Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সৌন্দর্যবোধ || Sujan Dasgupta

সৌন্দর্যবোধ || Sujan Dasgupta

।।১।।

গত বছর জানুয়ারিতে দেশ থেকে ফিরে সপ্তাহ পাঁচেক মুক্ত-জীবন কাটিয়েছিলাম, তারপরই করোনা-ত্রাসে সব কিছু লণ্ডভণ্ড। অতিমারী এই রোগের ওষুধ বা টিকে নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, একে অন্যের ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজেকে যতটুকু রক্ষা করা যায়! আমাদের পাশের বিল্ডিং-এ দু-জন বৃদ্ধ তো মারাই গেলেন! আমাদের বিল্ডিং-এ সবাই বেঁচেবর্তে আছি ঠিকই, কিন্তু যে-ভাবে বন্দি-জীবন কাটালাম তা মোটেই প্রীতিপ্রদ নয়। এ বছর অগাস্ট মাস থেকে জীবন মোটামুটি স্বাভাবিক হচ্ছে। তার প্রধান কারণ একাধিক করোনা-টিকা আবিষ্কার। কিছু বাধানিষেধ থাকলেও ক্লাসরুমে পড়ানো আবার শুরু হয়েছে—সেই পুরোনো জীবন একটু একটু করে ফিরে আসছে। ‘পুরোনো জীবন’ লিখতে গিয়ে খেয়াল হল একটা দারুণ খবরই তো দিইনি!

পয়লা অগাস্ট সক্কাল বেলা। প্রমথ সবে কফি বানিয়েছে হঠাৎ ডোর বেলের ডিং ডং। স্যুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে মূর্তিমান একেনবাবু!

আমি তো একেবারে থ, “আপনি!”

“চলে এলাম স্যার!”

“তা তো দেখতেই পাচ্ছি! গত সপ্তাহে যখন কথা হল, কিছু তো বললেন না তখন!”

“তা হলে আর সারপ্রাইজটা কী করে হত স্যার?”

“খুব ভালো সারপ্রাইজ, এ যাত্রায় কদ্দিন থাকছেন?”

“ডিসেম্বর পর্যন্ত, যদি তাড়িয়ে না দেন।”

একেনবাবুর গলা শুনে প্রমথও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাতে গরম কফির কাপ। আমাকে দাবিয়ে প্রমথই বলল, “না না, তাড়াব কেন! তবে বাড়িভাড়া বেড়েছে। আগে থেকেই জানিয়ে দিচ্ছি, পরে আবার ঘ্যানঘ্যান করবেন না।”

“প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!” আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন। প্রমথটা পারেও। একেনবাবু যত না কৃপণ তার দশ গুণ করে বলে। “ও চিরদিনের রাস্কেল! বাড়িভাড়া এক ফোঁটাও বাড়েনি। আর শুনুন, আপনি না থাকায় বাড়িটা একেবারে ঝিম মেরে গিয়েছিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে আপনার বকবকানি না থাকলে, বাড়িটা বড্ড নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।”

“কেন স্যার, আমি কি বেশি বকবক করি?”

“আরে না, মৌনীবাবাও আপনাকে দেখে লজ্জা পাবে!” কফির কাপ একেনবাবুকে এগিয়ে দিয়ে প্রমথ বলল। প্রমথও যে ভীষণ খুশি ওর চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।

এবার একেনবাবু শুধু নিউ ইয়র্ক পুলিশের কনসালটেন্ট হিসেবে আসেননি, ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা গেস্ট লেকচারারশিপ বাগিয়েছেন। এটা শোনামাত্র প্রমথ বলল, “বাঃ, দু-দিক থেকেই টাকা পিটবেন, এ তো ‘ডবল ডিপিং!”

“কী যে বলেন স্যার, দুটোই তো পার্ট-টাইম কাজ।”

উনি আসায় আমরাও ব্যাক টু আওয়ার ওল্ড রুটিন। সকাল বেলার আড্ডা আবার জমে উঠেছে। কফি নিয়ে বসে নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়ার ফাঁকে ফাঁকে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা আর তর্কাতর্কি। আজ আলোচনা হচ্ছিল রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে। দোষের মধ্যে বলেছি, “রবীন্দ্রনাথ অত লিখতেন কী করে জানি না, কম্পিউটার ছিল না, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ছিল না, এডিটিং করার কোনো টুল ছিল না…”

ব্যস, প্রমথ লাইন পেয়ে গেল।

“তার কারণ ওঁর প্রতিভা ছিল। তুই তো ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল, সব কিছু ব্যবহার করেও দিনে ছ-লাইন লিখতে পারিস না!”

প্রমথও পারে না, কিন্তু আমাকে থাবা মেরেই ওর আনন্দ। একেনবাবু আমাকে সাপোর্ট করলেন।

“আসলে স্যার সে-যুগে কলম চালিয়ে সবাই অভ্যস্ত ছিলেন, ঝড়ের বেগে লিখতে পারতেন। এ-যুগে তো সেই অভ্যাসই চলে গেছে।”

“আপনি নিজের কথা বলুন মশাই, সবার নয়। এই আমেরিকাতেই এক-আধ জন পাবেন যাঁরা কলম ত্যাগ করেননি।”

“বলেন কী স্যার! এমন কেউ এদেশে আছেন নাকি!”

“নিশ্চয়, আমাদের ইউনিভার্সিটিতেই আছে— মিথিলেশ সাহানি।”

“কোন মিথিলেশ? বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ, তার কথাই বলছি। পিএইচডি থিসিস হাতে লিখে অ্যাডভাইজারকে গছাবার চেষ্টা করেছিল! ইউনিভার্সিটি হাতে-লেখা থিসিস নেয় না বলে অ্যাডভাইজার রিসার্চের টাকায় ওটাকে টাইপ করানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন।”

ক্যাফেটেরিয়াতে মিথিলেশের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছর দুই আগে। ওর সম্বন্ধে এক-আধটা গল্প শুনেছি, কিন্তু এটা নয়। ধরে নিলাম প্রমথ মজা করছে।

“বাজে বকিস না, তুই জানলি কোত্থেকে?”

“কোত্থেকে আবার, ঘোড়ার মুখ থেকে।”

“তার মানে?”

“মানে হল বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের একজনের কাছে শুনে ওর অফিসে হানা দিয়েছিলাম। টেবিলে ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কিচ্ছু নেই, শুধু তাড়া তাড়া হাতে- লেখা কাগজ। একটু খ্যাপা, কিন্তু হিউমার আছে লোকটার। হাতে-লেখা পিএইচডি থিসিসের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। খবরটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি। আমাকে বেশ বুঝিয়েও দিল, মাথায় যা আসছে সঙ্গে সঙ্গে হাতে লিখে ফেললে কিছুই হারায় না। কিন্তু টাইপিং-এ যে টাইম লাগে, চিন্তার কয়েকটা টুকরো তাতে হারিয়ে যায়। একটা টেকনিক্যাল টার্মও ব্যবহার করল, Lossy Data Conversion বা ওইরকম একটা কিছু।”

“হোয়াট ননসেন্স! মাথায় ছিট আছে নির্ঘাৎ!”

“থাকতে পারে ছিট, কিন্তু ডেফিনিটলি এ জিনিয়াস। অন্তত একজন কলিগের মতে নোবেল প্রাইজ মেটিরিয়াল।”

“বলেন কী স্যার!” একেনবাবু বিস্ময়ে হাঁ!

জিনিয়াস হতে পারে, কিন্তু মিথিলেশ সম্পর্কে বাজে রিপোর্টই আমি পেয়েছি। শুনেছি প্রচুর পণ নিয়ে এক বড়োলোকের মেয়েকে বিয়ে করেছিল। পণ নেওয়া যে বেআইনি খুব ভালো করেই জানত। মাস ছয়েকের মধ্যে সে-বিয়ে ভেঙে গেলেও পণের একটা টাকাও ফেরত দেয়নি! উলটে ডিভোর্সের ক-দিন পরেই আর এক বড়োলোকের মেয়েকে বিয়ে করেছে- এবারও প্রচুর পণ নিয়ে।

কথাটা বলামাত্র প্রমথ আমাকে গালাগাল দিয়ে ধুয়ে দিল!

“যত্তসব গুজব!”

একেনবাবুও প্রমথকে সাপোর্ট করলেন, “আসলে স্যার, কেউ খ্যাতি পেলেই তার নিন্দা শুরু হয়।”

তর্কাতর্কিতে গেলাম না। আমার পাওয়া রিপোর্ট কতটা সত্যি আমি নিজেই জানি না! তার ওপর সকালের ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। রেডি হয়ে কলেজে ছুটলাম।

।।২।।

ইউনিভার্সিটিতে আমার অফিস দোতলায়। লিফট দিয়ে দোতলায় পৌঁছোলে সামনে একটা ছোটো লবি। তার ডান দিকে দুটো সিঁড়ি, একটা এক তলায় নামার, অন্যটা তিন তলায় ওঠার। লবি পার হয়ে সামনের বড়ো দরজা খুললে একটা হলওয়ে- যার দু-পাশে ফ্যাকাল্টি অফিসের সারি, মানে অধ্যাপকদের বসার ঘর।

লকডাউনে বিশেষ প্রয়োজনে যখন অফিসে যেতাম মাঝে মাঝে গিটারের টুং টাং আর গুনগুন শুনতাম। চোখে পড়ত তিন তলা যাবার সিঁড়ির মুখে জিন্‌স আর টপ পরা একটা মেয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে গান গাইছে। কেন জানি মনে হত ব্রেজিলের মেয়ে অথবা লাতিনা। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ছাত্রছাত্রীদের তখন বিল্ডিং-এ ঢুকতে দেওয়া হত না। এ শুধু ঢোকেনি, ভেতরে এসে গান-বাজনাও করছে! অবাকই লাগত।

আজ সকালের ক্লাস ছিল তিন তলায়। সিঁড়ি দিয়ে নামছি, দেখি সেই মেয়েটি গাইছে। আজ পরনে ভারতীয় পোশাক – সালোয়ার-কামিজ। সুরটা চেনা চেনা… আরে এ তো রবীন্দ্রসংগীত! চোখ বুজে গিটারে আপেজিও কর্ড দিতে দিতে গাইছে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই!’ পাশ কাটিয়ে নেমে দাঁড়ালাম। গান শেষ হলে আমাকে দেখে হাসল।

“বাঙালি?”

“হ্যাঁ, আপনি তো এখানে পড়ান, তাই না?

“হাউ ডু ইউ নো?”

“তুমি’ বলে সম্বোধন করব কিনা চিন্তা করলাম। ইংরেজিতে তুমি-আপনি’র ঝামেলা নেই।

“আপনাদের সেক্রেটারি, বেভ বলেছে।” বলেই যোগ করল, “আমি এখানে পিএইচডি করছি।”

বেভের অপরিসীম ক্ষমতা বিশ্বের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার। জিজ্ঞেস করলাম, “ফিজিক্সে?”

“না, বায়োলজি।”

বায়োলজি ডিপার্টমেন্টে শুধু মিথিলেশকেই চিনি। নামটা বলতেই একগাল হেসে মেয়েটি বলল, “আমার অ্যাডভাইজার।”

“বাঃ। তোমার নাম?” বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলাম। মনে হল এবার তুমি করে বলা যায়। “সরি, তুমি বলছি বলে রাগ করলে না তো?”

“মোটেও না, আমার নাম অমৃতা।”

চেহারার সঙ্গে মানানসই নাম। আমার একটা মিটিং ছিল। তাই আর দাঁড়ালাম না। বললাম, “আমি বাপি দে। একদিন আমার অফিসে এসো, ভালো করে আলাপ করা যাবে। আমার অফিস হচ্ছে…

আমাকে কথাটা শেষ করতে দিল না।

“জানি তো, এই হলওয়েতে ঢুকে কয়েকটা রুম পার হয়ে বাঁ-দিকে।”

এক ঘণ্টার মিটিং। শেষ হবার পর অফিসে আসতেই বেভ কয়েকটা চিঠিপত্র দিতে এল।

“তোমার সঙ্গে অমৃতার পরিচয় হয়েছে শুনলাম।”

“আজকেই হল, এর মধ্যেই জেনে গেছ!’

“কেন জানব না! ও তো তোমার দেশের, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বেভ বলল, “ও কিন্তু তোমার মতো নয়।”

“তা তো বটেই, ও মেয়ে আমি ছেলে।”

“তাই নাকি!” হেসে ফেলল বেভ। “আমি বলতে চাইছিলাম, শি ইজ ভেরি ফ্রেন্ডলি।”

“তার মানে! আমি কি ফ্রেন্ডলি নই?”

“উইশ ইউ কুড বি মোর!”

ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি হলেও বেভ প্রায়ই আমার ওপর গার্জেনি ফলায়!

“ঠিক আছে, আরেকটু ফ্রেন্ডলি হতে চেষ্টা করব। কিন্তু ব্যাপারটা কী? অমৃতা কি কিছু বলতে এসেছিল?”

“তুমি নাকি ওকে দেখা করতে বলেছ, কখন তোমার ক্লাস নেই খোঁজ করছিল।”

“তুমি তো জানো আমার শিডিউল!”

“তা জানি। কিন্তু তুমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও কি না সেটা তো জানি না।”

“ রহস্যময় হাসি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, “বাই দ্য ওয়ে, শি ইজ ভেরি বিউটিফুল।”

একদিন অমৃতা এল। কলকাতারই মেয়ে। কথা বলতে খুব ভালোবাসে। নিজের কথাই বলল বেশি। সল্ট লেকে বড়ো হয়েছে গান আর ছবির জগতে। বাবার নাম এমনভাবে বলল, ধরেই নিল আমি তাঁকে চিনি। নিশ্চয় বড়ো কোনো আর্টিস্ট হবেন। কিন্তু আর্টের ব্যাপারে আমার জ্ঞান একেবারেই শূন্য। মা-র নামটা বরং চেনা চেনা লাগল, রেডিয়ো বা টিভি-তে গাইতে শুনেছি।

এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন লাগছে এখানে?”

“খুউউব ভালো। এখানে এসে যে mRNA অর্থাৎ মেসেঞ্জার আরএনএ নিয়ে কাজ করতে পারব কোনোদিন ভাবিইনি।”

এই শব্দটির সঙ্গে আমি পরিচিত, কারণ কোভিড ১৯-এর কয়েকটা ভ্যাকসিন বা টিকে-তে mRNA ব্যবহার করা হয়েছে। এই বার বুঝলাম, কেন লকডাউনেও ওকে দেখতে পেতাম। অন্য ডিপার্টমেন্টের কাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও, ওদের ল্যাব-এ কাজ চলছিল পুরোদমে। ভাবলাম এই সুযোগে একটু জ্ঞান বাড়িয়ে নিই।

“আচ্ছা এই mRNA ব্যাপারটা কী বলো তো?”

প্রশ্ন করতেই উৎসাহিত হয়ে অনেক কিছু বলে ফেলল। যেটুকু মনে আছে লিখছি। mRNA একটা জেনেটিক বস্তু যার মধ্যে প্রোটিন তৈরি করার নির্দেশ থাকে। কোভিড ভ্যাকসিনে থাকে সিন্থেটিক mRNA যেটা দেহ-কোষের মধ্যে ঢুকে করোনা ভাইরাসের গায়ে যেরকম ‘স্পাইক’ প্রোটিন থাকে, সেরকম প্রোটিন তৈরি করতে বলে। সেটা তৈরি শুরু হলেই শত্রু আসছে মনে করে দেহ তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি গড়ে তোলে। পরে যদি সত্যিকারের কোভিড ভাইরাস শরীরে ঢোকে, দ্রুত লড়াই করে তাদের কাবু করে দেয়! তবে এই টেকনোলজি কাজে লাগানোর মূল সমস্যা mRNA-এর স্টেবিলিটি খুব ঠান্ডা অবস্থায় এটা স্থিতিশীল থাকে, রুম টেম্পারেচারে নয়।

যা লিখলাম তা কতটা ঠিক জানি না। মাথায় ঢুকল শুধু এটাই, অমৃতা খুব দরকারি কাজের সঙ্গে যুক্ত, আর অ্যাডভাইজারের ওপর ওর অগাধ আস্থা। এই সুকঠিন সমস্যাও যে অ্যাডভাইজার সমাধান করতে পারবে ও জানে। পাছে আমার কোনো সন্দেহ হয়, সেইজন্যেই ‘আমরা করব জয়, নিশ্চয়’ গানটাও খালি গলায় শুনিয়ে দিল। খ্যাপা আছে মেয়েটা!

।।৩।।

ওই দিনের পর আমার সঙ্গে অমৃতার আর কথা হয়নি, যদিও আরও বার দুয়েক সিঁড়িতে বসে ওকে গান গাইতে দেখেছি। একদিন যখন দেখা করতে এসেছিল অফিসে ছিলাম না। তবে এর মধ্যে বেভের সঙ্গে অমৃতার ভালো রকমের দোস্তি হয়েছে। ওর খবর বেভের কাছ থেকেই পাই। বেভ ধরেই নিয়েছে অমৃতার সম্পর্কে আমার একটা আগ্রহ আছে, নিজের থেকেই রিপোর্ট করে।

একদিন অফিসে ঢুকছি, পেছন থেকে কেউ বলল,

চেনা চেনা গলা। বেভ!

“বাঃ, বেশ তো বাংলা বললে!”

“তুমি তো আমায় শেখালে না, অমৃতা শেখাচ্ছে।”

“কিমন আচো?”

এটা ঠিক, বেভ বহু বার আমার কাছে বাংলা শিখতে চেয়েছে। আমিই হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। প্রমথর মতে এগুলো সবই ছোটো ছোটো ‘লাভ সিগন্যাল।’ আমি একটা ইডিয়ট আর ভীতু! এইসব নিয়ে একাধিক জায়গায় আগে লিখেছি। বেভের ডাকে যে আমি সাড়া দিই না, সেটা আমি ইডিয়ট বলে নয়, সমস্যা আমার মাকে নিয়ে। যাক সেকথা। যে-কথা বলতে ভুলে গেছি, বেভ এখন পার্ট-টাইম সেক্রেটারি, পার্ট-টাইম স্টুডেন্ট। পরের বছর থেকে হয়তো চাকরি ছেড়ে ফুল-টাইম স্টুডেন্ট হয়ে যাবে। সেটা ভাবতে ভালো লাগে না!

একদিন কলেজে এসে অফিসে ঢুকতে যাচ্ছি দেখি সবুজ শাড়ি আর লাল ব্লাউজ পরে বেভ হলওয়ে দিয়ে হেঁটে আসছে। কাছে এসে একগাল হেসে বাংলায় জিজ্ঞেস করল, “কিমন লাকচে?”

শাড়িতে সাদা মেয়েদের কাঠ-কাঠ লাগে। ও একেবারেই স্বচ্ছন্দ, মানিয়েছেও চমৎকার!

“দারুণ! কে দিল তোমাকে শাড়ি আর ব্লাউজ?”

“অমৃতা।”

“ও-ই পরিয়ে দিল?”

“না, নিজে নিজে পরেছি ইউটিউব দেখে।” বেভ সগর্বে বলল। খুশিতে ঝলমল করছে। “অমৃতা দেখে বলেছে পারফেক্ট। নিজের কপাল থেকে খুলে এটাও লাগিয়ে দিয়েছে,” বলে লাল টিপটা দেখাল।

“বাঃ, সব কিছুর সঙ্গে খুব ম্যাচ করেছে।”

“এইরকম নানান রঙের ডট নাকি পাওয়া যায়। এগুলোকে বোধহয় বিভি বলে, তাই না?”

“আমরা টিপ বলি, তবে বিন্দি কথাটাই বোধহয় বেশি চলে।”

“ইট ইজ সো বিউটিফুল, আমি ড্রেসের সঙ্গে এখন থেকে ম্যাচ করে বিন্ডি পরব। ভালো হবে না?”

বেভের ফ্যাশন সেন্স খুবই ভালো- ওর পোশাক-পরিচ্ছদই তার সাক্ষী। আমি মাঝে মাঝেই ওর ধমক খাই- আমার শার্ট আর টাই নাকি কখনো ম্যাচ করে না। কপ্লিমেন্টারি কালার, মনোক্রোম স্কিম, অ্যাডজেসেন্ট কালার, ট্রায়াডিক কালার- কালার ব্লকিং আর ম্যাচিং নিয়ে হাজাররকম বক্তব্য রাখে। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না!

“কই, আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না যে!”

“নিশ্চয়, ভালো হবে। আমি তোমাকে এক সেট টিপ এনে দেব। কিন্তু আজ হঠাৎ শাড়ি পরলে যে?”

“ছ-টার সময় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের একটা পার্টি হচ্ছে।”

একটা ইমেল নোটিস এসেছিল বটে, কিন্তু খেয়াল ছিল না। গত বছর পুরো ক্যাম্পাস ঝিম মেরে ছিল বলে এই অ্যাকাডেমিক ইয়ারে প্রায় প্রত্যেক মাসেই একটা-না-একটা পার্টি হচ্ছে!

“এনজয় করো।”

“তুমি আসবে?”

“আমি তো স্টুডেন্ট ন‍ই।”

“আমার ডেট হয়ে আসবে!”

“আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করাতে চাও? তুমি তো আমাদের সেক্রেটারি, খাতায়-কলমে আমি সুপারভাইজার। সেদিন আমাদের কোড অফ কনডাক্টের নোটিস দেখলে না?” হাসতে হাসতেই কথাটা বললাম।

গত কয়েক দিন ধরে ইউনিভার্সিটির সব কর্মীদের কাছেই ‘কোড অফ কনডাক্ট’ নিয়ে নানান নোটিস আসছে। মাঝে মাঝেই এগুলো আসে- ছাত্র-ছাত্রী ও সহকর্মীদের সঙ্গে আমাদের সঠিক আচরণবিধি স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য। বেভও নিশ্চয় দেখেছে। বাড়িতে এসে দেখি একেনবাবু নেই। প্রমথ ল্যাপটপ খুলে কিছু একটা করছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, বেভের সঙ্গে তোর কিছু এগোল?”

চমকে উঠলাম, কারণ বেভের কথাই ভাবছিলাম। তবে অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। তেড়িয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “প্রশ্নটা হঠাৎ তোর মাথায় এল কেন?”

“আজ ও শাড়ি পরেছে দেখলাম, তাই জিজ্ঞেস করছি।”

“সো? স্টুপিডামো করিস না, আমাদের অফিসে কাজ করে না ও?”

“তোকে দিয়ে কিসু হবে না। এদিকে মিথিলেশ তো তার ছাত্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে!”

“কী বলছিস যা-তা!”

“ঠিকই বলছি। অমৃতার সঙ্গে প্রচণ্ড মাখামাখি! লকডাউনের সময় থেকেই প্রেম শুরু হয়েছিল। মিথিলেশ তো দুর্দান্ত ফোটোগ্রাফার, অমৃতার বেশ কয়েকটা রিভিলিং ছবি মাইক্রোস্কোপ স্লাইডে মিনিয়েচার প্রিন্ট করেছিল। শুধু স্লাইডটা অমৃতার লকারে না রেখে ভুল করে রেখেছিল এক কলিগের লকারে। সেই কলিগ ডিনকে গিয়ে রিপোর্ট করেছে!”

“কার কাছে শুনলি এসব ননসেন্স, কবেকার ঘটনা?”

“সেটা জেনে তোর কী লাভ? খুবই রিসেন্ট ব্যাপার, তবে ডিন নাকি কোনো অ্যাকশান নেয়নি। মিথিলেশ হচ্ছে ডিন-এর ফেভারিট, সুতরাং নেবেও না।”

“অর্থাৎ দোষটা পড়বে অমৃতার ঘাড়ে। আমি শিওর মেয়েটাকে হ্যারাস করার জন্য আজেবাজে ছবিতে ওর মুখ লাগিয়ে কেউ ফোটোশপ করেছে।”

“হতে পারে, অমৃতার প্রেমে ডিপার্টমেন্টের অনেকেই নাকি পাগল!… হাঁ করে আছিস কেন, ভুল বললাম কিছু? পাগল করে দেবার মতো ভলাপচুয়াস চেহারা নয়?”

অমৃতার চেহারা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। কিন্তু এই ‘ভলাপচুয়াস’ শব্দটা আমার অসহ্য লাগে। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটির মধ্যে একেনবাবু ফ্ল্যাটে ঢুকলেন।

“কীসের কথা হচ্ছিল স্যার?”

“অমৃতার কথা, মেয়েটা সুন্দরী না?” আমাকে স্রেফ জ্বালাবার জন্যেই ভালোমানুষের মতো মুখ করে ‘সুন্দরী’ কথাটা ব্যবহার করল প্রমথ

“তা তো বটেই স্যার, তবে বেভ ম্যাডামের মতো নয়।” বলে আমার দিকে তাকালেন।

“আপনারা দু-জনেই ডিজগাস্টিং!” হাত-মুখ ধুতে বাথরুমে গেলাম।

দু-দিনও যায়নি ইউনিভার্সিটিতে হইচই, মিথিলেশের অফিস থেকে কেউ বা কারা কাগজপত্র চুরি করেছে। মিথিলিশের রিসার্চের সব কাজকর্ম হাতে লেখা কাগজে। অমৃতার দায়িত্ব ছিল সপ্তাহে সপ্তাহে ওগুলোকে কম্পিউটারে তুলে ইলেকট্রনিক ডকুমেন্ট তৈরি করা। অমৃতার বসার জায়গা মিথিলেশের অফিসের মধ্যেই। কাগজগুলো ছিল অমৃতার ডেস্ক ড্রয়ারে। নির্ঘাত কোনো কলিগের কীর্তি। রিসার্চের কাজ ভন্ডুল করতে বা ব্যর্থ প্রেমের প্রতিশোধ নিতে!

চুরির ব্যাপারটা প্রথমে ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি দেখছিল। তারপর ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট নিউ ইয়র্ক পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন। এটা জানলাম একেনবাবুর কাছ থেকে, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একেনবাবুকেই ব্যাপারটা দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। একেনবাবু ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জন প্রফেসরকে অফিশিয়ালি জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। প্রত্যেকেই বলেছেন এ ব্যাপারে কিছুই তাঁরা জানেন না!

অবাক হবার কিছু নেই, অপকর্ম করে স্বীকার করবে তত মূর্খ কেউ নয়। মিথিলেশ আর অমৃতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একেনবাবু জেনেছেন, যে-কাগজগুলো চুরি গেছে, সেগুলোতেই রয়েছে অতি-ভঙ্গুর মেসেঞ্জার আরএনএ-কে কী করে সাধারণ টেম্পারেচারে অটুট রাখা যায় তার পদ্ধতি। তবে খুব ক্রিপ্টিক্যালি লেখা। সেটার মর্ম উদ্ধার করতে সবাই পারবে না। মিথিলেশ ছাড়া পারবে অমৃতা, আর মিথিলেশের দু-এক জন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট। ফলে প্রশ্ন জাগে, তারাও এর মধ্যে জড়িত কিনা!

একেনবাবু তাদেরও জিজ্ঞেসাবাদ করেছেন। যে কোনো কারণেই হোক একেনবাবুর কাছ থেকে এ ব্যাপারে আমি বা প্রমথ কিছুই জানতে পারিনি। প্রশ্ন করলে নানান কথা বলে এড়িয়ে গেছেন, বিরক্ত হয়ে আমরাও আর চাপ দিইনি।

।।৪।।

সেদিন সোমবার। প্রমথ খুব সকাল সকাল কলেজে গেছে। একেনবাবু আর আমি ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি। হঠাৎ একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, মিস অমৃতার সঙ্গে কি আপনার শিগগিরি দেখা হয়েছে?”

এতদিনের জমানো ক্ষোভটা চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, “আপনিই তো ভালো জানবেন। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

“কী যে বলেন স্যার, আপনার সঙ্গে ওঁর আলাদা পরিচয়।”

মিথিলেশের পেপার চুরি হবার পর থেকে অমৃতার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু উত্তরে ‘না’-টা না বলে বললাম, “শুধু ‘হ্যাঁ’ বললে তো আপনার অনুসন্ধিৎসা মিটবে না। ঠিক কী জানতে চাইছেন?”

এতে কাজ হল।

“আসলে স্যার, মিস অমৃতা সেদিন বললেন, উনি এখানে আর পিএইচডি করবেন না।”

“কেন?”

“ওঁর সঙ্গে মিথিলেশবাবুর সম্পর্ক নিয়ে এত রটনা চলছে, তার ওপর এই চুরির ব্যাপার। ওঁর পক্ষে এখানে মন দিয়ে পড়াশুনো আর কাজ করা কঠিন।”

“এরকম একটা ভালো প্রজেক্টের কাজ ছেড়ে দেবে?”

“আমারও তাই মনে হচ্ছিল স্যার। কিন্তু আমি তো ওঁকে তেমন চিনি না, তাই কিছু বলতে পারলাম না।”

“ভালো করে আমিও চিনি না, তবে বেভের সঙ্গে কথা বলব। এইসব রটনা বা ছোটোখাটো চুরির জন্য পিএইচডি ছেড়ে দেওয়া বোকামো হবে। বেভ বোঝাবার চেষ্টা করতে পারে, বা এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতেও উৎসাহ দিতে পারে। বেড়ের সঙ্গে ওর খুবই যোগাযোগ।”

“বলুন স্যার, বলুন। দেশের মেয়ে, আপনারাই তো দেখবেন স্যার! আর আপনি বেভ ম্যাডামকে বললে ম্যাডামও নিশ্চয়ই চেষ্টা করবেন বোঝাতে!”

শেষের কথাটা বলার দরকার ছিল না- আমাকে একটু চিমটি দেওয়া হল!

সকালের ক্লাস শেষ হবার পর বেভের সঙ্গে কথা হল। কথা বলে বুঝলাম ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়েছে। মিথিলেশ আর অমৃতা যে প্রেম করছে, সেটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি। এই নিয়ে ওরা খুবই চাপে আছে। মিথিলেশই বলেছে অমৃতাকে অন্য কোনো রিসার্চ ল্যাবে চলে যেতে। এরকম প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করা কঠিন। মিথিলেশ নিজেও নাকি চাকরি ছাড়ার প্ল্যান করছে। শেষ কথাটা সত্যি হলে, অর্থাৎ মিথিলেশ চলে গেলে, অমৃতার এখানে পিএইচডি করা সত্যিই কঠিন হবে। এগুলো খুবই গোপন খবর। আমাকে সতর্ক করল বেভ।

“কাউকে বলবে না এসব কথা, অমৃতা আমাকে বারণ করেছে এগুলো বলতে। তোমাকে ট্রাস্ট করি বলেই বললাম।”

“না না, কাউকে বলব না।”

“আরও শুনবে?”

“নিশ্চয়।”

“এখানে নয়। বাইরে চলো, লাঞ্চ খেতে খেতে বলব।” বলেই যোগ করল, “ও, তুমি তো আবার আমাকে নিয়ে একা একা লাঞ্চ খেতে ভয় পাবে – কোড অফ কনডাক্ট-এ আটকাবে।”

“কী মুশকিল, তোমাকে তো ডেট-এ নিয়ে যাচ্ছি না। কলিগের সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়ায় কোনো অপরাধ নেই।”

“ঠিক আছে, বারোটার সময় বেরোব।” এক ঝলক হাসল বেভ, “ভালোই হল। ক-দিন তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।”

মনে পড়ে গেল কাল থেকে দিন কয়েকের জন্য ও ছুটি নিচ্ছে।

যেখানে খেতে গেলাম সেখানকার ওয়েটার, ম্যানেজার সবাই বেভের খুব পরিচিত। দোতলায় মাত্র কয়েকটা টেবিল, একদম ফাঁকা। বেভ বলায় সেখানেই আমাদের বসাল। খেতে খেতে যা শুনলাম তা হল, বর্তমান বউয়ের সঙ্গে মিথিলেশের বনছে না। দিন সাতেক আগে সে রেস্ট্রেইনিং-অর্ডার এনে মিথিলেশকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

‘রেস্ট্রেইনিং অর্ডার’ ব্যাপারটা আমি মোটামুটি জানি, ওটা দেওয়া হয় পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগ আনলে। এই অর্ডারে অত্যাচারী স্বামী বা পার্টনারকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। অর্ডার বাতিল না হওয়া অবধি সে অভিযোগকারীর ধারে- কাছে আসতে পারে না। মিথিলেশ এখন পেয়িং গেস্ট হিসেবে একটা বাড়িতে আছে।

মিথিলেশের স্ত্রী খামখেয়ালি আর খরুচে। বড়োলোকের মেয়ে বলে অত্যন্ত স্পয়েন্ট। মিথিলেশের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে! মিথিলেশ ওর যথেচ্ছাচারে বাধা দেওয়াতে অত্যাচারের মিথ্যে অভিযোগ তুলে শুধু রেস্ট্রেইনিং অর্ডার নয়, ডিভোর্স কেসও এনেছে! মিথিলেশের প্রথম বউয়ের ব্যাপারটা বেভ জানে না। আমিও সঠিক জানি না, তাই প্রসঙ্গটা তুললাম না। তবে মনের মধ্যে একটা অশুভ চিন্তা ভর করল। আর একটা খবর পেলাম বেভের কাছে- অমৃতার একটা চাকরির বন্দোবস্ত মিথিলেশ ইতিমধ্যে করে দিয়েছে। গত শুক্রবার সকালে একটা ইন্দো-রাশিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে অমৃতার ইন্টারভিউ ছিল। অন-দ্য-স্পট চাকরির অফার পেয়েছে। বিকেলে ওদের টেকনিক্যাল টিমের একটি মেয়ের সঙ্গে ডিনারও খেতে গিয়েছিল।

এটা শোনামাত্র মনে পড়ল শুক্রবার যখন কলেজ থেকে বেরোচ্ছি অমৃতা খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে বেভ-এর সঙ্গে কথা বলছিল। বেভ কিছু একটা সাজেস্ট করছিল– সম্ভবত সাজগোজ নিয়েই। আমি অবশ্য দাঁড়াইনি। প্রমথকে নিয়ে এক জায়গায় যাবার কথা ছিল। দেরি করলে গালাগাল দিয়ে আমার ভূত ভাগিয়ে দিত!

মিথিলেশের কী প্ল্যান? সেটাও বেভ শুনেছে। মিথিলেশ কলেজে আর পড়াবে না। তবে কোথায় যাবে এবং কবে যাবে এখনও ঠিক করেনি। ও-ও সম্ভবত কোনো রিসার্চ ল্যাব-এ যাবে। কর্মজগতে মিথিলেশে যা সুনাম, তাতে ওর ভালো কাজ পেতে কোনো সমস্যা হবে না। আর ডিভোর্স যখন হচ্ছে তখন মিথিলেশ- অমৃতার মিলনেও বাধা থাকবে না। বেভ খুবই খুশি, আমাকে বার বার বলল, “লাভ অলওয়েজ উইনস!”

বিকেলে বাড়ি ফিরে একেনবাবুকে বেভের কথাগুলো বললাম। তবে সতর্ক করে দিলাম, “এগুলো যেন পাঁচকান না হয়। বেভ বিশ্বাস করে আমাকে বলেছে।”

“কী যে বলেন স্যার! সব কিছু গোপন থাকবে। তবে মিস অমৃতা কি নতুন কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন?”

“অফার যখন পেয়েছে, ধরে নিচ্ছি যোগ দেবে।”

আমাদের কথা শেষ হতে-না-হতেই প্রমথ বাড়িতে ঢুকল। খুব উত্তেজিত! “মিথিলেশ মারা গেছে শুনেছিস?”

“কী বলছিস যা-তা!”

“আজ কলেজে আসেনি। ওর এক কলিগ বলল, রোববার রাতে কেউ ওকে রাস্তায় গুলি করেছে! মরো মরো অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। খানিক আগে হাসপাতাল থেকে ওর ডিপার্টমেন্টে খবর এসেছে- হি ইজ নো মোর। “ গত রাতে টিভি নিউজে শুনেছিলাম বটে ব্রুকলিনে গুলি লেগে একজন আহত হয়েছে। এ ধরনের খবর নিউ ইয়র্কে মাঝে মাঝেই শুনি, তাই বিশেষ মনোযোগ দিইনি।

প্রমথ ওদিকে বলে চলেছে, “কী ব্যাপার বল তো, এত দেরিতে খবর এসেছে, তাও আবার হাসপাতাল থেকে! আর কেউ না-জানুক, ওর স্ত্রী-তো জানবে বাড়িতে ফেরেনি বা ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না!”

আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, “কারণ, ওর স্ত্রীর সঙ্গে ওর যোগাযোগ নেই, একা থাকত পেয়িং গেস্ট হিসেবে একটা বাড়িতে।”

“তুই কী করে জানলি? বলিসনি তো!”

এখন আর সত্য গোপন রাখার অর্থ হয় না! অমৃতাও নিশ্চয় খবরটা পেয়েছে!

কী সর্বনেশে ব্যাপার!

বেভকে ফোন করলাম।

“বেভ তুমি কি খবরটা শুনেছ?” বলে মিথিলেশের মৃত্যুর খবরটা দিলাম।

“ও মাই গড!”

বিশেষ কিছুই জানি না এ ব্যাপারে, যা প্রমথর কাছে শুনেছি তাই বললাম।

“আমি এখুনি অমৃতাকে ফোন করছি। যদি ওর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?”

“নিশ্চয়ই, জানাও কখন যেতে হবে।”

একটু বাদেই বেভের ফোন এল।

“অমৃতা ভীষণ কান্নাকাটি করছে। ওকে বলেছি আমার কাছে এসে ক-দিন থাকতে। তুমি এখুনি চলে আসতে পারবে? ওকে আনতে যাব।”

বেভের বাড়ি চিনি। বললাম মিনিট দশেকের মধ্যে নীচে এসে দাঁড়াতে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করতে করতে নানান কথা মনে আসছিল। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মিথিলেশ নেই। আর এই সেদিন যার সঙ্গে পরিচয় হল, সেই অমৃতা যে এইভাবে মিথিলেশের জীবনে জড়িয়ে ছিল জানতে পারিনি!

আমি ইমোশনাল সিচুয়েশন এড়াবার চেষ্টা করি। তেমন একটা অবস্থায় গিয়ে পড়তে হবে ভাবতেই টেনশন হয়। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই যাচ্ছি বেভের জন্যে। ওকে ‘না’ বলতে পারি না। আমার সবরকম দরকারে এতটুকু দ্বিধা না করে ও এগিয়ে আসে। এই সেই বেভ, যার সম্পর্কে প্রথমে আমার ধারণা ছিল শ্যালো, প্লে-ফুল, শুধু মজা-ই করে বেড়ায়। সেই ধারণা বদলাতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। লোকের দুঃখকষ্টে মুহূর্তের মধ্যে উদ্‌বেল হয়, আগ বাড়িয়ে অনেক কিছু করে ফেলে। ছুটিতে নিশ্চয় ওর নানান প্ল্যান ছিল, নতুন বন্ধুর জন্য একমুহূর্তে সব বাতিল করল!

অমৃতা থাকে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের অ্যাপার্টমেন্টে। কাল সকালেই নাকি এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে ওর অন্য কোথাও যাবার কথা ছিল। জিনিসপত্র কিছু গোছানো, কিছু আধা-গোছানো অবস্থায়। মেয়েটা একেবারেই ডেভাস্টেটেড-চোখ দুটো লাল। অসম্ভব কেঁদেছে বোঝা যাচ্ছে। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বুঝলাম খবরটা শুনেছে বিকেলে যখন ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিল তখন। ওর কলেজ ছাড়ার কথা শুধু মিথিলেশ আর ডিপার্টমেন্ট হেড জানত। কিছু পার্সোনাল জিনিস কলেজে ছিল, সেগুলো তুলে নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আসবে এই ছিল প্ল্যান। মিথিলেশের সঙ্গে আজ কথা হয়নি। আগে থেকেই ঠিক ছিল সন্ধের সময় মিথিলেশ ওর কাছে আসবে, কিছু জিনিসপত্র নিয়ে দু-জনে ওর নতুন অ্যাপার্টমেন্টে যাবে। কাল সকালে নিয়ে যাবে বাদবাকি জিনিস।

ওর যা মানসিক অবস্থা, নতুন অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে অচেনা পরিবেশে একা একা গোছগাছ করে বসা অসম্ভব! ভাগ্যিস বেভ ওকে নিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে! মিথিলেশের মৃত্যুতে একটা অপরাধবোধও মনে হল ওর মধ্যে কাজ করছে। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে আমাকে বাংলায় বলল, “দাদা, মনে হয় আমি অন্যায় করেছিলাম ওর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে!”

মিথিলেশকে নিয়ে কোনো কথা আমাদের মধ্যে আগে হয়নি। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বললাম, “এটা একটা ফ্রিক অ্যাক্সিডেন্ট অমৃতা, নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাটে এরকম গোলাগুলি অনেক চলে। ফলে নিরীহ পথচারীরা প্রাণ হারায়!”

এটা কোনো সান্ত্বনার ভাষা হল না। বেভ বাঁচিয়ে দিল, বন্ধুর হাত ধরে নানান কথা বলে ওকে শান্ত করল। প্যাক করা কয়েকটা ব্যাগ আর ছুটকোছাটকা কিছু জিনিস গাড়িতে তুলে রওনা দিলাম। পথে প্রায় কোনো কথাই হল না।

বেভের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে আগে ঢুকিনি। বড়ো সাইজের টু-বেডরুম লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট। অবাক হতে গিয়ে মনে পড়ল কথায় কথায় বেভ বলেছিল, ও থাকে ওর মামার অ্যাপার্টমেন্টে। মামা থাকেন না, তাই একাই ব্যবহার করে।

বেভ ডিনার খেয়ে যেতে বলল, রাজি হলাম না। একেনবাবু আর প্রমথ আমার

জন্য অপেক্ষা করবে!

অমৃতা বাথরুমে। বেভের কাছ থেকে যখন বিদায় নিচ্ছি, বলল, “থ্যাংক ইউ, এত শর্ট নোটিসে এসে আমাদের রাইড দিলে!”

“এর জন্য থ্যাংক ইউ কেন বেভ, এরকম একটা বিপদ অমৃতার!”

হঠাৎ কী হল বেভের বুঝলাম না। একটু অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কতদিন আমি তোমার সেক্রেটারি?”

প্রশ্নটার সঙ্গে আগের কথাগুলোর কোনো সামঞ্জস্য পেলাম না। তাও উত্তর দিলাম, “তা বছর পাঁচেক।”

“এই প্রথম তুমি আমার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকলে। ডু ইউ রিয়্যালাইজ দ্যাট?”

“হ্যাঁ, আসলে…”

“আর কিছু বলতে হবে না… খেয়ে গেলে ভালো লাগত!”

“অন্য একদিন বেভ— সুসময়ে।”

“ইয়েস, আই উইল বি ওয়েটিং। মে আই হাগ ইউ?”

বেভের ফর্মালিটি দেখে হেসে ফেললাম, “আমার অনুমতি লাগবে?”

মাথা ঝাঁকিয়ে “না” বলে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরে রইল কিছুক্ষণ, তারপর “বাই” বলে দরজা খুলে দিল।

।।৫।।

মঙ্গলবার আমার সবচেয়ে বাজে শিডিউল। একের পর এক অনেকগুলো ক্লাস। তারই ফাঁকে দশটা নাগাদ অমৃতা কেমন আছে জানতে চেয়ে বেভকে একটা টেক্সট করলাম। ইচ্ছে করেই ফোন করলাম না, কারণ আঁচ করেছিলাম ওর ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যাপারে খুব ব্যস্ত থাকবে ক-দিন। উত্তরাধিকার সূত্রে মায়ের দিক থেকে পাওয়া বহু মিলিয়ন ডলারের ট্রাস্ট- নানান কারণে এতদিন বেভ নিতে চাইছিল না। আইনি জটিলতায় সেটা বোধহয় ওকে এবার নিতেই হবে। ওর মামা হচ্ছেন ট্রাস্টি, কাজের অনেকটাই ব্যাঙ্ক আর তাঁর সঙ্গে।

বেভের মামা চমৎকার মানুষ, ম্যানহাটানেই ওঁর বিশাল ইলেকট্রনিক্সের দোকান। কিছুদিন আগে একটা এইচডি টিভি ওঁর দোকান থেকে কিনেছিলাম। বেভের কথা শুনে বিশাল ডিসকাউন্ট দিয়েছিলেন, হয়তো বেভের বয়ফ্রেন্ড ভেবে। প্রমথ সে নিয়ে এখনও মাঝে মাঝে খোঁচা দেয়। মুচকি মুচকি হেসে একেনবাবু তাতে ইন্ধন জোগান।

টেক্সটের উত্তর চট করেই পেলাম। ‘সব কিছু ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না।’

ক্লাসগুলো শেষ হতে হতে সেই চারটে। সেগুলো শেষ করে যখন অফিসে এসে বসেছি, হঠাৎ বেভের মামার ফোন এল। আমি অবাক! ভাগ্যিস নম্বরটা সেভ করা ছিল, নইলে অপরিচিত নম্বরের ফোন আজকাল ধরি না। বললেন, “সরি, তোমাকে ফোন করছি। বেভ কোথায় আছে জানো, ওকে ধরতে পারছি না!”

“ও তো ছুটি নিয়েছে, আমার ধারণা ছিল আপনার সঙ্গেই কী একটা কাজে আছে!”

“হ্যাঁ, আমার সঙ্গে প্রায় পুরো সকালটা ছিল। তোমার দেশের একটি মেয়ে খুব বিপদে পড়েছে, একটা চাকরি দরকার বোধহয়। একটু আগে একটা কাজের খবর পেলাম, কিন্তু মেয়েটির ফোন নম্বর আমার নেওয়া হয়নি, আর বেভের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছি না। ফোন ধরছে না। হঠাৎ তোমার কথা মনে হল। ব্যাপারটা আর্জেন্ট, ইমিডিয়েট ওপেনিং— দু-এক দিনের মধ্যেই যোগ দিতে হবে।”

“আচ্ছা, আমি দেখছি ওকে ধরতে পারি কিনা।”

মেয়েটি কি অমৃতা হতে পারে? কিন্তু অমৃতা তো চাকরি পেয়ে গেছে! তা ছাড়া বেভের মামা বিজনেসম্যান, উনি অমৃতার কাজ কী বুঝবেন!

আমি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সেক্রেটারি হেলেনকে ফোন করলাম, যদি কিছু হদিশ দিতে পারে! আরও দু-এক জনের কাছে খোঁজ করলাম। ওয়াইল্ড গুজ চেজ!

ছ-টা নাগাদ যখন কলেজ থেকে বেরোচ্ছি, তখন বেভ ফোন করল।

“তুমি কি জানো, অমৃতার চাকরিটা হয়নি? কোম্পানি জানিয়েছে, নানান সমস্যায় ওদের বাজেট কাট হয়েছে, ওরা চাকরি দিতে পারবে না। এদিকে ও স্টুডেন্ট ভিসায়, যদি কোনো ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন না পায়, তাহলে দেশে ফিরে যেতে হবে।”

“ও মাই গড! তার মানে তোমার মামা তো একটু আগে ওর কথাই বলছিলেন! তোমাকে ধরতে পারছিলেন না, তাই আমাকে ফোন করেছিলেন।”

“আমার মোবাইল সাইলেন্ট ছিল। হ্যাঁ, জ্যাকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ব্রুকলিনের একটা প্রাইভেট কলেজে পার্ট-টাইম পড়ানোর ওপেনিং আছে। প্রোভোস্ট আর ডিন দু-জনেই জ্যাকের খুব পরিচিত।”

বেভ ওর মামা জ্যাককে নাম ধরে ডাকে। প্রথম বার ডাকটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। সে কথা থাক।

“কিন্তু এটা তো আনবিলিভেবল! কী করে কোনো কোম্পানি এটা করতে পারে— চাকরি দিয়ে ফেরত নেওয়া? এতে আইনি ঝামেলা নেই?”

“আমিও তাই ভেবেছিলাম। জ্যাক বলল এইসব চাকরির অফার নাকি ‘অ্যাট উইল এমপ্লয়মেন্ট।’ চাকরি দেওয়া, না-দেওয়া নিয়ে আইন-আদালত করা যায় না।”

“খুব খারাপ লাগছে অমৃতার জন্য। মিথিলেশের মৃত্যু, অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ ছেড়ে দেওয়া, চাকরি না-হওয়া। তবে চাকরির কথা শুনে আমার চিত্তাও ছিল— স্টুডেন্ট ভিসাতে এদেশে কাজ করত কী করে?”

ফরেন স্টুডেন্টদের ভিসা সমস্যার কথা বেভ ভালোই জানে। বলল, “কোম্পানির ওকে ইন্ডিয়ার ল্যাব-এ কাজ করতে পাঠানোর কথা ছিল। সেদিক থেকে সমস্যা হত না।“

“এখন কী করবে ভাবছে?”

“ইন্ডিয়াতেই ফিরে যাবে। সেই টিকিট কেনা নিয়েই দৌড়োদৌড়ি করছিলাম সকাল থেকে ব্যাঙ্ক, ট্র্যাভেল এজেন্ট, অ্যাপার্টমেন্ট লিজ ক্যান্সেল, আর দরকারি কিছু কেনাকাটা।”

“কবে যাবার প্ল্যান করছে?’

“শুক্রবারের টিকিট পেয়েছে। এ ক-দিন আমার কাছে থাকবে। আমার ছুটি দু-দিন এক্সটেন্ড করছি। তুমি এক বার এলে হয়তো ওর ভালো লাগবে।”

কিছুই করতে পারব না জানি। তবু বললাম, “কালকেই আসব। এর মধ্যে কিছু দরকার হলে জানিয়ো।”

“কখন আসবে?”

বিকেলের দিকে, কলেজ শেষ হলে।”

।।৬।।

আজ একেনবাবুর আর আমার তাড়াতাড়ি ডিনার করার কথা। প্রমথ গেছে ফ্র্যান্সিস্কার কাছে। একেনবাবুও ডিনারের পরে কোথাও যাবেন। পাড়ার চাইনিজ দোকান থেকে কিছু খাবার তুলে যখন বাড়ি ঢুকলাম, একেনবাবু ফোনে কার সঙ্গে জানি কথা বলছেন। হাত-মুখ ধুয়ে খাবারগুলো যখন টেবিলে রাখছি ওঁর ফোনকল শেষ হল।

“কার সঙ্গে এত কথা বলছিলেন?”

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে স্যার। একটা বড়ো খবর আছে।’

“কী খবর?”

“মিথিলেশবাবুকে যে লোকটা গুলি করেছে সে ধরা পড়েছে। ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, মার্ডার।”

“মার্ডার! কী বলছেন আপনি! আর এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ল কী করে?”

“বলতে পারেন স্যার ভাগ্য। একজন ট্যুরিস্ট তার মোবাইলে রাস্তার ভিডিয়ো তুলছিল। লোকটা যখন গুলি করছে তখন ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ভিডিয়ো যে তুলছিল সে বুঝতেও পারেনি কী ঘটতে চলেছে। গুলির আওয়াজ আর মিথিলেশবাবুর পড়ে যাওয়া থেকে ব্যাপারটা বোঝে। দ্রুত গিয়ে পুলিশকে ভিডিয়ো দেখায়। আততায়ীর ক্রিমিনাল রেকর্ড ছিল, শনাক্ত করতে পুলিশের অসুবিধা হয়নি। এটা ছিল দুপুরের খবর। এখন জানলাম, লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্যার বোঝা গেছে, ওকে টাকা দেওয়া হয়েছিল মিথিলেশবাবুকে খুন করার জন্য। কেন, সেটা ও জানে না আর টাকা কারা দিয়েছে তাও জানে না। ক্যাশ পেয়েছে, কাজ করেছে।”

“মাই গড! কলিগদের জেলাসি এর পেছনে নেই, এটুকু বুঝতে পারছি, “ আমি বললাম।

একেনবাবু দেখলাম চুপ করে আছেন।

“কেউ কি ওর রিসার্চে বাগড়া দেবার জন্য এটা করেছে বলে মনে হয়? আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম, ওর কাজটা খুব ইম্পর্টেন্ট। মিথিলেশের এই ভ্যাকসিন রিসার্চের স্পনসর হল নিউ জার্সির একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা হয়তো চায় না কাজটা শেষ হোক। মিথিলেশ না থাকলে কাজ শেষ হবে না। মিথিলেশের যেসব কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছে না, তার পেছনেও হয়তো সেই একই স্বার্থ কাজ করেছে!”

আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলেন একেনবাবু। তারপর বললেন, “এটা দারুণ বলেছেন স্যার। কিন্তু তাই বলে সুপারি কিলিং? ধরা পড়লে সেই কোম্পানিগুলোর কী অবস্থা হবে চিন্তা করুন স্যার!”

কথাটা ভুল নয়। এদেশের কোনো কোম্পানি খুনখারাবিতে নাক গলাবে না। রিসার্চ ভন্ডুল করবে ব্যাপারটা অবশ্য মানা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে জেলাসির ব্যাপারটাও মোটিভ হিসেবে উপেক্ষা করা যায় না। আসলে এই খুনটাই পুরো ব্যাপার গুলিয়ে দিয়েছে। আরও একটা চিন্তা হল, এর মধ্যে অমৃতা জড়িয়ে পড়বে না তো! ও-ই ছিল মিথিলেশের অন্যতম প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট!

“কী এত ভাবছেন স্যার?”

“অমৃতার কথা ভাবছি, ও পরশু ফিরে যাচ্ছে!”

“সব কিছুর সুরাহা না হলে মনে হয় না যেতে পারবেন,” একেনবাবু অস্ফুটস্বরে বললেন।

“তার মানে?”

“সব মানে কি আমি জানি স্যার! করছিলাম রিসার্চ কাগজ চুরির তদন্ত, এখন এটা মার্ডার। তার ওপর যা শুনেছি, উনি ছিলেন ভিক্টিমের গার্লফ্রেন্ড!”

“সো হোয়াট! ওর কী স্বার্থ এ ব্যাপারে?”

“স্যার, খুন তো রিভেঞ্জ থেকেও হতে পারে, তাই না? হয়তো মিথিলেশবাবু ওঁকে ডাম্প করার চেষ্টা করছিলেন, তাতে মানসিক আঘাত পেয়ে উনি প্রতিশোধ নিলেন।”

“কী বলছেন যা-তা! অমৃতার মতো মেয়ে হায়ার্ড গান দিয়ে খুন করাবে!”

“এরকম তো ঘটে স্যার।”

“সেক্ষেত্রে মিথিলেশের স্ত্রীও তো কাজটা করতে পারে। পারে না?”

“হ্যাঁ, তা পারেন। আপনি ম্যাডাম অমৃতার কথা বলছিলেন বলে আমি বললাম।”

“কলিগরাই-বা বাদ পড়ল কেন। তাদের কেউ যদি অমৃতাকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলে, সেও তো ফিল্ড ক্লিয়ার করার জন্য মিথিলেশকে খুন করাতে পারে।”

“স্যার সবই সম্ভব। আমাদের এখন প্রবাবিলিটি আর পসিবলিটি নিয়ে ভাবতে হবে। সম্ভবপর তো স্যার অনেক কিছুই, কিন্তু কোন সম্ভাবনাটা জোরদার সেটা বিচার করতে হবে।”

“আপনি বিচার করুন, আমি কাল বেভের কাছে যাচ্ছি। অমৃতা এখন ওখানে আছে। ও যে পরশু দেশে যেতে পারবে না, সেটা হয়তো বেচারা জানেও না।”

“আমিও কি স্যার যেতে পারি? খুব খারাপ লাগছে ওঁর জন্য। কলকাতার মেয়ে… এভাবে অ্যাডভাইজার-কাম-ফ্রেন্ডের মৃত্যু, তার ওপর এইসব ঝামেলা।”

“অত কিছু বলতে হবে না, বেভ খুশিই হবে আপনি গেলে।”

একেনবাবু আমার সঙ্গে আসতে চান জানিয়ে বেভকে ফোন করলাম। আমার চেনাজানা সবাই একেনবাবুকে পছন্দ করে। ঠিক হল বিকেলে নয়, পরদিন বুধবার সকাল বেলায়;-জনে যাব। ভাগ্যক্রমে সকালে আমার ক্লাস নেই।

।।৭।।

বেভ আমাদের দেখে খুব খুশি হল। একেনবাবু বেভের কাছেও প্রমথর গার্লফ্রেন্ড ফ্র্যান্সিস্কার মতো ‘ডিয়ার ডিটেকটিভ।” অমৃতার সঙ্গে একেনবাবুর আগে এক বার দেখা হয়েছে গোয়েন্দা হিসেবে, মিথিলেশের চুরি যাওয়া কাগজপত্র নিয়ে যখন খোঁজখবর করছিলেন।

অমৃতা দেখলাম এর মধ্যেই নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। তাতে নিশ্চয় বেভের একটা বড়ো ভূমিকা আছে।

একেনবাবু কিন্তু ধানাইপানাই করলেন না। সরাসরি বললেন, “ম্যাডাম, আমি জানি আপনার মন খুবই খারাপ, কিন্তু মিথিলেশবাবুর মৃত্যু নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করতেই হবে।”

“আমাকে অমৃতা বলুন, প্লিজ।”

“ও হ্যাঁ, মিস অমৃতা। প্রশ্নগুলো করতে হচ্ছে, কারণ মিথিলেশবাবুর মৃত্যুটা একটু রহস্যজনক।”

“রহস্যজনক! ওটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়?”

“মনে হয় না ম্যাডাম। আমি জানি এই নিয়ে নিউ ইয়র্ক পুলিশ আপনাকে প্রশ্ন করতে আসবে, তার আগেই ব্যাপারটা আমি বুঝে নিতে চাই— এতে হয়তো আপনার সাহায্যই হবে।”

কথাটা শুনে অমৃতার মুখ এমন হয়ে গেল… সেটা ভাষায় বোঝাবার ক্ষমতা আমার নেই।

খুব নীচু স্বরে বলল, “যা প্রশ্ন করার আছে করুন।”

“প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, আপনার সঙ্গে মিথিলেশবাবুর সম্পর্ক তো শুধু অ্যাডভাইজার আর ছাত্রীর ছিল না, আপনাদের মধ্যে তো একটা ভালোবাসার সম্পর্কও ছিল, তাই না?”

অমৃতা অনুচ্চ স্বরে বলল, “হ্যাঁ।”

“মিথিলেশবাবুর সঙ্গে আপনার শেষ কথা কখন হয়েছিল?”

“রবিবার বিকেলে।”

“কোনো ব্যাপারে কি উনি উদ্‌বগ্ন ছিলেন?”

“তা ছিল। ওর ডিভোর্স নিয়ে অনেক ঝামেলা হচ্ছিল।”

“কী ঝামেলা মিস অমৃতা?”

“ওর স্ত্রী একের পর এক মিথ্যে অভিযোগ এনে বাড়ি থেকে তো ওকে তাড়িয়েই ছিল, সেইসঙ্গে ডিভোর্স ফাইলিং-এ দাবি করেছিল বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ। আমাকে বলেছিল, সোমবার পুরো দিনটাই উকিল আর কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করে কাটবে। সেগুলো চুকিয়ে বিকেলে কলেজে আসবে।”

“বুঝলাম, তার মানে সোমবার আপনাদের মধ্যে কথা হয়নি।”

“ঠিক।”

“আচ্ছা, মিস অমৃতা আপনি হঠাৎ পিএইচডি প্রোগ্রাম ছাড়লেন কেন?”

অমৃতা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আমার সঙ্গে ওর, মানে মিথিলেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর গুজব আর কথা চালাচালি শুরু হয়েছিল— সম্মান বজায় রেখে কাজ করতে পারছিলাম না। তা ছাড়া ও-ও ইউনিভার্সিটি ছাড়ার কথা ভাবছিল, সেটাই ছিল বড়ো কারণ। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লোকের এরকম আগ্রহ কেন বুঝি না!”

“মিথিলেশবাবু তো আপনাকে একটা চাকরির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন ম্যাডাম, তাই না?”

“হ্যাঁ, কিন্তু হতে হতেও সেটা হয়নি।”

“ঠিক বুঝলাম না ম্যাডাম।”

“মানে চাকরিটা অফার করেছিল, কিন্তু অফারটা ফিরিয়ে নিয়েছে।”

“সে কী! কেন ম্যাডাম?”

“ওদের রিসার্চ বাজেট হঠাৎ কাট হওয়ার জন্য, আমি যা শুনেছি।”

“কোম্পানিটার নাম কী ছিল?”

“হিন্দ-রাশিয়া বায়োটেক ডিভিশন।”

“একটা ব্যাপারে আমি একটু কনফিউজড মিস অমৃতা—কী ধরনের কোম্পানি এই হিন্দ-রাশিয়া! আপনাকে একদিন ইন্টারভিউ করেই চাকরি দিল, ক-দিন বাদেই বলল বাজেট কাট! কী কাজ করার জন্য আপনাকে ওঁরা চাইছিলেন?”

“আমার রিসার্চ এরিয়ার কাজ— মেসেঞ্জার আরএনএ নিয়ে। মিথিলেশ এই ফিল্ডে একজন অথরিটি, ওর রেকমেন্ডেশনেই ইন্টারভিউয়াররা বাজেটের ভাবনা না করে চাকরিটা দিয়েছিল। পরে হেড কোয়ার্টার ওদের ‘না’ করে দেয়।

“এই খবরটা আপনি জানলেন কী করে?”

“অফার ফিরিয়ে নেবার মেসেজ পেয়েছি হেড কোয়ার্টার থেকে। ইন্টারভিউ করতে যারা এসেছিল তাদের কেউ যোগাযোগ করেনি। যারা ইন্টারভিউ নিতে এসেছিল তাদের মধ্যে একটি রাশিয়ান মেয়ে ছিল, তার সঙ্গেই আমার কাজ করবার কথা ছিল, ভেরি সুইট। তাকে ধরার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ফোন সুইচড অফ।”

“একটা প্রশ্ন মিস অমৃতা, আপনি বললেন মিথিলেশবাবু চাকরির যোগাযোগটা করে দিয়েছিলেন, তাঁকে কি ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন?”

“কথা হয়নি, কিন্তু একটা মেসেজ রেখেছিলাম। মিথিলেশ ওর ডিভোর্স কেসের ব্যাপারে কোর্ট, উকিল, ইত্যাদি নিয়ে খুব বিজি থাকবে বলেছিল।” তারপর একটু থেমে বলল, “মিথিলেশ অবশ্য আমার চাকরি নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিল না। ইন্টারভিউটা দিতে বলেছিল, কিন্তু বলেছিল চাকরি পেলেও সেটা নিতে হবে না, অন্য একটা বন্দোবস্ত করছে।”

“ঠিক বুঝলাম না ম্যাডাম, অন্য কী বন্দোবস্ত?”

“সেটা নিয়ে আলোচনা হয়নি। আসলে এদেশে ওর প্রচুর কনট্যাক্ট। দেশের বাইরে গিয়ে আমাকে চাকরি করতে হবে, এটা ও চাইছিল না। আর এই চাকরিটা তো ইন্ডিয়াতে।”

“তা হলে ইন্টারভিউটা দিলেন কেন ম্যাডাম, মানে মিস অমৃতা?”

“মিথিলেশ চেয়েছিল আমি ইন্টারভিউ দেওয়া প্র্যাকটিস করি। চাকরি না নিলেও, এটা একটা এডুকেশন। এমনকী সকালে ইন্টারভিউ যখন ভালো হল, ওরা ডিনারে ইনভাইট করল, তখন আমার খারাপই লেগেছিল। ওকে বললাম, ‘চাকরি নেব না, অথচ ওদের সঙ্গে ডিনার খাব!’

“ও বলল, “কেন খাবে না, বরং শাড়ি পরে সেজেগুজে ইন্ডিয়ান বিউটি হয়ে যাও। দেখবে মাইনের অফার কত্ত বেড়ে যাবে!’ শুনে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, “ওদের কারোর যদি আমাকে পছন্দ হয়ে যায়?’ খুব হেসেছিল শুনে। বলেছিল, ‘সেইজন্যেই তো চাকরি পেলেও চাইব না তুমি যাও।”

কথাটা বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল অমৃতার। তারপর যোগ করল, “ইন ফ্যাক্ট, দু-দিন আগে আমাকে জ্যাকসন হাইটসে নিয়ে গিয়েছিল শাড়ি-ব্লাউজ কিনে দিতে— আমার বার্থডে গিফট। আমি দেশে খুব একটা শাড়ি পরতাম না। ও খুব পছন্দ করে বলে এদেশে পরা শুরু করেছিলাম।

একেনবাবু সেদিন ডিনারে যাবার আগে অমৃতাকে দেখেননি, আমি দেখেছিলাম। লাল শাড়ি পরা ঢলঢলে হাস্যোজ্জ্বল মুখ। ঘন কোঁকড়ানো চুল সিঁথির দু-পাশ দিয়ে কাঁধের ওপর নেমে এসে থমকে গেছে। প্রশস্ত কপালে একটা লাল টিপ জ্বলজ্বল করছে— স্টানিং লাগছিল!

একটু কিন্তু কিন্তু করে একেনবাবু অমৃতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “একটা পার্সোনাল প্রশ্ন, আর কেউ কি আপনার সঙ্গে এদেশে বন্ধুত্ব করার, মানে বলতে চাচ্ছি অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করেছেন?

উত্তর দিতে অমৃতা অস্বস্তি বোধ করছে দেখে আমি একেনবাবুকে বললাম, “আমি বরং বেভের সঙ্গে পাশের ঘরে যাই।”

অমৃতা হাত তুলে বারণ করল, “না দাদা, আপনার সামনে আমার উত্তর দিতে অসুবিধা নেই।”

এই দাদা ডাকটা অমৃতার কাছে এই ক-দিনে দু-বার শুনলাম।

একেনবাবু যোগ করলেন, “বাপিবাবু তদন্তের কাজেও আমাকে অনেক সাহায্য করেন। আপনার উত্তরগুলো বাপিবাবু শুনলে সুবিধেই হবে।”

বেভ আমার দিকে তাকাল, ভাবটা– কই আমাকে তো বলোনি তুমি ডিয়ার গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট!

“মিস অমৃতা, প্রশ্নের উত্তরটা?”

“হ্যাঁ, দু-এক জন চেষ্টা করেছে।”

“আপনার ডিপার্টমেন্টের?”

“হ্যাঁ।”

“তাঁদের নামগুলো বলবেন?”

অমৃতা চুপ। বেভ দেখলাম খস খস করে একটা কাগজে কী জানি লিখল। তারপর অমৃতাকে দেখাতে অমৃতা ঘাড় নাড়ল।

বেভ একেনবাবুকে কাগজটা এগিয়ে দিল। দেখলাম লেখা অ্যালবার্ট গ্রাও, গ্যারি রয়।

অ্যাল গ্রাওকে আমি কয়েক বার মিট করেছি। অত্যন্ত মুখচোরা, তার মধ্যে এত প্রেম আছে বুঝিনি! গ্যারি রয় হল গৌতম রায়। অনেক বছর ধরে গ্র্যাজুয়েট স্কুলে ঘষটাচ্ছে, শোচনীয় গ্রেড-পয়েন্ট অ্যাভারেজ- যে কোনো সময় কলেজ থেকে বিতাড়িত হবে। তবে পজিটিভ দিক একটা আছে—কবিতা-টবিতা লেখে, নিউ ইয়র্কে বঙ্গ সন্তানদের সাংস্কৃতিক জগতে ওর ভালো প্রেজেন্স। অমৃতা ভালো গান গায়, সুন্দর চেহারা, প্লাস ফ্রি-অ্যান্ড-ফ্র্যাঙ্ক অ্যাটিচুড— গ্যারির যে পছন্দ হবে তাতে সন্দেহ কী!

একেনবাবু এদের দু-জনকেই চেনেন। অ্যালের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মিথিলেশের মিসিং পেপার খোঁজার সূত্রে, আর গ্যারিকে দেখেছেন ম্যানহাটানের একাধিক বাংলা ফাংশানে।

একেনবাবু কাগজে চোখ বুলিয়ে অমৃতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস অমৃতা, আপনি কি শুক্রবার দেশে যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ, সকালের ফ্লাইটে।”

ভাবলাম একেনবাবু হয়তো বলবেন, পুলিশ তাতে বাধা দিতে পারে। কিন্তু কিচ্ছু বললেন না।

“আজ আর কাল এখানেই থাকবেন?”

“রাত্রে এখানেই থাকব। দিনের বেলায় খানিকক্ষণের জন্য ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে, মিথিলেশের রিসার্চ রিপোর্ট টাইপ করতে অসুবিধা হচ্ছে। ডিপার্টমেন্ট-হেড ফোন করেছিলেন যদি একটু সাহায্য করি।”

এমন সময়ে অমৃতার একটা ফোন আসায় “এক্সকিউজ মি” বলে ফোনটা নিয়ে ও বেডরুমে গেল।

“বেভ ম্যাডাম, আপনিও কি কলেজে যাচ্ছেন?” একেনবাবুকে আমি চিনি, নিশ্চয় অমৃতাকে এড়িয়ে বেভকে কিছু প্রশ্ন করতে চান।

একেনবাবুকে বললাম, “ও তো ছুটিতে, কিন্তু আপনি ওকে লাঞ্চ খাওয়ালে হয়তো আসতে পারে।”

“কী যে বলেন স্যার, আপনি থাকতে আমি!”

“ঠিক আছে, আমিই নাহয় খাওয়াব। কী বেভ, আসতে পারবে?”

“আজ নয়, কালকে পারব।”

।।৮।।

বেভের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে কলেজ যাবার পথে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝছেন?”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। মিস অমৃতাকে ইন্টারভিউ দিতে পাঠালেন মিথিলেশবাবু, কিন্তু চাকরি নিতে বারণ করলেন!”

“আমারও ‘মদ্ভুত লাগল। অমৃতাকে নিয়ে মিথিলেশের নিশ্চয় অন্য প্ল্যান ছিল। কিন্তু সেটা কী তা এখন আর জানার উপায় নেই।”

“ঠিক স্যার।”

“তা কোথায় লাঞ্চ খাবেন, বেভকে তো খুব আসতে বললেন? বেচারাকে ছুটির মধ্যে আপনার জন্য কলেজে আসতে হচ্ছে।”

“কলেজে আসতে হবে কেন স্যার, বাড়িতে আসবেন! নিশ্চিন্ত মনে কথা বলা যাবে।”

“আপনি লাঞ্চ বানাবেন?”

“কী যে বলেন স্যার! হয় প্রমথবাবু বানাবেন, নইলে কথা বলার পর ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে যাব। বেভ ম্যাডাম বলে কথা!”

আমার অস্বস্তি লাগছিল বেভকে এভাবে বাড়িতে ডাকতে। একেনবাবুকে ঠেকানো অসম্ভব, নিজেই আমার কাছ থেকে বেভের নম্বর নিয়ে ফোন করলেন চেঞ্জ অফ ভেন্যু জানাতে।

রাত্রে খেতে বসে বেভকে নেমন্তন্ন করার কথা একেনবাবু বললেন প্রমথকে।

“ওই যাঃ, কাল ডিনারে তো আমি থাকতে পারব না।”

“না স্যার, লাঞ্চ।”

“বাঃ, এটা তো দারুণ খবর! ফাইনালি বাপিটার একটু বোধবুদ্ধি হয়েছে। লাঞ্চ আমি বানাব। বাপি, তোর কাজ হবে ওয়াশরুম আর বসার ঘরটা ভদ্রস্থ করা। আর একেনবাবু, আপনার কাজ হবে সেটাকে নোংরা না করা।”

আজ সকালে আমার ক্লাস নেই, বিকেলে শুধু একটা মিটিং। ব্রেকফাস্ট করেই প্রমথ কলেজে ছুটেছে, তাড়াতাড়ি ফিরবে। একেনবাবুও সকাল থেকে অদৃশ্য, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছে হাজিরা দিতে গেছেন কী একটা জরুরি কাজে! তবে ভরসা দিয়ে গেছেন বারোটার আগেই ফিরবেন। ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগেছি, আর একেবাবুর বাপান্ত করছি— কী দরকার ছিল বেভকে বাড়িতে আসতে বলার!

দশটার মধ্যেই আমার ঘর পরিষ্কার করার কাজ শেষ। প্রমথও ফিরে এসেছে। স্পাইস অ্যান্ড গ্রিল থেকে দুটো ইন্ডিয়ান চিকেন ডিশ নিয়ে— ভিন্দালু আর টিক্কা মাখনি। ও বানাবে মোগলাই পরোটা, আর মনে হয় একটা সবজি।

“বুঝলি, ভিন্দালুটা যদি ঝাল লাগে, তাই মাখনিও নিয়ে এলাম। তোর বান্ধবী বলে কথা!”

“চুপ কর স্টুপিড! এই একেনবাবুকে নিয়ে আর পারা যায় না, নেমন্তন্ন করে নিজে হাওয়া হয়েছেন। এবার বল, আমার কোনো সাহায্য লাগবে?”

“কিচ্ছু না, তুই তোর কাজ কর, আমি আমার কাজ।”

আমার কাজ? হঠাৎ ভাবলাম অমৃতা যেখানে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল, সেই হিন্দ- রাশিয়া কোম্পানি কী জিনিস তৈরি করে দেখি। গুগল সার্চ করে কিছু পেলাম না। বেশ খানিকটা কাঠখড় পুড়িয়ে উদ্ধার করলাম ওটা একটা শেল কোম্পানি। শেল কর্পোরেশনের অস্তিত্ব মূলত কাগজপত্রে। অনেক সময় এগুলো ব্যবহার করা হয় ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া বা অর্থপাচার করার জন্য। তবে এদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে, মেধাস্বত্বের অধিকারী হিসেবেও এরা রেজিস্টার্ড হতে পারে। এর বেশি অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারলাম না। এই খবরটা একেনবাবুকে জানাতে হবে তো!

রান্নাঘরে ঢুকে প্রমথকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে, শেল কর্পোরেশন সম্পর্কে কিছু জানিস?”

“আমাকে এখন ডিস্টার্ব করবি না!” এককথায় আমাকে হটিয়ে দিল।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ একেনবাবু বাড়ি এলেন। প্রমথকে রান্নাঘরে দেখে খুব খুশি। “আমার একটু টেনশন ছিল স্যার, যদি সময়মতো না আসতে পারেন।”

“না এলে আর কী হত, আপনাকে একটু পয়সা খরচা করতে হত এইটুকুই তো। খাওয়ার জায়গার কি অভাব আছে!”

“কী যে বলেন স্যার, কোথায় আপনার রান্না, আর কোথায় দোকানের খাবার! “ “থাক, আর তেল দিতে হবে না। বিলটা শুধু মিটিয়ে দেবেন— দুটো মাংসের ডিশ কিনে এনেছি।”

“না না, তা তো দেবই স্যার। এটা তো আমাদেরই দায়িত্ব, তাই না স্যার?” বলে আমার দিকে তাকালেন।

বললাম, “একদম দুশ্চিন্তা করবেন না, বিলের টাকা আমি মেটাব। তার আগে আপনাকে একটা খবর দিই। অমৃতা যেখানে ইন্টারভিউ দিয়েছিল, সেটা একটা শেল কর্পোরেশন।”

“জানি স্যার, ইন্দো-রাশিয়ান মাফিয়া টাইপ। ইনফর্মেশন কেনা-বেচা করে, কিন্তু লিগ্যালি নয়।”

“আপনি এটা কোত্থেকে জানলেন?”

“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আজ খবরটা দিলেন। আপনারা হয়তো জানেন না স্যার, রিসার্চের কাজ চুরি হয়ে যায় বলে যে-সব রিসার্চে ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট জড়িত আছে, এনএসএ, এফবিআই, আর সিআইএ তাতে চোখ রাখে। মিথিলেশবাবুর গত দু- বছরের সব ইমেল, ফ্যাক্স, আর ফোনের খবর এরা জানে। ইন ফ্যাক্ট মিস অমৃতা আর মিথিলেশবাবুর প্রেমের খুঁটিনাটিও ওদের জানা।”

প্রমথ বলল, “বলেন কী! এইরকমভাবে আমাদের ইমেল আর ফোন ট্যাপ করা যায়? এদেশে প্রাইভেসি অ্যাক্ট আছে না?”

“রিসার্চে ন্যাশনাল সিকিউরিটি জড়িয়ে থাকলে সব কিছু করা যায় স্যার। কিন্তু রিসার্চটা এত ইম্পর্টেন্ট কেন বুঝিনি।”

“আমি বোধহয় খানিকটা বুঝতে পেরেছি।” মনে করার চেষ্টা করলাম অমৃতা সেদিন ভীষণ উৎসাহিত হয়ে ওর রিসার্চ সম্পর্কে কী বলছিল।

“আমাকে বুঝিয়ে দিন তো স্যার, এগুলো জেনে রাখা ভালো।”

“আমি যা শুনেছি, বলছি। তবে অনেক কিছু আমার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে গেছে। ওদের কাজ ছিল মেসেঞ্জার আরএনএ ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরি করা— একটা নতুন টেকনোলজি। এটা ব্যবহার করে দ্রুত নতুন নতুন ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়। কিন্তু টেকনোলজির সবচেয়ে বড়ো সমস্যা মেসেঞ্জার আরএনএ-র স্টেবিলিটি। খুব ঠান্ডায় না রাখলে, এটা নষ্ট হয়ে যায়। মিথিলেশ এতে কোনো জিনিস যোগ করে বা কোনো টেকনিক ব্যবহার করে একে সাধারণ টেম্পারেচারেও ব্যবহারযোগ্য করেছিল।”

প্রমথ এটা শোনামাত্র বলল, “সেটা তো দারুণ ব্যাপার রে! তার মানে মেসেঞ্জার আরএনএ দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করা, মজুত রাখা, এবং নানান জায়গায় পাঠানো- সবই রুম টেম্পারেচারে করা যাবে! খরচা কত কমে যাবে ভাব তো! সেইজন্যেই এটা দিয়ে ভ্যাক্সিন স্প্রে তৈরির কথাও শুনেছিলাম। অর্থাৎ এর কমার্শিয়াল আর মিলিটারি ইম্পর্টেন্স সাংঘাতিক।”

“কমার্শিয়াল ইম্পর্টেন্স খানিকটা বুঝতে পারছি, কিন্তু মিলিটারি ইম্পর্টেন্স?”

“ধ্যাত! মানে ভ্যাকসিন তৈরি করতে খরচা কম হবে— সুপার কোল্ড টেম্পারেচারে মালটা বানাতে হবে না বা স্টোর করতে হবে না। হাসপাতালে বা ক্লিনিকে পাঠাতে রেফ্রিজারেটেড ট্রাক লাগবে না। বিলিয়নস অফ ডলার্স বেঁচে যাবে। এটা গেল কমার্শিয়াল দিক। মিলিটারি দিক থেকে, যদি কোনোদিন বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার হয়, মানে বীজাণু যুদ্ধ—এই টেকনোলজিতে চটজলদি ভ্যাকসিন বানিয়ে নিজেরা প্রতিষেধক নিয়ে বীজাণুগুলো ছড়িয়ে দেবে শত্রুদের মধ্যে।”

মাই গড! প্রমথর মাথায় খেলেও বটে। মনে অন্য একটা প্রশ্ন এল।

একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “মিথিলেশের কাছ থেকে তথ্যগুলো কি কেউ পেয়েছে? রিপোর্ট তো এখন টাইপ করা হচ্ছে শুনলাম!’

“সেটাই ভাবছি স্যার,” একেনবাবু বললেন। “কিছু কাগজ তো চুরি হয়েছিল। আবার মজার ব্যাপার কী জানেন, স্যার? ঠিক চুরিও হয়নি, মিথিলেশবাবুর লকারে অন্যান্য কাগজের মধ্যেই ছিল। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টরা কাগজে অচেনা কারোর ফিঙ্গার-প্রিন্ট পায়নি। একটা সম্ভাবনা, উনি কাগজগুলো মিসপ্লেস্ড করেছিলেন। আসলে কলেজে মিস অমৃতাকে নিয়ে সমস্যা, প্লাস ডিভোর্স- সব কিছু নিয়ে বেশ টেনশনের মধ্যে ছিলেন। হয়তো খেয়াল করেননি!”

এমন সময় একটা ফোন এল একেনবাবুর। ফোনটা ধরেই বললেন, “বলেন কী স্যার!”

গলার স্বর শুনেই বুঝলাম বিরাট একটা কিছু ঘটেছে। কথা বলতে বলতেই একেনবাবু ঘরে চলে গেলেন। মিনিট কয়েক বাদে ফিরে এসে বললেন, “খুবই গুরুতর ব্যাপার স্যার। আমার মনে হয় মিথিলেশবাবু বেশ একটা গোলমেলে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সুইস ব্যাঙ্ক আর কেম্যান আইল্যান্ডের ব্যাঙ্কে আট আট করে ষোলো মিলিয়ন ডলার জমা পড়েছে মিথিলেশবাবুর অ্যাকাউন্টে।”

“বলেন কী, ষোলো মিলিয়ন! কারা পাঠাল? ওসব জায়গায় টাকা থাকলে তো কেউ জানতে পারে না, শুনেছি।”

প্রমথ বলল, “ধ্যাত, এখন কিছুই গোপন থাকে না। চাপে পড়ে বারমুডা, কেম্যান— এইসব আইল্যান্ডগুলো বড়ো বড়ো দেশের সঙ্গে সহযোগিতা করে। সুইজারল্যান্ড তো বেশ কিছুদিন ধরেই করছে।”

“টাকা পাঠিয়েছে কারা?”

“এনএসএ আর সিআইএ সেটাই বার করার চেষ্টা করছে। সোজা জমা পড়েনি, বেশ কয়েকটা হাত ঘুরে এসেছে। তবে ওরা মোটামুটি নিশ্চিত এর সঙ্গে শেল কোম্পানি হিন্দ-রাশিয়া যুক্ত।”

“যারা অমৃতাকে চাকরি দিয়ে, আবার অফারটা ফিরিয়ে নিল?”

“হ্যাঁ স্যার।”

সিআইএ-র কথা আমরা সবাই জানি, এনএসএ হল ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি। এদের কাজ ইন্টারনেট-এর সব চ্যাটার বা ডেটার আদান-প্রদানের ওপর নজর রাখা। এনক্রিপ্টেড বা জটপাকানো ডেটাগুলোর জট ছাড়িয়ে পরীক্ষা করা।

আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছিল। টাকাটা মিথিলেশকে নিশ্চয় দেওয়া হয়েছে ওর রিসার্চের কাজগুলো হস্তগত করার জন্য। কিন্তু রিসার্চের কাগজপত্র পেল কীভাবে আর ওকে খুনই-বা করা হল কেন? প্রশ্নটা করাতে, একেনবাবু বললেন, “সেটাই ক্লিয়ার নয় স্যার।”

প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল, “যে করেই হোক হয়তো পেয়েছে। সেইজন্যেই মিথিলেশকে সরিয়েছে। কারণ ও বেঁচে থাকলে শুধু ওদের হাতে নয়, আমেরিকান কোম্পানির কাছেও টেকনোলজি থাকবে।”

“এটা ভালো বলেছেন স্যার।”

আমাদের এইসব কথাবার্তার মধ্যেই বেভ এল। আজকে একেনবাবুর অনারে সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে। মেরুন রঙের সিল্ক কামিজ, কালো-সোনালি মেশানো ওড়না, আর কালো সালোয়ার।

আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবুর প্রশ্ন, “ইন্ডিয়ান ড্রেসে ম্যাডামকে খুব মানায়, তাই না স্যার?”

বেভ সপ্রশ্নে আমার দিকে তাকাল।

“শুধু কপালের বিন্দি মিসিং!” একটু মজা করেই বললাম।

বেভ কপালে আঙুল ছোঁয়াল। “মিসিং, কারণ নীচে লিফটে ওঠার সময় হঠাৎ কপাল থেকে খসে পড়ল! তবে হারায়নি। ওয়াশরুমটা কোথায়, আমি লাগিয়ে আসি।”

ফিরে যখন এল কপালে সোনালি বর্ডার দেওয়া কালো টিপ। বেভের ফ্যাশন সেন্স তারিফ করার মতো। ওই টিপ এই পোশাকের সঙ্গে দারুণ মানায়।

একেনবাবু মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “এখন অ্যামেজিং লাগছে আপনাকে ম্যাডাম, আর টিপটা একেবারে পারফেক্ট ম্যাচ।”

“থ্যাংক ইউ।”

ইন্ডিয়ান দোকান থেকে বেভকে বিন্দির যে সেটটা আমি কিনে দিয়েছিলাম, সেটাতে এরকম ফ্যান্সি কিছু ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কোত্থেকে পেলে?”

“এটা অমৃতার। সেদিন ওর লাল শাড়িতে একেবারেই মানাচ্ছিল না। ম্যাচিং- এর জন্য আমার একটা লাল বিন্দি ওকে দিয়েছিলাম। এক্সচেঞ্জটা আমার কাছে ছিল।”

একেনবাবু হঠাৎ বললেন, “ম্যাডাম। আপনার টিপটা একটু দেখতে পারি, মানে হাতে নিয়ে?”

এই বেয়াড়া আবদারে একেনবাবুর দিকে তাকালাম। বেভ একটু অবাক হয়েই কপাল থেকে টিপটা খুলে দিল।

“আপনিও কি টিপ পরা শুরু করবেন নাকি!” প্রমথ ঠাট্টা করল।

একেনবাবু মন দিয়ে টিপের পেছন দিকটা দেখছেন। হঠাৎ টিপের পেছনটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “স্যার, এটা তো মনে হচ্ছে মাইক্রোডট, তাই না?”

একটা ছোট্ট উজ্জ্বল বিন্দু দেখলাম বটে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। প্রমথ ধাঁ করে গিয়ে ওর ঘর থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে এল। এখন বিন্দুটা বড়ো দেখাচ্ছে— আশেপাশের কালো কালো আঠা টাইপের ভেলভেটি ব্যাকগ্রাউন্ডে।

বেভ দেখলাম মাইক্রোডট ঠিক কী জানে না। ওকে বুঝিয়ে বললাম, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোপনে তথ্য পাঠানোর জন্য ফোটো শ্রিঙ্ক করে ছোট্ট ডট-এর সাইজে আনা হত। পাতার পর পাতা ছবি একটা ছোট্ট ফুলস্টপ সাইজের মাইক্রোডট-এ সংরক্ষণ করা যেত।”

“আমি বুঝিয়ে বলব, ম্যাডাম। তার আগে মিস অমৃতাকে একটু ফোন করে জিজ্ঞেস করুন সেদিন ডিনারে কেউ ওঁর টিপটা চেয়েছিলেন কিনা।”

বেভ বিস্মিত হয়ে বলল, “ঠিক আছে, করছি।”

বেভ যখন ফোন করছে তখন একেনবাবু কোত্থেকে ছোট্ট একটা ট্যুইজার এনে সাবধানে টিপ থেকে মাইক্রোডটটা তুলে একটা খামে ঢুকিয়ে ফেললেন। ফোনে বেভের কথা শুনে বুঝলাম, একেনবাবু একদম ঠিক। সেই রাশিয়ান মেয়েটিই অমৃতার কপালে টিপ দেখে মুগ্ধ হয়ে পরতে চেয়েছিল। নিজের কপাল থেকে খুলে অমৃতা টিপটা লাগিয়ে দিয়েছিল তার কপালে। মেয়েটি এত খুশি হয়েছিল যে অমৃতা আর সেটা ফেরত নেয়নি।

“থ্যাংক ইউ ম্যাডাম, থ্যাংক ইউ।” বলে একেনবাবু বেভকে টিপটা ফেরত দিয়ে কাকে জানি ফোন করতে ঘরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে নিয়ে এসে হাজির। শুধু হায়, হ্যালো আদান-প্রদান হল। দু-জনের কেউই বসলেন না। একেনবাবু খামটা ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে দিতেই ওঁরা অদৃশ্য হলেন।

ওঁরা চলে যেতেই আমরা লাঞ্চ খেতে বসলাম। প্রমথর তৈরি মোগলাই পরোটা বেভ এই প্রথম খাচ্ছে। আলু-কুমড়ো দিয়ে একটা ছক্কাও বানিয়ে ফেলেছে প্রমথ এর মধ্যে। সেটা খেয়ে বেভের মন্তব্য কুমড়ো দিয়ে বানানো এত সুস্বাদু খাবার আগে নাকি কখনো খায়নি!

“বাপি তোমাকে নেমন্তন্ন না করলে খাবে কী করে!”

“এবারেও তো ও আমাকে নেমন্তন্ন করেনি, ডিয়ার ডিটেকটভ করেছে।” বেভ অনুযোগ ভরা চোখে আমার দিকে এক ঝলক তাকাল।

সবাই কিছুক্ষণ আমার পেছনে ফুট কাটতে লাগল। এর মধ্যেই একেনবাবুর ফোনে একটা টিং করে শব্দ হল— মেসেজ এসেছে। মেসেজটা দেখে একেনবাবু বললেন, “ওটা মাইক্রোডট, এখন কনফার্মড।”

“বাঃ, তাহলে তো হয়েই গেল।” প্রমথ বলল, “এবার বলুন কী মনে হচ্ছে আপনার, অবশ্য যদি বিশেষ গোপন কথা না হয়।”

“আরে না স্যার, এখানে আর গোপন ব্যাপার কী। তবে বেভ ম্যাডাম তো ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানেন না।”

“তাতে কী, আমি বলে দিচ্ছি।” মিথিলেশের ওভারসিজ ব্যাঙ্কে অজস্র টাকা

জমা পড়ার কথা বেভকে বললাম।

“অমৃতাকে যারা ইন্টারভিউ করেছিল সম্ভবত সেই কোম্পানিই এই টাকা জমা দিয়েছে। যা শুনবে সব কিন্তু কনফিডেনশিয়াল।”

“আই নো।”

“ব্যস,” প্রমথ এবার একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “বলুন, এ-যুগে মাইক্রোডট কেন ব্যবহার করা হচ্ছে! ফ্ল্যাশ ড্রাইভে, মোবাইলে, নেট ব্যবহার করে ডার্ক ওয়েবেও তো তথ্য পাঠানো যায়। সেটাই তো এখনকার দস্তুর।”

“তা ঠিক স্যার। মুশকিল হল এখানে যে তথ্যগুলো যাচ্ছে, সেগুলো মিথিলেশবাবুর হাতে লেখা কিছু নোটস। স্ক্যান করে ছবি তুলে পাঠাতে গেলে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। মিথিলেশবাবু যে ভালো ফোটোগ্রাফার সেটা ধরতে পেরেছিলাম ম্যাডাম অমৃতার মিনিয়েচার ছবি তোলার খবর থেকে। ফোটো শ্রিঙ্ক বা ছোটো করার টেকনিক ওঁর ভালোই জানা ছিল। বেভ ম্যাডান, আপনি একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলেন না মাইক্রোডট কী? ওটা ফোটোগ্রাফ, কিন্তু খুব ছোটো সাইজের কীভাবে ওটা বানানো হয় বলি। হাতে লেখা পাতার ছবি তুলে প্রথমে তার থাম্বনেল সাইজের প্রিন্ট করতে হয়। এই থাম্বনেল প্রিন্টের ছবি যদি রিভার্স মাইক্রোস্কোপের মধ্যে দিয়ে তোলা যায়, তাহলে সাইজে সেটা বিন্দুর মতো হয়ে যায়।”

“রিভার্স মাইক্রোস্কোপ কী?” বেভ স্কুলছাত্রীর মতো জিজ্ঞেস করল।

আমিও কথাটা আগে শুনিনি, কিন্তু বুঝতে পারলাম একেনবাবু কী বলতে চাইছেন। উনি বেশ সহজ করে বুঝিয়ে বললেন, “মাইক্রোস্কোপে ছোটো জিনিস বড়ো দেখায়, রিভার্স মাইক্রোস্কোপে বড়ো জিনিস ছোটো দেখায়। সবই লেন্সের ব্যাপার ম্যাডাম। ওঁদের ল্যাবে এসব করার সব যন্ত্রপাতিই আছে। ছবি তো উঠল, কিন্তু মুশকিল হল সেটা পাচার করবেন কী করে! তখনই সম্ভবত বিন্দি ব্যবহার করার প্ল্যান ওঁর মাথায় আসে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “তার আগে বলুন তো, মিথিলেশ এরকম কাজ করল কেন— অত বড়ো একজন রিসার্চার?”

“সেইটেই একটা খটকা স্যার, টাকার হিসেবটাই মিলছিল না। আসলে উনি অর্থ ভালোবাসতেন, টাকার জন্য দু-বার বিয়ে করেছিলেন। আমি বলব টাকার জন্যেই মিস অমৃতার সঙ্গে উনি প্রেম করেছিলেন। মিস অমৃতার নানান ছবি ছোটো করে এক কলিগের ক্যাবিনেটে রেখে দেওয়াটা সম্ভবত অ্যাক্সিডেন্ট নয়, প্রি-প্ল্যানড। চেয়েছিলেন নিজের কার্যসিদ্ধি করে ম্যাডাম অমৃতাকে কলেজ এবং নিজের জীবন থেকে তাড়াতে। কলেজ তাড়িয়ে দিলে ম্যাডাম এদেশে থাকতে পারবেন না উনি জানতেন। আসলে ওঁর প্রেম ছিল শুধু রিসার্চ আর টাকায়। আমি নিশ্চিত ম্যাডাম এই মাইক্রোডটের ব্যাপারটা জানতেন না, কিন্তু ম্যাডামের চরিত্র মিথিলেশবাবু জানতেন। কেউ ওঁর টিপ পরতে চাইলে ম্যাডাম সানন্দে সেটা দিয়ে দেবেন। তাই মাইক্রোডটটা ম্যাডাম অমৃতাকে দিয়ে পাঠালেন। শুধু এইটুকুই হিন্দ-রাশিয়া কোম্পানিকে জানিয়েছিলেন। কোনো কারণে ধরা পড়লে মিস অমৃতা পড়তেন। উনি পুরো ব্যাপারটাই অস্বীকার করতেন। মুশকিল হল কালো বিন্দিটা লাল শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করছিল না বলে বেভ ম্যাডাম একটা লাল বিন্দি মিস অমৃতাকে পরিয়ে দিলেন। ফলে টিপের মধ্যে কিছু না পেয়ে শেল কোম্পানি ধরে নিল মিথিলেশবাবু টাকা পকেটস্থ করে ওদের ঠকিয়েছেন। মিথিলেশ খুন হলেন।”

প্রমথ শব্দ করে জমানো নিঃশ্বাস ছাড়ল, “উফফ!”

“সবচেয়ে বড়ো কথা, বেভ মাডাম আমাদের সবাইকে বাঁচিয়েছেন ওঁর কালার ম্যাচিং সেন্স-এর জন্য।” বক্তৃতা শেষ করে বেভের দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন, “থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।”

“ইউ আর ওয়েলকাম, ডিটেকটিভ। কিন্তু মাইক্রোডট কী করে পড়ে সেটা তো বললে না?’

“ম্যাগনিফাই করে। পুলিশ ল্যাবে ওসব করার জিনিস আছে।”

“এবার একেবারে ক্লিয়ার, ডিটেকটিভ ডিয়ার! ইউ আর সো স্মার্ট! আর জানো, আরও একটা জিনিস তুমি প্রমাণ করলে- আমার বন্ধু অমৃতা নির্দোষ। একটা ক্রিমিনাল জিনিয়াসকে ভালোবাসা তো অপরাধ নয়, তাই না?”

প্রমথ গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বেভকে বলল, “একটা গোবেচারা নন-জিনিয়াসকে ভালোবাসাও অপরাধ নয়।”

কত বড়ো রাস্কেল! ও কী বলছে একটা গাধাও বুঝতে পারবে।

Tags:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *