অভিঘাত
অপমান! এতবড়ো আঘাতটা সহ্য করতে পারছে না। সমস্ত দুঃখকে ছাপিয়ে অপমান আর উপেক্ষাটাই বড়ো হয়ে উঠেছে আজ তার কাছে। আগেও একাই ছিল সুরমা! স্বামী থাকতেও একাকীত্বটুকুই ছিল তার সবসময়ের সঙ্গী।আর পাঁচটা মেয়ের মতোই স্বপ্ন দেখে ছিল সুরমা, স্বামীর আদরে সোহাগে ভেসে যাবার স্বপ্ন! মধ্যবিত্ত স্বামীর সংসারটুকুর রাজেন্দ্রানী হয়ে ওঠার স্বপ্নে যখন বিভোর সকলের অলক্ষ্যে বিধাতা পুরুষ তখন রচনা করে চলেছেন এক অমোঘ কাহিনী।
এমনিতে তার স্বামীর শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকলেও একবছরের মাথায় স্বামী অজয় এক অজানা রোগের শিকার হলে স্বপ্ন গুলো একটু একটু করে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে লাগলো।…..
নিজের সামান্য চাকরিটুকুর জোরে একদিকে সংসার অন্যদিকে স্বামীর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে থাকলো।যমে মানুষে লড়াই চললো। দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রাণে বেঁচে ফিরলেও শরীর বড়োই দুর্বল। খেটেখুটে রোজগারের সামর্থ্য তার আর রইলো না। প্রাইভেট কোম্পানীর চাকরি গেছে আগেই। কোম্পানির দিক থেকে এককালীন কিছু থোক টাকা দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
দীর্ঘ রোগভোগের কারণে অজয়ের মন বড়ো কঠিন আর নিরাসক্ত, সুরমার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ তো করেই না উপরন্তু কথায় কথায় চটে যাওয়া, সন্দেহ আর অবিশ্বাস! নানান দুর্ব্যবহারে সুরমার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়।
স্ত্রীর প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতার বোধটুকু পর্যন্ত নেই অজয়ের। দিনভর ঘরে বাইরে পরিশ্রম করতে করতে দিন কেটে গেলেও, রাতটা কাটতে চায় না সুরমার। যতক্ষণ জেগে থাকে নিজের দুর্ভাগ্যের কথাই ভেবে যায়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সুরমার মন চায় বৃষ্টি! বৃষ্টির অঝোর ধারায় শ্রান্ত পরিশ্রান্ত মন প্রাণ জুড়িয়ে দিতে চায় সুরমা।
এত লড়াই! অবিশ্বাস্য হলেও কী এক অজানা শক্তিতে ভর করে অতিক্রম করে চলতে চায় সকল বাধাবিপত্তি, শেষ রক্ষা হলোনা তবুও।…
ছ’বছরের মাথায় অজয় চলে যেতে একা , একেবারেই একা হয়ে গেল সুরমা। আত্মীয় স্বজন বলতেও বিশেষ কেউ ছিল না। অশৌচান্তে কাজ কর্ম মিটে যেতে সত্যিকারের একা হয়ে গেল। একাকীত্ব যেন গিলে খেতে লাগলো। লড়াইটাও একটা অভ্যাস! সুদীর্ঘ লড়াইয়ের শেষ একটা অবসাদ এনে দিল সুরমাকে। অফিস টুকু ছাড়া বাইরে বের হতে মন চায় না তার, তবুও জাগতিক নিয়মে জীবন ধারণ করতে গেলেও তো ন্যূনতম ব্যবস্থাটা করতেই হয়! তার সেই ব্যবস্থাটা অফিস থেকে ফেরার পথেই সেরে নেয়,একা মানুষের প্রয়োজনই বা কতটুকু! মন ভালো থাকে না, শরীরেরও তেমন যুৎ নেই, অফিস ফেরত বাজার করতে গিয়ে সেদিন পড়েই যেত হয়তো। পাশের এক ভদ্রলোক দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ধরে ফেললেন সুরমাকে। ‘ইস কী হতে যাচ্ছিল বলুন তো!’ লজ্জিত মুখে সুরমা ধন্যবাদ জানাতেই , বললেন -‘আরে না না, এ আর এমন কী!’
সেদিনের পর থেকে যাতায়াতের পথে দেখা হয়ে গেলে সামান্য হাসি বা কুশল বিনিময় হয়, এটুকুই।
অফিসের সময়টুকু ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না সুরমার।
কিছুদিনের মধ্যেই ভদ্রলোক সুরমার সঙ্গে কথা বলে সুরমা সম্পর্কে যেমন সবটুকু জেনেছেন তেমনি সুরমাও জেনেছে ভদ্রলোকের নাম রমেশ, রমেশ বোস। অকৃতদার মানুষ অবসরের জীবনে রঙ তুলি নিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছেন। শিল্পী মানুষ! কথাবার্তা বলেন ভালো। তাকে মন্দ লাগে না সুরমার।….
এমনই একদিন রমেশবাবুর সঙ্গে দেখা হলে ভালো মন্দ দুচার কথার পর বললেন-‘সামনের রবিবার নজরুল ভবনে আমার ছবির প্রদর্শনী আছে। সেদিন তো আপনার ছুটি! আসুন না,আশা করি ভালোই লাগবে।
আচ্ছা, চেষ্টা করবো বলে চলে এলো সুরমা।
রবিবার প্রথমটায় যাবো না ভাবলেও,কী মনে হতে রমেশ বাবুর ছবির প্রদর্শনী দেখতে চলেই এল সুরমা।
মন্দ কাটলো না। এ এক অন্য জগৎ!
বড়ো যত্ন নিয়ে দেখালেন সব, কিছু কিছু ছবির বিষয় বুঝিয়েও দিলেন।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে বলেন -চলুন বাড়ী পৌঁছে দি আপনাকে।’
না না এটুকু তো আমি ঠিক চলে যাবো,ব্যস্ত হবেন না। আপনার কাজ রয়েছে।
বাড়তে লাগলো সম্পর্কের পরিধি। রমেশ বাবুর জীবনের কলস কানায় কানায় পূর্ণ, তবুও তার শিল্পী সত্ত্বাটি আশ্চর্য জনক ভাবে একা, একান্তই একা!
একাকীত্বের অবসাদে তিনি যে হতাশায় ভুগছেন সেটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না। রমেশ বাবুর প্রতি সহানুভূতিতে দ্রাবিত হয় মন,এমন একজন শিল্পী, এত গুণী মানুষ! সেও কিনা একা।
যতটা পারে সাহচর্য দেবার চেষ্টা করে সুরমা।
এভাবেই কাটছিল দিন গুলো,এখন প্রায়ই তিনি সুরমাকে বলেন-
‘এই জগতে মনের মত সঙ্গী খুঁজে পাওয়া বড়োই কঠিন। আপনার সঙ্গে পরিচয়ের পর মনের আগল খুলছি, সমমনস্ক মানুষ পাওয়ার ভাগ্য তো সবার হয় না।
আমার কাছে আপনার আগমণ ঈশ্বরের নির্দেশেই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।
রমেশ বাবুর একাকীত্ব, দুঃখ বোধ, জীবনের প্রতি নিস্পৃহতা দেখে ব্যথায় ভরে উঠলো চিরন্তন নারী হৃদয়। ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে চাইলো তাকে।
হাজার হোক রমেশবাবু পুরুষ মানুষ! শুধুমাত্র ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, শিল্পের প্রেরণা হিসেবে যে আরো কিছু চাই তার! প্রায়ই বলেন- তোমার সবটুকু আমি পেতে চাই সুরমা, শরীর মন প্রাণ সব। তোমার উষ্ণতায় ভরিয়ে তুলতে চাই নিজেকে,আমি একটা ঘুমন্ত আগ্নেয় গিরি। জাগিয়ে তোলো আমায়, তুমি আগুন, তোমার আগুনের গলিত লাভায় ভেসে যেতে চাই আমি,তোমার স্পর্শের শিহরণে পলে পলে শিহরিত হয়ে উঠতে চাই। দুজনেই রোমাঞ্চের অনুভবে মগ্ন হয়ে যেতে চাই সুরমা।
বুঝলো সুরমা, বুকের গভীরে রক্তাক্ত হলো সে। তবুও পারলো না সরে আসতে। একদিকে ভালোবাসার মানুষটির দাবি, ভালোবাসা পাওয়ার লোভ, তার বঞ্চিত জীবনে রোমাঞ্চকর অনুভূতির হাতছানি,অন্যদিকে আজন্ম লালিত সংস্কারের শৃঙ্খল পাপ পুণ্য বোধের তাড়না। দ্বন্দ্ব আর দ্বিধায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো সুরমা। শেষ পর্যন্ত জয় হলো ভালোবাসার। ভেসেই গেল নদীর মতো প্রবাহে,আদরে সোহাগে মোমের মতো গলে গলে মিশে যেতে থাকলো জীবনের উষ্ণতায়। ভরিয়ে তুলতে সমর্থ হলো রমেশ বাবুর জীবন। মনে প্রাণে যথার্থই প্রেরণা হয়ে উঠলো রমেশ বাবুর জীবনে।…..
রঙিন জীবনের রঙে পলে পলে রোমাঞ্চিত হওয়ার ফাঁকে রমেশবাবুও শিল্পী হিসেবে ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হতে লাগলেন। আসতে লাগল নাম, যশ,খ্যাতি-প্রতিপত্তি। মানুষ এখন একডাকে শিল্পী রমেশবাবুকে চিনতে পারে।
রমেশবাবুর জীবনের পরিধি বাড়তে লাগলো। বাড়তে লাগলো সম্পর্কের পরিধিও। কাজের প্রয়োজনে আজ এখানে তো কাল সেখানে! আজকাল ফোনেও তাকে সহজে পায়না। দু একদিন পর রমেশবাবু বাড়ীতে এলে সুরমা বলে কাল কতবার ফোন করেছি…. আরে, কাজের ফাঁকে সময় পাইনি একটুও। লক্ষ্মীটি মন খারাপ করে না!
সুরমা বোঝে কাজের চাপ বাড়ছে। হোয়াটসঅ্যাপে প্রায়ই অনলাইন দেখে মেসেজ দিয়ে রাখে সুরমা। মেসেজটুকুও পড়ার সময় হয়না তার। না দেখা অবস্থায় পড়ে আছে দেখে অভিমানে সেই মেসেজ তুলে নেয় সুরমা।
আজকাল রমেশ বাবুর বাড়ী ফেরারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় দুটো কথা বলার জন্য ছটফট করে মরে সুরমা।
সুরমা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে ক্রমশ।রমেশ বাবুর কাজের চাপ বাড়ছে ভেবে নিজেকে আশ্বস্ত করেছে। এটাই তো চেয়ে এসেছে,আজ সেজন্য একটু কষ্ট না হয় হলো।বাড়ীতে আসার সময়ের ঠিক ঠিকানা নেই। প্রায়ই বলেন একজিবিশনে ব্যস্ত থাকার কথা। কিছু জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হন। বলেন- তুমি কী বলতে চাও,সব ব্যাপারে তোমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে নাকি!
না না তা নয়…
বাড়ীতে থাকার সময়ে প্রায়ই ফোনে ব্যস্ত। রমেশবাবু সেদিন তখন বাথরুমে, ফোনটা বাজছে তো বাজছেই।
সুরমা টেবিলে চা রাখতে এসেছে, দেখে চিত্রার কল। কে এই চিত্রা! তাকিয়ে দেখে ততক্ষণে কল করে না পেয়ে মেসেজ করছে চিত্রা।
রমেশ বাবু স্নান সেরে বেরিয়ে এসেছেন। ফোনটা নিয়ে সোজা ব্যালকনিতে।
কথা বলছেন তো বলেই যাচ্ছেন। কোনদিকে হুঁশ নেই তার। কিছু একটা বলার ছিল সুরমার,বলতে এসে বুঝল সুরমার কথা শোনার মতো সময় বা আগ্রহ কোনটাই রমেশবাবুর নেই। ধীরে ধীরে ফিরে গেল।
সময় থেমে থাকে না,এর তার মুখে চিত্রা আর রমেশ বাবুর ঘনিষ্ঠতার কথা শুনতে পায়। রমেশবাবুও তার একজিবিশনের উদ্যোক্তা চিত্রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাড়ীতে সুরমা কথা বলার জন্য আকুল হয়ে ওঠে,রমেশবাবু তখন রোমান্টিক চ্যাটে ব্যস্ত। চিত্রার হোয়াটসঅ্যাপ অন করলেই দেখে সেও অনলাইন, রমেশবাবু অফলাইন হলে চিত্রাও একই সাথে অফলাইন হয়।
কতদিন সুরমা রাগে ক্ষোভে নিজের পাঠানো বার্তা ডিলিট করে দিয়েছে। এজন্য কিছু কম শুনতে হয়নি! সুরমাকে টিকটিকি বলে বিদ্রূপ করতেও ছাড়েন নি। রমেশবাবুর জীবন পূর্ণ করে তুলতে কি না করেছে সুরমা! আজ রমেশবাবুকে যারা মাথায় তুলে নাচানাচি করছে একদিন তারাই কত উপহাস করেছে, লাঞ্ছনা করেছে, গঞ্জনা দিয়েছে,পদে পদে অপদস্থ করতেও কসুর করেনি। রমেশ বাবুর কাছে সুরমার প্রয়োজন আজ ফুরিয়েছে। কিসের আশায়,কোন প্রত্যাশায় বাঁচবে সে!
…..বিনিদ্র রাত কেটে গেছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। একটার পর একটা ঘুমের বড়ি খেয়েও ঘুম আসে নি। আগেও দুঃখ ছিল, ছিল যন্ত্রনাও কিন্তু এরকম আত্মগ্লানি ছিল না। আজ যে আর কোন সান্ত্বনাই রইলো না তার জন্য!
বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দেখে, তার বুকের ভেতর অন্ধকার যে আরো গভীর! নিবিড় সেই অন্ধকারের মধ্যে কয়েক টুকরো সুখস্মৃতি মণিমুক্তার মতো জ্বল জ্বল করছে। তারাই নক্ষত্রের মতো পথ দেখাবে তাকে।
বেরিয়ে পড়লো পথে, দেখে বৃষ্টি আসছে। আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছিলো আগেই, অন্ধকারে বুঝতে পারেনি।
দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল -“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে!”
কাল যে পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরুর জন্মদিন।
খুব বড়ো একটা সত্য হলো চরম দুঃখের মাঝে কবিগুরুর কবিতাই দেয় সান্ত্বনার প্রলেপ,দেখায় পথ।
“যাহার লাগি চক্ষু বুজে বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর,
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি বিশ্ব ভুবন মস্ত ডাগর।”
সত্যিই তো! কী করতে যাচ্ছিলো সে!
অনন্ত জীবনের মাঝে এ ঘটনা মহাসমুদ্রের তরঙ্গমালায় তুচ্ছ একটা ঢেউ মাত্র। আরো ভাবলো “দুঃখ,শোক এগুলোকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখি বলেই সেগুলি বেঁচে থাকে।”
একদিন আবেগের বশবর্তী হয়ে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল সে, তার রুক্ষ-শুষ্ক জীবনের বঞ্চনা তাকে প্রভাবিত করেছিল। আর নয়! যে অদম্য শক্তি আর সাহস দিয়ে সে লড়াই করে গেছে তা আজও রয়েছে, সেই শক্তি দিয়েই অন্যকে পথ দেখাবে সে। তার জন্য অপেক্ষা করছে আজ সমস্ত পৃথিবী!