রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – শ্রীরামের সভায় মুনিগণের আগমন ও শ্রীরাম-সম্ভাষণ
আজি কালিকার যেন বৈকুণ্ঠ-নগরী।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম দিব্য শার্ঙ্গধারী।।
নীলোৎপল সমান শ্যামলকলেবর।
পীতাম্বর সতড়িত যেন জলধর।।
বনমালা গলে দোলে আর হেমহার।
কপোলে লম্বিত মণি শোভা কত তার।।
মকর কুণ্ডল ভাল শ্রবণেতে দোলে।
তাহার উজ্জ্বল আভা লেগেছে কপোলে।।
আজানুলম্বিত বাহু নাভি সুগভীর।
চন্দনে চর্চ্চিত অতি সুঠাম শরীর।।
শ্রীবৎস শোভিত বক্ষঃ অতি মনোহর।
গগন উপরে যেন শোভে শশধর।।
চরণে নূপুর বাজে রুণু রুণু শুনি।
নীলপদ্ম কোলে যেন হংস করে ধ্বনি।।
অঙ্গদ সহিত রাম মন্ত্রী জাম্ববান।
ভরত শত্রুঘ্ন আর যত মুনিগণ।।
নারদাদি গান করে সনক প্রভৃতি।
বিভীষণ হনুমান সুগ্রীব সংহতি।।
কি কব রামের গুণ কহিতে অপার।
রাক্ষস বনের পশু গুণে বদ্ধ যাঁর।।
ত্রিভুবনে নাহি দেখি গুণের উপমা।
চতুর্ম্মুখ চতুর্ম্মুখে দিতে নারে সীমা।।
হেন রামে দেখি মুনি আনন্দিত চিত।
স্বয়ং নারায়ণ রাম সংসারে পূজিত।।
লক্ষ্মী সরস্বতী সদা করে আরাধন।
অযোধ্যায় অবতীর্ণ বৈকুণ্ঠের ধন।।
চারিভিতে স্তুতি করে বহু পারিষদ।
সনক সনাতন ও বাল্মীকি নারদ।।
ব্রহ্মা আদি করিয়া যতেক দেবগণ।
কুবের বরুণ ঊনপঞ্চাশ পবন।।
গরুড় উপরে যেন বসি নারায়ণ।
বিষ্ণুরূপে রামেরে দেখিল মুনিগণ।।
মুনি সকলের ছিল যতেক বাসনা।
সেইরূপে রামেরে দেখিল সর্ব্বজনা।।
বৈকুণ্ঠ-সম্পদ রাম দশরথ ঘরে।
জন্মিলেন রাবণ-বধার্থ এ সংসারে।।
সেই রূপ সকলে দেখিল চক্রপাণি।
বিশ্বরূপ দেখি ত্রাস পায় সব মুনি।।
আপনার মূর্ত্তি রাম না জানে আপনি।
বিষ্ণু-অবতার রাম জানে সব মুনি।।
মুনিগণে আগত দেখিয়া নিজ ধাম।
গাত্রোত্থান করিলেন তখনি শ্রীরাম।।
কৃতাঞ্জলি হইয়া দিলেন অর্ঘ্য জল।
জিজ্ঞাসেন মুনিগণে সবার কুশল।।
মুনিরা বলেন রাম সমস্ত কুশল।
আপনার কুশল সম্প্রতি আগে বল।।
তুমি আর লক্ষ্মণ জানকী ঠাকুরাণী।
কুশলে আইলে দেশে বড় ভাগ্য মানি।।
রাক্ষস দুর্জ্জয় বড় বিধাতার বরে।
রাক্ষস মায়ায় রাম কোন্ জন তরে।।
ইন্দ্রজিৎ সে দুর্জ্জয় ত্রিভুবনে জানি।
লক্ষ্মণ মারেন তারে অপূর্ব্ব কাহিনী।।
মারিলে ত্রিশিরা খর দূষণ কবন্ধ।
মারীচেরে বিনাশিলে মায়ার প্রবন্ধ।।
দেবান্তক নরান্তক অতিকায় বীর।
মারিলে নিকুম্ভ কুম্ভ দুর্জ্জয় শরীর।।
কুম্ভকর্ণে বিনাশিলে বড়েই বিষম।
পলায় যাহার নামে আপনি শমন।।
রাবণের সহ রণ কে করিতে পারে।
করিলে দেবের ত্রাণ মারিয়া তাহারে।।
মারিলে এ সব বীর তাহা নাহি গণি।
ইন্দ্রজিতে যে মারিল তাহারে বাখানি।।
ইন্দ্রজিৎ মায়াধারী যুঝে অন্তরীক্ষে।
না দেখেন দেবরাজ সহস্রেক চক্ষে।।
ইন্দ্রে বান্ধি লয়েছিল লঙ্কার ভিতরে।
আনিলেন মাগিয়া বিরিঞ্চি পুরন্দরে।।
সেই ইন্দ্রজিতে ধ্বংস করি এলে ঘর।
শুনিয়া এসব কথা বিস্ময় অন্তর।।
মারিলে যে সব বীর যুদ্ধে যমদূত।
মারিল লক্ষ্মণ ইন্দ্রজিতে সে অদ্ভুত।।
শ্রীরাম বলেন রাক্ষসের কি বিক্রম।
এক এক রাক্ষস সাক্ষাৎ যেন যম।।
রাবণের সেনাপতি কেবা কারে চিনে।
রণে প্রবেশিলে তারা যম ইন্দ্র জিনে।।
রাবণের ভায়ের ডরে কেহ নহে স্থির।
ত্রিভুবন জিনি কুম্ভকর্ণের শরীর।।
কাটিলে না মরে সে, না ধরে কেহ টান।
কুম্ভকর্ণ এড়ি ইন্দ্রজিতের বাখান।।
দশ মুণ্ড কেটে রাবণ পেয়েছিল বর।
তারে ছাড়ি বাখান কি তাহার কোঙর।।
অগস্ত্য নামেতে মুনি দক্ষিণেতে বাস।
রাক্ষসের বৃত্তান্ত জানেন ইতিহাস।।
রাক্ষসের বৃত্তান্ত কহেন মহামুনি।
শ্রীরাম কহেন মুনি কহ তাহা শুনি।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের মধুর পাঁচালী।
গাহিল উত্তরকাণ্ডে প্রথম শিকলি।।