নিশুতি রাতের ডাক : 01
টালিগঞ্জ এলাকার মায়াপুরী সিনে স্টুডিওর বিশাল চৌহদ্দির ভিতর একটা লম্বা গড়নের বাড়ি। বাড়িটা আপাতদৃষ্টে দোতলা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেড়তলা বলাই ভাল। নিচের তলাটা ঘুপসি মতো এবং গুদামঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। ওপর তলায় খোলা টানা বারান্দা এবং সারবন্দী ঘর। এই সব ঘর সিনেমা প্রযোজকরা ভাড়া নেন। এমনি একটি ঘর সম্প্রতি ভাড়া নিয়েছেন প্রতিভা পিকচার্স। তাঁদের নতুন ছবিটির নাম ‘পাতালে কয়েক দিন’। ছবির স্ক্রিপ্ট মোটামুটি খাড়া করা হয়েছে। প্রথা অনুসারে মহরতও হয়ে গেছে। আর দু একদিনের মধ্যে ছবি। তোলার কাজ শুরু হয়ে যাবে।
পরিচালক অমিয় বকসীর নাম একসময় বাংলা সিনেমায় সুনিশ্চিত বক্স অফিস ছিল। প্রতিটি ছবিই হিট। কিন্তু মধ্যে কয়েকটা বছর কোনো অজ্ঞাত কারণে অমিয় বকসী সিনেমা জগত থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। এক প্রখ্যাত নায়িকার কাছে প্রচণ্ড অপমানিত হয়েই তিনি নাকি সিনেমায় ইস্তফা দিয়েছেন বলে গুজব রটেছিল। কিন্তু গুজব হচ্ছে গুজব। তার কোনো মাথামুণ্ডু থাকে না। আসল ব্যাপার অমিয় বকসী ছাড়া কেউ জানে না।
এতদিন পরে আবার অমিয় বকসী ছবি করতে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রযোজকও পেয়ে গেছেন সঙ্গে সঙ্গে। তার ছবি হিট করার প্রধান কারণ, সমালোচকদের মতে, নতুনত্বের চমক এবং বাস্তবতা। বাস্তব জীবনকে অবিকল নকল করেও তার মধ্যে একটা নতুনত্বের চমক দিয়ে ভিন্ন মাত্রা এনে দিতেন। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ফুটিয়ে তুলতেন নিপুণভাবে। দর্শকের সঙ্গে ছবির পাত্র-পাত্রীদের একাত্মতা সঞ্চারিত হত। কাজেই তার নতুন ছবি ‘পাতালে কয়েক দিন’ নিয়ে ইতিমধ্যে পত্র-পত্রিকায় জল্পনা শুরু হয়ে গেছে। এবারও না জানি কি নতুনত্বের চমক ছবিঘরগুলোতে শিহরন ঘটাবে! ·
সিনে স্টুডিওর ভেতর প্রতিভা পিকচার্সের ওই অফিসঘর প্রতিদিন সকাল দশটার মধ্যে খোলে। এদিন অমিয় বকসী সকাল আটটায় চলে এসেছেন। এত সকালে আসবেন বলে আগের দিন চাবি নিয়ে রেখেছিলেন।
ছবির নায়িকা এখনও ঠিক হয়নি। নতুন মুখ এনে বরাবর যেমন তাক লাগিয়ে দিয়েছেনে অমিয় বকসী, এবারও তেমনি ইচ্ছা। সকালে অফিসে এসে এক দঙ্গল ফোটো নিয়ে বসে আছেন–সবই সম্ভাব্য নায়িকাদের। একদফা প্রত্যেকের স্ক্রিন ও ভয়েস টেস্ট হয়ে গেছে। এখন চূড়ান্ত নির্বাচনের অপেক্ষা শুধু।
আজ এত সকালে স্টুডিও নির্জন আর স্তব্ধ। গাছপালায় পাখ-পাখালি ডাকছে। মাথার ওপর, পুরনো আমলের সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। অমিয় বকসীর সাদা কালো উস্কোখুস্কো চুলগুলো বারবার চোখে এসে পড়ছে। একটার পর একটা ফোটো দেখছেন। একটু আগে স্টুডিও গেটের ধারে ক্যান্টিন থেকে সুরেশ নামে ছেলেটা এক কাপ চা দিয়ে গেছে। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে! তবু চুমুক দিচ্ছেন। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন না বলেই ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। এমন সময়
–আসতে পারি?
অমিয় বকসী মুখ তুলে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটি যুবক। চেনা লাগল, কিন্তু মনে করতে পারলেন না কিছু। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, কেমন। যেন রুক্ষ চেহারা। হাতে স্টিলের বালা। পরনে যেমন তেমন একটা প্যান্ট-শার্ট। স্টুডিওর ভেতরে আজকাল মস্তানদের উপদ্রব হয়। কেউ ছবিতে নামতে চায়, কেউ টাকাকড়ি দাবি করে। তাকে দেখামাত্র অমিয়র মনে দুটো প্রশ্ন এল। এখন অফিস খোলা থাকবে, ও জানল কী করে এবং দারোয়ান ওকে ভেতরে আসতে দিল কেন। অমিয় বিরক্ত ছিলেন। আরও বিরক্ত হয়ে বললেন কী চাই?
যুবকটি ভেতরে ঢুকে বলল–পরিচালক অমিয় বকসী দেখছি খুব ব্যস্ত মানুষ!
অমিয় ভুরু কুঁচকে বললেন কী চাই আপনার?
–আপনাকে।
তার ঔদ্ধত্যে অমিয় অবাক হয়ে গেলেন। তবু শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললেন তার মানে?
যুবকটি টেবিলে হাত রেখে দাঁড়াল। বলল–আপনি নন্দিতা নামে একটা। মেয়ের সর্বনাশ করেছেন!
নন্দিতা! কে সে? অমিয় বকসী রূঢ়স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
–অনেকদিন ধরে তাকে আশা দিয়ে তাকে বাতিল করেছেন। এখন বলছেন কে সে? যুবকটি তার শার্টের বুকপকেট থেকে একটা ছোট ছবি বের করে অমিয়র সামনে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিল।দেখুন তো এবার, কে নন্দিতা!
অমিয় ছবিটার দিকে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন–এমন অসংখ্য মেয়ে সিনেমায় নামতে চায়। যোগ্যতা থাক বা নাই থাক। আপনি কী বলতে চান?
যুবকটি রুক্ষস্বরে বলল বলতে চাই যে আপনার জন্যই নন্দিতা আত্মহত্যা করেছে গতকাল। আপনি তাকে—
অমিয় খাপ্পা হয়ে বললেন–কে কিসের জন্য আত্মহত্যা করেছে, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? আপনি চলে যান এখান থেকে। নইলে আমি পুলিসে ফোন করব।
যুবক বিকৃতমুখে বলল–তা তো করবেনই। একটা বোকা মেয়ের সর্বনাশ করে সাধু সেজে বসে আছেন! কিন্তু জেনে রাখুন, আপনাকে এই পাপের ফল ভুগতেই হবে। আপনি কিছুতেই রেহাই পাবেন না।
বলে সে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। দরজার পর্দাটা নাড়া খেয়ে দুলতে থাকল। অমিয় সেদিকে চোখ রেখে হতবাক বসে রইলেন। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন। বলেই মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা।
কান্টিনের সেই কিশোর ছেলেটি–সুরেশ এল চায়ের কাপ নিতে। তার মুখে মিটিমিটি হাসি। বলল–লোকটা কে স্যার? উরে ব্বাস! আর একটু হলেই আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিত সিঁড়ির নিচে।
অমিয় কোনো কথা বললেন না। সেই ছবিটা পড়ে আছে টেবিলের ওপর। ছবিটার দিকে তাকালেন একবার। ছবিটার কথা ভুলে গেছে হয়তো এখনই আবার ফিরে আসবে। এলে ওকে কৌশলে আটকে রেখে পুলিসে খবর দেবেন। অমিয় অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছিলেন।
সুরেশ অমিয়র মুখের ভাব দেখে দমে গিয়েছিল। মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে তাকাতে চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল সে।
নন্দিতার ছবিটা দেখে স্মরণ করার চেষ্টা করছিলেন অমিয়। চেনা-চেনা লাগছে। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছেন না তার কথা। গত দু মাসে অসংখ্য মেয়ে তার কাছে এসেছে। তার ঠিকানা যোগাড় করে বাড়িতেও গেছে। কাউকে কাউকে পাত্তাও দিয়েছেন। কিন্তু এই মেয়েটি
কিছুক্ষণ পরে প্রযোজক রথীন্দ্র কুশারী এসে হাসিমুখে ঢুকলেন। কি বকসী? সিলেকশান হল?
অমিয় তাকালেন। তারপর মাথাটা সামান্য দুলিয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। রথীন্দ্র বললেন–তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন ব্রাদার? শরীর খারাপ নাকি?
–না। মানে, ভাবছি–আপাতত নায়িকার ব্যাপারটা রেখে অন্যান্য অংশগুলো নিয়ে কাজ শুরু করা যায় নাকি।
–সে তুমি ভাই যা ভাল বোঝ, কর! আমার বলার কিছু নেই। রথীন্দ্র হাসতে লাগলেন। কখনও তো তোমার ব্যাপারে নাক গলাইনি। ঘোড়া তোমার। তুমি তার পিঠে কোনদিক থেকে চাপবে, সেটা তোমাব ভাবনা।
অমির এতক্ষণে স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারলেন। বুঝলে রথীন? এই স্টুডিওর জাস্ট পেছনে উইলফ্রেড কোম্পানির একটা ক্যান্টিন আছে দেখেছ? বিশাল ক্যান্টিন। কাজেই ওদের কিচেনটাও বিশাল এবং একেবারে মডার্ন গ্যাজেটে সাজানো। প্রকাণ্ড ওভেন। রুদ্র দেখে এসে আমাকে বলেছে। সে নাকি এলাহি কারবার। ওদের বেকারিও আছে। সেই সঙ্গে আইসক্রিম তৈরির মেশিন।
রথীন্দ্র মার্লবরো সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন–তাহলে ভালই তো!
–আমেরিকান সিগারেট কোথায় পেলে বাccu?
রথীন্দ্রের ডাকনাম বাচ্চু। বললেন–আমার লোক আছে। দুনিয়ার কোন্ দেশের কোন্ ব্র্যান্ড চাই বল না।
সিগারেট ধরানোর সময় অমিয়ও বললেন–কে লোক? আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিও না? আমার একটা জিনিস চাই। না–সিগারেট নয়। কিছু সাউন্ড রেকর্ড। ধরো প্লেনের সাউন্ড, কিংবা ট্রেনের। জাপানের একটা রেকর্ডিং কোম্পানি দারুণ সব রেকর্ড করে।
রথীন্দ্র বলেন–সে এক মহা ধড়িবাজ স্কাউন্ট্রেল। ডক এরিয়ার ঘাগু।
–কে বল তো?
–ও! তোমারও অবশ্য চেনার কথা। কি সব ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আনিয়েছিলে যেন একসময়?
ক্যামেরা, ফিল্ম এই সব। অমিয় একটু হাসলেন। আচ্ছা, সেই ছোট্ট ওরফে সুরেন্দ্র সিং নয় তো?
রথীন্দ্র খ্যা খ্যা করে হাসলেন। –ওরফে আলিম খান ওরফে গব্বর সিং। বুঝেছি। ব্যাটার নামের শেষ নেই।
–রোগা, ঢ্যাঙা, চিবুকে দাড়ি।
নাকের কাছে কখনও জড়ল থাকে, কখনও থাকে না। বলে যাও!
–হুঁ, সেই বটে। তোমার সঙ্গে দেখা হলে একবার আসতে বলবে তো!
রথীন্দ্র মাথা দুলিয়ে হাত বাড়িয়ে ফোটোগুলো নিলেন। দেখতে দেখতে একটা ছবি তুলে বললেন–আরে! রুবি না?
–চেনো নাকি?
ভীষণ চিনি। এর আগে তো ‘পঙ্ক প্রতিমায় একটা ছোট্ট রোল করেছে। ভাল। সম্ভাবনা আছে।
ছবিটা অমিয় আলাদা করে রেখে সেই ছোট্ট ছবিটা-নন্দিতা নামে একটি মেয়ের রথীন্দ্রকে দিয়ে বললেন–দেখ তো, একে চোনো নাকি?
রথীন্দ্র দেখে এককথায় বললেন–চিনি না।
অমিয় বললেন–ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। সওয়া আটটা নাগাদ মস্তান টাইপ একটি ছেলে এসে আমাকে শাসিয়ে গেল। মেয়েটি নাকি
কথায় বাধা পড়ল। সহকারী পরিচালক সীমন্ত রুদ্র ঢুকে বলল–অমিয়দা, ক্যান্টিন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হয়েছে। কোনো অসুবিধে হবে না। তবে আপনার একবার গিয়ে দেখা দরকার। এখন দশটা বেজে এল শ্ৰায়। ইনফুল অ্যাকশান সব পেয়ে যাবেন।
অমিয় উঠে দাঁড়ালেন।–এস বাচ্চু! যাওয়া যাক।
রথীন্দ্র অনিচ্ছা দেখিয়ে বললেন–আমাকে দেখিয়ে কী লাভ। খামোকা! এই গরমে ওই নরকে–মানে তোমার ছবি পাতালে কয়েক দিনএর পাতালে আমাকে দয়া করে ঢুকিও না ভাই!
সীমন্ত হাসল।তা একটু গরম হবে দাদা! কিচেন তো! বিরাট বিরাট ওভেন।
রথীন্দ্র খিকখিক করে হেসে বললেন–ওহে অমিয়! শুটিং যে করবে ওখানে–তোমার টেকনিশিয়ানরা ঢুকতে চাইবে তো? নরকদর্শন করার মতো বুকের পাটা দ্বাপরে সেই যুধিষ্ঠির ছাড়া আর দেখেছি কলিযুগে তোমার।
অমিয় শুধু হাসলেন। তারপর সীমন্তের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। খোলা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন কয়েকটা স্টিল নিয়ে দেখা যাবে কেমন আসছে ব্যাপারটা।
মায়াপুরী স্টুডিওর এলাকাটি বিশাল। প্রায় চল্লিশ একর জমি। বেশিটাই বাগান, গাছপালা, পুকুর আর পার্ক। পশ্চিম দিকটায় চারটে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড গোডাউনের মতো স্টুডিও ঘর। ওই দিকটায় একটা প্রদর্শনীভবনও আছে। তা ছাড়া ল্যাবরেটরি, রেকর্ডিং রুম ও কিছু সারাক্ষণের কর্মীর কোয়াটার নিয়ে জমজমাট। দক্ষিণে সেই লম্বাটে দেড়তলা বাড়িটা। বাকি পূর্ব ও উত্তর অংশে যে বাগান, পুকুর, পার্ক এবং গাছপালার জঙ্গল, অনেক সময় সেখানেও শুটিং হয়। স্বাভাবিক পরিবেশে আউটডোর শুটিংয়ের ঝামেলা অনেক। মায়াপুরীতে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। এমন কি আস্ত পাড়াগাঁর সেট তৈরি করে সম্প্রতি একটি ছবির শুটিং হয়েছে এদিকটায়।
সীমন্তকে সেদিকে পা বাড়াতে দেখে অমিয় বললেন–ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?
সীমন্ত একটু হেসে বলল–এখান দিয়ে খুব কাছে পড়বে দাদা! এই শর্টকাট আমিই আবিষ্কার করেছি। আসুন!
অমিয় তাকে অনুসরণ করলেন। ডানদিকে খানিকটা দূ.. কিছু লোক ব্যস্তভাবে ফিতে ধরে কি সব মাপজোক করছে। সীমন্ত বলল–তপোবন ছবির সেট হচ্ছে। বুঝলেন দাদা? একেবারে রিয়েল তপোকন করে ছাড়বে। কিন্তু বলুন তো দাদা, সে যুগে কি কৃষ্ণচূড়া ছিল? ওই দেখুন, কুটির তৈরি করেছে। কৃষ্ণচূড়ার গা ঘেঁষে। কোনো মানে হয়?
সংকীর্ণ খোয়াবিছানো রাস্তার দু ধারে পাম গাছ। বাঁদিকে পুকুরপাড়ে গিয়ে সীমন্ত বলল–ওই যে দেখছেন পাঁচিলের ভাঙা জায়গাটা। ওখান দিয়ে বেরুলেই গিয়ে পড়ব ক্যান্টিনের পেছন দিকে। একটু জঙ্গল হয়ে আছে। তবে অসুবিধে হবে না।
অমিয় চুপচাপ আসছিলেন। একখানে দাঁড়িয়ে বললেন, রুদ্র, ওখানে দেখছি প্রচুর ক্যাকটাস। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এল। …থাক। পরে আলোচনা করব। এখন চল, যেখানে যাচ্ছি সেখানেই যাই।
ভাঙা পাঁচিলের ওপর দিয়ে যেতে অসুবিধে হল না। ছবির জন্য অমিয় সবরকম কষ্ট বরদাস্ত করতে রাজি। বরাবর তার এই স্বভাব। অন্য পরিচালক হলে সীমন্তকে বকাবকি করতেন এমন বনবাদাড় আর আবর্জনাসঙ্কুল কুপথে নিয়ে আসার জন্য। সীমন্ত কিছুদিনের মধ্যেই অমিয়কে চিনে ফেলেছে।
উইলফ্রেড কোম্পানির ক্যান্টিনবাড়িটা দোতলা। পেছন দিকটায় খানিকটা লম্বাটে ফাঁকা জায়গা। কোনো আমলে লাইমকংক্রিটে মোড়া হয়েছিল। এখন ফেটেফুটে ঘাস গজিয়ে রয়েছে। সমান্তরালে গভীর খোলা নর্দমা। বাড়িটা ঘুরে সামনের দিকে যেতে যেতে সীমন্ত কিচেনের চিমনি দুটো দেখাল। কিচেনের ব্যাকডোরে একটা উর্দিপরা লোক হাঁ করে তাকিয়ে ছিল দুজনের দিকে। সীমন্ত বলল–ম্যানেজারসাব হ্যায়?
সে তেমনি অবাক চোখে তাকিয়ে মাথা দোলাল।
অমিয় বললেন–ওকে বল না রুদ্র, ম্যানেজারকে খবর দিতে। আমরা এখান দিয়েই তো কিচেনে ঢুকতে পারি মনে হচ্ছে।
স্টুডিওর দিকে হাত নেড়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট করতেই সে তক্ষুণি অমিয়কে সেলাম দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সীমন্ত হাসতে হাসতে বলল–সিনেমার যাদু, দাদা! দেখেছি, বিস্তর লোক ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে পড়ে মায়াপুরীতে কিছু ঘটতে দেখলেই। ওই ভাঙা জায়গাটার মিস্ট্রি বুঝতে পারছেন তো? অনেক সময় ছাদে উঠেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে এবার যা হতে চলেছে, তা এদের লাইফে একটা রীতিমতো ঘটনা।
অমিয় অন্যমনস্কভাবে বললেন–কেন?
নয়? এতকাল মায়াপুরীর প্রতিবেশী হয়ে থেকেছে। এবার তাদের কিচেনও মায়াপুরীর পার্ট হয়ে যাচ্ছে। সেটা ছবিতে এরা দেখতে পাবে। এ কি সামান্য ব্যাপার এদের কাছে? আমি যে ম্যানেজার ভদ্রলোকের কাছে গেছি, এতক্ষণ সে-খবর রটতে বাকি আছে বুঝি? দেখুন না কী হয়।
অমিয় চিন্তিতভাবে বললেন–ভিড়ের ঝামেলা হলে তো
কথা কেড়ে সীমন্ত বলল আচ্ছা দাদা, এক কাজ করলে কেমন হয়? ধরুন, রাতের দিকে যদি শুটিং করা হয়! তাহলে কিন্তু ভিড়টা কম হবে। রাতের শিফটে লোকজন ওদের কারখানায় তত বেশি থাকবে না নিশ্চয়।
–কিন্তু রাতে কিচেনে রান্না-টান্না তো হবে না। ওভেন চালু থাকবে না! আমি চাইছি ইন ফুল অ্যাকশান কিচেন চালু রয়েছে এবং হিরো ওভেনের সামনে কাজে ব্যস্ত। মুখে আগুনের লাল ছটা। ঘাম, যন্ত্রণা, এবং…
সীমন্ত একটু ভেবে বলল–ম্যানেজার আসুক। কথা বলে দেখছি, যদি রাতে কিচেন চালু রাখা যায়।
অমিয়ও ভাবছিলেন। বললেন–ধর, আমরা যদি কোম্পানির নাইট শিফটের লোক এবং আমাদের টেকনিশিয়ান–সবাইকে ডিনার খাইয়ে দিই! মানে, এই ক্যান্টিন থেকেই। খরচ আমাদের।
কিচেনের ব্যাকডোরে একজন-দুজন করে উর্দিপরা একদঙ্গল লোক বেরিয়ে এল। তারপর এলেন কান্টিনের সেই ম্যানেজার। ভদ্রলোক বাঙালি। নাম সত্যসাধন :: চক্রবর্তী। ব্যস্ত হয়ে বললেন–আসুন, আসুন। এই নোংরা জায়গায় দাঁড়িয়ে কেন? তারপর হাসতে হাসতে বললেন–জানেন তো স্যার, বিলিতি প্রবাদ আছে খাওয়ার টেবিলে আর রান্নাঘরের মধ্যে পার্থক্যটা হল স্বর্গ আর নরকের।
অমিয় বললেন–শুধু একটুখানি ওই নরকদর্শনই করে যাব মিঃ চক্রবর্তী। পরে সীমন্ত এসে আপনার সঙ্গে কথা বলে যাবে।
–আচ্ছা, আচ্ছা, আসুন!
ভেতরে ঢুকে অমিয় থমকে দাঁড়ালেন। উইলফ্রেড কোম্পানির মালিকরা এখন দেশী লোক। কিন্তু আগের ব্রিটিশ আমলের সবকিছু নিখুঁত বজায় রাখা হয়েছে তো বটেই, উপরন্তু মডার্ন বিদেশী গ্যাজেটে আরও ভোল ফেরানো হয়েছে। গ্যাস এবং কয়লার ওভেন, প্রকাণ্ড চিমনি, বিশাল সব অ্যালুমিনিয়মের চৌকো পাত্র থেকে ভাপ বেরুচ্ছে। যথেষ্ট গরম কিচেনের ভেতরটা। গলগল করে ঘামছিলেন অমিয়। ওভেনের ঢাকনা খুলছে আর লাল আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। সীমন্ত ঝটপট করে কিছু ছবি তুলে ফেলল অমিয়র ইশারায়।
ম্যানেজার মিঃ চক্রবর্তী দোতলায় কান্টিন হল এবং তার অফিসে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু তাড়া আছে বলে অমিয় কিচেনের ব্যাকডোর দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
বাইরের আবহাওয়ায় পৌঁছে বড় করে শ্বাস ফেললেন। সত্যি যেন নরকে ঢুকেছিলেন কিছুক্ষণ। এ মুহূর্তে ইচ্ছে করছিল ছবির নাম পাতালে কয়েক দিন এর বদলে নরকে কয়েক দিন করে দেবেন নাকি। কিন্তু এদেশের দর্শকের কাছে নরক-টরক চালানো কঠিন। তবে এবারকার এই নতুনত্ব দর্শকদের দারুণ চমকে দেবে।
একটু পরে সেই ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে স্টুডিও এলাকায় পৌঁছে অমিয় একটা গাছতলায় দাঁড়ালেন। সিগারেট ধরিয়ে একটু হাসলেন। বুঝলে রুদ্র? যখন অধ্যাপনা করতুম, আমার সাবজেক্ট ছিল ইংরেজি সাহিত্য। দান্তের ইনকার্নো পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিত। কি অসাধারণ বর্ণনা নরকের। যেন চোখের সামনে দেখতে পেতুম ভয়ঙ্কর আগুনের শিখা! অবশ্য আমাদের হিন্দুদের নরক তো আরও ভয়ঙ্কর। আসলে যা বলতে চাইছি, তা হল মানুষ ইহজীবনে পাপ করলে মৃত্যুর পর নাকি নরকের আগুনে জ্বলতে হয় অনন্তকাল। আমার ছবিটা ভেবেছি একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। পাপের জন্য নরকই বরাদ্দ। কিন্তু কেউ কেউ বেঁচে থেকেই নিয়তির কাছে সেই শাস্তি পায়। যন্ত্রণায় তার। অস্তিত্ব টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে।
সীমন্ত অবাক হয়ে তাকাল। ছবির বিষয়কে এমন নিজের করে নিয়ে ভাবতে পারেন বলেই হয়ত অমিয় বকসী একসময় জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির শীর্ষে উঠতে পেরেছিলেন। তা ছাড়া বিষয়টিও অকল্পনীয়ভাবে নতুন।
অমিয়র মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। বড় করে শ্বাস ছেড়ে বললেন–হ্যাঁ। ঠিক আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা। আমার ছবির গল্পে কিচেনের ওভেন থাকবে তারই প্রতীক হয়ে–মানে, নরকের। যাই হোক, রুদ্র, তুমি দেখ আজ বিকেলের মধ্যে ছবিগুলোর প্রিন্ট দিতে পার নাকি। ইতিমধ্যে শুটিংয়ের ব্যাপারে আমি বাচ্চুর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। তারপর তুমি মিঃ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে আসবে। একটা ছুটির দিনে সন্ধ্যার পর হলেই ভাল হয়। ওদের লোকজন কম থাকতে পারে সেদিন। ভিড় এড়ানো যাবে।
অমিয় থাকেন বরানগর এলাকায় গঙ্গার ধারে একটা নতুন ছতলা ফ্ল্যাট বাড়ির চারতলায়। পশ্চিমের ব্যালকনিতে বসলে গঙ্গা দেখা যায়। স্টুডিও থেকে দুপুরে ফিরে এসে স্নান খাওয়ার পর ছবির স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসেছিলেন। সূর্যাস্তের সময় ব্যালকনিতে গেলেন। আজ সারাটা দিন কেমন একটা অন্যমনস্কতা তাঁকে পেয়ে বসেছে। মন স্থির করে বসাতে পারছিলেন না কোথাও। বারবার সকালের সেই যুবকটি এবং নন্দিতা নামে মেয়েটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ছবির চেহারাটা মনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। মাত্র আঠার-উনিশ বছরের ছিপছিপে গড়নের মেয়ে। মাথায় একরাশ চুল। মুখখানি মিষ্টি। একটা সরলতার ভাবও আছে। নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়। তার সঙ্গে তার কখনও চেনাজানা হয়েছিল কি? মাঝে মাঝে চেনা মনে হচ্ছে। আবার ঘুলিয়ে যাচ্ছে। মনেরই ভুল সম্ভবত। ব্যালকনিতে বসে থাকতে থাকতে গঙ্গার ওপারে সূর্য ডুবে গেলে বুক পকেট থেকে ছবিটা আবার বের করলেন। হঠাৎ আবার মনে হল মেয়েটি খুবই চেনা।
সেই সময় সীমন্ত এল প্রিন্টগুলো নিয়ে। এনেই বলল-দারুণ এসেছে দাদা! কল্পনাতীত!
অমিয় প্রিন্টগুলো দেখতে ব্যস্ত হলেন। অন্যমনস্কতার দরুন নন্দিতার ছবিটা পড়ে গিয়েছিল হাত থেকে। একটু হলেই উড়ে গিয়ে নিচে পড়ত। সীমন্ত। ঝটপট কুড়িয়ে নিয়ে বলল–কে দাদা? নায়িকা নাকি?
অমিয় গম্ভীরমুখে বললেননা।
সীমন্তের ক্যামেরার বাতিক আছে। ফোটো তোলা ওর হবি। বলল–তাহলে ছবিটা আমি রাখছি, দাদা। কাজে লাগাব। ফেসখানা দারুণ! বড়ো করে আনলে দেখবেন কি কাণ্ড করে ফেলেছি।
অমিয় আস্তে বললেন–নাও। কিন্তু মেয়েটি নাকি সুইসাইড করেছে!
–সে, কি! তাহলে তো এটার দাম আরও বেড়ে গেল দাদা!
অমিয়র সকালের ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করছিল না। মনটা তেতো হয়ে যায় মস্তান ছেলেটার কথা ভাবলে। বললেন–ঠিক আছে। বাচ্চুর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। কাল দুপুর পর্যন্ত আমি একটু বাইরে থাকছি। স্টুডিওতে যাচ্ছি না। সন্ধ্যার দিকে বরং স্টুডিওতে যাব। তোমার অতক্ষণ থাকার দরকার নেই। নিরিবিলি স্ক্রিপ্ট নিয়ে আবার বসব। কিচেনের সিকোয়েন্সের শট ডিভিসান সেরে ফেলতে চাই। তুমি শুধু একটা কাজ করবে। ক্যামেরাম্যান শ্যামসুন্দরকে বলে রেখো, সে যেন ছটা পর্যন্ত অফিসে আমার জন্য অপেক্ষা করে। সে না থাকলে শট ডিভিসান করার অসুবিধে আছে।
অমিয় এখন বিপত্নীক। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই ফ্ল্যাটে তার এক দূরসম্পর্কের দিদি থাকেন। তিনি বৃদ্ধা এবং অসুস্থ মানুষ। কাজের লোক বলতে বৃন্দাবন নামে একটি কিশোর আর সোনা নামে মধ্যবয়সী একটি মেয়ে। সোনা সন্ধ্যার পর চলে যায়। সকালে আসে। বৃন্দাবন সারাক্ষণ থাকে। তার বাড়ি মেদিনীপুরের গ্রামে।
সীমন্ত চলে যাবার একটু পরে পারমিতা এলেন। পারমিতা সান্যাল একটি মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা। থাকেন কাছাকাছি সরকারি হাউসিং এস্টেটের ফ্ল্যাটে। অমিয়র সঙ্গে তার পরিচয় পুরনো। বয়স চল্লিশের এদিকে। বত্রিশে বিয়ে করেছিলেন ভালবেসেই। বছর পাঁচেক পরে ডিভোর্স করেছেন ভদ্রলোককে। দেখতে সুন্দরী হলেও শরীরটা একটু মুটিয়ে গেছে। অমিয় ওঁকে ছবিতে নামাতে প্রস্তুত। কিন্তু পারমিতা বলেন, নায়িকা সাজাতে তো পারবে না! কাজেই আর ও লোভ দেখিও না।
অমিয় ব্যালকনিতে চুপচাপ বসেছিলেন। পারমিতা পাশের আসনে বসে বললেন–তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?
অমিয় একটু হেসে বললেন–আচ্ছা মিতা, একটা কথা মাথায় খালি ঘুরছে সারাদিন। ধর, যে পাপ তুমি দৈবাৎ মোহের বশে কিংবা নিজের অজ্ঞাতসারে করে ফেলেছিলে, তার জন্য তোমার শাস্তি হওয়া উচিত কি না।
–হঠাৎ এ সব কথা কেন?
না। মানে একটা ছবির আইডিয়া।
-তাই বল। পারমিতা একটু ভেবে বললেন–এটুকু বলতে পারি যে শাস্তি হওয়াটা মোটেও উচিত নয়।
অমিয় একটু খুশি হয়ে সিগারেট ধরালেন। কিছুক্ষণ হালকা চালে কথাবার্তা বলার পর নতুন ছবিটার কথা উঠল। নায়িকা নির্বাচন হয়নি শুনে পারমিতা ফুট কাটলেন–তুমি কোনোদিনই কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পার না অমু! ওটাই তোমার কেরিয়ারের সেটব্যাক। এ ম্যান অফ ইনডিসিসান!
আমিয় হাসলেন।–ইউ আর রাইট। যেমন তোমার সম্পর্কেও।
পারমিতা ওর কাঁধে মৃদু থাপ্পড় মেরে বললেন–হুঁ! আমি যেন বসে আছি তোমার পথ চেয়ে। ওই কি যেন গানটা–ফাগুনের গান গেয়ে! তারপর প্রথম যুবতীদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন।
অমিয় আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। খ্যাতিমান সিনেমা পরিচালকের পক্ষে যা যা অর্জন করা সম্ভব, একসময় সবই পেয়েছেন। ভোগ করেছেন। ধর্মাধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাননি। উজ্জ্বলতা বলা ভুল, তবে একথা ঠিক যে তাঁর। তথাকথিত চরিত্রগুণ বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না–মেয়েদের ব্যাপারে। এখন যৌবন স্তিমিত হয়ে এসেছে। মন খুঁজছে ভিন্ন কোনো আশ্রয়। স্বার্থের ঊর্ধ্বে কোনো সম্পর্ক–যা তাঁকে জীবনের পরম মূল্যে অভিষিক্ত করতে পারবে।
অবশ্য এ ব্যাপারটা তাঁর নিজের কাছেও অস্পষ্ট। শুধু পারমিতাকে দেখলে এতদিন পরে তার মনে এই ধোঁয়াটে আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। জীবনে অন্তত এই একজন নারীর কাছে অমিয় নিজের শরীর নিয়ে পৌঁছুতে চাননি–যেন সাহসে কুলোয়নি। আর পারমিতাও যেন খুব কাছে এসেও দূরের হয়ে থেকেছে। এখন জীবনের প্রায় আসন্ন অপরাহ্নে শরীরটাও বড় ক্লান্ত আর মূল্যহীন লাগে।
কী ভাবছ?
অমিয় বললেন কালকের প্রোগ্রামের কথা।
-তাহলে আমি উঠি। বলে ঈষৎ অভিমান দেখিয়ে পারমিতা উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু অমিয় তাকে বাধা দিলেন না। শুধু বললেন–হ্যাঁ। রাত হয়ে যাচ্ছে। দেখ-সাবধানে যেও।
–আমি তো সুন্দরী নায়িকা নই যে পেছনে মস্তান লাগবে! বলে পারমিতা চলে গেলেন।
আমিয় একটু পরে বুঝলেন, পারমিতা রাগ করে চলে গেল। কিন্তু এজন্য নিজের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটল না দেখে নিজেই অবাক হলেন। খুব ভেতরে যেন একটা ভারসাম্যের অভাব ঘটেছে। অথচ স্পষ্ট করে বুঝতে পারছেন না কেন এই অস্থিরতা …
পরদিন সন্ধ্যায় যখন মায়াপুরী স্টুডিওতে প্রতিভা পিকচার্সের অফিসে বসে ক্যামেরাম্যান শ্যামসুন্দর গুপ্তের সঙ্গে আলোচনা করে কিচেন-সিকোয়েন্সের শট ডিভিসান করছেন, তখনও অমিয়র মনে সেই অস্থিরতার তরঙ্গ। রাত সাড়ে আটটা বাজলে শ্যামসুন্দর চলে গেলেন গাড়ি করে। স্টুডিও চত্বর জনহীন। খাপচা-খাপচা আলো পড়েছে এদিকে-ওদিকে। অমিয় গেটের দিকে এগিয়ে। ড্রাইভার কমলকে বললেন–তুমি আর একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি।
কমল গেটের কাছ থেকে দেখল, ডিরেক্টরসাব বাগানের দিকে যাচ্ছেন। সে একটু অবাক হল। ওদিকটায় আলো নেই। অমন করে জঙ্গলের দিকে কোথায় যাচ্ছেন উনি?
উইলফ্রেড কোম্পানির কারখানার সকালের শিফট আরম্ভ হয় সকাল নটা থেকে। লাঞ্চ পিরিয়ডের বিরতি বেলা বারোটায়। ক্যান্টিন অবশ্য আটটার মধ্যে খুলে যায়। কিচেনে কাজ শুরু হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।
নটায় সেকেন্ড বাবুর্চি ইমদাদ খাঁ একবার বলেছিল, কৈ বদ বু নিকালতা হ্যায়। কেউ কান করেনি। হেডবাবুর্চি গঙ্গাধর এসেই বলল–ডেডোবডি রাঁধুচি কই রে? নাক-অ না অছি সড়া?
সত্যিই একটা উৎকট গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকটায় প্রচণ্ড ছুঁচোর উপদ্রব। ব্যাকডোরটা জরাজীর্ণ। তলায় ফাটল অনেকটা। ওভেনে ছুঁচো পড়েছে তাহলে! গন্ধটা চামড়া অথবা কাঁচা কাঁচা মাংস পোড়ার। শ্মশানে দাহের সময় এমন গন্ধ নাকে এসে লাগে। কিন্তু অমন নারকীয় আগুনে ছুঁচো পুড়ে ছাই হতে এক মিনিটও লাগার কথা নয়। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলল কুকুরের রোস্ট তৈরি করে ইমদাদ খাঁ ন্যাকামি করছে।
ওভেনে কিছু ঢোকা কঠিন। অতএব চিমনির ভেতর সম্ভবত কুকুর ঢুকে রোস্ট হয়ে গেছে. চিমনি দুটো ওভেন থেকে মেঝের সমানলে বেরিয়ে বাইরে গিয়ে খাড়া হয়েছে দেয়ালের সঙ্গে। বাইরের দিকে চিনির গায়ে তিন বর্গফুট কপাট আছে। খুলে মাঝে মাঝে সাফ করা হয়। কালক্রমে তাপ খেয়ে খেয়ে ভেতর-ভেতর সেই কপাট জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। গঙ্গাধর হুকুম দিল কপাট খুলে দেখতে!
খুব তেতে আছে চিমনিদুটো। হ্যাঁচকা টানে প্রথমটার কপাট খোলা হল। ছাই জমে আছে। কুকুর-বেড়াল ছুঁচো কিছু নেই। তারপর দ্বিতীয়টা খুলেই ফাগুলাল নামে কিচেনবয় আঁতকে উঠে এ বাপ বলে পিছিয়ে এল।
চিমনিটার ভেতর দোমড়ানো একটা মানুষের দেহ, পোশাকপরা। পোশাক থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মাথার চুল পুড়ে গেছে। দেহের জায়গায় জায়গায় দাগড়া-দাগড়া লাল কালো দাগ।
খবর পেয়ে ম্যানেজার সত্যসাধন চক্রবর্তী দৌড়ে এলেন। ততক্ষণে হইচই পড়ে গেছে। ভিড় হয়ে গেছে। মায়াপুরী স্টুডিওর পুকুরপাড়ে শুটিং হচ্ছিল একটা ছবির। ভিড় দেখে সেখান থেকেও অনেকে ভাঙা পাচিল ডিঙিয়ে চলে এল। ম্যানেজার মিঃ চক্রবর্তী বীভৎস মৃতদেহটা দেখেই অফিসে ছুটলেন পুলিসকে ফোন করতে।
মুখটা একটু ওপর দিকে ঘুরে আছে মৃতদেহের। মায়াপুরীর এক টেকনিশিয়ান ভিড়ের ভিতর উঁকি মেরে দেখছিলেন। তিনিই চেঁচিয়ে উঠলেন–সর্বনাশ! এ যে অমিয় বকসী মনে হচ্ছে।
প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে পারল না। আরও দু-তিনজন ভিড় ঠেলে সাহস করে উঁকি দিলেন। অমিয় বকসীর সঙ্গে বহুকাল তারা কাজ করেছেন। তাকে আপাদমস্তক চেনেন।
হ্যাঁ, অমিয় বকসীই। সঙ্গে সঙ্গে হইচই স্তব্ধ হয়ে গেল। একজন ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে দৌড়ে গেলেন প্রতিভা পিকচার্সের অফিসে খবর দিতে। মায়াপুরী স্টুডিওর সত্তর বছরের জীবনে এমন অদ্ভুত ঘটনা কখনও ঘটেনি।