উলঙ্গ একাকীত্ব
বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে দল বেঁধে কিনারাযুক্ত থালার আকারে রাক্ষসেরা লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। ঠিক যেন আলোর তরঙ্গ খেলছে গতিপথে।ভুষাকালি মাখা শরীরে ঝাঁকড়া চুল, মাথায় চোখ যেন আগুনের গোলা। থেকে থেকে আলো জ্বলছে নিভছে।মনে হচ্ছে তারা হো হো করে হাসতে হাসতে ব্রহ্মান্ডকে গিলতে আসছে। তারা এতো নাচছে ব্রহ্মান্ড বেলুনের মতো ফুলছে।
এই রাক্ষসেরা এতো খায় যে গায়ে গতরে কল্পনাতীতভাবে বেড়ে ওঠে। ভুরিভোজ সব সময় লেগেই থাকে। সুযোগ পেলেই সামনে যা পায় সব গিলে খায়। এদের হাত থেকে কেউ রেহাই পায় না। এই রাক্ষসগুলো গর্ব করে বলে আমরা ব্ল্যাক হোল। আমাদের পরামর্শ দেয় মহারাক্ষস। মহারাক্ষসরাও দলবেঁধে ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে থাকে। এরা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। এরা সমস্ত রকমের আলোও গিলে খায়। ব্ল্যাক হোলের চেহারাটা গ্যাসীয় মেঘ বা নক্ষত্ররা বুঝতে পারে না। হরাইজনের সীমানা পেরিয়ে কোনও ব্ল্যাক হোলের আশপাশে থাকা গ্যাসীয় মেঘ বা নক্ষত্ররা ঢুকে পড়লে অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টান এড়িয়ে তারা আর বেরিয়ে আসতে পারে না। বেরিয়ে আসতে পারে না এমনকি আলোও। তাই কৃষ্ণগহ্বরগুলোকে রাক্ষস বলা হয়েছে।
রাক্ষস মহারাক্ষসদের খিদে দিনদিন বেড়েই চলেছে। কে কত বেশি খেতে পারে তাই নিয়ে খাওয়ার সময় রেষারেষি করে। ধাক্কাধাক্কি মারামারির ফলে ওদের শরীর থেকে অভিকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়।
এদের দূরবীন দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। দূরবীনে এদের সঠিক চেহারাকে ধরতে পারলাম না। দৃষ্টিতে অসংখ্য ক্ষুদ্র কণা কোন মুলুক থেকে এসে ভীড়ল তা অজানা।
মাত্রাতিরিক্ত খেয়েও এরা ভর শূন্য। পরমাণুর থেকে ওজন কম। হালকা অথচ ভয়ানক শক্তিশালী।
পরমাণুর চেয়েও অনেকগুণ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রায় ভরশূন্য এই কণারা স্বীকার করল অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে এরা ঘোরাফেরা করছিল। রাক্ষসদের শরীরেই এদের প্রথম খোঁজ পাওয়া যায়। নাম এদের ‘নিউট্রিনো’। এদের চরিত্র অদ্ভুৎ। চোখের নিমিষেই লুকিয়ে পরে। এরা ছোটে প্রায় আলোর গতিতেই। অভিকর্ষ বলই শুধু এদের চলার পথে আগল তুলে দাঁড়াতে পারে, এমনকি এদের চলার পথ বাঁকিয়েচুরিয়ে দিতে পারে। ব্রহ্মাণ্ডের আর কোনও কণা, পদার্থ, বস্তু বা তরঙ্গকেই এরা তোয়াক্কা করে না। ওরা বলল প্রতি মুহূর্তে আমাদের ত্বক ফুঁড়ে লক্ষ কোটি এইসব ভুতুড়ে কণা বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। আমরা বুঝতেই পারি না। এরা আসে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। মহাদৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বরের ভুরিভোজের উচ্ছিষ্ট থেকে বা অন্যান্য অজানা উৎস থেকে এরা পৃথিবীকেও ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। চরিত্রের কারণেই এদের ‘ভুতুড়ে কণা’ বলা হয়।
এই ভুতুড়ে কণারা রাক্ষসদের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের অ্যান্টার্কটিকার পুরু বরফের চাদরে লুকিয়ে রাখে। শক্তিশালী হওয়ায় বরফের চাদরে মুখ ঢেকে লুকিয়ে থাকতে পেরেছিল।
দু’-একটি ভুতুড়ে কণা কোনও কারণে পৃথিবীকে ফুঁড়ে বেরতে পারেনি তাই বরাতজোরে রাক্ষসরা তাদের হদিশ পায়।
কোনও সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল গোগ্রাসে ভুরিভোজের সময় দেখেছিল তাদের শরীর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে কণা আর গ্যাস। গ্যাসটি ঝর্ণার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল আর তাতে স্নান করছিল ভুতুড়ে কণারা। এই দুই মিলিত হয়েই এক্স রশ্মি ও রেডিয়ো রশ্মি রূপে নতুন তরঙ্গের সৃষ্টি ।
মহারাক্ষসেরা জানতে পারে এই নতুন তরঙ্গটি ৭৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটি ছায়াপথ (‘গ্যালাক্সি’) থেকে আসছে। সেই ছায়াপথের কেন্দ্রেও রয়েছে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল (সব ছায়াপথেই থাকে একটি করে)। ভরের নিরিখে সেই সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলটি সূর্যের ভরের ৩ কোটি গুণ। এই সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলটি গোগ্রাসে একটি সূর্যকে খাওয়ার সময়েই ভুরিভোজের উচ্ছিষ্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিল যে কণা ও গ্যাসই, ওরাই রেডিয়ো তরঙ্গের জন্ম দিয়েছে। সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে এই অত্যন্ত শক্তিশালী ভুতুড়ে কণা। যা এসে মুখ লুকিয়েছিল অ্যান্টার্কটিকার পুরু বরফের চাদরে। রাক্ষসদের ধারণা, উৎস একই হওয়ায় রেডিয়ো তরঙ্গ আর এই শক্তিশালী ভুতুড়ে কণার মধ্যে বোধ হয় নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
রাক্ষস মহারক্ষসদের নিয়ে এই ব্রহ্মাণ্ড উত্তরোত্তর এগিয়ে চলেছে আরও বেশি বিশৃঙ্খলার দিকে।
যার নাম এনট্রপি।
আমি ও সুমিত কোনও এক পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে এই কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে দুজনে গল্প করছিলাম। সুমিত হঠাৎ মাটি থেকে ইঁটের টুকরো কুড়িয়ে পুকুরের মাঝখানে ছুঁড়ে ফেলে দিল। দেখলাম জলে তরঙ্গের সৃষ্টি হল। আর তা ধীরে ধীরে আরও বড় আকার নিয়ে পাড়ে এসে আমাদের টেনে নিল। ঠিক যেন ব্রহ্মাণ্ডের দুই মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেল। ফলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি হল। সৃষ্ট তরঙ্গ যেমন করে সব আলো ও বস্তুসমূহকে যেভাবে গিলে খায়, মনে হল ব্রহ্মাণ্ডই আমাদের গিলে গোগ্রাসে খেতে এগিয়ে এলো। চারিদিক অন্ধকার ছিল বলে কেউ কাউকে দেখতে পেলাম না। তখন,আমার স্টিফেন হকিংসের ‘ব্ল্যাক হোলস’ এরিয়া থিয়োরেমের কথা মনে পড়ে গেল।
গত শতাব্দীর সাতের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে হকিং বলেছিলেন, রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের চেহারা উত্তরোত্তর বাড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কিছুতেই কমে যেতে পারে না। অনুভব করলাম ঠান্ডা হাওয়া। সেই হাওয়া একেবারে ঝর্ণার মতো গতিধারায় আমাকে ভিজিয়ে দিল। আমি ভিজে গেলেও কেমন শুকনো ছিলাম। আবার অনুভব করলাম আমার শরীর ফুঁড়ে কিছু আমার ভিতর ঢুকছে আবার বাইরে বেরিয়ে আসছে। তীব্র আলোর ছটায় আমি চোখ খুলতে পারলাম না।
সুমিতকে চেঁচিয়ে ডাকতেও পারছিলাম না।ধাক্কাধাক্কি করতে করতে মনে হল কৃষ্ণগহ্বরের কিনারে চলে এসেছি। হাত বাড়িয়ে খুঁজে পেলাম লোহার গেট। খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম লোহার গেটটাকে। আমার চাপে গেট খুলে গেল। মনে হল বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এলাম কোথায়?
চোখ কচলাতে কচলাতে দেখলাম গেটের সামনে দিয়ে চলে গেছে সরু লম্বা গলি আর গেটের পাশেই রয়েছে একটি কামান যা ১৭৫৬ এর যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল। সরু গলির একপাশে জি পি ও। অন্যপাশে কালেক্টরিয়েট বিল্ডিঙ। বুঝলাম আমি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামের ধ্বংসাবসেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে। জি পি ও এর মধ্যে আজও রয়েছে কিছু খিলান, যা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ। সিঁড়িতে কিছু পিতলের পাত যা পুরনো ফোর্ট উলিয়ামের দেওয়ালের অবস্থান চিহ্ন, সবই শ্বেতপাথরের ফলোকে কার্জন লিখে রেখে গেছেন। এই লোহার গেটের পিছনেই ব্ল্যাক হোল বা অন্ধকূপ। মনে পড়ছে সিরাজের অন্ধকূপ হত্যার কথা।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ঘোরতর ইংরেজ বিরোধী ছিলেন। বিনা শুল্কে ইংরেজদের ব্যাবসা করার অধিকার খর্বের চেষ্টা করেন। কাশিমবাজার কুঠি দখল করে ১৬ই জুন ১৭৫৬ সালে সিরাজের সৈন্য বাহিনী এসে উপস্থিত হল কলকাতায়।
ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ হল। অবশেষে হারলেন সাহেবরা, হলওয়েল আত্মসমর্পণ করলেন। ২০শে জুন নবাব অধিগ্রহন করলেন ফোর্ট উইলিয়াম। প্রায় ধ্বংস হয়েছে কেল্লা। জীবিত ইংরেজদের রাখবেন কোথায়? যাদের মধ্যে নারী,পুরুষ, শিশু সকলেই আছেন। তারা সবাই যুদ্ধবন্দি। ঠিক হল তাদের রাখা হবে কেল্লার জেলে। সাহেবরা যাকে বলত “ব্ল্যাক হোল”। ১৪৬জন ইংরেজকে বন্ধ করা হল ১৮ফুট লম্বা ও ১৪ফুট চওড়া একটি কক্ষে। একেই জুন মাসের ভ্যাপসা গরম সাথে যুদ্ধের ক্লান্তি, আগুন, ধোঁয়া সব মিলিয়ে দমবন্ধ করা ভয়ানক পরিবেশ ঐ ঘরের। পরদিন সকালে যখন ঐ ঘর খোলা হল দেখাগেল বেঁচে আছে মাত্র ২৩জন।
এইঘটনা আজও ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে “অন্ধকূপ হত্যা” নামে। যদিও এইনাম সাহেবদেরই দেওয়া। কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে। এই ঘটনায় মৃতদের শান্তির উদ্দ্যেশে হলওয়েল আজকের বিবাদী বাগ ও এন এস রোডের মাঝে তৈরি করলেন একটি মনুমেন্ট। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই মনুমেন্ট ভেঙ্গে পড়ে, পরে অবশ্য সেই মনুমেন্ট সরিয়ে দেওয়া হয়।
কার্জন ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসেই নির্দেশ দিলেন, তৈরি হল পুরনো ফোর্ট উলিয়ামের মানচিত্র এবং খুঁজে বের করলেন উল্লেখযোগ্য স্থান গুলি। দেওয়ালের অবস্থান চিহ্ন বোঝাতে বসালেন পিতলের পাত এবং শ্বেতপাথরের ফলক।
আমি দূর থেকে দেখছি ফেয়ারলি প্লেস দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একা সুমিত। ইস্টার্ন রেলওয়ে এর অফিস বাড়ির দেওয়ালের পাসে ফুটপাথে তাকিয়ে সে দেখছে একটি পিতলের পাতে রয়েছে জ্যামিতিক চিহ্ন আঁকা, তারপর তাকাল ঠিক এর উল্টো দিকে ইস্টার্ন রেলওয়ের অফিস বাড়ির দেওয়ালে, যেখানে শ্বেতপাথরের ফলকে পরিষ্কার লেখা আছে ঐ স্থানটিই হল পুরনো ফোর্ট উইলিয়ামের উত্তর-পশ্চিম সীমানা। এই সীমানা দিয়েই ঢুকেছিলেন তরুন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ও তার সেনা।
এদিকে আসতেই সুমিত বেলুনের মতো ফুলে ভাসতে ভাসতে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। আমি দেখলাম সেই প্রবেশ দ্বার দিয়েই ফোন কানে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো এক যুবক।
ফোনে ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা নিয়ে কথা বলতে শুনলাম। এতোদিন জানতাম ব্ল্যাক হোলের থেকে আলো নির্গত হয় না, তাই ব্ল্যাক হোলের ফটোও তোলা যায় না। সাধারণ ক্যামেরায় তোলা যা অসম্ভব। ইভেন্ট হরাইজ়ন টেলিস্কোপে তোলা গেছে সেই ব্ল্যাক হোলের ছবি যে এম৮৭ নামে এক গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ঘাপটি মেরে বসেছিল।
আমিও আসতে আসতে ফুলছি আর আড়ি পেতে শুনছি। বেশ জোরে জোরে বলছিল, ব্ল্যাক হোল নক্ষত্রের প্রেত দশা। যে কোনও নক্ষত্রে চলে দুই বিপরীতমুখী ক্রিয়া। নক্ষত্রের অগ্নিকুণ্ড, যা লুচির মত ফোলাতে চায় তাকে। আর বিশাল পরিমাণ পদার্থের প্রচণ্ড গ্রাভিটি, যা সঙ্কুচিত করতে চায় তাকে।
জীবনশেষে আগুন স্তব্ধ, তখন শুধু গ্রাভিটির চাপ। নক্ষত্র ভারী হলে, তখন তা পরিণত হয় ব্ল্যাক হোলে। চাপে নিষ্পেষিত একটি শাঁস, তার বাইরে বিস্তৃত একটা অদৃশ্য বলয়, যার মধ্যে কোনও কিছু — এমনকি আলোও — বাইরে বেরোতে পারে না। বিজ্ঞানের পরিভাষায় ওই বলয়ের নাম ইভেন্ট হরাইজ়ন। এই হল ব্ল্যাক হোলের সাধারণ পরিচয়। আর যদি শাঁস ঘিরে বলয় বা ইভেন্ট হরাইজ়ন না থাকে? তখন শাঁস উলঙ্গ। বিজ্ঞানের পরিভাষায় নাম নেকেড সিংগুলারিটি।
যুবক ফোনে বলছিলেন, এম৮৭ গ্যালাক্সি ম্যাগনেটিক মোনোপোল দিয়ে গড়া। সাধারণ চুম্বকের থাকে দুই মেরু— উত্তর ও দক্ষিণ। কোনও চুম্বককে ভেঙে দু’টুকরো করলেও যে দু’টো চুম্বক পাওয়া যায়, তাতে প্রত্যেকটার দু’টো করে মেরুই থাকে। তবে ওই যুবকের ধারণা একটাই মেরু। কোন এক নোবেলজয়ী পদার্থবিদ কল্পনা করেছিলেন এক মেরু বিশিষ্ট চুম্বক যা এখনও বাস্তবে মেলেনি। অথচ যুবকের দাবি এম৮৭ গ্যালাক্সি মোনোপোলের আখড়া।
ভেবে দেখলাম সমগোত্রীয় মেরুর মধ্যে বিকর্ষণ হওয়াই স্বাভাবিক। তাই হয়তো অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আমরা দুজনে আর কিছুতেই কাছাকাছি আসতে পারলাম না। বোধ হয় ইভেন্ট হরাইজন আমাদের কোনোভাবে হারিয়ে গেছে।
আমরা পরস্পরের থেকে অনেক দূরে গ্যালাক্সি মোনোপলের আখড়ায়।আমরা এখন নেকেড সিংগুলারিটি।