Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিজ্ঞানমনস্ক বিদ্যাসাগর || Soumen Chakraborty

বিজ্ঞানমনস্ক বিদ্যাসাগর || Soumen Chakraborty

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবলমাত্র একটি নাম নয়, এটি একটি সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান। যাঁর জীবন বৃত্তান্ত পড়লে আমরা নতুন ভাবনায় সমৃদ্ধ হই, নব চেতনায় উদ্ভাসিত হই। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে ওনার জন্য। একাধারে মহান পন্ডিত, অকুতোভয় সুউচ্চ শির, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক; আবার উনিই দয়ার সাগর। দেশের পিছিয়ে পড়া নারীসমাজের কল্যাণ ও তাদের শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার জন্য ওনার প্রচেষ্টা দেশীয় ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। আমার আলোচনার বিষয়বস্তু ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিজ্ঞান চেতনা’, যেটা এমনিতেই প্রথমে শুনলে একটু খটকা লাগে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আমরা একজন সংস্কৃত পণ্ডিত, সমাজ সংস্কারক এবং দয়ার সাগর হিসাবেই জানি বা মানি। কিন্তু তিনি যে একজন প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক তথা বিজ্ঞান অনুরাগী ছিলেন, সে বিষয়ে আমরা অনেকেই অবগত নই। কারণ তাঁর জীবনের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হলেও দুর্ভাগ্যবশত তাঁর চরিত্রের এই দিকটিতে সেভাবে আলোকপাত করা হয়নি। আমি চেষ্টা করবো আজ এই দিকটি তুলে ধরতে।পাঠ্যজীবনে বিদ্যাসাগর বিজ্ঞান চর্চা করেননি;‌ কারণ তিনি মূলত কলাবিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। সংস্কৃত ভাষায় এমন কোনো বিষয় ছিল না, যা উনি পাঠোদ্ধার করেননি। চতুর্বেদ থেকে শুরু করে আঠারো পূরাণের সমস্তটাই উনি পাঠ করে, তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সফল হন। কাজেই এমন একজন মহান জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফলতার শিখরে বিরাজিত, তাঁর কাছে জ্ঞানের সমস্ত দিকই অবারিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কাজেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আচার–‌আচরণে একজন সার্থক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের রূপও আমরা দেখতে পাই। তিনি যে বিজ্ঞানের তত্ত্ব, তথ্যাদি ও আবিষ্কারের খবরাখবর রাখতেন, তা তাঁর কাজকর্মে প্রমাণিত।

আমরা সকলেই অবহিত যে উনি সময় পেলেই ওনার গ্রামের অবহেলিত, দরিদ্র পাড়ায় গিয়ে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ‘রসসাগর বিদ্যাসাগর’ বইয়ে রয়েছে— ‘‘নিজে বহু অসুখে ভুগেছেন তার যন্ত্রণা, অপরকে ভুগতে দেখার যন্ত্রণা পণ্ডিত বিদ্যাসাগরকে ‘চিকিৎসক’ বিদ্যাসাগর করে তুলেছিল।’’ আসলে গরীব অসহায় মানুষের জন্য তাঁর হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হতো।

বাঙালির শিক্ষার জন্য তিনি প্রচুর পুস্তক রচনা করেছিলেন। যা কালজয়ী রচনা হিসেবে সমাদৃত। বিজ্ঞানের মৌলিক বই তিনি না লিখলেও ছাত্রদের পঠনের অসুবিধার কথা ভেবে তিনি বিজ্ঞানের অঙ্গনে প্রবেশ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আসলে যেকোনো শিক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানে বিরাজ করলে, তাঁর কাছে সমস্তটাই প্রাঞ্জল। এ যেন অনেকটা যেকোনো উপায়ে এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারলে, তখন ওপর থেকে সবকিছুই দৃশ্যমান। তবে সৎপথ অবলম্বন করতে হবে, নাহলে কুয়াশায় দৃশ্যপট আচ্ছাদিত হবে।

বিদ্যাসাগর মহাশয় উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বার্স ভ্রাতৃদ্বয় রচিত ইংরেজি বই ‘‌এক্সেমপ্লারি বায়োগ্রাফি’‌ থেকে কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবনী সঙ্কলন করে ‘‌জীবনচরিত’‌ নামে প্রকাশ (‌১৮৫০)‌ করেন। যে সমস্ত জীবনী ‘‌জীবনচরিত’‌–‌এ স্থান পেয়েছিল, তাঁরা ছিলেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মহান ব্যক্তিত্ব। উদ্ভিদবিদ স্যার ক্যারোলাস লিনিয়াস, জ্যোতির্বিদ কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও। এছাড়াও পদার্থবিজ্ঞানী নিউটন, ভূগোলবিদ ডুবাল এঁদের মধ্যে অন্যতম। যেটা তৎকালীন সময়ে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের আবিস্কার সম্পর্কে বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদের অবগতি করানোর জন্য একটি অনন্য প্রয়াস।

শুধু তাই নয়, তিনি ছাত্রদের সুবিধার জন্য বিজ্ঞান সংক্রান্ত কয়েকটি কঠিন ইংরেজি শব্দের পরিভাষা মাতৃভাষা বাংলায় উল্লেখ করে ‘‌জীবনচরিত’‌–‌এর শেষে যুক্ত করে দিয়েছিলেন, যার কয়েকটি আজও আমরা ব্যবহার করি।
‘‌চেম্বার্স রুডিমেন্টস অফ নলেজ’‌ বইয়ের অনুকরণে ‘‌বোধোদয় চতুর্থ ভাগ’‌ বইটি লেখা। জড়পদার্থ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ, মানবজাতি, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, ধাতু, কৃষিকর্ম, জল, নদী, সমুদ্র অর্থাৎ প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা এতে স্থান পেয়েছে। সেই যুগে এই বই ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। বইটির মাধ্যমে জগৎ সম্বন্ধে কিশোরদের সম্যক ধারণা গড়ে তোলার প্রয়াস তাঁর সমগ্র চিন্তাধারার মধ্যে ছিল। রসায়ন বিদ্যায় ধাতু কী, তার ধর্ম ও উদাহরণ থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়ে সবিশেষ আলোচনা ছিল সেই বইটির মধ্যে।

তিনি চেয়েছিলেন ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানকে আকর্ষণীয় করে তুলতে। ‘‌জীবনচরিত’‌ ও ‘‌বোধোদয়’‌ বই দুটিকে একযোগে বিজ্ঞানের বর্ণপরিচয় ও বিজ্ঞানের ধারাপাত বললে অত্যুক্তি হয়না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের থেকে প্রেরণা লাভ করে বহু গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক নতুন পুস্তক রচনায় আগ্রহী হন। তাদের বই রচনার ক্ষেত্রে তিনি নানাভাবে সাহায্য করতেন। এই যেমন শব্দের সঠিক প্রয়োগ ও বিভিন্ন শব্দের সঠিক অনুবাদ করে সাহায্য করতেন। উদাহরণস্বরূপ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী প্রণীত পাটিগণিত গ্রন্থের যেমন তিনি শব্দ সঙ্কলনে সাহায্য করেন। এছাড়াও বীজগণিত বই রচনায় তিনি উৎসাহিতও করেন। চন্দ্রকান্ত শর্মাকেও তিনি গণিতাঙ্কুর প্রণয়নে উৎসাহিত করেছিলেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অক্ষয়কুমার দত্ত প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ ‌‘‌বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’‌–‌এর সংশোধন করে দেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমসাময়িক প্রখ্যাত চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন বিদ্যাসাগরের মতোই নিজের সংকল্পে দৃঢ়। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন একজন অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসক। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হোমিওপ্যাথি রীতিতে বিশ্বাসী হন। তিনি কলকাতায় ভারতীয় বিজ্ঞানমন্দির (‌ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স)‌ প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। যা বর্তমানে ভারতীয় গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।

আসলে বিদ্যাসাগর মহাশয় চেয়েছিলেন, দেশমাতৃকার নব প্রজন্ম যেন শুধুমাত্র পুঁথি সর্বস্ব না হয়। তারা বর্তমান পৃথিবীর বিজ্ঞান চর্চা সম্পর্কে জেনে নিজেদের সমৃদ্ধ করুক। তবেই ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। তাইতো তিনি নিজের চেষ্টায় বিজ্ঞান শিক্ষার সম্প্রসারণে সবিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ গরীব মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করার প্রয়াস, তাঁর বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয় বহন করে। তাইতো তিনি মহান তাঁর গৌরবে। নিদারুণ প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে নিরন্তর যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে। আসলে তৎকালীন সময়ে তাঁকে সঙ্গ দেবার মতো মানুষের যথেষ্ট অভাব ছিল। কয়েকজন যাঁদের নাম পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ওনারা ব্যতিক্রম। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- ‘‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন।’ দুঃখ ভারাক্রান্তভাবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন: ‘তাঁর সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না।…প্রতিদিন দেখিয়াছেন—আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না ও যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।…এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক ও তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।’’

তথ্যসূত্র:- রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর- মালেকা বেগম,
আজকাল পত্রিকায় সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের লেখা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress