বাংলায় কতো পেতি রে?
নাঃ! বোধহয় স্কুলে পড়াকালীন, চল্লিশের কোঠা পেরোই নি, কেবল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পঞ্চাশোর্দ্ধ নম্বর ওঠাতে, বাবাকে আমার বাংলার অধ্যাপক ছোটমামা ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন
“আপনার চৌদ্দ পুরুষের পরম সৌভাগ্য অবনীবাবু – ওর থেকেও ওঁচা বাংলা লেখে এমন পরীক্ষার্থীও আছে পশ্চিম বাংলায়! ” ( অতি অবশ্যই ঠাট্টাচ্ছলে, কারণ তার কথাতে আমিও হেঁ হেঁ করে বোকাবোকা দেঁতো হাসি দিয়ে পায়ের ধূলো নেওয়াতে, বুকে জড়িয়ে নিয়ে ‘ শাবাশ ‘ কথাটা কিন্তু বলেছিলেন তাতে বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বাংলাটা ঠিক প্রথাগত বাংরেজি ভাষা হয়তো ছিলোনা, কিন্তু তখন তা পরখ করার সুযোগ ছিলোনা)
কড়াধাঁচের মাষ্টারমশাই ছিলেন রবিন পাল, বাংলা পড়াতেন।
খাঁটি খদ্দরের পাঞ্জাবি এবং “অতিখাসা মিহিসুতির” ধুতি পরে স্কুলে আসতেন।কাঁধেঝোলা শান্তিনিকেতনী এক কাপড়ের সাধারণ ব্যাগ, তাতে খানকয় লাল কলম এবং কিছু নোটের কাগজ, ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের প্যাকেট,দেশলাই ও দু – চারটে বই!
কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কোন বই বা কাগজ না দেখে, অনর্গল অত্যন্ত উচ্চমানের বাংলায় আমাদের কাব্যালোচনা করতেন, কখনো রবীন্দ্রনাথের “সবুজের অভিযান “, কখনো গল্পগুচ্ছের ” জীবিত ও মৃতের” কাদম্বরী চরিত্রের সাথে যেন সাক্ষাৎ করিয়ে দিতেন তার অদ্ভুত বাচনভঙ্গিমায়, আবার কখনো নবীন সেনের ” পলাশীর যুদ্ধের খোলা মাঠে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, মোহনলালের দেশপ্রেমের বর্ণনা দিয়ে আমাদের শিহরিত করতেন –
” – দাঁড়া রে দাঁড়া! দাঁড়া সৈন্যগন! – গরজিলা মোহনলাল – ” নিকটে শমন “! তখন মনে হতো, যেন সিরাজ বাহিনীতে কয়েকটি মোহনলাল থাকলে, মির্জাফরেরা ধোপে টিঁকতোনা, সমূলে বিনাশ হয়ে, ভারত তাদের শাসকের রাজদণ্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিক্রি করতোনা!
তিনি কিন্তু অতি মজার মানুষ ছিলেন রবিনবাবু!
হঠাৎ হাসতে হাসতে প্রতীপ মিত্রকে বললেন ( ট্যারা চোখ – কোনদিকে তাকিয়ে বোঝা যেতোনা) “তুমি হেসে হেসে কথা, বলছো কেন? “
” স্যার, আমাকে বলছেন?”
” না,তুমি কেহে? আমি ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে শুটিংএ ব্যস্ত ওই মৃণাল সেনকে বলছি!”
প্রতীপ উঠে দাঁড়ালো!
” হোমওয়ার্ক করেছো? “
” ইয়ে, মানে না, মানে না স্যার!”
” না মানে যে না, সেটা আমাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে? হাঁদারাম পাদা কোথাকার? “
” তা কি করছিলে,হোমওয়ার্ক না করে?”
” ইয়ে মানে…”
” বুঝেছি। তা কোন কাজটা করছিলে?
পানাপুকুর পরিষ্কার না পল্লী উন্নয়ন?
নাকি শহরে মশার দৌরাত্ম্যি বেড়েছে দেখে আমাদের জীববিজ্ঞান পড়ায়, তোমাদের ওই, প্রফেসর শম্ভুনাথের চ্যালা হয়ে ব্লিচিং পাউডার সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করছিলে?
চ্যালাকাঠের বাড়ি পিঠে পড়লে না, ওই ইচিং ব্লিচিং সব বেরিয়ে যাবে,রাস্কেল কোথাকার! ”
ওই প্রতীপ মিত্রর প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় আর কি?
আমরা ওনাকেও তার বাবা টিনোপাল এবং মা রানীপাল,এবং তার রাজসিক পড়ানোর গুরুত্ব না বুঝে, হায়, ব্যঙ্গ করতাম – তিনি পাল রাজবংশের শেষ উত্তরসূরি বলতাম !
আমাদের সকলেরই মনে থাকার কথা ,সেই টাকমাথা খদ্দরের পাঞ্জাবি,আর ধুতি পরা, মোটা কাঁচের কালো সেলুলয়েড ফ্রেমের চশমা , মাথায় ইন্দ্রলুপ্ত, চারটে লম্বা চুল ফিনফিনে গোছার, কড়ামেজাজের কিন্তু অত্যন্ত স্নেহশীল স্যারকে?
অবশ্যই ওনাদের মতন শিক্ষকেদের আজকের আশু প্রয়োজন, তাদের অভাব অপূরনীয়! আজকের প্রজন্ম যেন সত্যিই এইরকম শিক্ষালাভ তথা স্নেহবরষণ থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য এক একসময় করুণাই হয়!