ভাটিখানা
শঙ্কর, মুনিয়া দুজন দুজনকে ভালোবাসে। শঙ্কর ছেলে ভালো, দোষ চোলাই খায়।
দুজনেই ইটভাটায় কাজ করে। সাঁওতাল পাড়ায় বাস। সেখানের অধিকাংশ পুরুষ চোলাই খেয়ে বাড়িতে উৎপাত করে। মুনিয়া জানে। তার বাবাও খেতো। অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।
শঙ্করকে মুনিয়া বলে, “চোলাই ছাড়, নইলে তোকে বিয়ে করবো না”।
শঙ্কর অনুনয়ের সুরে বলে,” তোকে আমি খুব ভালোবাসিরে মুনিয়া, তুই ছাড়া আমি বাঁইচতে পাইরবো না। ছুটোবেলায় মা’কে হারায়ছি। বাবা আবার বিয়া কইরলো। সৎমা খেতে দিইতোনা, মাইরতো। বাবাকে বইললে উইত্তর কইরতোক না। আমি পলাই এসেছি। ভিইক্ষা কইরে খাইছি। আমার কেউ নেইরে। তোর ভালোবাসা পাইয়ে আমি সুইখে আছি রে মুনিয়া। তুই দেইখিস বিয়ার পর আর খাইবোনা। তুই যা বইলবি শুইনবো”। মুনিয়া মেনে নেয়। অন্যান্য কামিনরা বলে, “পোড়ামুখি, আগে ওর নেশা ছাড়া। বিয়ার পইর আইর ছাইরবেক না দ্যাখবি।
আমাদের মরদগুলানও ছাইড়বো ছাইড়বো কইরে আইজও ছাইড়ে নাই। ঘইরকে অশান্তি করে, মাইরধোর করে। ও ছাইড়বো বইলছে, তুইও বিইশ্বাস গেলি, পাগল নাকি তুই”!
মুনিয়া মা’কে জানালো আসছে ফাল্গুনে সে বিয়ে করবে। মনে ভাবে শঙ্করকে সবসময় কাছে পাবো, মদ খাওয়া ঘুচিয়ে ছাড়বো।
পুরো সাঁওতাল পাড়া নিমন্ত্রণ করে মুনিয়া জানালো ,সকলে আসবে কিন্তু মদ খাওয়া চলবে না।
সকলে তাই করলো।
একরাত নেশা করতে না পেরে পরদিন অনেকেই কাজে না গিয়ে মদ খেয়ে চুর।
বিয়ের পর শঙ্কর মুনিয়াকে কাজে যেতে দেয়না। বলে,” আমি থাইকতে তুই কেনে কাইজ কইরবি। ঘইরকে রাইন্না কইরবি; মায়ের বিইশ্রাম হবে”।
মুনিয়া মেনে নেয়। শঙ্কর কাজে যাওয়া শুরু করে। সুখেই কাটছিলো তাদের।
বেশ ক’দিন পর শঙ্কর কাজ থেকে ঘরে এলে মুনিয়া কেমন মহুয়ার গন্ধ পায়। মা’কে জিজ্ঞাসা করলে বলে, সেও একই গন্ধ পাচ্ছে। মুনিয়ার সন্দেহ হয়। শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করলে অস্বীকার করে।
একদিন শঙ্কর বেশি রাতে টলতে টলতে ঘরে এলে মুনিয়ার সাথে তর্ক বাঁধে। শঙ্কর নেশার ঘোরে গায় হাত তুললে মুনিয়া প্রচন্ড রেগে বলে, ভাটিখানা আমি তুলেই ছাড়বো।
রাতেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুনিয়া সব মহিলাদের একজোট করে।
পরদিন মহিলারা হাতা,খুন্তি,কুড়ুল নিয়ে ভাটিখানা ভেঙে তছনছ করে দেয়। ভাটির মালিকের সঙ্গে তাদের বচসা শুরু হয়।মালিক দলবল নিয়ে মারতে আসে। মুনিয়াকে মারলে মুনিয়ার জেদ চেপে যায়। বলে, আমি বেঁচে থাকতে ভাটিখানা চালাতে দেবোনা। পুরুষগুলোর সর্বনাশ করতে দেবোনা। প্রতিদিন মহিলারা ঘরে বাইরে ঝামেলা সামলায়, তবুও দমেনা। প্রয়োজনে তারা স্বামীদেরও মারতে ছাড়েনা। ইটভাটাতেও পাহারা দেয়।
ভাটিখানার মালিক গ্ৰামের মোড়লকে জানায়। মোড়ল নিজেও মদ খায়। তাই বিচারসভার আয়োজন করে সব মহিলাদের উপস্থিত থাকতে আদেশ করে। মোড়লের স্ত্রীও একই অত্যাচারের শিকার। মহিলাদের সঙ্গে তিনিও হাজির।মোড়ল কথা শুরু করতেই তিনি বললেন, “ভাটিখানা বন্ধ হোক আমিও চাই। এবার থানায় গিয়ে জানাবো। ভাটিখানা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত থামবোনা”। মোড়ল চুপ।
পুলিশকে জানিয়ে, ভাটিখানা তুলে দেওয়া হলে সবাই খুশিতে মুনিয়ার জয়গান করলো।