Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রথযাত্রা || Kajal Mukherjee

রথযাত্রা || Kajal Mukherjee

রথের মেলায় রথের উপর শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব, বলরাম আর সুভদ্রাকে দেখে নিতাই দুহাত কপালে ঠেকিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করলো।

তারপর ভাবল রথের উপর এই দেবতারা যদি থাকেন তবে তার আরাধ্য দেবতা, তার মাও রথের উপর থাকতেই পারেন?

নিতাই তখন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, একদিন না একদিন তার মাকে রথের উপর চড়িয়ে ঘোরাবেই।

কিন্তু কি করে?

তারা যে বড্ড গরিব? দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খাবারই জোটে না তাদের। তার মা লোকের বাড়ি বাড়ি ঠিক ঝিয়ের কাজ করে যে টাকা রোজগার করে তাতে কোনোমতে তার আর মায়ের বস্তির এই এক কামরার ঘরে থাকা,খাওয়া চলে।

নিতাইয়ের বাবা কবে যেন অন্য কোথাও চলে গেছে, নিতাই তখন অনেক ছোট ,বাবার কথা মনেও পড়ে না তার। আর তার বাবা খোঁজও রাখে না তাদের। নিতাইরা শুনেছে তার বাবা যেন অন্য কোথাও গিয়ে বিয়ে করে আর একটা সংসার পেতেছে।

নিতাই বেশি দূর পড়াশোনা করেনি বা বলা ভালো করতে পারেনি। নিতাই এখন একটা মোটর বাইকে সারানোর দোকানে কাজ শিখছে ,আর বাইক, স্কুটির চাকায় হাওয়া দেওয়াএইসব কাজ করে অল্প কিছু রোজগার করে। তার স্বপ্ন , টু হুইলার সারানোর কাজ ভালো করে শিখে একদিন সে নিজেই একটা টু হুইলার সারানোর দোকান করবে, তার মাকে আর বাড়ি বাড়ি বাসন মাজা আর ঘর মোছার কাজ করতে দেবে না। কিন্তু স্বপ্ন দেখলেই তো হলো না , সেই স্বপ্নকে সফল করার জন্য দরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, কঠোর পরিশ্রম, যোগাযোগ মূলধন আর সময়।

নিতাই এর কাছে প্রথম দুটো থাকলেও বাকিগুলো একেবারেই ছিল না।

নিতাই বাড়ি এসে তার মাকে রথযাত্রার গল্পটা করার পর, তার ইচ্ছের কথাটা মাকে বলাতে তার মা হেসে কথাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিলেন ।বললেন ,’ধুর বোকা ছেলে, আমরা গরীব মানুষ ,দুবেলা দুটো ভালো করে খেতেই পাই না, রথে চড়েন দেবতারা আর দেবতাদের আশীর্বাদ ধন্য মানুষেরা।
আমাদের মত হতদরিদ্র ,হাভাতে মানুষরা কথা ওসব কথা ভাবতেই পারে না। তুই আমার কাছে যা বলেছিস বলেছিস ,বাইরে আর কারো কাছে এসব কথা বলিস না, তাহলে সবাই তোকে পাগল বলে ক্ষেপে।

এর কিছুদিন পর থেকে নিতাইয়ের মায়ের শরীর অত্যাধিক পরিশ্রম করার ফলে আর ঠিকমত খাবার আর বিশ্রাম না পেয়ে দিন দিন যেন খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে লাগলো, যেসব বাড়িতে নিতাইয়ের মা কাজ করতো,, সেসব বাড়িতে ঠিকঠাক যেতে পারছিল না বলে নিতাইয়ের মার কয়েকটা কাজ চলে গিয়েছিল, হলে তাদের সংসারে অভাব অনটন আরো বেশি চেপে বসেছিল। নিতাইয়ের মায়ের দু এক বাড়ির কাজের টাকা, সরকারি অনুদানের টাকা, আর নিতাইয়ের সামান্য কিছু রোজগারের টাকায় তাদের কোনমতে খাওয়া-দাওয়া চলছিল।

নিতায়ের মা দিন দিন আরো বেশি রোগা হয়ে যাচ্ছিল, কি কারনে যেন ইদানিং খাওয়া-দাওয়াও বিশেষ করতে পারত না। নিতাই ডাক্তার দেখানোর কথা আর হাসপাতালে যাওয়ার কথা বললেই বলতো, না আমি ঠিক আছি আমার কিছু হয়নি ,কোথাও যেতে হবে না।

এর মধ্যে একদিন সকালে নিতাই দেখল তার মা বমি করছে আর বমির সাথে রক্ত বেরোচ্ছে মুখ থেকে। নিতাই আর মা তার মায়ের কোন কথা শুনল না, জোর করে নিয়ে গেল সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে।
ডাক্তারবাবু নিতাইয়ের মাকে পরীক্ষা করে বললেন , টিবি হয়েছে , ফাইনাল স্টেজ,এবং নিতাই কে জিজ্ঞাসা করলেন ,এতদিন সে কেন মাকে নিয়ে আসেনি হাসপাতালে, যখন সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার সব রকম সুযোগ আছে ,আর তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসার কার্ডও আছে ।

ডাক্তারবাবুকে নিতাই বলতে পারল না ,যে তার মা এতদিন কিছুতেই চিকিৎসা করাতে চায়নি, এতদিন হাসপাতালে আসতে চায়নি, এমনকি তার অসুখের কষ্টের কথা মুখ ফুটে নিতাইকে কোনদিন বলেওনি, বা জানতেও দেয়নি।

ডাক্তার বাবু বললেন নিতাই কে, ‘আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি,এখনই টিবি হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে হবে তোমার মাকে।’

ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন মত নিতাই তার মাকে নিয়ে টিবি হাসপাতালে ভর্তি করে দিল ,হাসপাতালে নিতাইয়ের মা নিতাইয়ের হাত ধরে বললেন ,’একা একা কি করবি তুই?তোকে এখন থেকে কে দেখবে বাবা ,কেই বা রান্না করে দেবে তোকে? নিজের যত্ন নিস, আমার জন্য বেশি চিন্তা করিস না, আমার যা হয় হবে।’

নিতাই তার মাকে বলল ,’ওসব কথা একদম বলবে না, দেখে নিও, তুমি ঠিক হয়ে যাবে,আর আমার জন্য বেশি চিন্তা কোরো না।’

হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে নিতাই-এর মনে বারে বারে এটাই মনে হচ্ছিল যে, তার মা ঠিক হয়ে যাবে তো? আর বুঝি তার দ্বারা আর তার মা কে রথে চড়ানোর পরিকল্পনাটা সফল হবে না বোধহয়।

নিতাইয়ের মনের কথাটা এত তাড়াতাড়ি বাস্তব রূপ নেবে আর এইভাবে সেটা নিতাই কখনো কল্পনাই করতে পারেনি।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুদিন পরে এক রাতে ফোন এলো নিতাইএর কাছে,যে তার মায়ের অবস্থা ভালো নয়, সে যেন এখনই হাসপাতালে যায়।

অথচ সেদিন বিকেলেই নিতাই দেখা করে এসেছিল তার মায়ের সাথে হাসপাতালে ,তখনও তার মায়ের অবস্থা অতটা খারাপ ছিল না, নিতাইয়ের সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথা হয়েছিল তার মায়ের, নিতাই কি খেয়েছে ,কি করছে ,এসব জিজ্ঞাসা করেছিল তার মা।

তারপরেই যে কি কি থেকে কি হয়ে গেল, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এতটা খারাপ অবস্থা হয়ে গেল তার মায়ের, ভাবতেই পারছিল না নিতাই।

যাই হোক , ফোন পেয়েই নিতাই সেই রাতেই হাসপতালে চলে গিয়েছিল , তখন তাকে হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল ,রাতে অপেক্ষা করতে হাসপাতালে ।

তার মায়ের অবস্থা কিরকম আছে , আর কিছু দরকার পড়লে তাকে পরে জানানো হবে।

ভোরবেলায় ফোন এসেছিল নিতাই এর কাছে, ফোনের ওপার থেকে নিতাইকে বলা হল ,যে তার মা আর নেই। শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার মায়ের, শরীরের অনেকগুলো অঙ্গ বিকল হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বাবুরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

এই খবরটা পেয়ে নিতাইয়ের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গিয়েছিল, এরপর সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না।

হাসপাতালের বেডে গিয়ে দেখল তার মায়ের বেডটা খালি পড়ে রয়েছে , সেখানে উপস্থিত নার্সের মুখ থেকে শুনল,তার মায়ের মৃতদেহ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখান থেকে তার মায়ের মৃতদেহ কাগজপত্র দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

নিতাই তো একেবারে অথৈ জলে পড়ল ,কিভাবে কি হবে সে কিছুই বুঝতে পারছিল না এদিকে তার কাছে টাকা পয়সাও বিশেষ কিছু ছিল না।

নিতাই এর অবস্থা দেখে হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে উপস্থিত একজন নার্সের পরামর্শ মত অবশেষে নিতাই তাদের পাড়ায় ক্লাবের সেক্রেটারিকে ফোন করল।ক্লাবের সেক্রেটারি সব শুনে বললেন, তিনি তাদেরএলাকার জনপ্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করবেন, যাতে নিতাইয়ের মায়ের মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিনামূল্যে শববাহী গাড়ির ব্যবস্থা করা যায়।

হাসপাতালের মর্গের সামনে ঘন্টা চারেক অপেক্ষা করার পর নিতাই দেখল ,তাদের এলাকার ক্লাবের একজন লোক একটা শববাহী গাড়ি নিয়ে সেখানে এসে নিতাইকে ডাকছেন।

নিতাই এর কাছ থেকে তার মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট আর সব কাগজপত্র চেয়ে নিলেন ক্লাবের ওই ভদ্রলোক। এরপর মর্গের ডোম আর শববাহী গাড়ির ড্রাইভার এর সাহায্যে নিতাইয়ের মায়ের মৃতদেহ ওই শববাহী গাড়িতে তোলা হল।

মর্গ থেকে মৃতদেহ বার করা, ফুলের মালা ,ধূপকাঠি ইত্যাদি সব ব্যবস্থা ক্লাবের ভদ্রলোকই কিভাবে কি করলেন নিতাই এসব কিছুই জানতে পারল না। তার চোখ থেকে তখন কেবলই জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছিল, কিভাবে কি যে হয়ে গেল সব এখন কি করবে সে?

তার একমাত্র আশ্রয়স্থল , তার জীবনের সবকিছু ,তার জীবন্ত দেবতা,তার মা যে তাকে ছেড়ে কোন অজানা জায়গায় চলে গেছে।

নিতাইয়ের মায়ের মৃতদেহ যখন শববাহী গাড়িতে উঠিয়ে শ্মশান যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল, তখন নিতাইকে ডাকা হল ওই গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসার জন্য , গাড়ি এবার শ্মশানের পথে রওনা হবে।

নিতাই ওই শববাহী গাড়িতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল ,ওই সাদা শববাহী গাড়িটার গায়ে বড় বড় করে লেখা আছে ,’স্বর্গরথযাত্রা’ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress