অসম্মানের বিদায়
।।১।।
বেভ এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছে। বেভের সম্বন্ধে আগেও আমি লিখেছি, আমাদের ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি। প্রমথ আর একেনবাবু বেশ কয়েক বছর ধরে আমাকে উত্ত্যক্ত করে যাচ্ছে বেভকে নিয়ে। অস্বীকার করব না, বেভের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। কিন্তু আমি সতর্ক, আমাদের সম্পর্ক কখনো বন্ধুত্বের বেশি যাবে না। মা-কে কথা দিয়েছি ওঁর পুত্রবধূ মেমসাহেব হবে না। এরকম কথা দেওয়া এ-যুগে খুবই হাস্যকর, তা কি আর জানি না! থাক ওসব কথা, হঠাৎ করে বেভের এই আসার কারণ একেনবাবু। কলেজে আমার অফিসে বসে ‘বম্বে প্যালেসে’র খাবার নিয়ে কথা হচ্ছিল। মেনুতে কোনো বাঙালি ডিশ আছে কিনা জানতে চাইছিল বেভ। সেইসময় ঘরে ছিলেন একেনবাবু। হঠাৎ বলে উঠলেন, “ম্যাডাম, বম্বে প্যালেসে বাঙালি খাবার মিলবে না। বাঙালি রান্না খেতে চাইলে আপনাকে প্রমথবাবুর রান্না খেতে হবে। আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড!”
“সত্যি?”
“একদম! কালকেই চলে আসুন না ম্যাডাম!” বলেই আমার দিকে তাকালেন, “কী বলেন স্যার?”
একেনবাবুর যদি কোনো আক্কেল থাকে! কোনো মেয়েকে হুট করে এভাবে কেউ নেমন্তন্ন করে! বেভ জানে ওকে নিয়ে কাল বম্বে প্যালেসে যাচ্ছি। শুক্রবার বেশি ভিড় হয় বলে টেবিল রিজার্ভেশনও করেছি। কী করে পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করব ভাবছি, মুচকি হেসে বেভ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “হাউ অ্যাবাউট এ রেইন চেক?”
“নিশ্চয়।”
“থ্যাংক ইউ ডিটেকটিভ, আই অ্যাম গেইম।”
যাঁরা মার্কিনি আদবকায়দায় অভ্যস্ত নন, তাঁদের বলি কী কথা চালাচালি হল। বেভ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আরেক দিন যেতে পারি (অর্থাৎ, বম্বে প্যালেসে?”
আমার ‘নিশ্চয়’ উত্তর শুনে একেনবাবুকে বলল, “আমি রাজি।”
বেভ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই একেনবাবুকে চেপে ধরলাম, “এটা কী করলেন, দুম করে নেমন্তন্ন করে দিলেন বেভকে? প্রমথ বাড়িতে থাকবে কিনা জানেন না, আমারও তো অন্য প্ল্যান থাকতে পারে!
“কী যে বলেন স্যার, আমি তো জানি প্রমথবাবু বাড়িতে থাকবেন। আর আপনার প্ল্যান তো বেভ ম্যাডামকে নিয়েই বম্বে প্যালেসে যাওয়া।”
“সেটা বুঝলেন কী করে?”
“অল্প একটু গেস-ওয়ার্ক স্যার। কাল যখন প্রমথবাবুকে বলেছিলেন, শুক্রবার বাড়িতে ডিনার খাবেন না, তখনই মনে হয়েছিল। আর একটু আগে দেখলাম বেভ ম্যাডাম বম্বে প্যালেসের মেনু-তে বাঙালি ডিশ খুঁজছেন।”
“বুঝলাম। এবার বিদায় হন তো, গিয়ে দেখুন প্রমথ রান্না করতে রাজি হবে কিনা! আমি কিন্তু ওকে কিচ্ছু বলতে পারব না।”
“বলতে হবেও না স্যার।” একগাল হেসে একেনবাবু চলে গেলেন।
এখানে বেভকে নিয়ে দু-একটা কথা বলে নিই, আগে মনে হয় লিখিনি। যা লিখেছি তা হল বেভ ওর প্রয়াত মায়ের সূত্রে অনেক সম্পত্তির মালিক, কিন্তু ওর দাদুর সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্ক খুব বাজে ছিল বলে সেটা নিতে চায়নি। মাস ছয়েক আগে হঠাৎ একদিন অফিসে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল, “তুমি তো জানো আঙ্কল জ্যাক আমাকে অনেক দিন ধরে চাপ দিচ্ছে মায়ের সম্পত্তিগুলো নিতে। এতদিন রাজি হইনি, কিন্তু এখন ভাবছি নেব। তুমি কী বলো?”
বেভের এই আঙ্কল জ্যাককে আমি চিনি, ম্যানহাটানে ওঁর অ্যাপ্লায়েন্স এবং ইলেকট্রনিক্স-এর বিশাল শোরুম। বেভের মায়ের সম্পত্তির উনি ট্রাস্টি বা এক্সিকিউটার। বেভকে খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন!
“আমার বলার কী আছে বেভ, এটা তো তোমার ব্যাপার!”
“তোমার মতটা আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট, উত্তর দাও।”
মনে হল কোটি কোটি ডলারের সম্পত্তি পেলে তো এই চাকরি আর করবে না। সেই অ্যাঙ্গেল থেকেই উত্তর দিলাম, “তোমাকে আমরা মিস করব, কিন্তু যেটা তোমার ন্যায্য পাওনা সেটা নেবে না কেন?”
“কিন্তু তুমি তো ইনহেরিটেন্সে বিশ্বাসী নও।”
“আরে সে তো দু-দশ টাকার ক্ষেত্রে, এখানে তো কোটি কোটি টাকার কথা বলছ!”
এ নিয়ে আর কথা হল না। দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার আগে বেভ বলল, “আমাকে মিস করার প্রশ্নই নেই, চাকরি আমি ছাড়ব না।”
বিকেলে বাড়ি ফিরে প্রমথর রুদ্রমূর্তি দেখব ভেবেছিলাম, অ্যাডভান্স নোটিস না দিয়ে এ-ভাবে কাউকে খেতে ডাকলে ওটাই ওর নর্মাল রিয়্যাকশন। সেটা তো নয়ই, উলটে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “বুঝলেন একেনবাবু, আমরা হেল্প না করলে নিজের মুরোদে বাপি কোনোদিনই বেভকে পাবে না।”
পারফেক্ট রাস্কেল! আর এটা তো কেবল শুরু, বৃহস্পতিবার রাত্রি থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত রান্না করতে করতে লাগাতার আমাকে খোঁচা দিয়ে চলল। ঠিক এই কারণেই ওর দুর্দান্ত রান্নার কোনো বিবরণ আমি দেব না!
।। ২।।
শুক্রবার কাঁটায় কাঁটায় ছ-টার সময় বেভ এসে হাজির। এমনিতেই বেভ সুন্দরী, কিন্তু সাজগোজের জন্য আজকে ওকে স্টানিং লাগছে! একেনবাবুকে বলল, “থ্যাংক ইউ, আমাকে নেমন্তন্ন করার জন্য। বাপিকে এতদিন ধরে চিনি, কিন্তু কোনোদিন ডাকেনি!”
“মাই প্লেজার ম্যাডাম!” শুধু এটা বললেই চুকে যেত, কিন্তু যোগ করলেন, “আসলে বাপিবাবু একটু লজ্জা পান!”
বেভ আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
আমি কিছু বলার আগেই প্রমথ বলল, “বাপিকে নিয়ে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব, তার আগে ড্রিঙ্কসের কথা জিজ্ঞেস করি, কী নেবে?”
“ওয়াইন আছে?”
“আছে। কেন জানি না বাপি হঠাৎ গতকাল রিজলিং কিনে এনেছে!
প্রমথ ভালো করেই জানে বেভ রিজলিং পছন্দ করে। রিজলিং একটা সুগন্ধি সাদা মদ, জার্মানির রাইন নদীর আশপাশ থেকে তোলা আঙুর থেকে তৈরি। আমরা কেউই ওয়াইন খাই না, কিনেছি বেভের জন্যেই।
“সো সুইট।” বলে আমার দিকে তাকাল বেভ।
বেভকে সঙ্গ দেবার জন্য সবাই অল্প করে ওয়াইন নিলাম।
“চিয়ার্স,” ওয়াইনে চুমুক দিয়ে বেভ বলল, “জানো, পাশের বাড়িতে আমি ক-দিন আগেই এসেছিলাম? তখন অবশ্য জানতাম না, এটা তোমাদের বাড়ি।”
“পাশের বাড়িতে? কার কাছে এসেছিলেন ম্যাডাম?”
“কারও কাছে না, এসেছিলাম একজনকে নামাতে।”
আমাদের পাশের বাড়ি বলতে এখন একটাই। অন্যদিকে যে বাড়িটা ছিল, সেটা ভেঙে একটা পার্কিং লট হয়েছে। পাশের বাড়িটাও খুব পুরোনো, শিগগিরি নাকি ভেঙে ফেলা হবে! নোটিস পেয়ে বেশিরভাগ ভাড়াটেই চলে গেছে। যারা আছে, তাদের দু-একজনের সঙ্গে পাড়ার রকমারি স্টোরে দেখা হয়। একজন হল আবদুল সৈয়দ, তার আবার রকমারি স্টোরের মালিক আব্বাসির সঙ্গে বেশ দোস্তি। আব্বাসিই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। ওর দেশের লোক, মানে কায়রোর। বিজনেসম্যান, কেমিক্যাল সাপ্লাইয়ের ব্যাবসা। তারপর থেকে আবদুলের দেখা হলে সবসময়ই দু-চারটে কথা হয়।
দ্বিতীয় জন ড্যান, পেশায় প্লাম্বার অর্থাৎ কলের মিস্তিরি। অবজ্ঞা করবেন না, এদেশে ওই প্রফেশনে যা রোজগার আমার মতো পাতি-অধ্যাপকদের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। একবার বাথটাব ড্রেন দিয়ে এক ফোঁটা জলও যাচ্ছিল না! প্লাম্বার পাচ্ছিলাম না, সবাই সুপার বিজি। তখন আব্বাসি ড্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। খুবই এফিশিয়েন্ট, ঝটাপট পাইপ-টাইপ খুলে পরিষ্কার করে দিয়েছিল। তবে গল্প করতে পারে বটে। ওদের বিল্ডিং ভাঙার কারণটা তখনই ভালো করে জেনেছিলাম। পুরোনো বাড়ি বলে অনেক বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, ‘গ্র্যান্ড-ফাদার’ ক্লজে এতদিন ছাড় পেয়ে যাচ্ছিল। ‘গ্র্যান্ড ফাদার’ ক্লজ হল নিয়মকানুন মেনে যে- সব বিল্ডিং এককালে বানানো হয়েছিল, এখনকার নতুন নিয়ম মানা হয়নি বলে সেগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করা যায় না। পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিতে হয় ত্রুটিগুলো ঠিক করার জন্য। সেই সময়টাও এখন পার হতে চলেছে। সিটি ইন্সপেকশনে বিল্ডিংকে পাশ করাতে হলে বিল্ডিং-এর পেছনে যে পরিমাণ টাকা খরচ করতে হবে, তার থেকে পুরোটা ভেঙে ফেলে নতুন বাড়ি তোলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ওদের বাড়ি ছাড়ার নোটিস ছ-মাস আগেই দেওয়া হয়ে গেছে, সেই ছ-মাসের বাকি আছে মাত্র দু-মাস। ড্যানের তাতে খুব একটা সমস্যা নেই। একটা নতুন কন্ডোমেনিয়াম কিনেছে তিন ব্লক দূরে, সেটার কাজ এই মাসেই শেষ হয়ে যাবে।
“কংগ্র্যাচুলেশনস, তার মানে তো ক-দিন বাদেই ঝাঁ-চকচকে একটা অ্যাপার্টমেন্টে যাচ্ছ।”
ড্যান বলল, “ওল্ড ইজ গোল্ড। বিল্ডিং-টা পুরোনো হতে পারে, কিন্তু এর দরজা-জানলা, হার্ডউড ফ্লোর সব ওক কাঠের। ওইরকম কোয়ালিটি এ-যুগে মিলবে না। বাথটাবগুলো মেটালের তৈরি, ঠুনকো ফাইবার গ্লাসের নয়। ফিটিংসগুলো হ্যান্ডমেড এক্সপেন্সিভ অ্যান্টিক ব্র্যান্ড। আই উইল মিস দিস প্লেস।”
ড্যান আর আবদুল ছাড়া আরও একজনকে আব্বাসির দোকানে দেখেছি, সে হল অ্যালেক্স। শক্তপোক্ত চেহারা, পেশায় ফার্নিচার মেকার, কথাবার্তায় একটু রাফ সেটা ওর চরিত্র না ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাব বলতে পারব না। তবে ড্যানের মতে ‘অ্যালেক্স দ্য গ্রিক’ খুবই আনফ্রেন্ডলি, কারোর সঙ্গে মেশে-টেশে না। স্ত্রী স্যান্ডি আর বছর চারেকের মেয়ে নিয়ে বেশ কয়েক বছর হল বিল্ডিং-এ আছে। তার ওপর ফার্নিচার বানানোর নানান কাজ বাড়িতেই করে, যেটা ড্যানের মতে বেআইনি। বিশাল উড ওয়ার্কিং বেঞ্চ আর নানান টুলস রেখে একটা বেডরুমকে প্রায় ওর ওয়ার্কশপ বানিয়ে ফেলেছে! বাইরে থেকে বিল্ডিং-এ ঢুকে লবিতে যারা ভিড় করে তাদের বেশিরভাগই অ্যালেক্সের কাস্টমার। তাদের সামাল দেয় অ্যালেক্সের বউ স্যান্ডি। ড্যানের মতে স্যান্ডির মাথায় একটু সমস্যা আছে। যখন-তখন অকারণে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করে। প্রথম দিন ওকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে ড্যান ভেবেছিল লিফট কাজ করছে না। ড্যানও সিঁড়ি দিয়ে তেতলায় উঠছিল অ্যাপার্টমেন্টে যাবে বলে। হঠাৎ স্যান্ডি জিজ্ঞেস করে, ‘তুমিও কি পাহাড়ে উঠবে বলে সিঁড়ি-ভাঙা প্র্যাকটিস করছ?’ তখনই ড্যান বুঝতে পারে যে মহিলার স্ক্রু-টা একটু ঢিলে!
অ্যালেক্সের কাঠ-কাটা আর ড্রিল করার আওয়াজ নিয়ে সবচেয়ে বেশি যিনি কমপ্লেইন করেন, তিনি বৃদ্ধা আর্টিস্ট ডরোথি—এই বাড়ির চতুর্থ ভাড়াটে। গত বছর ডরোথি তাঁর পঙ্গু স্বামীকে হারিয়েছেন। স্বামী জীবিত থাকতে মাঝে মাঝে তাঁকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে রাস্তায় বেরোতেন। ইদানীং নিজের হাঁটুতেও সমস্যা হচ্ছে, বাড়ির বাইরে তেমন আসেন না। ‘মিলস অন হুইল’ টাইপের কোনো সংস্থা বাড়িতে এসে খাবার দিয়ে যায়। হঠাৎ কিছু কেনার দরকার পড়লে ড্যানের সাহায্য নেন। আবদুল বা অ্যালেক্স কাউকেই উনি পছন্দ করেন না। অ্যালেক্সকে অপছন্দ কাঠের আওয়াজের জন্য, আবদুলের ওপর চটা ওঁকে কুকুর পুষতে দিচ্ছে না বলে। ডগ অ্যাডপশন এজেন্সি থেকে একটা কুকুর এনেছিলেন, কিন্তু আবদুল বাড়িওয়ালাকে অভিযোগ করে তাকে তাড়িয়েছে।
এই দেখুন, কোত্থেকে কোথায় চলে এলাম! যাইহোক, ভাবছিলাম বেভকে জিজ্ঞেস করব যাকে ও ড্রপ করল সে এদের কার কাছে এসেছিল, কিন্তু তার আগেই একটা অঘটন! বেভ যে চেয়ারে বসেছিল, সেটাতে পেছনে হেলান দিতে গেলে ব্যাক-রেস্টটা এত দ্রুত হেলে পড়ে— অসাবধান হলেই উলটে যাবার সম্ভাবনা। বেভ প্রায় পড়েই যাচ্ছিল! কোনোমতে ওকে ধরে সামাল দিলাম। বেশ কিছুটা ওয়াইন চলকে পড়ল! “সো সরি, তোমাকে সাবধান করা উচিত ছিল।” বলে পাশের একটা চেয়ারে যখন ওকে বসাচ্ছি, মজা করেই জিজ্ঞেস করল, “আর ইউ শিওর, দিস ওয়ান ইজ সেফ?” সত্যি, কী এমব্যারাসিং! প্রমথর রান্নার প্রশংসা করব না ঠিক করেছিলাম, কিন্তু ওর রান্নাই যাকে বলে ‘সেভড দ্য ডে!’ বেভ নাকি জীবনে এত ভালো খাবার খায়নি। বেভকে প্রমথ এমনিতেই পছন্দ করে, কিন্তু এই কথাটা শুনে আমার কানে কানে বলল, “এরকম খুবসুরত খাসা মেয়েকে মাতৃভক্তি দেখাতে গিয়ে যদি হারাস, তাহলে তুই একটা প্রাইজ ইডিয়ট!”
বেভ আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী আলোচনা করছ তোমরা দু-জন?”
এত রাস্কেল প্রমথটা, কী উত্তর দিই এখন? প্রমথই বাঁচাল, “বাপিকে বলছিলাম, তুমি হচ্ছ সত্যিকারের কনোসার অফ ফুড, খাবারের ভালো-মন্দ দুর্দান্ত বোঝো।”
“থ্যাংক ইউ শেফ। তুমি কিন্তু আমাকে বাঙালি রান্না শিখিয়ে দেবে।”
“শিওর, এনি টাইম।”
আমি বললাম, “তুমি রান্না করার সময় পাবে কোথায়, বেভ? তোমাকে তো এখন প্রপার্টি সামলাতে হবে। আমি বলি কী, তুমি বরং প্রমথকে কুক হিসেবে রাখো, আর একেনবাবুকে তোমার সিকিউরিটি হেড।”
“বেশ, আর তুমি?”
“তুমি বাপিকে পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নাও, কারণ ও হচ্ছে গুড ফর নাথিং!”
খিলখিল করে হাসল বেভ। “তোমরা সঙ্গে থাকলে তো আমার চিন্তাই থাকবে না। সত্যি, এই প্রপার্টি বিজনেস আমার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে! আঙ্কল জ্যাক অবশ্য অনেক সাহায্য করছে। আগে পুরো সময়টা ছিল আমার। এখন দেখো, কাল সকালে আমাকে ছুটতে হবে গ্রেনিচে। কী একটা ঝামেলা হয়েছে ভাড়াটেদের সঙ্গে, রবিবারও মনে হয় ওখানে কাটাতে হবে। ভাবছি, সব কিছু বিক্রি করে দেব।”
“গুড আইডিয়া, তারপর তিন মাসের জন্য ওয়ার্ল্ড ক্রুজে চলে যাও।” প্রমথ নিদান দিল।
বেভ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ছুটি তো পাব না, তাই না?”
“চাকরি থেকে রিজাইন করো। এই বাপি ব্যাটার সঙ্গে কাজ করতে তোমার ভালো লাগে?”
এইসব আগড়ম-বাগড়ম গল্প করতে করতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল।
বুঝতে পারছিলাম বেভ ভীষণ খুশি হয়েছে আমাদের বাড়িতে এসে। যাবার আগে সবাইকে জড়িয়ে হাগ করার পর, একেনবাবুর গালে একটা চুমুও দিল নেমন্তন্ন করার জন্য।
একেনবাবু তো লাল-টাল হয়ে একাকার! চলে যাবার পর আমাদের বললেন, “বেভ ম্যাডাম একেবারে এক ঝলক সানশাইন!”
।।৩।।
সোমবার অফিসে পৌঁছে দেখি বেভ তখনও আসেনি। পার্ট-টাইম সেক্রেটারি জর্জ একা অফিসে বসে আছে, খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
“কী হয়েছে জর্জ?”
“জারার খোঁজ পাচ্ছি না!”
জর্জের গার্লফ্রেন্ড জারা। ছোটোখাটো চেহারার মিষ্টিমতো একটি মেয়ে। মাঝে মাঝে জর্জের কাছে আসে দেখি। বেভ ওদের দু-জনকেই খুব পছন্দ করে।
“খোঁজ পাচ্ছ না মানে?”
জর্জের উত্তর একটু অসংলগ্ন। যেটুকু বুঝলাম, জারা কিছুদিন ধরে খুব স্ট্রেসের মধ্যে ছিল। দেশ থেকে বিয়ে নিয়ে ওর ওপর খুব চাপ আসছিল। বাবা-মায়ের ইচ্ছে ওর বিয়ে হয় পারিবারিক বন্ধু, কায়রোর মাঝবয়সি এক হোটেল-মালিকের সঙ্গে। জারার তাকে খুবই অপছন্দ। জর্জকে বলেছে ‘চলো, আমরা বিয়ে করে ফেলি।” সেটা কথার কথা। জারাও জানে, জর্জের পক্ষে এখন বিয়ে করা অসম্ভব! জর্জের মা মরণাপন্ন, জর্জ নিজে স্ট্রাগল করছে। জারা এখানে স্টুডেন্ট ভিসা-তে, বাবা টাকা পাঠাচ্ছে বলে পড়াশুনো করতে পারছে। বাবার অমতে বিয়ে করলে, সেটা বন্ধ হবে। ওর যা ভিসা, তাতে চাকরি করতে পারবে না। জর্জের পক্ষে জারাকে সাপোর্ট করা অসম্ভব। জারা মাঝে মাঝে বলছে ও এই চাপ আর নিতে পাচ্ছে না, একদিন পালিয়ে যাবে! কত বয়স হবে জারার? আঠেরো-উনিশ? এরকম মিষ্টি একটা মেয়ে এতটা মানসিক চাপে আছে?
“তুমি কি ভাবছ জারা কোথাও পালিয়ে গেছে?”
“না, না, থিংস আর মাচ বেটার নাউ। ফাইনালি ওর ইচ্ছের কথাটা আঙ্কল আর দাদা বুঝতে পেরেছেন এবং মেনেও নিয়েছেন। দু-জনেই এদেশে থাকেন, জারাকে খুব সাপোর্ট করছেন। ইন ফ্যাক্ট, অবস্থা এতটাই ভালো যে জারা পেনসিলভেনিয়াতে এক বিয়ের নেমন্তন্নে গিয়েছে ওর দাদা আর আঙ্কলের সঙ্গে। সেখানে পৌঁছে ফোন করবে বলেছিল, কিন্তু করেনি। ফোনও বন্ধ। তাই চিন্তা হচ্ছে।”
এর অনেক কারণ থাকতে পারে। ফোন হারিয়ে গেছে, সিম কার্ড গণ্ডগোল করছে, নেটওয়ার্ক সমস্যা, কত কিছু। আমি নিজে একবার ফোন হারিয়ে ফ্যাসাদে পড়েছিলাম। প্রমথর সঙ্গে এক জায়গায় যাবার কথা ছিল। কিন্তু ওর মোবাইল নম্বরই মনে পড়ছিল না, নম্বর তো সব ফোনে সেভ করা থাকত। তার ওপর ফোন হারিয়ে মেজাজটা এত বিগড়ে গিয়েছিল, কাউকে দিয়ে যে প্রমথকে খবর দেব, তার মুডও ছিল না। বাড়ি ফিরে অবশ্য প্রমথর কাছে বিস্তর গালাগাল খেতে হয়েছিল!
জিজ্ঞেস করলাম, “আগে কখনো এরকম হয়েছে?”
“না, জারা খুব রেস্পন্সিবল।”
“শেষ কখন কথা হয়েছিল?”
“বুধবার দুপুরে।”
“ওর আঙ্কল কোথায় থাকেন?”
রাস্তার যে নাম বলল, সেটা আমাদেরই বাড়ির রাস্তা। ইতিমধ্যে বেভ এসে গেছে। জারার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সে কী! বুধবারই তো তোমাদের পাশের বাড়িতে ওকে ড্রপ করলাম!”
ও মাই গড! খবরটা তো জানতাম, দুটোকে কানেক্ট করতে পারিনি!
আমি জর্জের দিকে তাকাতে, একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “মা-র হঠাৎ একটা সিজার হওয়ায় হাসপাতালে ছুটতে হয়েছিল। নইলে আমারই জারাকে পৌঁছে দেবার কথা ছিল। তখন ওর আঙ্কলের সঙ্গে পরিচয় হত।”
জানতাম জর্জের মা-র ব্রেন ক্যানসার, অবস্থা চিকিৎসার বাইরে। মাঝে মাঝেই সিজার হয়। খবর এলেই জর্জ হাসপাতালে হসপিস কেয়ার ইউনিট-এ ছোটে। এইসবের মধ্যেই জর্জ তার দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন করে বিব্রত করি না।
জর্জকে জিজ্ঞেস করলাম, “পুলিশে খবর দিয়েছ?”
“বুঝতে পারছি না দেব কি না।”
“জারা-র আত্মীয়স্বজন কেউ এখানে থাকে না?”
“আত্মীয়স্বজন বলতে কাকা আর দাদা। কারোর সঙ্গেই পরিচয় হয়নি, ফোন নম্বরও জানি না।”
“পাড়াতুতো বা দূর-সম্পর্কের কেউ নেই?”
“ওর কাজিনের নম্বর আমি জানি, লং আইল্যান্ডে থাকে। তাকেও ধরতে পারছি না।”
“এখানে জারা কোথায় থাকে?”
“ম্যাডিসন স্কোয়ার পার্কের কাছে, ওর বাবা-মা’র পরিচিত এক ফ্যামিলির পেয়িং গেস্ট হয়ে। বাড়িটা চিনি, ভদ্রলোকের নাম অ্যান্ড্রু উড।”
“তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছ?”
“তাঁরা কিছুই জানেন না। ওঁদের বলে গিয়েছিল রোববার ফিরবে।”
“রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হল কিনা কে জানে! পুলিশকে তো মনে হয় একটা খবর দেওয়া উচিত!”
আমি আর জর্জ যখন এইসব কথাবার্তা বলছি, বেভ তখন একেনবাবুকে ফোন করছে।
“ডিটেকটিভ, তুমি কোথায়? একটু আসবে?”
আমার একটা ক্লাস ছিল। সেটা শেষ করে যখন ফিরলাম, একেনবাবু আমার ঘরে বসে জর্জ আর বেভের সঙ্গে কথা বলছেন। ঘরে ঢুকতেই জর্জ একটা ফোন ধরতে ওর ডেস্কে গেল। একেনবাবু বেভকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি যে মিস জারা-কে বুধবার ড্রপ করলেন, কোত্থেকে ওঁকে তুলেছিলেন?”
“একটা ডাফল ব্যাগ নিয়ে এখানেই এসেছিল, জর্জের সঙ্গে ওর আঙ্কলের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। তখনই হাসপাতাল থেকে জর্জের ফোন এল।”
“ক-টার সময়ে মিস জারা-কে ড্রপ করলেন ম্যাডাম?”
“বিকেল পাঁচটা নাগাদ। আসলে ও একাই যাচ্ছিল, আমিই বললাম, ‘বাড়ি যাবার পথে নামিয়ে দেব।”
“আপনি কি ওঁর সঙ্গে বাড়িতে ঢুকেছিলেন?”
“না। তবে কেউ এসে দরজা খুলে দিয়েছিল। পরিচিতই হবে, আমাকে হাত নেড়ে জারা দরজা বন্ধ করে দিল।”
আমি একেনবাবুকে বললাম, “আপনি একটু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে বলুন না, একটি জলজ্যান্ত মেয়ে এভাবে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল!”
“সত্যিই অদৃশ্য হয়েছেন কিনা জানি না তো স্যার।”
“তার মানে?”
“মানে স্যার…”
উত্তরটা শোনার আগেই জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, পাশের বাড়িতে কার কাছে যেতে পারে মেয়েটি? আবদুল? আঙ্কল যখন, আবদুল হবার সম্ভাবনাই বেশি— তাই না?”
“সবাইকে তো আমরা চিনি না স্যার। তা ছাড়া কেউ দরজা খুলে দিলেই তো ধরে নেওয়া যায় না স্যার তিনি ওখানেই থাকেন। কেউ তো বেড়াতেও আসতে পারেন ওই বাড়িতে!”
“তা ঠিক। ওর দাদাও তো হতে পারে।”
“তবে বেভ ম্যাডাম যখন চাইছেন একটু খোঁজখবর তো করতেই হবে।”
“থ্যাংক ইউ ডিটেকটিভ।”
এসবের মধ্যেই জর্জ ফিরে এসেছে। বলল, “মিস্টার উড পুলিশকে রিপোর্ট করেছেন। জানিয়েছেন, জারার রবিবার ফেরার কথা, এখনও বাড়ি ফেরেনি!
যোগাযোগও করা যাচ্ছে না!”
নতুন কোনো খবর নয়, কিন্তু বেভ যেন আরও বিচলিত। একেনবাবু বললেন, “চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। পুলিশ খোঁজখবর করবে, অ্যাক্সিডেন্ট বা অঘটন কিছু ঘটে থাকলে খবর পাওয়া যাবে।”
“তুমি বলছ?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম, আর আমিও ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে বলে রাখব খোঁজার ব্যাপারে একটু চাপ দিতে। তাতে কাজ কতটা হবে জানি না।”
“আর ইউ কিডিং, তুমি বললে কাজ নিশ্চয় হবে।”
“কী যে বলেন ম্যাডাম!”
।।৪।।
বিকেলে কলেজ থেকে ফেরার পথে পাঁউরুটি কিনতে আব্বাসি-র দোকানে থেমেছি, দেখি আবদুল একেনবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। আমি অবাক, এর মধ্যেই একেনবাবু ফিল্ডে নেমে পড়েছেন!
একেনবাবুর প্রশ্নটা শুনতে পাইনি, কিন্তু আবদুলের উত্তর শুনে প্রশ্নটা অনুমান করতে অসুবিধা হল না।
আবদুল বললেন, “হ্যাঁ, জারা আমার ভাইঝি। আপনি জানলেন কী করে?”
“আসলে স্যার, ম্যাডাম জারার এক বন্ধু ক-দিন আগে আপনাদের বাড়ির সামনে ওঁকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। শুনেছি স্যার, আপনার দেশ কায়রোতে। ম্যাডাম জারাও কায়রো থেকে— তাই দুইয়ে দুইয়ে এক করেছিলাম আর কী!”
কথাটা একেনবাবু বললেন একটা বিটকেল ইংরেজিতে- ‘মেকিং টু অ্যান্ড টু ইনটু ওয়ান,’ যার কোনো অর্থ হয় না। আবদুলের ভুরুটা একটু কোঁচকাল
“আসলে একটা প্রশ্ন ছিল স্যার। ওঁর কি কোনো বিয়েতে যাওয়ার কথা ছিল?” এবার আবদুল একটু বিরক্ত হল। “কী ব্যাপার বলুন তো, একটু আগে দু- জন পুলিশ এসে এই নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন করে বলে গেল জারাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না! আমি ওদের বলেছি, জারা কিছুক্ষণের জন্য এসেছিল, খানিক বাদে ওর কোনো বন্ধুর বাড়িতে চলে গেছিল!”
“তাই নাকি স্যার! আসলে কনফিউশনটা হচ্ছে ওঁর নাকি একটা বিয়েতে যাবার কথা ছিল আপনার আর ওঁর এক দাদার সঙ্গে! ব্যাগ-ট্যাগ নিয়েই তো নেমেছিলেন!”
“হ্যাঁ, সেরকমই কথা ছিল, কিন্তু জারার ইচ্ছে ছিল না যাবার। আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিল অন্য কোথাও যাবে।”
“এবার বুঝলাম স্যার। কোথায় যাবেন বলেছিলেন কি স্যার?”
“না, সেটা বলেনি।”
“আশ্চর্য স্যার!”
“কী আশ্চর্য?”
“মানে স্যার, আপনাদের সঙ্গে বিয়ের নেমন্তন্নে যাচ্ছিলেন। ধরে নিচ্ছি আপনাদের বিশেষ পরিচিত কারোর বিয়ে… সেখানে না গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেলেন, অথচ বলেও গেলেন না!”
“এ যুগের মেয়ে, সব কথা তো বলে না!”
“একদম ঠিক স্যার, থ্যাংক ইউ। আমি ওঁর বন্ধুকে জানিয়ে দেব যা বললেন। আসলে তিনিই উদ্বগ্ন হয়ে খোঁজ করছিলেন।
আবদুল যখন চলে যাচ্ছে, তখন একেনবাবু বললেন, “আরেকটা কথা স্যার…”
আবদুল বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
“আপনার দাদাকে কি জানিয়েছেন যে ওঁকে পাওয়া যাচ্ছে না?”
“না, দাদার সঙ্গে আমার সেরকম সদ্ভাব নেই, কথাবার্তা তেমন হয় না। তবে
পুলিশকে ওর কনট্যাক্ট নম্বর দিয়ে দিয়েছি।”
“আরেকটা প্রশ্ন স্যার, জারার দাদা এসেছিলেন কি?”
“হ্যাঁ, এসেছিল। জারা যাচ্ছে না বলে একাই চলে গেল।” এবার বেশ বিরক্ত হয়েই আবদুল উত্তরটা দিল।”
“কিন্তু আপনি তো গেলেন না, স্যার।”
একটা উটকো লোকের এইসব প্রশ্নে আবদুল যে বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু উত্তর দিল, “আমি শুধু যাচ্ছিলাম রাতে যেন জারাকে একা একা ফিরতে না হয় সেইজন্য। ও যখন গেল না, আমিও গেলাম না। আপনি এখন সন্তুষ্ট, না আরও কিছু জানতে চান?” শেষ প্রশ্নে আবদুলের শ্লেষ সুস্পষ্ট।
“থ্যাংক ইউ স্যার, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”
পাঁউরুটি নিয়ে বাড়ি ফিরছি, একেনবাবু আমার সঙ্গে বেরোলেন। বললাম, “আপনি তো দেখছি সিরিয়াসলি ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছেন?”
“বেভ ম্যাডামের আদেশ স্যার, কী করব বলুন?”
“ছাড়ুন ওসব অজুহাত, একজন প্রতিবেশীকে খামোখা চটিয়ে দিলেন!”
“উনি কি খুব রেগে গেলেন স্যার?”
“রাগবেন না! আপনার প্রশ্নের ধরনেই তো মনে হল আপনি ওঁকে অবিশ্বাস করছেন!
“তা একটু করছি স্যার।”
“তার মানে?”
“আপনিই বলুন স্যার, ম্যাডাম জারা ওঁর বয়ফ্রেন্ড মিস্টার জর্জকে বলেছেন আঙ্কল আর দাদার সঙ্গে বিয়েতে যাচ্ছেন। সেইমতো ব্যাগে জামাকাপড় নিয়ে কলেজে এসেছেন, কিন্তু আঙ্কল বলছেন সেখানে ওঁর যাবার ইচ্ছেই ছিল না! এটা কী করে সম্ভব?”
“সম্ভব নয় কেন? হয়তো কোনো কারণে জারা কোথায় যাচ্ছে জর্জকে লুকোতে চেয়েছিল। হয়তো যাচ্ছিল অন্য একটা ছেলের সঙ্গে উইকএন্ডে ফূর্তি করতে। জর্জের যাতে কোনো সন্দেহ না হয়, সেইজন্য বিয়ে আর আঙ্কলের গল্প ফেঁদেছিল!”
“এটা মন্দ বলেননি স্যার, আপনার মাথায় কিন্তু বেশ বদবুদ্ধি খেলে!”
“ঠাট্টা করছেন?”
“কী যে বলেন স্যার!” বলেই দেখি বাড়ির পথে না গিয়ে উলটো দিকে হাঁটা
শুরু করলেন একেনবাবু।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছেন?”
“কয়েকটা প্রশ্ন আছে স্যার, একটু ক্লিয়ার করে আসি।”
“সে তো বুঝলাম, যাচ্ছেন কোথায়?”
“এসে বলছি স্যার।”
বুঝলাম উত্তর দেবেন না। টিপিক্যাল একেনবাবু!
“ফিরবেন কখন? ডিনার খাবেন তো?”
“নিশ্চয় স্যার। প্রমথবাবু আজ ডিমের সেই স্পেশাল ডালনাটা রাঁধছেন, ওটা কি কখনো মিস করতে পারি?”
একেনবাবু ইজ সামথিং!
বাড়িতে ঢুকেই দেখি প্রমথর রুদ্রমূর্তি!
“এই একেনবাবুটাকে এবার তাড়াতে হবে!”
“কেন, কী করলেন?”
“একটা সিম্পল কাজ দিয়েছিলাম; দুটো ডিম ফেটাতে আর চারটে আলু সিদ্ধ করতে। বাড়িতে বিস্কুটের গুঁড়ো আছে, ভেবেছিলাম আলুর চপ করব, বিকেলে চায়ের সঙ্গে জমবে। দেখলাম ফেটানোর বদলে ছ-টা ডিম সিদ্ধ করে বসে আছেন! যখন বকুনি দিতে যাচ্ছি তখন কিনা বলেন, “ডিমের ডালনা করুন স্যার, ওটা আপনার হাতে একেবারে স্বর্গীয়।’ বলে অদৃশ্য।”
“শিগগিরি ফিরছেন না! একটু আগে দেখা হল, একেবারে ডিনারের সময়ে আসবেন।”
“সত্যি, তুই লাই দিয়ে দিয়ে লোকটাকে মাথায় তুলেছিস!”
দু-জনে মিলে কিছুক্ষণ একেনবাবুর শ্রাদ্ধ করলাম। তারপর জারার নিখোঁজ হবার কথা, একেনবাবু -আবদুলের বাক্যালাপ-আলোচনায় কোনো কিছুই বাদ পড়ল না। তার মধ্যেই প্রমথ ওর রান্নার প্ল্যান শুরু করল।
“ডিমের ডালনা তো করতেই হবে, এ ছাড়া আর কী করা যায় বল তো?
ডাল, আলুপোস্ত, বেগুন ভাজা?”
“ব্যস ব্যস, আর কিছুর দরকার নেই।”
এখন আমার কাজ শুধু একেনবাবুর করা অতি-সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়ানো, চাল সিদ্ধ করে ভাত বানানো, আর প্রমথর খিদমত খাটা।
।।৫।।
একেনবাবু ফিরলেন ডিনারের একটু আগে। একপ্রস্থ রান্না করে প্রমথ আর আমি একটু রেস্ট নিচ্ছি, একেনবাবু ঘরে ঢুকেই বললেন, “উফফ, ডিমের ডালনার কী দারুণ খুশবাই স্যার, নীচ থেকেই পেলাম!
“গন্ধ শুঁকেই ভোজন করুন, আপনার জন্য ডিম নেই।”
“হতেই পারে না স্যার। বাপিবাবু খুব হেল্থ কনশাস, একসঙ্গে দুটোর বেশি ডিম খান না। আর আপনার স্যার, কুসুমকোমল হৃদয়। আমাকে বঞ্চিত করে কখনোই কিছু খাবেন না।”
“খেতে পারলেই ভালো হত। কিন্তু গিয়েছিলেন কোন চুলোয়?” প্রশ্নটা প্ৰমথই করল গজগজ করতে করতে।
“আসলে স্যার মাথায় একটা ম্যাজিক ঘুরছে, কিছুতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না।”
“কী যা-তা বকছেন, কীসের ম্যাজিক?”
“বলছি স্যার, খেতে খেতে বলি?” বলেই খাবার টেবিলে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লেন।
“বসলে তো হবে না, এখনও একটু সময় লাগবে। ডালে সম্বার দেওয়া হয়নি, বেগুনও ভাজা হয়নি।”
“বেশ তো স্যার, আপনি রান্না করুন, গল্পটা না হয় কিচেনেই করি,” বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রমথর পিছন পিছন একেনবাবুও রান্নাঘরে।
ডালে সম্বার দেবার জন্য সর্ষের তেলে পেঁয়াজ, তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কা ভাজতে ভাজতে প্রমথ বলল, “এবার বলুন আপনার ম্যাজিকের কথা।”
ভাজার সুগন্ধ নাকে টেনে নিয়ে চোখ বুজে মাথা নাড়তে নাড়তে একেনবাবু বললেন, “আহা-হা, ডালের সম্বার একটা আলাদা জিনিস!” তারপর শুরু করলেন, “হ্যাঁ স্যার, যা বলতে যাচ্ছিলাম- ছোটোবেলায় নোংরা ধুতি-ফতুয়া পরা টিকিওয়ালা এক ম্যাজিশিয়ানের এক অবিশ্বাস্য জাদু দেখেছিলাম। প্রথমে লোকটা একটা ছোটো মেয়েকে তরকারি রাখার খোলা ঝুড়িতে দাঁড় করিয়ে তাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল। সবাই আমরা লোকটার দিকে তাকাচ্ছি, আর চাদর-ঢাকা মেয়েটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ খড়খড় শব্দ, চাদরটা কোলাপ্স করে ঝুড়ির ওপর পড়ল, মেয়েটা অদৃশ্য! চাদরের নীচে হাত ঢুকিয়ে লোকটা বার করল একটা খরগোশ!”
“বলেন কী! কী করে?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। “বড়ো বড়ো স্টেজে ডিস-অ্যাপিয়ারিং ম্যাজিক দেখেছি, কিন্তু সেখানে তো ধোঁকা দেবার জন্য অনেক ইনস্ট্রুমেন্ট থাকে!”
“তখন বুঝিনি স্যার, এখন মনে হয় ট্রিকটা জানি— মাস হিপ্নোটিজম। আমাদের সবার চোখে চোখ রেখে লোকটা প্রত্যেককে হিপ্নোটাইজ করে দিয়েছিল। তারপর আমাদের যা-যা বলছিল, আমরা সেটাই যেন দেখছিলাম।”
“এরকম করা যায়?”
“যায় স্যার, যায়। আমিই তো একটা ছটফটে চঞ্চল মুরগিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম।”
“মানে?”
“দেশে আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে অনেক মুরগি ছিল। তার একটার মুণ্ডু মেঝেতে চেপে ধরে তিনটে চকের দাগ দিলাম- একটা ওর ঠোঁটের সামনে দিয়ে সোজা। অন্য দুটো দু-দিকে তিরিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। তারপর যখন মুণ্ডু ছেড়ে দিলাম, ওই চঞ্চল মুরগি চোখ বুজে শান্ত হয়ে ঝিম মেরে রইল। যেই তালি দিলাম ঘোর কেটে আবার সেই চঞ্চল।”
“এর সঙ্গে ছোটো মেয়েটার অদৃশ্য হবার সম্পর্ক কী?”
“বলতে চাচ্ছি স্যার হিপ্পোটিজমে অনেক কিছু ঘটতে পারে। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে চঞ্চল মুরগি স্বভাব বদলে শান্ত হয়ে যায়। সেইভাবে ঘোরের মধ্যে যেটা মনে হচ্ছে ঘটছে, সেটা আসলে ঘটছে না।”
একেনবাবুর মাথায় কী যে ঘুরছে ভগবান জানেন!
“গল্পটা তো শুনলাম, কিন্তু এটা নিয়ে হঠাৎ এত চিন্তা করছেন কেন?”
“এই যে ম্যাডাম জারা-র অদৃশ্য হওয়া!”
গরম কড়াইয়ে ডাল ঢালতে ঢালতে প্রমথ বিরক্ত গলায় বলল, “আপনি এত রহস্য করে কথা বলেন কেন মশাই? একটু ঝেড়ে কাশুন না, কী বলতে চান?”
“বলছি এই যে, ম্যাডাম জারা পাশের বাড়িতে ঢুকলেন, তারপর তাঁকে আর পাওয়া যাচ্ছে না—এখানে তো মাস হিপ্নোটিজম কাজ করছে না।”
“পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? আবদুল তো বললই সে বাড়ি থেকে চলে গেছে। কোথায় গেছে, সেটাই শুধু জানি না আমরা।”
“না স্যার, সেখানেই খটকা। মনে আছে স্যার, মিস্টার আব্বাসির দোকানে মিস্টার আবদুল বললেন, ম্যাডাম জারা কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলেন, তারপর চলে যান। ম্যাডাম জারার বড়ো ভাইও বিয়েতে জারা যাচ্ছেন না বলে একাই চলে যান।”
“হ্যাঁ।”
“ম্যাডাম জারা কিন্তু বাড়ি থেকে বের হননি। আর ওঁর বড়ো ভাই এসে ঘণ্টা কয়েক বাদে চলে গিয়েছিলেন।”
“এই খবরগুলো আপনি পেলেন কখন?” আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। “সিসিটিভি ক্যামেরার রেকর্ড থেকে।”
ভেরি ইন্টারেস্টিং! এ-যুগটা সিসিটিভি ক্যামেরার যুগ। একসময় এগুলো লাগানো থাকত মিউজিয়ামে, বড়ো বড়ো হোটেল-লবিতে, আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। এগুলো লাগানো আছে বলে বেশিরভাগ দুষ্কৃতিকারীরা ধরা পড়ে যাবার ভয়ে চুরি-ডাকাতির চেষ্টা করত না। এখন অবশ্য সিসিটিভি সব জায়গাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ম্যানহাটানের চতুর্দিকে সিসিটিভি ক্যামেরা তো নিজেই দেখি। আগে দেখতাম রাস্তার মোড়ে মোড়ে রেডার গান আর ক্যামেরা- গাড়িগুলোর ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি করে যাচ্ছে। রেডার দিয়ে স্পিড মাপছে আর ক্যামেরা দিয়ে দেখছে ট্র্যাফিক আইন মানছে কিনা। ফাঁকি দেবার উপায় নেই, ক্যামেরায় গাড়ির নম্বর ছবিতে উঠে যাবে! জরিমানা না দিয়ে পালাবার উপায় নেই!
ইদানীং দেখছি আমাদের বাড়ির ছোটো রাস্তাতেই বেশ কয়েকটা ক্যামেরা। এর অর্থ প্রাইভেসি বলে আর কিছু থাকছে না। এগুলো নাকি বেশি করে লাগানো শুরু হয়েছে বছর কুড়ি হল, উদ্দেশ্য ডোমেস্টিক টেররিজম থেকে সুরক্ষা দেওয়া। নাশকতা কতটা আটকেছে জানি না, কিন্তু কখন আমরা বাড়িতে ঢুকছি বা বেরোচ্ছি পুলিশের সেটা নজরে আসছে!
“দাঁড়ান, দাঁড়ান, তার মানে ক্যামেরায় উঠেছে জারা বাড়িতে ঢুকেছে, কিন্তু দেখা যায়নি ও বেরিয়েছে!”
“ঠিক স্যার, সিসিটিভি ক্যামেরাকে তো হিপনোটাইজ করা যায় না— ওদের কোনো মাইন্ড নেই, সুতরাং যা দেখাচ্ছে সেটাই ঠিক।”
“ব্যাক-ডোর দিয়ে তো বেরোতে পারে?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল।
“আমিও সেটা ভাবছিলাম স্যার। কিন্তু স্টুয়ার্ট সাহেব বললেন, পেছনের দরজাটা ভাঙা বলে পার্মানেন্টলি বন্ধ। তাই ওঁর বিশ্বাস জারা ওই বিল্ডিং-এই আছে। নিজের ইচ্ছায় লুকিয়ে আছে বা ওকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আজ রাতেই পুলিশ বিল্ডিং চেক করবে।”
“কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে, এভাবে আর ক-দিন জারা লুকিয়ে থাকবে? আর ওকে জোর করে লুকিয়ে রাখা হলে তার কারণটা কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হয়তো জারার আঙ্কল ওর বাবা-মা’র আসার জন্য অপেক্ষা করছে। এলেই বিয়ের বন্দোবস্ত করা হবে। এক বয়স্ক হোটেলওয়ালার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছিল বললি না?” প্রমথ আমাকে প্রশ্ন করল।
“কিন্তু ওর কাকা এটা করবে কেন, ওর বাবার সঙ্গে তো কাকার সম্পর্ক ভালো নয়!”
“সেটা তো ওর কাকার কথা, যে-লোকটা ইতিমধ্যেই মিথ্যে বলেছে প্রমাণিত।”
একেনবাবু বললেন, “মিস্টার উডের সঙ্গে আজ ম্যাডাম জারার বাবার কথা হয়েছে, তিনি কিন্তু এদেশে আসার ব্যাপারে কিছু বলেননি।”
প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “মিস্টার উড কে?”
বললাম, “জারার বাবার বন্ধু, যার বাড়িতে জারা পেয়িং গেস্ট হয়ে আছে।”
“তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?”
“একটু কনফিউজিং স্যার। তবে ম্যাডাম জারা পাশের বাড়িতেই আছেন এটা ক্লিয়ার।
।। ৬।।
সকাল বেলায় একেনবাবুর ‘একটু কনফিউজিং’-টাই বিশাল আকার নিল। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের লোকেরা সারা রাত বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও জারার টিকি, দেখতে পেল না। আবদুল একই কথা বলছে, জারা মাত্র এক ঘণ্টা ছিল। ওর দাদার সঙ্গে দেখা হবার পর ও চলে যায়। আবদুল নিজে নীচে নেমে ওকে বিদায় জানায় ছ-টা নাগাদ। ও-কে যখন জানানো হল, সিসিটিভি-তে জারা চলে যাচ্ছে দেখা যায়নি, তখন দারুণ চটে গেল! টেকনোলজি কি সবসময় কাজ করে? লুজ কানেকশনের জন্য সবসময় পাওয়ার তো নাও থাকতে পারে। পাওয়ার প্রবলেম ছাড়াও সিসিটিভি ক্যামেরা এক-আধ সময় কাজ, করে না। আবদুলের নিজের দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে, সে নিয়ে দু-এক বার ভুগেছে।
প্রশ্ন হল মেয়েটা স্রেফ উবে যায় কী করে! ম্যানহাটান থেকে অনেক সময় হেলিকপ্টারে লোকেদের ট্রান্সপোর্ট করা হয়, বিশেষ করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। আগে উঁচু উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে হেলিকপ্টার উড়তে দেওয়া হত, এখন অবশ্য অনেক রেস্ট্রিকশন। হাজার-গন্ডা পারমিশন নিতে হয়, অর্থাৎ রেকর্ড থাকে। তবে সেটা করা হয়ে থাকলে আবদুল যে মিথ্যে বলছে, তার অকাট্য প্রমাণ মিলে যাবে! আসলে জারার অন্তর্ধানের পেছনে যে আবদুল কোনো-না-কোনো ভাবে যুক্ত, সেটা একেনবাবু আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দু-জনেই নিশ্চিত। অর্থই হচ্ছে অনর্থ! জারার বাবা খুবই অর্থবান, আর কাকা ও বাবা-র সম্পর্ক যখন বিশেষ ভালো নয়— জারাকে অপহরণ করে টাকা আদায় করার সম্ভাবনা খুবই জোরদার।
পুলিশ বিল্ডিং-এর সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কাজে লাগার মতো কোনো সূত্র কেউই দিতে পারেনি। ড্যান অল্পক্ষণের জন্য একটি মেয়েকে দেখেছে যখন সে বিল্ডিং-এ ঢুকছিল। ড্যান জারাকে আগে দেখেনি, সুতরাং যাকে দেখেছে সে জারা ছিল কিনা সঠিক বলা সম্ভব নয়। তবে এক তলায় নেমে এসে আবদুল যে দরজা খুলে দিয়েছিল, সেটা ড্যান দেখেছে। অর্থাৎ যে-ই আসুক না কেন, সে আবদুলের পরিচিত। আবদুলের সঙ্গে ড্যানের তখন একটু কথাও হয়েছিল, কারণ তার খানিকক্ষণ আগে আবদুলের দোকানের এক কর্মচারী একটা বড়ো বাক্স নিয়ে এসেছিল আবদুলকে দেবার জন্য। ছেলেটি ড্যানের মুখ-চেনা, মাঝে মাঝে ও আবদুলের কাছে আসে জিনিসপত্র দিতে। বিশেষ পরিচিত কিছু ক্লায়েন্টকে আবদুল পার্সোনালি গিয়ে মাল ডেলিভারি করে। ড্যান একটা কাজে যখন বাইরে যাচ্ছিল, তখন ছেলেটির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় ড্যানই ওকে বিল্ডিং-এ ঢুকতে দিয়েছিল। ছেলেটা খুবই অ্যাপোলোজেটিক। কাঁচুমাচু মুখে ড্যানকে বলেছিল, দু-বাক্স মাল আনার কথা ছিল, ভুলে শুধু একটা বাক্স সকালে ডেলিভারি করে গিয়েছে। তার জন্য আবদুলের কাছে বকুনিও খেয়েছে খুব।
ড্যান দেখেছিল বাক্সের ওপরে লেখা ‘KOH’।
‘কী আছে বাক্সে?” ড্যান জিজ্ঞেস করেছিল। “কস্টিক পটাশ।”
জিনিসটার সঙ্গে ড্যান পরিচিত- ক্লিনিং এজেন্ট। প্লাম্বাররা অবশ্য ড্রেন পরিষ্কারের জন্য অ্যাসিডই ব্যবহার করে বেশি, কিন্তু কস্টিক সোডা বা পটাশও
এক-আধ সময় কাজে লাগে।
“আবদুল জানে তো তুমি আসছ?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে, ওপরে নিয়ে যাও।”
সেইসময় একটা ফোন আসায় নীচে হলওয়েতেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ড্যান। কয়েক মিনিট বাদে ছেলেটি নেমে এসে ড্যানকে ‘বাই’ বলে চলে যায়। ড্যান তখন ও ফোনে। ফোনের কথা যখন শেষ হবার মুখে তখন আবদুল নেমে এসেছিল হিজাব পরা মেয়েটির জন্য দরজা খুলতে। যে-সময়ের কথা ড্যান বলেছে, সেটা বেভের সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ওই সময়েই জারাকে বেভ নামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর কী ঘটেছে ড্যান জানে না। ড্যান ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে।
তবে একটা ব্যাপারে পুলিশের প্রথম থেকেই একটু খটকা লেগেছে, সেটা আবদুলের ব্যবহার। বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা লুকোচ্ছে!
পুরো রিপোর্টাটাই আমরা পেলাম একেনবাবুর কাছ থেকে। সকাল বেলাতেই ওঁর সঙ্গে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের লম্বা ফোনালাপ হয়েছে। একেনবাবু নাকি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আবদুলের অ্যাপার্টমেন্টে সাসপিশাস কিছু পাওয়া গিয়েছে কিনা। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের উত্তর, কয়েকটা প্রোডাক্ট স্যাম্পল, আর বাড়ির নর্মাল টুকিটাকি জিনিস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি
একেনবাবু তখন ওঁকে বলেছিলেন, “মুশকিল কী জানেন স্যার, যেটা পেয়েছেন, তার থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট হল যেটা পাননি।”
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট তাতে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “এটা কী ধরনের কথা একেন্ড্রা, কোনটে পাইনি সেটা বুঝব কী করে?”
“ঠিক স্যার, এক বার দেখুন তো কী কী জিনিস উনি গত দু-তিন মাসে অর্ডার করেছেন?’
“দেখব। আপাতত আবদুলকে আমরা দু-দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেলে রেখে দিচ্ছি। এর মধ্যে তুমি ওর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখো কিছু পাও কিনা! আবদুলের অ্যাপার্টমেন্ট সিল করা আছে, আমার লোক পাহারা দিচ্ছে। আর হ্যাঁ, যা করতে হবে, তাড়াতাড়ি করতে হবে, কোনো চার্জ ছাড়া তিন দিনের বেশি ওকে আটকে রাখা যাবে না।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই শুধু একেনবাবু নয়, আমি আর প্রমথও লেজুড় হয়ে পাশের বাড়ি গেলাম। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের একজন লোক সদর দরজা খুলে দিল। তার কাছেই আবদুলের অ্যাপার্টমেন্টের চাবি।
আবদুলের অ্যাপার্টমেন্ট বেশ বড়ো— টু বেডরুম, টু অ্যান্ড হাফ বাথ অ্যাপার্টমেন্ট। হাফ বাথ মানে শুধু একটা কমোড আর বেসিন বা সিংক। সেটা লিভিং-কাম-ডাইনিং রুমের লাগোয়া, বাইরের লোকদের ব্যবহারের জন্য। রান্নাঘর ছোটো, কিন্তু ওয়েল ইকুইপড-গ্যাস-স্টোভ, ডিশওয়াশার, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ—সবই টপ অফ দ্য লাইন। কিচেন-সিংকে বেশ কিছু বাসনপত্র জমে রয়েছে। একটা বেডরুম, যেটা মনে হয় গেস্ট-বেডরুম- সেখানে বিছানার ওপর অজস্র হাবিজাবি জিনিস ডাঁই করা। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু কার্ডবোর্ডের প্যাকিং বাক্স। অনলাইনে কিছু অর্ডার করলেই বাক্সগুলো এসে হাজির হয়। নিয়মিত সেগুলো ফেলে না দিয়ে জমতে দিলে যা হয়। একেনবাবু সেগুলোই কিছুক্ষণ ঘাঁটলেন। কিছু একটা খুঁজছিলেন, না পেয়ে মনে হল একটু হতাশ। বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকলাম। দেখার কিছু নেই, বেশ নোংরা। তবে ড্যান ঠিকই বলেছিল বাথটাবটা দেখে মনে হল কাস্ট আয়রনের বা ওইরকম কোনো মেটালের। বেসিন, জলের কল সবগুলোই সলিড অ্যান্টিক টাইপ। ওগুলো যখন দেখছি তখন একেনবাবু কাউকে ফোন করছেন। ইতিমধ্যে আমি আবার লিভিং রুমে ফিরে এসেছি। সেখানে বুককেস-এ ছড়িয়ে- ছিটিয়ে কিছু বই। বেশিরভাগই আরবি-তে লেখা, আমার পক্ষে বোঝা অসম্ভব। এ ছাড়া গোটা চারেক ইংরেজি থ্রিলার, ব্যস। পাশে কাচের ছোট্ট আলমারিতে ঘর সাজানোর টুকিটাকি জিনিস। সোফাসেটটা ইটালিয়ান ক্লাসিক স্টাইলের। এটা বলতে পারলাম, কারণ আমার এক কলিগের বাড়িতে ক-দিন আগেই এ ধরনের একটা সেট দেখেছি। পাশে বিসদৃশভাবে রাখা একটা ‘কিং টাট’ সিংহাসন চেয়ার। নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে ওরকম একটা সিংহাসন চেয়ার চোখে পড়েছিল, খুবই দাম ছিল সেটার। দেয়ালে লাগানো কয়েকটা ইসলামিক ওয়াল আর্ট। আবদুলের মাস্টার বেডরুমটাও দেখলাম। সেটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বড়ো বড়ো ক্লজেটে প্রচুর জামাকাপড় ঝুলছে। পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ঘুরে দেখার পর মনে হল আসাটা একেবারেই বেকার হয়েছে, সন্দেহজনক কিছুই নেই।
প্রমথ আমাদের সঙ্গে এলেও আবদুলের অ্যাপার্টমেন্টে আসেনি। লবিতেই অ্যালেক্সের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় আমাদের ডাইনিং চেয়ারের পিঠ হেলে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে কথা বলা শুরু করেছিল। প্রমথ যে ‘আনফ্রেন্ডলি’ অ্যালেক্সকে চেনে জানতামও না! আমরা যখন নীচে নেমে এসেছি ওদের কথাবার্তা তখন সবে শেষ হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কী নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা চলছিল?”
প্রমথর উত্তর শুনে আমি সত্যিই অবাক— কাঠের কেমিস্ট্রি নিয়ে! কাঠের ফার্নিচারে কোন এপক্সি আঠা সবচেয়ে ভালো কাজ করে, সেই নিয়ে প্রমথ নাকি জ্ঞান দিচ্ছিল অ্যালেক্সকে— এই ইনভেস্টিগেশনের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই!
তবে এসবের মধ্যেই অ্যালেক্স নাকি ওকে বলেছে চেয়ারের ব্যাকরেস্ট হেলে যাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। নিয়ে এলে দশ মিনিটের মধ্যে ও ঠিক করে দেবে। অর্থাৎ, আজকে এই আসার সেটাই হল হাইলাইট— একটা কিছুর সমাধান তো হল।
।।৭।।
আরও বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেছে, জারার খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিঃসন্দেহ যে আবদুল জানে জারা কোথায়, কিন্তু চেপে যাচ্ছে! পুলিশকে যে সে মিথ্যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল, “বাপি, এই গল্পটা তুই আবার লিখতে যাস না।”
“কেন? এটা তো দারুণ গল্প, আর আমরা সবাই এর সঙ্গে জড়িত!”
“তোর লেখা কয়েক পাতা পড়লেই বোঝা যায় কে দোষী। এই গল্পে সেই কয়েক পাতাও লাগবে না, একদম গোড়াতেই পাঠক বুঝে যাবে জারার এই অন্তর্ধানে আবদুল যুক্ত। তাহলে আর হু ডান ইট-এর সাসপেন্স রইল কোথায়! কী বলেন একেনবাবু, চুপ করে আছেন যে?”
একেনবাবু এতক্ষণ চোখ বুজে আয়েশ করে জেলি মাখা পাঁউরুটি খাচ্ছিলেন। সেটা শেষ করে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “একটা গল্প বলি শুনুন, স্যার। লাস ভেগাসে জুয়ো খেলতে গিয়ে স্লট মেশিনে সর্বস্বান্ত হয়ে হতভাগ্য জুয়ারি মিস্টার জনি টয়লেটে গিয়ে দেখেন সেটা কয়েন-অপারেটেড। স্লটে একটা কোয়ার্টার না ফেললে টয়লেটের দরজা খুলবে না। পকেটে একটা পয়সাও নেই, এদিকে বেগ অতি প্রবল। মিস্টার জনি-র বিভ্রান্ত অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়ে কাছে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক তাঁকে একটা কোয়ার্টার দিলেন। কোয়ার্টার নিয়ে দৌড়ে টয়লেটে পয়সা ঢোকাতে গিয়ে মিস্টার জনি দেখেন, আগের লোকটা দরজা ভালো করে বন্ধ করেনি, ফলে দরজাটা লক্ড নয়। কর্ম সেরে হালকা হয়ে মিস্টার জনি বেরিয়ে এসে প্রথম যে স্লট মেশিন দেখলেন, সেখানে গিয়ে ভদ্রলোকের দেওয়া সেই কোয়ার্টার ফেলামাত্র তিনি ‘হিট দ্য জ্যাকপট।’ সেই টাকার কিছু অংশ বাজি রেখে সেদিন বেশ কয়েক মিলিয়ন ডলার নিয়ে মিস্টার জনি বাড়ি ফিরলেন। আর সেদিন থেকেই ওঁর ভাগ্য খুলে গেল। বেশ কয়েক বছর বাদে বিকেলে মদ্যপান করতে করতে মিস্টার জনির হঠাৎ মনে হল যাঁর জন্য ওঁর এই সম্পদ তাঁকে সম্পদের অর্ধেক দেওয়া উচিত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকায় একটা বিজ্ঞপ্তি পাঠালেন।
‘তিন বছর আগে ডিসেম্বর মাসে লাস ভেগাসের সিজার প্যালেসের টয়লেটে একটি কোয়ার্টারের জন্য আমার ভাগ্য ঘুরে গিয়েছিল। আমি এখন আট মিলিয়ন ডলারের মালিক। আমার সম্পত্তির অর্ধেক সেই মহানুভবকে দান করতে চাই, যাঁর জন্য আমার এই সৌভাগ্য। কবে এটি ঘটেছিল ঠিকঠাক জানালে আমি তাঁকে তাঁর ভাগটা তুলে দেব।’
এই নোটিস বেরোবার ক-দিন বাদেই এক ভদ্রলোক মিস্টার জনির বাড়িতে এসে হাজির। বললেন, ‘আমিই সেই লোক, চিনতে পারছেন? ১৮ ডিসেম্বর টয়লেটের সামনে আপনার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আপনাকে আমি একটা কোয়ার্টার দিয়েছিলাম। মনে পড়েছে?
মিস্টার জনি তাঁকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু চার মিলিয়ন ডলার হাতছাড়া করার ইচ্ছে ইতিমধ্যে তাঁর উবে গেছে। ভদ্রলোককে মিস্টার জনি বললেন, ‘না, না, আপনাকে আমার বেশ মনে আছে। কিন্তু আমি খুঁজছিলাম তাঁকে, যিনি কোয়ার্টার দিয়ে টয়লেটে ঢুকে কাজ সারার পর দরজা ভালো করে বন্ধ না-করে চলে গিয়েছিলেন। তিনি না থাকলে তো আমি বড়োলোক হতাম না!”
“কী ননসেন্স বকছেন মশাই! এটা কি আমার প্রশ্নের উত্তর হল!” প্ৰমথ বিরক্ত হয়ে বলল।
“বলতে চাচ্ছি স্যার, ‘একটা কোয়ার্টার’-এর জন্যেই মিস্টার জনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন, কিন্তু কার দেওয়া কোয়ার্টার সেটা না জানা পর্যন্ত ব্যাপারটা কিন্তু রহস্যই।”
“মানছি, কিন্তু এই গল্পের সঙ্গে জারা-আবদুল গল্পের মিল কোথায়?”
“ম্যাডাম জারা অদৃশ্য হয়েছেন, সেটা স্যার আমরা জানি। আমাদের সন্দেহ মিস্টার আবদুলের তাতে হাত আছে। কিন্তু কী করে ম্যাডাম জারা ভ্যানিশ হলেন, সেটা না জানা পর্যন্ত ‘দোষী কে বুঝতে পারছি’ বলাটা কি ঠিক হবে?”
“ঠিক কথা,” আমি বললাম, “জারা তো নিজের ইচ্ছেতেও অদৃশ্য হতে পারে। পেছনের ফায়ার এস্কেপ দিয়ে নেমে যেতে পারে, সামনে ডেলিভারি ট্রাক দাঁড়ালে তার আড়ালে লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারে। ওর বিয়ে হতে চলেছে, সেটা জেনেও জর্জ ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। কোনো উপায় না দেখে হয়তো আর কারোর সঙ্গে ইলোপ করার প্ল্যান করে থাকতে পারে। জর্জের তো সেটা জানার কথা নয়। একটু ভাবলেই হাজাররকম সম্ভাবনা বের হবে। কী বলেন একেনবাবু?”
একেনবাবু হঠাৎ যেন বেশ অন্যমনস্ক। মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে, তার উত্তর দিচ্ছেন।
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি তো মশাই আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না! জারার তো নিজের থেকে পালাবার অনেক কারণ থাকতে পারে।”
“উত্তর নিশ্চয় দেব স্যার, তার আগে বলুন তো মিস্টার আবদুলদের বিল্ডিং-এ কি গরম জল পাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হত?”
“জানি না। তবে ড্যানকে ফোন করলেই জানতে পারব। জানাটা কি খুব জরুরি?”
“হ্যাঁ, স্যার। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের একটা মেসেজ এসেছে, মিস্টার আবদুল অনলাইনে একটা বড়ো ইমারসন হিটার অর্ডার করেছিলেন। সেটা ডেলিভারি করা হয়েছিল সাত দিন আগে। আমি কিন্তু সেটা খুঁজে পাইনি ওঁর বাড়িতে। পুলিশও পায়নি।”
ইমারসন হিটার কী, আমি জানি। এদেশে যখন কলেজে পড়তাম কাপে জল নিয়ে তার মধ্যে ইমারসন হিটারের কয়েল ঢুকিয়ে সেটাকে দ্রুত গরম করে ইন্সট্যান্ট কফি বানিয়ে খেতাম। কিন্তু সেগুলো খুব ছোটো সাইজের।
তবে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইমারসন হিটার নিয়ে গবেষণা করার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না।
ড্যানকে ফোন করলেই ফোন ধরে। আমার প্রশ্ন শুনে অবাক হল। উত্তর দিল, “না, ওই একটা সমস্যা ওদের বিল্ডিং-এ নেই।”
সেটা জানাতেই একেনবাবুর মুখটা বেশ থমথমে হয়ে গেল। একটা টেক্সট মেসেজ পাঠালেন কাউকে।
“কী ব্যাপার, চুপ করে আছেন যে?”
“জানি না স্যার, যেটা বুঝতে পারছি, সেটা বড়ো কষ্টের।”
“মানে?”
“মনে হচ্ছে ম্যাডাম জারাকে খুন করা হয়েছে।’
“খুন করা হয়েছে মানে? জারার বড়ি গেল কোথায়?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল। “সেটাই তো খুঁজে পেলাম না স্যার। তবে আমার মনে হচ্ছে সব কিছু লুকিয়ে আছে মেটাল বাথটাব, গরম জল, দু-বাক্স কস্টিক পটাশ, আর ওই ইমারসন হিটারে।”
“কী উলটোপালটা বলছেন আপনি?”
“আপনিই বলুন স্যার, উলটোপালটা কিনা— আপনি তো কেমিস্ট্রির লোক। এসব ব্যাপারের অথরিটি।”
“তেল মারতে হবে না, পরিষ্কার করে বলুন কী ঘুরছে আপনার মাথায়?”
“মিস্টার আবদুল ওঁর অফিস থেকে দু-বাক্স কস্টিক পটাশ আনিয়েছিলেন, যার একটা কণাও বাড়িতে দেখলাম না। অনলাইনে কিনেছিলেন একটা ইমারসন হিটার, সেটাও অদৃশ্য। আসলে তখনই মনে হল স্যার, নিশ্চয় অ্যাকোয়ামেশন ব্যবহার করে বডিটা অদৃশ্য করেছিলেন।”
“সেটা আবার কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এবার প্রমথ উত্তর দিল, “এটাও জানিস না? অ্যালকালাইন হাইড্রোলিসিস। প্রেশারাইজড সিলিন্ডারে অ্যালাকালাইন সলিউশনে বডি চুবিয়ে রেখে গরম করলে সহজেই সেটাকে গলিয়ে ফেলা যায়। ডেডবডি পোড়ানো বা কবর দেবার বদলে এটা তো এদেশেও এখন করা হচ্ছে অফিশিয়ালি।”
সেইসঙ্গে একেনবাবু যোগ করলেন, “তার অনেক আগে থেকেই সাউথ আমেরিকার ড্রাগ-মাফিয়ারা বহু ইনফর্মারকে খুন করে অ্যালকালাইন সলিউশনে ডুবিয়ে ডেডবডি তরল করে অদৃশ্য করে আসছে। সেগুলো অবশ্য স্যার আন- অফিশিয়ালি!”
“সেটা তো আপনি জানবেন ভালো,” বলে পুরো কেমিস্ট্রিটা প্রমথ সহজ করে বুঝিয়ে দিল। “আসলে কস্টিক পটাশের ক্রিস্টাল জলে ঢাললে জল খুব গরম হয়ে ওঠে, আর সেই গরম অ্যালক্যালাইন সলিউশন শরীরের টিস্যুগুলো মানে মাংসগুলোকে ধ্বংস করে, এমনকী হাড়গোড়কেও।”
“আপনি বলছেন জারাকে খুন করে জল-ভরতি বাথটাবে ফেলে দিয়ে সেখানে পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইড ফেলা হয়েছিল?” একেনবাবুকে প্রশ্ন করে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝতে চাইলাম।
“ঠিক তাই স্যার।”
“কিন্তু এই সন্দেহটা আপনার হল কী করে?”
“আসলে স্যার, যখন দেখলাম ম্যাডাম জারার চিহ্ন মাত্র নেই, বাথটাব মেটালের তৈরি, আর দু-বাক্স ভরতি KOH, মানে পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইড পাওয়া যাচ্ছে না—তখনই সন্দেহটা মাথায় এসেছিল স্যার। তারপর শুনলাম মিস্টার আবদুল বড়ো সাইজের ইমারসন হিটার কিনেছেন? কেন? বাড়ির ওয়াটার হিটার কি কাজ করছিল না? সেইজন্যেই একটু আগে আপনাকে প্রশ্নটা করেছিলাম স্যার।”
“সেটা করেছিলেন ঠিকই। প্রশ্নটা তখন একটু অদ্ভুতই মনে হয়েছিল।”
“উত্তর যদি ‘কাজ করছিল না’ হত, তাহলে অন্যভাবে চিন্তা করতাম। গরম জল পাওয়া যাচ্ছে না, সুতরাং বালতি বা বাথটাবের জল গরম করতে হচ্ছিল স্নান করার জন্য। যেহেতু গরম জল পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে ওটা ব্যবহার করা হয়েছে জল আরও গরম করার জন্য। অ্যালকালাইন সলিউশনে দেহ গলে ঠিকই, কিন্তু জল খুব গরম না থাকলে অনেক সময় লাগে। ঠিক কিনা স্যার?” প্রশ্নটা প্রমথকে। “হ্যাঁ, প্রতি টেন ডিগ্রিতে রিয়্যাকশন টাইম দ্বিগুণ হয়।” প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল।
“ঠিক স্যার, বডি অদৃশ্য করতে অনেক সময় লাগলে মিস্টার আবদুলের ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকত। সেইজন্যেই মিস্টার আবদুল ইমারসন হিটার কিনেছিলেন। তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে শুরু করল। আমার ধারণা তাও নিশ্চয় এক চেষ্টায় পুরো শরীরটা গলেনি। বেশ কয়েক বার জল ড্রেন করে, গরম জলে বাথটাব ভরতি করে কস্টিক পটাশ ফেলে জল আরও গরম করতে হয়েছিল। তবে বাথটাবটা মেটালের হওয়ায় সমস্যা হয়নি।
“উফফ, কী হরিবল!”
“জানি স্যার, তবে কিনা খুন করাটাই সবচেয়ে বড়ো অপরাধ। মরে গেলে পুড়িয়ে দিন, গলিয়ে দিন, কবর দিন- কী এসে যায়?”
“কিন্তু খুনটা করা হল কীভাবে?”
“তার উত্তরটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। গুলি করে, গলা টিপে, গলা কেটে… এই মার্কিন মুলুকেই এইরকম ব্যাপার আগে ঘটেছে। মেয়েদের পবিত্র রাখা কি পুরুষদের সহজ দায়িত্ব?”
“কী বলছেন আপনি!”
“ম্যাডাম জারা পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বাইরের এক বিধর্মীকে বিয়ে করার প্ল্যান করছেন, এটা কী মেনে নেওয়া যায়! পরিবারের সম্মান রক্ষা করার জন্যেই এই খুন। যাকে বলা হয় ‘অনার কিলিং।’ এতে পাপ নেই।
“এরা মানুষ না পশু?” আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
“চুপ কর, পশুদের নিন্দা করিস না!” প্রমথ ধমক দিল। “কোনো পশু খিদে বা আত্মরক্ষা ছাড়া কাউকে হত্যা করে না, একমাত্র মানুষ করে। এখানে ধর্ম-টর্ম কোনো ব্যাপার নয়। আমরা হিন্দুরা সতীদাহ করতাম না? এখনও তো হয় মাঝেমধ্যে, খবরে পড়ি। দেশে দলিতদের যে খুন করা হয় বা কালোদের এদেশে… দরকার শুধু অজুহাতের। তার ওপর মেয়েরা হচ্ছে বিশেষ টার্গেট! ‘অনার কিলিং’ না মুণ্ডু—মোস্ট ডিজগাস্টিং ‘ডিজ-অনার কিলিং। কি বলেন একেনবাবু?”
“একদম ঠিক স্যার, বিচিত্র এই পৃথিবী।”
“বুঝলাম, কিন্তু এই খুনের ব্যাপারটা এখনও আপনার থিওরি।”
“সেটা ঠিক স্যার। সেইজন্যেই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে এখুনি একটা মেসেজ পাঠালাম, বাথটাবের ড্রেন পাইপ খুলে ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করার জন্য।
উপসংহার
ডিএনএ উদ্ধারের পর সেটা যে জারার তা প্রমাণিত হয়েছে। আবদুল আর জারার দাদা দু-জনেই ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারের অপরাধে অভিযুক্ত। ওদের যে শাস্তিই হোক, জারা আর ফিরে আসবে না।