্ঠস্বর–এখনও তুমি ঠিক আগের মতই দুষ্ট রয়েছে।

ঘুমন্ত নূরের শিয়রে এসে দাঁড়ায় বনহুর, অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ সে সন্তানের মুখের দিকে, তারপর ছোট্ট একটা চুম্বনরেখা এঁকে দেয় ওর লালটে।

মনিরার কক্ষ থেকে বনহুর যখন বেরিয়ে আসে তখন সমস্ত চৌধুরী বাড়ি সুপ্তির কোলে ঢলে। পড়েছে।

অল্পক্ষণ পর শোনা যায় অশ্বপদ শব্দ।

তাজের পদশব্দ বুঝতে পায় নূরী, মনিরাও বুঝতে পারে এ তার স্বামীর অশ্বের খুঁরের আওয়াজ। মনিরা পুত্রকে বুকে আঁকড়ে ধরে–বাপ নূর, আমার নূর–

হঠাৎ মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় নূরের, চোখ রগড়ে তাকায়।

মনিরার, গন্ড বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু! কতদিন পর পুত্রের পাশে। এসেছিলো পিতা, কিন্তু কি নির্মম অভিশাপ। চিরদিনের জন্য তার কণ্ঠ রোধ হয়ে গেছে, আর কোনোদিন সে তাকে বলতে পারবে না তার পিতা কে। নূর আজ পিতার সন্তান হয়েও পিতাহারা।

মা, তুমি কাঁদছো? কচি হাত দু’খানা দিয়ে মায়ের মুখখানা উঁচু করে ধরে বলে নূর।

মনিরা সন্তানকে আরও নিবিড়ভাবে বুকে টেনে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বলে–একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম বাপ, তাই–

আম্মি–কি দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে? বাপির তো কোনো অমঙ্গল হয়নি?

না বাবা, তোমার বাপি ভালই আছে।

কবে আসবে আমার বাপি বলো না আম্মি?

মনিরা পুত্রের কথার কোনো জবাব দিতে পারে না। তার অশ্রু কিছুতেই বাধা মানছিলো না, বিন্দু বিন্দু গড়িয়ে পড়ছিলো নূরের চোখে মুখে।

নূর তার ছোট্ট হাত দুখানা দিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো আবার–আম্মি, বাপির কথা বললেই তুমি কাদো! কেন কাঁদো আম্মি?

না না, কিছু না বাপ। তুমি ঘুমাও–মনিরা নূরকে শুইয়ে দিয়ে চুলে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

এখানে মনিরা যখন সন্তানকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত তখন বনহুরের অশ্ব ছুটে চলেছে কান্দাই জঙ্গলের দিকে। নিস্তব্ধ প্রান্তরে তাজের খুঁরের প্রতিধ্বনি এক অদ্ভুত শব্দের সৃষ্টি করে চলেছে।

প্রশস্ত পথ।

দুই ধারে সারিবদ্ধ পাইন আর শালগাছ। আর ছড়িয়ে আছে তামাক ও চা বাগান। কোনো জনমানবের সাড়াশব্দ নেই, কাকড় বিছানো পথে অশ্বের খুঁরের আঘাতে রক্তাভ ধূলি কণাগুলো যেন মেঘে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

ভোর হবার পূর্বেই বনহুর আস্তানায় পৌঁছে গেলো।

রহমান, কায়েস ও বনহুরের অন্যান্য অনুচরগণ চঞ্চলভাবে তখন অপেক্ষা করছিলো তাদের সর্দারের জন্য। সকলের চোখেমুখেই উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে।

বনহুর অশ্ব থেকে অবতরণ করতেই দু’জন বলিষ্ঠ অনুচর অশ্ব বগলা চেপে ধরলো, তারপর নিয়ে গেলো অশ্বশালার দিকে।

বনহুর অনুচরগণের মুখোভাব লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই কোনো কিছু ঘটেছে। সকলের মুখেই কেমন যেন একটা উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বনহুর এগুতেই রহমান ব্যাগ্রভাবে সরে এলো–সর্দার একটা সংবাদ আছে।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–বুঝতে পেরেছি। তোমরা দরবারকক্ষে যাও আমি এক্ষুণি প্রস্তুত হয়ে আসছি।

রহমান অনুচরগণকে নিয়ে চলে গেলো দরবারকক্ষের দিকে।

বনহুর চললো তার বিশ্রামকক্ষে।

কক্ষে প্রবেশ করে মাথার পাগড়িটা ছুঁড়ে দিলো শয্যার উপরে। রিভলভারসহ বেল্টটা খুলে। রাখলো টেবিলে। তারপর প্রবেশ করলো স্নানকক্ষে।

পূর্ব আকাশে তখন ভোরের সূর্য উঁকি ঝুঁকি মারছে। কান্দাই জঙ্গলের শাখায় শাখায় জেগে উঠেছে পাখির কলরব। মহুয়া ফুলের সুরভী নিয়ে মাতাল হাওয়া ছুটোছুটি করছে বনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।

বনহুরের স্নানাগার ছিলো অদ্ভুত ধরনের। চারিপাশে সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা প্রশস্ত জায়গায়। উপরে কোন ছাদ বা চালা ছিলো না। ভিতরটা ছিলো উঁচুনীচু ঠিক পাহাড়ের চূড়ার মত অসমতল, মাঝখানে বয়ে চলেছে ঝরণাধারা ঠিক পাহাড়িয়া ঝরণার মত। কাক চক্ষুর ন্যায় সচ্ছ জল, বনহুর এই ঝরণায় ইচ্ছামত স্নান করতো। পাথর কেটে এই ঝরণা ধারা সৃষ্টি করা হয়েছে।

বনহুর স্নানাগার থেকে যখন বেরিয়ে এলো তখন তাকে ধীর-স্থির বলেই মনে হচ্ছিলো। তারপর যখন দরবারকক্ষে এসে আসনে বসলো তখন তার মুখমন্ডল কঠিন, চোখ দুটো যেন অগ্নিশিখার মত জ্বলছে।

বনহুর আসন গ্রহণ করতেই রহমান বললো–সর্দার, একটা সংবাদ আছে।

জানি তোমরা কি বলতে চাও? মঙ্গল ডাকু তার অনুচরদের হত্যার খবর জানতে পেরেছে।

হা সর্দার—

এই সংবাদে সে ভীষণভাবে ক্ষেপে গেছে!

হা, আমাদের আস্তানার সন্ধানে তার সমস্ত অনুচরকে উত্তেজিত করে তুলেছে–

বনহুর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে যেন–হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ–সে হাসির শব্দে দরবারকক্ষ যেন থর থর করে কেঁপে উঠে। অনুচরগণের হৃৎপিন্ড যেন শিউরে উঠে অজ্ঞাত এক আশঙ্কায়।

বনহুর হাসি থামিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে–আমার আস্তানার সন্ধান লাভের পূর্বেই মঙ্গল ডাকুর আস্তানা আমি নিশ্চিহ্ন করে ফেলবো! রহমান, অনুচরগণকে অস্ত্রশস্ত্রে প্রস্তুত হয়ে নিতে আদেশ দাও। আজ রাতেই আমি ঝাঁম জঙ্গল আক্রমণ করবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress