Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বচক্ষে মৃত্যু দেখা || Arghyadeep Chakraborty

স্বচক্ষে মৃত্যু দেখা || Arghyadeep Chakraborty

বাড়ি ফিরছি দু’মাস পরে। অফিসের কাজে ছিলাম বাইরে। স্টেশনে যখন নামলাম তখন সন্ধে সাতটা বাজে। স্টেশন থেকে প্রায় এক কিমি দূরে আমার বাড়ি।

আজ আবার বেজায় গরম। যদিও এটা গ্রীষ্মকাল তবুও আজকে গরম যেন খুব বেশি। ট্রেনে করে যখন আসছিলাম তখন জানালা থেকে দেখছিলাম আকাশে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অর্থাৎ বুঝছিলাম গরমের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে কালবৈশাখী ধেয়ে আসছে।

বাড়ি আমার গ্রামে। এই স্টেশনটিও একপ্রকার গ্রাম্য স্টেশন। আজও অব্দি এখানে একটাই লাইন আছে। অর্থাৎ ট্রেন একটা লাইন দিয়ে আপ হয়ে যায় আবার সেই লাইন দিয়েই ডাউন হয়ে আসে। যাই হোক স্টেশনে নেমে রিক্সা বা মোটর ভ্যান গাড়ি ধরলেই বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়। অন্য কোনোদিন হলে এখান থেকে ঠিকই গাড়ি পাওয়া যেত। কিন্তু আজকে দেখলাম কোনো গাড়িই নেই। হয়তো সবাই বুঝতে পেরেছে, ঝড়-বৃষ্টি আসছে তাই আগাম চলে গেছে যে যার বাড়ি।

কী আর করব স্টেশন থেকেই হাঁটা পথ ধরলাম। যেহেতু দু-মাসের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম তাই সঙ্গে দু-তিনটে ব্যাগ আছে। এত ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হয়। কিন্তু কোনো উপায় যখন নেই তাই এভাবেই যেতে হবে বুঝে নিলাম।

এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। ঝড়েরও দেখা নেই। শুধু আকাশে মাঝেমাঝেই দামিনী তিড়িং-বিড়িং করে নেচে বেড়াচ্ছে আর তাই জন্য মেঘ গুর-গুর গুর-গুর করছে।

পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। হাত ঘড়িটা কোনোরকমে দেখেছি। এখন এসে পৌঁছেছি একটা বড় মাঠের ধারে। এই মাঠের পরেই আমার বাড়ি। মাঠের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে আমার বাড়ি দেখা যায়। বলা যায় এই মাঠের পর থেকেই একের পর এক গ্ৰাম শুরু হয়। তারমধ্যে প্রথম গ্ৰামটাই আমার।
স্টেশন থেকে ইট পাতা রাস্তা ধরে এতক্ষণ এলাম। মাঠ পেরোলেই মাটির পথ শুরু।

এতক্ষণ যখন আসছিলাম তখন একটা জনপ্রাণীকেও রাস্তায় দেখিনি। অবশ্য গ্রামের দিকের ব্যাপার তো এই ঝড়-বাদলের সময় সাধারণত কেউ ঘরের বাইরে বের হয় না। কিন্তু কিছু কিছু ছোটো ছোটো দোকান দেখেছিলাম খোলা আছে।

হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল। ইতোমধ্যেই আমি মাঠ ধরে হাঁটা শুরু করে দিয়েছি। সঙ্গে যদি আমার এতগুলি ব্যাগ না থাকত তাহলে এর অনেক আগেই বাড়ি পৌঁছে যেতাম। ঝড়ে মাঠ ময় ধুলো উড়তে লাগল। এমনভাবে উড়তে লাগলো যেন কোনো আত্মা মৃত মানুষের শরীর ছেড়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছে। এতকিছু আমি দেখলাম কীভাবে? ঐ আকাশে যে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তার আলোতেই।

এই হাঁটার সময় যদি ঝড়টা না উঠত তাহলে ভালোই হত এটাই ভাবছিলাম। হাঁটার গতি আর একটু বাড়িয়ে দিলাম। মাথা মুখ সব ধুলোয় ঢেকে যেতে লাগল।

হঠাৎ দেখলাম আমার থেকে কুড়ি-তিরিশ হাত দূরেই একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন। এতক্ষণ তো তাঁকে দেখিনি। আমি তাঁকে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। আমাদের গ্রামের হারুণদা। গ্ৰামে যে গমকল আছে উনি সেখানে কাজ করেন।
আমি ডাক দিলাম একবার…. ও হারুণদা…।
শুনতে পেয়েছেন জেনে ভালো লাগল। পিছন ফিরে তাকালেন।
আমি বললাম “দাঁড়ান দাঁড়ান, একসাথে যাই।”
আমাকে দেখে বললেন, “ও তুই। তা এতদিন পরে ফিরলি?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ গো, ওই অফিসের কাজে বাইরে গেছিলাম। চলুন যাই।”
হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলতে লাগলাম।
“তা এই ঝড় বৃষ্টির সময় আপনি বাইরে বেরিয়েছেন কেন?”
“ঐ একটু খাবার আনতে গেছিলাম।”
“ও। তা আপনাকে তো দেখতে পেলাম না পথে।”
“কিন্তু আমি তো দেখলাম তোকে, দূর থেকে আসছিস। তা এই ঝড়ের সময় আর দেরি করিনি রে। বাড়ির পথ ধরেছি।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ তাই হবে। ঠিকই বলেছেন। আসলে সঙ্গে এত ব্যাগ নিয়ে আসছি, আর বাড়ি যাওয়ারও তাড়া আছে তাই আপনাকে অত লক্ষ করিনি।”
“হুম।”
ঝড়ের মধ্যে বেশি কথা বলতে পারলাম না।

এবার এক ফোঁটা দু-ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। হঠাৎ দেখলাম আমার পাশে যেন একশোটা পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম হারুণদার গলার এক বিকট শব্দ…. আ….।
ঠিক ব্যাপারটা বুঝলাম না। পাশ ফিরে যেই তাকালাম দেখলাম, হারুণদা মাটিতে পড়ে আছে। তাঁর হাতে ধরা আছে খাবারের থলিটা। সঙ্গে সঙ্গেই একটা পৃথিবী কাঁপানো শব্দ শুনতে পেলাম। শুনে আমার মনে হল, আমার বুঝি কানের পর্দা ছিঁড়ে গেল। ব্যপারটা যেন দুই-তিন সেকন্ডের মধ্যে ঘটে গেল, এতটাই তাড়াতাড়ি হল। বুঝলাম তার মাথায় বাজ পড়েছে। আকাশ কেড়ে নিল হারুণদার প্রাণ!

আমি তখন ধপ করে বসে পড়েছি মাটিতে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। এভাবে কোনো মানুষকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখিনি।
আমার আর মাথা কাজ করছিল না। কেমন সব ভুলভাল কথা সারা মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল… আমার ঠিক পাশেই একটা মানুষের উপর বাজ পড়ল…. অথচ আমার উপর পড়ল না… আমি যদি মরে যেতাম তাহলেও হয়ত হারুণদা বাড়ি ফিরে ছেলে-পুলেকে খাবারের থলিটা দিতে পারত …. মৃত্যু কখন যে কীভাবে আসে … আহা, গো! তাদের আর খাওয়া হল না….।

বৃষ্টি এখন ঝমঝম করে শুরু হয়ে গেছে। আমি পুরোদমে ভিজছি। পাশেই হারুণদার মৃতদেহও ভিজছে। তিনি উপুড় হয়ে পড়েছিলেন। মৃতদেহটি চিৎ করে শোয়ালাম। চোখে-মুখে রক্ত লেগে আছে। আমার বুকের ভিতরে হৃদপিণ্ড এত জোরে চলছিল যেন মনে হচ্ছিল এক্ষুনি খুলে হাতে চলে আসবে।
আমি ব্যাগ-পত্তর ওখানেই রেখে পাগলের মতো চিৎকার শুরু করে বাড়ির দিকে ছুটে চললাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *