গোরাচাঁদ
গোরাচাঁদ ঘরে আসতেই বন্ধুরা তাকে সহর্ষে অভ্যর্থনা জানাল। আয় গোরা, আয়; একটু আগেই তোর কথা হচ্ছিল। হপ্তাখানেক দেখা নেই—ভাবছিলাম হল কী! জলধর কালই তোর বাড়ি যেত। তা তোর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল?
বন্ধু বলতে ঘরে তখন তারা চারজন। সলিল, জলধর, নিয়োগী আর মানিক। ওরা তাস খেলছিল। বেশির ভাগ দিন সন্ধেটা ওদের তাস খেলেই কেটে যায়। সলিলদের বাড়ির বৈঠকখানার নামই হয়ে গিয়েছে ‘তাসের ঘর’।
গোরাচাঁদ খুবই বিমর্ষচিত্তে ঘরে ঢুকেছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, জবরদস্ত ডেঙ্গুজ্বর কিংবা ম্যালেরিয়ায় ভুগে সবে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। চোখমুখ শুকনো, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, দাড়ি কামানো হয়নি ভাল করে, চোখের চশমা ঢিলে হয়ে নাকের ডগা পর্যন্ত গড়িয়ে এসেছে। এরকম হবার কথা নয়, অন্তত এখন।
হাতের তাস হাতে রেখেই জলধর বন্ধুকে দেখছিল। বলল, “কিরে গোরা, তোর এ হাল কেন? অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? আমার বাড়ির ফোনটা ডেড, নয়ত তোকে—।”
গোরাচাঁদ কোনও কথা বলল না। একেবারে কোণের দিকে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল।
নিয়োগী বলল, “বিয়ে পেছিয়ে গেল নাকি রে? মন খারাপ? আরে মন খারাপ হবার কী আছে! গরমে বিয়েটা ঠিক জমে না। গরম বর্ষা পার করে দে—মাত্তর তো আর চার পাঁচটা মাস, তারপর লাগা। অর্লি অঘ্রানে। নরম শীতে নতুন বউ…ফাইন!”
গোরাচাঁদ বেশ বিরক্ত হয়ে নিয়োগীকে দেখল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “জলের বোতলটা দে।”
বন্ধুরা তাস খেলতে বসলে চায়ের কাপ খাবারের প্লেটের সঙ্গে কয়েকটা জলের বোতলও জমে যায়।
মানিক জলের বোতল এগিয়ে দিল। বলল, “খালি পেটে জল খাবে দাদা? একটু তলানি আছে। দেব?” বলে হাসল। বন্ধুদের মধ্যে মানিক হল জুনিয়র।
গোরাচাঁদ ও-সব নেশার জিনিস খায় না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একবার দশ বিশ ফোঁটা খেয়েছিল। মিলিটারি মাল। তাতেই তার জিব জড়িয়ে গিয়ে সে কী অবস্থা! পান সিগারেট ছাড়া গোরাচাঁদের আর কোনও নেশা নেই। তার বন্ধুরাও ঠিক নেশুড়ে নয়, তবে মাঝেমাঝে দু-এক পাত্তর চড়িয়ে নেয়।
জল বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল খেয়ে নিল গোরাচাঁদ। তারপর বলল, “একটু চা হলে হত।”
সলিল বলল, “চা হবে। আগে বল, তোর হয়েছে কী?”
“সে অনেক কথা। বলছি। আগে একটু চা…।”
সলিল উঠে গেল চায়ের কথা বলতে।
জলধর বলল, “আমরা তো তোর বিয়ে নিয়েই কথা বলছিলাম। ভাবছিলাম তোকে বলব, তোর জেঠামশাই ওল্ডম্যান, তাঁকে আর কষ্ট দেওয়া কেন! তোর বিয়ের ব্যাপারটা আমরাই ম্যানেজ করে দেব। এই ধর বিয়ের চিঠি, প্যান্ডেল, খাওয়া-দাওয়া, লোকজনকে আপ্যায়ন…।”
জলধরের কথা শেষ হল না, গোরাচাঁদ বলল, “বিয়ে হচ্ছে না। আমি করছি না। ”
বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল, “সে কি রে? কেন? সব ঠিক হয়ে গেল—এখন— ?”
সলিল ফিরে এল।
সলিল ফিরে আসতেই মানিক বলল, “সলিলদা, শোনো গোরাদা কী বলছে! বিয়ে করছে না গোরাদা।”
সলিল দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল গোরাকে। অবাক হয়ে বলল, “বলিস কিরে! সত্যি নাকি?”
গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এই বিয়ে করছি না।”
“কেন?”
“আমাকে বিচ্ছিরিভাবে ইনসাল্ট করেছে। যা-তা বলেছে মেয়েটা।”
“মেয়েটা! কোন মেয়েটা?”
“ওই মেয়েটা, কমলিকা না মালবিকা— কী যেন নাম ওটার।” গোরাঁচাদ রীতিমতন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের গলায় বলল। নামটাও যেভাবে বলল—মনে হল,ওই মেয়ের নাম মনে রাখারও যেন তার প্রয়োজন নেই।
তাস খেলার পাট চুকে গেল। হাতের তাস ফেলে বন্ধুরা পরম কৌতুহলে গোরাচাঁদকে দেখতে লাগল। ব্যাপারটা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। গোরাচাঁদ কোনও কালেই বদমেজাজি নয়, হঠকারিও নয়। রুক্ষ রূঢ় সে হতে পারে না কোনও অবস্থাতেই। ওর স্বভাব নরম। নিরীহ ভিতু ধরনের মানুষ। সাদামাটা সরল। তার জেঠামশাইয়ের একান্ত বাধ্য ও অনুগত। অবশ্য তার কারণ আছে। গোরাচাঁদের বাবা যখন মারা যান গোরার বয়েস তখন তিন। জেঠামশাই জেঠাইমাই তাকে মানুষ করেছেন।
মা অবশ্য ছিলেন। কিন্তু ওর তেরো চোদ্দো বছর বয়েসে মা-ও চলে যান। জেঠামশাই জেঠাইমাই তার সব। জেঠামশাইদের কোনো ছেলে নেই, একটি মেয়ে আছে—গোরাচাঁদের দিদি। দিদিও অনেক দিন ধরে অন্য সংসারের লোক হয়ে গিয়েছে—থাকেও কলকাতার বাইরে। দুর্গাপুরে। মাঝেমধ্যে আসে অবশ্য। দিদিও গোরাচাঁদকে ভালবাসে খুব। …তা ছেলে হিসেবে গোরাচাঁদ চমৎকার। সরল, ভদ্র , সভ্য, নম্র। দেখতেও ভাল। গায়ের রং ফরসা ; চেহারা গোলগাল। চোখ দুটি বড় বড় মুখে সব সময় একটু হাসি লেগে থাকে।
বন্ধুরা যেন বুঝতে পারছিল না, শিষ্ট মার্জিত নম্র গোরাচাঁদ হঠাৎ এভাবে বিগড়ে গেল কেন? ও কি সত্যিই বিগড়েছে? না, তামাশা করছে? চেহারা দেখে তো মনে হয় না তামাশা করছে!
জলধর যেন তখনও বিশ্বাস করেনি। বলল, “তুই বেটা সত্যি বলছিস? না, নাটক করছিস?” বলে বন্ধুদের সঙ্গে একবার চোখাচুখি করে নিল।
“সত্যি বলছি।”
“হয়েছেটা কী?”
“বললাম তো, মেয়েটা আমাকে ইনসাল্ট করেছে। একবার নয় অনেকবার। কালও আমাকে যা-তা বলেছে।”
“কেন?”
“আমি কেমন করে জানব?”
“তুই কিছু করেছিলি?”
গোরাচাঁদ আরও বিরক্ত হল। বলল, “আমি কিছু করব? মানে? আমি তাকে চোখেই দেখিনি। সে তুই দেখেছিস।”
কথাটা মিথ্যে নয়। সম্বন্ধ-করা বিয়ে। জেঠামশাইয়ের এক বন্ধু সম্বন্ধটা দিয়েছিল। জেঠামশাই জেঠাইমা দিদি মেয়ে দেখেছে। আর গোরাচাঁদ ও তার বন্ধুদের তরফে দেখেছে জলধর।
মানিক রঙ্গ করে বলল, “চোখে দেখনি বোলো না দাদা, বলো ফটো দেখেছ—ফেস টু ফেস হওনি।”
সলিল বলল, “এই মানিক, চুপ কর। ব্যাপারটা শুনতে দে।” বলে গোরাচাঁদের কাছাকাছি গিয়ে বসল। “ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বল। হয়েছেটা কী?”
গোরাচাঁদ সামান্য সময় চুপ করে থাকল। বলল, “কী বলব! গত হপ্তায় যখন এখানে এলাম—তোদের বললাম, জেঠামশাই এই জষ্টি মাসেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবে বলেছে। মেয়েদের তরফও তাই চায়। জেঠাইমা বলছে, আষাঢ়। জ্যৈষ্ঠমাসে নাকি বড় ছেলের বিয়ে দিতে নেই।”
নিয়োগী বলল, “তোর আর বড় ছোট কী! তুই তো একটাই।”
সলিল বলল, “ছেড়ে দে, যাহা বাহান্ন তাহা তিপান্ন, জষ্টিমাস আর আষাঢ় মাসে তফাতটা কী!… তারপর কী হল বল?”
গোরাচাঁদ বলল, “মাস নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বিশ্বাস কর। তা গত হপ্তায় এখান থেকে ফিরে গেলাম—সেটা তোর শনিবার। রবিবার সন্ধেবেলায় এক ফোন।”
“ফোন?”
“বাড়িতে। ফোন তুলতেই একটা মেয়ের গলা। কী বলল জানিস?”
“কী?” বন্ধুরা এসঙ্গে বলল।
“বলল, কী গো নদের চাঁদ কেমন আছ?”
“নদের চাঁদ?”
“বিশ্বাস কর, প্রথম কথাই বলল, কী গো নদের চাঁদ, কেমন আছ? আমি ভাই একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। বুঝতেই পারলাম না কী ব্যাপার। আজকাল ফোনে যা সব কাণ্ড হয় তোরা জানিস। কিছু চ্যাংড়া আজেবাজে কথা বলে, অসভ্যতা করে। চেংড়িরাও করে ভাই। থার্ড ক্লাস কথাবার্তা বলে। তা আমি বললাম, কাকে চাই? কে নদের চাঁদ?.. তখন মেয়েটা বলল, আহা, ঢং কোরো না। তোমাকেই চাই! গোরাচাঁদ না কালাচাঁদ! কী নাম রে? ভদ্রলোকের ওই সব নাম হয় নাকি? শোনো নদের চাঁদ, বিয়ে করতে সাধ হয়েছে—নামটা পালটাতে পারোনি। যাও কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট করে নামটা আগে পালটে নাও। টেলিফোনের পাঁজিতে ভাল ভাল নাম পাবে। বুঝলে? নামের কী বাহার? গোরাচাঁদ! অখাদ্য। আবার করেন কী, না—গেঞ্জি জাঙ্গিয়ার ব্যবসা! ছিছি! ওই ছেলের আবার বিয়ে করতে সাধ! নোলা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে! লজ্জাও করে না?”
বন্ধুরা অবাক। বিশ্বাস করতে পারছিল না। জলধর বলল, “যাঃ, কী বলছিস! তোকে এসব কথা বলল? একটা মেয়ে? তাও আবার যে-মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা ফাইন্যাল হয়ে গিয়েছে।”
গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে সদুঃখে বলল, “শুধু ওইটুকু বলল নাকি! আরও কত কী বলল। অসভ্যের মতন। তারপর আরও বলল, কাল আবার ফোন করব। রাত আটটা নাগাদ। ফোন ধরবে। না ধরলে তোমার বারোটা বাজিয়ে দেব। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব—বুঝলে কালাচাঁদ। আমায় তুমি চেনো না।”
সলিল বন্ধুদের মুখের দিকে তাকাল। শেষে গোরাচাঁদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলল, “গোরা, দিস ইজ নট পসিবল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। বিয়ে আমরাও করেছি। আমাদের বউরাও কম তেঁয়েটে নয়। তা বলে তারা বিয়ের আগে এভাবে কথা বলেনি। সে সাহস ছিল না।”
মানিক বলল, “দাদা, তুমি কি ফোন ধরার সময় হুঁশে ছিলে?”
“মানে?”
“মানে নরম্যাল ছিলে তো? কান ঠিক ছিল! তোমার আবার কানের দোষ আছে একটু।”
“বাজে কথা বোলা না।”
নিয়োগী বলল, “গোরা, মেয়েটার গলা শুনে তুই চিনতে পারলি?”
গোরাচাঁদ রেগে গিয়ে বলল, “আমি কি মেয়ের গলা শুনেছি? না, তাকে চোখে দেখেছি।”
“তবে কেমন করে বুঝলি ওই মেয়েটাই ফোন করছে?”
“বাঃ, অদ্ভুত কথা। কেমন করে বুঝলি! মেয়েটা অত কথা বলে যাচ্ছে, হাসছে হি হি করে, টন্ট করছে—আর আমি বুঝব না! আমি কি গাধা! তা ছাড়া ও তো বুঝিয়েই দিল—এই হল সেই মেয়ে যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
সলিল বলল, “তুই নাম জানতে চাইলি না?”
“চেয়েছি। বলেছে, ন্যাকামি কোরো না! নাম না বললে চিনতে পারছ না, না?”
জলধর বলল, “সেই মেয়েই। কমলিকা। আমি তো ওকে দেখেছি। কথাও শুনেছি। মেয়েটাকে দেখতে ভাল। তবে ভেতরে বিচ্ছু বলে মনে হল। যে-ভাবে টেরচা চোখে আমাকে দেখছিল। গলার স্বরটা একটু ভাঙা ভাঙা, না কিরে গোরা?”
গোরাচাঁদ বলল, “ভাই, ফোনে গলা শুনে বোঝা যায় না। অচেনা গলা। তবে জোর আছে গলার। ধমক মেরে কথা বলে। “
মানিক বলল, “পরের দিন তোমাকে ফোন করেছিল আবার?”
“করেছিল। আটটার পর পরই।”
কী বলল?”
“ন্যাস্টি কথাবার্তা।”
“অশ্লীল কিছু?”
“নানা, ভালগার টাইপের কথাবার্তা! আমায় কেমন নাড়ু-নাড়ু দেখতে ! চোখ লিচুর মতন, নাক ভুটানিদের টাইপ। আমার নাকি গলগণ্ড রোগ আছে।”
“গলগণ্ড! তোমার? কই আমরা তো দেখছি না। বরং তোমার গল বেশ গোলগাল। তা শুধু চেহারার কথা বলল?”
“চেহারা, স্বভাব। হোয়াট নট! যা প্রাণে চাইছিল বলে গেল। তারপর শেষে বলল, পয়সা ছড়ালে কাকের অভাব হয় না বুঝলে নাড়গোপাল। তোমার মতন পাত্তর আমার পাশে দাঁড়াবার যুগ্যি নয়। আমার বাপ অনেক ভাল ভাল পাত্তর আনতে পারে—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিএ, সরকারি অফিসার। তুমি তাদের কাছে গোল্লা। হনুমান!”
“হনুমান?” মানিক আঁতকে উঠল। “দাদা, তোমায় হনুমান বলল! কী মেয়েরে বাবা! এ তো অত্যন্ত অসভ্য, বেয়াদপ!”
এমন সময় চা এল গোরাচাঁদের।
চা দিয়ে বাচ্চা মেয়েটা চলে যেতেই গোরাচাঁদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “কী বলব ভাই! রোজ রাত আটটার পর মেয়েটা ফোন করে আর একতরফা যা মুখে আসে বলে যায়। শেষে কাল বলল, শোনো নদের চাঁদ তোমায় ওয়ার্নিং দিয়ে দিচ্ছি, তুমি যদি গাড়ি সাজিয়ে টোপর হাতে সত্যিই বিয়ে করতে আস, বিপদ হবে। পাড়ার ছেলেদের বলে রাখব, বোমা মেরে তোমার বিয়ের সাধ ঘুচিয়ে দেবে।”
নিয়োগী সভয়ে বলল, “সে কিরে? পাড়ার ছেলেদের লেলিয়ে দেবে বোমা মারতে। এ তো মাইরি পলিটিক্যাল নেতাদের মতন কথা হল! মেয়েটা তো ডেনজারাস।”
গোরাচাঁদ বলল, “আমিও কাল মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। স্ট্রেট বলে দিয়েছি—গুঁড়ো মশলার মেয়ে বিয়ে করতে আমার বয়ে গেছে। যত্ত ভেজাল!”
সলিলের যেন রোমহর্ষ অনুভূতি হল। বলল, “তুই বললি?”
“বললাম। কালোকে কালো বলব—তাতে ভয় কিসের! ওরা তো গুঁড়ো মশলার বাড়ির লোক। মেয়ের বাপের গুঁড়ো মশলার বিজনেস। অন্নপূর্ণা গুঁড়ো মশলা! আমাকে যদি ও গেঞ্জি জাঙ্গিয়ার ব্যবসাদারের ছেলে বলতে পারে—আমি ওকে গুঁড়ো মশলা বলতে পারব না? আমাদের সাতাশ বছরের হোসিয়ারি কারখানা। হোসিয়ারি বিজনেসে সুতো ভালমন্দ হতে পারে— কিন্তু ভেজাল চলে না। ওরা ভেজাল। আমরা নির্ভেজাল।
বন্ধুরা প্রথমটায় কথা বলতে পারল না। গোরাচাঁদকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
নিয়োগী শেষমেশ কথা বলল। “গোরা, তুই ঠিক করেছিস। রাইটলি সার্ভড। তোর কারেজ দেখে জয় হিন্দ বলতে ইচ্ছে করছে।”
জলধররা হেসে ফেলল। অবশ্য অট্টহাস্য নয়। মুচকি হাসল।
সলিলদের অ্যাটর্নি অফিস। বাপকাকার আমলের। আইনটা তার মাথায় আসে চট করে। ঠিক আইন নয়, তবে আসল কথাটা সে না বলে পারল না। বলল,”গোরা, কেস তুই কাঁচাতে চাইলেও কি পারবি? তোর জেঠামশাই! বলেছিস তাঁকে?”
গোরাচাঁদ বলল, ভয়ভয় গলায়, “না ভাই, বলিনি। জেঠামশাইকে কি এসব কথা বলা যায়! বিশ্বাসই করবে না। বড় এক বগ্গা মানুষ। তার ওপর ওই গুঁড়ো মশলার সঙ্গে জেঠামশাইয়ের খাতির জমে গেছে। আমি যদি বলি, মেয়েদের বাড়ি থেকে মেয়েটা রোজ রাত্তিরে আমায় ফোন করছে, জেঠামশাই ভাববে, আমি তলায় তলায় ইয়ে করছি। বলবে, রাস্কেল—তুই বললেই আমি মেনে নেব—ও-বাড়ির থেকে মেয়েটি তোকে ফোন করে। বিয়ের আগেই। তুই আমায় সহবত শেখাবি! আসলে তোর কোনো বদ মতলব আছে।”
জলধর মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক। জেঠামশাইকে একথা বলা যায় না। বলা উচিত নয়।”
নিগোগী বলল, “তা হলে জেঠাইমাকে বল।”
“জেঠাইমা মানেই জেঠামশাই। বলার সঙ্গে সঙ্গে জেঠার কানে চলে যাবে।”
“তা হলে?”
মনমরা মুখ করে গোরাচাঁদ বলল, “বড়দের কানে উঠলেই—এবাড়ি ওবাড়ি ঝগড়া লেগে যাবে। তারপর ধর হাজার হোক, ওরা মেয়ে পক্ষ! মেয়ের বাপ-মা যখন মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে—সে বড় কেলেঙ্কারি হবে। একটা মেয়ের পক্ষে নিজের প্রেস্টিজ বাঁচানো বড় কথা। …না, আমি অতটা অসভ্যতা করতে পারব না। এক আমি দিদিকে বলতে পারি! কিন্তু কোথায় দিদি? সে না আসা পর্যন্ত কিছুই করতে পারছি না।…সত্যি বলতে কি, আমি চাইছি, অন্য রকম কিছু করতে, যাতে এই নেগোসিয়েশানটা নিজের থেকেই ভেঙে যায়। …তোরা আমায় বাঁচা।”
মানিক বলল, “কেমন করে?”
গোরাচাঁদ বলল, “কেমন করে—সেটা তোরা ঠিক কর। তোরা আমার বন্ধু। বন্ধু হয়ে যদি এসময়ে আমায় না দেখিস, কবে দেখবি! আমি তোদের কাছে এসেছি বিপদে পড়ে। যা হয় তোরা কর।”
বন্ধুরা চুপ। কী বলবে! হঠাৎ জলধর বলল, “দাঁড়া, দেখছি। ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।”
দুই
মাঝে একটা দিন বাদ গেল। তার পরের দিন গোরাচাঁদ ট্যাক্সি করে এসে হাজির। বাড়ির সামনে ডিজেল ট্যাক্সির বিকট আওয়াজ মিলোতে না মিলোতেই গোরাচাঁদ যেন টলতে টলতে ঘরে ঢুকল। চোখ লালচে, মুখ টকটক করছে, ঘামছিল দরদর করে। জামার বোতাম খোলা। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটেছে। গোরাচাঁদের এমন চেহারা বড় একটা দেখা যায় না।
ঘরে এসে গোরাচাঁদ বন্ধুদের তাস খেলা দেখতে দেখতে ক্ষোভের গলায় বলল, “তাস খেলছিস! খেল! সারা জীবন তাসই খেলে যা?”
সলিল বন্ধুকে দেখতে দেখতে বলল, “কেন, কী হয়েছে?”
“না, হবে আবার কী! কিছুই হয়নি। আমি শুধু তোদের দেখছি। তোরা আমার বন্ধু! ভাবতেও কষ্ট হয়। হাউ সেলফিশ!”
নিয়োগী বলল, “কী হয়েছে বলবি তো! ঘরে ঢুকেই হেঁয়ালি শুরু করলি!”।
মানিক হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। বলল, “দাদা, তুমি বোসো। আগে বোসো।”
“বসব! আমার বসার দরকার নেই! আমি তাস খেলতে আসিনি।”
জলধর বলল, “নতুন কিছু হয়েছে বুঝি? বেজায় খেপে গিয়েছিস?”
গোরাচাঁদ বলল, “খেপে গিয়েছি। খেপে যাওয়া তো সামান্য ব্যাপার ; আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সারা গা জ্বলে যাচ্ছে! মাথা কেমন করছে!”
সলিল বলল, “বোস আগে। মাথা ঠাণ্ডা কর। জল খা।” বলে পাশ থেকে জলের বোতল বাড়িয়ে দিল।
গোরাচাঁদ জলের বোতল নিল না। বলল, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাড়ি ছাড়া করাবে ওই মেয়েটা। আমার সুখস্বস্তির বারোটা বাজিয়ে দিল।”
সলিল বলল, “আবার কী হল? এখনও ফোন করছে?”
“কাল করেনি। আজ করেছিল। আমাদের অফিসে। ভাগ্যিস জেঠামশাই তখন ছিল না?”
“কখন করেছিল।”
“এই তো বিকেলের পর, ছ’টা সোয়া ছটা।”
“তুই তা হলে তোদের অফিস থেকেই আসছিস?”
মাথা হেলিয়ে গোরাচাঁদ বলল, “না এসে পারলাম না। তোরা আমার অবস্থাটা যদি বুঝতিস!”
নিয়োগী বলল, “কী বলল মেয়েটা?”
“যা মুখে আসে বলে গেল। আমাকে নিয়ে রগড় করল, টিজ করল। …আমায় কী বলে জানিস? কত বড় আস্পর্ধা! বলল, তোমার যা বুদ্ধি গোরাচাঁদ—ছাগলের মাথাও তার চেয়ে সাফ। টুকেমুকে বি কম পাস করেছিলে, পেছনে তোমার জেঠা এক জোড়া ঠেলা লাগিয়েছিল পয়সা খরচ করে। ওই বুদ্ধি নিয়ে তুমি গেঞ্জির ব্যবসা করবে! যতদিন জেঠামশাই আছে, তারপর তো তোমায় সকলে লুটেপুটে খাবে। তুমিও দু হাতে পয়সা উড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়াবে। তোমার যে কত মুরোদ আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। না আছে বিদ্যে না বুদ্ধি! তোমার মতন অপদার্থকে বিয়ে করে আমি কি শেষে হাঁড়ি মেজে মরব। ওটি হচ্ছে না। “
জলধর বিস্ফারিত বদনে বলল, “বলিস কী! এসব কথা বলল তোকে। ছাগল বলল।”
“ছাগলের চেয়েও খারাপ বলল। …ছুঁচোটুচোও বলল।”
“আর কী বলল?”
“বলল, আমার স্বভাব-চরিত্র খারাপ।”
“স্বভাব-চরিত্র খারাপ?” মানিক হাতের তাস ফেলে দিয়ে থ’মেরে বসে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। “ওঃ, ভাবা যায় না। দাদার স্বভাব হল ঝরনার জল। স্ফটিক স্বচ্ছ! বিশুদ্ধ, জার্ম ফ্রি, ব্যাকটেরিয়া মাইনাস। এমন স্বভাব লাখে একটাও পাওয়া যায় না। সেই দাদাকে কিনা স্বভাব নিয়ে কথা বলা! ছি ছি! এ তো মানহানির মামলা আনা যায়!”
মানিককে থামিয়ে দিয়ে নিয়োগী বলল, “গোরা, স্বভাবের সঙ্গে চরিত্রও বলল? তোর চরিত্র? মানে ক্যারেকটার?”
গোরাচাঁদ এবার গলা চড়িয়ে বলল, “বলল মানে? এমন একটা খারাপ কথা বলল শুনলে তোরা কানে আঙুল দিবি।”
জলধর গলা বালিয়ে বলল, “কী খারাপ কথা বলল? ইয়ের কথাটথা—?”
“বলল, আমি একটা মেয়ের সব লুটেপুটে নিয়েছি। মেয়েটাকে চিট করেছি। তাকে পথে বসিয়ে এখন দিব্যি সাধুপুরুষ সেজে বিয়ে করতে যাচ্ছি অন্য মেয়েকে। আমি বজ্জাত, বেহায়া, ক্রিমিন্যাল। আমাকে জেলে দেওয়া উচিত।”
সলিল আর নিয়োগী মাথা নাড়তে নাড়তে একসঙ্গে বলল, “দিস ইজ টু মাচ। আর টলারেট করা যায় না।”
মানিক বলল, “দাদা, লুটেপুটে খাওয়া মেয়েটার নাম বলল?” বলে আড়চোখে তাকিয়ে থাকল।
“না।” গোরাচাঁদ প্রায় ধমকে উঠল। “নাম বলবে! কিসের নাম? কার নাম? আমি কি তোমার মতন মেয়ে-হ্যাংলা!…” বলে সলিলদের দিকে তাকাল গোরাচাঁদ। বলল, “আমার ভীষণ লেগেছে, ভাই। জীবনেও এত খারাপ, বাজে, মিথ্যে কথা শুনিনি। ভদ্রলোকের ছেলে একেবারে ইতর হয়ে গেলুম। তোমরা হয় কিছু করো, না হয় বন্ধুত্ব শেষ করে দাও।”
বন্ধুরা চুপচাপ। মুখ নিচু করে বসে থাকল যেন।
শেষে জলধর বলল, “ভাবিস না গোরা, আমি আছি। তোর হয়ে লড়ে যাব। দেখছি মেয়েটাকে। “
তিন
দিন কয়েক পরে গোরাচাঁদ বন্ধুদের আড্ডায় এসে দেখল, নতুন একজনের আবির্ভাব ঘটেছে সেখানে। এ মুখ তার দেখা নয়, চেনাও নয়। তাদের এই আড্ডায় তারা চার পাঁচ জন নিয়মিত আড্ডাধারী ছাড়াও মাঝেমাঝে অনিয়মিত দু একজন গল্পগুজব করতে চলে আসে। তারাও বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু এই নতুন মানুষটিকে গোরাচাঁদ কখনও দেখেনি।
গোরাচাঁদকে দেখেই জলধর হাত বাড়িয়ে ডেকে নিতে নিতে বলল, “আয় গোরা, তোর জন্যে হাঁ করে বসে আছি। একটু দেরি করে ফেললি।”
দেরি সামান্য হয়েছিল গোরাচাঁদের। নিয়োগী খবর দিয়েছিল, সাতটা নাগাদ চলে আসবি। জরুরি ব্যাপার আছে।
এখন প্রায় পৌনে আট।
মানিক বলল, “দাদা, তুমি কি রাত আটটার প্রোগ্রাম শেষ করে আসছ?”
গোরাচাঁদ কোনো জবাব দিল না কথার। মানিকটা দিন দিন বড় বেশি চ্যাংড়া হয়ে উঠছে।
জলধর বলল, “গোরা, আলাপ করিয়ে দিই। এ হল আমার পুরনো বন্ধু। চারু ব্যানার্জি। আমরা সিবি বলে ডাকতাম। স্কটিশে আমার ক্লাসমেট ছিল। সিবি এখন ঈগল এজেন্সির পার্টনার।” বলে সিবির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “চারু, এই আমাদের গোরা। এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম। বেচারির একেবারে যায়-যায়, অবস্থা। তোমায় কিছু একটা করতেই হবে।”
ঠিক নমস্কার নয়, চোখে চোখে এক রকম আলাপের সৌজন্য বিনিময় হল। চারুর চোখে ঈষৎ হাসি, গোরাচাঁদের চোখে খানিকটা কৌতূহল।
গোরাচাঁদ দেখছিল চারুকে। বেশ টগবগে চেহারা, ধারালো নাকমুখ, গায়ের রং কালচে। চারু গোরাচাঁদেরই সমবয়েসি হবে। গালে পাতলা দাড়ির জন্যে খানিকটা যেন ব্যক্তিত্বময় বলে মনে হয়। হাতে পাইপ।
সলিল বলল, “বোস গোরা, এখানে আয়। তোর কথা জলধর সবই বলেছে সিবিকে। …ফারদার তোর যদি কিছু বলার থাকে বলতে পারিস।”
গোরাচাঁদ বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না… উনি…!”
জলধর বলল, “উনি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। ঈগল পাখি মানে লোকের হাঁড়ির খবর টেনে বার করা ওঁর পেশা। অবশ্য টাকা দিয়ে চারুকে ভাড়া করতে হয়। …তোর কপাল ভাল গোরা, চারুকে আমি পেয়ে গেলাম। একেবারেই হঠাৎ দেখা আমাদের অফিসের সামনে। অনেক কাল পরে। চারু বলল, ও এখন ঈগল এজেন্সিতে কাজ করছে। পার্টনার। ওকে পেয়ে আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলুম। মনে হল, চারু আমাদের কাজে আসতে পারে। দারুণ হেলপ হবে। তোর কথা বললুম। আজ ওকে আসতে বলেছিলুম এখানে—তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমরাও সবাই থাকব। ভাল করে সব কথা বলা যাবে।”
গোরাচাঁদ তখনও ভাল করে কিছু বুঝছিল না। বন্ধুদের দেখছিল।
সলিল বলল, “জলধর একটা কাজের কাজ করেছে। সিবি-ই তোকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে গোরা।”
চারু পাইপের ছাই খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, “উদ্ধার করতে পারব কিনা জানি না। চেষ্টা করব। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নিই সলিলবাবু। কলকাতায় আজকাল বেশ কয়েকটা প্রাইভেট ইনটেলিজেন্স এজেন্সি হয়েছে। তারা নানা রকম কাজ করে। এমন কি সিকিউরিটি সার্ভিসও। আমরা সবরকম কাজ করি না। আমাদের ফার্ম ছোট। আমরা স্পেশ্যালাইজড কাজ নিই। তবে খুবই যত্ন করে করি।”
“আপনারা কী কী কাজ করেন?” সলিল বলল।
“প্রথমে মেটরিমোনিয়াল কাজকর্ম। ধরুন, পাত্র বা পাত্রী পক্ষ—সিক্রেটলি কিছু ইনফরমেশান চাইল, ফ্যামিলি সম্পর্কে, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে। আমরা সেটা যোগাড় করে দি। তারপর হল ডিভোর্সের ব্যাপারে পার্টিকে তাদের দরকার মতন ইনফরমেশান সাপ্লাই করা। “
মানিক বলল, “বাঃ! বিয়ে আবার বিবাহ-বিচ্ছেদ! আপনারা তো মশাই গাছেরও খান, তলারও কুড়োন!”
চারু বলল, “সরি, গাছ দু জাতের। একই গাছের নয়।”
নিয়োগী বলল, “আর কী করেন স্যার?”
“ব্ল্যাকমেলিং কেস। আপনাকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে—আপনি আমাদের কাছে এসে ক্লায়েন্ট হলেন। তারপর দেখুন সেই ব্ল্যাকমেইলারকে কী করি!”
সলিল বলল, “গোরার কেসটা ব্ল্যাকমেইল বলে চালানো যাবে?”।
“এখনই বলতে পারছি না। সব শুনতে হবে ভাল করে— তারপর ভেবে দেখব।”
জলধর গোরাচাঁদকে বলল, “গোরা, আমি সবই বলেছি যতটা পারি। এবার তুই বল। নিজের কেস নিজে বলাই ভাল। ”
গোরাচাঁদ বলব-কি বলব না করে তার বিপদের কথা বলতে লাগল।।
গোরাচাঁদের বৃত্তান্ত শেষ হল যখন তখন ঘড়িতে সাড়ে ন’টা। গরমের দিন। সাড়ে নটা এমন কিছু রাত নয়। আচ্ছা ভাঙতে প্রায়ই দশ সোয়া দশ বেজে যায়। কাজেই জলধররা কেউ চঞ্চল হল না।
সিগারেট খুঁজতে খুঁজতে সলিল চারুর দিকে তাকাল। অর্থাৎ বলতে চাইল, শুনলেন তো সব—এবার বলুন কী করা যায়?
চারু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। ভাবছিল। চোখ বন্ধ করে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চোখ খুলল। তারপর গোরাচাঁদকে বলল, “আপনি কী করতে চান?”
“আমি! আমি কী চাইব?”
“মানে মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান? না, তাকে হটাতে চান?”
ওই মেয়েকে বিয়ে! অসম্ভব! মশাই, ওই মেয়েকে কেউ বিয়ে করে? কালীর খাঁড়া। ডেনজারাস মেয়ে। অসভ্য, ভালগার, পাজি…। না, ওকে আমি বিয়ে করব না। নেভার।”
“বাড়িতে একবার বলে দেখুন না?”
“আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে বাড়িতে বলব! আমার জেঠামশাইকে আপনি চেনেন না।জেঠার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাধ্য আমার নেই। এমনিতেই বাড়িতে বিয়ের বাজার বসে গেছে। আজ বেনারসি, কাল বালুচরি, পরশু স্যাকরা, তরশু ফার্নিচার…। না মশাই ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। তবে হ্যাঁ, দিদি এলে বলতে পারি। দিদি দুর্গাপুর থেকে কবে আসবে তাও জানি না। এদিকে দেখতে দেখতে দিন চলে যাচ্ছে…।”
জলধর বলল, “চারু, বিয়েটা ভেঙে যাওয়াই দরকার। মেয়েটাকে তুই প্যাঁচে ফেলে দে। এমন কিছু একটা কর, যাতে মেয়ে পক্ষের আর মুখ না থাকে কিছু বলার। দু একটা ব্ল্যাক স্পট লাগিয়ে দে। এমনিতেই বিয়ে ভেঙে যাবে।”
গোরাচাঁদ তাড়াতাড়ি বলল, “না না, নোংরা কিছু করবেন না। হাজার হোক ভদ্রবাড়ির মেয়ে। ব্ল্যাক স্পট লাগালে কেচ্ছা হয়ে যাবে। সেটা উচিত নয়।”
মানিক রগড় করে বলল, “উঃ, দাদার যে বড় দরদ। তোমার ক্যারেকটারে যখন স্পট লাগাল। ”
“সবাই সব পারে না। আমি ভদ্রলোক। ইতরামি করতে পারব না।”
চারু বলল, “আসলে আপনি চাইছেন, সাপও মরে, লাঠি না ভাঙে। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“বেশ দেখি কী করতে পারি! তা এ সব করতে হলে কিছু টাকা পয়সা লাগবে। কত তা বলতে পারছি না। হাজার দুই চার হতে পারে।”
গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে জানাল, তার আপত্তি নেই।
চার
জ্যৈষ্ঠ মাসের ফাঁড়াটা কাটল। জেঠাইমার দয়ায়। এখন আষাঢ় চলছে। পাঁজিতে আষাঢ় মাসের মাঝামাঝির আগে বিয়ের দিন নেই। প্রথমটা দিনটা পড়েছে বৃহস্পতিবার, দ্বিতীয়টা শনিবারে। বৃহস্পতিবারে জেঠাইমা বিয়ে দেবে না। শনিবারে মেয়ের তরফে আপত্তি। কাজেই সেই একেবারে আষাঢ়ের শেষে সোমবার দিনটাই মোটামুটি ঠিক। আর তা না হলে শ্রাবণের গোড়ায়।
আষাঢ় মাসের দু’ একটি দিন, গোড়ায় গোড়ায়, আকাশ ঘোলাটে, মেঘ হল, বৃষ্টি হল না। তারপর বৃষ্টি নামল। দিন দুই ভাল বৃষ্টি হল। আবার রোদ। রোদ-বৃষ্টির মাঝখানে পড়ে গোরাচাঁদের সর্দি লেগে গেল। বর্ষার সদি। জেঠামশাই অন্য কাজে ব্যস্ত বলে গোরাচাঁদকেই সোদপুরের কারখানা আর শোভাবাজারের অফিস সামলাতে হচ্ছিল। এমন সময় সর্দিজ্বর।
গোরাচাঁদ জ্বর গায়ে সেদিনও বেরুতে পারেনি। জ্বর ততটা নয়, একশো এক ছুঁয়েছে, কিন্তু নাক, গলা, মাথার অবস্থা খারাপ। নাক বুজে আছে, গলায় অসম্ভব ব্যথা। টনসিল ফুলেছে, গলার স্বর ভাঙা। মাথার কথা আর কী বলবে গোরাচাঁদ—ছিঁড়ে যাচ্ছিল যেন। ভীষণ যন্ত্রণা।
সন্ধেবেলায় গোরাচাঁদ খানিকটা গরম নুনজলে গার্গল করে ঘরে আসতেই দেখল, ফুটকি কী একটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভাঙা গলায় গোরাচাঁদ বলল, “ওটা কী রে?”
ফুটকি বলল, “পুরনো ঘিয়ে আদার রস, রসুন, মধু দিয়ে মেড়ে কফের ওষুধ। বুকের সর্দি তুলে দেবে। গলা পরিষ্কার হবে।”
নাকমুখ কুঁচকে বমির ভাব করে গোরাচাঁদ বলল, “কে দিল? পুরনো ঘিয়ে আদার রস! তোর কবরেজি?”
ফুটকি বলল, “আমার নয়, জেঠাইমার। জেঠাইমাকে কে বলেছে!”
“ফেলে দে। ভদ্রলোকে ওসব অখাদ্য খায় না। একে পুরনো ঘি তায় আদার রস, তার সঙ্গে মধু। ওদিকে আবার রসুন। কী কম্বিনেশন! ফেলে দে।”
ফুটকি বলল, “ফেলে দিতে হয় তুমি দাও। আমি রেখে যাচ্ছি।”
ফুটকির ভাল নাম লীলা। কাছাকাছি পাড়ার মেয়ে। জেঠাইমার সঙ্গে লীলার মায়ের খুবই বন্ধুত্ব। লীলার বাবা কচিকাচাদের ডাক্তার। একটু খেপাটে। নাম আছে ডাক্তার হিসেবে, পয়সা তেমন নেই।
গোল মতন ছোট বাটিটা রেখে ফুটকি চলে যাচ্ছিল, গোরাচাঁদ বলল, “তুই কি বাড়ি চললি?”
“হ্যাঁ। সাতটা বাজল। বৃষ্টি আসতে পারে।”
“তা যাবার আগে আমাকে কড়া করে এক কাপ চা খাইয়ে যা। আগুনের মতন গরম। গলাটা জ্বলে যাচ্ছে। কেমন বসে আছে দেখছিস না। শব্দ বেরুচ্ছে না। কী রকম শোনাচ্ছে রে আওয়াজটা?”
ফুটকি দু’ পলক দেখল গোরাচাঁদকে। তারপর অক্লেশে বলল, “গাধার মতন। ” বলে চলে গেল।
গোরাচাঁদ থ’ মেরে গেল। ফুটকির কথাবার্তা বরাবরই বেমক্কা। যা মুখে আসে বলে দেয়। কোনও বাদ-বিচার নেই। গোরাচাঁদকে তোয়াক্কা করে না। মান্য তো নয়ই। আসলে মেয়েটা এ-বাড়িতে ছেলেবেলা থেকে আসছে যাচ্ছে বলে ওর কোনো সঙ্কোচ আড়ষ্টতা নেই। কিছুই গ্রাহ্য করে না। আগে তো গোরাচাঁদকে ‘তুই’ বলত। বয়েসে বছর পাঁচেকের ছোট। আজকাল অবশ্য ‘তুমি’ বলে তাও যেন বাধ্য হয়ে। বেশি আস্কারা মেয়ে ও মাথায় উঠেছে। জেঠাইমাই ওকে মাথায় তুলেছে। তবে মেয়েটা ন্যাকা নয়। সাফ-সুফ কথা বলে। এক সময় মেয়েদের ফুটবল খেলত। আঁটসাঁট চেহারা। মাথায় একটু বেঁটে। মেয়েদের স্কুলে ভূগোল পড়ায়। ও আবার জলধরের শালী হয় সম্পর্কে। জলধরের বউয়ের মাসতুতো বোন।
গোরাচাঁদ অবশ্য ‘গাধা’ শব্দটায় খুশি হল না। কিন্তু এখন তার দিন ভাল যাচ্ছে না। যার যা খুশি বলে গেলেও তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। সেই মশলা-বাড়ির মেয়েটা, মানে গুঁড়ো মশলার কারবারি ফটিক দত্তের মেয়েটা, আজ ক’দিন চুপ মেরে আছে। মাঝে একদিন ছাড়া আর ফোন করেনি। ফোন করে অবশ্য সেদিন বলেছে, সোনার চাঁদ গোরাচাঁদকে সে হাতিবাগানের বাজারের কাছে বাগে পেয়েছিল। ইচ্ছে করলেই গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চাঁদের মাথায় চাঁটি মারতে পারত। দয়া করে মারেনি।
তারপর আর ফোন আসেনি। গোরাচাঁদ আজকাল ফোনের ডাক পেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়, গলা দিয়ে শব্দ বেরুতে চায় না! দরদর করে ঘামতে থাকে।
বন্ধুদের ওপরেও গোরাচাঁদ বেশ ক্ষুন্ন হয়ে উঠছিল। ওরা কোনও কর্মের নয়। কিছুই করল না। এতদিনের বন্ধু, এত মাখামাখি, ভাব-ভালবাসা, দায়ে অদায়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, সেই বন্ধুরাই তাকে একা হাড়িকাঠের সামনে রেখে সরে থাকল। লাভের মধ্যে গোরাচাঁদের হাজার দেড়েক টাকা গচ্চা গেল। ওই চারু বাঁড়ুজ্যেকে দিতে হয়েছে।
কী করেছে চারু? কিস্যু নয়। মেয়ের নাম ধাম ছবি, মেয়ের বাপের খোঁজ-খবর সব নিয়ে দিব্যি বসে আছে। জলধর কোত্থেকে একটা ফালতু, বাজে লোক ধরে আনল। কে জানে লোকটা চিট ক্লাসের কী না?
বড় দুঃখেই গোরাচাঁদ বড় করে নিশ্বাস ফেলতে গেল, নাক বন্ধ থাকার জন্যে পুরোপুরি ফেলতে পারল না, বাতাস আটকে গেল।
এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কারা যেন আসছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সলিলরা ঘরে ঢুকল। চার বন্ধু, আর সেই দাড়িঅলা চারু।
“কি রে? তোর নাকি চার পাঁচ জ্বর! হেপাটাইটিস? না, ম্যালেরিয়া?” সলিল বলল।
গোরাচাঁদ বন্ধুদের দেখছিল। বলল, “কে বলল?”
“বাজারে খবর! তা কী হয়েছে তোর? হেভি টাইপের ম্যালেরিয়া?”
“না। কে বলেছে তোদের আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে?”
“হলেই হয়। কলকাতা শহরে আকচার ম্যালেরিয়া হচ্ছে।”
“আমার সর্দিজ্বর হয়েছে। কমন কোল্ড। ইনফ্লুয়েঞ্জা!”
“তাই নাকি! তা ভাল। বাঁচালি।
“ নিয়োগী বলল, “তুই বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিস না?”
“দু’ দিন বেরোইনি। কারখানা অফিস দু’ দিক দেখতে হচ্ছিল। তার ওপর বৃষ্টি বাদলা। ”।
“কেমন আছিস এখন?”
“জ্বর। গলা বুজে আছে। মাথায় যন্ত্রণা। গা-হাত ভেঙে যাচ্ছে।”
মানিক বলল, “সেরে যাবে দাদা। মেরে কেটে সাত দিন। তবে ক্যালকাটা ফিভার হলে দশ পনেরো দিনের ধাক্কা। শরীরটা বেশ উইক করে দিয়ে যাবে। তা তাতে একদিক থেকে ভাল। আষাঢ় মাসটাও তুমি কাটিয়ে দিতে পারবে। শরীর দুর্বল হলে বিয়ে করা যায় না। এখন আমাদের টাইম দরকার। তুমি যদি আরও একটু বেয়াড়া অসুখ বাধাতে পারতে, শ্রাবণ মাসটাও গড়িয়ে দেওয়া যেত।”
ঠিক এই সময় ফুটকি ঘরে এল। গোরাচাঁদের জন্যে গরম কড়া চা এনেছে।
ফুটকিকে দেখেই জলধর বলল, “কী গো? তুমি! যাক, দেখা হয়ে গেল! কোনো খবরই পাই না। কেমন আছ? খবরটবর ভাল?”
ফুটকি হাসল। “আপনারা ভাল?” বলে সলিলদের দিকেও তাকাল। হাসি হাসি মুখ। সলিলরা সকলেই ফুটকিকে চেনে। এবাড়িতেই দেখছে বরাবর।
একমাত্র চারুই ফুটকিকে চেনে না।
জলধর চারুকে বলল, “চারু, আমার শালী লীলা। অনেক ভাগ্যে এমন শালী পেয়েছি। লীলা খেলোয়াড়। লেডিজ ফুটবলে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলত।”
চারু চকচকে চোখ করে হাসল। বলল, “বাঃ। আমি এই প্রথম মেয়ে ফুটবলার দেখলাম। এখনও খেলেন?”
জলধর বলল, “না, এখন আর—কই—খেলাটেলা…। তা তোমার হাতে ওটা কী?”
“চা। গোরাদার জন্যে!”
“আমাদের জন্যেও একটু হয়ে যাক ভাই। গোরাকে চা না খাইয়ে অন্য কিছু খাওয়ালে পারতে। এনার্জি পেত। চায়ে মুখ আরও বিস্বাদ হয়ে যাবে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় বেশি চা খেতে ভাল লাগে না।”
মানিক বলল, “দাদার চেহারা দু দিনেই যা হয়েছে। মনে হচ্ছে সলিড টায়ার পাঞ্চার হয়ে গিয়েছে।”
ফুটকি বলল, “আকুপাঞ্চার।”
হেসে উঠল সকলেই একসঙ্গে। অট্টহাসি।
গোরাচাঁদ অপ্রতিভ। সে হাসতে পারল না। ফুটকির ওপর চটে গেল। বন্ধুদের সামনে এই রসিকতার কী মানে হয়! ঠিক আছে, এক মাঘে শীত পালায় না। গোরাচাঁদও পরে দেখে নেবে ফুটকিকে।
চা দিয়ে ফুটকি চলে যাচ্ছি।
জলধর বলল, “চায়ের সঙ্গে ঝালটাল কিছু হবে? বড়া ক্লাসের। বর্ষার দিন।”
“জেঠাইমাকে বলছি।”
“থ্যাংক ইউ! তা শ্যালিকা, খবরটবর বললে না?”
“ভালই। ”
জলধর আর ফুটকির মধ্যে খুব সাবধানে, আড়ালে চোখাচুখি হল। ফুটকি চলে গেল। জলধর চারুর দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন চোখ টিপল। ছোট করে। বলল, “নিজের শালী বলে বলছি না, চারু। লীলা ভালই খেলত। আমি দেখেছি ওর খেলা। বুদ্ধি করে খেলতে পারত। বেশ মেয়ে।”
গোরাচাঁদ অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দিল। দিয়েই ‘উঃ’ করে উঠল। চা যে এত আগুন গরম বুঝতে পারেনি। জিভ পুড়ে গেল।
সলিল বলল, “কী হল রে? জিভ বার করে বসে থাকলি?”
গোরাচাঁদ জিভ সামলাতে সামলাতে বলল, “ভীষণ গরম। জিভ ঠোঁট পুড়ে গেল।
মানিক মজা করে বলল, “একটু দেখেশুনে খাও, দাদা! চোখ চেয়ে দেখো।”
সলিল ততক্ষণে আরাম করে বসে পড়েছে। সিগারেট ধরাচ্ছিল। বলল, “তোর কিছু ভাল খবর আছে, গোরা। গুড নিউজ। চারুবাবু অনেকটা সাকসেসফুল। ”
গোরাচাঁদ প্রত্যাশাই করেনি চারুর কাছ থেকে কোনো ভাল খবর শুনতে পাবে। কথাটা কানে যাওয়া মাত্র সে চারুর দিকে তাকাল। চোখে কৌতুহল।
চারু বলল, “কাজ অনেকটাই এগিয়েছে গোরাবাবু। আমি মাঝে আর কোনো খবর .দিতে পারিনি আপনাদের। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। কাজটাই তো আসল। ইন ফ্যাক্ট আমি আপনার ব্যাপার নিয়ে ভীষণ বিজি ছিলাম। কম কাঠখড় পোড়াতে, ঘোরাঘুরি করতে হয়নি।”
জলধর চারুকে বলল, “কতটা এগিয়েছ, তাই বলো গোরাকে।”
গোরাচাঁদ মাথা হেলাল। অর্থাৎ সে জানতে চায় কাজের কাজ কী হয়েছে?
চারু বলল, “প্রথমত আমি আপনাকে মেয়েটির বাড়ির ব্যাপারে অনেক কথাই বলতে পারি। ফ্যামিলি ইনফরমেশান। তারপর ওদের বিজনেস সম্পর্কেও খোঁজ-খবর করেছি। ভালই চালাচ্ছে। মাসে হাজার পঞ্চাশ টাকার বিজনেস করত। এখন ঢিলে যাচ্ছে কিছুদিন। প্রোডাক্ট খারাপ হয়ে গিয়েছে হালে। দেদার ভেজাল দিচ্ছিল। ওদিকে…”
বাধা দিল গোরাচাঁদ। মেয়ের বাপের ব্যবসা সম্পর্কে জানার কোনো আগ্রহ তার নেই। বলল, “বাপ বাদ দিন, মেয়ের কথা বলুন।”
চারু বলল, “মেয়ে, কী বলব, এমনিতে খারাপ নয়। দেখতে-শুনতে ভাল। লেখাপড়াও করেছে খানিকটা। তবে মেয়েটি একটু রোগা আর লম্বা। একটা চোখ সামান্য টেরা। তা এসব ঠিক আছে। স্বভাবটাই ঠিক নেই। রুক্ষ টাইপের, বদমেজাজি, ঝগড়ুটে। তা ছাড়া ওর একটা মেন্টাল—মানে সাইকোলজিক্যাল সিকনেস—গোলমাল আছে। ইনসমনিয়ায় ভোগে, রাত্তিরে যেখানে সেখানে ফোন করে, চেনা অচেনা মানে না, যা মুখে আসে বলে…!”
“পাগল?” গোরাচাঁদ বলল, প্রায় আঁতকে উঠে।
“না, পাগল ঠিক নয়, ওই ছিট টাইপের। তা তার চেয়েও বড় কথা ওর একজন—আই মিন—ওই কমলিকা মেয়েটির একজন ফ্রেন্ড আছে। লাভার। তা চার পাঁচ বছর ধরে দু’জনের লাভ চলছে। লুকিয়ে ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া। চিঠিচাপাটিও চলে। এরকম একটা চিঠি আমি হাতাতে পেরেছি। মেয়েটির লেখা।”
গোরাচাঁদ বলল, “লাভার! প্রেম! ও তা হলে এই বিয়েতে…”
“একেবারেই রাজি নয়, একদম নয়। ওর বাড়ি থেকে জোর করে এই বিয়েটা চাপাচ্ছিল। মেয়ে বলেছে, এই বিয়ে ঠিক হলে ও হয় বাড়ি থেকে পালাবে, না হয় গলায় দড়ি দেবে। বাড়ির লোক এখন খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। তবে পিছিয়ে যায়নি।”
গোরাচাঁদ বলল, “ভীষণ অন্যায় কথা। বাড়ির লোক এভাবে জোর করতে পারে না।”
মানিক বলল, “দাদা, ওর বাড়ির লোক নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। মেয়েকে নিয়ে মাথা ঘামাও। প্রেম করা খেপি মেয়েকে তুমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারো না!”
“আমি কি করব বলেছি! আশ্চর্য!”
“তা হলে তুমি এবার বেঁকে দাঁড়াও। তোমার রিজেকশান স্লিপ পাঠিয়ে দাও।”
“কাকে?”
সলিল কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই নিয়োগী বলল, “গোরা, দিস ইজ দি মোমেন্ট। গোল্ডেন অপারচুনিটি। কথাটা তুই জেঠাইমাকে বলে দে।”
গোরাচাঁদ ভেতরে ভেতরে খুশি হচ্ছিল। প্রেম-করা খেপি মেয়েকে তো তার গলায় ঝোলানো যাবে না। জেঠামশাই জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে খারিজ। ক্যানসেল। বলল, “জেঠাইমাকে বলা কি ঠিক হবে! ওদের ভেতরের কথাবার্তা। তার চেয়ে দিদিকে বলাই ভাল। দিদিকে বলতে পারি।”
“তাই বল।”
“কিন্তু প্রমাণ। দিদি যখন বলবে, কিসের উড়ো খবর শুনে এইসব বাজে কথা বলছিস? ভদ্দরলোকের বাড়ির মেয়ের নামে মিথ্যে গুজব রটানো ভাল নয়। নোংরামির কাজ। বাবা যখন জানতে চাইবে, প্রমাণ কী? তখন? কী বলব বাবাকে?… দিদি তো ভাই ছেলেমানুষ নয়, জামাইবাবুও পাকা লোক।”
“প্রমাণ?” সলিল বলল, “প্রমাণ পেলেই তুই এগিয়ে যাবি! এই তো?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে। প্রমাণ চারুবাবুর কাছে আছে।”
চারু বলল, “আমি আপনাকে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছি। শুধু চিঠি নয়, একটা ফটোও। যাতে ফটোর পেছনে কমলিকা লিখেছে, রাজুকে আমার ভালবাসার সঙ্গে।”
“টু রাজু, উইথ মাই লাভ!” মানিক রগড় করে বলল।
“রাজু কে?”
“ওর লাভার।”
“কই চিঠি? ফোটো কোথায়?”
চারু বলল, “দিচ্ছি। তার আগে আর-একটা কথা বলে নিই গোরাবাবু! মেয়েটি হয়তো আপনাকে আবার একদিন ফোন করবে। দু’ চারদিনের মধ্যেই। সারেন্ডার করতে পারে, কিংবা দু’ দশটা রাফ কথা বলতেও পারে। আপনি তখন সমানে সমানে লড়ে যেতে পারেন। ওকে নক আউট করতে পারেন। তাই না?”
জলধর এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “গোরা, হাতে ব্রহ্মাস্ত্র পেয়েও যদি তুই বেটা বখরি হয়ে থাকিস—ধিক তোকে। ধিক আমাদের।”
গোরাচাঁদ উত্তেজিত হয়ে বলল, “করুক ফোন, আমি ওকে দেখে নেব।”
পাঁচ
যে ফোনের নামে এতদিন গোরাচাঁদের হৃৎকম্প হত, গলা শুকিয়ে যেত ভয়ে—সেই ফোনের প্রত্যাশায় এখন সে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। অধৈর্য হয়ে ওঠে। দিন চারেক কেটে গেল। কোনো ফোন নেই। ছ’ দিনের মাথায় ফোন এল। রাত প্রায় ন’টা নাগাদ। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। বারান্দায় গিয়ে গোরাচাঁদ ফোন ধরল। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। ও দিকে প্রবল বৃষ্টি, মেঘগর্জন, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর এই সময় সব অন্ধকার হয়ে গেল হঠাৎ। লোডশেডিং।
ফোন তুলতেই সেই গলা, তবে আজ একটু চাপা, ধীর, সামান্য জড়ানো। “কে, সোনার চাঁদ নাকি?”
গোরাচাঁদ কোনো জবাব দিল না।
“কী গো, গোরাচাঁদ শুনতে পাচ্ছ না। কালা হয়ে গেলে?”
“শুনছি।”
“বাঃ, এই তো! কথা ফুটেছে। ” বলেই হাসি।
গোরাচাঁদ নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। কড়া গলায় বলল, “শুনুন, আপনি হাসি থামান। এতদিন তো একতরফা খুব হেসেছেন। রসিকতা করেছেন। অপমান করেছেন আমাকে। এবার যে আপনাকে কাঁদতে হবে।”
“কাঁদতে হবে! কেন মশাই! কী দুঃখে!… খুব বৃষ্টি হচ্ছে। একটু গলা তুলে কথা বলো গোরাচাঁদ। তোমার গলা ভাল শুনতে পাচ্ছি না! বাব্বা, কী জোর বাজ পড়ল।”
গোরাচাঁদ বাঁকা গলায় বলল, “আসল বাজটা তো পড়েনি। পড়বে।”
“তাই নাকি? কোথথেকে?”
“আমার কাছ থেকেই।… শুনুন—শুনতে পাচ্ছেন—রাজুকে চেনেন। রাজু! মনে পড়ছে!”
“রাজু। মনে পড়বে না কেন! রাজু আমার বন্ধু।”
“শুধু বন্ধু? না, আরও বেশি। লাভার।”
“লাভারই তো! অনেক দিনের।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বড় বড় চিঠি লেখা হত। আমার আদরের, রাজু। তাই না। একটা চিঠি এনে পড়ব?”
“পড়তে পারো। আমার কাঁচকলা হবে। প্রেম করি, চিঠি লিখি। বেশ করি। তাতে তোমার কী গো নদের চাঁদ!”
গোরাচাঁদ ঘাবড়ে গেল। কী মেয়ে রে বাবা! একটুও দমল না, ভয় পেল না। কী বলবে বুঝতে না পেরে সে বলল, “ওদিকে প্রেম হচ্ছে, আর এদিকে—”
“মশাই, প্রেম নয় শুধু চুটিয়ে প্রেম। রাজু কি স্মার্ট, কী রকম ম্যানলি দেখতে, হ্যান্ডসাম! তোমার মতন গোবরগণেশ, হাঁদা, রসগোল্লা নাকি সে?”
গোরাচাঁদ চটে গেল। পড়ক বৃষ্টি। চেঁচিয়ে বলল, “শাট আপ। কথা বলতে শেখেননি? অসভ্য, অভদ্র, থার্ড ক্লাস! ন্যাস্টি! লজ্জা করে না, একটা ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেন বলছেন—আর এদিকে বিয়ের—”
“কে তোমাকে বিয়ে করতে কেঁদে মরছে নদের চাঁদ! আমি তো গোড়া থেকেই বলছি—লেজ গুটিয়ে পালাও। নয়ত বিপদে পড়বে।”
“চুপ করুন। আমি বিয়ে করছি না। আপনার মতন অসভ্য ন্যাস্টি মেয়েকে কোনো ভদ্রলোক বিয়ে করে না। এ বিয়ে হবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।”
“আঃ! বাঁচা গেল!”
“হ্যাঁ, বাঁচা গেল। আমি বাঁচলাম।”
হঠাৎ কী যে হল, ফোনের ওপারে হাসির লহরা ছুটল। কী জোর হাসি। হাসতে হাসতে যেন মরে যাবে মেয়েটা। হাসছে তো হাসছেই। জোরে, ধীরে, লহর তুলে, ছররার মতন হাসির ধ্বনি ছিটিয়ে হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে ক্রমশ যেন কী একটা হচ্ছিল। স্বর পালটে যাচ্ছিল। গলা অন্যরকম হয়ে আসছিল।
গোরাচাঁদের কানের দোষ। বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় হাসির দাপট কমল। ভোল্টেজ কমে গেলে আলো যেমন নিভু-নিভু হয়ে আসে, সেইভাবে হাসির দমকা কমে এল। তারপর ওপার থেকে কে যেন বলল, “কী গো?”
গোরাচাঁদ চমকে উঠল। যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ধরতে পারল গলার স্বর।
“কী গো?”
“ফুটকি!”
“আমি।”
“তুই ওখানে কী করছিস?”
“আমি ওখানে কেন! আমি তো এখানে জামাইবাবুর বাড়িতে।”
“জামাইবাবু! জলধরের বাড়িতে?”
“হ্যাঁ, জলধরদার বাড়িতে আজ আমার নেমন্তন্ন ছিল। যা বৃষ্টি! আর বাড়ি ফেরা হবে না। এখানেই থেকে যাব।”
গোরাচাঁদ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই-তুই এতক্ষণ আমার সঙ্গে রগড় করছিলি। আশ্চর্য!”
“এতক্ষণ কেন করব, বরাবর করছি, এতদিন।”
গোরাচাঁদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। ফুটকি, ফুটকি এতদিন তার সঙ্গে মজা করছিল। তাকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। “ফুটকি তুই—তুই…।”
“তুই তুই কী করছিস?” এবার জলধরের গলা, মানে ফুটকির হাত থেকে ফোনটা সে নিয়ে নিয়েছে। “কুঁতিয়ে কথা বলছিস কেন! স্ট্রেট বল.।”
“জলধর।”
“জলধর মিত্তির। লীলার জামাইবাবু। প্রাণের আরাম। তোরও বন্ধু। …তা কেমন খেলালাম তোকে।”
“শালা!”
“বল, বল। যা খুশি বল।… তা তুই কিছু বুঝলি? তোর যা মাথা, ইট মারলে ইষ্টক হয়ে যায়। তুই মাইরি সত্যি স্টকে এক পিস মালই। বুঝলি কিছু?”
“কী বুঝব?”
“লীলা।”
গোরাচাঁদ সামান্য চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “বুঝেছি। তবে ওকে। একেবারে ইয়ে অবস্থা থেকে দেখছি।”
“ভালই তো! ইয়েরাই পরে টিয়ে হয়। আরে তুই নিজের বাগানের গাছের ফল খাবি—তার স্বাদই আলাদা। আমরা তো টুকরির মাল খেয়েছি। ” ও পাশে গুঞ্জন উঠল যেন।
গোরাচাঁদ এবার হেসে ফেলল জোরে। বলল, “তা না হয় খাব। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ইউ নো মাই জেঠামশাই!”
“কি ভাবিস না তুই। ঘণ্টা আমরা বাঁধব। দিদি বাঁধবে। নিয়োগীকে দিদির কাছে দুর্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। এভরিথিং ও-কে।”
“ও! মানে তোরা সবাই তা হলে…”
“বিন্দুমাত্র সন্দেহ রাখিস না গোরা, সবাই মিলে মাথা খাটিয়েছি। তুই আমাদের বন্ধু, তোর ভাল-মন্দ আমরা না দেখলে কে দেখবে!” জলধর হাসছিল।
শালা! ভাল-মন্দ দেখনেওয়ালা।… তা ওর কী হবে? মশলাবাড়ির মেয়েটার? ভদ্রবাড়ির একটা মেয়েকে নিয়ে তোরা যা কেচ্ছা করলি… ছি ছি!”
জলধর বলল, “তুই ভাবিস না। চারুর এনট্রি পাকা হয়ে গেল।”
চারু! কেন রাজু?”
“ওই একই হল। যা চারু তাই রাজু। টাকার এপিঠ ওপিঠ।”
“কী বলছিস তুই?”
“ঠিকই বলছি। চারু আসলে ফুড ডিপার্টমেন্টে আছে, নলিনীর সঙ্গে। অফিসার। তোর গুঁড়ো মশলার যাওয়া-আসা আছে চারুর কাছে। ইয়ের ব্যাপার থাকে তো—! চারু মশলাবাড়ির সদর পেরিয়েছিল, এবার অন্দরে ঢুকে যাবে। ও নিয়ে তুই ভাবিস না। তোর টাকাও আমার কাছে।”
গোরাচাঁদ ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “এখানেও ধাপ্পা! তোরা আমায় বুদ্ধ বানিয়ে ছাড়লি।”
জলধর হো হো করে হাসছিল। বলল, “গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—!”
“থাম, গীতা আওড়াতে হবে না। …ফুটকি আছে? ওকে একবার দে।”
ফুটকি ফোন নিল। “কী বলছ?”
“বলছি, তোর কেরামতি দেখলাম। তা তুই গলাটা পালটাতিস কেমন করে?”
ফুটকি হাসছিল, বলল, “কায়দা আছে। ফোনের মুখে পাতলা রাংতা রাখতাম। একটু পেঁজা তুলো। তা ছাড়া তোমার তো বাঁ কানটা ভাল না।”
“বাঃ! চমৎকার! যেমন জামাইবাবু তেমনি তার শালী।… তা তুই এত কাণ্ড করতে গেলি কেন? ব্যাপারটা কান ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতন হয়ে গেল। সরাসরি দেখালেই পারতিস!”
“যাঃ! নিজে দেখতে জানে না, আবার আমায় বলে!” বলতে বলতে ফোন রেখে দিল ফুটকি।
গোরাচাঁদ ফোন নামিয়ে রাখল। দাঁড়িয়ে থাকল সামান্য। তখনও বৃষ্টি পড়ে চলেছে। গোরাচাঁদের মজা লাগছিল। ভালও লাগছিল। বেশ ঝরঝরে মনে হচ্ছিল নিজেকে। বুকের কাছে কী যেন একটা ঝুলত এতদিন। এখন একেবারে হালকা।