ঘনাপুরার কুঠিবাড়ি
বিন্ধ্যাচলের কাছে শিউপুরা নামে একটি জায়গা আছে। শীতকালে অনেক বাঙালি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য সেখানে যান। একবার হল কি, আমিও আমার এক বন্ধুর সঙ্গে শিউপুরাতে এলাম। আমার বন্ধুর নাম অজয়। ও প্রতিবছরই ওর মা-বাবা ভাইবোনদের নিয়ে এখানে আসে। এবং মাসখানেক থেকে শরীর ভাল করে তারপরে যায়। এ বছর একটু অসুবিধের কারণে ওর বাড়ির লোকরা কেউ এল না। তাই দু’ বন্ধুতেই আমরা এলাম।
শিউপুরাতে আসার আগে লগনদেওকে চিঠি লিখে ঘর বুক করে তবেই আসা হয়। কিন্তু এবারে সেসব কিছুই করা হয়নি। তাই লগনদেও অন্য চেঞ্জারদের ঘর দিয়ে ফেলেছে মাত্র দু’দিন আগে। এমন সময় আমরা গিয়ে হাজির।
অজয়কে দেখেই তো জিভ কাটল লগনদেও। বলল, “এ কী বাবু, আপমি!” আমি। আমার ঘর কই?”
অজয় বলল, “হ্যাঁ,
“আমি তো এবারে আপনার কোনও চিঠি পাইনি। অন্যবারে আপনি মানি অর্ডারে টাকা পাঠিয়ে দেন, চিঠি দেন কিন্তু এবারে সেসব কিছুই করেননি। তাই ভাবলাম আপনাদের হয়তো কোনও অসুবিধে হয়ে গেছে, এ বছর এলেন না। এই ভেবে আমি অন্য লোককে ঘর দিয়ে দিলাম।”
অজয় হেসে বলল, “তোমার অনুমানই ঠিক। আমাদের খুবই অসুবিধে এ বছর। তাই বাড়ির কেউ আসেনি। তবে কিনা আমার তো অসুবিধে কিছু নেই, সেইজন্য আমার এই বন্ধুটিকে নিয়ে চলে এলাম। এখন আমাদের থাকার একটু ব্যবস্থা করে দাও।”
লগনদেও বলল, “অসম্ভব। এ বছর এত বেশি চেঞ্জারের ভিড় যে, কোথাও কোনও জায়গা খালি নেই।”
“তা হলে কী হবে? ফিরে যাব আমরা?”
“না না। ফিরে যাবেন কেন? ব্যবস্থা একটা হবেই। এখান থেকে তিন কিমি দূরে পাহাড়ের কোলে ঘনাপুরা নামে একটি গ্রাম আছে। তার জল হাওয়া আরও ভাল। আপনারা সেইখানেই চলে যান। তবে কিনা ওখানে গেলে একটু অসুবিধে হবে আপনাদের। দোকান বাজার করতে শিউপুরাতেই আসতে হবে। আর—।”
“বলে ফ্যালো।”
“আর একটা অসুবিধে হবে, সন্ধে পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারবেন না।”
আমি বললাম, “কেন?”
“ওখানে একটু বাঘের ভয় আছে।”
অজয় বলল, “কুছ পরোয়া নেই। ঘনাপুরাতেই যাব আমরা।”
“যান। তার আগে আমাকে দশটা টাকা দিয়ে যান, আপনাদের জন্য দোকান বাজারটা তো করে নিয়ে যেতে হবে।”
আমি দশটা টাকা লগনদেও-এর হাতে দিতেই ও খুব খুশি হয়ে ছোট্টু নামে একটি কিশোরী মেয়েকে আমাদের সঙ্গে দিল।
ছোট্টু আমাদের সামান্য মালপত্তর যা ছিল তা মাথায় নিয়ে বলল, “চলিয়ে বাবুজি।” আমরা ছোটুকে অনুসরণ করে গ্রাম্য পথ ধরে পার্বত্য ঘনাপুরার দিকে চললাম। এই ঘনাপুরার উলটোদিকেই হল কালীকুঁয়ার বন। দুর্ধর্ষ সব ডাকাতের আস্তানা যেখানে।
আমি যে সময়কার কথা বলছি তখন এইখানকার বনভূমি যে কী নিবিড় ছিল তা এখনকার মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। যেমন গভীর অরণ্য, তেমনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। গাছের ডালে ডালে যেমন ময়ূরের বাহার ছিল, তেমনই ছিল বানরের উপদ্রব।
যাই হোক, একসময় আমরা ছোটুর সঙ্গে ঘনাপুরায় এসে পৌঁছলাম। এইখানে ইংরেজ আমলের পরিত্যক্ত একটি কুঠিবাড়ি ছিল। তারই একটি ঘরে আশ্রয় হল আমাদের। ঘরটা ধুলোয় ময়লায় ভরা। কিন্তু হলে কী হয়, মিষ্টি মেয়ে ছোট্ট নিমেষের মধ্যে ঘর ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দু’জনের জন্য দুটো নোয়ারের খাটিয়া এনে পেতে দিল। আমরা তার ওপর বেডশিট বিছিয়ে সেটাকে আমাদের শোওয়া-বসার উপযোগী করে নিলাম।
একটু পরেই লগনদেও এল। চাল ডাল তেল নুন আলু আর আণ্ডা নিয়ে। চালের সের তখন আট আনা। তেল আড়াই টাকা, আর এক টাকায় এক ডজন আণ্ডা। পাঁচ সিকে দেড় টাকায় একটা গোটা মুরগিও পাওয়া যেত। ভাবা যায়?
রান্নার জন্য কেরোসিন স্টোভের চল অতটা ছিল না তখন। ঘুঁটে কয়লার উনুনে অথবা উনুনের মতো করে ইট পাথর সাজিয়ে তাইতে কাঠ জ্বেলে রান্না করা হত।
আমরা লগনদেওকে বললাম, “সবেরই তো ব্যবস্থা হল, এখন রান্না করার জন্য একজন কাউকে ব্যবস্থা করে দাও।”
লগনদেও বলল, “কেন, ছোট্টুকে তো দিয়েছি। ও-ই সব ব্যবস্থা করে দেবে। সারাদিন ও আপনাদের কাছে কাছে থাকবে। শুধু রাত্রে চলে যাবে ওর মায়ের কাছে।”
লগনদেও এর পর ওর পরিচিতদের সঙ্গে একটু বাতচিত করে আমাদের দেখভাল-এর পরামর্শ দিয়ে চলে গেল শিউপুরার দিকে।
ছোট্টু আমাদের রান্নাবান্নার কাজে লেগে গেল। আর আমরা অল্প সময়ের মধ্যে ঘনাপুরাকে চষে ফেলে ওখানকার পরিষ্কার ইঁদারার জলে স্নানটান করে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য তৈরি হলাম।
কিশোরী ছোটুকে খুবই ভাল লেগে গেল আমাদের। গায়ের রং মাজা কালো। ভাসা ভাসা চোখ আর কী সুন্দর ওর মুখখানি। খুবই গরিবের মেয়ে। ওর বয়স যখন দু’ বছর তখন ওর বাবা কালীকুঁয়ার ডাকাতদের হাতে প্রাণ হারায়। এখন ওর বয়স চোদ্দো বছর। একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ নেই ওর। মা জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে সেই কাঠ বাজারে বিক্রি করে কোনওরকমে দিন চালায়। ছোটুর বিয়ের জন্যও কথাবার্তা চলছে শিউপুরার একটি ছেলের সঙ্গে, কিন্তু ছেেেলটির বাবা দু’ হাজার টাকা নগদ না পেলে এই বিয়েতে রাজি নয়।
যাই হোক, আমরা মধ্যাহ্নভোজন সেরে ট্রেন জার্নির ক্লান্তি দূর করতে তেড়ে একটা ঘুম দিলাম। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ছোট্টুকে ডেকে চা করতে বললাম। ও খুব আনন্দের সঙ্গেই আমাদের কাজ করতে লাগল। তার ওপর আমরা যে ক’দিন এখানে থাকব সেই ক’দিন আমাদের সঙ্গে ওকে খেতে বলায় ও আরও খুশি।
আমরা যখন কুঠিবাড়ির বাইরে বসে চা খাচ্ছি সেই সময় ছোট্টুর মা এল। ওর মাকে আরও সুন্দর দেখতে। মা এসে বলল, “লগনদেও তোমাদের এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। শিউপুরাতে একটি ঘরও খালি নেই।”
বুঝতে পারছি না।” আমার একটু ভূতের ভয় আছে। তাই বললাম, “কেন, রাত্রিবেলা খারাপ কিছু হয় নাকি এখানে?”
“কিন্তু এই বাড়িতে তোমরা কেমন করে থাকবে আমি তো কিছু
“কী যে হয় আর কী হয় না, তা আমরাও জানি না। তবে এই কুঠিবাড়িতে এর আগেও যারা এসেছিল তারা কেউ এক রাতের বেশি থাকতে পারেনি। সাহেব আমলের পুরনো বাড়ি৷ কত নাচ-গান, হইহল্লা, আমোদ-ফুর্তি, কত খুনখারাপি হয়েছে এখানে, তার ঠিক নেই।”
অজয় বলল, “তাতে কী? এই বন পাহাড়ের দেশে এমন একটা আশ্রয় যখন পেয়েছি তখন কোনও কিছুরই ভয়ে এখান থেকে আমরা যাচ্ছি না।”
অজয় বলল বটে, আমার কিন্তু ভয় কাটল না।
ছোটুর মা আমাদের রাতের খাবারের জন্য কয়েকটা রুটি ও ডাল তৈরি করে দিয়ে বিদায় নিল। আমরা ছোটুর জন্য ডাল রুটি দিয়ে দিলাম ওর মাকে। তারপর পাহাড় জঙ্গলের দেশে বনভূমির ফাঁক-ফোকরে যতটুকু যাওয়া যায় গিয়ে ফিরে এলাম।
সন্ধে হতেই ছোট্টুর মা একটা লণ্ঠন নিয়ে এসে রেখে গেল আমাদের জন্য। তারই আলোয় দু’জনে দুটো গল্পের বই নিয়ে পড়তে লাগলাম। কিন্তু রাতের কুঠিবাড়ি যে কখন কী চেহারা নেবে তাই কল্পনা করেই শিউরে উঠতে লাগলাম আমি। বেশিক্ষণ বইয়ে মনোনিবেশ করতে পারলাম না। বই মুড়ে রেখে অকারণেই পায়চারি করতে লাগলাম ঘরময়। কিন্তু আশ্চর্য! অজয়ের কোনও ভাবান্তর নেই।
একসময় ও-ই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হল তোর? ভয় করছে?” “তা একটু করছে বইকী! এইরকম একটা বাড়িতে রাত্রিবাস করা রীতিমতো ভয়ের ব্যাপার।”
“ভয়ের তো একটা কারণ থাকবে?”
“সেই কারণটা যখন ঘটবে তখনই টের পাবি। প্রথমে আলো নিভবে। তারপর খাটিয়া দুটো এদিক-ওদিক করবে। পরে বন্ধ দরজার খিল আপনা থেকেই খুলে যাবে। নয়তো হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও দরজা-জানলার কিছুই আমরা খুলতে পারব না। অর্থাৎ ছকে বাঁধা নিয়মগুলো এক-এক করেই হতে থাকবে সব।”
অজয় বলল, “কোনও কিছুই হবে না। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়, তেড়ে একটা ঘুম দে, দেখবি সকাল হয়ে গেছে।”
ওর কথামতো তাই করলাম। কিন্তু করলে কী হবে, দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ার ফলে আর মনের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক দানা বেঁধে থাকায় ঘুম কিছুতেই এল না। হঠাৎই দরজায় টক টক শব্দ।
ভয়ে বুক আমার শুকিয়ে যেতে লাগল। এই বুঝি আরম্ভ হল ভূতের উপদ্রব। আমার ভয় দেখে অজয়ই উঠে গিয়ে দরজা খুলল।
ছোটুর মা সামনে দাঁড়িয়ে। বলল, “তোমাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
অজয় বলল, “না, না।”
“তোমরা দু’জনে ইচ্ছে করলে আমার ঘরে গিয়ে থাকতে পারো। আমরা মা-মেয়েয় আলাদা ঘরে শোবো, তোমরা দু’জনে একসঙ্গে থাকবে।”
অজয় বলল, “কোনও দরকার নেই। বেশ আছি আমরা। এই রাতদুপুরে এই ঘর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।”
আমি ততক্ষণে বেডশিট গুটিয়ে উঠে পড়েছি। বললাম, “ও না যায় না যাবে। আমি যাব। আমার ভয় করছে খুব।”
অজয় বলল, “কাপুরুষ কোথাকার! যা তবে বেরিয়ে যা। আমি একাই থাকব এই ঘরে। আমার কোনও ভয়ডর নেই।”
আমি আমার টর্চটি হাতে করে ব্যাগ, বেডশিট যা ছিল সব নিয়ে ছোটুর মায়ের সঙ্গে ওদের ঘরে চলে এলাম। গরিব মানুষের মাটির ঘর। দুটো ঘর পাশাপাশি। একটিতে আবর্জনা ভর্তি। অপরটি বসবাসের। তাইতেই একটি খাটিয়ায় পুরু করে কাঁথা পেতে বিছানা করা আছে। আর একটি শয্যা প্রস্তুত আছে ঘরের মেঝেয়। আমাদের দু’জনের জন্যই এই ব্যবস্থা। ওরা মা-মেয়েতে পাশের ঘরে সেই আবর্জনার পাশেই একটু জায়গা করে নিয়ে শুতে গেল। আমি রইলাম এই ঘরে।
ছোটুর মা বারবার বলল, “কী জেদি বাঙালি বাচ্ছা রে বাবা। একদম ভয়ডর নেই। এত করে বললাম তবু শুনল না। মা জগদম্বা সবার ভাল করুন। ওর যেন কোনও বিপদ না হয়।” একা ঘরে ছোট্ট একটি চিমনি জ্বেলে শুয়ে রইলাম চুপচাপ। সে আলোয় অন্ধকারের কোনও ক্ষতিই হল না। না হোক, এখানে শুয়ে থাকলে আর যাই হোক ভূতের হাতে প্রাণ তো দিতে হবে না।
শুয়ে রইলাম। কিন্তু ঘুম এল না। হঠাৎই আমার কানে এল বিশ্রী ধরনের একরকম গানবাজনার শব্দ। মনে হল কারা যেন হইহল্লা করছে, নাচছে আর দারুণ সব বেলেল্লাপনার গান গাইছে। এসব যে কোথা থেকে ভেসে আসছে তা বুঝতে আর বাকি রইল না। আমি টর্চের আলোয় ঘরের দরজা খুলে উঁকি মেরেই দেখি দূরের সেই কুঠিবাড়ি যেন রাতের অন্ধকারে প্রাণ পেয়ে জেগে উঠেছে। ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে। বেলজিয়াম কাচের ভেতর দিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে সেই আলো।
এই মুহূর্তে কেমন যেন এক অলৌকিক প্রভাবে আমার মনের ভেতর থেকে সমস্ত ভয় দূর হয়ে গেল। নিজেকে এবার সত্যিই কাপুরুষ বলে মনে হল আমার। অজয়কে ওইভাবে কুঠিবাড়িতে একা ফেলে রেখে এইভাবে চলে আসাটা কোনওমতেই উচিত হয়নি আমার। তাই এখনই ওকে ওইসব উপদ্রবের হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন মনে করে জুতোটা পায়ে গলিয়ে নামতে যাচ্ছি অমনই ছোট্টু এসে হাত ধরল আমার, “কাঁহা যা রহে তুম?” বললাম, “কুঠিবাড়িতে।”
“মাত যাও। ওখানে গেলেই তোমার বিপদ হবে।”
ততক্ষণে ছোটুর মা-ও উঠে এসেছে, “কী হল রে ছোটু?” তারপর আমাকে দেখেই বলল, “এত রাতে কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
আমি কুঠিবাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, “আমার বন্ধুর কাছে। তোমরাও এসো আমার সঙ্গে। চেঁচিয়ে গ্রামের আর সব লে কদের ডাকো।”
ছোটুর মা বলল, “কেন মিছিমিছি পরিশান হতে যাচ্ছ? ওই সাহেব ভূতেরা ওইরকমই। হঠাৎ করে ওই কুঠিবাড়িতে কোনও মেহমান এলে ওদের খুব আনন্দ হয় এবং তখনই ওইসব আরম্ভ করে। সারারাত এই গানবাজনা চলবে ওদের। এই সময় কেউ বাধা দিলে ভীষণ রেগে যায় ওরা। আর গ্রামের লোকেদের কথা বলছ? হাজার ডাকাডাকি করলেও কেউ আসবে না। জেনেশুনে কেউ যাবে না ওখানে।”
আমি বললাম, “এইরকমই যখন ব্যাপার, তখন আগেভাগে আমাদের সতর্ক না করে ওই কুঠিবাড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়াটা কোনওমতেই উচিত হয়নি লগনদেওয়ের। কাল সকালে ও আসুক, তারপর যা বলবার বলব ওকে।”
“বলাই উচিত। গত দু’ বছরের মধ্যে কেউ রাত কাটায়নি ওই বাড়িতে। সেইজন্যই ও মওকা বুঝে তোমাদের ওই বাড়িতে ঢুকিয়ে পরখ করে দেখতে চেয়েছিল উপদ্রবটা আগের মতোই হয় কিনা। অথচ মজার ব্যাপার, দিনের বেলায় আমরা ওই বাড়িতে ঢুকি বেরোই কিন্তু কারও কিছু হয় না। শুধু রাত্রিবাস করতে গেলেই যা বিপত্তি।”
কুঠিবাড়ির বেলেল্লাপনা তখন চরমে উঠেছে। নাচগানের সঙ্গে চলেছে ‘হ্যাঃ হ্যাঃ’ করে সে কী বিকট হাসি!
আমি সব ভয়কে জয় করে সাহসে বুক বেঁধে হনহন করে এগিয়ে চললাম কুঠিবাড়ির দিকে। ওরা মা-মেয়েতে অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগল আমার চলে যাওয়া।
কুঠিবাড়ির সামনে এসে একবার থমকে দাঁড়ালাম আমি। তারপর এগিয়ে গিয়ে দুম দুম করে দুটো লাথি মারলাম দরজায়। সঙ্গে সঙ্গে গানবাজনা থেমে গেল। আলোও নিভে গেল ঘরের।
আর কী হল?
দরজাটা দু’ হাট হয়ে খুলে গেল। আমার সামনে এসে দাঁড়াল কুকুরমুখো এক ফিরিঙ্গি সাহেব। যেমন বিচ্ছিরি তার চেহারা, তেমনই সাজপোশাক। ক্রুদ্ধ সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, “হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?”
আমি তখন ভীষণ রেগেছি। বললাম, “আই ওয়ান্ট টু ষষ্ঠীপুজো তোদের বাপের।” “স্পিক ইংলিশ, ব্লাডি নেটিভ।”
“শাট-আপ। অসভ্য ট্যাঁশ ফিরিঙ্গির দল। তোদের বাপ-ঠাকুর্দা যে যেখানে আছে সবার নাম-ঠিকানা একটা কাগজে লিখে এখনই আমাকে দে। ফেরার পথে তোদের সবাইকে গয়ায় নেমে একটা করে পিণ্ডি দিয়ে তবেই আমি বাড়ি যাব।”
সাহেব আমার কথার মানে কী বুঝল কে জানে? অন্ধকারে আরও অনেকগুলো ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের কাছ থেকে একটা কাগজ চেয়ে খসখস করে কতকগুলো নাম লিখে আমার হাতে দিয়ে বলল, “গেট আউট।”
আমি বললাম, “যাব তো বটেই। নাহলে এই রাতদুপুরে এখানে বসে কি তোদের কেত্তন শুনব? তবে যাওয়ার আগে তোদের হাল কী করি দ্যাখ।” বলেই সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা অজয়ের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে আনলাম ওকে। তারপর ঘরের মধ্যে যে লণ্ঠনটা ছিল সেটা খাটিয়ার ওপর কাত করে খানিকটা তেল ঢেলেই শিখা দিয়ে ধরিয়ে দিলাম আগুনটা। শুধু খাটিয়ায় নয়, সেই আগুন ছড়িয়ে দিলাম আশপাশেও।
সঙ্গে সঙ্গে ভেলকির খেলা। ইংরেজিতে অশ্রাব্য গালাগালি দিতে দিতে ছায়ামূর্তিগুলো জানলা দরজা গলে যে যেদিক দিয়ে পারল পালাল।
লেলিহান অগ্নিশিখায় কুঠিবাড়ি পুড়ে ছাই। আমিও অজয়কে নিয়ে ছোট্রুদের বাড়িতে এসে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে ঘোর কাটালাম ওর।
একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে ও বলল, আমি চলে আসার পর কখন যে কী হয়েছিল তা ওর মনে
নেই। তবে ওদের দলে ভিড়ে এবং উৎসাহ পেয়ে ও শুধু নেচেই চলেছিল, নেচেই চলেছিল। পরদিনই আমরা কুঠিবাড়ির সর্বনাশ দেখে ঘনাপুরা ত্যাগ করেছিলাম। লগনদেও কারও মুখে খবর পেয়েই সম্ভবত ভয়ে দেখা করেনি আমাদের সঙ্গে। তবে কিনা ফেরার পথে গয়ায় পিণ্ডি দিতে গিয়ে এক অন্য অভিজ্ঞতা হল। পাণ্ডারা বলল, “আমরা গুণ্ডাগর্দি করি, মানুষ খুন করি, জ্যান্ত মানুষেরও পিণ্ডি চটকাই। কিন্তু সাহেব ভূতের পিণ্ডির মন্ত্র আমাদের কারও জানা নেই। তবে কিনা আমাদের যেমন গয়া তেমনই ওদের হয়তো গোয়া। তা আপনারা একবার গোয়ায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে পারেন।”
আমাদের বয়েই গেছে গোয়ায় যেতে। তাই গয়া থেকে বুদ্ধগয়া দেখে দু’-একদিনের মধ্যেই আমরা বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।