চাঁপাডাঙার বাঁধ
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা।
সেকালে হুগলি জেলার চাঁপাডাঙায় দামোদর নদের বাঁধের ওপর দিয়ে সন্ধের পর চলাফেরা করবে অমন বুকের পাটা কারও ছিল না। কেননা ওইসব অঞ্চলের আশপাশের গ্রামগুলোতে তখন লোকবসতিও যেমন কম ছিল তেমনই ছিল ঠ্যাঙাড়ে ও ডাকাতের উপদ্রব।
তা একবার হল কি, তালপুকুর গ্রামের বিধুভূষণ নামে একটি ছেলে বাড়িতে বাবার অসুখের খবর পেয়ে কলকাতা থেকে চাঁপাডাঙায় এল। হাওড়া চাঁপাডাঙা লাইনে মার্টিন রেলের তখন সুবর্ণযুগ। তা সে যাই হোক, বিধুভূষণ যখন এল তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সঙ্গে ঘড়ি আংটি টাকাপয়সা সবকিছুই ছিল তার। চাঁপাডাঙা থেকে ওদের গ্রাম তালপুকুর হচ্ছে তিন-চার মাইলের পথ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই পথ সে পাড়ি দেবে কেমন করে?
গ্রামের ছেলের কাছে ওই পথ এমন কিছু নয়। তার ওপর সঙ্গে টর্চও আছে। কিন্তু এই পথ পাড়ি দিতে সে ডাকাতের পাল্লায় পড়বে না তাই-বা কে বলতে পারে? অথচ বাড়ির এত কাছাকাছি এসে স্টেশনে পড়ে থাকতেই কি মন চায় কারও?
অবশেষে অনেক ভাবনাচিন্তার পর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে মনে করে ভগবানের স্মরণ নিয়ে বাঁধের পথ ধরল বিধুভূষণ।
বেশ আসছে, বেশ আসছে, এইভাবে বেশ কিছুটা পথ আসার পরই ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল তার।
বিধুভূষণ দেখল, একজন লোক লণ্ঠন হাতে ওকে পথ দেখিয়ে ওর আগে আগে চলেছে। সে কী নিকষ অন্ধকার।
শুধু কয়েক মুঠো জোনাকির আলো আর ওই লণ্ঠনের আলোটি ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। ওর হাতে টর্চ থাকলেও সেই টর্চের আলো জ্বলছে না। অথচ দেশে আসবার আগে নতুন ব্যাটারি ভরে নিয়েছে। সেই ঘন অন্ধকারে লোকটির সারা শরীর ঢাকা। শুধুমাত্র লম্বা লম্বা পা দুটি ছাড়া তার শরীরের কোনও অংশই দেখা যাচ্ছে না।
বিধুভূষণের এবার ভয় করল খুব। তাই সে চলার গতি মন্থর করে একসময় চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
চলমান পা দুটোও থমকে দাঁড়াল।
অন্ধকারের ভেতর থেকেই একটা কেমন যেন খ্যানখেনে গলার স্বর ভেসে এল, “আয় না রে! আয়।”
বিধুভূষণ বুঝতে পারল এই অন্ধকারে যাদের ভয় সে করেছে এ তারা নয়। বরং যাদের কথা বারেকের তরেও মনের মধ্যে উঁকি দেয়নি সেই ভূতের পাল্লাতেই পড়েছে সে।
ওর শিরদাঁড়া বেয়ে একটি হিমস্রোত নেমে এল।
বিধুভূষণ বলল, “কে তুমি! আমার সঙ্গ নিয়েছ কেন? আমার খুব ভয় করছে তোমাকে।” অন্ধকারে কে যেন হেসে উঠল খিলখিল করে। সে কী হাসি! যেন সর্দি বসা ঘড়ঘড়ে গলা। বলল, “ভয় নেই রে। আয় আমার সঙ্গে।”
বিধুভূষণ সম্মোহিতের মতো আবার চলতে লাগল তার পিছু পিছু।
বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর দেখল অন্ধকারে রাস্তার মাঝখানে কয়েকটা ছায়াশরীর পথ আগলে বসে আছে। তাদের চোখের ভেতর থেকে লাল-নীল টুনির মতো আলো জ্বলছে। তারা বলল, “এই অসময়ে এখান দিয়ে কে যায়?” উত্তর হল, “ওকে যেতে দে।”
“কাল সকাল হতে তর সইল না? এখন আমাদের রাজত্বে এই অন্ধকারে ও কেন এল ওকে জিজ্ঞেস কর।”
“ওর বাবার খুব অসুখ রে। সেই শুনে ও দেখতে এসেছে। ওর দোষ নেই।” বিধুভূষণের গায়ে কাঁটা দিল। ওর বাবার অসুখের কথা ও কী করে জানল?
সেই ছায়াশরীরগুলো বিশ্রী গলায় হেসে উঠল এবার, “ওর বাবার অসুখ তো তোর কী? তুই ওর কে?”
বলার সঙ্গে-সঙ্গেই সেই লণ্ঠনধারীর মুখ থেকে আগুনের একটা হলকা ছুটে গেল ছায়াশরীরগুলোর দিকে।
ব্যস। চোখের পলকে সব উধাও।
আবার নিঃশব্দে পথচলা।
যেতে যেতে হঠাৎই একসময় দেখতে পেল মশাল হাতে ভয়ঙ্কর চেহারার কিছু লোক বনজঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বাঁধের পথ ধরে এগিয়ে আসছে। যারা আসছে তাদের শরীর আছে। আর কী ভীষণ চেহারা তাদের! বিধুভূষণ বুঝতে পারল আজ আর নিস্তার নেই তার। কালীচরণের পাল্লায় পড়ছে সে। ওরই দলবল এসে আক্রমণ করবে এবার। ভয়ঙ্কর ডাকাত কালীচরণ। যার প্রাণে কোনও মায়ামমতা নেই।
দলের পুরোভাগেই তখন কালীচরণ ছিল। গম্ভীর গলায় হাঁক দিল, “কে ও? কে আসে?”
লণ্ঠনধারী তখন উধাও।
বিধুভূষণ বলল, “আমি তালপুকুর গ্রামের ছেলে। আমার বাবার অসুখের খবর পেয়ে আসছি। আমাকে যেতে দাও কালীচরণ।”
কালীচরণ বিকটভাবে হেসে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল আশপাশ থেকে পৈশাচিক কণ্ঠস্বরে সে কী হাসি! সে এমন হাসি যে, হাসি আর থামতেই চায় না।
“কে হাসে? কারা হাসে? কে?” ধমকে উঠল কালীচরণ।
হাসিও থেমে গেল।
কালীচরণ বলল, “ওরে দুগ্ধপোষ্য বালক, নিয়তির ডাক না পেলে এই দামোদরের বাঁধে রাতদুপুরে কেউ আসে না। তোর মরণ যে ঘনিয়েছে বাবা।”
অমনি ফ্যাঁসফেঁসে গলায় অন্ধকার থেকে কারা যেন বলে উঠল, “তোর মরণ যে ঘনিয়েছে বাবা, তোর মরণ যে ঘনিয়েছে, তোর মরণ যে—।”
গর্জে উঠল কালীচরণ, “কে! কে বলে এই কথা? কে?”
আবার সব চুপ।
বিধুভূষণ এবার মিনতি করে বলল, “শোনো কালীচরণ! আমার সঙ্গে যা কিছু আছে সবই তোমাকে দিয়ে দেব। শুধু দয়া করে আমাকে প্রাণে মেরো না। একবার অন্তত ঘরে যেতে দাও। বাবা আমার মৃত্যুশয্যায়, তাঁকে একবার শেষ দেখাটা দেখতে চাই।”
কালীচরণ আবার হাসল। বলল, “ওরে সাপের লেখা আর বাঘের দেখা, জানিস তো? আমি সেই বাঘ। ডাক তোর বাবাকে। ডাক তোর ভগবানকে। আমার নাম কালীচরণ।’ বলেই বল্লমটা উঁচিয়ে সজোরে ছুড়ে দিল বিধুভূষণের দিকে।
বল্লমটা বিধুভূষণের বুকে লেগেই ভেঙে দু’ টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ঠং করে একটা শব্দ হল শুধু।
বিধুভূষণ তখন লোহার মতো কঠিন হয়ে গেছে। ওর দু’ চোখে ক্রোধের আগুন। সে রেগে বলল, “তবে রে শয়তান! এবারে আমার খেলাটা দেখ।” বলেই সে বজ্রবাহু নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কালীচরণের দিকে।
বিধুভূষণের সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে লাঠি বল্লম ফেলে ওর দলের লোকেরা যে যেখানে ছিল পালাল। পারল না শুধু পালিয়ে যেতে কালীচরণ।
বিধুভূষণ তখন রোবটের মতো হয়ে গেছে। সে দু’ হাতে কালীচরণকে ধরে তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে ধড়ের ওপর মুণ্ডুটা পাকিয়ে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলল।
অন্ধকারের ভেতর থেকে কারা যেন বলে উঠল, “সাব্বাশ। সাব্বাশ বিধুভূষণ।”
বিধুভূষণ সেইরকম লৌহকঠিন অবস্থাতেই গ্রামের কাছাকাছি চলে এল। এই চেহারা নিয়ে কী করে ঘরে যাবে সে? ওর বাড়ির লোকেরা এই অবস্থায় ওকে দেখলে চিনতে পারবে কী? এইসব চিন্তা করতে করতেই গা মাথা ঝিমঝিম করে উঠল তার। দাঁড়িয়ে থাকতেই-থাকতেই হঠাৎ সেইখানে মাথা ঘুরে পড়ে গেল বিধুভূষণ।
পরদিন সকালে গ্রামের লোকজন এসে উদ্ধার করল ওকে। ঘরে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতেই জ্ঞান ফিরল ওর। বাবা ঠাকুরের কৃপায় ভালই আছেন। আর বিধুভূষণও যেমন ছিল তেমনই আছে। ওর শরীরে কোথাও কোনও বিকৃতি নেই। তবে কিনা দুর্ধর্ষ কালীচরণ কাল রাতে কোনও দুষ্টচত্রে হাতে প্রাণ হারিয়েছে। পুলিশ এসে ডেডবডিও নিয়ে গেছে তার।
গতরাতের ওই অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা বিধুভূষণ তখনকার মতো কারও কাছে বলল না। এমনকী বাড়ির লোকেদের কাছেও নয়। বলা যায় না, কী থেকে কী হয় ! সকলকে ভূতের গল্প শোনাতে গিয়ে শেষকালে খুনের দায়ে ধরা পড়বে কী? তবে সেই থেকে বিধুভূষণ আর কখনও ভুলেও রাত্রিবেলা ওই পথে আসেনি।